0

প্রবন্ধ - বিবি বসু

Posted in


প্রবন্ধ


মোরা শিক্ষা বলি কাকে!
বিবি বসু


প্রবন্ধ লেখা যথেষ্ট কঠিন কাজ। আর কঠিন কাজে অনীহা কিছু নতুন নয়। যা বলছি তা কতকগুলো টুকরো ভাবনা বই কিছু নয়।আচ্ছা ধান ভানতে শিবের গীত না গেয়ে প্রসঙ্গে আসি সরাসরি। কয়েকটা আলগা ভাবনা আপনাদের সাথে ভাগাভাগি করে নিই নাহয়। বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে যা দেখছেন, তাই নিয়ে ভাবছেন কিছু? বিপুল কর্মযজ্ঞ চলেছে---নাম সর্ব শিক্ষা মিশন।উদ্দেশ্য ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত কোন শিশুকে শিক্ষাক্ষেত্রের বাইরে না রাখা।উদ্দেশ্য আংশিক সফল নি:সন্দেহে। নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে কটা কথা বলি।বর্তমানে স্কুল শিক্ষার ক্ষেত্রে পাশ ফেল প্রথা অবলুপ্ত হবার কারণে স্বভাবতই অনেক মানুষ অনেক কথা বলছেন।বিষয়টির বিরোধিতা করছেন। শিক্ষার মানের অবনমন ঘটছে এতে---একথা তারা সোচ্চারে বলেন। তাদের প্রশ্নের উত্তর পরে দিচ্ছি। এখন দেখি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পাশ ফেল না থাকায় পড়ুয়ারা কতটা উপকৃত। প্রথমত: পাশ ফেল প্রথা উঠে যাবার ফলে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে স্কুলছুট হবার প্রবণতা অনেক কমেছে। দ্বিতীয়ত: শিশুশ্রমের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে এই প্রথা।প্রশ্ন উঠবে কিভাবে। দাঁড়ান গুছিয়ে বলার চেষ্টা করছি। আজকাল বাড়িতে কাজের লোক পান? রাতদিনের লোক? আমাদের ছোটবেলায় দেখা পুতুলের মা, বাদলের মা প্রায় লুপ্তপ্রায় প্রজাতি। ভেবে দেখেছেন কেন? কারণ তাদের আর গ্রামের বাইরে বেরিয়ে শহরে এসে গৃহস্থ বাড়িতে রাতদিনের কাজ করতে হচ্ছেনা। তারা ১০০ দিনের কাজ পাচ্ছেন। স্বামী স্ত্রী উভয়েই কাজে বেরিয়ে যাচ্ছেন। বাড়ির ছেলেটি বা মেয়েটি থাকবে কোথায়। সর্বজনের জন্য শিক্ষার দ্বার খুলে গিয়ে কিন্তু এই সমস্যার সমাধান হয়েছে খানিক। শিশুকে তাই বই, খাতা, স্কুলের ব্যাগ, জুতো, দুপুরের খাওয়া দাওয়া তফসিলি জাতিভুক্ত ছাত্র ছাত্রীদের আর্থিক অনুদান দিয়ে বিদ্যালয়ে রাখা হচ্ছে। এই বিদ্যালয়ের চৌহদ্দির মধ্যে শিশু সবচেয়ে নিরাপদ। আর পড়াশোনা? মুখ টিপে হাসছেন? হ্যাঁ, স্বীকার করছি এখনকার সরকারি স্কুলের এবং সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলের ছেলেমেয়েরা আপনার মতন ক্লাস সেভেনে 'শ্রীকান্ত'র চারটে খণ্ডই পড়ে ফেলেনি। তারা প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। তবু স্কুলে নিত্য যাওয়া আসা চলার ফলে যতটুকু ইনপুটই। পাক না কেন, তা ফেলনা নয়।বিদ্যালয়ে তাকে উচ্চৈঃস্বরে বলা অশ্রাব্য ভাষা শুনতে হয়না। সে এক অন্য জগতের সন্ধান পায় যা থেকে তার আগের প্রজন্ম বঞ্চিত ছিল।ভবিষ্যতে এইসব শোনা কথার স্মৃতি ফিকে হলেও, কিছু অবশিষ্টাংশ মাথার কোন কোণ থেকে ঘাই মারবে। তার সন্তানকে সে চাইবে আলোর পথে ঠেলতে। এইটুকু প্রাপ্তিই বা কম কি! তর্ক উঠবে এবার। ক্লাস এইটে কারোর জীবন শেষ হয়ে যায়না। এই সরকারি নো ডিটেনশন রীতির ফলে যে সকল ছেলেমেয়ের পড়াশুনোর ভিত ঝুরঝুরে রয়ে গেল,তারা ক্লাস নাইনে অবধারিত ফেল করবে।তখন কি হবে। এক বছর, দুবছর, তিনবছর সুযোগ নাহয় দেয়া গেল কিন্ত তাতেওতো যার হবার নয় তার হবেনা।মধ্যিখান থেকে আত্মবিশ্বাসে ভয়ানক চিড় ধরবে। নিজেকে নিয়ে লজ্জা বাড়বে। তখন? এক্ষেত্রে সমাধান একটাই। না সেটা এখনো ভারতে করা সম্ভব হয়নি।তবে আমরা যদি সবাই মিলে বিভিন্ন জায়গায় বারবার বলে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি, তাহলে ভারত ভাগ্যবিধাতারা কোন একদিন সাড়া দিয়ে ফেলতেও পারেন সেই চেষ্টাটাই করা যাক। শিক্ষক শিক্ষিকারা যে ছাত্র বা ছাত্রীকে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ালেন, তাদের ওপর একটু ভরসা করেই দেখুন না সরকার বাহাদুর। ক্লাস এইটের পর শিক্ষকদের বেছে দিতে হবে কারা জেনারেল স্ট্রিমে পড়বে আর কারা কারিগরি শিক্ষায় যাবে।সেইমতো ইস্কুলে ইস্কুলে যদি ভোকেশনাল ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা হয় এবং ট্রেনিং শেষে পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের রীতিমতন যাচাই করে যদি সরকারি সার্টিফিকেট দেওয়া যায়,তাহলে সামগ্রিক চিত্রটাই কিন্তু পালটে যাবে। এবার প্রশ্ন হ'ল ভোকেশনাল ট্রেনিং হ'ল, সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া সার্টিফিকেটও এল কিন্তু কর্মসংস্থানের উপায় কি? প্রশিক্ষিত মানুষজন নিয়ে চলতে গেলে আন-অর্গানাইজড সেক্টরের চলবে কিভাবে? সরকার নির্ধারিত মূল্য দিয়ে যে তাদের শ্রমের মূল্য চোকাতে হবে। ছোট ব্যবসায়ীর নাভিশ্বাস উঠে যাবে।তাহলে উপায়? কোনমতে বি.এ পাশ বেকারদের মতনই কি এই সব প্রশিক্ষিত ছাত্রছাত্রীর জীবন কাটবে? তাহলে এত ঘটা ন্যাটা করে ট্রেনিং--এর প্রয়োজনটা কি ছিল? সরকারি ক্ষেত্রে নাহয় নিয়ম করা গেল সরকারি তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষিত ব্যক্তি ছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে(কারিগরি বিদ্যার প্রয়োগমূলক ক্ষেত্রগুলোতে) নিয়োগ করা যাবেনা। কিন্তু পাড়ার হরবিলাস কাকার কাছে হাতেকলমে কাজ শেখা বাপনকে দিয়ে বছরভর চলতে থাকা মেলা, খেলা, রক্তদান শিবির, সাইকেল বিতরণ উৎসব, রবীন্দ্রজয়ন্তী ইত্যাদি প্রভৃতির জন্য ইলেক্ট্রিকের কাজ আর করানো যাবেনা। প্রত্যেকটি পঞ্চায়েত এবং মিউনিসিপালিটির অধীনে থাকবে এইসব প্রশিক্ষিত কারিগরদের নিয়ে গড়া এসোসিয়েশন। এলাকার প্রশিক্ষিত কারিগরদের নাম এখানে নথিভুক্ত থাকবে। বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষকে যোগাযোগ করতে হবে এলাকার পঞ্চায়েত বা মিউনিসিপ্যালিটির সাথে। সেখান থেকে কাজ করার মানুষ পাওয়া যাবে এবং কাজ শেষে নির্দিষ্ট মূল্য অফিসে এসে রসিদের বিনিময়ে মেটাতে হবে। মানুষজনকেও আর প্লাম্বার, ইলেক্ট্রিশিয়ান, কার্পেন্টার, বিউটিশিয়ান, ড্রাইভারদের জন্য হাঁ করে দিনের পর দিন বসে থাকতে হবেনা আর রাস্তায় যার সাথে দেখা হবে তাকে বলতে হবেনা, 'ভাই আমার টয়লেটের সিস্টার্ন কাজ করছেনা,কাজ জানা কাউকে পাঠাতে পারেন?' আর ভোকেশনাল ট্রেনিংপ্রাপ্ত কেউ স্বাধীন ব্যবসা করতে চাইলে উপযুক্ত মূলধনের যোগান সে কোথা থেকে কিভাবে পাবে, তাও পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রয়োজন নাহলে বিশাল জীবনসমুদ্রে কূলহীন ভাসতে হবে। যাক অনেক অলীক কথা বলে ফেললাম। তাও বলি এদেশে কিস্যু হবেনা যারা ভাবছেন, তারা কি তাদের ছোটবেলায় দেখেছিলেন বাড়ির বাসন মাজেন যে বাসন্তীদি তার মেয়ে ইউনিফর্ম পরে, দুটো বেণী বেঁধে পিঠে ব্যাগ নিয়ে,বিশ্ব বাংলার লোগো দেওয়া সাইকেল চালিয়ে ইস্কুলে যাচ্ছে? দেখেননি। এটা যখন কালের নিরিখে সম্ভব হয়েছে, বাকিটাও যে হবেনা এমন কথা বুক ঠুকে বলি কিভাবে? কোন গল্পকারকে এযুগের গল্পে লিখতে হবেনা----পরপর দুবছর ক্লাসে উঠতে না পারায়, অমুকের ইস্কুলে যাওয়া চিরতরে ঘুচে গেল।তাই না? চলুন আশা রাখি। এই বিপুল মানবসম্পদ একদিন ঠিকভাবে ব্যবহৃত হবে আর দেশটা ঝলমলে হাসি হাসবে। হিন্দু-মুসলিম, রামনবমী-মহরম জাতীয় ভাবনা ভাবার সময় থাকবে না  মানুষের। প্রত্যেকের হাতে কাজ ...আর তা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করাটাই যে মনুষ্যধর্ম, সেটা বুঝতে পারবেন আপামর ভারতবাসী।

0 comments: