1

প্রাচীনকথা - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in

প্রাচীনকথা


মহাভারতের নারী—হিড়িম্বা
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়



রামায়ণ-মহাভারতে উপেক্ষিতা নারীর সংখ্যা কম নয়। অনেকেই নানা গুণে গুণী হওয়া সত্ত্বেও নিতান্ত কাব্যের প্রয়োজনে দু/একবার সম্মুখে অবতীর্ণ হওয়া ছাড়া বিশেষ ভূমিকা তাঁদের নেই। সেইসব নারীদের গুণাবলীও তেমন করে স্বীকৃত হয় না কোথাও, এমনকি কাব্য রচয়িতার কাছেও। এই প্রবন্ধে তেমনই একজন নারীর কথা, যিনি উপেক্ষিতা তো বটেই, অনাদর, অপমানও কম জোটেনি তাঁর কপালে। তিনি হলেন মধ্যমপাণ্ডব ভার্যা, হিড়িম্বা। আজকের আলোচনা তাঁকে নিয়েই...... 

মেগাস্থিনিস তার ভারত বিবরণে ষোলটি মহাজনপদের কথা উল্লেখ করে গেছেন। সেগুলি হলো---কাশী, কোশল, অঙ্গ, মগধ, বৃজি, মল্ল, চেদি, বৎস, কুরু, পঞ্চাল, গান্ধার, শূরসেন, অশ্মক, মৎস, কাম্বোজ, অবন্তী। এই মহা জনপদগুলির অবস্থান ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে বৌদ্ধ ধর্মের কাছাকাছি সময়ে এবং মহাজনপদগুলির বিস্তার ছিল আফগানিস্তান থেকে গঙ্গার সমতলভূমি ধরে আরও দক্ষিণে ও পূর্বে বাংলা পর্য্যন্ত অর্থাৎ বর্তমান বাংলা ও দক্ষিণে বিন্ধ্য পর্বতমালা পর্য্যন্ত। জনপদ্গুলিতে অর্ধ-যাযাবর জনগোষ্ঠী থেকে শুরু করে কৃষিভিত্তিক সমাজের মানুষেরা বসবাস করতেন এবং রাজনৈতিক ভাবেও যথেষ্ট সংগঠিত ছিল। সুতরাং জনপদগুলিতে নিষাদস্তর থেকে আর্যস্তর পর্য্যন্ত মানুষেরা বসবাস করতে পারতেন বা করতেন। 

প্রসঙ্গটির উল্লেখ করতে হল মহাভারতের চরিতাবলী অণ্বেষণে। আরো স্পষ্ট ভাষায় বলা ভালো, মহাভারত রচয়িতার শ্লোকে উঠে এসেছে যেসব চরিত্র, তার সবগুলিই যে আর্যস্তরের এমন কথা বলা যায় না। উচ্চ রাজন্যবর্গের মানুষেরা সেখানে যেমন রয়েছেন নিজ মহিমা এবং গরিমার কারণে বা কল্যাণে, তেমনই স্থান করে নিয়েছেন জনগোষ্ঠী বা অরণ্যবাসীরাও। আমাদের আলোচ্য বিষয় তেমনই এক অরণ্যবাসী নারী, তিনি জনগোষ্ঠী সমাজের প্রতিভূ। ইনি হলেন ভীমের পত্নী হিড়িম্বা।

জনজাতি বা জনগোষ্ঠী সমাজ বলতে আমরা কি বুঝি? মানব বিবর্তনের ধারায় জনগোষ্ঠীগুলির অবস্থান এবং তাদের জীবনচর্চা অবশ্যই এক উল্লেখযোগ্য বিষয়। বৈদিক সাহিত্য ও প্রাচীন মহাকাব্যসহ প্রাচীন ও মধ্যযুগের তথ্য থেকে জনগোষ্ঠী সমাজের কথা জানা যায়। জনগোষ্ঠী সমাজের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্লেষণ করলে আমরা যা জানি তা এইরকম--- জনগোষ্ঠী সমাজের মানুষগুলি নিজস্ব জীবনধারণের ঐতিহ্য বহন করেন। তাঁদের একটি সুনির্দিষ্ট সাংষ্কৃ্তিক বিকাশ আছে অর্থাৎ ভাষা, আচার, ধর্মীয় বিশ্বাস ইত্যাদির প্রতি স্বতন্ত্রতা এবং নানাকারণে বর্তমানে বিশেষ ভৌগলিক অঞ্চলে বসবাস করলেও হাজার হাজার বৎসরের প্রাচীন জনগোষ্ঠী বা আদিম সমাজের মানুষগুলি যে একস্থানে অবস্থান করতেন না, সেকথা বলাই বাহুল্য। তাঁরা যাযাবরবৃত্তি অবলম্বন করতেন। যাযাবর বৃত্তির কারণে জনগোষ্ঠীগুলির প্রকৃত অবস্থান সম্বন্ধে সঠিক তথ্য পাওয়া মুশকিল। Indian Museum থেকে প্রকাশিত ‘Tribes of Ancient India’ বইতে পাচ্ছি জনগোষ্ঠীগুলির অবস্থান ছিল কয়েকটি বিশেষ অঞ্চলে, এবং তার মধ্যে অবশ্য প্রয়োজনীয় ছিল একটি নদী। মনে রাখতে হবে, আমাদের আলোচ্য নারী হিড়িম্বা কে রাক্ষসী বা রক্ষঃকূলজাত বলা হয়েছে। ‘Tribes of Ancient India বইটিতে সরস্বতী নদী কেন্দ্রিক জনগোষ্ঠীগুলির অন্যতম একটি গোষ্ঠী হলো রাক্ষস। কারো মতে, যমুনা নদীর দক্ষিণে চেদি জনপদ। যমুনার দক্ষিণে বেত্রবতী বা বেতোয়া নদীর ধারে এর অবস্থান। হিড়িম্বা চেদি জনপদের একজন স্বনামধন্যা নারী। কেউ কেউ আবার হিড়িম্বাকে দাক্ষিণাত্যের এক জনগোষ্ঠী কিংবা আটবিক গোষ্ঠীর নারী বলে মনে করেন। সরস্বতী নদীর সভ্যতা কি মহাভারতের রাজত্বকালে বেত্রবতী নদী তীরস্থ চেদি রাজ্য পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল, নাকি যাযাবর বৃত্তির কারণে জনগোষ্ঠীটি একস্থান থেকে আর এক স্থানে চলে গিয়েছিলেন? সরস্বতী নদী তীরস্থ জনগোষ্ঠীটির চেদি রাজ্য এবং আরও দক্ষিণে গমন সেই ঘটনাই ইঙ্গিত করে।

স্বর্গীয় কালীপ্রসন্ন সিংহ মহাশয় অনূদিত মহাভারতকেই অনুসরণ করেছি এই রচনায়। সেখানে দেখছি জতুগৃহ দাহের পর পাণ্ডবেরা বারণাবত নগরী থেকে বেরিয়ে গঙ্গা পার হয়ে স্থলপথে ক্রমাগতঃ দক্ষিণ দিকে গমন করতে করতে এক মহারণ্যে প্রবেশ করেন এবং সেখানেই হিড়িম্বার প্রথম প্রবেশ। উত্তরভারতে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে গঙ্গা নদীর অববাহিকা। তার ক্রমাগতঃ দক্ষিণদিকের গভীর অরণ্যই চেদি রাজ্য ( শাশ্বত—দীপংকর লাহিড়ী), যে অরণ্যের গোষ্ঠীপতি কন্যা ছিলেন হিড়িম্বা, মহাভারতে যাঁকে বলা হয়েছে রাজকন্যা।

আগেই বলেছি, মেগাস্থিনিস যে জনপদগুলির উল্লেখ করেছিলেন, সেগুলির বিস্তার ছিল গঙ্গার সমতলভূমি ও আরও দক্ষিণ ও পূর্ব পর্য্যন্ত। আবার জনগোষ্ঠীগুলির স্বাভাবিক যাযাবর বৃত্তির কারণে এক স্থান থেকে আর একস্থানে ক্রমেই চলে যাওয়া, স্থান পরিবর্তন এসবও স্বাভাবিক মনে হয়। বিশেষতঃ, হিড়িম্বা ‘রাক্ষস’ জনগোষ্ঠীর একজন, যিনি অরণ্যবাসী। Risley তাঁর ‘Tribes and castes of India’ বইতে লিখছেন, ‘রক্ষ’ বাংলার একটি জনগোষ্ঠী। যাযাবর এই জনগোষ্ঠীটির ঘুরতে ঘুরতে বঙ্গদেশে এসে বসবাস ও ক্রমে এখানকার অধিবাসী হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়। মোটের উপর হিড়িম্বা যে জনজাতি গোষ্ঠীর একজন, এই সিদ্ধান্তে আমরা উপনীত হই।

মহাভারতে হিড়িম্বার প্রসঙ্গ উত্থাপন জতুগৃহ দাহের পর। জতুগৃহ দাহের ঘটনা মহাভারতের পাঠক-পাঠিকাদের অল্পবিস্তর সকলেরই মনে আছে। জতুগৃহ দাহের সময় যে পাঁচজন পুরুষ ও এক নারী অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন, মনে রাখতে হবে, তাঁরা সকলেই নিষাদস্তরের মানুষ এবং জনজাতি সম্প্রদায়ের। মহাভারতের যুগ থেকেই চলে এসেছে এই মানুষগুলির প্রতি মিথ্যাচার ও অবহেলা। হিড়িম্বা ও ঘটোৎকোচও এক অর্থে তার শিকার বলা যায়। ভীম ও হিড়িম্বার কাহিনিটি সংক্ষেপে এইরকম---

জতুগৃহ দাহের পর পান্ডবেরা মাতা কুন্তীকে নিয়ে গঙ্গার তীর ধরে আরো দক্ষিণে চলতে চলতে এক গভীর অরণ্যসংকুল স্থানে এসে উপস্থিত হন। সেই অরণ্যসংকুল স্থানটি (সম্ভতঃ মহাভারতের সময় তা ছিল চেদি রাজ্য) সেই সময় ছিল হিড়িম্ব নামক এক রাক্ষসের তত্ত্বাবধানে। নিজ রাজ্যে আগন্তুকদের আগমনের সংবাদ পেয়ে গোষ্ঠীপতি (বা গোষ্ঠীপতি পুত্র) হিড়িম্ব তার ভগ্নী হিড়িম্বাকে আদেশ দেন ভয় প্রদর্শন করে আগন্তুকদের ঐ স্থান থেকে বিতাড়িত করতে। মহাবাহু, সিংহস্কন্ধ, কমলনয়ন, সুরূপ ও যুবা (এইভাবেই ভীমের রূপ বর্ণিত হয়েছে এস্থলে) ভীমকে দেখে এবং তাঁর পৌরুষের মুগ্ধ হয়ে হিড়িম্বা ভীমের প্রতি অনুরক্ত হন এবং ভীমের স্ত্রী হবার বাসনা প্রকাশ করেন। ভীমের প্রতি এই অনুরাগ হিড়িম্বা পান্ডব ভ্রাতা ও মাতা কুন্তীর নিকটেও গোপন করেন না, ভীমকে বিবাহ করার বাসনা প্রকাশ করেন। ভীম তাঁকে বিবাহ করলে প্রয়োজনে হিড়িম্বের হাত থেকে পাণ্ডবদের রক্ষা করার প্রতিশ্রুতিও দেন। ভীম হিড়িম্বার রূপে মুগ্ধ হলেও তাঁকে বিবাহ করতে অস্বীকার করেন এবং হিড়িম্বর সঙ্গে যুদ্ধ করাই মনস্থ করেন। ভীম ও হিড়িম্বর মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। ভীম হিড়িম্বকে হত্যা করলে হিড়িম্বাকেও হত্যা করতে উদ্যত হন। কিন্তু নারীহত্যা করা পাপ এবং যেহেতু হিড়িম্বা তাঁকে কামনা করেছেন, সুতরাং তিনি স্ত্রী-স্বরূপা, সেই কারণেই যুধিষ্ঠিরের আদেশে ভীম হিড়িম্বাকে বিবাহ করতে বাধ্য হন। কিন্তু এই বিবাহ ছিল শর্তসাপেক্ষ। যুধিষ্ঠির আদেশ দেন কেবলমাত্র এক বৎসরকাল হিড়িম্বা ভীমের সঙ্গে একত্র বাস করতে পারবেন এবং পুত্রের জন্মের পরই তাঁকে ভীমের সংসর্গ ত্যাগ করতে হবে। এই রাজ্যে বসবাস করতে গেলে হিড়িম্বার সাহায্য তাঁদের প্রয়োজন সেটি তাঁরা জানতেন তৎসত্ত্বেও হিড়িম্বা কেবলমাত্র দিনের বেলা স্বামী সন্দর্শনে যাবার অনুমতি পান। হিড়িম্বা এই শর্ত মেনেই ভীমকে বিবাহ করেন এবং ঠিক এক বৎসর পর পুত্র ঘটোৎকচের জন্মের পর ভীমকে ছেড়ে চলে যান। আমরা হিড়িম্বাকে মহাভারতের আর কোন ঘটনার সঙ্গে জড়িত দেখিনা, কোথাও তাঁর উল্লেখ নেই। হিড়িম্বা তাঁর শর্ত আজীবন মেনে চলেছিলেন এবং কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পুত্রবিয়োগের মত ঘটনার পরেও আমরা তাঁকে দেখতে পাই না। মহাভারতের রূপকার এই ভয়ানক এবং দুঃখজনক ঘটনার পরেও তাঁর কোন উল্লেখ করেননি। 

মহাভারতের এই নারী চরিত্রটি আলোচনা করার সময় প্রথমেই যে চিন্তাটি আমাদের মনে আসে তা হল, ভীমের প্রতি হিড়িম্বার কামভাব জাগরণ এবং মাতা কুন্তীর কাছে মিলনেচ্ছার কথা ব্যক্ত করা। সাধারণ নাগরিক সমাজে বর্তমানে তা অবাঞ্ছিত এবং কদর্য মনে হতে পারে। মনে রাখতে হবে, হিড়িম্বা ছিলেন জনগোষ্ঠী সমাজের একজন। উচ্চস্তরের বা আর্য সমাজের নারীদের মত শিক্ষা-দীক্ষা, পরিশীলতা বোধ তাঁর ছিল না কিংবা না থাকাই স্বাভাবিক। হাজার হাজার বছর আগে অরণ্যবাসী এক নারীর পক্ষে তা জানাও সম্ভব ছিল না।

তাছাড়া, সেযুগে, নারী, পুরুষ নির্বিশেষে প্রেম কিংবা কামভাব জাগলে ব্যক্ত না করার মতো কারণ বা পরিবেশ ছিল না। বরঞ্চ, একজন নারী কোনও পুরুষের নিকট মিলনেচ্ছা প্রকাশ করলে সেইইচ্ছা পূরণ না করলে সেই পুরুষের মর্য্যাদা হানি হতো। মাতা কুন্তী অথবা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যুধিষ্ঠির কেউই হিড়িম্বার ভীমের প্রতি প্রণয় বা মিলনেচ্ছা প্রকাশের জন্য কুপিত হননি, অভব্য আচরণ বলে মনে করেননি বা ধিক্কার দেননি। মহাভারতের আদিপর্বেই আমরা দেখতে পাই বিচিত্রবীর্য্যের মৃত্যুর পর বংশরক্ষার কারণে ভীষ্ম পুত্রবধূদের গর্ভে ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদনের কথা বললে তা অনুমোদিত হয় এবং পুত্রের সম্মুখে মাতা সত্যবতীর কানীনপুত্র বেদব্যাসের কথা উল্লেখিত হলে ভীষ্ম তা সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করেন। কারণ সে যুগে একজন নারী কোন পুরুষকে কামনা করলে তা চরিতার্থ করা ছিল একজন পুরুষের পক্ষে মর্য্যাদা ও পৌরুষের বিষয়। সুতরাং সেদিক দিয়ে বিচার করলেও হিড়িম্বার আচরণ অন্যায় ছিল না। হিড়িম্বের মৃত্যুর পর হিড়িম্বাকে রাক্ষসকুলজাত বলে ভীম তার প্রণয় ও বিবাহপ্রস্তাব কে অগ্রাহ্য করলে কুন্তী ও যুধিষ্ঠিরের হস্তক্ষেপে তার সমাধান হয় এবং ভীম ও হিড়িম্বার বিবাহ হয় শর্তসাপেক্ষে, যে বিবাহটি স্থায়ী হয় মাত্র এক বৎসরের জন্য এবং পুত্র ঘটোৎকচের জন্মের পরই তার অবসান ঘটে। 

হিড়িম্বাকে বলা হয়েছে তিনি রাক্ষস রাজকন্যা। হয়ত সে যুগে তিনি একজন গোষ্ঠীপতি কন্যা ছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বভাবে ছিল মানসিক দৃঢতা, ক্ষমতা ও অধিকার বোধ, গুণী ও বয়স্কদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং প্রকৃত প্রেমিকার মতো সারাজীবন নিজে দুঃখ পেয়েও প্রেমিকের শপথ রক্ষার দায়িত্বপালন। অথচ, মহাভারতে একমাত্র ভীম কর্তৃক যুদ্ধার্থে ঘটোৎকচের জন্মের প্রয়োজনে কাব্যে হিড়িম্বার আনয়ন ছাড়া আর কোনও উল্লেখ দেখা যায় না। তথাকথিত ব্রাত্য, অন্ত্যজ, নিম্নবর্গের মানুষগুলিকে শুধুমাত্র নিজের প্রয়োজনে আজও ব্যবহার করে চলেছেন উচ্চবর্ণের মানুষেরা। অধিক উদাহরণ নিষ্প্রয়োজন।

মহাভারতের আদিপর্বে চেদিরাজ উপরিচর বসু ও রাজা সুবাহুর উল্লেখ পাই। মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি হিড়িম্ব-হিড়িম্বা এই রাজকুলের একজন? কিন্তু তাঁদের স্বভাবে সেই পরিশীলতা বোধ দেখা যায় না এবং যায় না বলেই আমাদের অনুমান করে নিতে হয় তাঁরা কোন জনগোষ্ঠী সমাজের এবং যেহেতু হিড়িম্বা কে রাজকন্যা বলা হয়েছে, তিনি যে গোষ্ঠীপতি কন্যা এইরকম ভাবা স্বাভাবিক। হিড়িম্বার চরিত্র চিত্রণে মহাভারতকারও বিশেষ যত্নশীল নন। হিড়িম্বার প্রতি ভীমের নিষ্ঠুরতার কথা জানাই যায়। কিন্তু শুধু তাই নয়, নিজেদের স্বার্থে অন্যান্য সকলে তা অনুমোদন করেছেন, এটা ভেবে আশ্চর্য লাগে। কারণ তাঁরা জানতেন এই অরণ্যেওবস্থান করতে গেলে হিড়িম্বার শক্তি ও সাহায্য তাঁদের প্রয়োজন। এমন কি, পতি-পত্নীর মাঝে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যুধিষ্ঠির যে শর্ত আরোপ করেছেন তাও নিজেদের স্বার্থে এবং হিড়িম্বা তা মেনে নিয়েছেন ভীমের প্রতি তাঁর অনুরাগ ও প্রেমের জন্য এবং আজীবন সেই সত্যকে রক্ষা করেছেন দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে। প্রেমের জন্য হিড়িম্বার এত বড় ত্যাগ স্বীকারকে আমরা যথাযথ মূল্য কিন্তু দিই না। যুদ্ধে জয়লাভের জন্য সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরও কপটতার আশ্রয় নিয়েছেন, কিন্তু হিড়িম্বা কখনই নয়। অরণ্যবাসী এই নারী আজীবন তার সততা, প্রেম ও শপথকে রক্ষা করেছেন, কোনও কিছুর বিনিময়েই তিনি তা থেকে সরে আসেননি।

মহাভারতের বিভিন্ন টীকাকার, পরবর্তী রচয়িতাগণ কেউই কিন্তু হিড়িম্বার বিষয় নিয়ে সেভাবে আলোকপাত করেননি। হিড়িম্বার প্রতি দুর্ব্যবহারের কথা কোথাও উল্লেখিত হয়নি। তবে কি আমরা ধরে নেব, সেই মহাভারতের যু্গেও যে পুরুষতান্ত্রিকতা চলে আসছে তার পরিপ্রেক্ষিতেই হিড়িম্বার বিবাহে বাধ্যতামূলক শর্তপালন, ঘটোৎকচ পান্ডবকুলের সন্তান হয়েও একাকী অরণ্যচারী রমণীর সন্তান পালন, প্রেমের জন্য আত্মবলিদান, এমনকি সন্তানের মৃত্যুতেও আমরা মহাভারতের কোথাও দেখিনা হিড়িম্বার শোকপালন। মজার কথা, কয়েক বছর আগে হিন্দি ও বাংলা দুটি ভাষাতেই নির্মিত দুটি চলচ্চিত্রে আমরা’ Contact Marriage’ বা শর্তসাপেক্ষে বিবাহের ঘটনা দেখি। বিস্ময় বোধ করি তখনই যখন দেখি হাজার হাজার বছর আগের মহাভারতে ভীম ও হিড়িম্বার বিবাহের ঘটনা, সেই অর্থে কত আধুনিক! কিংবা বলা ভালো, হাজার হাজার বছর হরে নারী শোষিত আসছে একই ভাবে, এখনও!

সুখময় ভট্টাচার্য তাঁর ‘মহাভারতের রচনাবলী’তে লিখছেন—‘...রাক্ষসী হিড়িম্বা ভীম হইতে একটি পুত্র লাভ করিয়াছিলেন। যার নাম ছিল ঘটোৎকচ। অতঃপর ভীম হিড়িম্বাকে বিদায় দিয়াছেন।‘ যেন অনেক হয়েছে, এবার আর তার দরকার নেই...পুত্রার্থে ক্রিয়তেঃ ভার্যা’।

অতি সম্প্রতি একটি বই, ননীগোপাল চক্রবর্তীর ‘মহাভারতঃপ্রসঙ্গ চরিতাবলী’ গ্রন্থেও দেখি যুধিষ্ঠিরের আদেশে ভীম হিড়িম্বার পাণিগ্রহণ করেছিলেন শর্তসাপেক্ষে। হিড়িম্বা পুত্রলাভ করলে তিনি আর তাঁর সঙ্গে অবস্থান করবেন না। জ্যেষ্ঠের আদেশ ভীম মেনেছেন কিন্তু নিজের প্রয়োজনটুকু ব্যক্ত করতে দ্বিধাবোধ করেননি। অনুরাগ অন্য আর্যকুলের বা রাজকুলের রমণীর(দ্রৌপদী) প্রতি কিন্তু বনবাসকালে নিজের প্রয়োজনটুকু মিটিয়েছেন হিড়িম্বার দ্বারা। অরণ্যবাসী এক রমণীর প্রতি এই আচরণ কি অভব্যতা নয়? 

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যুধিষ্ঠিরের বিলাপ এবং কৃষ্ণের সান্ত্বনা প্রদান আমরা মহাভারতে পাই, কিন্তু হিড়িম্বার শোক প্রদর্শিত হয় না কোথাও। হিড়িম্বা তাঁর শর্তে অটল, কিন্তু যত দৃঢচেতা নারীই হোন না কেন, পুত্রের মৃত্যুতে মাতার শোক হবেনা এমন ভাবা অস্বাভাবিক, বাতুলতা মাত্র।

কৌরব, পাণ্ডব এবং অন্যান্য রাজকুল রমণীদের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর তাঁদের সন্তানের মৃত্যুতে যে হাহাকার ও বিলাপ আমরা পাই মহাভারতে তার বর্ণনা আছে পাতার পর পাতা জুড়ে, কিন্তু জনগোষ্ঠী সমাজের অরণ্যচারী এই রমণী তাঁর সন্তানের মৃত্যুতেও অবহেলিতা। অসীন সাহসিনী, দৃঢচেতা, অরণ্যবাসী এই নারীর প্রতি অবহেলা, অনাদর আমাদের মনে প্রশ্ন জাগায়। প্রেমের জন্য এই আত্মবলিদান উদ্বুদ্ধ করে আমাদের। 


(‘এবং আমরা’ পত্রিকায় ‘মহাভারতের নারী’ এই বিশেষ সংখ্যায় পূর্ব প্রকাশিত)

1 comment:

  1. সুলিখিত প্রবন্ধটি ভালো লাগলো। হিড়িম্বার চরিত্র আমাকেও ভাবিয়েছে অন্যভাবে। উপস্থাপনা যথাযথ।
    দোলা সেন

    ReplyDelete