2

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


প্রবাদের জন্মকথা 
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় 

শিরোনাম দিয়েছি বটে, কিন্তু প্রবাদের কোন জন্মকথা হয় না। কোন একটি প্রবাদ, কবে তার উৎপত্তি, তা হয়তো খুঁজে দেখা যেতে পারে, কিন্তু উৎপত্তির সঙ্গেসঙ্গেই সেটা প্রবাদ হয় না, হয় লোকমুখে উচ্চারিত হতে হতে। ‘রাতে মশা দিনে মাছি, এই নিয়েই কলকাতায় আছি’ বলেছিলেন আদি কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত দুশ’ বছর আগে তারপর নগরবাসীর মুখফেরতা হয়ে প্রবাদের চেহারা পেয়েছে। গিরিশচন্দ্র ঘোষ ১৩০ বছর আগে তাঁর ‘প্রফুল্ল’ নাটকে একটা সংলাপ লিখেছিলেন – মুখ্য চরিত্র যোগেশ বিলাপ করছে ‘আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেলো’। একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙন নির্দেশক নাট্যচরিত্র যোগেশের সেই বিলাপ কালক্রমে প্রবাদ হয়ে গেছে। এ রকম অনেক প্রবাদবাক্য আমরা জানি, সাহিত্য, নিত্যদিনের কথাবার্তায় প্রয়োগ করি, যেগুলির উৎপত্তির কার্যকারণ ও অন্তর্নিহিত অর্থ খুজে পাই। কিন্তু মৌখিক কথাবার্তায় সৃষ্ট হাজার হাজার প্রবাদবাক্য হারিয়েই যাচ্ছে। 



‘প্রবাদ’কে লোকসাহিত্যের অঙ্গ বলা হয়, যদিও আধুনিক সাহিত্যের অনেক বাক্য বা কথন প্রবাদের তালিকায় প্রবেশ করেছে। কোন একটি সংজ্ঞাতে প্রবাদকে বাঁধা যায় না। একটি প্রচলিত সংজ্ঞা ‘প্রবাদ হল দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সঞ্জাত সংক্ষিপ্ত বাক্য বা বাক্যাংশ’। এই সংজ্ঞাতেও অসঙ্গতি খুঁজে পাবেন কেউকেউ। ‘জানু ভানু কৃশানু শীতের পরিত্রাণ’ এই পংক্তি বা বাক্যটি দুখিনী ফুল্লরার বারো মাসের অভিজ্ঞতার বিবৃতি, আবার ‘লাগে টাকা দেবে গৌরি সেন’ এই প্রবাদটিতে ব্যক্তির অভিজ্ঞতার উপস্থিতি নেই। তবুও প্রবাদ যে লোকজীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই উদ্ভুত এ বিষয়ে বিতর্কের খুব বেশি অবকাশ নেই। লোকসাহিত্য গবেষক আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন, “সাধারণ জীবনের অভিজ্ঞতার উপরই প্রবাদ রচিত হইয়া থাকে, ইহার রচনা কোন কোন সময় জটিল হইয়া উঠিতে পারে, কিন্তু ভাব কিংবা বক্তব্যের দিক হইতে লোকসাহিত্যের অন্যান্য বিষয়ের মতো ইহাও নিতান্ত সাধারণ স্তরের জীবনের সমস্যা লইয়াই রচিত হয়। বাংলা দেশের সাধারণ কৃষিকর্ম, রন্ধনকর্ম, পারিবারিক জীবনের কিংবা সমাজের নানা সমস্যা, এই সকল বিষয়ই প্রবাদে প্রধানত প্রাধান্য লাভ করিয়াছে। কোন অলৌকিক, রোমান্টিক কিংবা নিগূঢ বিষয় ইহাতে স্থান পায় না”। অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্যের ভিত্তিতেই প্রবাদ রচিত হয়, মানুষের শাশ্বত জ্ঞানের ভিত্তিতে নয়” (‘বাংলার লোক-সাহিত্য’ ৬ষ্ঠ খন্ড – প্রবাদ) । তবুও প্রবাদ কখনও কখনও শাশ্বত জ্ঞানের চেহারা নিয়ে নেয়। “সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে” প্রবাদটি মানুষের সাংসারিক অভিজ্ঞতা সঞ্জাত আবার শাশ্বত সামাজিক জ্ঞানও বটে। আবার ‘ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায়’ প্রবাদটিতে শাশ্বত জ্ঞানের ইঙ্গিত আছে কিন্তু অভিজ্ঞতালব্ধ এমন বলা যায় না। চর্যাপদ থেকে শুরু করে চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, কবিকঙ্কণের চন্ডীমঙ্গল, কিংবা রামায়ণ, মহাভারতে অনেক প্রবাদবাক্য পাওয়া যায়, যেগুলির পরবর্তী যুগের লেখকদের হাতে রূপভেদ ঘটেছে। ভারতচন্দ্রের রচনায় পাই ‘হাভাতে যদ্যপি চায় সাগর শুকায়ে যায়’ আধুনিক লেখক রূপভেদ ঘটিয়ে লিখেছেন ‘অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়’। 



অনেকে ‘প্রবাদ’ ও ‘প্রবচন’কে এক গোত্রের মনে করেন। সেটি ঠিক নয়। প্রবাদ অভিজ্ঞতা সঞ্জাত সরস, ব্যঞ্জনাধর্মী অর্থবহ বাক্য, কিন্তু প্রবচন বা প্রকৃষ্ট বচন নীতিবাক্য,উপদেশ বা পরামর্শমূলক আপ্তবাক্য। ‘খণার বচন’গুলি কৃষিকার্য ও সাংসারিক অভিজ্ঞতা সঞ্জাত উপদেশবাক্য, কিন্তু প্রবাদ নয়। ‘নদীর ধারে পুঁতলে আলু, আলু হয় গাছ বেরালু’ খণা কথিত এই বচনে বালি-মাটিতে আলু চাষের পরামর্শ রয়েছে, কিন্তু এটা প্রবাদ হিসাবে গন্য করা যায় না। আবার ব্যতিক্রমও আছে ‘বামুন, বাদল, বাণ / দক্ষিণা পেলেই যান’ খণার বচনের অন্তর্গত কিন্তু প্রবাদ হিসাবেই গন্য হয়েছে। নীতি-বাক্যের সঙ্গে প্রবাদের তফাত আছে। সামাজিক আচার-ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রবাদের মূল্য আছে কিন্তু নীতি ও তত্বকথা হিসাবে সেই মূল্য চিরন্তন বা সার্বজনীন নয়। তত্বজ্ঞান বা লোকশিক্ষা কখনোই প্রবাদের মূল কথা নয়। ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’ প্রবাদটি নৈতিক জগতের সত্য বটে, কিন্তু ব্যবহারিক জগতের তথ্য নয়। ‘তেমনই জন জামাই ভাগনা, তিন নয় আপনা’ প্রবাদটি ব্যবহারিক জগতের তথ্য হলেও নৈতিক জগতের সত্য নয়। এর ব্যতিক্রম যে নেই তাও নয়, যেমন ‘টাকা মাটি মাটি টাকা’ শ্রী রামকৃষ্ণের কথা বা প্রবচন, কিন্তু প্রবাদবাক্য হিসাবেও প্রয়োগ হয় এর অর্থময়তা ও অন্তর্নিহিত সামাজিক পর্যবেক্ষনের জন্য। খ্যাতকীর্তি প্রবাদ সংগ্রাহক ডক্টর সুশীল কুমার দে’র মন্তব্য শিরোধার্য করে বলি “প্রবাদের প্রধান অনুপ্রেরক নৈতিক জ্ঞান নয়, সাংসারিক জ্ঞান; পরোক্ষ চিন্তা নয়, প্রত্যক্ষ অনুভূতি। ...প্রবাদের মধ্যে যে সত্য নিহিত থাকে তাহা প্রায়ই আপেক্ষিক সত্য – তত্বের সত্য নয়, তথ্যের সত্য...প্রবাদ মুখ্যত বাস্তব ঘেঁষা – ইহা পথঘাটের প্রাজ্ঞতা, প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার স্বচ্ছন্দ প্রকাশ – a short sentence drawn from long experience”। (‘বাংলা প্রবাদ, ছড়া ও চলতি কথা’ – সুশীলকুমার দে) 



অনেক প্রবাদে ইতিহাসের স্পর্শ পাওয়া যায়, আবার অজস্র প্রবাদ-বাক্যে সেকালের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যও দেখা যায়। “ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে, বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেবো কিসে”এই ঘুমপাড়ানি ছড়াটি আধুনিক যুগেও প্রবাদের মতো ব্যহার হয়। প্রবাদটি আমাদের সেই নবাব আলিবর্দীর আমলের বর্গি হামলার ইতিহাসে নিয়ে যায়। অনেক প্রবাদ, যেগুলিতে সেই স্থানের বা সেখানকার মানুষের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান সেইসব প্রবাদে বিদ্রুপ, বিদ্বেষ থাকতে পারে তবুও সামাজিক বাস্তব অভিজ্ঞতাই উৎপত্তির কারণ বলেই সেগুলি প্রবাদবাক্য হয়ে উঠেছে। ‘লম্বা কাছা, কাছা টান তবে জানবে বর্ধমান’। আধুনিক বর্ধমানবাসীর পোষাক পরিচয় নিশ্চই এটা নয় কিন্তু দুশোবছর আগের গ্রামীণ অভিজ্ঞতা হয়তো এমনই। এইরকম আরো কয়েকটি প্রবাদবাক্যে স্থানিক বৈশিষ্ট্য বিবৃত হয়েছ, সেগুলি হয়তো এখন প্রাসঙ্গিক নয় কিন্তু আঠেরো-উনিশ শতকের গ্রামীণ সমাজে এই প্রবাদবাক্যগুলিতে বিবৃত বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল, তবেই তো এগুলি রচিত হয়েছিল। প্রত্যক্ষ সামাজিক পর্যবেক্ষনের ফলেই এইসব প্রবাদগুলির উৎপত্তি। কয়েকটি নমুনা - (১) বাঁদর, সভাকর,মদের ঘড়া এই তিন নিয়ে গুপ্তিপাড়া’ (২) রাড়, ষাঁড় সন্যাসী, তিন নিয়ে বারানসী’ (৩) বেহায়া, বেরসিক বাঁকা তিন নিয়ে ঢাকা (৪)শান্তিপুর রসের সাগর, এক এক ঘরে তিন তিন নাগর (৫) রাস, তাস জোরের লাঠি তিন নিয়ে পানিহাটি। 



বাংলার লোকসাহিত্যের মতো বাংলার লোকপ্রবাদগুলিও লুপ্তপ্রায়। একথা ঠিক যে আমাদের আধুনিক শহুরে মার্জিত মননে অনেক লোকপ্রবাদ অশ্লীল মনে হয়, সেগুলির প্রয়োগ করা থেকে আমাদের রুচিশীল মনন বিরত থাকে। কয়েকটি নমুনা – (১)’দোজবরের মাগ সোঁদর বনের বাঘ’ (২) ‘বেরিয়ে এলাম বেশ্যা হয়ে কুল কলঙ্ক ক্ষয়/এখন কিনা ভাতার শালা ধম্ম বেচে খায় (৩)’সাত রাঁড় এক এয়ো যার কাছে যাই সেই বলে আমার মতো হয়ো’ (৪)’আদরবিবির চাদর গায়, ভাত চায় না ভাতার চায়’ (৫) ন্যাংটো পোঁদে কাপড়, পোঁদ বলে বড় ফাঁপর’ ; এই প্রবাদবাক্যগুলি একালের রুচিশীল মননে পরিহারযোগ্য মনে হলেও প্রবাদগুলির মধ্যে লুকিয়ে থাকা সমকালীন সময়ের সরল পর্যবেক্ষণ, গ্রামীণ মানুষের সরল যাপন, সরস বোধকে অস্বীকার করা যায় না। এইসব পর্যবেক্ষন যে সত্য একথাও বাংলার সামাজিক বিবর্তনের ইতিহাস ঘেঁটে পাওয়া যাবে। খ্যাতকীর্তি প্রবাদ সংগ্রাহক ও গবেষক সুশীলকুমার দে বলেছেন “জাতির আভ্যন্তরীণ বাস্তব বিবরণ, তাহার ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও রসিকতা, তাহার জীবন্ত ভাষা ও বিচিত্র ভূয়োদর্শন, তাহার ধর্ম-কর্ম, বিদ্যাশিল্প, ব্যবসা-বানিজ্য, চাষবাস, জলহাওয়া, আচার-ব্যবহার, সন্সকার-সংস্কৃতি, শাসন-শিক্ষা, সমাজের সকল শ্রেণি ও সকল স্তরের বৈশিষ্ট্যের যথেচ্ছ চিত্র প্রবাদগুলিতে ব্যপ্ত হইয়া আছে – যাহা কল্পনার রঙে রঙ্গীন বা ভাবমাধুর্যে অতিন্দ্রীয় নয়, নিতান্ত ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য ও বাস্তব-বুদ্ধির ঈক্ষণে সরস ও সজীব”। (ড.সুশীলকুমার দে / ‘বাংলা প্রবাদ, ছড়া ও চলতি কথা’) 



পুরনো কলকাতা নি্যেও অনেক প্রবাদ আছে যেমন ‘বেটী মাটি মিথ্যা কথা এই নিয়ে কলকাতা’ কিংবা (২) ‘তেঁতুলে নেই টক কলকাতার ঢপ’ ইত্যাদি। এখন এগুলি প্রাসঙ্গিক মনে না হলেও তিনশো বছর আগের শৈশবের কলকাতার কিছু পর্যবেক্ষণ তো বটে। এইরকম পুরাতন কলকাতাকে নিয়ে অনেক প্রবাদ রচিত হয়েছিল মুখে মুখে। তা সেই তিনশো বছর আগের গন্ডগ্রাম কলকাতাও আর নেই তাই আধুনিক কলকাতাকে চিনতে সেই প্রবাদগুলিও অপ্রাসঙ্গিক। তবুও পুরনো কলকাতার কয়েকটি প্রবাদ এখনও বেশ বেঁচে আছে আর তার জন্মকথা জানতে আমাদের আগ্রহও আছে। তেমনই তিনটি প্রবাদের গোড়ার কথায় গিয়ে লেখাটির ইতি টানবো। 

(১) “ধনীর মধ্যে অগ্রগন্য রামদুলাল সরকার, বাবুর মধ্যে অগ্রগন্য প্রাণকৃষ্ণ হালদার”। প্রবাদবাক্যটিতে উনিশ শতকী কলকাতার দুই ধনাঢ্য ব্যক্তির নাম রয়েছে। বাঙালির স্বাধীন শিল্পদ্যোগ ও ব্যবসার ক্ষেত্রে রামদুলাল সরকার একটি স্মরণীয় নাম। নিতান্ত দরিদ্র অবস্থা থেকে ধণাঢ্য শিল্পদ্যোগী হয়ে ওঠার পেছনে এক চমকপ্রদ গল্প আছে। রামদুলাল সরকারের জন্ম ১৭৫২ ও মৃত্যু ১৮২৫। বাল্যকালে পিতৃ-মাতৃহীন রামদুলাল মাতামহীর আশ্রয়ে প্রতিপালিত হতে থাকেন। মাতামহী সেকালের প্রসিদ্ধ ধনী মদনমোহন দত্তর গৃহে পাচিকার কাজ করতেন। মদনমোন রামদুলালকে স্নেহ করতেন, সামান্য লেখাপড়া শিখিয়ে তাঁর গদিতে দশটাকা বেতনের চাকরিতে নিয়োগ করেন। একবার মদনমোহন রামদুলালকে নিলাম কিনতে পাঠিয়েছিলেন। রামদুলাল নিলাম ক্রয় না করে চোদ্দ হাজার টাকায় নিলামে একটা ডুবে যাওয়া জাহাজ কেনেন তারপর সেই জাহাজটি এক সাহেবের কাছে এক লক্ষ টাকায় বিক্রি করে দেন। এই কেনা-বেচায় লাভ করা পুরো টাকাটা রামদুলাল মালিক মনমোহন দত্তকে দিয়ে দেন। মদনমোহন রামদুলালের সততা ও ব্যবসাবুদ্ধিতে খুশি হয়ে ঐ একলক্ষটাকা রামদুলালকেই দিয়ে দেন এবং স্বাধীনভাবে ব্যবসা করার পরামর্শ দেন। ঐ টাকায় স্বাধীনভাবে ও সততার সঙ্গে ব্যবসা করে বিপুল ধন সঞ্চয় করেন রামদুলাল। রামদুলালকে বলা হত ভারতের প্রথম লাখপতি ব্যবসায়ী। এ দেশের বহির্বানিজ্যের পথপ্রদর্শক ছিলেন রামদুলাল। আঠেরো শতকে শেষে বাংলার সঙ্গে আমেরিকার বহির্বানিজ্যের যোগাযোগ ঘটে প্রধানত রামদুলালের মাধ্যমে। আমেরিকার ব্যবসায়ীরা রামদুলালের নামে তাঁদের একটি বানিজ্য জাহাজের নামকরণ করে। চিন, ইংলন্ড, আমেরিকার বণিক্মহলে রামদুলালের ছিল অশেষ খ্যাতি। রামদুলাল তাঁর অর্জিত অর্থ দরিদ্রকল্যাণ ও সৎকাজে ব্যয় করেন। সেকালের মানুষ রামদুলালের এই ভূমিকাকে গ্রাহ্য করেই প্রবাদ রচনা করেছেন যে এটাই প্রকৃত ধনীর লক্ষন। প্রবাদবাক্যটির অপর ব্যক্তি প্রাণকৃষ্ণ হালদার ছিলেন চুঁচুড়ার প্রসিদ্ধ ধনী কিন্তু অন্য মেরুর মানুষ। নিজেকে ইংরাজি কায়দায় পরিচয় দিতেন ‘বাবু প্রাণকিষেণ হলডর’। সেকালে ‘বাবু’ শব্দটি ছিল বিদ্রুপের বস্তু, উনিশ শতকের কদর্য ‘বাবু কালচার’এর পৃষ্ঠপোষক। প্রাণকৃষ্ণ হঠাৎ ধনী হয়েছিলেন অসৎ উপায় অবলম্বন করে। ‘নোট ও কোম্পানীর কাগজ’ জাল করে প্রাণকৃষ্ণ ধন-সম্পত্তি লাভ করেন। জাল করার অপরাধে প্রাণকৃষ্ণের দীপান্তর হয়েছিল। প্রাণকৃষ্ণের অপরাধে সহায়তা করার জন্য ভাই নীলমণি হালদারও দন্ড ভোগ করেন। ভাবা যেতে পারে প্রবাদ রচয়িতা উনিশ শতকের কদর্য ‘বাবু’ সংস্কৃতির এক পৃষ্ঠপোষককেই চিনিয়েছেন প্রাণকৃষ্ণের মধ্য দিয়ে। আবার বলতে হয় সেই কথাটা প্রবাদের মধ্যে বিদ্রুপ, রসিকথা থাকে, কিন্তু লুকিয়ে থাকে সমকালীন সত্যও। 



(২) ‘লাগে টাকা, দেবে গৌরী সেন’ খুব জনপ্রিয় ও বহু ব্যবহৃত প্রবাদ। তা গৌরী সেন কি সত্যিই ছিলেন ? হ্যাঁ ছিলেন, কিন্তু কে ছিলেন এই গৌরী সেন ? গৌরী সেনের কথা বলার আগে বৈষ্ণবচরণ শেঠের কথা বলতে হয়। শেঠ পদবীধারী তন্তুবায় পরিবার ছিল কলকাতার আদি বাসিন্দা আর এক তন্তুবায় পরিবার বসাকদের সাথে হুগলীর সপ্তগ্রাম থেকে গোবিন্দপুর গ্রামে (এখনকার দক্ষিণ কলকাতা) বসতি স্থাপন করে ইংরেজরা আসারও আগে। পরে তারা সুতানুটি অঞ্চলে চলে আসেন। বৈষ্ণবচরণ ব্যবসা-বানিজ্য করে ধনবান হয়ে উঠেছিলেন। কলকাতায় জোড়াবাগান অঞ্চলে বৈষ্ণবচরণের নামে একটি রাস্তা আছে। এই বৈষ্ণবচরণের ব্যবসার অংশীদার ছিলেন গৌরী সেন। গৌরী সেনের আদি নিবাস ছিল হুগলীতে। সেখান থেকে চলে আসেন কলকাতার বড়বাজার অঞ্চলে, থাকতেন কলুটোলা স্ট্রীটে। একবার বৈষ্ণবচরণ গৌরী সেনের নামে সাত নৌকা দস্তা কেনেন। পরে দেখা গেলো দস্তার মধ্যে রূপোর ভাগই বেশি। বৈষ্ণবচরণ ভাবলেন গৌরী সেনের ভাগ্যজোরেই দস্তা রূপো হয়ে গেছে। তিনি রূপো মেশান দস্তা বিক্রির সব টাকা গৌরী সেনকে দিয়ে দিলেন, আর গৌরী সেন হয়ে গেলেন বিপুল অর্থবান । এহেন ধনবান গৌরী সেন খুব অমায়িক ছিলেন ও দান-ধ্যানে অর্থ ব্যয় করতে ভালোবাসতেন, ঋণগ্রস্ত দরিদ্র কিংবা কণ্যাদায়গ্রস্ত পিতা গৌরী সেনের কাছ থেকে ফিরে যেতেন না। ঋণের দায়ে কেউ কারারুদ্ধ হলে তিনি তাকে মুক্ত করে আনতেন। এমনকি যাকে সাহায্য করছেন সে তাঁকে প্রতারণা করছ কি না তাও যাচাই করতেন না। তাঁর দানশীলতার জন্যই মুখে মুখে প্রবাদের সৃষ্ট হয়েছিল ‘লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন’। 



(৩) আর একটি প্রবাদ ‘হরি ঘোষের গোয়াল’ পুরনো কলকাতার প্রবাদ হলেও আজও সাহিত্যে, দৈনন্দিন কথাবার্তায় হামেশাই ব্যবহৃত হয়। কে এই হরি ঘোষ আর কেনই বা প্রবাদটির জন্ম ? হরি ঘোষের পুরো নাম শ্রীহরি ঘোষ। তাঁর পিতা বলরাম ঘোষ ছিলেন চন্দননগরের ফরাসী গভর্নর দুপ্লের দেওয়ান। বলরাম দুপ্লের দেওয়ানী করে ধনবান হয়েছিলেন। কলকাতায় শ্যামবাজার সংলগ্ন বলরাম ঘোষ স্ট্রীট নামে বহু পুরাতন একটি রাস্তা আছে। পলাশী যুদ্ধের আগের বছর ১৭৫৬তে পিতা বলরামের মৃত্যুর পর শ্রীহরি কলকাতার শ্যামপুকুর অঞ্চলে কুড়ি বিঘে জমির ওপর বাড়ি, বাগান, পুকুর বানিয়ে বসবাস করতে থাকেন। ইংরেজরা মীরকাশিমের কাছ থেকে ইংরেজরা মুঙ্গের দুর্গের দখল নেওয়ার পর ইংরেজরা শ্রীহরিকে মুঙ্গের দুর্গের দেওয়ান নিযুক্ত করে। দেওয়ানী করে শ্রীহরি অগাধ ধনসম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। চাকুরী থেকে অবসর নিয়ে শ্রীহরি বিশাল একটি বাড়ি করেন সেখানে বহু আত্মীয়-সজন, বন্ধু-বান্ধব,দুঃখী মানুষ, অনাহুত, রবাহুতত্রা থাকতেন। তাদের ভরন-পোষন করতেন শ্রীহরি। সেই বাড়িটিই প্রবাদের ‘হরি ঘোষের গোয়াল’। ধনবান, অথচ খুবই সাদাসিধে মানুষ ছিলেন শ্রীহরি। সেই জন্য ঠকেওছিলেন। এক আত্মীয়ের জামিনদার হয়েছিলেন, কিন্তু সেই ব্যক্তি সেই সুযোগ নিয়ে পালিয়ে যায় ,ফলে ইংরেজরা শ্রীহরির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। প্রতারিত হয়ে মনোকষ্টে শ্রীহরি কাশী চলে যান। সেখানেই ১৮০৬ সালে শ্রীহরি ঘোষের মৃত্যু হয়। 

এভাবেই রামদুলাল সরকার, গৌরী সেন, হরি ঘোষরা অমরত্ব পেয়ে যান প্রবাদের মধ্যে। প্রবাদের যেমন জন্মকথা হয় না, মৃত্যুও হয় না প্রবাদের, কিংবা প্রবাদের মানুষেরও। 



তথ্যসূত্র (১) ‘বাংলা প্রবাদ, ছড়া ও চলতি কথা’ / ড. সুশীলকুমার দে (২) ‘বাংলার লোকসাহিত্য’ ৬ষ্ঠ খণ্ড / ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য (৩) ‘কলকাতা বিচিত্রা’ / রাধারমণ রায় (৪) ‘ভারতকোষ’ ৪র্থ খণ্ড / বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ 

2 comments: