Next
Previous
Showing posts with label স্মৃতির সরণী. Show all posts
0

স্মৃতির সরণী - সঞ্চয়িতা বিশ্বাস

Posted in

স্মৃতির সরণী


মেজোমামী
সঞ্চয়িতা বিশ্বাস


মেজোমামী মারা গেলেন গত শনিবার। চিররুগ্ন মানুষ ছিলেন। সারা জীবনটাই ধুঁকতে ধুঁকতে গেছে তাঁর। কিন্তু তাঁর ছোট্ট সংসারের উপর তাঁর দুর্বল মুঠোর রাশটা কখনো আলগা হয়নি। সেই অর্থে তিনি সুখীই ছিলেন। মামীকে যে আমি খুব ভালোটালো বাসতাম, তা নয়। সহজসরল শান্ত মানুষ ছিলেন বলে আমার ভালোই লাগতো। মামীর কথা মনে পড়লেই তাঁর সংসারটাই চোখে ভাসছে শুধু। 

বড়ো রাস্তাটার ধারে কাঠের দোকানে ঘ্যাঁসঘ্যাঁস করে করাত চালাচ্ছে কেউ। বাতাসে কাঠের গুঁড়ো উড়ছে। কাঠের গন্ধের মধ্যে দিয়ে দোকানের পাশের গলি ধরে তিরিশ সেকেন্ড হাঁটলেই বাইরের শব্দ নিভে আসে। গাছপালায় ঘেরা বিশাল উঠোন তকতক করছে। ডাইনে বেড়ার দেওয়াল আর টিনের চাল দেওয়া বিশাল দালানখানা। জুতো খুলে মাটির মেঝেতে পা দিলেই আরাম লাগে পায়ের তলায়। বারান্দায় একটা খাট পাতা…দুটো কাঠের চেয়ার…একটা পাটী গুটোনো। বারান্দা পেরিয়ে মূল ঘরখানা বেশ বড়ো। সংসারের যাবতীয় আসবাব, মানে পালঙ্ক-আলমারী-মিটসেফ-আলনা-ঠাকুরঘর, সবটাই ওই ঘরে। পাশাপাশি আছে, কিন্তু ঠাসাঠাসি অগোছালো নয়। একটা কান মোচড় দেওয়া সাদাকালো টিভি…তাতে নীল কাঁচ বসিয়ে রঙিন করবার চেষ্টা করা হয়েছে। টেবিলক্লথের কোণে একগোছা সুতোর ফুল…পাশে'মনে রেখো'। মূলঘরের পিছনে কামরা ঘরে আরো একটা বড়ো তক্তপোশ। বেড়ার ফাঁক দিয়ে রোদ্দুর এসে বরফি আঁকে তার সারা গায়ে। এ বাড়িতে একটা গন্ধ আছে…ধূপ-কাঠের আসবাব -ন্যাপথালিন- বাঁশ- মাটি- রেক্সোনা মেশানো গন্ধ। এই গন্ধ শুধু এই বাড়িতেই ছিল…যতদিন না বেড়ার ঘর ভেঙে পাকা দালান তোলে মেজোমামা!

মামীর সংসারের ছন্দ বড়োই সরল। সকালে উঠে ঘরদোর ঝাঁড়পোঁছ করে রান্নার জোগাড় করা। রান্নার শেষে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়া। ঘুম থেকে উঠে রাতের রান্নার জোগাড়। তারপর খাওয়া। আবার ঘুম। আমার মায়ের সংসারে সর্বদাই ব্যস্ততা…একা থাকলেও…সবাই থাকলেও। মামীর সংসারে কোনো ব্যস্ততা নেই। যখন রান্না শেষ হবে, তখন মামা খেয়েদেয়ে অফিসে যাবে। তাতে ট্রেন পেলে পাবে, না পেলে নেই! মামী রুগ্ন বলে এ সংসারে সবাই কাজ করে। মামী উনুন জ্বালালে মামা শাক কুটতে বসে, দাদা উঠোন ঝাঁট দিতে যায়। কেউ বসে থাকে না, কিন্তু কারো কোনো ব্যস্ততাও নেই। বকফুল গাছের তলা সাদা হয়ে যায়…শুকনো পাতার উপর দিয়ে তক্ষক ছুটে পালায়। এবাড়ির ভাড়াটে বৌ'টা শব্দ করে বালতিতে জল তোলে চাপকল থেকে। শিরশিরে হাওয়ায় মটমট শব্দ হয় বাঁশবনে। 

মামীর রান্নার হাতটি বড়ো সরেস। পোলাও-কোর্মাটাইপ সরেস নয়। এ বাড়িতে রগরগে রান্নাগুলো মামা রাঁধে। মামী ঝকঝকে কাঁসার থালায় জুঁইফুলের মতো ভাত উঁচু করে দেয়…এক পাশে লবণ, কাঁচালঙ্কা আর পেঁয়াজ। তারপাশে চালের গুঁড়ো দিয়ে বকফুলের বড়া, মাছপাতা বা ঘ্যাঁটকোল পাতা বাটা, রসুন দিয়ে কলমীশাক ভাজা। পাশে খাঁজকাটা বাটিগুলোতে থাকে কাঁচামুগের ডাল, উচ্ছে-আলু দিয়ে ছোট মাছ, ফুলকপি আর নতুন আলু দিয়ে কাতলার ঝোল, জলপাইয়ের টক…। জলভরা কাঁসার গ্লাসে আলো ঠিকরায়। এখানের জলের স্বাদ কষাটে…ভারী…খুব ঠাণ্ডা। 

মামীর কথা মনে পড়লে তাঁর রোগজীর্ণ ডানহাতটার কথা মনে পড়ে। ঢিলঢিলে শাঁখা-পলা-লোহাপরা হাতখানা ঝাঁঝড়ি ডুবোচ্ছে আমার দিদার আমলের কড়াইতে। কড়াইভরা তেলে একটা মালপোয়া ফুলে উঠছে। বাইরে উঠোনের উনুনে মামা কাস্তেপিঠে বানাচ্ছে মাটির ছাঁচে। একবাটি নতুন গুড় নিয়ে অপেক্ষা করছি কখন বুক ফুলবে ধপধপে পিঠেগুলোর। পাশে থকবক করে ফুটছে দুধ। ওতে পাটালী পড়বে…এলাচ-তেজপাতা পড়বে…কাঁচি পোড়া পিঠেগুলো ডুবে নরম হবে গোটা রাত ধরে…

মামীর কথা মনে পড়লে একটা স্মৃতির কথা মনে পড়ে। স্মৃতিটা আমার নয়। কিন্তু বহুশ্রুত হওয়ার দরুণ স্মৃতিটা আমার হয়ে গেছে। আমার জন্মের পরপরই মা অসুস্থ হয়ে পড়ে। ভর্তি হতে হয় কৃষ্ণনগরের সরকারী হাসপাতালে। এর হাত ওর হাত ঘুরতে ঘুরতে মামীর হাতে এসে পড়ি একসময়। মা ফিরে আসার আগে অবধি মামীর কাছেই ছিলাম। রাজুদাদা, মামীর একমাত্র সন্তান, ছোট ছিল বলে আমাদের দুজনকেই ঐ চিররুগ্ন মানুষটা স্তনপান করিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল। মামীর সাথে যতবার আমার দেখা হয়েছে, মামী এই গল্পটা আমায় করেছে। এগারো বছর মামাবাড়ি যাই না। তবুও মামীর সংবাদটা শোনার পর থেকে বারবার ফিরে যাচ্ছি ঐ বাড়িটায়। কোনো বেদনা নয়, মনখারাপ নয়। তবু কোথায় যেন তিরতির করে কাঁপছে…টান পড়ছে ফাৎনায়…বুদবুদ উঠছে…। একটা শীর্ণ সুখী মানুষ উঠোনের পাটি পেতে উঁচু একটা বালিশে শুয়ে গুনগুন করে গল্পটা আরো একবার বলছে…।
0

স্মৃতির সরণী - বিপুল দাস

Posted in

স্মৃতির সরণী 


কথামালা
বিপুল দাস


শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেছিল একটা ঝকঝকে প্রজন্ম। জীবনমৃত্যু পায়ের ভৃত্য করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সংগঠিত রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে। পুঁজি বলতে ছিল কিছু দেশি বন্দুক, পেট, রেডবুক, চোখে স্বপ্ন আর বুকে আদর্শের আগুন। কিন্তু একটা সুসংগঠিত, নিষ্ঠুর, পেশাদার ঘাতক বাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘদিন গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মত রণকৌশল, রসদ, এবং অস্ত্র তাদের ছিল না। অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল, গ্রামেগঞ্জের আমাশা-ম্যালেরিয়া ছিল। সুসংহত বাহিনী না গড়ে, উপযুক্ত রাজনৈতিক এবং সামরিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই যুদ্ধ শুরু করার ডাক শুনে এরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে, ঘর ছেড়ে পথে নেমে এসেছিল। এদের ঝাড় শেষ করে দিয়েছিল সিদ্ধার্থ রায়, কিন্তু বংশ লোপ করতে পারেনি।

মাঝে মাঝে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়। অ্যাকশন স্কোয়াডের শঙ্কর পূজারি বামুন হয়ে গেছে। কী করব বল, চাকরি পাব না জানি, ভেরিফিকেশনে আটকে যাবে। সংসার তো চালাতে হবে – বলেছিল শঙ্কর। শঙ্কর জানে না কত হার্ড-কোর নকশালপন্থী, কত আগুনখেকো বিপ্লবী কী সব ভুজুংভাজুং দিয়ে পুলিশ ভেরিফিকেশন ক্লিয়ার করে নিয়েছে। মিহির হাত দেখে আর পাথর বেচে বেশ কাঁচা পহা আমদানি করেছিল। লাং ক্যান্সারে মারা যায় মিহির। কত বন্ধু ঠিকাদারি-প্রোমোটারিতে চকচকে হয়ে উঠল। কত বন্ধু লাইন করে সরকারি চাকরি পেল। বন্দীমুক্তি পর্বে ছাড়া পাওয়ার পর বেসীর ভাগ কেমন নির্জীব হয়ে পড়েছিল। চোখে আর সেই দ্যুতি ছিল না। অনেকেই ফিজিক্যালি হান্ডিক্যাপড্‌ হয়ে পড়েছিল। খড়দার হোগলাদা পরে চেষ্টা করেছিল মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে আবার উঠে দাঁড়াতে। হয়নি। চারুদার বড় মেয়ে অনীতার বর সেন্ট পলস্‌-এর মেধাবী ছাত্র সুগত সেনগুপ্ত আবার পার্টির কাজ শুরু করেছিল। অসম থেকে ফিরে এল জ্বর নিয়ে। পরে যখন ধরা পড়ল মেনেজাইটিস ম্যালেরিয়া, তখন আর কিছু করার ছিল না।

সেই ছাতিমগাছটা সব জানত। কিন্তু এখন আর গাছটা খুঁজেই পাই না। এক রকম গাছ আছে, বনে আগুন লাগলে সেই গাছ নিজের ধ্বংস বুঝতে পেরে খুব দ্রুত নিজের বীজ ঝরিয়ে দেয় মাটিতে। আমি পুড়ে যাচ্ছি, তোরা থাক। আমাদের ছাই-এর ওপর তোদের নবাঙ্কুর জেগে উঠুক নতুন ধারাপাতে। কে জানে, আবার নতুন সপ্তপর্ণী জেগে উঠবে কিনা।

সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে আমি আমার মত করে নিজেকে বিশ্লেষণ করতে শুরু করেছিলাম। কতটুকু বুঝেছিলাম মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ। নির্বাচিত লেনিন রচনাবলির ক’পৃষ্ঠা পড়েছি আমি। বিশ্ব-রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভারতবর্ষের মানুষের সনাতন সাংস্কৃতিক কাঠামো, ভারতের পরিবর্তিত সামাজিক পরিস্থিতি ও মানুষের মানসিক কাঠামো – এ সবের প্রেক্ষিতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ডাক দেওয়ার সময় কি হয়েছিল। বিপ্লবের জন্য মাটি কি প্রস্তুত ছিল। এ যেন আগুনটুকু শুধু আছে, রান্নাবান্নার জিনিস নেই, হাতাখুন্তি নেই, অথচ দেশসুদ্ধ লোকের নেমন্তন্ন হয়ে গেছে।

যত বিশ্লেষণ করি, মোহমুক্তি ঘটতে থাকে আমার। আমার মত করে লেখালেখি আর সঙ্গীতের জগতে নিজেকে সমর্পণ করি। ক্রমশ এই উপলব্ধি হয়, ‘ বাহির হইতে প্রযুক্ত বল দ্বারা অবস্থার পরিবর্তন না হইলে’ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করে সেই পরিবর্তন হয়তো সম্ভব।

এখনকার আশাবাদী সি পি এম –এর কমরেডরা বলেন – পার্টি আবার ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু কেমন করে ঘুরে দাঁড়াবে, সে কথা কোথাও শুনি না। তেভাগা বা তারও আগে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি ঐক্যে যে শক্তি জেগে উঠতে শুরু করেছিল, যে ভাবে গানে-নাটকে-চলচ্চিত্রে-সাহিত্যে প্রগতিশীল মানুষ নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত মানুষের কথা প্রচার করেছেন, যে ভাবে দিনের পর দিন চিড়েমুড়ি খেয়ে আদর্শে নিবেদিত কম্যুনিস্ট গ্রামে গ্রামে সংগঠন গড়ে তুলেছে, যে ভাবে কম্যুনিস্ট পার্টি শ্রমিকের স্বার্থে শহরে তীব্র গণ-আন্দোলন গড়ে তুলেছে, তৎকালীন প্রশাসনকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে – আর এক দল চৌত্রিশ বছর ধরে তার ফল ভোগ করেছে। যে গাছকে রোদজলঝড়বৃষ্টি থেকে রক্ষা করে, আগাছা নিংড়ে, পোকা মেরে, জল ও সার দিয়ে মহাবৃক্ষে পরিণত করা হয়েছিল, সেই বৃক্ষ ফলবতী হতেই সেই গাছের ছায়ায় এসে বসল চালাক মানুষের দল, ফড়ের দল। তারা যথেচ্ছ ফল খেল, ফুল তুলল, পাতা ছিঁড়ল, ডাল ভাঙল। গাছকে বাঁচানোর কথা আর কেউ ভাবল না। ভেবেছিল আরও পঞ্চাশ বছর এই গাছ আমাদের ছায়া দেবে, ফলপাকুড় দেবে। পেটে গামছা বেঁধে, ঝড়জলরোদে গ্রামে গ্রামে কম্যুনিস্ট পার্টির সংগঠন গড়ে তোলা এবং ধরে রাখার লোক তখন আর নেই। প্রতিটি সিদ্ধান্ত দ্বিধাগ্রস্ত। দক্ষিণ মুখাপেক্ষিতা। ভুলের ওপর ভুল। পরে আবার ভুল স্বীকার। গ্রামেগঞ্জে গিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থেকে সংগঠন করার লোক আর রইল না। নতুন কোনও প্রজন্ম এগিয়ে এল না সেই আরব্ধ কাজের দায়িত্ব নিতে। ভাগ্যিস পুব-পাকিস্তান থেকে বিশাল সংখ্যায় বামপন্থী মনোভাবের লোক, তেভাগায় অংশগ্রহণ করা কিছু লোক পশ্চিমবঙ্গজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। এরা ছিল বামপন্থীদের একটা অন্যতম শক্তি। পার্টি ভাগ হওয়ার পর মগজ কমে গিয়েছিল সি পি এমের। সেটি সি পি আই নিয়ে আলাদা হয়ে যায়। আর মগজবিহীন ক্রমবর্ধমান ধড় নিয়ে সি পি এম ভেবেছে – দ্যাখো আমি বাড়ছি মাম্মি।

আশির দশকের মাঝামাঝি থেকেই অনিয়ন্ত্রিত কোষ-বিভাজনের ফলে উদ্ভুত মারণ রোগের লক্ষণ টের পাওয়া যাচ্ছিল।ক্রমে জনসংযোগের বদলে জনবিচ্ছিন্নতা শুরু হ’ল। স্থানীয় নেতারা সবাই প্রায় ছোটখাটো সামন্তপ্রভু হয়ে বসেছিল। প্রোমোটারি-রাজ দৃঢ় ভাবে কায়েম হয়ে বসল। আস্তে আস্তে পায়ের তলার মাটি নরম এবং সরে যাচ্ছে – এটা না বোঝার কথা নয়। কিন্তু হিটলার যেমন ভাবতে পারেনি রাশিয়ার তুষারাবৃত প্রান্তর থেকে তার অজেয় বাহিনী মার খেয়ে পালিয়ে আসবে, তেমনই বামফ্রন্টের ছোটবড় নেতারা বিশ্বাস করতে পারেনি এই সরকারের পতন হতে পারে। মার্ক্সবাদ বিজ্ঞান, তাই সে অজর, অমর, অক্ষয়, অব্যয়। তাকেও যে স্থানকালপাত্রের প্রেক্ষিতে প্রয়োগের উপযুক্ত করার জন্য সামান্য ঘষামাজা করে নিলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না, এই শুচিবাই থেকে বেরোতে না পারা ভয়ানক ক্ষতি করে ছিল। শহরে, গ্রামে, গঞ্জের অফিসে-স্কুলকলেজ-আদালতে ছোট দরের একপো-আধপো নেতাদের দেখেছি কথায় কথায় বিরোধীদের, সরকার বা পার্টির সামান্য সমালোচনা করলে আস্তিন গুটিয়ে তেড়ে আসতে। এরা কেউ সংগ্রামের ভেতর দিয়ে, ত্যাগতিতিক্ষার ভেতর দিয়ে, আদর্শের জন্য সি পি এম করতে আসেনি। যাঁরা এসেছিল, তারা অনেকেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে বসে গেছে। শহরে ছাত্র আন্দোলনের নেতারা, শ্রমিক বেল্টের নেতারা অনেকেই তখন বড় নেতা মন্ত্রী। মুড়ি, রুটিগুড় তখন ইতিহাস। গ্রামেগঞ্জে সামন্তপ্রভুদের কড়া হাতে রাশ টানা, আত্ম-সমালোচনা, আত্মশুদ্ধি –এ সব কথা মাঝে মাঝে প্রকাশ্যে এবং রুদ্ধদ্বার বৈঠকে উচ্চারিত হ’ত বটে, কিন্তু কঠোর হাতে পরিমার্জনা করতে সে রকম উৎসাহ কারও ভেতরেই ছিল না। যেমন-আছে-থাক, স্ট্যাটাস কো-এর এই সুখপ্রদ অবস্থাকে কেউ আর টালমাটাল করতে চায়নি। যদি এই মসৃণ জীবনযাপন পালটে যায়।

সেই মহাবৃক্ষের নীচে তখন ফল কুড়িয়ে খাওয়ার লোক বেশি। গাছ মরে গেলে তাদের কিছু আসে যায় না। আবার অন্য গাছের ছায়া খুঁজে নেবে। এরা বাংলার মাটিতে কম্যুনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস কিছুই জানে না। এরা সলিল চৌধুরী, শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্যের নাম শোনেনি। তেভাগা আন্দোলনের কথা জানে না। একমাত্র বামপন্থার শক্তিই পারে জাতিধর্ম, শ্রেণিগতস্থান নির্বিশেষে সম্প্রীতি ও ঐক্যের বন্ধনে সমাজকে সুস্থ ও সংহত রাখতে – এসব কিছু তারা বুঝতে চায়নি। পরগাছার মত সেই বৃক্ষ থেকেই ক্রমাগত রস টেনে স্ফীত হয়েছে। এদের নির্মূল করার অভিযান কোনও দিন হয়নি। প্রবল আত্মবিশ্বাস, গরিমা, দম্ভ, স্বচ্ছল জীবনযাপনে অভ্যস্ত কমরেডরা টের পায়নি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে, ঘরের বাইরে অসংখ্য সুযোগ-প্রত্যাশী ও স্তাবকদের ভীড়েসংগ্রাম হারিয়ে যাচ্ছে। ভিটেতে ঘুঘুর ডাক অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। শোনা যাচ্ছিল ভিতের নীচে উইপোকার শব্দ। তখন আর সময় নেই। বস্তু যখন খুব ভারি হয়ে যায়, তখন তার আপন ভারেই গতিজাড্য নিয়ে সামনে গড়ায়। তাই হয়েছিল। বিশাল পার্টি তার নিজস্ব ভরেই গড়িয়ে চলছিল। সবাই ভাবত – এই তো দিব্যি চলছে।

পশ্চিমবঙ্গের কম্যুনিস্ট আন্দোলন, কম্যুনিস্ট-শাসিত সরকার – দীর্ঘদিন ধরেই অনেকের মাথাব্যথার কারণ হয়ে ছিল। এর পতন তারা চেয়েছিল। ভূমিসংস্কারের সুফল এই সরকার দীর্ঘদিন ভোগ করেছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত দেশীয় ভূস্বামীদের একটা বড় অংশ, অ-কম্যুনিস্ট দলগুলো, বিদেশি পুঁজিপতিদের দালালশ্রেণি – নানা ভাবে চেষ্টা করেছে এই সরকারকে উৎখাত করতে। কিছু জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্র, ইলেক্ট্রনিক প্রচারমাধ্যম, কেন্দ্রের সরকার – এই কম্যুনিস্ট পার্টি এবং তার সরকারকে কোনও দিনই পছন্দ করেনি। কম্যুনিস্টদের প্রতি ঘৃণা ছিল অনেক বিখ্যাত লোকেরও। সেটা আমরা পরবর্তী পর্যায়ে লালগড়, নন্দীগ্রাম আন্দোলনে দেখেছি। শুনেছি লাল রং তারা কেমন ঘৃণার চোখে দেখেন। কম্যুনিস্ট নেতাদের শহিদ বেদিতে পদাঘাত করতেও তাদের বাধেনি। লালগড়, নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর, নেতাই – তারও আগে সাঁইবাড়ি, মরিচঝাঁপি, অনীতা দেওয়ান, নেতাদের বক্রোক্তি-দম্ভোক্তি ইত্যাদি ঘটনা মানুষ ভালো ভাবে নেয়নি। অনেকগুলো ক্ষত তৈরি হয়েই ছিল। সুতরাং যাঁরা সেদিন বা আজও কম্যুনিজম্‌কে ঘৃণা করছে, নিশ্চয় তাদের কাছেও অজস্র যুক্তি আছে। আবার এমনও বহু মানুষ আছেন, যাঁরা কম্যুনিজম্‌কে নয়, ঘৃণা করেছেন তথাকথিত সরকারি বামপন্থীদের।

চৌত্রিশ বছরের বাম জমানার অবসান ঘটানোর জন্য তখনকার বিরোধী নেত্রীর কৃতিত্ব অস্বীকার করার কোনও প্রশ্নই নেই। ছল-বল-কৌশল, মিথ্যাচার, ক্রমাগত মিথ্যা-প্রচার –এ সব রাজনীতির অঙ্গ। দোষারোপ অর্থহীন। ক্ষমতার গন্ধ পেয়ে তিনি বাম-বিরোধী সমস্ত শক্তিকে সং গঠিত করতে পেরেছিলেন। এমন কী, কিছু বামাদর্শের রাজনৈতিক দলও আর একটি বাম সরকারকে উৎখাত করার জন্য তার সমর্থনে জোট বেঁধেছিল। কৃতিত্ব অবশ্যই বিরোধী নেত্রীর। ক্ষমতায় আসার পর দক্ষ কূটনীতির চালে অদরকারী এবং ভবিষ্যতে ক্ষতিকারক হতে পারে, এমন শক্তিকে নিকেশ করলেন, বর্জন করলেন। দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত সঙ্গীদের নিয়েই নিজস্ব বৃত্ত তৈরি করলেন। এটি ছিল অন্তর্বলয়। আর একটি বহির্বলয়ে স্থান দিলেন সহযোগী শক্তিগুলিকে। বাংলার সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের এবং অন্যান্য জগতের বিশিষ্টজন, যাঁরা এই লড়াই-এ তাকে সমর্থন করেছিল এবং পরবর্তীতে ক্ষমতার পদলেহী কিছু মানুষ এই বহির্বলয়ে স্থান পায়।

কিন্তু প্রশ্ন হ’ল, পরিস্থিতির এই অবস্থায় পৌঁছনোর জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রণনীতিই কি সর্বাংশে কাজ করেছে ? সেটাই কি একমাত্র কারণ ছিল ? বাম-ঐক্য কেন রুখতে পারল না এই ভাঙন। এ কথা ঠিক, সমস্ত বিরোধী শক্তি একজোটে এই সরকারের পতন চেয়েছিল। যে জনশক্তি ছিল বামেদের দাঁড়িয়ে থাকার মূল স্তম্ভ, পার্টি সেই সাধারণ মানুষের থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছিল। মানুষও তাদের ‘চোখের মনির মত’ সরকার এবং পার্টি থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছিল। ছোটখাটো নেতাদের উদ্ধত আচরণ, চাপা একটা সন্ত্রাসের আবহ, সীমাহীন স্বজনপোষণ, গ্রামেগঞ্জের নেতাদের অনৈতিকতা, নেতামন্ত্রীদের সংগ্রাম-বিমুখতা, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের হাল ফেরাতে না পারা – মানুষ সত্যি বদল চেয়েছিল। এই বদল ঘটানোর জন্য যতটা না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সমগ্র বিরোধী জোত দায়ী, তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী বাম-সরকার নিজে এবং বামদলগুলি। মানুষ যতটা না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্যারিশমা দেখে ভোট দিয়েছে, তার চেয়ে বেশি ভোট দিয়েছে যে ভাবে হোক এই সরকারের বদল চেয়ে।

তবু, অবস্থা বোধহয় এর চেয়ে কিছুটা ভালো ছিল। মোটামুটি একটা গণতান্ত্রিক আবহ ছিল। যে রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে গেছেন বিধান রায়, প্রফুল্ল সেন, অজয় মুখোপাধ্যায়, সেখানে জ্যোতি বসু, এমন কী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পর্যন্ত বেমানান মনে হয়নি। যে রাজ্যে রাজনীতি করে গেছেন চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষচন্দ্র বসু, উমেশ ব্যানার্জী, বিধানচন্দ্র রায়, মুজাফ্‌ফর আহ্‌মেদ, প্রমোদ দাশগুপ্তের মত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব – সেখানে অশোক মিত্র, বিনয় কোঙার, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, অরুণাভ ঘোষ, তথাগত রায় পর্যন্ত তবু চলে যায় – কিন্তু তারপর যা পড়ে রইল, এই বাংলার বরাবরের রাজনীতির সভ্য, মার্জিত, সংস্কৃত রূপের আবহমান ধারাটি তারা তছনছ করে দিলেন।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই দক্ষ দাবাড়ুর মত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মরণ-পণ চালের কাছে, কূতনীতির কাছে, রাজনীতির কাছে চালবাজির কাছে বামদলের পোড়খাওয়া দক্ষ রাজনীতিক বাহিনী হেরে গেছে। কিন্তু আবারও বলছি, নেত্রীকে তার কাজের জন্য কৃতিত্ব দিলেও, ক্ষেত্র বামসরকার এবং পার্টিই তৈরি করে দিয়েছিল তাদের অবিমৃষ্যকারিতা দিয়ে। বোঝেনি, এক একটা দাম্ভিক উক্তি জনমানসে কেমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে পারে একদিন দু’শো পঁয়ত্রিশ আর পয়ঁত্রিশের তুল্যমূল্য অহংকারী ঘোষণা। 

বাম-সরকার আর পার্টি সমার্থক হয়ে গিয়েছিল। সরকারি আমলাদের অপদার্থতা, নৈতিক স্খলন, জমি অধিগ্রহণের নীতি, অন্যান্য কিছু ভুল সরকারকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার কথা ছিল পার্টির। ভুল সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার কথা ছিল পার্টির। ছোট শরিকরা দু’একবার মিঁউ মিঁউ করেছে, তাতে কোনও কাজ হয়নি। মার্ক্সবাদী কম্যুনিস্ট পার্টি কেন তখন সরকারের সমালোচনা করল না। তারাও কি চেয়েছিল ভুলটা ধামাচাপা দেওয়া যাক। কেন সরকারের সব সিদ্ধান্তকেই অন্ধের মত সমর্থন করে গেল। কেন সরকারকে সাবধান করেনি অসাধু আমলা, ধান্দাবাজ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। “ওরা আমাদের সমর্থক”—এই যুক্তির কাছে মাথা নুইয়েছে পার্টি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে চাপ দেয়নি কেন। বিশেষত শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক জনসমর্থন বিরোধী সরকারি ফরমানকেই সমালোচনা না করে স্বাগত জানিয়েছে। ক্ষেত্র সরকার এবং পার্টি, উভয় মিলেই তৈরি করে দিয়েছিল কোনও এক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য। ‘কোনও এক’ বললাম এই জন্য যে, তিনি যে কেউ হতে পারতেন। মমতা, প্রমিতা, অমল, বিমল বা ইন্দ্রজিৎ। পড়ে-পাওয়া ঘুঁটিগুলো চমৎকার সাজিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কুড়িয়ে-পাওয়া সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে তার মত কূটবুদ্ধিসম্পন্না রাজনীতিকের অসুবিধা হয়নি। সমস্ত পরিবেশ কার্যকারণযোগে দশচক্রে ভগবান ভূত হওয়ার মত তার অনুকূলে এসে গিয়েছিল। প্রবল একটা হাওয়া উঠেছিল পরিবর্তনের। ঝড়ের মুখে খড়কুটোর মত উড়ে গেল কয়েকটা দীর্ঘযুগ। লক্ষ মানুষের কান্নাঘামরক্ত দিয়ে তৈরি একটা দল। আবার যদি এই পার্টিকে উঠে দাঁড়াতে হয়, তবে মুখ থেকে কোকের বোতল সরিয়ে, আমেরিকা-আলবেনিয়া-কিউবার কথা ভুলে রংপুর থেকে আসা লুঙি পরে অবিরত সাইকেল চালিয়ে গ্রামে-গ্রামান্তরে ঘুরে সংগঠন গড়ে তোলা আরও অনেক বলরাম সাহা, কেষ্ট দাস, অমৃত মুখার্জী, স্বদেশ পাল, ভোলা মুখার্জীর দরকার। আবার যদি গ্রামে গ্রামে ঘুরে জনসংযোগের মাধ্যমে গণসংগঠন গড়ে তোলা যায়, যদি তাঁদের মত জাগতিক সুখদুঃখের বিলাসিতা ভুলে শুধুমাত্র আদর্শের জন্য এগিয়ে আসতে পারে নতুন একটা প্রজন্ম, তবেই হয়তো পার্টি আবার উঠে দাঁড়াতে পারবে।

কিন্তু মুশকিল আছে। সেই সময় পক্ষে কতগুলো সমীকরণ কাজ করেছিল। তেভাগা আন্দোলনের টাটকা স্মৃতি, তার অভিজ্ঞতা, দেশ ছেড়ে এসে নতুন ইহুদি হওয়ার মানসিক যন্ত্রণা, ফলে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ক্ষোভ – সহজেই দানা বেঁধেছিল কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন। শহর জনজোয়ারে উত্তাল হয়ে উঠেছে সরকারবিরোধী আন্দোলনে। তাকে যোগ্য সহযোগিতা করে গেছে বামপন্থী, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। গানে, নাটকে, চলচ্চিত্রে, সাহিত্যে মুখর হয়ে উঠেছিল মানুষের প্রতিবাদের ভাষা।

বাম আমলের ‘ধীরে খাও, দিয়ে খাও’ নীতি রাতারাতি পালটে গেল। শুরু হ’ল অন্য কায়দায় শাসন। প্রতিবাদের মুখগুলোকে চুপ করিয়ে রাখার জন্য সরাসরি শাসানি। কেউ সরকারের সমালোচনা করবে না, কেউ কোনও সামাজিক অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে না, কেউ নারী নিগ্রহের প্রতিবাদে পথে নামবে না, চাষিরা ন্যায্যমূল্যে সার পাচ্ছে না কেন – কেউ সে প্রশ্ন করবে না, কেউ কোনও অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুলবে না।করলেই তুমি মাওবাদী, করলেই তোর বাপ সিপিএম ছিল, করলেই সরকারকে হেয় করার চক্রান্ত, করলেই নাশকতার ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব খাড়া করা হতে লাগল। এমন কী – রাশিয়া, স্পেন, ইটালির কথা মনে পড়ে – নির্দোষ রসিকতার মূল্য চোকাতে হ’ল অধ্যাপককে।

বাম শাসনের অবসান চেয়ে, পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিলেন রাজ্যের শিল্পীসাহিত্যিক, কলাকুশলীদের এক বৃহদংশ। খুব প্রভাবিত হয়েছিল শহুরে নাগরিক। নন্দীগ্রামে গুলিচালনার প্রতিবাদে পথে নেমেছিল সহস্র সাধারণ মানুষ। আমিও হেঁটেছিলাম। কিন্তু খুব আশ্চর্যের বিষয়, পরবর্তীতে সরকারের কোনও অন্যায় সিদ্ধান্ত, নেতামন্ত্রীদের অনৈতিক কার্যকলাপ, পথেঘাটে নেতামন্ত্রীদের ঔদ্ধত্য, সিন্ডিকেট-প্রোমোটাররাজ –এসব দেখাও এরা কাঠপুতুলের মত নির্বাক রইলেন। প্রতিবাদে পথে নামলেন না। অথচ, পূর্ববর্তী সরকারের এই ধরণের অনৈতিক ক্রিয়াকলাপ নিয়ে এরা চ্যানেলে চ্যানেলে মুখর হয়ে ছিলেন। এদের কারও গলা দিয়েই প্রতিবাদের কথা উচ্চারিত হ’ল না। কোন এক অদৃশ্য বন্ধনীতে এদের ঠোঁট বন্ধ রইল। কে জানে, কোথায় বন্ধক দিয়ে রেখেছেন নৈতিক শক্তিটুকু। অন্যায়কে অন্যায় বলার সৎসাহসটুকু।

প্রসঙ্গত বলা ভালো, দিনবদলের ডাক-দেওয়া সেই সব বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই পরে বিভিন্ন ভাবে রাজানুগ্রহ লাভ করেছেন। সাংসদ, মন্ত্রী, বিভিন্ন কমিটির চেয়ারম্যান, প্রেসিডেন্ট, উপদেষ্টামণ্ডলীর সভ্য। অনুগত লেখক-শিল্পীরা পেয়েছেন সরকারি খেতাব। বিভিন্ন ভূষণে ভূষিত হয়েছেন তারা।

২০১১-এর পালাবদলের পর সরকারের কাজকর্মের খতিয়ান নিলে দেখা যাবে কাজ কিছু হয়নি, তা নয়। অনেক কাজ হয়েছে। সেটাই তো স্বাভাবিক। রাজ্যের উন্নয়নই তো সরকারের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। কিন্তু অনেক কেন্দ্রীয় সরকারের প্রোজেক্ট তাদের টাকায় সম্পন্ন হলেও গ্রামেগঞ্জের সাধারণ মানুষের ধারণা এটা এই সরকার করে দিয়েছে। গ্রামগঞ্জের সাধারণ অশিক্ষিত মানুষ তো দূরের কথা, শহুরে শিক্ষিত মানুষের ক’জন খবর রাখেন কোন কাজ কোন সরকারের। বিরোধী দলগুলোর এমন ছন্নছাড়া অবস্থা, সত্যিমিথ্যেটুকুও তারা সঠিক ভাবে প্রচার করতে পারে না। মাঝে নেপোয় দই মেরে চলে যায়। কাজ হয়েছে। গ্রামেগঞ্জে যোগাযোগের ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। দু’টাকার চাল, কন্যাশ্রী, সাইকেল – যে কথা ভেবে এসব প্রকল্প চালু করা হয়েছিল, সেটা সম্পূর্ণ সফল। প্রতিটি প্রকল্পের পেছনে সুদূরপ্রসারী ভাবনা কাজ করেছে। প্রগতির ফলের কথা ভেবেই উন্নয়নের কাজ হয়েছে, অন্তত কিছু ক্ষেত্রে তো বটেই। তবু বলব, চুরিচামারির ভেতরেও কিছু কাজ হয়েছে।

এ রাজ্যে রাজনীতির একটা সুষ্ঠু পরিমণ্ডল ছিল। যার যে রাজনৈতিক আদর্শ পছন্দ, সে সেই রাজনীতি করেছে। রাজনৈতিক ভাবেই চাপান-উতোর চলেছে। আমার এই প্রায় সত্তর বছর বয়সে এসে এই প্রথম দেখলাম নোংরা, কুৎসিত ভাষায় বিরোধী পক্ষকে আক্রমণ। তবে এ ব্যাপারে প্রগতিশীল বামেরাও পিছিয়ে নেই। তাদেরও অতীত এবং বর্তমান রেকর্ড ভালো নয়। ভাবতে অবাক লাগে একদিন এ রাজ্যের ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মত বাগ্মী সাংসদের ভাষণ শুনে মুগ্ধ হয়েছে বিরোধী নেতারাও, হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছে, আজ সেই পার্লামেন্টে পশ্চিমবঙ্গের সাংসদরা মাথায় কলসি, হাতে কুলো, কাঁখে কয়লায় ঝুড়ি নিয়ে ধরণা দিচ্ছে। সাংসদ বলছে – ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে রেপ করিয়ে দেব। এ কোথায় নেমেছে রাজনীতি। এমন দেউলেপনা, এমন রুচিহীন, বিকারগ্রস্তের মত রাজনীতি করছে সুস্থ সংস্কৃতির পীঠস্থান পশ্চিমবঙ্গ। সরকারি বুদ্ধিজীবীর দল নিশ্চুপ। মুখে কুলুপ। অনেকে আবার কুযুক্তি দেখিয়ে দোষ খণ্ডানোর চেষ্টা করে। চৌত্রিশ বছরের কথা বলে। যেন ‘ব’ চুরি করেছে, সুতরাং ‘ত’-এর চুরি আইনত সিদ্ধ হয়ে গেছে। একটা অন্যায়কে আর একটা অন্যায় দিয়ে জাস্টিফাই করার চেষ্টা।

এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা ভালো নয়। খুব দ্রুত মেরুকরণ ঘটে যাচ্ছে। এই সরকারের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি অতিরিক্ত নমনীয়তা, তোষণ-নীতি সাধারণ হিন্দু বাঙালি ভালো ভাবে নেয়নি। বিশেষত যাদের এখনও আপশোষ রয়েছে “ ওই পারে দালান, পুষ্কর্ণী, নাইহলের বাগান শ্যাখেরা ভোগ করতাসে”, যারা ঘরবাড়ি, ইজ্জৎ, সব হারিয়ে এখানে আবার শিকড় বসাতে চেয়েছেন এটাই তাদের প্রকৃত স্বদেশ – এই ভাবনায়, বুকে এখনও দগদগে স্মৃতির ক্ষত, তারা ব্যাপারটা একেবারেই পছন্দ করেনি। এই প্রথম বোধহয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা ভুল হিসেব করে ফেললেন।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতাদের উদ্ধত জবান, দু’একটি জায়গায় উৎসব নিয়ে অশান্তি – কড়াহাতে দমন করার ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছেন তিনি। পূর্ববর্তী একজন মুখ্যমন্ত্রীর মত বলতে পারেননি – এ রাজ্যে দাঙ্গা করতে এলে মাথা গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। সাম্প্রতিক কালে দু’ সম্প্রদায়ের ভেতরে এ রকম অবিশ্বাসের আবহ এর আগে আমি দেখিনি। কাজচালানো গোছের যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানটুকু ছিল, সেটাও বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এ বড় সুখের সময় নয়। এখন যা দেখা যাচ্ছে, তা সত্যি উদ্বেগের কথা। সাধারণ, মধ্যবিত্ত বাঙালি ভয় পেয়েছে। এবং আরও ভয়ের কথা এই ভয় থেকে উত্তরণের জন্য যার অভয়বাণী দেবার কথা, তিনি আশ্চর্যজনক ভাবে নীরব রইলেন। সমস্ত পৃথিবীতে যখন ইসলাম জগতে নারীমুক্তি আন্দোলন ক্রমশ জোরদার হয়ে উঠছে, আধুনিক প্ররথিবীর দিকে তাকাবে বলে তারা বোরখা ছেড়ে মুক্ত অক্সিজেন নিতে চাইছে, তিন তালাকের মত একটি নিষ্ঠুর ও পুরুষতান্ত্রিক নিয়মের শৃঙ্খল থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে, তখন আমাদের সরকারের প্রতিনিধি সেই তিন তালাকের সমর্থনে বলছেন – কে কার সঙ্গে থাকবে, সেটা তারাই ঠিক করুক। এ যেন শাহবানু মামলায় রাজীব গান্ধীর ভূমিকারই নব্য-সংস্করণ। আলমদুলিল্লাহ্‌।

এ সব ধর্মীয় নেতারা সাধারণ আতরাফ শ্রেণির নিম্নবর্গীয় মুসলমান নয়। এরা বহিরাগত আশরাফ শ্রেণির। সাধারণ খেটে-খাওয়া মুসলমানদের ওপর হয়তো এদের বিরাট প্রভাব আছে, সরকারি পলিসি বোধহয় সে রকমই ভেবেছিল। তাই এদের বেয়াড়াপনা দেখেও প্রশাসন আশ্চর্যজনক ভাবে নীরব থেকেছে। আর সেখানেই ভুল বার্তা গেছে। এখন দেখা যাচ্ছে প্রচুর সাধারণ মুসলমান এ সব ফতোয়া অস্বীকার করছে। বলছে, এ সবের সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্ক নেই। বলছে – বরকতি হুজুরের কথা আমাদের কথা নয়। উনি এ রাজ্যের সবশ্রেণির মুসলমানের প্রতিনিধি নন। আর এখানেই বর্তমান সরকার একটু থমকে গেছে। তা হলে কি কিছু ভুল হ’ল। একে তো এক রকম হিসেব কষে ধর্মগুরুদের প্রতি নমনীয়তা দেখানো হয়েছে, তাদের নানারকম সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে এই ধর্মগুরুদের কথাই শেষ কথা নয়। মুসলিম সমাজে মুক্তচিন্তার মানুষও প্রচুর রয়েছে। আবার, এদের প্রতি নমনীয় থাকতে গিয়ে খুব দ্রুত একটা ভাঙন ধরে গিয়েছে। খুবই ভয়ের এবং আশঙ্কার কথা দ্রুত মেরুকরণ ঘটছে পশ্চিমবঙ্গে। নিরপেক্ষ বাঙালি রামনবমীর মিছিল দেখে খুশি হচ্ছে। হাটেমাঠে, চায়ের দোকানে কথা বলে বুঝেছি যত লোক মিছিলে ছিল, তার অন্তত একশ গুণ লোক এই মিছিলকে সমর্থন করেছে। এ কী অশনিসংকেত নয়।

ইদানীং শুরু হয়েছে এ রাজ্যে বসে কিছু ধর্মীয় নেতার ‘ফতোয়া’ দেওয়ার আস্ফালন। আমরা, যারা বাংলার আবহমান ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গে আবাল্য পরিচিত, তারা 'ফতোয়া' শব্দটি ক্বচিৎ শুনেছি। পির, ফকির,ইমাম, মহরম, আজান, কোরান,ইদ, ইফতার, সালাম অনেকটাই হিন্দু বাঙালির গ্রহণীয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু 'ফতোয়া' কখনওই হয়নি। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই হিন্দু সমাজেও ফতোয়া ছিল, অন্য নামে। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বাড়বাড়ন্তের সময় উচ্চবর্ণের মানুষ তুচ্ছ অপরাধেই নিম্ন বর্ণের মানুষকে বিধান দিয়ে জাতিচ্যুত করেছে, সমাজ থেকে তাড়িয়ে দেবার ফরমান জারি করেছে। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, আরও অনেক সমাজ সংস্কারকদের যুদ্ধের ফলে এবং, অবশ্যই ডিরজিওপন্থী নব্যযুবাদের আধুনিকতা, ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে হিন্দুদের এগিয়ে আসা ইত্যাদি কারণে উচ্চবর্ণের মানুষদের সেই বিধান দেবার প্রবণতা ক্রমশ কমে যায়। ধর্মের কড়া কানুনের শৃঙ্খলা অনেকটাই শিথিল হয়ে যায়। মুক্ত চিন্তার প্রসার ঘটে হিন্দু বাঙালিদের ভেতরে। 
" ফতোয়া" ইসলাম শাস্ত্রসম্মত রায় বা নির্দেশ। ফতোয়ার প্রয়োজন পড়ে তখনই, যখন কোনও ব্যক্তি বা কোনও বিচারক কোরান বা হাদিস থেকে প্রাপ্ত শরিয়ত বা ফিকাহ্‌ গ্রন্থগুলিতে উদ্ভূত সমস্যার সন্তোষজনক সমাধানে পৌঁছতে পারেন না। ইসলামের আদি পর্ব থেকে ইমাম ও মুফ্‌তিদের দেওয়া বহু ফতোয়া সংগৃহীত হয়েছে। সেগুলিই ফিকাহ্‌ নামে পরিচিত। সাধারণ ভাবে একজন মুফ্‌তি ফতোয়া দেওয়ার অধিকারী।এই বিংশ শতাব্দীতেও কোনও কোনও মুসলিম রাষ্ট্রে ইসলামি ধর্মশাস্ত্রের পণ্ডিতদের নিয়ে ফতোয়া কমিটি গঠন করা হয়। ওই সব দেশে প্রচলিত আইনের পাশাপাশি ফতোয়াও কার্যকর হয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশে ফতোয়াকে নিছক ধর্মীয় অভিমত হিসেবে দেখা হয়। স্বাভাবিক ভাবেই তার কোনও আইনি বা সাংবিধানিক গুরুত্ব নেই। ভারতে তো নয়ই, বাংলাদেশের মত মুসলমান-প্রধান দেশেও ফতোয়াকে অসংবিধানিক বলে ঘোষণা করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও দুই দেশেই ফতোয়া দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ করা যায়নি। এ দেশে বেশির ভাগ ফতোয়া দিয়ে থাকেন দারুল উলুম দেওবন্দের মুফ্‌তিরা। সেই ফতোয়া ে দেশের মুসলমানেরা কতটা গ্রহণযোগ্য মনে করেন, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। ২০০৭ সালের জুলাই মাসে দেওবন্দের এক মুফতি ছেলেমেয়েদের একই স্কুলে পড়া নিষিদ্ধ করে ফতোয়া দেন। তার কয়েক মাস আগেই মুসলমানদের জন্য জীবন বীমা বে-আইনি ঘোষণা করে ফতোয়া জারি হয়। তারও আগে উত্তরপ্রদেশের একটি গ্রামে ইমরানা নামের এক মহিলাকে তাঁর শ্বশুর ধর্ষণ করলে ওই মাদ্রাসা থেকে ফতোয়া দেওয়া হয় ইমরানা আর তার স্বামীর সঙ্গে বাস করতে পারবে না। নারীদের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারির প্রবণতা বেশি। নারী নিজের অধিকারের জন্য যত সচেতন হচ্ছে, এই ধরণের ফতোয়া তত বাড়ছে। ধর্মের সঙ্গে নারী-প্রগতির সঙ্ঘাতের ফলেই ফতোয়ার প্রবণতা বাড়ছে। (চলতি ইসলামি শব্দকোষ, মিলন দত্ত)
সাত আট'শ বছর ভারত শাসন করেছে বাঙালি মুসলমান নয়, বিদেশি মুসলমান। তাঁদের উত্তরপুরুষদের রক্তে এখনও সেই অহংকার রয়েছে। ক্ষোভ রয়েছে এখন পরাধীন হয়ে থাকার। বিদেশাগত উচ্চবর্ণের আশরাফ এরা। সৈয়দ, শেখ, মুঘল, পাঠান। ভারতের সঙ্গে বার বার যুদ্ধে এরাই জয়ী হয়েছেন, বিজিতের ভূমিতে বসবাস করেছেন যাঁরা ফিরে যাননি। এদের অর্থের জোর ছিল। বড় বড় শহরে এরা স্থায়ী ভাবে কায়েম হ'ন। তা ছাড়া উচ্চবিত্ত আমির-ওমরাহ্‌, নবাববংশের উত্তরাধিকারীরাও নগরেই থিতু হ'ন। কলকাতার কথাই যদি ধরা যায়, এদের ভেতরে অনেক রকম মানসিকতা কাজ করেছে। শহরে সংখ্যালঘু হওয়ার জন্য জোট বেঁধে থাকার প্রবণতা (প্রাণীমাত্ররই এই প্রবণতা থাকে), অপ্রয়োজনেও আস্ফালন করে পায়ের তলার মাটি শক্ত করা, ধর্মের কড়া অনুশাসনে নিজের কৌমকে সংগঠিত করা রাখা, ভোটার হিসেবে যতটা পারা যায় সুবিধা উসুল করে নেওয়া। এবং পূর্বপুরুষের সংস্কৃতিকে হারিয়ে যেতে না দেওয়া। 
এরা বাদেও এক বিশাল সংখ্যক মুসলমান রয়েছে পশ্চিম বাংলায়। রয়েছে শিক্ষিত এবং প্রকৃত অর্থেও আলোকপ্রাপ্ত, আধুনিক-মনস্ক মুসলমান। এরা আজ এই সব মৌলবি, মুফতি, বরকতিদের সামাজিক সর্দারি সরাসরি অস্বীকার করছেন। হয়তো একদিন সত্যি আমাদের দেশের মুসলমান সমাজ পরিপূর্ণ ভাবে আধুনিক হয়ে উঠবে। মনুষ্যত্বের পক্ষে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে ওরাই স্বর তুলবে। ইমামভাতা নয়, চাই আরও আধুনিক শিক্ষা, চাই আরও স্বাস্থ্য নিকেতন। কয়েক জন ধর্মগুরুর নির্দেশ এই বাংলার সমগ্র মুসলিম সমাজের কণ্ঠ নয়। ("ধর্মীয় মেরুকরনের সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক মেরুকরণও হচ্ছে। পশ্চিম বাংলাতে মুসলমান সমাজের অধিকাংশ বাঙালি। কিন্তু যে ইসলামিক আচার আমরা দেখি তা কিন্তু বাঙালি মুসলমানেরা পালন করেননা। বাঙালি হারিয়ে না যায়।" -- আরিফ আহমেদ।)

এক ক্রান্তিকারী সময়ে বসে আছি। আগের সরকারের অবিমৃষ্যকারিতার ফল ভালোমন্দ মিশিয়ে ভোগ করছি, কিন্তু এই সরকারের অবিমৃষ্যকারিতার ফল আরও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কী করতে পারি আমরা ?

মনুষ্যত্ববোধের অহংকার মানুষকে প্ররোচিত করে যে কোনও রকমের ভাঙন, যা তার এবং তার প্রজাতির অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলতে পারে – তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। বিভিন্ন জনের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন হয়। কেউ ওয়ার অ্যান্ড পিস লেখেন, কেউ কমোডে বসে মেঝেয়ে থুথু ফেলেন, কেউ গেয়ে ওঠে উই শ্যাল ওভারকাম, কেউ রিকশাওয়ালা পেটায়, কেউ ডেপুটেশন দেয়, কেউ পুলিশকে খিস্তি দেয়, আবার কোনও কবি বন্দুক হাতে গ্রানাডা পাহাড়ে চলে যান তবে সব কিছু এত সহজে হয় না। রক্তে বিরুদ্ধগতির প্রবাহও থাকে। অনেক প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীও পাকিস্তানের সঙ্গে খেলা থাকলে এক্সট্রা উত্তেজনায় জারিত হ’ন। কোথা থেকে আসে এই এক্সট্রা ? এও কভারেজ। রাষ্ট্র বা তার নিজের অস্তিত্বের সংকটের বিরুদ্ধে এক রকম ডিফেন্স মেকানিজম্‌। এক ধরণের পোকা আছে, বিপদ দেখলে দুর্গন্ধময় রস ছড়ায়।

মানুষ নামক জটিল প্রাণী অসীম অনন্ত এক রহস্যে মোড়া। আপাতভাবে মনে হয় শান্ত নদীর জল। কিন্তু অনেক চোরাপাথর, মগ্নমৈনাক থাকে জীবনের গভীরে। রহস্যের গোপন কন্দরে ডুবে থাকে সেই সব ডুবোপাহাড়। অসীম বিশ্বাস ও কোটি টাকার অহংকারী টাইটনিকও ডুবে যায় কত সহজে।

বয়স যখন সত্তরের দিকে ঢলে পড়েছে, যখন ভবিষ্যৎ বলে আর কোনও উজ্জ্বল আকাশ নেই, তখন বারে বারে পেছন ফিরে দেখা ছাড়া আর কিছু থাকে না। তবু বর্তমানও নাছোড়বান্দা নীল ডুমো মাছির মত বিনবিন করতে থাকে। লিখি, পুরনো দিনের কথা। আমার বাল্যের মহানন্দা, কৈশোরের শিলিগুড়ি, যৌবনের টালমাটাল সময়ের কথা। প্রথম প্রেমিকার অকাল-মৃত্যু ও এখনও তার স্বপ্নে আমার অশ্রুপাত।

“শিকড়ের ডানা হোক, ডানার শিকড়” --- হুয়ান রামোন হিমেনেথ।

(শেষ)
0

স্মৃতির সরণী - বিপুল দাস

Posted in

স্মৃতির সরণী


কথামালা
বিপুল দাস


১৯৭১-এ ইন্দিরা গান্ধী রাষ্ট্রপতি শাসনের সুযোগ নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে নকশাল দমনের কাজে ব্যবহার করতে শুরু করলেন। সঙ্গে রাজ্য-পুলিশ এবং প্যারা-কমান্ডোদের এই মিলিত আক্রমণের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন স্টিপল্‌চেজ’। সিপিএম-এর ক্যাডাররা নকশালদের মারছে, কংগ্রেসি গুণ্ডারা মারছে, পুলিশ মারছে, মিলিটারি মারছে। পার্টির নেতৃত্বও তখন আর প্রশ্নহীন, অবিসংবাদিত নয়। দল ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন অনেক তাত্ত্বিক নেতা। বহু তরুণের তাজা প্রাণের রক্তে ভিজে আছে পশ্চিমবাংলার মাটি। ক্ষতবিক্ষত, ছিন্নভিন্ন দল থেকে বেরিয়ে তৈরি হচ্ছে অসংখ্য উপদল। যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল কাকদ্বীপ থেকে তেলেঙ্গানা, শ্রীকাকুলাম থেকে গোপীবল্লভপুর, অন্ধ্রে, উড়িষ্যায়, মধ্যপ্রদেশে, বিহারে, উত্তরপ্রদেশে – তার উৎসভূমির প্রদীপ নিভে আসছিল। কিন্তু অগ্নিশিখাটুকু নেভানো যায়নি। এখনো তারা তাদের আদর্শের জন্য লড়াই করে যাচ্ছে জেহানাবাদে, জঙ্গলমহলে, সীতামাঢ়ীতে, অন্ধ্রে। কিন্তু চারু মজুমদারের লাইন থেকে অনেক দূরে তাদের রণনীতি। ভূমিহীন কিষাণের অধিকারের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম নয়, তারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধের ডাক দিয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের সেই আন্দোলনের রূপরেখা ও তার প্রয়োগের ত্রুটিবিচ্যুতি অনেক আলোচনা, অনেক লেখালেখি হয়েছে। শৈলেন দেবনাথের মতে –

একঃ চারু মজুমদারের গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার রণনীতি ভুল ছিল। এই লাইন সার্থক ভাবে প্রয়োগ করতে হলে গ্রামীন শ্রমিককৃষক বাহিনীকে যে রাজনীতির শিক্ষা দেওয়া দরকার ছিল, তা দেওয়া হয়নি। গেরিলাযুদ্ধের রণকৌশল শেখানো হয়নি। অস্ত্র বলতে সামান্য কিছু ছিনতাই করা পুলিশের রাইফেল আর জোতদারের গাদা বন্দুক। চারু মজুমদার ভেবেছিলেন এ ভাবেই সরকারকে বাধ্য করবেন সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতির দিকে।

দুইঃ কানু সান্ন্যালের আপত্তি সত্ত্বেও জনভিত্তির ওপর জোর না দিয়ে গোপন সংগঠনের ওপর জোর দেওয়া। গোপনীয়তা বজায় রাখার ব্যাপারে এই গোপন সংগঠনগুলোর মধ্যে দ্রুত যোগাযোগের অব্যবস্থা।

তিনঃ শহুরে মধ্যবিত্ত মানসিকতার যুবকদের প্রকৃত রাজনৈতিক শিক্ষা ছাড়াই, তাদের সম্পর্কে ঠিকঠাক খোঁজখবর না নিয়েই পার্টির কাজের দায়িত্ব দেওয়া। প্রকৃতপক্ষে এক সময় কোনও একটি অঞ্চলের প্রায় সমস্ত কিশোর এবং যুবকরাই নকশালপন্থী হয়ে গিয়েছিল। রাজনৈতিক ক্লাস নিয়ে ভারতবর্ষ এবং পৃথিবীর ইতিহাস, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে লড়াই-এর কৌশল, দেশি পুঁজি-বিদেশি পুঁজির শোষণের পদ্ধতি – ইত্যাদি বিষয়ে তাদের খুব কমই বোঝানো হয়েছে। এক ধরণের নায়কোচিত বীরত্বের আবেগে সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখত এরা। স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল।

চারঃ রাজনৈতিক সভাসমাবেশ, সঠিক প্রচার ইত্যাদির দ্বারা জনভিত্তি সুদৃঢ় করার বদলে ব্যক্তিহত্যার লাইন, ফলে জনসমর্থনও যেটুকু ছিল, শেষের দিকে সেটাও আর ছিল না। প্রকৃত পক্ষে কে প্রকৃত শ্রেণিশত্রু, সেটা নিয়ে দলের কর্মীরাই সংশয়ে ভুগেছে। এমনও দেখা গেছে, যে মানুষটি পার্টির সহায় বা সমর্থক হতে পারত, শুধুমাত্র ধনী হওয়ার অপরাধে খতম হয়ে গেছে।

পাঁচঃ ঠিকঠাক স্ক্রুটিনি না করে যেমন খুশি ক্যাডার নিয়োগ করে সংখ্যার বিচারে আত্মপ্রসাদ লাভ হ’ত, কিন্তু তার ফলে দলে বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের স্পাই, এবং অবশ্যই পুলিশের গুপ্তচর বাহিনী দলে ঢুকে পড়েছিল। গোপন সভাসমাবেশের কথা দ্রুত পুলিশের কাছে পৌঁছে যেত।

একদম সঠিক বিশ্লেষণ করেছেন শৈলেন দেবনাথ। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা হবে, অথচ যোদ্ধা হচ্ছে নবিশ আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা শহুরে কলেজের ছাত্র এবং আনাড়ি কৃষক। রণকৌশল তৈরি না করেই, তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না দিয়ে গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার ডাক দেওয়া হ’ল। কানু সান্ন্যালের আপত্তি সত্ত্বেও গোপন সংগঠনের ওপর জোর দেওয়া। রাজনৈতিক ভাবে সংগ্রামকে এগিয়ে না নিয়ে ব্যক্তিহত্যার রাজনীতি। আদপেই শ্রেণিশত্রু নয়, এমন নিরীহ মানুষকে খতম করার চুল হিসেব। দলে কে পঞ্চমবাহিনীর লোক, সে সব মনিটরিং করার কেউ ছিল না। গোপন খব্র অতি সহজেই ফাঁস হয়ে যেত। গুরুত্বপূর্ণ নেতারা অভাবিত ভাবে ধরা পড়ে যেতেন।

১৯৬৭ তে আমি কলেজে, সেকেন্ড ইয়ার। আজ আমার এই ৬৭ বছর বয়সে পেছন ফিরে তাকিয়ে কত অস্পষ্ট ছবি ভেসে ওঠে। টুকরো টুকরো হয়ে গেছে সিপিআই এম এল। আমি কোনও দিন অ্যাকশন স্কোয়াডে ছিলাম না। এমন কী ওয়াল-পোস্টারিংও করিনি। পড়াশোনা করতাম। নতুন ছেলেদের সঙ্গে কথা বলে দেখতাম ওরা কেউ সোনাম ওয়াংদির নামও শোনেনি, এম এন রায় তো দূর অস্ত্‌। বুঝতাম ওরা অ্যাকশনে যেতে বেশি আগ্রহী। ওরা রেডবুকের নাম শুনেছে, চারু মজুমদারের ঐতিহাসিক আটটি দলিল পড়েনি। গল্পের ছলেই আমি প্যারি কমিউনের গল্প, রাশিয়ার বিপ্লব, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং বিশ্বপুঁজির বাঁটোয়ারা নিয়ে পশ্চিমি শক্তির লড়াই, জাতপাতের ঊর্ধে উঠে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের ঐক্যের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র ও শ্রেণিহীন সমাজ গড়ার কথা বলতাম। খুব একটা সুবিধে হ’ত না। তা ছাড়া আমার নিজেরই তখনও অনেক সংশয় দূর হয়নি।

চারুদার পরিবারের সঙ্গে এখনও ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে। অসম্ভব ভালোমানুষ ছিলেন লীলাদি। বড় মেয়ে অনীতা মজুমদার ডাক্তার, ছোট মেয়ে মধুমিতা ভালো গল্পকবিতা লেখে, ছোট ছেলে অভিজিৎ মজুমদার শিলিগুড়ি কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক। নানারকম সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে অভিজিৎ জড়িত। এ ছাড়াও সিপিআই—এম এল( লিবারেশন) গ্রুপের সক্রিয় কর্মী।

মাঝে মাঝে নদীর পারে গিয়ে একটা পুরনো গাছ খুঁজি। গাছটা আর খুঁজেই পাই না। সেই নদী নেই। অনেক দূরের একটা কালো জলের আবিল নর্দমা হয়ে গেছে আমার প্রিয় মহানন্দা। যা ছিল টলটলে সবুজ জল, এখন পঙ্কিল, দুর্গন্ধময়। সেই গাছটার নীচে একদিন আমার মাথায় শোষণমুক্ত পৃথিবীর কথা বলেছিল দীপকদা। এই গাছের নীচে পুলিশের দালাল ননী মজুমদার শরীরে চৌত্রিশটা টাঙ্গির কোপের চিহ্ন নিয়ে পড়েছিল। এই গাছের নীচে রানাকে গুলি করে বর্ষার মহানন্দায় ভাসিয়ে দিয়েছিল সিদ্ধার্থ রায়ের পুলিশ। গাছটা নেই। পরে শুনেছিলাম কে নাকি ঐ গাছে ফাঁসি দিয়ে মরেছিল। আশপাশের লোকজন ভয় পেত। কেটে ফেলেছে ওরাই। নেই সেই মহাযুদ্ধের সাক্ষী। কেউ সেদিন বলেনি – বাছা তুমি রণে যাইও না। চৌদিকে কাফিরের দেশ, জহর মিলে তো পানি মেলে না। তিতাসের সেই বিখ্যাত জারিগান।

শাশ্বত একদিন একটা অদ্ভুত গল্প শুনিয়েছিল। ওর বাবা অনিল সরকার ছিলেন আমাদের পাড়ার স্কুলের হেডমাস্টার। তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান থেকে এসে আরও অনেক উদ্বাস্তুর মত কলোনিতে জমি পেয়ে ঘরবাড়ি তুলেছিলেন। ওপারেও তিনি শিক্ষক ছিলেন। কলোনিতে স্কুলের জন্য জমি দিয়েছিলেন স্থানীয় একজন পুরনো রাজবংশী জোতদার শ্রেণীর লোক। ওপারে সব ছেড়ে-আসা মানুষজন মাথার ওপরে আচ্ছাদন আর দু’বেলা কায়ক্লেশে নুনভাতের ব্যবস্থা করার পর হাত দিয়েছিলেন তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে লেখাপড়া শেখানোর ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে। প্রাথমিক ভাবে ওই ভূস্বামীর দলিজ ঘরে ক্লাসের ব্যবস্থা হয়েছিল। পরে সরকারি সাহায্য আর স্থানীয় মানুষের উদ্যোগে একটু একটু করে স্কুলটা গড়ে উঠেছিল।

ফালতু ধরা পড়েছিল শাশ্বত। সে সময়ে অবশ্য অনেকেই এ রকম ফালতু, শুধু সন্দেহের বশেই ধরা পড়ত। কোনও কালে কোনও পলিটিক্সের ভেতরেই সে ছিল না। নদীর পারে ছাতিমতলায় ননী মজুমদার খতম হয়েছে শুনে সে একেবারে কাঁচা গাণ্ডুর মত একটু বেশি রাতে স্পট দেখতে গিয়েছিল। সেখানে মোতায়েন ছিল জাসুসি পুলিশ। বর্ষায় ধানখেতে যেমন ধানগাছের নড়াচড়া দেখে কপাত্‌ করে পলো ফেলে শোলমাছ ধরে মানুষ, তেমনই কপাত্‌ করে তাকে ধরেছিল পুলিশ। ওরা নিশ্চিত ছিল শাশ্বত একজন ক্রিমিনাল। কারণ, আর্থার কোনান ডয়াল বলেই গেছেন অপরাধী তার অপরাধের স্পটে একবার ঘুরে আসবেই।

ভ্যানে তোলার আগে একজন পুলিশ তার পেছনে বন্দুকের নল ঠেসে ধরে বলেছিল – মাদারচোদ, রাজনৈতিক ক্ষমতার উস্‌সো বন্দুকের নল, অ্যাঁ ? দ্যাখ কেমন লাগে। শালা, মাও-সে-তুং তোর গাঁড়ে ভরে দেব এবার। ইন্ডিয়ার খাবি আর চায়নার ঢেকুর তুলবি। আর একজন সিপাই বলেছিল – এই দত্ত, বাই চান্স ফায়ার হয়ে যাবে। হা হা করে হেসে উঠেছিল দত্ত। বলেছিল – আরে সেও তো একরকম মারা-ই হবে। মাইরি, এদের পোঁদে নল ঠেকালেই আমার বডিতে কেমন হিট এসে যায়। শাশ্বত টের পাচ্ছিল তার রেক্‌টামে চাপ দিচ্ছে রাষ্ট্রের ধাতব-শীতল তীক্ষ্ণতা।

পেছনে বন্দুক ঠেকিয়ে ওকে একটু দূরে অন্ধকারে দাঁড়-করানো কালোগাড়িতে তোলা হয়েছিল। তখন আর একটা জিপ থেকে নেমে এসেছিল একজন কাঁধে স্টারলাগানো অফিসার। হাতে মোটা কালো কাঠের রুলার। শাশ্বত টের পাচ্ছিল এখনই মলমূত্রে তার পোশাক নষ্ট হয়ে যাবে। তার মুখের দিকে টর্চ মেরে কিছুক্ষণ দেখল সেই অফিসার। মদের গন্ধ পাচ্ছিল শাশ্বত।

আরে, এটাকে কে ধরে আনল ?

আমরা স্যার, আমি আর দত্ত। জানতাম, মাল ঠিক দেখতে আসবে।

মাল না বাল। এটাকে তো বাংলার ঠেকে রেগুলার বসে থাকতে দেখি। শালা, এখনই হেগেমুতে দেবে। এ করবে মার্ডার ? ধুস্‌, দেখছিস না লিভার পচে গেছে। একদিন জোরে কোথ্‌ পেড়ে হাগলেই লিভারমিভার সব বেরিয়ে যাবে। দু’দিন পরে এটা এমনই ভোগে যাবে।

শাশ্বত বুঝতে পারছিল না সে যে বাংলাপোষ্য নয়, বাপের কড়া শাসনে নিয়মিত কে সি নাগপোষ্য কিশোর, সে কথা বলে কোনও লাভ হবে কিনা।

নাম কী তোর ?

শা শা ...

দেব স্যার ? দেখুন আবার আপনাকে খিস্তি দেবার চেষ্টা করছে। বাহানচোদ...

চুপ করো দত্ত। আমাকে হ্যান্ডেল করতে দাও।

মারুন স্যার, আপনিই হ্যান্ডেল মারুন। দেখুন কিছু বেরোয় কিনা।

হ্যাঁ বল, কী নাম তোর ?

শাশ্বত সরকার। বাবার নাম ...

জানি, তোর বলতে হবে না। অনিল সরকার। এই এরিয়ার প্রত্যেকের ঠিকুজিকুষ্ঠি আমাদের জানা আছে। এত রাতে এখানে কী করতে এসেছিলি ? তুই জানিস না আজ এখানে একজনকে কুপিয়ে মারা হয়েছে।

তৎ... তখন আসতে সাহস হয়নি, এখন ভাবলাম একবার দেখে আসি জায়গাটা।

দেখাচ্ছি তোকে। দত্ত, একে জিপের পেছনে বসাও। ওই বাঁশঝাড়ের ওদিকটায় চলো।

দত্ত বুঝে গেল বাঁশঝাড়ের সামনে নামিয়ে একেও একই চিত্রনাট্য অনুযায়ী বলা হবে – যা পালা, ছেড়ে দিলাম তোকে। তারপর প্রাণভয়ে যেই ছুটতে শুরু করবে, পেছন থেকে সরকারি বুলেট পিঠ ফুটো করে দেবে। স্যারের হাত বড় চমৎকার। কালই কাগজে বেরোবে মিথ্যে এনকাউন্টারের গল্প।

বাঁশঝাড়ের পাশে অন্ধকারে জিপ দাড় করাল ড্রাইভার গুরুং। চোখের সামনে কত মার্ডার দেখল সে। শাশ্বতকে নিয়ে দত্ত নেমে এসেছিল। জিপের সামনে হেডলাইটের আলোর বৃত্তে তাকে দাঁড়াতে বলল এস আই চৌধুরী। বলল – যা ভাগ, বাড়িতে গিয়ে পড়তে বোস। যা যা, পালা জলদি।

এক মুহূর্ত থমকে গিয়ে প্রাণের ভয়ে দৌড়তে শুরু করেছিল শাশ্বত। গাড়ির আলোয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল প্রাণের ভয়ে মানুষ কেমন করে পালাতে চায়। দত্ত অপেক্ষা করছিল স্যারের নিখুঁত অ্যাক্‌শনের জন্য। স্যার এসে গাড়িতে বসে রইলেন। পালিয়ে বাঁচতে-চাওয়া ওই শরীরটার প্রতি তার কোনও আগ্রহ দেখা গেল না।

ছেড়ে দিলেন স্যার ? হতাশ গলায় দত্ত বলেছিল।

ধুস্‌ ওটা আর ম্যাক্সিমাম একমাস বাঁচবে। ফালতু একটা সরকারি বুলেট খরচ করে কী লাভ ? বুঝতে পারছ না, এটার নকশাল হওয়ার মত মুরোদ নেই। নকশাল হতে গেলে হেবি দম লাগে। শালা, প্রথম দিকে ফোর্সের মনোবলই ভেঙে দিয়েছিল। বউ দিনরাত কাঁদত। চাকরি ছেড়ে দিতে বলত। শ্বশুর কালীঘাটে পুজো দিয়ে এসেছিল।

শাশ্বত পালিয়ে যাওয়ার পর হয়তো এ রকমই কথাবার্তা হয়েছিল ওদের ভেতর। অনেক পরে শাশ্বত জেনেছিল সেই এস আই ছিল তার বাবার ছাত্র। এই শক্তিনগর কলোনি গড়ে ওঠার সময় বিনয় চৌধুরীও অনিল সরকারের সঙ্গে স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজে উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছে। সেই বিনয় চৌধুরীর ছেলে এখন এস আই আয়ুষ্মান চৌধুরী।
0

স্মৃতির সরণী - বিপুল দাস

Posted in


স্মৃতির সরণী 


কথামালা

বিপুল দাস



১৯৭০-এ পার্টির অন্তর্দ্বন্দ্ব বোঝা যাচ্ছিল। পার্টির একটা বড় অংশ ভারতবর্ষের মাটিতে চারু মজুমদারের নীতির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তোলে। ১৯৭১-এ পার্টি ভেঙে সত্যনারায়ণ সিং বেরিয়ে গেলেন। তার আগে বেরিয়ে গেছেন অসীম চ্যাটার্জী, সন্তোষ রাণা। আমাদের ধারণা ছিল সি এম কোনও দিন ধরা পড়বেন না। তিনিই তো গেরিলা যুদ্ধের কথা ছড়িয়ে দিয়েছেন। নিশ্চয় তিনি নিজেও গেরিলা কায়দাতেই পুলিশকে লেজে খেলাবেন। কয়েকবার ধরা পড়তে পড়তেও বেঁচে যান। কিন্তু যেদিন কাগজ পড়ে জানতে পারলাম চারু মজুমদার গ্রেপ্তার, সেদিন আমরা হতাশায় ভেঙে পড়েছিলাম। কেউ কারও মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারছিলাম না। এও জানতাম, অন্যান্য বন্দীদের মত তাকেও কারাগারেই মেরে ফেলা হবে। গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ১৯৭২-এর ১৬ই জুলাই এন্টালি থেকে। ২৮শে জুলাই সরকার ঘোষণা করে হৃদরোগে আক্রমণের ফলে তাঁর মৃত্যুর খবর।

পার্টির অবস্থা ছন্নছাড়া। সব কমরেডরা হয় জেলে, না হয় বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছে। ২৮শে জুলাই আলিপুর জেলে চারু মজুমদার মারা যান। সুশীতল রায়চৌধুরী আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকাকালীনই মারা যান। কমরেড সরোজ দত্তকে পুলিশ ভোরে লেকের ধারে চিরাচরিত প্রথায় গুলি করে মারে।

১৯৬৭ তে নির্বাচনে বামফ্রন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। নির্বাচনে জিতে সরকারে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলে চারু মজুমদার এবং আরও কয়েকজন মার্ক্সবাদী কম্যুনিস্ট নেতা এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। সি পি আই এম থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন কয়েকজন। সিপিএম কানু সান্ন্যালের নেতৃত্বে নক্‌শালবাড়ি এলাকায় সশস্ত্র কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করতে শুরু করেছিলেন। ১৯৬৯ এর ১ল মে ময়দানে কানু সান্ন্যাল ঘোষণা করলেন সি পি আই(এম এল) গঠনের কথা।

তার আগেই সংসদীয় গণতন্ত্র বর্জন এবং সশস্ত্র আন্দোলনের প্রশ্নে দল থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন চারু মজুমদার প্রমুখ কিছু নেতা। ১৯৬৭-এ নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহে সমর্থন ও তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে হাত মেলালেন চারু মজুমদার, কানু সান্ন্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল। ৮ই মে থেকেই প্রকৃত পক্ষে নকশালবাড়ির কৃষক অভ্যুত্থান শুরু হয়ে যায়। নকশালবাড়ি, খড়িবাড়ি, ফাঁসিদেওয়া এবং শিলিগুড়ির কিছু অংশে জমি দখল এবং ফসল কেটে নিয়ে যাওয়া শুরু করেছিল চাষিরা। ১৬ই মে শিলিগুড়ি এলেন তৎকালীন সরকারের ভূমিরাজস্ব মন্ত্রী হরেকৃষ্ণ কোঙার। যাওয়ার আগে জনসভায় এই আন্দোলনকে ‘হঠকারী’ বলে তীব্র সমালোচনা করলেন। ১৯৬৭, ১৮ই মে, কানু সান্ন্যালের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে ভূমিহীন কৃষকদের নতুন ভাবে ভূমির অধিকার অর্জনের সশস্ত্র লড়াইকে সমর্থন জানালেন শিলিগুড়ি কিষাণ সভার সভাপতি জঙ্গল সাঁওতাল। ১৭ই মে শুকনার ফরেস্ট বাংলোয় কানু সান্ন্যাল আরও কয়েক জনকে নিয়ে হরেকৃষ্ণ কোঙারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখলেন সেখানে পুলিশের এস পি, ডি আই জি রয়েছে। মন্ত্রীমশাই বললেন পুলিশ যে লিস্ট দেবে, তাদের মধ্যে যাদের নামে ওয়ারেন্ট আছে, তাদের সারেন্ডার করালে পুলিশ কেস তুলে নেবে।

১৮ই মে থেকেই গ্রেপ্তার শুরু হয়েছিল। ক’দিন বাদেই একজন ভাগচাষিকে আক্রমণ করল জোতদারের পোষা লেঠেল বাহিনী। ২৪শে মে নকশালবাড়ি থানার সেকেন্ড অফিসারের নেতৃত্বে দারোগা সোনাম ওয়াংদিসহ একদল পুলিশ এল হাতিঘিঁষার ঝড়ু জোতে। ওদের কাছে খবর ছিল বিপ্লবী নেতারা এখানে আত্মগোপন করে আছে। মুহূর্তে খবর ছড়িয়ে পড়ল। বুড়াগঞ্জ, আজামাবাদ এবং বিজয়নগর চা-বাগান এবং পাশ্বর্বর্তী জোত থেকে আড়াই-তিন হাজার সশস্ত্র মানুষ পুলিশকে ঘিরে ফেলল। শুরু হ’ল নকশালবাড়ির প্রথম সশস্ত্র লড়াই। তীরের আঘাতে মারা গেলেন দারোগা সোনাম ওয়াংদি।

২৫শে মে প্রসাদ জোতে একটি মহিলা সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। আচমকাই সেখানে উপস্থিত হ’ল এক গাড়িভর্তি আসাম ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস্‌-এর পুলিশ। খুব দ্রুত ওরা গাড়ি থেকে নেমেই পাশেই একটি বাঁশঝাড়ের আড়ালে পজিশন নিল। তারপর শুরু হয় নিরস্ত্র মহিলা এবং শিশুদের ওপর বিনা প্ররোচনায় অবিরাম গুলি বর্ষণ। সমাবেশের এগারো জন সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। এই সভার আহ্বায়ক ছিল প্রহ্লাদ সিং। তার স্ত্রীর পিঠে বাঁধা ছিল ছোট শিশু। যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন উত্তরবাংলার রাজবংশী মহিলারা কীভাবে তাঁদের শিশুদের পিঠে কাপড় দিয়ে আটকে কাজকর্ম করে। একটা গুলি প্রহ্লাদ সিং-এর স্ত্রীর বুকে ফুঁড়ে তার শিশুটিকেও খতম করে দেয়।

কলকাতায় রামমোহন লাইব্রেরিতে গঠিত হ’ল নকশালবাড়ি কৃষক সংগ্রাম সহায়ক কমিটি। সভাপতি প্রমোদ সেনগুপ্ত। সম্পাদক পরিমল দাশগুপ্ত। সভায় প্রস্তাব নেওয়া হ’ল নকশালবাড়ি থেকে পুলিশ প্রত্যাহার ও বন্দী কৃষকদের মুক্তি। ‘সত্যযুগ’ পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে সি পি এম-এর রাজ্য কমিটি চারু মজুমদার, সুশীতল রায়চৌধুরী এবং সৌরীন বসুকে বহিষ্কারের কথা ঘোষণা করল। পরে বেরিয়ে এলেন মহাদেব মুখার্জীও। 

কোয়ালিশন সরকারের অন্যতম শরিক সি পি এম এই সশস্ত্র অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করেছিল। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নকশালবাড়ির মত সশস্ত্র আন্দোলন দাবানলের মত দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে দিল। উদ্দীপ্ত ভূমিহীন কৃষক এবং ছোট ভাগচাষিরা জোতদারদের বিরুদ্ধে শুরু করল সশস্ত্র গণ-আন্দোলন। ১৯৬৯-এর ২২শে এপ্রিল লেনিনের জন্মদিনে কম্যুনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া( মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হ’ল। 

শ্রেণিশত্রু খতমের ডাক দিলেন চারু মজুমদার। ১৯৭১ এ বিশাল সংখ্যায় ছাত্রছাত্রীরা ঝাঁপিয়ে পড়ল বিপ্লবে অংশ নিতে(পরে দেখা যায় প্রকৃত রাজনৈতিক চিন্তার অভাব এবং তাৎক্ষণিক আবেগ তাদের এই প্রয়াসকে অনেকটাই ব্যর্থ করে দেয়)। শোনা যায়, এ সময়ে শিয়ালদার একজন কংগ্রেসি এম এল এর বাড়ি পরিণত হয়েছিল নকশালদের টর্চার করার চেম্বার হিসেবে। পুলিশ এবং কংগ্রেসি দালালরা ছেলে তুলে এখানে ঢুকিয়ে দিত।
0

স্মৃতির সরণী - বিপুল দাস

Posted in

স্মৃতির সরণী


কথামালা
বিপুল দাস


কোথাও কি ফাঁকি ছিল? না কি যে জনজোয়ারে উত্তাল হয়ে উঠেছিল গোটা দেশ, তাকে সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারেনি পার্টি। আমার মনে হয়েছে পরেরটাই ঠিক। দেশের সেরা শিক্ষায়তন থেকে সেরা মেধা নিয়ে বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ছাত্রদল। বুকের ভেতরে একটা আদর্শ নিয়ে মরণকে উপেক্ষা করে, সব জাগতিক সুখ জলাঞ্জলি দিয়ে গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছিল ওরা। অন্ধের চীনের বিপ্লবনীতিকেই অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে। তাকে ভারতীয়করণ বা বঙ্গীয়করণের প্রয়োজন আছে কিনা, কেউ সেই প্রশ্ন তোলেনি। সব মাটিতে এক ফসল ফলে না। মাটির চরিত্র আলাদা হলে ফসল ফলানোর তরিকাও আলাদা হয়। চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান -- এই শ্লোগান ব্যর্থ হয়েছে দূরদর্শিতার অভাবে। ভারতীয় জাতীয়তাবোধের অভিমানকে বুঝতে না পারার জন্য। ক্ষেত্র প্রস্তুত – এই ধারণাও সম্ভবত ভুল সংকেত দিয়েছিল বিপ্লবীয়ানাকে।

“আমাদের মনে রাখতে হবে নকশালবাড়ির আন্দোলনই সংশোধনবাদ এবং বিপ্লবী মার্ক্সবাদের পার্থক্য স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছে। একটি স্ফুলিঙ্গ যেমন দাবানল সৃষ্টি করতে পারে, তেমনই এই সংগ্রামের স্ফুলিঙ্গ দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ভারতবর্ষজুড়ে। আমাদের হৃদয়ে জাগিয়ে রাখতে হবে কমরেড মাও সে তুং-এর চিন্তাধারা। এই লাইন মার্ক্সবাদ—লেনিনবাদকে বুর্জোয়া শ্রেণী ও সংশোধনবাদসহ প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণীর হাত থেকে রক্ষা করেছে, তাকে বিকশিত করেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবই ভারতবর্ষের মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ”।

এই পথে নেমে এসেছিল যাঁরা, কথাগুলো অন্তর থেকে বিশ্বাস করেছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজ, দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ উত্তাল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেদ-মেশিনে তৈরি হচ্ছে দেশি অস্ত্র। ওদিকে তৈরি হতে শুরু করল নক্‌শালদের জন্য মানবতাবিরোধী দমননীতির পলিসি। নির্বিচারে হত্যা, সন্দেহবশে যে কোনও ব্যক্তিকে আটক করে রাখার ক্ষমতা, লক-আপে খুন, মিথ্যে এন্‌কাউন্টার দেখিয়ে বন্দী বিপ্লবীদের গুলি করে মেরে ফেলা। অবস্থা পালটে যাচ্ছিল। কিছু ব্যাপারে সাধারণ মানুষ আর তাদের সমর্থন করছিল না। কে শ্রেণিশত্রু, আর কে নয় – এটা বোঝা যাচ্ছিল না। গ্রামের সাধারণ জোতদার, স্কুলের শিক্ষক, বা বিরোধী নেতা – শ্রেণিশত্রুর চরিত্র নির্ধারণে কোথাও গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছিল। আর, বাংলার সব মেধাবী যুবার উজাড় হয়ে যাওয়া। ক্রমশ বিরোধী প্রচার আরও জোরদার হয়ে উঠছিল। ক্রমশ জনসমর্থন হারাচ্ছিল নক্‌শাল আন্দোলন। চোরডাকাত, গুণ্ডাবদমাশও অন্যায় করে ‘নক্‌শাল’ পরিচয় দিয়ে বুক ফুলিয়ে চলে যেতে শুরু করেছিল। এসব মনিটরিং-এর কোনও ব্যবস্থা ছিল না। প্রচলিত শিক্ষা-ব্যবস্থাকে বানচাল করে বিকল্প কোনও শিক্ষা-ব্যবস্থার কথা ভাবা হয়নি। তার আগে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রয়োজন ছিল। তারপর নীতি-নির্ধারণ। সসমাজসংস্কারক মনীষীদের মূর্তি ভেঙে ফেলা কোথাও যেন লেগেছিল চিরকালের মার্জিত রুচি, ধর্মপ্রাণ, বাংলার ঐতিহ্য নিয়ে অভিমানী মানুষের। তারা এটা ভাল ভাবে নেয়নি। এর সঙ্গে ছিল সরকারি ধামাধরা বুদ্ধিজীবীদের ক্রমাগত বিরূপ প্রচার। বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা চারু মজুমদারের তত্ত্বের অসারতা প্রমাণের চেষ্টা করে গেছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, সামাজিক গুণ্ডামি – এ সবের বিরুদ্ধে সুসংহত ভাবে সংগ্রাম করে সর্বস্তরে সাফল্য অর্জন ক্রমশ অলীক হয়ে উঠছিল। সহানুভূতিশীল অংশও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল।

ভুল খোঁজা হচ্ছিল। কোথায় ভুল ছিল? তত্ত্বে, না প্রয়োগে। এই প্রশ্নের উত্তরে সি এম বলেছিলেন –“আমাদের কি কোনও ভুল হয়েছিল? ভুল হবে না – এ কথা কি কেউ বলতে পারে? কিন্তু তা নিয়ে অনুশোচনার দিন তো আজ নয় – আজ দিন আগুনের মত জ্বলে ওঠার, রক্তের ঋণ রক্তের দামে শোধ করার”।
0

স্মৃতির সরণী - বিপুল দাস

Posted in


স্মৃতির সরণী


কথামলা
বিপুল দাস


এই শহর যখন ষাটের দশকের শেষ দিক এবং সত্তর দশকের প্রথম দিকে এক ক্রান্তিকারী সময়ের ভেতর দিয়ে টালমাটাল ভাবে পার হচ্ছিল, আমরা তখন কলেজে। সেই সময়ের কথা এখনও দুঃস্বপ্নে হানা দেয় বারে বারে। এখনও কানে স্পষ্ট শুনতে পাই আমাদের বন্ধু বিপ্লবের ছোট ভাই বিদ্যুতের আর্ত চিৎকার। বাবা বাঁচাও। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। সাথে বিদ্যুতের বুকেপিঠে সি আর পি এফ-এর বুটের লাথির আওয়াজ আর ‘মাদারচোদ নকশাল’ সুভাষিতাবলি। তখন আমরা মাঝে মাঝে খবর পেয়ে যেতাম আজ আমাদের পাড়ায় কৌম্বিং অপারেশন হবে। যাকে বলে চিরুনি-তল্লাশি। পুরো মহল্লা ওরা ঘিরে ফেলত। ওদের সঙ্গে থাকত লোকাল থানার অফিসার। একটা বড় কালো প্রিজন ভ্যান নিঃশব্দে এসে একটু দূরে কোনও অন্ধকারের দাঁড়িয়ে থাকত। একটা জিপ জাতীয় ছোট গাড়িও থাকত। জিপের ভেতরে লুকিয়ে বসে থাকত স্থানীয় খোঁজদার। সাধারণত যুব কংগ্রেসের নেতা। সে-ই দারোগাবাবুকে বাড়ি চিনিয়ে দিত। থানার অফিসার জওয়ানদের নিয়ে দরজায় টোকা দিত। কখনই হা রে রে রে করে ডাকাতের মত হিংস্র উল্লাসে কোনও বাড়িতে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ত না। বা কখনও নক্‌শাল ধরতে গিয়ে বাড়ির মহিলাদের যৌন হয়রানি করেছে – এমন প্রায় শোনাই যেত না। তবে পরবর্তী কালে কোনও মহিলা নক্‌শাল নেত্রী বা সন্দেহভাজনকে গারদে অকথ্য অত্যচার করা হ’ত, সে সব প্রকাশ পেয়েছিল। দরজায় নম্র হাতে নক করত বা মৃদু গলায় দরজা খুলতে বলত। তারপর ওরা শেয়ালের মত গন্ধ শুঁকত। প্রত্যেকটা ঘর, বারান্দা, রান্নাঘর, বাথরুম, চিলেকোঠা, ছাদ, জলের ট্যাঙ্ক, আলসে, ছাদ্ঘেঁষা গাছেও টর্চ মেরে ভালো করে দেখত। সে ভাবেও ক’জন ধরা পড়েছিল। এক রকম আলোর ফানুশ ফাটাত আকাশে। বিস্তীর্ণ অঞ্চল দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে যেত। আমাদের এক বন্ধু রাত তিনটের সময় বাড়ির পেছনের দেওয়াল টপকে প্রায় পালিয়েই গিয়েছিল। তখনই ফানুশের সবুজ আলোয় তার পলায়নপর লিকলিকে পাদু’টো দেখতে পেয়েছিল এক জওয়ান। পাড়ার সবাই গুলির শব্দ শুনে বুঝতে পেরেছিল গেল একজন ভোগে। তখন বাচ্চারাও গুলির শব্দ আর পেটর আওয়াজের তফাত্‌ বুঝতে শিখে গিয়েছিল। পায়ে গুলি লেগেছিল তড়িতের।

তখন সন্ধের পর সবাই মাল টেস্ট করত। এদিক ওদিক মুড়িমুড়কির মত মাল পড়ত। আমরা শিওর ছিলাম আমাদের এ পাড়াটা মুক্তাঞ্চল তৈরি হতে আর বেশি দেরি নেই। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার সি এম-এর স্বপ্ন সফল হবেই। ভারি ভারি শব্দগুলো মুখের মধ্যে নিয়ে নাড়াচাড়া করতাম। আহা, কী ওজনদার শব্দ। মহান জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব, আধাসামন্ততান্ত্রিক-আধাঔপনিবেশিক। কেয়া বাত। পার্লামেন্ট শুওরের খোঁয়াড়। হক কথা। শুধু চারু মজুমদার নন -- সরোজ দত্ত, সুশীতল রায়ছৌধুরীদের লেখায় আমরা বুঝতে পারছি সে সব কথা। কত নতুন নতুন শব্দ। পাতি-বুর্জোয়া, ভারতবর্ষের কুলাক-শ্রেণী। শব্দগুলো মুখের ভেতরে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে কপাত্‌ করে গিলে ফেলি। শরীরে রক্তের সঙ্গে মিশে যায় চারুদার বাণী। দেশব্রতী পড়ে জানতে পারি শ্রীকাকুলামের কমরেডদের বীরত্বের গল্প। ডেবরা, গোপীবল্লভপুর নাকি মুক্তাঞ্চল হয়ে গেছে। কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের ঐক্য জিন্দাবাদ -- জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।

কলেজ ক্যান্টিনে একদিন সি পি আই-এর সম্প্রীতিদাকে বেল্ট খুলে বেদম মার দিল অভিজিৎ। আমরা থামাতে পারি না। আমাদের সঙ্গে সি পি আই-সি পি এম-এর ছেলেদের খুব দ্রুত বিভাজন ঘটে যাচ্ছিল। বন্ধুরা অনেকেই শত্রু শিবিরের। আমাদের কমরেডদের মনে হত আত্মার আত্মীয়। ওকে রক্ষা করার জন্য আমাদের জান দিতে হবে। ওপরে ওপরে ওদের সঙ্গে ক্যান্টিনে চা-চারমিনার খেলেও বুঝতে পারছিলাম ও আসলে আমার শ্রেণিশত্রু।

হঠাৎ একদিন দেখলাম আমাদের স্কুলের দেওয়ালে লেখা রয়েছে – কমরেড রণজিৎ অমর রহে। বুকের ভেতরে ছাঁৎ করে উঠল। লম্বা, ফর্সা, মোচওয়ালা রণজিৎদা এক রাতে আমার ঘরে ছিল। বীরভূমের ছেলে। কোনও রাজনীতির কথা নয়, সারা রাত আমরা শুধু কবিতা নিয়ে গল্প করে গেছি। কী অসাধারণ মেধা, কী অগাধ পড়াশোনার গভীরতা, কী আশ্চর্য স্মৃতি। সার্ত্রের অস্তিত্ত্ববাদ থেকে চার্বাকের দর্শন, নাজিম হিকমত থেকে হাইনের কবিতা। সেই প্রথম জেনেছিলাম ‘বিংশ শতাব্দীতে/খুব বেশি হলে একবছর/ মানুষের শোকের আয়ু – অমর এই পংক্তির রচয়িতা নাজিম হিকমত। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদ। আমি শুধু মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনে গেছি। ভারতবর্ষকে আরও একবার স্বাধীন করবে বলে চারু মজুমদারের ডাকে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রণজিৎ।

বেশির ভাগ রাত কাটে দূরে কোনও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। কলেজের পরীক্ষা ক্রমাগত পিছিয়ে যায়। সি পি এম-অধ্যুষিত এলাকায় যেতে পারি না। এ সবের ভেতরেই ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’—এই বাক্য নিয়ে সংশয়ে পড়ে যাই। কারও সঙ্গে আলোচনা করা সম্ভব নয়। পার্টিতে সংশয়বাদীরা সবচেয়ে বিপজ্জনক। এ ভাবেই আমার অ্যাকাডেমিক কেরিয়ার ডুম হয়ে যায়। নরমেধ যজ্ঞে মেতে উঠেছে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের পুলিশ। গভীর রাতে অশ্বমেধের বলি হয়ে যায় সোনার টুকরো ছেলেরা। যা, পালা – পেছন থেকে বিশ্বাসঘাতক রাইফেলের গরম সিসা ছুটে এসে বিপ্লবের শরীর থেকে গরম রক্ত বের করে নেয়। শত শহিদের লাশ পড়ে থাকে আলপথে, লেকের ধারে, মহানন্দার পারে, ছাতিমগাছের নীচে।

কলেজ-ক্যান্টিনে প্যারোডি গান গেয়ে মিহির তখন হেবি নাম করে ফেলেছে (পরে মিহিরাচর্য হয়ে কোষ্ঠীবিচার করত)। পায়রা ডিম পেড়েছে অ্যাটম বোম, জ্যোতি তাতে তা বসায়। হাঁড়ি ফেটে বেরিয়ে এল ডজন খানেক ডাঙে। তখন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির গান মার্কেটে হেবি হিট। মিহির প্যারোডি বাঁধল – আমি সেই জ্যোতি বোস নই রে, সেই জ্যোতি বোস নই। আমি ভোটের জ্যোতি, জোটে মতি কলকাতাতে রই। আমি বেঞ্চে দাদরায় তাল ঠুকি – ধা ধিনা না তিনা ধা ধিনা না তিনা। ক্যান্টিনের রাখালদা একদিন আপত্তি জানাল। সি পি এম-এর ছেলেরা নাকি বলেছে ক্যান্টিন বন্ধ করে দেবে। কলেজ ইলেকশনে সুতলি প্যাঁচানো বিশাল একটা মাল চার্জ করল মৃদুল। একটুর জন্য বেঁচে গেলেন মাইতি স্যার।

খবর ছিল সেদিন আমাদের পাড়ায় ছানবিন হবে। একটু বেশি রাতে খবর পেয়েছিলাম। তড়িঘড়ি সব দেশব্রতী এক জায়গায় করে মহানন্দায় ভাসিয়ে দিয়েছিলাম। আমার ঘরে দেশব্রতী পেলে আমাকে কেউ বাঁচাতে পারত না। খুব খারাপ লাগছিল। কত গুরুত্বপূর্ণ সব প্রবন্ধ ছিল।

আস্তে আস্তে সব কেমন শুনশান হয়ে আসছিল। শ্রেণিশত্রু খতম অভিযান নিয়ে কোথাও কোনও খবর পাচ্ছিলাম না। টেলিফোন গোডাউনের ফাঁপা খুঁটিগুলোর ভেতরে লুকিয়ে-রাখা সব মাল একদিন ধরা পড়ে গেল। তার মাঝেও একদিন তরুণ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঠান্ডা মাথায় পাইপগান চালিয়ে কনেস্টবল উড়িয়ে দিল। সব পুলিশের কোমরে চেন। চেনের সঙ্গে বন্দুক বাঁধা। চারুদা বলেছেন ওদের অস্ত্র কেড়ে নিয়েই আমাদের অস্ত্র ভাণ্ডার গড়ে তুলতে হবে।

চারদিক থেকে ভেঙে পড়ার আওয়াজ শুরু হয়েছিল। নর্থবেঙ্গল ইউনিভার্সিটির কিষান চ্যাটার্জীর কোনও খবর পাচ্ছি না। অরবিন্দদা, দীপকদা – যাঁরা সবসময় চারুদার পাশে থাকত, তাদের কাছ থেকে কোনও খবর পাচ্ছি না। সি পি এম-এর ছেলেরা চান্স পেলেই আমাদের ধরে ক্যালাচ্ছে। রয়েছে কংগ্রেসি গুণ্ডাদের চোরাগোপ্তা আক্রমণ। এরই মাঝে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। হঠাৎ একদিন শুনলাম বিধান সভা নির্বাচনের মুখে ্মিহির কংগ্রেসের হয়ে পথসভা করেছে। ভালো বক্তা ছিল মিহির। স্ট্রিট কর্নার জমিয়ে দিল। পার্টি লুফে নিল ওকে।

পালাচ্ছি পালাচ্ছি পালাচ্ছি। অন্ধকারে একদিন আমি আর মিলন মুখোমুখি বসে মুড়ি খাচ্ছি। মিলন বলল – কংশাল হবি ? মিলনের জামাইবাবু সিদ্ধার্থ রায় পর্যন্ত লাইন করে ওর সেফ ব্যবস্থা করে ফেলেছে। এই জামাইবাবু মিলনের দিদিকে ইলোপ করলে মিলন পাইপগান হাতে নিয়ে কসম খেয়েছিল এক নম্বর শ্রেণিশত্রু বুবু মজুমদারকে খতম করতেই হবে।

কংশাল শুনে আমার ভাঙনের শব্দে আমিই ভেসে যাই। কেন, কেন এমন হ’ল ? কী ভাবে, কখন আমরা জনগণের থেকে দূরে সরে গেলাম। সে কি মূর্তিভাঙা ? সে কী নিরীহ কনেস্টবলের মৃত্যু ? চারু মজুমদারকে কি কেউ ক্রমাগত মিথ্যে মুক্তাঞ্চলের স্বপ্ন দেখিয়ে গেছে। ভাগ্যিস অন্ধকার। তবু আমি মিলনের চোখের দিকে তাকাতে পারি না।

স্থিতাবস্থা টালমাটাল করে অবস্থার পরিবর্তন চেয়েছিল একটা প্রজন্ম। সব ছেড়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিল। ওরা বিশ্বাস করেছিল একটি স্ফুলিঙ্গ দাবানল সৃষ্টি করতে পারে। রাত জেগে স্টেনসিল কাটা হ’ত মাও-সে-তুং-এর। মাথায় সেই বিখ্যাত লালতারা দেওয়া টুপি। ভারতবর্ষ জুড়ে একটা ঢেউ এসেছিল বিপ্লবের। এখনও খুঁজে দেখলে হয়তো পশ্চিমবঙ্গের কোনও জীর্ণ দেওয়ালে পাওয়াও যেতে পারে সেই ছবি। টুপি-মাথায় চেয়ারম্যানের সেই ছবি। দেওয়ালে এখন শ্যাওলা পড়ে গেছে। বেশির ভাগ পুরনো দেওয়াল ভেঙে নতুন দেওয়াল উঠেছে। নতুন সিমেন্টবালির আস্তরণে কোথায় চাপা পড়ে গেছে বিখ্যাত সেই স্টেনসিল-কাটা ছবি। যে ছবি দেখলে একদিন স্পন্দিত হয়ে উঠত বুক।

আমাদের পাড়ার পাতু যে রাতে ওয়ালিং করতে বেরোত, পরদিন সকালে ঊঠেই তার হাতে আলকাতরার দাগ দেখানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ত। কিন্তু সরাসরি নয়। কায়দা করে হাতদুটো পেছনে লুকোনোর চেষ্টা করছে, এমন একটা ভান করত। সবাই কৌতূহলী হলে, যেন কিছুই না, হাত সামনে এনে দেখাত। এই করতে গিয়ে কংগ্রেসি দালালের নজরে পড়ে যায়। সি আর পি এফ-এর এক জওয়ান তার তলপেটে সবুট লাথি ঝেড়েছিল। বন্দীমুক্তি পর্বের পরবর্তী অধ্যায়ে দেখা গেল তার মলমূত্র ত্যাগের কোনও কন্ট্রোল নেই। তাদের বাড়ির মার্বেলের মেঝে যখন তখন সে নষ্ট করে ফেলছে। তার ডাক্তারদাদা আন্তরিক উদ্যোগ নিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ করে এনেছিল। কিন্তু কক্সিস অঞ্চল বসে যাওয়ার ফলে পাতু ন্যুব্জ বৃদ্ধের মত লাঠি হাতে হাঁটাচলা করত। কোনও এক পনেরই আগস্টের পুণ্যলগ্নে পাড়ায় তেরঙ্গা উত্তোলনের সময় সে চিরদিনের জন্য বসে পড়ে। সম্ভবত শেষ মুহূর্তে পাতু ‘জয়হিন্দ’ বলার চেষ্টা করেছিল। তার পাঞ্জাবির পকেটে একটি পনেরই আগস্টের চকোলেট ছিল।

কিছুদিন আগে আমার কাছে একটি ছেলে অভিযোগ করছিল – জানেন স্যার, এই মিহির মাস্টারমশাই ‘বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থায় যে যত পড়ে, সে তত মূর্খ হয়’ বলে পরীক্ষার হলে ঢুকে আমার খাতা কেড়ে নিয়েছিল। আর এখন, উনি নিজেই জ্যোতিষচর্চা করছেন। গুষ্টির রাহুকেতু করে হাতে পাথর পরাচ্ছেন। আমি ওর কথার কোনও উত্তর দিতে পারিনি।

0

স্মৃতির সরণী - বিপুল দাস

Posted in


স্মৃতির সরণী


কথামালা
বিপুল দাস


আমার লেখালেখি, আমার জীবনবোধ কিছুটা তো অবশ্যই পরিবেশ ঠিক করে দেয়। আমি যা দেখিনি, শুনলেও আমাকে আলোড়িত করেনি, যে ইকো-সিস্টেমে আমার চলন সহজ, স্বচ্ছন্দ নয় – কী ভাবে সে সব বিষয় নিয়ে লিখব। পাঠক তো নিজের অভিজ্ঞতার নিরিখে যাচাই করে নেয় গল্পের সত্যি। যে লেখক পাঠকের বিশ্বাসযোগ্যতার যত কাছে যেতে পারেন, সেই গল্প তত বেশি সার্থক হয়ে ওঠে। কারও বাড়িতে সাত বার বজ্রপাত হতেই পারে, এ হ’ল বাস্তবের সত্য। কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার বাইরে। গল্পে এমন ঘটনা থাকলে পাঠকের বিশ্বাসের অনেক দূরে থাকে সেই সত্যি।

কী আমি লিখতে চাই, কেমন হবে আমার জীবনবোধ – এ প্রশ্ন আমি নিজেকেই অনেকবার করেছি। একটা গল্প শেষ হলে পড়ে বুঝতে চাই, ঠিক এটাই কি আমি লিখতে চেয়েছি। মহানন্দার ওপর ব্রিজ তৈরি হবে। তিনপুরুষ ধরে ঘাটে পারানির কাজ করছে, সেই মাঝির সমস্যা নিয়ে গল্প লিখলাম। লেখা শেষ হলে বুঝি, আমি যা লিখতে চেয়েছিলাম, সত্যিই আমি সে কথা লিখতে পারিনি। এত দিন ধরে পুরনো মাঝি ইন্দ্রমোহনকে দেখে, ওর নৌকোয় খেয়া পারাপার করে – ব্রিজ হ’লে ওর রুজির সমস্যা ছাড়াও প্রতিদিন নদীর স্রোতকে চ্যালেঞ্জ করবে বলে ওর রক্তের ভেতরে যে আর একটা নদী গর্জে উঠত – আমি আমার জীবনবোধ দিয়ে তার কতটুকে বুঝতে পেরেছি। এখানে ব্যারাজ হবে, ব্রিজ হবে। এতদিন যারা ওকে তোয়াজ করেছে, এখন তারাই গটমটিয়ে ব্রিজ পেরিয়ে ওপারে যাবে। এই ক্রাইসিস তো ওর অমার্জিত, অশিক্ষিত বোধে কয়েকটি খোঁচা হয়ে জেগে থাকে শুধু। আমি আমার মার্জিত বোধে যা বুঝলাম, তাই কি আসল সত্যি।

এবার ধরা যাক আমার পরিবেশ। তাল, নারকেলের ছায়াঢাকা গ্রাম। গ্রামীন কূটকচালি আছে, দুর্গাপুজো আছে, মহরমের তাজিয়া আছে। এখানেই আমার বড় হয়ে ওঠা। এখন আমার বোধে রাষ্ট্রীয়-সন্ত্রাস, রোহিলাদের সমস্যা, গাজা স্ট্রিপ, সিঙ্গুরে কৃষিজমি হস্তান্তর, ২০১৭ সালেও ডাইনি সন্দেহে পুড়িয়ে মারা – এগুলো তাহলে কী ভাবে কাজ করবে।

আসলে আমি কী লিখব, কীসের ভিত্তিতে আমার জীবনবোধ গড়ে উঠবে, সেটা কিছুটা নির্ভর করে আমি কোন মাটিতে দাঁড়িয়ে আছি, আমার শেকড় কোন রস টানছে – তার ওপর। এগুলো প্রত্যক্ষ প্রভাবকের কাজ করে। গল্পের প্রেক্ষিত, চরিত্র সৃষ্টিতে সরাসরি সাহায্য করে। আর একটা প্রক্রিয়া খুব ধীরে ধীরে কাজ করে। সেটা হ’ল ব্যক্তিমানুষ থেকে সামাজিক মানুষ, সামাজিক মানুষ থেকে রাষ্ট্রিক মানুষ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া। নিজেকে সংবিধানের অন্তর্গত একজন নাগরিক ভাবার সঙ্গে সঙ্গে এর ভালো মন্দও যেন নিজের উঠোনে এসে পড়ে। দুনিয়াজোড়া মানুষের ভালোমন্দের দায়িত্বরক্ষার আমিও একজন অংশীদার – এই বোধ খুব গভীরে অস্পষ্ট, কিন্তু নিশ্চিতভাবে কাজ করে। কেউ চাপিয়ে দেয় না, কিন্তু কোথা থেকে যেন এই দায় আসে। এ কথা সাধারণ মানুষ সম্পর্কে যেমন প্রযোজ্য, লেখক সম্পর্কেও। এই মনুষ্যত্ববোধের অহংকার তাকে প্ররোচিত করে যে কোনও রকমের ভাঙন, যা তার এবং তার প্রজাতির অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলতে পারে – তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। বিভিন্ন জনের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন হয়। কেউ ওয়ার অ্যান্ড পিস লেখেন, কেউ কমোডে বসে মেঝেয়ে থুথু ফেলেন, কেউ গেয়ে ওঠে উই শ্যাল ওভারকাম, কেউ রিকশাওয়ালা পেটায়, কেউ ডেপুটেশন দেয়, কেউ পুলিশকে খিস্তি দেয়, আবার কোনও কবি বন্দুক হাতে গ্রানাডা পাহাড়ে চলে যান তবে সব কিছু এত সহজে হয় না। রক্তে বিরুদ্ধগতির প্রবাহও থাকে। অনেক প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীও পাকিস্তানের সঙ্গে খেলা থাকলে এক্সট্রা উত্তেজনায় জারিত হ’ন। কোথা থেকে আসে এই এক্সট্রা ? এও কভারেজ। রাষ্ট্র বা তার নিজের অস্তিত্বের সংকটের বিরুদ্ধে এক রকম ডিফেন্স মেকানিজম্‌। এক ধরণের পোকা আছে, বিপদ দেখলে দুর্গন্ধময় রস ছড়ায়।

এখন ইনফর্মেশন টেকনোলজির চূড়ান্ত পেশাদারিত্বের ফলে অনেক বেশি তথ্য দ্রুত লেখকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। এর ভেতরে কিছু তথ্য সংবাদের চেয়েও বেশি ডাইমেনশন নিয়ে লেখকের মনে আলোড়ন তোলে। একই ঘটনা ভিন্ন লেখকের মনোজগতে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ঘটনা একটি, কিন্তু মাল্টি-ফেসেড হওয়ার ফলে এক-এক মানুষের কাছে এক-একটি তলের উজ্জ্বলতা প্রখর হয়ে ওঠে। একটি ঘটনার অনেকগুলো মাউন্টেড স্পট থাকে। লেখক ঝাড়াই বাছাই-এর পরে সিদ্ধান্তে আসেন কী লিখবেন। ধর্মের প্রতি মানুষের সীমাহীন আনুগত্য কী ভাবে মানুষকে অমানুষ বানায়, এ কথা এই মুহূর্তে আর নতুন করা বলার কিছু নেই। প্রত্যক্ষ এবং মিডিয়াবাহিত পরোক্ষ অভিজ্ঞতা সেই রসায়নাগারে কাজ শুরু দেয়। জীবনবোধ পীড়ন শুরু করে। কেউ লেখেন মশাল হাতে এক উন্মাদের নিষ্ঠুরতার গল্প, কেউ লেখেন মানবিকতার গল্প।

মানুষ নামক জটিল প্রাণী অসীম অনন্ত এক রহস্যে মোড়া। আপাতভাবে মনে হয় শান্ত নদীর জল। কিন্তু অনেক চোরাপাথর, মগ্নমৈনাক থাকে জীবনের গভীরে। রহস্যের গোপন কন্দরে ডুবে থাকে সেই সব ডুবোপাহাড়। অসীম বিশ্বাস ও কোটি টাকার অহংকারী টাইটনিকও ডুবে যায় কত সহজে।

সেইসব ডুবোপাহাড়ের সঙ্গে অবিরত ঘর্ষণ হতে থাকে স্থানিক পরিবেশ থেকে সংগৃহীত অসংখ্য তথ্যের সঙ্গে, রক্তে লালিত বিশ্বাসের সঙ্গে, গেঁড়েবসা সংস্কারের সঙ্গে, যাপিত অভিজ্ঞতা ও পঠিত তত্ত্বের সঙ্গে। আমরা কখনও কখনও শান্ত মানুষের হঠাৎ জেগে ওঠা দেখি। ওই গ্রাফ ধরার চেষ্টা করেন লেখক। কী লিখতে চাই মনে হলেই মানুষের বুকের ভেতরের ওই পাথর একবার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। এই বোধহয় জীবনবোধের তাড়না, যার থেকে কোনও স্রষ্টারই নিষ্কৃতি নেই।

যন্ত্র আর মানুষের সম্পর্ক নিয়ে আমি খুব ইন্টারেস্ট ফিল করি। যন্ত্র কত দূর পর্যন্ত মানুষের প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠতে পারে ? যন্ত্র কি কোনও দিন মানুষের মগজের সমতুল্য হয়ে উঠবে ? মানুষ যেভাবে জীবনকে চিনেছে সন্তানের গালে চুমু খেয়ে, মানুষ যেভাবে মৃত্যুকে দেখেছে মারী ও মড়কে, সহস্র অপমান ও লাঞ্ছনাবঞ্চনায় -- যন্ত্র কী জীবন ও মৃত্যুকে সেভাবে চিনতে পারবে ? যন্ত্রের কি কোনও দিন টিলার মাথায় দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখার সাধ হবে ? মানুষ যেভাবে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে গেছে, লক্ষ কোটি সংকেত লিখে রেখেছে মগজের সর্পিলাকার দ্বিতন্ত্রী হিসেবের খাতায় – যন্ত্র কি পারবে ?

0

স্মৃতির সরণী - বিপুল দাস

Posted in


স্মৃতির সরণী


কথামালা
বিপুল দাস



একটি শহরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গড়ে উঠতে অনেক সময় দরকার। ভৌগোলিক ভাবে যেমন কোনও ক্ষেত্রের উর্বরতা রাতারাতি বৃদ্ধি পায় না, সময় পলি বহন করে আনে। সঞ্চিত হতে থাকে অনুর্বর সেই জমির ওপর। তারপর কর্ষণ, বীজবপন, সারপ্রয়োগ, নিড়ানির পর ফসল ফলে, ঠিক তেমনই কোনও জনপদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার রাতারাতি তৈরি হয় না। তার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হয়। কিছু শর্ত থাকে। প্রাচীন শহরগুলোতে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বহমানতা থাকে। ক্ষেত্র প্রস্তুতই থাকে, শুধু বীজ বপনের অপেক্ষা। একটি জনপদের সমস্ত মানুষের মানসিক শিক্ষার স্তরকে উন্নীত করে তোলা একজন মানুষ বা একটি প্রতিষ্ঠানের সাধ্য নয়। বিশেষ করে সেই শহর যদি অর্বাচীন হয়, নিতান্ত ব্যবসায়িক কারণেই দ্রুত বেড়ে উঠতে থাকে, ভিন ভিন্ন সংস্কৃতির বিচিত্র জনজাতির আবাস হয় – তবে নির্দিষ্ট, একমুখী সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে ওঠা কঠিন। নবীন শহর শিলিগুড়ির সেই সমস্যা রয়েছে। বাণিজ্যে, ক্রীড়াক্ষেত্রে এ শহর বেশ এগিয়ে গেছে, কিন্তু শুধু কিছু ঝাঁ-চকচকে পথঘাট, রাতে উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত শহর, অজস্র আধুনিক কেতার দোকানপাট, অসংখ্য হোটেল, বেশুমার নার্সিং-হোম একটা শহরের উন্নতির মাপকাঠি নয়। সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকান্ড যে কোনও শহরের একটি অন্যতম আধুনিকতার পরিচয়। এ শহরে শেষ কবে বড় মাপের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর বসেছে, সঙ্গীতপ্রিয় মানুষ ভুলে গেছে। এখানে বড় মাপের টেবিল-টেনিস আসর বসে, নেহরু কাপের খেলা হয়, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের খেলা হয়, বলিউডি গানার মেহ্‌ফিল বসে, কিন্তু কোনও গবেষকের প্রয়োজনীয় বই আনতে হয় কলকাতা থেকে। একমাত্র নাট্যোৎসবের সময় ‘কলিকাতার’ দল এলে দর্শক আনুকূল্য পায় উদ্যোক্তা। অন্য সময় প্রেক্ষাগৃহ শূন্য। ভালো প্রেক্ষাগৃহ বলতে সবেধন নীলমণি দীনবন্ধু মঞ্চ। এ শহরে কবিসভার চেয়ে হরিসভা, শোকসভা, জনসভার শোভা বেশি। খুব অনিয়মিত ভাবে হাতে গোণা কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। স্বীকার করতে লজ্জা আছে, কিন্তু দ্বিধা নেই – শিলিগুড়ি শহরের আশপাশের ছোট মফস্‌সলি শহরগুলোর সংস্কৃতি চর্চার ঐতিহ্য এবং মান অনেক বেশি গৌরবময়। পাশের শহর, পাশের রাজ্য, এমন কী সীমান্তঘেঁষা শহর বলে পাশের রাষ্ট্র থেকেও এ শহরে মানুষ ছুটে আসে জীবিকার তাগিদে, চিকিৎসার গরজে, কাঞ্চঞ্জঙ্ঘায় সানরাইজ দেখতে। হাতির পিঠে চড়ে গণ্ডার দেখতে। শিলিগুড়ির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কত পুরনো, এ খবর তাদের কাছে নিতান্ত অপ্রয়োজনীয়। আর, শহরজুড়ে যারা ভিন্ন রাজ্য থেকে এসে শুভলাভের কড়ি গুণে চলেছে, শিলিগুড়ির সাংস্কৃতিক মানোন্নয়ন হ’ল কিনা, তাদের কিছু আসে যায় না।

উত্তরবাংলার এই মফস্‌সল শহরে যাদের জন্ম, তাঁরা বড় হয়েছে তিস্তা, তোর্সা, মহানন্দা, করতোয়ার ভিজে বাতাসে। নদীপারে কাশবনের দোলা আর উত্তরে তাকালেই দা গ্রেট হিমালয়ান রেঞ্জ। পাহাড় পরিষ্কার থাকলেই ভোরে দেখতে পাই কাঞ্চনজঙ্ঘার শুভ্র মুকুটে একরকম লাল, আবার বিকেল গড়ালে সেখানে কেমন দুখি লাল। আমাদের অস্তিত্ত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মইষাল বন্ধুর গান, চা-বাগানের কুলি-লাইনের গল্প, বৈকুণ্ঠপুর ফরেস্টের আর মহানন্দা স্যাংচুয়ারির গাঢ় সবুজ গন্ধ। উত্তরের দারুণ বর্ষা আর কনকনে শীত। শালশিমুলজারুলখয়েরের ছায়ায় আমাদের বড় হয়ে ওঠা। মানুষের চৈতন্যে অবিরত রেকর্ডিং হতে থাকে ছড়ানো-ছেটানো এই সব উপাদান। সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে শুষে নেওয়া এই সব উপকরণ যেন একটা আর্কাইভে জমা হতে থাকে। বস্তুত, প্রায় তখনই ঠিক হয়ে সে কী লিখবে, কাদের নিয়ে লিখবে। এ কারণেই উত্তরের লেখকদের গল্পে বারে বারে তিস্তা নদী এসেছে, কাঠমাফিয়াদের কথা এসেছে, ভাওয়াইয়া ও রাজবংশীদের কথা এসেছে। বহুদিন আগে দেখা ডুয়ার্সের বাসে একজন ভুটিয়া রমণীর নাকে সোনার নথের ঝিকমিক মগ্ন-চৈতন্যে নিহিত থাকে। ধূপগুড়ির রোদ্দুর আর ওই নথের ঝিলিক নিয়ে একটা গল্প তৈরি হয় আমার মগজে। স্কুলে পড়ার সময় পিকনিক করতে গিয়ে সেভোকে করোনেশন ব্রিজের ওপর থেকে একমুঠো পাহাড়ি ঝাউপাতা ফেলে দিয়েছিলাম তিস্তার জলে। এই নদী বাংলাদেশে জলে গেছে। এখন বয়স যখন হেলে পড়েছে অড সাইডে, একটা গল্প তৈরি হতে চায়, যার নাম হতে পারে – মনোয়ারা বেগমের প্রতি শুভেচ্ছা।

পাহাড় থেকে গড়িয়ে নেমেই মহানন্দা সমতলে এসেছে শিলিগুড়িতে। পাহাড় গড়িয়ে পাথর আসে। পাথর গড়িয়ে চূর্ণীভবন চলে দীর্ঘকাল ধরে। নদীর গর্ভে বালি জমে। এখন ওই রুগ্ন, কঙ্কালসার নদীর দিকে তাকালে আমার বুকের ভেতরে কষ্টটা টের পাই। থাক, আমি দুঃখটা বালিচাপা দিয়ে রাখি।

কিছুদিন আগে আগে হঠাৎ মনে হ’ল যাই, একটু সেই নদীকে দেখে আসি। আমার প্রিয় মহানন্দা। রাস্তা পার হয়ে নতুন বসতির ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নদী আর খুঁজেই পাই না। এ কী রে বাবা, পুকুরচুরি শুনেছি, আস্ত নদীটাও চুরি হয়ে গেল নাকি। যেখান দিয়ে হেঁটে এলাম, একদিন সেখানে ডুবজলে সাঁতার কাটতাম। অনেক সরে গেছে নদী। শেষে পাওয়া গেল। ঘরবাড়ি শেষ হওয়ার পর একটা ফাঁকা জায়গা দেখে দাঁড়ালাম। এখানে অন্ধকার। একটা বড় গাছও হয়ে গেছে এ ক’বছরে। হিসেব করে দেখলাম তা প্রায় চল্লিশ বছর পরে আবার নদীর পারে এসে দাঁড়িয়েছি। গাছ তো বড় হতেই পারে।

গাছটার নীচে গিয়ে বসলাম। আমার ছেলেবেলার নদী। আমার পায়ের কাছে মহানন্দা। উত্তরে তাকালে স্পষ্ট দেখা যায় তিনধারিয়া, কার্শিয়াং-এর আলো। অন্ধকারে কালো জল পাড়ে এসে ছলাত্‌ ছলাত্‌ শব্দে ভেঙে পড়ছে। সেই চিরকালের চেনা নদীকে ভীষণ অচেনা মনে হয়। কোথা থেকে এসেছে এই নদী ? কত যুগ ধরে বয়ে চলেছে এই নদী ? এর নাম কে রেখেছে মহানন্দা ? জগদীশচন্দ্র বসুর সেই বিখ্যাত লেখাটার কথা মনে পড়ল। ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে। আমি তো বিখ্যাত মানুষ নই, তবু ইচ্ছে হ’ল নদীর সঙ্গে কথা বলতে। ফিসফিস করে উচ্চারণ করলাম –

নদী, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ ?

কার্শিয়াং-এর কাছে একটা ছোট্ট সরোবরে আমার জন্ম।

নদী, তোমার যাত্রাপথের গল্প বলো।

পাহাড়ে কত শত চঞ্চল ঝর্ণা এসে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাদের সবাইকে নিয়ে পাহাড়ের বন্ধন ছেড়ে নেমে এলাম শিলিগুড়ির সমতলে। আমার পবিত্রতা নষ্ট হয়ে গেল। এ শহরের মানুষ নদীকে ভালোবাসে না। আমি কলুষিত হলাম। ওদিকে সুকিয়াপোখরি থেকে বালাসন এসে আমার সঙ্গে মিলিত হ’ল। শিলিগুড়ি পার হয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত বরাবর এগিয়ে চলেছি। গজলডোবা থেকে তিস্তা ক্যানাল হয়ে তিস্তার জল এসে পড়েছে আমার বুকে। লকগেট বন্ধ করে সেই জল পাঠিয়ে দেওয়া হয় পশ্চিমে। শুখা মরশুমে ফসল ফলায় উত্তর আর দক্ষিণ দিনাজপুরের সুখা জমিতে।

তারপর ?

তারপর বিহারে ঢুকে পড়েছি। নেপাল থেকে আসা মেচি নদীর সঙ্গে দেখা হ’ল কিষাণগঞ্জের কাছে। সমস্ত জলসম্পদ নিয়ে ক্রমে আরও দক্ষিণে এঁকে বেঁকে, কতবার দিক পালটে অনেক পথ পার হওয়ার পর নাগর ও কুলিকের মিলিত ধারা এসে মালদহ জেলার মহানন্দপুরের কাছে আমার সঙ্গে মিশে গেল। তখন আর আমার সেই পাহাড়ি চঞ্চল খরধারা নেই। কিছুটা অলস ছন্দে আমার এগিয়ে চলা। কত স্ফীত হয়েছি।

নদী তার দুঃখের কথা বলে। কেউ শোনে না। ট্রাক ভর্তি বালিপাথর চলে যায় নগর-সভ্যতার দিকে। শহরের চারপাশে যে সবুজ বলয় ঘিরে রাখত শিলিগুড়িকে, সেই বলয়ের ব্যাসার্দ্ধ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। উন্নয়ন চাইলে উচ্ছেদও তোমাকে মেনে নিতে হবে। পুবে বৈকুণ্ঠপুর ফরেস্ট কত দূরে সরে গেছে। এখন সেখানে মানুষ, শুধু মানুষ। উত্তরে মানুষের প্রতিরোধ অগ্রাহ্য করে চা-বাগান উচ্ছেদ করে তৈরি হয়েছে বিলাসবহুল আবাসন। পশ্চিমে নদীর ওপারেও চলে গেছে শিলিগুড়ি। আর দক্ষিণে শিলিগুড়ি এখন জলপাইগুড়ির দিকে দৌড়ে চলেছে। শুধু মানুষ, শুধু ধূসর কংক্রিট। বৈকুণ্ঠপুর থেকে সবুজ টিয়ার ঝাঁক এখন আর আসে না শিলিগুড়িতে।

তবু সৃষ্টির বাসনা জেগে থাকে কিছু মানুষের মনে। এই প্যাশনের মৃত্যু হয় না। রয়েছেন কিছু অধ্যাপক। রয়েছে কিছু নাটকের দল। মাঝে মাঝে ছবির প্রদর্শনীও হচ্ছে। গদ্যপদ্যের জগতে শক্তিশালী কলম নিয়ে এগিয়ে আসছে কিছু তরুণ মুখ। ওরাই গানে, কবিতায় মুখর করে তোলে বইমেলা।

কতকাল হ’ল শিলিগুড়ি টাউন স্টেশনের ক্যান্টিন বন্ধ। মমতাজ আলি, আস্‌রাফ আলির কথা মনে পড়ে। পুরনো স্টেশন প্রায় পরিত্যক্ত। আরও দক্ষিণে নতুন স্টেশনঘর হয়েছে। খুঁজেই পাই না কোথায় ছিল আমদের সেই মফস্‌সলি কফি-হাউস রেল-ক্যান্টিন। ওখানেই এক নির্জন দুপুরে অমরেশ ওর প্রেমিকার বান্ধবীর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিলে বুঝেছিলাম, কাকে বলে – একটি কথার দ্বিধা থরো থরো চূড়ে ...।

হঠাৎ কোনও দিন বিধান মার্কেটে ‘নেতাজি কেবিন’-এ যাই। এখানেও শিলিগুড়ির লেখক-শিল্পীরা আসা-যাওয়া করত। এখন আর করে কি না, জানি না। তপনের বিখ্যাত বই-এর দোকান ‘বুকস্‌’ বন্ধ হয়ে গেছে। উত্তরবাংলার প্রায় সব লেখককবিরা এখানে আসত তাদের প্রয়োজনীয় বই-এর খোঁজে। আমাদের নিত্যদিনের সায়ং সভার নাটমন্দির ছিল বুকস্‌। যে কোনও বই দরকার হলেই তপনকে বলতাম। তপন ওর লোক দিয়ে আনিয়ে দিত। অনেকেই এক সময় প্রচুর বই আনিয়েছেন এই বুকস্‌ মারফত্‌। আমাদের খুব কষ্ট হয়েছিল বুকস্‌ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর। এত বড় শহর। বলা হয় দ্বিতীয় কলকাতা নাকি। অথচ বুকস্‌-এর মত আর একটা বই এবং লিটল্‌ ম্যাগাজিনের দোকান শিলিগুড়িতে হ’ল না। শহরে এতগুলো কলেজ, কাছেই বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, এত মানুষ, এত দোকানপশার, অথচ আমাদের একটা পাতিরাম বা ধ্যানবিন্দু নেই। আমাদের হংকং মার্কেট আছে, আমাদের বিদেশি ব্যাঙ্ক আছে, আমাদের বিখ্যাত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল আছে, আমাদের মন্দির-মসজিদ-গির্জা-গুরুদ্বার আছে, অথচ হায়, একটি ছোটখাটো কলেজ স্ট্রিট নাই।

হবে নিশ্চয় একদিন। আশায় বাঁচে চাষা। কলকাতার ইতিহাস তিনশ বছরের। এই শহরের গঞ্জ থেকে মফস্‌সল শহর হয়ে বড় শহর হয়ে ওঠার ইতিহাস খুব বেশি হলে পঞ্চাশ বছরের। এই শহরের সংস্কৃতির ইতিহাস যেদিন লেখা হবে, সেদিন পাহাড়তলির নাম আলাদা ভাবেই উল্লেখিত হবে।
0

স্মৃতির সরণী - বিপুল দাস

Posted in


স্মৃতির সরণী


কথামালা
বিপুল দাস



পাহাড়তলিতে ‘অ্যান্টিবায়োটিক’ নামে একটা গল্প লিখেছিলাম। অনেকে এখনও গল্পটার কথা বলে। নিখিলের মতো খুঁতখুঁতে মানুষও বলেছিল – মন্দ হয়নি। ওই গল্পটিই আমার গল্পের জগতে যাত্রার সবুজ সংকেত। ওই গল্পটাই পেছনে লাথ মেরে আমাকে অপার দুঃখের জগতে ঠেলে দিয়েছে। পরে আমি বেশ কিছুদিন নাটক নিয়ে, এবং প্রায় কুড়ি বছর সেতার নিয়ে রগড়েছি। শেষে আবার গল্পের কাছে ফিরে এসে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছি। মাঝের সময়টা লেখালেখি করেছি, কিন্তু অনিয়মিত ভাবে। টেনশন ছাড়া। ওভাবে লেখা হয় না। দু”টি অসমতল তলের ঘর্ষণ ছাড়া, সংশয় ছাড়া, নিজেকে সিংকটাপন্ন করে তুলতে না পারলে লেখা যায় না। এ সত্য আমাকে শিখিয়ে দিয়ে গেছেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর কাছে আর সিরাজদার কাছে আমি জীবন ও শিল্প-বিষয়ক অনেক গূঢ় কথা জেনেছি।

আমার বাড়ি শিলিগুড়ি। উত্তরবাংলার এই মফস্‌সল শহরে আমার জন্ম। আমি বড় হয়েছি তিস্তা, তোর্সা, মহানন্দা। করতোয়ার ভিজে বাতাসে। নদীপারে কাশবনের দোলা আর উত্তরে তাকালেই দা গ্রেট হিমালয়ান রেঞ্জ। পাহাড় পরিষ্কার থাকলেই ভোরে দেখতে পাই কাঞ্চনজঙ্ঘার শুভ্র মুকুটে একরকম লাল, আবার বিকেল গড়ালে সেখানে কেমন দুখি লাল। আমার অস্তিত্ত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মইষাল বন্ধুর গান, চা-বাগানের কুলি-লাইনের গল্প, বৈকুণ্ঠপুর ফরেস্টের আর মহানন্দা স্যাংচুয়ারির গাঢ় সবুজ গন্ধ। উত্তরের দারুণ বর্ষা আর কনকনে শীত। শালশিমুলজারুলখয়েরের ছায়ায় আমার বড় হয়ে ওঠা। মানুষের চৈতন্যে অবিরত রেকর্ডিং হতে থাকে ছড়ানো-ছেটানো এই সব উপাদান। সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে শুষে নেওয়া এই সব উপকরণ যেন একটা আর্কাইভে জমা হতে থাকে। বস্তুত, প্রায় তখনই ঠিক হয়ে সে কী লিখবে, কাদের নিয়ে লিখবে। এই কারণেই আমার গল্পে বারে বারে তিস্তা নদী এসেছে, কাঠমাফিয়াদের কথা এসেছে, ভাওয়াইয়া ও রাজবংশীদের কথা এসেছে। বহুদিন আগে দেখা ডুয়ার্সের বাসে একজন ভুটিয়া রমণীর নাকে সোনার নথের ঝিকমিক মগ্ন-চৈতন্যে নিহিত থাকে। ধুপগুড়ির রোদ্দুর আর ওই নথের ঝিলিক নিয়ে একটা গল্প তৈরি হয় আমার মগজে। স্কুলে পড়ার সময় পিকনিক করতে গিয়ে সেভোকে করোনেশন ব্রিজের ওপর থেকে একমুঠো পাহাড়ি ঝাউপাতা ফেলে দিয়েছিলাম তিস্তার জলে। এই নদী বাংলাদেশে জলে গেছে। এখন বয়স যখন হেলে পড়েছে অড সাইডে, একটা গল্প তৈরি হতে চায়, যার নাম হতে পারে – মনোয়ারা বেগমের প্রতি শুভেচ্ছা।

ষাটের দশক চলছে। পাহাড়তলির শহর শিলিগুড়ি তখন নেহাতই এক অর্বাচীন শহর। বড়সড় একটা গঞ্জ থেকে ক্রমশ শহর হয়ে উঠছে। নাগরিক ব্যাধি তখনও তার শরীরে রোগজীবাণু ছড়িয়ে দেয়নি। শহড়জুড়ে নারকেলসুপারি, আমজাম, শিরীষ, দেবদারু গাছ ছড়িয়ে আছে। হাইরাইজ কাকে বলে, প্রোমোটার কাকে বলে, এগ-রোল কিংবা পার্লার কাকে বলে – শিলিগুড়ি জানে না। গ্রামীন সারল্য এবং লাবণ্য ছিল শিলিগুড়ির অন্তর এবং বহিরাবরণে। তখন উত্তরে তাকালেই কাঞ্চনজঙ্ঘা, তখন মহানন্দার জল ছিল সত্যি কাকচক্ষু। ওপর থেকে পরিষ্কার দেখা যেত টলটলে জলের নীচে নুড়িপাথরের গড়িয়ে চলা। পুবে জনপদ শেষ হতে না হতেই শুরু হয়ে যেত বৈকুণ্ঠপুর ফরেস্টের ঘনসবুজ। সেদিক থেকে শহরের দিকে উড়ে আসত টিয়াপাখির ঝাঁক। শহরে বেশির ভাগ বাড়ি ছিল তরাই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য মেনে কাঠের খুঁটির ওপর মাটি থেকে অন্তত চারফুট উঁচুতে কাঠেরই ঘর। তখনও কাঠা অত আক্রা হয়নি এ শহরে। তখনও রাতে গাড়ির হেড-লাইট নিভিয়ে লোভের ট্রাক চকচকে করাত নিয়ে লুঠ করত না জঙ্গলের শালশিমুলসেগুনশিশুর দীর্ঘ বনস্পতি।

এই সব লাবণ্য, সবুজ ঘ্রাণ, পাহাড়ি নদীর ছন্দ, ছোট শহরের মানুষের আন্তরিক আত্মীয়তার উষ্ণতা ঘিরে রেখেছিল আমাদের। 

মহানগরের দুষ্ট ক্ষতগুলো তখনও শিলিগুড়িকে আক্রমণ করেনি। বাতাস তখনও অনেক পরিষ্কার। শহরে ধুলো কম, অক্সিজেন বেশি। মোমো আসেনি, মিষ্টির দোকানগুলো তখনও বাঙালি ব্যবসায়ীদের হাতে। পরিষ্কার-পরিছন্ন ছোট্ট শহর। ট্রেন চলে না, কিন্তু শহরের মহাধমনি হিলকার্ট রোডের ওপরে তখনও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়েজের ন্যারোগেজ লাইন পড়ে আছে। পরে সেগুলো তুলে ফেলা হবে। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন হব-হব করছে। পুরনো টাউন স্টেশনের যৌবন ঢলে পড়লেও তার চ্ছটা রয়েছে। তখনও উত্তরে তাকালে শহরের মানুষ দেখতে পায় কাঞ্চনজঙ্ঘায় রক্তরাগ। বিধান মার্কেট সবে শুরু, হংকং মার্কেট চালু হয়নি। অশ্রুকুমার সিকদারের নাম বিরল-উচ্চারিত। আমরা নবোত্থিত-শ্মশ্রু সদ্য-তরুণ কিছু যুবা বয়সের দোষে দু’ছত্তর কবিতা লিখে ফেলেছি। বুদ্ধদেব বসু, সুধীন দত্ত, জীবনানন্দের তিন ছত্তর পড়েও ফেলেছি। অশ্রু সিকদারের নাম অস্পষ্ট কানে আসছে। কে একজন বলল –অশ্রুবাবুর দাঁত দেখা যায় না। আমার বিশ্বাস হয়নি। কোনও মানুষ কখনই হাসেন না, তাই আবার হয় নাকি। পরে সাক্ষাৎ পরীক্ষায় প্রমাণিত হয় যে, উক্ত ধারণা হাইপোথেসিস মাত্র। আমরা ক’জন বন্ধু বেশ কয়েক বার দূর থেকে সৌম্য, শান্ত, একটু ওজনদার চাউনির ধবধবে ধুতিপাঞ্জাবিপরিহিত অধ্যাপককে দূর থেকে দেখে শিহরিত, মনে হয়েছিল একেই বলে অধ্যাপক। আর, বাংলা সাহিত্যের এ রকম একজন ওস্তাদ আমাদের শহরে থাকেন, এটা যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না। মাঝে মাঝেই বাবুপাড়ায় তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের মনে হতো কিছু একটা রেডিয়েশন বোধহয় আমাদেরও স্পর্শ করে গেল।

টাউন স্টেশনের ওভারব্রিজ থেকে রোজ একটা দু’টো তক্তা কমে যায়। আমরা রেল-ক্যান্টিনে আড্ডা মারতে মারতে পরিকল্পনা করি স্যারের বাড়িতে একদিন দেখা করতে যাব। আলোচনা এর বেশি আর এগোয় না। এদিকে টাউন স্টেশনে কুলি কমে যাচ্ছে, এন জে পি-তে বাড়ছে। শহরে পুরনো লোক কমে যাচ্ছে, আনকো লোক বাড়ছে। হঠাৎ একদিন দেখি প্ল্যাটফর্মে শীর্ষেন্দু মুখোপাধায়। আমরা পাকামি মেরে গিয়ে আলাপ করে জানতে চাইলাম তিনি গল্পটার নাম –‘টিকটিকিরা জল খায় না কেন’ রাখলেন কেন। কী যেন একটা সাদামাটা উত্তর দিয়েছিলেন, যেটা আমদের হতাশ করেছিল। আমরা আশা করেছিলাম উনি অস্তিত্ত্ব-অনস্তিত্ত্ব বিষয়ক কোনও ভারি তত্ত্বের কথা বলবেন। একদিন সাইকেল নিয়ে তিন বন্ধু সেবকে বেড়াতে যাওয়ার পথে দেখলাম পথের দু’পাশের গাছপালা সব সাফ। হু হু করে বাড়ছে জমির দাম। হং কং মার্কেটে নতুন ধরনের হাওয়াই চটি এসে গেল। আমি সাইন্সের ছেলে, কালদোষে কবিতা লিখি। একদিন সাহস করে বাংলার অধ্যাপক অশ্রু সিকদারকে ঘেমে নেয়ে তার ক্লাস-লেকচার শোনার পারমিশন চাইলাম। তখন ইউনিয়ন ছাত্রদের ফুসকুড়ি বা ঘামাচির ব্যাপারে খবর্দারি করত না। স্যার আমাকে অনুমতি দিলে আমি, মনে আছে, লাইব্রেরি নীচে এগারো নাম্বার রুমে তাঁর ক্লাস করেছিলাম। বাংলা অনার্সের স্টুডেন্টের সঙ্গে।

সেই ক্লাসই আমাকে নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল। ক্রমে স্যারের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং প্রমাণিত হয় যে, অশ্রুকুমার সিকদারেরও দাঁত দেখা যায়। কিন্তু আমার একটু আপশোষ থেকে যায়, যে এই গুজব ছড়িয়েছিল, তাকে ব্যাপারটা দেখাতে না পারার জন্য।

উটকো লোকে শহর ভরে যাচ্ছিল। শহরে কাঠের খুঁটির ওপরে পুরনো স্টাইলের বাড়ি কমে যাচ্ছিল। চারতলা, পাঁচতলা বাড়ি দেখা যাচ্ছিল। শিলিগুড়ি কলেজ ক্রমশ আয়তনবান হয়ে উঠছে। কথা নেই বার্তা নেই, হঠাৎ তিলক ময়দান হয়ে গেল কাঞ্চনজঙ্ঘা ক্রীড়াঙ্গন। বাঙালিদের মিষ্টির দোকান কমছে, অবাঙালিদের মিষ্টির দোকান বাড়ছে। অশ্রুকুমার সিকদার শিলিগুড়ি কলেজ ছেড়ে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলেন। আমি তখনও গল্প লিখতে শুরু করিনি। কবিতা লিখছি। অনেকগুলো একসঙ্গে স্যারকে দেখিয়ে আনছি। স্যার অবশ্য সরাসরি বলছেন না – কিস্‌সু হয়নি, মুখে উৎসাহ দিচ্ছেন এবং নিজের সংগ্রহ থেকে কবিতার বই দিচ্ছেন পড়ার জন্য। পরে অবশ্য জানতে পেরেছিলাম তিনি নাকি আমার কবিতার প্রশংসা করেছেন। বন্ধুদের সেদিন ক্যান্টিনে চায়ের সঙ্গে ভেজিটেবল্‌ চপ খাইয়েছিলাম। সাইকেল চালিয়ে যখন স্টেশন ফিডার রোড ধরে বাড়ি ফিরছি, মনে হ’ল কানের পাশে সুড়সুড়ি লাগছে। হাত দিয়ে দেখলাম ঘাড়ের রোঁয়াগুলো।

মাঝে মাঝে এক আধটা লিটল্‌ ম্যাগাজিন হাতে আসে। আমরা ক’জন গোগ্রাসে গিলি। কলকাতায় গেলে ম্যাগাজিন আর কবিতার বই কিনে আনি। শহর খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছিল। যতটা ভৌগোলিক এবং জনসংখ্যা ও তাদের বিচিত্র বৈশিষ্ট্যে, ততটা সাংস্কৃতিক ভাবে নয়। একটি, দু’টি ম্যাগাজিন বেরোয় বটে, কিন্তু এত বেশি মফস্‌সলি গন্ধমাখা, আধুনিকতা থেকে অনেক দূরে সেই পত্রিকা আমাদের বিরক্ত করত। ইতিমধ্যে পড়ে ফেলেছি বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, সুধীন দত্ত। আমাদের বন্ধু নিখিল বসু বলল বিনয় মজুমদার না পড়লে আধুনিক কবিতা বোঝা যাবে না। নিখিল আমাদের সর্দার। সে সত্তর দশকের প্রথমেই কলকাতায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠের ডাক পেতে শুরু করেছিল। আমাদের আধুনিক করে তোলার কঠিন সংকল্প করেছিল। ‘ফিরে এসো চাকা’ জোগাড় করলাম। প্রকাশক মীনাক্ষী দত্ত, মূল্য তিনটাকা। কালো রং-এর প্রচ্ছদে কবির মুখাবয়ব। বইটা হাতে নিয়ে কেমন যেন গা শিরশির করে উঠল। “ রোমাঞ্চ কি র’য়ে গেছে; গ্রামে অন্ধকারে ঘুম ভেঙে/ দেহের উপর দিয়ে শীতল সাপের চলা বুঝে/ যে-রোমাঞ্চ নেমে এলো, রুদ্ধশ্বাস স্বেদে ভিজে ভিজে।/ সর্পিণী, বোঝোনি তুমি, দেহ কিনা, কার দেহ, প্রাণ”। আমি, গীতাংশু আর নিখিল তর্কে মেতে উঠি কাব্যের অন্তর্গত চিরকালীন সৌন্দর্য ও মৃত্যুর তুলনামূলক আলোচনায়। শেষে ঠিক হয় অশ্রুদা ছাড়া এ শহরে আর দ্বিতীয় কেউ নেই, যাঁর কাছে যাওয়া যেতে পারে। এর আগে একবার এ রকম হয়েছিল একটি পংক্তি পড়ে – একটি কথার দ্বিধা থরো থরো চূড়ে/ ভর করে আছে সাতটি অমরাবতী। শব্দ ও বাক্যের অন্তর্গত ব্যঞ্জনা, ভারসাম্য, ছন্দের চতুরালি, একটি গূঢ় কথার উড়াল বুঝতে পেরে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যাই। এত গোপন ভার বহন করে কবিতা।

এর মাঝে একদিন অশ্রুদা আমাকে উপহার দিলেন শঙ্খ ঘোষের ‘নিহিত পাতালছায়া’। পড়ে আমি ভোঁ হয়ে গেলাম। কী আলতো অথচ অমোঘ উচ্চারণ। এতকাল যা পড়ে এসেছি, মায় জীবনানন্দ, এ একদম আলাদা। “ ... অসীম ছড়ায় শূন্যে শঠ/ প্রতি মুহূর্তের কণ্ঠ ছিঁড়ে নেয় অন্ধকারে পর্বতকন্দরে মহাকাল/ কারণবিহীন এক মহাপরিণাম ভেসে চলে যায় গভীর সাগরে”। আরও চাই, শঙ্খ ঘোষের আরও বই চাই। যা পেরেছি, জোগাড় করেছি। রাত জেগে কবিতা পড়ি। ডাইরির পৃষ্ঠায় আপনমনে লিখি – তোমার নিজের হাতে ভিক্ষা নিতে এত ভালো লাগে। প্রিয় কবির লাইন। ‘নিজের’ ও ‘ভিক্ষা’ শব্দদুটির নিচে পেন দিয়ে দাগ দিলাম। এক ধরণের ভয় করে উঠল হঠাৎ। আচমকাই আমি বুঝতে পারে শব্দ তার নিজের তৈরি বেড়া ভেঙে কীভাবে সামান্য ভরটুকু শক্তিতে রূপান্তরিত করে নিচ্ছে। মনে হয় আকাশে সহস্র সূর্য ঝল্‌সে উঠল বুঝি। ব্যাঙের ছাতার মত মেঘ। কীভাবে যে একটা দুটো শব্দ তীব্র তড়িৎগ্রস্ত কালো মেঘের মত আকাশে ফেটে পড়ে, কবি ছাড়া আর কেউ বুঝি তার নাগাল পায় না। উৎসারিত মারণরশ্মি ধেয়ে আসে চৈতন্যের দিকে। বিপন্ন বিস্ময়ে কবি দেখতে পায় ব্যক্তিগত আবরণ কেমন করে গলে যায়, খসে পড়ে লৌকিক চামড়া। দগদগে পোড়া ঘা-এর যন্ত্রণায় মানুষ মনে করে হেমলক, একগাছা দড়ি অথবা ধাবমান ট্রামের সামনে আছে ম্যাজিক-মলম।আমাদের শহর বদলে যাচ্ছিল। গাছ কমছিল, হোটেল বাড়ছিল। একটু বেশি রাতে হিলকার্ট রোডের আলো-আঁধারিতে দাঁড়িয়ে থাকে উগ্র সাজে রোগা রোগা মেয়েরা। মহানন্দার জল আরও কালো হয়ে যাচ্ছে। গাড়িধোয়া তেলমবিল, শহরের সব আবিলতা, চা-বাগান গড়িয়ে-আসা বিষ নিয়ে আমাদের শহরের নদী ক্রমে মরে যাচ্ছিল। আমাদের শহরের সব গাছ, তরাই-ডুয়ার্সের গন্ধ, আমাদের নদী – সব চুরি হয়ে যাচ্ছিল। আর আমাদের ভাবনাচিন্তার বদল ঘটে যাচ্ছিল আধুনিক কবিতার দিগ্বলয়ের পরিধি বরাবর। যখনই কোনও সংশয় আসে, মমতাজ আলির রেল-ক্যান্টিনে বসে আমাদের তুমুল তর্ক শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত সেই অশ্রুদার বাড়িতে যাওয়া সাব্যস্ত হয়। ততদিনে আমরা জেনে গেছি অধ্যাপক অশ্রুকুমার সিকদারের আপাতগম্ভীর আবরণের আড়ালে দিব্যি একজন স্বাভাবিক ভালোমানুষ রয়েছেন। এই বিশাল পণ্ডিত মানুষটির সামনে আমাদের আর তখন কোনও সংকোচ ছিল না।