0

স্মৃতির সরণী - বিপুল দাস

Posted in


স্মৃতির সরণী


কথামলা
বিপুল দাস


এই শহর যখন ষাটের দশকের শেষ দিক এবং সত্তর দশকের প্রথম দিকে এক ক্রান্তিকারী সময়ের ভেতর দিয়ে টালমাটাল ভাবে পার হচ্ছিল, আমরা তখন কলেজে। সেই সময়ের কথা এখনও দুঃস্বপ্নে হানা দেয় বারে বারে। এখনও কানে স্পষ্ট শুনতে পাই আমাদের বন্ধু বিপ্লবের ছোট ভাই বিদ্যুতের আর্ত চিৎকার। বাবা বাঁচাও। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। সাথে বিদ্যুতের বুকেপিঠে সি আর পি এফ-এর বুটের লাথির আওয়াজ আর ‘মাদারচোদ নকশাল’ সুভাষিতাবলি। তখন আমরা মাঝে মাঝে খবর পেয়ে যেতাম আজ আমাদের পাড়ায় কৌম্বিং অপারেশন হবে। যাকে বলে চিরুনি-তল্লাশি। পুরো মহল্লা ওরা ঘিরে ফেলত। ওদের সঙ্গে থাকত লোকাল থানার অফিসার। একটা বড় কালো প্রিজন ভ্যান নিঃশব্দে এসে একটু দূরে কোনও অন্ধকারের দাঁড়িয়ে থাকত। একটা জিপ জাতীয় ছোট গাড়িও থাকত। জিপের ভেতরে লুকিয়ে বসে থাকত স্থানীয় খোঁজদার। সাধারণত যুব কংগ্রেসের নেতা। সে-ই দারোগাবাবুকে বাড়ি চিনিয়ে দিত। থানার অফিসার জওয়ানদের নিয়ে দরজায় টোকা দিত। কখনই হা রে রে রে করে ডাকাতের মত হিংস্র উল্লাসে কোনও বাড়িতে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ত না। বা কখনও নক্‌শাল ধরতে গিয়ে বাড়ির মহিলাদের যৌন হয়রানি করেছে – এমন প্রায় শোনাই যেত না। তবে পরবর্তী কালে কোনও মহিলা নক্‌শাল নেত্রী বা সন্দেহভাজনকে গারদে অকথ্য অত্যচার করা হ’ত, সে সব প্রকাশ পেয়েছিল। দরজায় নম্র হাতে নক করত বা মৃদু গলায় দরজা খুলতে বলত। তারপর ওরা শেয়ালের মত গন্ধ শুঁকত। প্রত্যেকটা ঘর, বারান্দা, রান্নাঘর, বাথরুম, চিলেকোঠা, ছাদ, জলের ট্যাঙ্ক, আলসে, ছাদ্ঘেঁষা গাছেও টর্চ মেরে ভালো করে দেখত। সে ভাবেও ক’জন ধরা পড়েছিল। এক রকম আলোর ফানুশ ফাটাত আকাশে। বিস্তীর্ণ অঞ্চল দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে যেত। আমাদের এক বন্ধু রাত তিনটের সময় বাড়ির পেছনের দেওয়াল টপকে প্রায় পালিয়েই গিয়েছিল। তখনই ফানুশের সবুজ আলোয় তার পলায়নপর লিকলিকে পাদু’টো দেখতে পেয়েছিল এক জওয়ান। পাড়ার সবাই গুলির শব্দ শুনে বুঝতে পেরেছিল গেল একজন ভোগে। তখন বাচ্চারাও গুলির শব্দ আর পেটর আওয়াজের তফাত্‌ বুঝতে শিখে গিয়েছিল। পায়ে গুলি লেগেছিল তড়িতের।

তখন সন্ধের পর সবাই মাল টেস্ট করত। এদিক ওদিক মুড়িমুড়কির মত মাল পড়ত। আমরা শিওর ছিলাম আমাদের এ পাড়াটা মুক্তাঞ্চল তৈরি হতে আর বেশি দেরি নেই। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার সি এম-এর স্বপ্ন সফল হবেই। ভারি ভারি শব্দগুলো মুখের মধ্যে নিয়ে নাড়াচাড়া করতাম। আহা, কী ওজনদার শব্দ। মহান জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব, আধাসামন্ততান্ত্রিক-আধাঔপনিবেশিক। কেয়া বাত। পার্লামেন্ট শুওরের খোঁয়াড়। হক কথা। শুধু চারু মজুমদার নন -- সরোজ দত্ত, সুশীতল রায়ছৌধুরীদের লেখায় আমরা বুঝতে পারছি সে সব কথা। কত নতুন নতুন শব্দ। পাতি-বুর্জোয়া, ভারতবর্ষের কুলাক-শ্রেণী। শব্দগুলো মুখের ভেতরে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে কপাত্‌ করে গিলে ফেলি। শরীরে রক্তের সঙ্গে মিশে যায় চারুদার বাণী। দেশব্রতী পড়ে জানতে পারি শ্রীকাকুলামের কমরেডদের বীরত্বের গল্প। ডেবরা, গোপীবল্লভপুর নাকি মুক্তাঞ্চল হয়ে গেছে। কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের ঐক্য জিন্দাবাদ -- জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।

কলেজ ক্যান্টিনে একদিন সি পি আই-এর সম্প্রীতিদাকে বেল্ট খুলে বেদম মার দিল অভিজিৎ। আমরা থামাতে পারি না। আমাদের সঙ্গে সি পি আই-সি পি এম-এর ছেলেদের খুব দ্রুত বিভাজন ঘটে যাচ্ছিল। বন্ধুরা অনেকেই শত্রু শিবিরের। আমাদের কমরেডদের মনে হত আত্মার আত্মীয়। ওকে রক্ষা করার জন্য আমাদের জান দিতে হবে। ওপরে ওপরে ওদের সঙ্গে ক্যান্টিনে চা-চারমিনার খেলেও বুঝতে পারছিলাম ও আসলে আমার শ্রেণিশত্রু।

হঠাৎ একদিন দেখলাম আমাদের স্কুলের দেওয়ালে লেখা রয়েছে – কমরেড রণজিৎ অমর রহে। বুকের ভেতরে ছাঁৎ করে উঠল। লম্বা, ফর্সা, মোচওয়ালা রণজিৎদা এক রাতে আমার ঘরে ছিল। বীরভূমের ছেলে। কোনও রাজনীতির কথা নয়, সারা রাত আমরা শুধু কবিতা নিয়ে গল্প করে গেছি। কী অসাধারণ মেধা, কী অগাধ পড়াশোনার গভীরতা, কী আশ্চর্য স্মৃতি। সার্ত্রের অস্তিত্ত্ববাদ থেকে চার্বাকের দর্শন, নাজিম হিকমত থেকে হাইনের কবিতা। সেই প্রথম জেনেছিলাম ‘বিংশ শতাব্দীতে/খুব বেশি হলে একবছর/ মানুষের শোকের আয়ু – অমর এই পংক্তির রচয়িতা নাজিম হিকমত। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদ। আমি শুধু মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনে গেছি। ভারতবর্ষকে আরও একবার স্বাধীন করবে বলে চারু মজুমদারের ডাকে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রণজিৎ।

বেশির ভাগ রাত কাটে দূরে কোনও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। কলেজের পরীক্ষা ক্রমাগত পিছিয়ে যায়। সি পি এম-অধ্যুষিত এলাকায় যেতে পারি না। এ সবের ভেতরেই ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’—এই বাক্য নিয়ে সংশয়ে পড়ে যাই। কারও সঙ্গে আলোচনা করা সম্ভব নয়। পার্টিতে সংশয়বাদীরা সবচেয়ে বিপজ্জনক। এ ভাবেই আমার অ্যাকাডেমিক কেরিয়ার ডুম হয়ে যায়। নরমেধ যজ্ঞে মেতে উঠেছে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের পুলিশ। গভীর রাতে অশ্বমেধের বলি হয়ে যায় সোনার টুকরো ছেলেরা। যা, পালা – পেছন থেকে বিশ্বাসঘাতক রাইফেলের গরম সিসা ছুটে এসে বিপ্লবের শরীর থেকে গরম রক্ত বের করে নেয়। শত শহিদের লাশ পড়ে থাকে আলপথে, লেকের ধারে, মহানন্দার পারে, ছাতিমগাছের নীচে।

কলেজ-ক্যান্টিনে প্যারোডি গান গেয়ে মিহির তখন হেবি নাম করে ফেলেছে (পরে মিহিরাচর্য হয়ে কোষ্ঠীবিচার করত)। পায়রা ডিম পেড়েছে অ্যাটম বোম, জ্যোতি তাতে তা বসায়। হাঁড়ি ফেটে বেরিয়ে এল ডজন খানেক ডাঙে। তখন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির গান মার্কেটে হেবি হিট। মিহির প্যারোডি বাঁধল – আমি সেই জ্যোতি বোস নই রে, সেই জ্যোতি বোস নই। আমি ভোটের জ্যোতি, জোটে মতি কলকাতাতে রই। আমি বেঞ্চে দাদরায় তাল ঠুকি – ধা ধিনা না তিনা ধা ধিনা না তিনা। ক্যান্টিনের রাখালদা একদিন আপত্তি জানাল। সি পি এম-এর ছেলেরা নাকি বলেছে ক্যান্টিন বন্ধ করে দেবে। কলেজ ইলেকশনে সুতলি প্যাঁচানো বিশাল একটা মাল চার্জ করল মৃদুল। একটুর জন্য বেঁচে গেলেন মাইতি স্যার।

খবর ছিল সেদিন আমাদের পাড়ায় ছানবিন হবে। একটু বেশি রাতে খবর পেয়েছিলাম। তড়িঘড়ি সব দেশব্রতী এক জায়গায় করে মহানন্দায় ভাসিয়ে দিয়েছিলাম। আমার ঘরে দেশব্রতী পেলে আমাকে কেউ বাঁচাতে পারত না। খুব খারাপ লাগছিল। কত গুরুত্বপূর্ণ সব প্রবন্ধ ছিল।

আস্তে আস্তে সব কেমন শুনশান হয়ে আসছিল। শ্রেণিশত্রু খতম অভিযান নিয়ে কোথাও কোনও খবর পাচ্ছিলাম না। টেলিফোন গোডাউনের ফাঁপা খুঁটিগুলোর ভেতরে লুকিয়ে-রাখা সব মাল একদিন ধরা পড়ে গেল। তার মাঝেও একদিন তরুণ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঠান্ডা মাথায় পাইপগান চালিয়ে কনেস্টবল উড়িয়ে দিল। সব পুলিশের কোমরে চেন। চেনের সঙ্গে বন্দুক বাঁধা। চারুদা বলেছেন ওদের অস্ত্র কেড়ে নিয়েই আমাদের অস্ত্র ভাণ্ডার গড়ে তুলতে হবে।

চারদিক থেকে ভেঙে পড়ার আওয়াজ শুরু হয়েছিল। নর্থবেঙ্গল ইউনিভার্সিটির কিষান চ্যাটার্জীর কোনও খবর পাচ্ছি না। অরবিন্দদা, দীপকদা – যাঁরা সবসময় চারুদার পাশে থাকত, তাদের কাছ থেকে কোনও খবর পাচ্ছি না। সি পি এম-এর ছেলেরা চান্স পেলেই আমাদের ধরে ক্যালাচ্ছে। রয়েছে কংগ্রেসি গুণ্ডাদের চোরাগোপ্তা আক্রমণ। এরই মাঝে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। হঠাৎ একদিন শুনলাম বিধান সভা নির্বাচনের মুখে ্মিহির কংগ্রেসের হয়ে পথসভা করেছে। ভালো বক্তা ছিল মিহির। স্ট্রিট কর্নার জমিয়ে দিল। পার্টি লুফে নিল ওকে।

পালাচ্ছি পালাচ্ছি পালাচ্ছি। অন্ধকারে একদিন আমি আর মিলন মুখোমুখি বসে মুড়ি খাচ্ছি। মিলন বলল – কংশাল হবি ? মিলনের জামাইবাবু সিদ্ধার্থ রায় পর্যন্ত লাইন করে ওর সেফ ব্যবস্থা করে ফেলেছে। এই জামাইবাবু মিলনের দিদিকে ইলোপ করলে মিলন পাইপগান হাতে নিয়ে কসম খেয়েছিল এক নম্বর শ্রেণিশত্রু বুবু মজুমদারকে খতম করতেই হবে।

কংশাল শুনে আমার ভাঙনের শব্দে আমিই ভেসে যাই। কেন, কেন এমন হ’ল ? কী ভাবে, কখন আমরা জনগণের থেকে দূরে সরে গেলাম। সে কি মূর্তিভাঙা ? সে কী নিরীহ কনেস্টবলের মৃত্যু ? চারু মজুমদারকে কি কেউ ক্রমাগত মিথ্যে মুক্তাঞ্চলের স্বপ্ন দেখিয়ে গেছে। ভাগ্যিস অন্ধকার। তবু আমি মিলনের চোখের দিকে তাকাতে পারি না।

স্থিতাবস্থা টালমাটাল করে অবস্থার পরিবর্তন চেয়েছিল একটা প্রজন্ম। সব ছেড়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিল। ওরা বিশ্বাস করেছিল একটি স্ফুলিঙ্গ দাবানল সৃষ্টি করতে পারে। রাত জেগে স্টেনসিল কাটা হ’ত মাও-সে-তুং-এর। মাথায় সেই বিখ্যাত লালতারা দেওয়া টুপি। ভারতবর্ষ জুড়ে একটা ঢেউ এসেছিল বিপ্লবের। এখনও খুঁজে দেখলে হয়তো পশ্চিমবঙ্গের কোনও জীর্ণ দেওয়ালে পাওয়াও যেতে পারে সেই ছবি। টুপি-মাথায় চেয়ারম্যানের সেই ছবি। দেওয়ালে এখন শ্যাওলা পড়ে গেছে। বেশির ভাগ পুরনো দেওয়াল ভেঙে নতুন দেওয়াল উঠেছে। নতুন সিমেন্টবালির আস্তরণে কোথায় চাপা পড়ে গেছে বিখ্যাত সেই স্টেনসিল-কাটা ছবি। যে ছবি দেখলে একদিন স্পন্দিত হয়ে উঠত বুক।

আমাদের পাড়ার পাতু যে রাতে ওয়ালিং করতে বেরোত, পরদিন সকালে ঊঠেই তার হাতে আলকাতরার দাগ দেখানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ত। কিন্তু সরাসরি নয়। কায়দা করে হাতদুটো পেছনে লুকোনোর চেষ্টা করছে, এমন একটা ভান করত। সবাই কৌতূহলী হলে, যেন কিছুই না, হাত সামনে এনে দেখাত। এই করতে গিয়ে কংগ্রেসি দালালের নজরে পড়ে যায়। সি আর পি এফ-এর এক জওয়ান তার তলপেটে সবুট লাথি ঝেড়েছিল। বন্দীমুক্তি পর্বের পরবর্তী অধ্যায়ে দেখা গেল তার মলমূত্র ত্যাগের কোনও কন্ট্রোল নেই। তাদের বাড়ির মার্বেলের মেঝে যখন তখন সে নষ্ট করে ফেলছে। তার ডাক্তারদাদা আন্তরিক উদ্যোগ নিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ করে এনেছিল। কিন্তু কক্সিস অঞ্চল বসে যাওয়ার ফলে পাতু ন্যুব্জ বৃদ্ধের মত লাঠি হাতে হাঁটাচলা করত। কোনও এক পনেরই আগস্টের পুণ্যলগ্নে পাড়ায় তেরঙ্গা উত্তোলনের সময় সে চিরদিনের জন্য বসে পড়ে। সম্ভবত শেষ মুহূর্তে পাতু ‘জয়হিন্দ’ বলার চেষ্টা করেছিল। তার পাঞ্জাবির পকেটে একটি পনেরই আগস্টের চকোলেট ছিল।

কিছুদিন আগে আমার কাছে একটি ছেলে অভিযোগ করছিল – জানেন স্যার, এই মিহির মাস্টারমশাই ‘বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থায় যে যত পড়ে, সে তত মূর্খ হয়’ বলে পরীক্ষার হলে ঢুকে আমার খাতা কেড়ে নিয়েছিল। আর এখন, উনি নিজেই জ্যোতিষচর্চা করছেন। গুষ্টির রাহুকেতু করে হাতে পাথর পরাচ্ছেন। আমি ওর কথার কোনও উত্তর দিতে পারিনি।

0 comments: