0

প্রবন্ধ - পল্লববরন পাল

Posted in


প্রবন্ধ


পাখির চোখ 
পল্লববরন পাল 



কী দেখা যাচ্ছে সামনে? 

এই বিখ্যাত প্রশ্ন পৃথিবীতে সম্ভবত প্রথম করেছিলেন অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য – তাঁর একশো পাঁচজন ছাত্রের উদ্দেশে, যার মধ্যে একজন মাত্র উত্তর দিয়েছিলেন – পাখির চোখ – আমরা সবাই জানি সেই ছাত্রের নাম অর্জুন - এবং অর্জুনের দেওয়া উত্তরটাই নাকি সঠিক উত্তর – শুধু পুরাণেই নয়, ত্রেতা-সত্য-কলি যুগনির্বিশেষে গুরু-শিক্ষক-বাবা-মা-অভিভাবকেরা ছাত্রছাত্রী-সন্তানসন্ততিদের মুখ থেকে এইরকম উত্তর পেলে যারপরনাই তৃপ্ত ও গৌরবান্বিত বোধ করেন। যদিও পাখির চোখ ব্যাপারটা প্রতিকী – এখনকার শহুরে ছেলে ছোকরারা তো আর পাখি দেখবে না, কারণ শহর থেকে আমরা উন্নয়নের নামে যেমন গাছপালা উচ্ছেদ করেছি, কলেরা নির্মূল করেছি, তেমনি পাখিদেরও আধার কার্ড ইস্যু করিনি, আমরা গর্ব ভরে পাখিহীন শহরের নামে সোচ্চার হই – এখনকার ছেলেরা তাই এই প্রশ্নের উত্তরে ‘পাখির চোখ’-এর পরিবর্তে পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলবে – ‘আমেরিকা’, এবং এই উত্তরে অভিভাবকদের চোখও আনন্দে চকচক করে উঠবে। মহাভারতের যুগে যা ছিলো পাখি, একশো বছর আগে যা হয়তো ছিলো স্বাধীনতা, আজ সেটাই আমেরিকা – অথবা অন্য কিছু। 

বিজ্ঞান আমাদের শিখিয়েছে, ধ্রুব সত্য (সোজা বাংলায় যাকে আমরা absolute truth বলি) বলে কিছু নেই, যে কোনও সত্যের গায়ে গা ঠেকিয়ে প্রিয় বন্ধুর মতো থাকে কিছু স্থান-কাল-পাত্রের শর্ত – অর্থাৎ স্থান কাল বা পাত্রের পরিবর্তনের সংগে সংগে সত্যেরও বদল ঘটে। একই সময়ে পৃথিবীর কোনও এক জায়গায় দিন, আবার কোনও এক জায়গায় রাত – একই মুহূর্তে দুটোই সত্য, কিন্তু দুটি আলাদা জায়গায় – এখানে এই দুটি সত্যের সঙ্গে কাল ও স্থানের যুগপৎ শর্ত আছে। 

একটা ধোঁয়াটে কুয়াশা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে - মনের মধ্যে খচ্‌খচ্‌ - অর্জুন ছাড়া বাকিরা উত্তরে যা বলেছিলো, অর্থাৎ - গাছ পাখি আকাশ মানুষজন ইত্যাদি অনেক কিছুই দেখা যাচ্ছে – এ উত্তরটার মধ্যে ভুলটা কোথায়? আদৌ কি ভুল বলা যাবে এই উত্তরটাকে? 

আসলে যে কোনও প্রশ্নেরই একাধিক উত্তর হতে পারে। উত্তরদাতাকে বুঝতে হবে, প্রশ্নের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি? অর্থাৎ প্রশ্নকর্তা এই এতগুলো উত্তরের মধ্য থেকে কোন উত্তরটা আশা করছেন। হাঁ-মুখের সামনে সন্দেশ হাতে নিয়ে যদি কেউ প্রশ্ন করেন – মিষ্টিটা কি আমি খাবো? – উত্তরদাতাকে সর্বাগ্রে বুঝতে হবে – উনি গলাধঃকরণের জন্য বড়োই উদগ্রীব ও উতলা হয়ে আছেন, এ প্রশ্নের মাধ্যমে শুধুমাত্র আপনার সম্মতি চান – এখন যদি আপনি হঠাৎ হাঁ হাঁ করে ডায়াবেটিসের ওপর একটা উইকিপিডিয়া-মুখস্থ দীর্ঘ বক্তৃতা শুরু করেন – ত্রেতা বা সত্য যুগে কী হতো বলতে পারবো না, তবে কলিযুগে যে আপনার কপালে নির্ঘাৎ চোদ্দপুরুষ উদ্ধারকারী অনভিধানিক শব্দাবলী অথবা বাংলা প্যাঁদানি জুটতো, এটা বলার জন্য আমাকে জ্যোতিষশাস্ত্রে ডিলিট হওয়ার দরকার নেই। 

কী দেখা যাচ্ছে সামনে? 

জ্যোতিষশাস্ত্রর কথা এলোই যখন, এই প্রশ্নটির সম্পূর্ণ অন্য একটি মাত্রা উদ্ঘাটিত হলো – এযাবৎ মনে পড়ে গেলো – একমাত্র জ্যোতিষীরা এই প্রশ্নে যার পর নাই আহ্লাদিত হন, কারণ, ওঁরা দাবি করেন যে, সামনে যা যা দেখা যাচ্ছেনা, মানে সাদাচোখে আমরা যা দেখতে পাইনা অর্থাৎ আমাদের সামনের দিনগুলো কেমন কাটবে, মানে আমাদের ভবিষ্যৎ ওঁরা পরিষ্কার দেখতে পান - যা আমরা চেষ্টা করেও পারিনা। 

জ্যোতিষীরা একজন একজন করে মানুষকে তার নিজস্ব ভবিষ্যৎ দেখান, এবং এ কথা অনস্বীকার্য যে, আমার ভবিষ্যৎ আমি মনে মনে ঠিক যেমনটি দেখতে চাই, মোটামুটি জ্যোতিষীর গণনাও সেই পথই নির্দেশ করে, কিন্তু এই পথে অনেক লোমহর্ষক ঘটনা-টটনা ঘটাতে হয় তাঁদের, জীবিকার খাতিরেই - নইলে আমাদের অন্ধ বিশ্বাসের সুতো আলগা হয়ে যেতে পারে। এটা তো ঘটনা যে, সুতোটা সত্যিই খুব আলগা। অবশ্য আলগা বলিই বা কি করে – যেখানে সংবাদপত্রে বা টেলিভিশনে জ্যোতিষীদের রমরমা বিজ্ঞাপণ ক্রমবর্ধমান। আসলে জ্যোতিষ দাঁড়িয়ে আছে শুধুমাত্র একটা ধারণা বা বিশ্বাসের ওপর, যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি এখনও প্রতিষ্ঠিত নয়। তাতে অবশ্য ইদানিং কিছু যায় আসেনা। কারণ, খুব সুচিন্তিতভাবেই জড়িবুটি যজ্ঞমন্ত্র ইত্যাদির ওপর মানুষের আস্থা ফেরানোর ভয়ঙ্কর কৌশলকে মানবকল্যাণকর হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে সর্বত্র – ছোটবেলায় জানতাম – সাধু-সন্ন্যাসীরা মূলত হিমালয়বাসী – ইদানিং দেখছি দেশের এবং বিভিন্ন রাজ্যের রাজধানীতেই শাসনক্ষমতার আশেপাশেই এই সব জটাজুট সাধু সন্ন্যাসীদের ভীড় ক্রমবর্ধমান। জ্যোতিষশাস্ত্রকে(Astrology) জ্যোতির্বিজ্ঞানের(Astronomy) সাথে গুলিয়ে দিয়ে জ্যোতিষের গায়ে বিজ্ঞানের পোষাক পরানোর একটা গভীর চেষ্টা অনেকদিন ধরেই চলছে গোপনে গোপনে। ইদানিং তো টুথপেস্ট থেকে পায়খানার প্যান পরিষ্কারের লোশন সবকিছুতেই জড়িবুটির পরিমাণে মানুষের বিশ্বাস আদায়ের কর্পোরেট প্রতিযোগিতা চলছে। মৃতদেহ নিয়ে যজ্ঞ পূজা এসব আবার ফিরে ফিরে আসছে। বৃষ্টি আনবার জন্য পূজা, বন্যা রুখবার জন্য পূজা – এসব তো সামাজিক আচার অনুষ্ঠান হিসেবে দেখি আমরা। আমরা শক্তিদেবীর পুজো করি বিপুল জাঁক আড়ম্বরে, কিন্তু শক্তিদেবীর মন্দিরে তাঁর মূর্তির সামনে একটি আট বছরের মেয়েকে কয়েকজন শক্তিপুজারীর উপর্যুপর ধর্ষণ ও হত্যার পরেও সেই দেবীর শক্তির প্রতি আমাদের কোনও প্রশ্ন জাগেনা। 

কী দেখা যাচ্ছে সামনে? 

পাঁচ বছর বাদে বাদে এক একজন দ্রোণাচার্য গুরু এই প্রশ্ন করেন কোটি কোটি ছাত্রের উদ্দেশে – প্রথম দ্রোণ দেখিয়েছিলেন কাঠের পাখি, সাম্প্রতিক দ্রোণেরা দেখান ‘উন্নয়ন’ কিম্বা ‘আচ্ছে দিন’ – তফাৎ, প্রথমবারের পরীক্ষায় পাশের হার ০.৯৫, এক শতাংশেরও কম, নিরানব্বই শতাংশ ফেল – আর এখন? – এখন পাশ-ফেল উঠে গেছে, সবাই পাশ। সবাই দেখতে পাচ্ছে পাখি এবং আরও নির্দিষ্ট করে বললে ‘পাখির চোখ’ – এ ছাড়া অন্য কিছুই আর দেখা যাচ্ছে না। অন্তত খাতায়-কলমে তো তাই। 

সত্যি কি তাই? 

একদল সামনে দেখছে উন্নয়নের সুনামি, আর এক দল কিন্তু দেখছে আধপেটা কৃষকদের বিক্ষোভ মিছিল - এক দল দেখছে লণ্ডন, অন্য দল দেখছে ভাগাড় - এক দল সংরক্ষণ বলতে বোঝে গরু, অন্য দল বোঝে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর মানুষ - এক দল দেখছে সামনে ‘আচ্ছে দিন’, অন্য দল দেখছে ধর্ষিতা কন্যাশ্রী। 

তপন সিংহের ‘আতঙ্ক’ সিনেমার সেই বিখ্যাত ডায়লগ – মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি। মাস্টারমশাইয়ের চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সেই ভাঙাচোরা ভয়ার্ত মুখের ক্লোজ-আপ আমরা কেউ ভুলিনি। ভোলবার কথাও নয় – কারণ, আজ ঘরে ঘরে আমাদের সকলের মুখের ক্লোজ-আপে অবিকল সেই একই আতঙ্ক। সেই সিনেমার গল্পে ঘটনাচক্রে রাস্তার মাঝখানে ভর সন্ধ্যাবেলায় মাস্টারমশাই যা দেখে ফেলেছিলেন, সেটাই আসলে কিন্তু উনি দেখেননি – মানে দ্রোণাচার্য যা দেখাতে চান না, উনি সেটাই দেখে ফেলেছিলেন – এবং যেহেতু সেই দেখাটা একেবারেই উচিতকাজ হয়নি, তাই সেটা আদৌ ঘটেইনি কোনওদিন, অর্থাৎ উনি ভুল দেখেছিলেন। মাস্টারমশাইয়ের বোঝা উচিৎ ছিলো যে, দ্রোণাচার্যের ইচ্ছেমতো ওঁর ওইসব কৃষকমিছিল, ভাগাড়, অনগ্রসর মানুষ বা ধর্ষিতা কন্যাদের দেখতে পাওয়াটা মোটেই উচিৎ কাজ নয়, বরং ওতে জান-প্রাণ-মান সংশয়ের যথেষ্ট আশঙ্কা আছে - পরীক্ষায় যদি দশে দশ পেতে হয়, তবে ওঁকে দেখতে হবে – 

শুধুই পাখির চোখ 

অর্থাৎ 

উন্নয়ন আর আচ্ছে দিন 

যা ওঁর মতন আমরাও সবাই সামনে বেমালুম দেখতে পাচ্ছি। 

0 comments: