0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


ফকিরাণি কথা (প্রথম পর্ব) 
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায় 


বাউলানিদের কথা যখন হামেশাই হয়, তখন একটু ফকিরাণিদের কথাও হোক। কিন্তু সেকথা বলতে গেলে আগে গোড়ার দু/চার কথা বলা প্রয়োজন। সত্যি কথা বলতে কি, বাউল সাধনা করেন এমন এক বাউলের আশ্রমে আমার দেখা হয়েছিল মুর্শিদাবাদ থেকে আসা লালবাবার সঙ্গে। তিনি সাহেবধনী সম্প্রদায়ের মানুষ। দোল উৎসবে গেছি সেই আশ্রমে, অনেকে এসেছেন সেখানে। বয়স্ক, বৃদ্ধ লাল টুকটুকে আপেলের মতো মানুষটি আমায় বলেছিলেন—মা রাধারাণী, মেয়ে বাউল খুঁজে বেড়াচ্ছিস, আমাদের ওখেনে যা, কত মেয়ে বাউল, মেয়ে ফকির দেখতে পাবি। ওদের চেনার লোক কম রে মা, পারিস যদি...তবেই বুঝব!’ বলেই যে হাসিটি হাসলেন, সে অমূল্য। 

বাউল-ফকিরদের আড্ডায়, আখড়ায়, আশ্রমে কত রকম কথার যে চাষ! আর কি মিষ্টি করেই যে তাঁরা কথা বলতে পারেন! আগে সেকথাই হোক, এ তো আর রেলের গাড়ি নয়, যে ঠিক সময়ে ইস্টিশনে গাড়ি থামতে হবে! এ হলো গালগল্প, একটু এদিক/ওদিক হলেই ক্ষতি কি বাপু, দুটো কথা নাহয় বলেই যাই। 

যে আশ্রমে গিয়েছিলুম, সেই আশ্রমের মূল মানুষটিকে সকলে গুরুজি বলে ডাকেন, দেখাদেখি আমিও তাই। একদিন সকালের দিকে গুরুজির কাছে গেছি, গিয়ে দেখি গেরুয়া ধুতি, চাদর, মাথায় গেরুয়া টুপি পরা এক সাধু বসে আছেন গুরুজির পাশে। গুরুজি আমায় ডেকে পরিচয় করিয়ে দিলেন---এ হলো পরমানন্দ আশ্রমের সাধুজি, তুই চিনিস না। এর সঙ্গে আমার বড় প্রেম গো’। আহা...এভাবে কেউ বলতে পারে নাকি, এর সঙ্গে আমার বড় প্রেম! বুকের মধ্যে কেমন যেন ধ্বকধ্বক করে উঠল। কই, আমি তো বলতে পারি নে, কার সঙ্গে আমার প্রেম! বলতে আর পারলুম কই, এ জীবনে? আর এমন উদার ভাবে আমরা কাউকে গ্রহণ করতেই কি পারি? জানি না, একটু হয়ত কথা শুনে অন্যমনস্ক হয়েছিলুম, গুরুজি আমায় হাঁক দিলেন—ওরে, তোদের সেই সিনেমার গান আছে না...তুমি দেখ নারী-পুরুষ/ আমি দেখি শুধুই মানুষ’। যেদিন সেটা পারবি, সেদিন বুঝবি তুই মানুষ হলি।‘ বুঝলুম, সাধুবাবা আর গুরুজি আলাদা পথের পথিক, তবু তারা একে অপরের গুণমুগ্ধ, সেখানে ধর্মের কোনও বিভেদ নেই, পথের কোনও বিভেদ নেই, মানুষে মানুষে কোনও বিভেদ নেই। গুরুজী তাঁর কাছে কাজের কথা আশ্রমের কথা, সুবিধে-অসুবিধের কথা বলেন, বলেন স্বামীজিও। তারপর দুজনে খানিক গল্প গুজব করে আবার যে যার কাজে চলে যান। কোথাও কোনও মলিনতা নেই, কোনও বিরোধ নেই,উজ্জ্বল অন্তর আলোর মতো। 

হচ্ছিল আশ্রমের গানের কথা, এসে পড়লেন সাধুবাবা। যে কথা বলছিলেম, সেই আশ্রমেরই এক দোল উৎসবের সময় আমার দেখা লালবাবার সঙ্গে, আবার আমার আলাপ হলো সেদিনই বাউল-ফকিরদের বন্ধু শক্তিনাথ ঝা মশাইয়ের সঙ্গেও। একটু খুলে বলি। কদিন ধরেই আশ্রমে যাচ্ছি, এটা সেটা নিয়ে গুরুজিকে প্রশ্ন করছি, বিরক্ত করছি। সেদিন শক্তিনাথ ঝা মশাইয়ের সঙ্গে উনি আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন, উনিও এসেছিলেন গুরুজীর উৎসবে। গুরুজি তাঁকে বললেন—এই যে এই মেয়েটা খালি এখান-সেখান যেতে চায়, জানতে চায়। আপনি পড়াশোনা জানা মানুষ, দেখুন তো এটাকে’ বলেই আমাকে ঠেলে দেবার ভঙ্গি করে বললেন—যা’। আমি অল্প হেসে গুরুজীর দিকে তাকিয়ে বললুম—জয়গুরু! গুরুজি হেসে ফেললেন—যা, আর আমাকে জ্বালাস না।‘ 

বসলুম শক্তিনাথ বাবুর কাছে। সেই একদিনের কয়েকঘন্টার সুবাদে তিনি আজও আমার মাষ্টারমশাই। আমি খুব সামান্য বাউলানি-ফকিরাণিদের কথা জানি, জানি না বলাই সমীচীন, খুব সামান্যই তাঁদের জগতকে দেখেছি; অনুভবও আমার অতি সামান্য, তবু যদি কিছু পূর্বজন্মের করুণা আমার উপর থাকে, তাহলে সুধীরবাবু এবং শক্তিনাথ বাবুর মতো শিক্ষক পাওয়াই আমার জীবনে পরম প্রাপ্তি। তাঁরা দুজনেই আমার প্রথাগত শিক্ষক নন। সুধীরবাবুর সঙ্গে পরে যদিও বা কয়েকবার দেখা হয়েছে,শক্তিনাথবাবুর সঙ্গে আমার দেখা সেই একবারই। আমি নিশ্চিত, তিনি তাঁর কয়েকঘন্টার ছাত্রীটিকে মনে করতে পারবেন না, সম্ভবও নয়। তবু তাঁর কথাতেই আমি ফকিরাণিদের নিয়ে আগ্রহী হয়েছিলাম। তিনিই আমায় উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন—অন্ত্যজ মানুষদের নিয়ে কাজ কর, বাউল-ফকিরদের নিয়ে কাজ করতে চাইলে, মেয়েদের নিয়ে কর। ওরা পুরুষদের কাছে মুখ খুলে কথা বলতে পারে না, একজন নারীর পক্ষে সে কাজ করাও অনেক সুবিধেজনক। আর ঘুরে ঘুরে, মাঠে নেমে কাজ কর, যত পারো ওদের দেখো, সঙ্গ করো, নইলে চিনবে কি করে! মহিলা ফকিরদের নিয়ে কোনও কাজই হয়নি, যদি একটা পাতাও তুমি ওদের নিয়ে লিখতে পারো, জানবে তুমি পেরেছ। শুরু করো।‘ 

ঠিক সেই লোভে যে কাজ করতে শুরু করেছি তা নয়। এ তো আর এসি বার্থ রিজার্ভ করে বেড়াতে যাওয়া নয়, এ কাজ কত যে কঠিন, কত রকমের সমস্যার, বিরক্তিরও সম্মুখীন হতে হয়, যারা এই কাজে রত তারাই জানেন। এই নিয়ে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা একটু বলে নিই। এক জায়গায় এক মহিলা ফকিরের সন্ধান দিলেন একজন। তিনি নাকি খুব সাধনা করেন, সব কিছু বলে দিতে পারেন, তাঁর এমন ক্ষমতা। সব সময় হাতে তসবি নিয়ে মালা ঘোরাচ্ছেন। কম কথা বলেন। তাঁর কাছে গেলে হয়ত ফকিরাণিদের সম্বন্ধে কিছু জানা যাবে। 

গেলুম, যা অভিজ্ঞতা হলো সে আর বলার নয়। মহিলার সঙ্গে একজন ভদ্রলোকও ছিলেন, তাঁর স্বামী কিনা জানি না। ফকিরাণিদের কি স্বামী থাকে? তখনও বিশেষ কিছুই জানি না, তেমন করে খোঁজখবর করাও হয়নি। মহিলার চেয়ে দেখলুম সেই ভদ্রলোকই বেশী কথা বলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আমার অসুবিধেটা কি?
--আমার তো কোনও অসুবিধে নেই।‘ 

তিনি ঠিক কি অসুবিধের কথা বলছেন, তাও বুঝলাম না। এবার লোকটি সেই মহিলাকে ইশারা করলেন, তিনি জিজ্ঞেস করলেন---আমার কি স্বামীর সঙ্গে কোনওরকম বনিবনার অভাব? আমি কি সেজন্য ওনাদের কাছে এসেছি? 

আমি অবাক! বললুম-- না, আমার সে অসুবিধের কথা নয়,আমি তো সেজন্য আসিনি! আমি মহিলা ফকির দের সম্বন্ধে জানতে এসেছি। একজনের কাছে এনার সংবাদ পেলুম’ বলে মহিলাটিকে দেখাই। 

ভদ্রলোক আবার বললেন—স্বামী কি অন্য নারীতে আসক্ত? স্বামীর সঙ্গে বোঝাপড়া না থাকলে ঠিক করে দেওয়া যায়, এসব আমাদের কাছে কিছু নয়। কিন্তু কিছু টাকা-পয়সা লাগবে, জলপড়া এসব তো আছে... বুঝতেই তো পারেন, তার ওপর ধরুন কবজ, তাবিজ এসব নিতে গেলে...’ মাঝপথে উঠে পড়ি। আর কোনও কথা নয়। এ অভিজ্ঞতা আরও হয়েছে। 

একজন মহিলার সাংসারিক, পারিবারিক বৃত্তের বাইরে এসে ঘুরে বেড়ানোর মধ্যে যে কতরকমের অসুবিধে, যারা যান তারাই বোঝেন ভালো। কত রকমের যে দায় দায়িত্ব! সত্যি কথা বলতে কি, অনেক সময় সেসব দায়-দায়িত্ব এড়ানোও যায় না। মা হয়েছি, সন্তানের পাশে থাকা, স্বামীর প্রয়োজনে বাড়িতে থাকা, বৃদ্ধশ্বশুরমশাইকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়া এমন সব হাজারো কাজের পরিধি থেকে বেরিয়ে যেতে অনেক সময়ই পারিনি। যা করা যেত, তার অনেক বাকি, করতে আর পারলুম কই? 

শুধু ঘুরে বেড়ানোর ফলে হয়েছে ঘোরার নেশা, হয়েছে মানুষ দেখার নেশা। মানুষকে কাছ থেকে জানতে, চিনতে তাই তো এত ভালো লাগে...! 

ফকিরাণি সম্বন্ধে বলতে গেলে নারী সাধনার দিকটির কথা আগে একটু বলতে হয়। সেই প্রসঙ্গেই আসি। 

বিভিন্ন লৌকিক ধর্মগুলিতে নারীর অংশগ্রহণ সাদরে গৃহীত এবং নারীকে সিদ্ধিদাত্রী বলেও মনে করা হয়। নারীই সেখানে প্রকৃত গুরু। কিন্তু বাউল,সহজিয়া তন্ত্রবাদ প্রভৃতিতে সেকথা স্বীকার করলেও জনমানসে এর প্রতিক্রিয়া বিপরীত। আবার যেভাবে বাউলানি-বৈষ্ণবীদের (এখানে উভয়কেই বাউলানি নাম দিয়েছি)দেখা যায় প্রকাশ্যে আচার বা ধর্মপালন করতে, মহিলা ফকির কিংবা ফকিরাণিদের তেমন দেখা যায় না। সামাজিক বিধিনিষেধের ভয়ে তাঁরা হয়ত তা পারেন না। কিন্তু একটা কথা ভেবে অবাক হই, ভগবত প্রেম,সঙ্গীত প্রেম কিংবা মানবপ্রেম যাইই হোক, তাঁদের কারো মধ্যে জেগে ওঠে না, তা কি হতে পারে! এ তো বিশ্বাস যোগ্য নয়। যদিও ফকিরাণিদের নিয়ে আলোচনা করার আগে জানা দরকার ইসলাম মতে এই সাধনা কতখানি বিধিসম্মত(কিংবা বিধিসম্মত নয়)। তারও আগে জানা দরকার ‘ফকির’, ফিকির’ বা ‘ফকিরাণি’ শব্দগুলির অর্থ। এই আলোচনার শুরু কিন্তু সুফীবাদ দিয়ে। 

হজরতের জীবদ্দশাতেই সুফীবাদের শুরু। এই মতবাদের মূল কথাই হলো প্রেম, প্রেমই ধর্ম। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মিলনই হলো প্রেম। সুফী সাধকের প্রেমের গুরু হলেন তাঁর পির বা মুরশিদ। গুরু, পির কিংবা মুরশিদের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া সুফীসাধকের সাধনা সম্ভব নয়। অর্থাৎ আমরা বাউলে যেমন বলি শিক্ষাগুরু, দীক্ষাগুরু, এও তাই। মুরশিদই হলেন বাহ্যিক ও আত্মিক গুরু। সুফীরা এদেশে এসে নানা জনহিতকর কাজ, অলৌকিক কার্যকলাপ ইত্যাদির কারণে সাধারণ জনগন কিছুটা ভয় পেতেন কিন্তু সমাজের নিম্নস্তরের মানুষগুলি তাঁদের কল্যাণমূলক কাজের জন্য অনেককেই শ্রদ্ধার আসনে বসেছিলেন। ক্রমে ক্রমে বাউল, সহজিয়াদের সঙ্গেও সুফীদের সংমিশ্রণ শুরু হয়। সমাজে অবহেলিত, অত্যাচারিত নিম্নবর্গের মানুষগুলি ক্রমশঃ সুফীবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়,কখনও বা একত্রে বসবাস করতে থাকে। অত্যাচারিত মানুষগুলি সুফীদের দ্বারা উপকৃতও হতে থাকে। এইসব সমাজের নারীরাও সুফীদের কাছে অপাংক্তেয় ছিলেন না, সুফীরা তাদের গ্রহণ করেছিলেন সহজেই। অনেকের সঙ্গেই তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধও হয়েছিলেন। ফলে সুফীদের সঙ্গে এইসব সমাজের মানুষদের একটা সামাজিক মিলমিশ শুরু হয়। সামাজিক মিলমিশের কাছে ধর্ম বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি কখনই। কিন্তু বাউল-সহজিয়া সম্প্রদায়ে যেভাবে আমরা তাদের সমাজের নারীদের প্রকাশ্যে দেখি, সেকালে কিংবা একালে কোনও সময়েই মুসলিম সমাজের নারীদের তা দেখা যায়নি, দেখা গেল না। এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে আমরা কাদের বলব ফকিরাণি? 

বৈষ্ণব সমাজে একজন বৈষ্ণবের স্ত্রীকে বৈষ্ণবী আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে। অনেক সময় ভ্রাম্যমান ভিক্ষাজীবি গায়িকাকেও আমরা বৈষ্ণবী বলে থাকি। তেমনই ভিক্ষাজীবি মুসলিম নারীও থাকতে পারেন, যাদের আমরা ফকিরাণি বলতে পারি। বাউলানিদের মধ্যে গোঁসাই মায়ের মতো শিক্ষা, দীক্ষা দেওয়াও এদের কাজ হতে পারে। শিক্ষা ও দীক্ষা দেওয়া নারীরা কিন্তু ‘ফকিরি’ নারী, যারা নিজেরাও প্রকাশ্যে ’ফকিরি’ আচরণ করেন। শব্দটির অর্থ—সর্বত্যাগী বা সন্ন্যাসীনি /সন্ন্যাসী। তাহলে ফকিরাণি বলতে আমরা ভিক্ষাজীবি মুসলিম নারী, ফকিরি নারী এবং ফকিরদের স্ত্রী—এই তিনজনকেই বলতে পারি। 

‘ফিকিরি’ কথার অর্থ চিন্তা, যদিও বেশীর ভাগ সময় চালাকি বা ধান্দা অর্থে ব্যবহৃত হয়। এর সঙ্গে ‘ফকিরাণির‘ কোনও সম্পর্ক নেই। মুসলিম সমাজে এই সন্ন্যাসিনী, সর্বত্যাগী নারীদের কোনও স্থান নেই,কারণ ইসলাম ধর্মে বৈরাগ্যের কোনও স্থান নেই। তার অর্থ এই নয় যে, এইধর্মে ভগবত চিন্তার কোনও স্থান নেই। এর অর্থ মুসলিম সমাজে গৃহধর্ম বাদ দিয়ে ঈশ্বরের আরাধনা নয়। যেহেতু ইসলাম শরিয়ত আইন কঠোর ভাবে মেনে চলে, তাই এই ধর্মে বিশেষতঃ নারীদের পক্ষে ‘ফকিরি’ নেওয়া সম্ভব নয়। 

শক্তিনাথ বাবুর ফকিরাণি সম্বন্ধে যা বলেছিলেন, মাঝে মাঝেই সেকথা মনে পড়ে। তাই যেসব মুসলিম বন্ধুবান্ধব আছেন, তাদের কাছেই প্রথম খোঁজ খবর নিতে শুরু করলুম। সত্যি কথা বলতে কি,আমার এই সব বন্ধুরা বইপত্র দিয়ে, তাঁদের নিজস্ব ধর্মীয় জ্ঞান দিয়ে, মৌলবীর কাছে নিয়ে গিয়ে এমনি সব নানাভাবে সাহায্য করেছেন আমায়। আমি তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। দারুণ আবার নিদারুণ অভিজ্ঞতাও হয়েছে কত সময়। তেমনই একটি শুরুর অভিজ্ঞতা বলি। 

বাড়ি থেকে কিছু দুরেই এক মাজার আছে। সন্ধ্যার সময় ঐ দিক দিয়ে গেলে দেখতে পাই,অনেক লোক সেখানে সন্ধ্যেবেলায় বাতি জ্বেলে দিয়ে যান, ধুপ জ্বেলে দিয়ে যান। ভিতরে আমিও গেছি। সুন্দর পরিবেশ, মনকে টানে। সেই মাজারে একবার ‘উরস’ উৎসবের খোঁজ মিলল। মুসলিম এক বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করে যাবার কথা ব্যক্ত করলুম। ইনিই খোঁজটি দিয়েছিলেন আগে। আমি কেন যেতে চাই, বন্ধুটি জানেন। এই উৎসবে এক ফকিরাণি আসবেন, কথা বলবেন, গান গাইবেন, বন্ধুটিই জানিয়েছেন। অধীর আগ্রহ নিয়ে সেই দিনটির দিকে তাকিয়ে আছি। বন্ধুটী হাসি হাসি মুখে আমায় যে ইঙ্গিত করলেন, তার একটিই অর্থ--এত আগ্রহ নিয়ে যেন না যাই, প্রশ্নের উত্তর তো না মিলতেও পারে! আমিও নাছোড়, যাবই। কিছু তো মিলবে! 

ধারণা হয়েছিল, বাউলানিদের মতো গেরুয়া কিংবা সাদা, কিংবা মুশকিল আসান পীরের মতো কালো যে কোনও একরঙা কোনও পোশাকে ফকিরাণিকে দেখব। না, ইনি একেবারে সাধারণ গৃহবধূ। চোখে চশমা, বয়স মধ্যচল্লিশ। পরণে ছাপা শাড়ি, মাথায় ঘোমটা। স্বামীর সঙ্গে এসেছেন। তিনিই সব জায়গায় নিয়ে যান সঙ্গে করে। তখনও কিছুই জানি না। যা দেখি, তাই অবাক লাগে। গান বাজনা হলো। কিছু পাঠপর্বও চলল। অনেক মানুষজন এসেছেন। খাওয়া দাওয়ারও বিরাট পর্ব চলছে সেখানে। যারা এসেছেন, সকলের জন্যই ব্যবস্থা হয়েছে। ফকিরাণি নিজেও কিছু কিছু তদারক করছেন।এত সবের মাঝে আমি তাঁকে একা পাওয়ার জন্য ছটফট করছি। বন্ধুটিকে বললাম সেকথা। তিনি তাঁকে গিয়ে কি বললেন জানিনা, মহিলা খুব হাসি হাসি মুখ করে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। এটা সেটা কথা হলো। স্বামীটিও ফকিরাণিকে আমার কাছে আসতে দেখে তাড়াতাড়ি চলে এলেন, আমাদের কাছেই বসলেন। তাঁকে সকলে ডাকেন ফকিরণ মা বলে। অর্থাৎ গোঁসাই মা আমরা যেমন বলি, তেমন আর কি! আমিও সকলের দেখাদেখি সেই সম্বোধনই করলাম। প্রশ্ন করি, কিরকম এই মারফতি জীবন, তিনি কিভাবে এই আচরণ করেন, তিনি কি তাহলে শরিয়তি নিয়ম মানেন না? কারণ ইসলামে তো গৃহধর্ম ছাড়া বৈরাগ্যের অনুমতি নেই, তাহলে? তিনি কি প্রকাশ্যে শিক্ষা, দীক্ষা দেন? তা কি ধরণের...। আমার জানার, কৌতূহলের সীমা নেই। একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছি। ফকিরণ মা তাঁর স্বামীর দিকে একবার তাকিয়ে আমার হাতখানা নিজের হাতে নিয়ে বললেন---রাত্রিবেলা আগে স্বামীকে সন্তুষ্ট করবে।‘ স্পষ্ট যৌন ইঙ্গিত। আবার বললেন—তাঁর সন্তুষ্টিতেই সব। স্বামী ভালোমতো সন্তুষ্ট হলে তারপর শুদ্ধ কাপড়ে ছাদে গিয়ে আরাধনা করবে, আমি তো তোমাদের কালীর আরাধনাও করি...’ বুঝলাম, যতই ফকিরণ মা হোন আর যাই হোন, গার্হ্যস্থ জীবনকে বাদ দিয়ে শুধু মারফতি জীবন এদের সমাজে বোধহয় সম্ভব নয়। আর একদিন কি তিনি আমায় সময় দেবেন? মারফতি জগত সম্বন্ধে তাঁর কি ধারণা জানার ইচ্ছে ছিল। কথার মাঝখানেই বলে উঠলেন, যাই করো...স্বামী না বললে কিছুই করা যাবে না...আগে তাঁকে সন্তুষ্ট...  

— তাহলে রাবেয়া বশরী, তিনি কি করে মারফতি জগতে যেতে পারলেন? উত্তর দিলেন না। স্বামী কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন, আমিও আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলাম...কিন্তু উত্তর এলো না। আমার বলার মধ্যে কিছু ছিল কিনা জানি না, উনি চুপ করে রইলেন। এর পর প্রায় দেড়/দু বছর অনেক চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। না, টেলিফোনেও তিনি কোনও উত্তর দেননি, দেখা করার অনুমতিও না। সেদিনের ফকিরণ মায়ের মারফতি জগত কিরকম আমার আর জানা হয়নি।

0 comments: