0

প্রবন্ধ - মানস লায়েক

Posted in


প্রবন্ধ


শাস্তি সমগ্র
মানস লায়েক


সময়কাল ৮৮ থেকে ৯৩। বাবার বদলির চাকরির সুবাদে অনেকগুলো স্কুল পেরিয়ে তখন পাকাপাকি একটা স্কুলে স্থিত হলাম। মধ্য কলকাতার নাম করা সরকারি স্কুল। আরও নামকরা সেখানকার শিক্ষকসম্প্রদায় ---পড়ানো আর ছাত্রশাসনে। প্রথমেই মনে পড়ে যাচ্ছে অষ্টমশ্রেণীর ভূগোল ক্লাসের একটা ঘটনা। ভূগোল স্যর সবসময় সামনের টেবিলে দুটো হাত ভর দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়াতেন।ছাত্র সম্প্রদায় ওইজন্য ওঁর নাম দিয়েছিলো ৬টা দশ। আমরাও নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় ৬'টা দশের ক্লাস' এরকমভাবেই বলতাম। তা একবার অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশের ক্লাস। স্যর জিজ্ঞেস করেছিলেন লন্ডনে সকাল আটটা বাজলে দিল্লীতে সময় কত? ওমা আমার পাশে বসা সৌম্য বলে উঠল, 'স্যর ৬টা দশ'। স্যর বললেন, 'কি বললি?' আমি উত্তর দিলাম হেসে হেসে 'স্যর ও ৬টা দশ বলেছে'। সারা ক্লাসে হাসির তুফান। স্যর পুরো বাঘের মতন সৌম্যর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। স্যর সৌম্যকে উত্তমমধ্যম দিয়ে যখন ক্লান্ত, ততক্ষণে আমি নিজেই কান ধরে বারান্দায় বসে পড়েছি।

আমি যে সময়ের কথা বলছি, সে সময়ে ছাত্র-শাসন ও শাস্তিদান ছিল নিতান্তই স্বাভাবিক ঘটনা। টিচার্স রুমে বিভিন্ন সাইজের বেত রাখা থাকতো। কেউ কেউ আবার নিজের হাত অথবা বোর্ড পরিস্কার করার ডাস্টারকে বেশি উপযোগী বলে মনে করতেন।

এ প্রসঙ্গে কোনও কোনও শিক্ষকমশাইয়ের কথা। সারাটা ক্লাস যেন সার্কাসের রিহার্সাল। ক্লাস মনিটরের প্রথম কাজ---স্যরের হাতে নিয়মভঙ্গকারী ছাত্রদের তালিকা তুলে দেওয়া। তারপরে অপরাধের গুরুত্ব বিচার করে শুধু দাঁড়িয়ে থাকা, কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা, বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা, পরস্পরের কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা, দূর প্রান্তে থাকা আসতে দেরী করা ছাত্রের প্রতি অব্যর্থ নিশানায় ডাস্টার নিক্ষেপ। এর মধ্যেই চলেছে ক্লাসের পড়া আর পড়া ধরা।

পড়া ধরা প্রসঙ্গে মনে পড়লো ইতিহাস শিক্ষকের কথা। তিনি এক একদিন পড়া ধরতেন। না পারলে হাতে ডাস্টারের বাড়ি আর কানমলা যা আমরা খুবই ভয় পেতাম। একদিন দুজন ছাত্র বসে ঘনঘন ঘড়ি দেখছিলো কখন ক্লাস শেষ হবে! শেষে একজন আর না থাকতে পেরে বলে উঠলো, 'আর পাঁচ মিনিট।' তারপর যে কি শাস্তি হলো তাদের, তা বলাই বাহুল্য। এই স্যরেরই আর একটি ঘটনা বলে শেষ করছি। তিনি ছিলেন আমাদের ক্লাস টিচার। কোনও কারণে স্কুলে না গেলে, অনুপস্থিতির কারণ ক্লাস ডাইরিতে লিখে নিয়ে যাওয়া ছিল নিয়ম। না লিখে নিয়ে গেলে বা অনুপস্থিতির কারণ যথেষ্ট সন্তোষজনক না হোলে জুটতো শাস্তি! আমি একবার দুতিনদিন স্কুলে যাইনি। ডাইরিতে লেখা ছিল সজনেখালি বেড়াতে যাবার জন্য স্কুলে আসতে পারিনি। নিচে বাবার সই। দুরুদুরু বুকে স্যরের কাছে গেলাম। ভাবছি স্যর কি করেন! স্যর লেখাটা পড়ে মৃদু হাসলেন। বললেন---'তুমি সত্যি কথা লিখে নিয়ে এসেছো---তোমার শাস্তি হবেনা।'

একটা বিখ্যাত বাংলা রক গানের ততোধিক বিখ্যাত একটি লাইন – “এখানে সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই”। যে সময়ের কথা বলছিলাম, তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। বিশ্বায়ন এসে জাঁকিয়ে বসেছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে – বোধে ও অভ্যাসে – আড্ডায় ও একাকীত্বে। সত্যিই এখন সত্যি বলে কিছু নেই – সব ভার্চুয়াল। এই সন্তর্পণ সামাজিক পরিবর্তনের সংগে সংগে স্কুল থেকে হারিয়ে গেছে সেই সব শাস্তি – এখন শাস্তি দেওয়া সামাজিক অপরাধ। এ আমাদের উত্তরণ নাকি অবনমন? উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ সময়। তবে খুব নিরাসক্ত অভিজ্ঞতার নিরিখে এটুকু অবশ্যই বলা যায় – এই শাস্তিহীন কৈশোর বৃহত্তর অপরাধ প্রবনতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, যদিও শুধুমাত্র শাস্তিহীনতাই এই অসুখের একমাত্র কারণ নয়।

0 comments: