ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
গার্ড (অনুবাদ গল্প)
নন্দিনী সেনগুপ্ত
৬
স্বপ্নগুলো ঠিকঠাকভাবে মনে পড়ছিল না তার। মনে হচ্ছিল স্বপ্নগুলো যেন একটা আরেকটাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, এ ওর ঘাড়ে চড়ে বসছে। একটা স্বপ্নের ভিতরে সে নিজে ছিল, টোবিয়াসও ছিল। হ্যাঁ, আবছা আবছা মনে পড়ছে তার, কে যেন তার সামনেই টোবিয়াসকে বিশ্রীভাবে অপমান করছে। হ্যাঁ, সে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে দেখছে, কিচ্ছু করতে পারছে না, কিন্তু তার খুব কষ্ট হচ্ছে, স্বপ্নের মধ্যেই সে বুঝতে পারছিল যে তার খুব কষ্ট! পরের স্বপ্নটা? হ্যাঁ, তার পরের স্বপ্নে সে তার প্রিয়তমা প্রথম স্ত্রীকে দেখেছিল। দেখেছিল সে রেললাইন ধরে হেঁটে আসছে। সে আরও রুগ্ন, আরও ফ্যাকাসে তার মুখ। সুন্দর কোনও পোশাক নয়, তার শরীরে পাগলীর মত ছেঁড়াখোঁড়া নোংরা কাপড় জড়ানো; উদাস ভঙ্গীতে চলে যাচ্ছিল তার কেবিনের পাশ দিয়ে। হ্যাঁ, তার পর আর কিছু মনে পড়ছে না তার। কিন্তু কিছু একটা ঘটেছিল স্বপ্নের ভিতরে। ঠিক এই জায়গাটাতেই কিছু হয়েছিল .. তারপরে তার প্রিয়তমা দ্রুত পদক্ষেপে রেললাইন ধরে মিলিয়ে যাচ্ছিল তার দৃষ্টিসীমার বাইরে... যেতে যেতে সে টলে টলে পড়ে যাচ্ছিল... তবুও, ভীষণ তাড়াতাড়ি দৌড়ে চলে যাচ্ছিল।
ঠীল জোর করে মনে করবার চেষ্টা করছিল পুরো স্বপ্নটা। ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্নটা জুড়ে নির্মাণ করবার চেষ্টা করছিল তার সম্পূর্ণ অবয়ব। নাহ, শুধু এইটুকুই মনে পড়ছে যে মিনা চলে যাচ্ছিল। একেবারে ছেড়ে চলে যাচ্ছিল তাকে? হ্যাঁ, হয়তো তাই। কারণ, যাবার আগে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিল সে। প্রিয়তমার দুই চোখে কত কষ্ট, যন্ত্রণা, ক্ষোভ ফুটে উঠছিল। তার পা দুটো তাকে টেনে নিয়ে যেতে পারছিল না। হয়তো সেই জন্য সে টলে পড়ে যাচ্ছিল। উফফ, কী সাঙ্ঘাতিক স্বপ্ন!
ওর হাতে যেন কী একটা ছিল। হ্যাঁ, কাপড়ে জড়ানো, ছোট রক্তমাখা, কী যেন! এমনভাবে ওই জিনিসটার দিকে সে তাকিয়েছিল, উফফ ওর দৃষ্টিটা! নাহ... ওই স্বপ্নের দৃশ্য থেকে ঠীলের মনে পড়ে গেলো অতীতের ঘটনা। মনে পড়ে গেলো মৃত্যুপথযাত্রিণী সেই মা, তার প্রথম স্ত্রী তার সদ্যোজাত শিশুটির দিকে ঠিক এইভাবেই একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। মৃত্যুর পরেও চোখের পাতা বুজে যায়নি। চোখের মধ্যে ভীষণ কষ্ট ছিল, সন্তানকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট! সেই চোখের চাউনি ঠীল কোনওদিন ভুলতে পারবে না। সে নিজে অনাথ হয়ে জন্মায় নি, তার বাবা- মা দুজনকেই সে দেখেছে। সে হয়তো সেই কষ্ট নিজের অন্তর দিয়ে বুঝতে পারবে না কোনওদিন, তবে ভুলতেও পারবে না।
কিন্তু স্বপ্নের মধ্যে ও ওইভাবে এলো কেন? চলেই বা গেলো কেন? সে জানে না, বুঝতে পারছে না। সত্যিই কি বুঝতে পারছে না? হয়তো বা তার অন্তরাত্মা জানে। সম্ভবত তার প্রথম স্ত্রী তাকে অস্বীকার করে চলে গেলো; চিরতরে চলে গেলো তার আত্মার ঠাঁই ছেড়ে। ঝড়বৃষ্টির রাতে একবারে চলে গেলো সে; ঠীল পিছনে পিছনে অনেকবার ডেকেছিল, ‘মিনা, মিনা!!’ ডাকছিল, চীৎকার করে ডাকছিল। ডাকতে ডাকতেই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তার।
নিকষ অন্ধকারের মধ্য দিয়ে ট্রেনটা এগিয়ে আসছে। ট্রেনের সামনের লাল আগুনের ভাঁটার মতো হেডলাইটদুটো একটা বিশালাকার দৈত্যর চোখের মতো দেখাচ্ছে। লাইটের সামনের বৃষ্টিফোঁটাগুলোকে লালচে আভায় মনে হচ্ছে যেন রক্তবিন্দু। মনে হচ্ছে রক্তের ধারাপাত, আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে। ঠীলের মনে হঠাৎ আতঙ্ক জাগলো। ট্রেন যত এগিয়ে আসছে, তত তার ভয় বেড়ে যাচ্ছে। স্বপ্ন আর বাস্তব যেন একাকার হয়ে যাচ্ছে। সে এখনো স্বপ্নের অপসৃয়মান নারীর অবয়ব দেখতে পাচ্ছে রেললাইনের উপরে। সে কার্তুজের থলিটা হাতড়াচ্ছিলো অন্ধকারে। আরেকটু হলেই গুলি ছুঁড়ে ট্রেনটা থামিয়ে দিতো সে। ভাগ্যক্রমে বেশ দেরি হয়ে গেলো; ট্রেনের আলোয় তার চোখ ধাঁধিয়ে গেলো আর ট্রেনটা ঝমঝম করে এগিয়ে গেলো তাকে পিছনে রেখে।
রাতে ডিউটির বাকি সময়টুকু ঠীল কোনওভাবেই শান্তি পাচ্ছিল না। তার মনে হচ্ছিল সে এখনি বাড়ি ফিরে যায়। ফিরে যায় তার ছোট্ট সোনা টোবিয়াসের কাছে। মনে হচ্ছিল সে যেন কতযুগ তাকে দেখেনি। সম্প্রতি সে টোবিয়াসের স্বাস্থ্য নিয়ে একটু চিন্তিত ছিল। এরকমও ভাবছিল যে চাকরিটা ছেড়ে দেবে এক্কেবারে।
সময় কাটাবার জন্য ভোর হতে না হতেই সে ট্র্যাক রক্ষণাবেক্ষণের কাজে লেগে পড়ল। বাঁহাতে একটা লম্বা লাঠি আর ডানহাতে একটা লোহার রেঞ্চ নিয়ে সে লাইনের জোড়গুলো যখন ঠুকে ঠুকে পরীক্ষা করছিল বা ফিসপ্লেটের নাটবল্টু টাইট দিচ্ছিল, তখনও সূর্যের আলো ফোটেনি। ঝড়বৃষ্টি থেমে গিয়েছে; ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের স্তরের ফাঁক দিয়ে হাল্কা আকাশ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।
রেললাইনের ধাতব পাতের উপরে নিজের পদক্ষেপের আওয়াজ মিশে যাচ্ছিল গাছগুলোর ডালপালা- পাতা থেকে খসে খসে পড়া জলবিন্দুর শব্দের সাথে। এই শব্দগুলোই হয়তো বা কিছুটা শান্তি দিল ঠীলকে; একাকীত্ব, নৈঃশব্দ সবকিছু হঠাৎ ভীষণ অসহ্য মনে হচ্ছিল। সকাল ছ’টায় পরের ডিউটির লোক আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঠীল এতটুকু সময় নষ্ট না করে রওনা দিল বাড়ির দিকে।
কী সুন্দর এই রবিবারের সকালটা! ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘগুলো অনেকক্ষণ দূরে সরে গেছে, হারিয়ে গেছে দিগন্তসীমার ওপারে। সূর্যটা রক্তমুখী মাণিক্যের মতো জ্বলজ্বল করে উঠে নিষ্কলুষ আলোয় ভাসিয়ে দিতে চাইছে অরণ্যের অন্ধকার কোণগুলো। অরণ্যের গাছের কাণ্ডগুলোর গোলকধাঁধার ফাঁক দিয়ে সূর্যের ধারালো রশ্মি এসে বিদ্ধ করছে। ফার্নের পাতাগুলো সূর্যের আলোয় স্নান করে শাণিত ফলকের মতো হয়ে উঠছে; অরণ্যভূমির রূপালী ধূসর লাইকেন ছত্রাকগুলিকে রক্তপ্রবালের গুচ্ছের মতো দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন অরণ্যে গাছগুলোর মাথায়, কাণ্ডে, ঘাসে ঘাসে দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে। আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। আকাশে বাতাসে একটা সতেজ সজীব ভাব! এই সজীবতার ছোঁয়া, প্রাণের ছোঁয়া ঠীলকেও স্পর্শ করছে। তার হৃদয়মন হাল্কা হয়ে উঠছে, মাথার ভেতরে একটু একটু আবছা হচ্ছে গতরাতের দুঃস্বপ্নের ছবিগুলো।
বাড়ি ফিরে ঠীল যখনি রোদ্দুরমাখা বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা টোবিয়াসের আপেলের মতো লাল গালদুটো দেখতে পেল, তখনি সব দুশ্চিন্তা, দুঃস্বপ্নের ছবি একেবারে মিলিয়ে গেলো। সত্যি, কী যেন একটা অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে ঠীলের মধ্যে। সারাদিনে এই ব্যাপারটা লেনাও লক্ষ্য করলো। রবিবারে চার্চে গিয়ে আজ ঠীল কেবল ধর্মগ্রন্থের ভেতরে মুখ গুঁজে বসে রইলনা; পাশ থেকে আড়চোখে কী যেন দেখছিল লেনার দিকে। এমনকি দুপুরবেলাতেও সেরকম কোনও কথা না বলেই, ঠীল নিজেই গুছিয়ে নিচ্ছিল টোবিয়াসের অতিরিক্ত ছোট জামাকাপড়, যেগুলো রাস্তায় ঠাণ্ডার জন্য গায়ে চাপানো প্রয়োজন। এই ছোটখাট পরিবর্তনগুলো হয়তো সেভাবে লক্ষণীয় ছিলনা, কিন্তু সূক্ষ্ম একটা বদল কোথাও ঘটেছিল।
সারাদিনে ঠীল একটুও ঘুমায়নি; ছুটি ছিল তার। সেদিন রাতে ডিউটি ছিলনা। তাড়াতাড়ি রাত নটার মধ্যেই ঘুমাতে গেলো সে। সবে ঘুমিয়ে পড়বে, তখনি লেনা জানালো যে পরদিন সকালে সে তার সঙ্গে ডিউটিতে যেতে চায়, কারণ ওই উপহার পাওয়া জমিটা সাফসুতরো করে, ঠিকঠাক ভালোভাবে খুঁড়ে, তারপর আলু বুনতে চায় সে ওই জমিতে।
অধীর আগ্রহে পড়ে চলেছি ।
ReplyDelete