0

ধারাবাহিক - ফাল্গুনি ঘোষ

Posted in


ধারাবাহিক


বইপাড়ার তন্ত্রধারক
ফাল্গুনি ঘোষ


নব্বই দশকের প্রথম ভাগ। কলেজস্ট্রিট বইপাড়ায় নিয়মিত যাতায়াত শুরু। তারপর একসময়ে বেশ কয়েকবছর চব্বিশ ঘন্টাই কলেজস্ট্রিটের বুকে থেকে যাওয়া। ক্রমশ প্রকাশনার কাজে জড়িয়ে পড়ে আজও নিত্য সঙ্গী বইপাড়া। একদিন মফস্বল থেকে এসে পড়েছিলাম এই মহানগরে। সেই অথৈ সমুদ্রে এই বইয়ে ঘেরা পাড়াটি যে একটু একটু করে আমার পাড়া হয়ে উঠল, তার পিছনে এমন বেশ কিছু মানুষের ভূমিকা প্রবল, যাঁরা প্রচলিত খ্যাতির আলোকবৃত্তে হয়তো দাঁড়িয়ে নেই, কিন্তু আমার জীবনে আমার বইপাড়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এঁদের হাত ধরেই আমি বইপাড়াকে চিনেছি- আজও চিনে চলেছি। এই সিরিজ সেইসব মানুষের প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের দুর্বল প্রয়াস।



নব্বইয়ের দশকের কোনো এক দুপুর। আমি আর এক বন্ধু প্রেসিডেন্সির রেলিঙে পুরোনো বইয়ের সম্ভারে ব্যস্ত। লক্ষ্য মূলত কবিতার বই। বই থেকে বই। দরদাম থেকে দরদাম। হঠাৎই পিছন দিক থেকে কাঁধে হাত পড়ল। ঘুরে দেখি একটু ভাঁজ পড়া কপাল আর মৃদু হাসি মেশানো এক চাপদাড়ি মুখ। "এই বইটা পড়েছ?" অফ হোয়াইট আর গৈরিক মেশানো প্রচ্ছদের একটা বই ততক্ষণে বাড়িয়ে ধরেছেন তিনি। কবিতার বই। এই কবি ও তাঁর কবিতা- দুইই অজানা। স্বীকার করতেই হল। "পড়ে দেখো।" বইটি হাতে গুঁজে দিয়ে দামের অপেক্ষা না করেই হাঁটা দিলেন চাপদাড়ি। বইটি ছিল বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়ের 'পা রেখেছেন পরম'। আর চাপদাড়ির নাম ...

দুই বন্ধু রাত জেগে পাগলের মতো পড়ে ফেললাম বইটি। পড়তেই থাকলাম। তারপর মাঝারি লম্বা একটা চিঠি লিখলাম কবিকে। এবার চিঠি পাঠাতে হবে। ঠিক করলাম, ওই বইবাহককে খুঁজে বার করে তাঁর হাত দিয়েই পাঠানো হবে। অতঃপর কখনো বন্ধুটি, কখনো আমি চিঠিটি পকেটে নিয়ে বইপাড়ার পথে পথে তাঁর সন্ধানে। একদিন শিকে ছিঁড়ল আমার ভাগ্যেই। কফিহাউসের এক কোণের টেবিলে প্রুফের তাড়ায় ব্যস্ত তিনি। চিঠি তো দেওয়া গেল। তারপর প্রায়শই দেখা হয়। বিচিত্র বইয়ের খবরাখবর। সঙ্গে নানা মানুষের অসুস্থতায় তাঁর অক্লান্ত ছোটাছুটি, ব্যবস্থাপনা। কানে আসতে লাগল নানা কাহিনি। এককালের কলেজস্ট্রিটে নানা আন্দোলনের মুখ এই মানুষটি বেলঘড়িয়ায় মেতে আছেন চোখে-না-পড়া শিশুদের নিয়ে। আর আছেন এবং আছেনই বইপাড়ায়। প্রুফে সম্পাদনায় আর পছন্দসই বই, খুব দুঃসাধ্য না হলে, একাধিক কপি কিনে তরুণদের পড়িয়ে চলায়।

প্রথম দেখার পরে কেটে গেছে বছর কুড়ি প্রায়। যতদিন দেখছি, কোনোদিনই অসম্ভব সুস্বাস্থ্য দেখিনি, তবু আরও কিছুটা ভেঙেছে শরীর। কিন্তু বইয়ের সম্ভারের সামনে চোখদুটো একইরকম সন্ধানী ও উজ্জ্বল। আমরাও প্রেসিডেন্সি রেলিঙে বই দেখে চলেছি আজও। কাঁধের উপরে একটা অপেক্ষা চলছে। আরও কোনো রঞ্জন সরকারের হাত এসে পড়ে কিনা।

0 comments: