1
undefined undefined undefined

প্রাচীন কথা - দোলা সেন

Posted in


প্রাচীন কথা


পঞ্চকন্যার তৃতীয়া - কুন্তী
দোলা সেন



অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরীস্তথা।
পঞ্চকন্যা স্মরেন্নিত্যং মহাপাপম বিনাশনম॥


কথা হচ্ছিল প্রাতঃস্মরণীয়া পাঁচজন মেয়ের। ভোরবেলায় যাঁদের নাম করলে মহাপাপও বিনাশ হয়। কিন্তু যাঁদের মতো হতে বলেন না কোন আশীর্বাদকই। এই বৈপরীত্যই বারে বারে আমাকে টেনে নিয়ে গেছে মহাভারতের মহাসমুদ্রে। প্রতীক ছেড়ে সহজভাবে খুঁজে বেরিয়েছি তাঁদের মানবী সত্ত্বাকে। জানতে চেয়েছি কোন অপরূপ চরিত্রবলে এঁরা সেই পুরুষপ্রধান যুগেও আপন স্বাতন্ত্র্যে ভাস্বর ছিলেন। তাঁদের চারিত্রিক ঔজ্জ্বল্য ঢাকতে বারে বারে অবতারণা করা হয়েছে রূপকের। কখনো কৃষিসভ্যতার আড়ালে রূপকের জালে তাঁদের ব্যাখ্যা করা হয়েছে; কখনো বা পঞ্চেন্দ্রিয়-দেহ আত্মা ইত্যাদির দৈবিক বাতাবরণে তাঁদের মাথায় পরানো হয়েছে অলৌকিক মুকুট। কিন্তু ওই যে কথায় আছে না – যা নাই ‘ভারতে’ তা নাই ভারতে! প্রথম ভারত মানে মহাভারত। তাই তৎকালীন সমাজের এক সংগ্রামী নারী – যিনি বারবার ক্ষুরধার বুদ্ধি আর রাজনৈতিক সচেতনতায় উল্টে দিয়েছেন ভাগ্যের হিসাব, যাঁর চরিত্রে মহানতার সাথে মিশে থাকে কিছু স্বার্থান্ধতা, ক্ষুরধার রাজনৈতিক বুদ্ধির কাছে পরাজিত হয় আবেগ ও মমতা – এবং তারপরেও আমাদের কাছে যাঁর প্রধান পরিচয় একজন জননী – সেই কুন্তীর কথা হোক আজকের আলোয়।


কুন্তী (প্রথম ভাগ)


যাদব বংশের রাজা শূরসেন। পুত্রলাভ উপলক্ষ্যে তাঁর ঘরে আজ মস্তবড় উৎসব। তাঁর একটি সুলক্ষণা শান্ত সুন্দরী মেয়ে আছে বটে, কিন্তু বংশরক্ষা তো আর কন্যা দিয়ে হয় না! পুত্রলাভে তাই আজ তাঁর আনন্দের সীমা নেই। বিভিন্ন জায়গা থেকে তাঁর আত্মীয় স্বজনেরা এসেছেন, এই আনন্দের ভাগীদার হতে। রাজ্যময় আনন্দের মাঝে একটি মুখ শুধু মলিন। সেই মুখ শূরসেনের ভাগ্নের। নামেই ভাগ্নে, সমবয়েসী দুটি মানুষের মধ্যে আসল সম্পর্কটা গভীর বন্ধুত্বের।

এই ভাগ্নেটি নিঃসন্তান। তাই বন্ধুত্বের কোন এক আবেগঘন মুহূর্তে শূরসেন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তাঁর একটি সন্তান তিনি একে দান করবেন। তারপর কালের নিয়মে বহু সময় পেরিয়ে গেছে। প্রথম সন্তানের মুখ দেখেছিলেন যখন, তখন এই শপথের কথা তাঁর মনেও ছিল না। কিন্তু আজ এই পুত্রলাভের আনন্দঘন মুহূর্তে ভাগ্নের মলিন মুখটি তাঁকে পূর্ব প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিল। কিংবা হয়ত ছেলে পাবার আনন্দে মেয়েটির গুরুত্ব তাঁর কাছে কমে গিয়েছিল। তা সে যে কারণেই হোক, শূরসেন সর্বসমক্ষে তাঁর পূর্ব প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করলেন এবং সভামাঝেই ভাগ্নের হাতে কন্যাটিকে দান করলেন। সভায় ধন্য ধন্য পড়ে গেল।

এই মেয়ের নাম পৃথা। ভাগ্নের নাম রাজা কুন্তীভোজ, আর যে পুত্রলাভের জন্য এই উৎসব – তার নাম বসুদেব। বসুদেবের পুত্র যুগাবতার শ্রীকৃষ্ণ অবশ্য পরে বহুবার এই পিতৃস্বসার পাশে দাঁড়িয়েছেন বিভিন্ন সময়ে।

কুন্তীভোজের অবস্থা হল আনেকটা সামনে পাহাড় আর পিছনে খাদে আটকে যাওয়া প্রাণীর মতো‎। যখন এই প্রতিজ্ঞা, তখন তাঁর মনের কোণে কোথাও কন্যালাভের বাসনা ছিল না। তাই আজ যখন বসুদেবের বদলে পৃথাকে দান করলেন শূরসেন, তখন তিনি মনে মনে ভারি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। এদিকে শূরসেন অত্যন্ত শক্তিশালী রাজা। আর এই মুহূর্তে এই মহান দানের স্তুতিগানে সমগ্র যাদবকুল যেভাবে মেতে উঠেছে, তাতে তাঁর প্রতিবাদের ফল যে কোনদিক দিয়েই ভালো হবে না – সেটুকু না বোঝার মতো কাঁচা রাজনীতিবিদ তিনি নন। কাজেই মনে যাই থাক, হাসিমুখেই পৃথাকে গ্রহণ করলেন তিনি। নতুন পিতার নামে তাঁর নতুন নামকরণ হল – কুন্তী। ছোট মেয়েটি কিছু বোঝার আগেই বদলে গেল তার বাবা-মা-ঘর-গোত্র সব, সবকিছু। শূরসেন কন্যাদায় থেকে মুক্ত হলেন, আর কুন্তীভোজ অপ্রসন্ন মনে সেই দায় নিয়ে ঘরে ফিরলেন।

শূরসেনদত্ত কন্যা – তাকে আর যাই হোক অবহেলা করা যায় না। তাই তার জন্য তৈরি হল আলাদা মহল। সেখানে ধাত্রীমাতা ও দাসী পরিবৃত হয়ে বড় হয়ে উঠতে লাগলেন কুন্তী। হয়ত দাসীসংসর্গের জন্যই তিনি রাজকন্যাসুলভ ঔদ্ধত্য অর্জন না করে এক নরম সেবাপরায়ণা নারী হয়ে বেড়ে উঠছিলেন। রাজপ্রাসাদে তো সমানেই বহু মুনি ঋষির আনাগোনা – তা কুন্তীভোজের মনে হল, খাইয়ে দাইয়ে মেয়েটাকে বড় করছেন যখন, তখন তাঁদের সেবায় কুন্তীকে নিয়োজিত করাই যায়! রাজকন্যার সেবায় তুষ্ট মুনিদের আশীর্বাদে রাজার যশ ও পুণ্য দুইই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে।

যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। কিশোরী কুন্তীর খেলধূলার দিন গেল। ছোট মেয়েটি তাতে দুঃখ পেয়েছিল নাকি বাইরের জগতের সংস্পর্শে আসতে পেরে খুশি হয়েছিল তা ঠিকমতো জানা যায় না। জন্ম থেকেই তিনি পিতামাতার স্নেহবঞ্চিত – নিজের মনে নিজেকে গুটিয়ে রাখা তাঁর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।


তা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মুনি ঋষিরা আসেন। তাঁদের কেউ সৌম্য, কেউ ক্রোধী, আবার কেউ বা স্নেহপরায়ণ। তাঁরা সকলেই এই মেয়ের সেবায় মুগ্ধ, চমৎকৃত। তাঁদের কাছে নানা ধর্মকথা, রীতিনীতি, উপদেশ শুনতে শুনতে বড় হয়ে ওঠেন কুন্তী, মননে ঋদ্ধ হন। তাঁর সেবা আর মধুর ব্যবহারের খ্যাতি পল্লবিত হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে তা একদিন মহর্ষি দুর্বাসার কানে পৌঁছায়।

সদা অসন্তুষ্ট কোপনস্বভাব এই তপস্বী সর্বদাই অপরের ছিদ্রান্বেষণে ব্যস্ত থাকেন। হয়ত কোন অপ্রাপ্তি তাড়া করে বেড়ায় তাঁকে। কঠোর তপস্যা তাঁকে সিদ্ধ করেছে। তিনি ত্রিলোকের ভক্তি, সমীহা আর ভয়ের পাত্র। কিন্তু ভালোবাসা? কই সেরকম কিছু তো জমা হয় নি তাঁর ঝুলিতে! তাই কাউকে তা পেতে দেখলেই রাগে অস্থির হয়ে ওঠেন, তাঁর ত্রুটি আবিষ্কার করে অভিশাপ না দেওয়া পর্যন্ত শান্ত হন না। সেই দুর্বাসা কুন্তীর এত প্রশংসা শোনার পরেও পরীক্ষা নিতে আসবেন না, সে কি হয়?

এই আগমনের সংবাদে কুন্তীভোজের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ঋষিবর ক্রুদ্ধ হলে তাঁর রাজ্যের সমূহ সর্বনাশ। তাই তিনি তড়িঘড়ি কুন্তীর কাছে এলেন, স্নেহবচনে তাঁকে অভিষিক্ত করে দুর্বাসার আগমন এবং উদ্দেশ্য জানালেন।

মনে মনে হাসলেন কুন্তী। দুর্বাসার নানা উপাখ্যান তিনি নানা মুনির কাছে শুনেছেন। তিনি জানেন ঋষির রোষের ভয়ই পিতাকে আজ প্রার্থীর ভূমিকায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তবু এই তাঁর জীবনে প্রথম পাওয়া পিতার স্নেহবচন। তিনি মধুর বচনে কুন্তীভোজকে আশ্বস্ত করলেন – পিতা, আপনি আমায় পালন করেছেন। আপনার কোন ক্ষতি আমি হতে দিতে পারি না। নির্ভয় হোন, ঋষিকে সন্তুষ্ট করার দায়িত্ব আমার।

নিশ্চিন্ত হয়ে চলে গেলেন কুন্তীভোজ। একবারও ভেবে দেখলেন না কি অসম্ভব এক গুরুদায়িত্ব তিনি তাঁর কন্যার উপর চাপিয়ে দিয়ে গেলেন।

দুর্বাসা এলেন কুন্তীর ভবনে। আর আক্ষরিক অর্থেই অতন্দ্র সেবায় নিয়োজিত হলেন পৃথা। দাসীদের ভরসা করতে পারেন না। একা হাতে সব কাজ করেন। আর ছটফট করতে থাকেন সেই মহাঋষি। কিছুতেই যে তিনি কোন ত্রুটি খুঁজে পাচ্ছেন নে যার জন্য অভিশপ্ত করে দেওয়া যায় এই নারীর জীবন! গভীর রাত হোক বা দিবা দ্বিপ্রহর, যখন যা আদেশ করছেন ঋষি, হাসিমুখে মুহূর্তমধ্যে তাই পালন করছেন পৃথা। অবাক হন ঋষি। এক মমতাও কি কাজ করে ভিতর ভিতর? নাহলে কেনই বা তিনি পৃথাকে শোনান নানা শাস্ত্রের কথা,সমাজের রীতি, রাজনীতির কথা? কুন্তীকে তিনি গড়ে তোলেন আগামী জীবনের উপযুক্ত করে। বৎসর অতিক্রান্ত হল। তুষ্ট হযেছেন দুর্বাসা, যাবার আগে বর দিয়ে যাবেন মেয়েটিকে। কিন্তু তার আগে শেষ পরীক্ষা করে দেখে নেবেন এই মেয়ে সেই বরের উপযুক্ত কিনা।

ব্রাহ্মমুহূর্তে স্নানে গেলেন দুর্বাসা। ফিরে এসেই নাকি সদ্যপ্রস্তুত অন্ন চাই তাঁর! কুন্তী তাঁর অভ্যস্ত দ্রুততায় রান্না নিয়ে ঘরে এলেন যখন, তখনই ঘরে ঢুকছেন মহর্ষি। প্রণতা মেয়েটিকে ওঠার মুখে বাধা দিলেন ঋষি। তাঁর পিঠের উপর রাখলেন সদ্যপ্রস্তুত খাদ্য। পিঠ পুড়ে গেল তাপে, তবু একবছর যে মেয়েটি অনিদ্রা ও প্রায় অনাহারে কাটিয়েছে, আজও তার ধৈর্যচ্যুতি হলো না। বেদনার সামান্যতম কম্পনকেও সে বাইরে আসতে দিল না! তুষ্ট হলেন দুর্বাসা। সহনের এই চূড়ান্ত রূপই তিনি দেখতে চেয়েছিলেন। তাঁর আশীর্বচনে কুন্তীর দহনজ্বালা প্রশমিত হলো। পৃথার কানে তিনি দিলেন এক মন্ত্র। সেই মন্ত্রে যে দেবতাকেই আবাহন করবেন কুন্তী তিনি এসে কুন্তীর বাসনাপূর্ণ করবেন।

চলে গেলেন দুর্বাসা। কিন্তু ছোট থেকে যে বড় হয়েছে দাসীমহলে আর পুরুষ বলতে একমাত্র দেখেছে জিতেন্দ্রিয় তপস্বীদের, সেই সদ্যতরুণীর পক্ষে এই বরের প্রকৃত অর্থ হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব ছিল না। শিশুর হাতে নতুন খেলনা এলে সে যেমন সেটিকে নানাভাবে নেড়েচেড়ে ঠুকেঠাকে দেখতে থাকে, কুন্তীর অবস্থা হল অনেকটা সেইরকম।

এইরকমই এক দিনে সে প্রাসাদের লাগোয়া নদীতীরে স্নান সেরে ওঠার সময় তার চোখ পড়ল সদ্যোত্থিত দিবাকরের দিকে। কি জানি কী ছিল সেই সকালের আলোয়, জলের ঝিলিমিলিতে, কিংবা পাতার ফাঁক দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়ায় – পৃথার চোখ আর দিবাকরের ওপর থেকে সরল না। তার মুগ্ধ হৃদয় চাইল, এই অর্কপ্রভকে কাছে পেতে, তার মুখ থেকে দুটি কথা শুনতে। তাই সে মন্ত্রোচ্চারণ করে দিবাকরকে আহ্বান করল। এলেন সেই তেজোময় পুরুষ, জানতে চাইলেন কী তার প্রার্থনা। “কী চাই?” – তা তো জানে না পৃথা। তার তো শুধু দেখে ভালো লেগেছিল, একটু কথা বলতে ইচ্ছে হয়েছিল। তার ইচ্ছেপূরণ হয়ে গেছে, এবার সে দিবাকর এবং দুর্বাসাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে যেতে চায় তার আপন ঘরে। হাসলেন দিবাকর। তিনি জানেন, কিশোরী পৃথার মধ্যে এক নারী জন্ম নিচ্ছে – সে এখনো তাকে চেনে না। একে পরিণত করতে হবে তাঁকেই। ঋষির বরকে পুরো সার্থক না করে তাঁরও তো আর ফিরে যাবার উপায় নেই! তিনি বালিকাকে বোঝালেন এই আবাহনের প্রকৃত অর্থ। বড় যত্নে বড় সাবধানে দিবাকর পৃথাকে দিলেন নারীত্বের প্রথম স্বাদ। তৃপ্ত হয়ে ফিরে গেলেন দিবাকর। আর ফিরে তাকাবার প্রয়োজন বোধ করলেন না।

আর জীবনের প্রথম অবুঝ ইচ্ছের দাম চুকিয়ে ঘরে ফিরে এলেন পৃথা। এরপর মাসের আবর্তনছন্দে ছেদ পড়তেই ধাইমার ভ্রুকুটি – সব শুনে মাথা চাপড়ে হায় হায় করা ছাড়া আর কিই বা করতে পারেন তিনি। সবদিক বজায় রাখতে গেলে যা করা যায় সেটাই করলেন তিনি। পৃথাকে লোকচক্ষু থেকে গোপন রাখলেন। ন মাস পরে দিব্য কবচ কুণ্ডলধারী এক উজ্জ্বল শিশুর জন্ম হল। কিন্তু সে কানীন। আর পৃথা যে কত একা, কত অসহায় সেকথা ধাইমার চেয়ে বেশি কে জানে? তাই শিশুটিকে এক ডালায় করে আর এক ভোরের আলোয় দিবাকরকে আর ধাইমাকে সাক্ষী রেখে চোখের জলে ভেসে প্রথম সন্তানকে নদীর জলে ভাসিয়ে দিতে দিতে পৃথা একমুহূর্তে জীবনের অনেকগুলো ধাপ এক নিমেষে পার করে গেল। নরম মনের মেয়েটা ধীরে ধীরে পালটে যেতে লাগল – সে বুঝে গেল জীবনভোর তাকে একলা চলতে হবে। নিজের বা আপনজনের স্বার্থরক্ষায় তাকে কখনো ক্ষুদ্র, কখনো মহৎ আবার কখনো বা নিষ্ঠুর হতে হবে। এই তার নিয়তি। জীবন তাকে এভাবেই খেলায় নামিয়েছে।

এসব কথার আভাস কুন্তীভোজের কানে পৌঁছেছিল কিনা কে জানে, কিন্তু এই ঘটনার কিছুদিন পরেই তিনি কুন্তীর স্বয়ম্বরসভা আহ্বান করলেন। কুন্তী হলেন কুরুকুলবধু – রাজা পাণ্ডুর স্ত্রী। একানেও কুন্তীর জন্য কোন সরল জীবন অপেক্ষা করে নেই। বড় ভাই ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ। তাই ছোটভাই পাণ্ডু রাজা হয়েছেন। রাজনীতির এক জটিল সমস্যার সূত্রপাত এখান থেকেই। এবার দুভাইয়ের মধ্যে যাঁর সন্তান আগে জন্মাবে সেই রাজ্যাধিকারী। কাজেই পুত্রলাভের তাগাদা দুজনের মধ্যেই থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। কাজেই পাণ্ডু দ্বিতীয় বিবাহ করে ফেললেন মদ্ররাজকন্যা মাদ্রীকে।

এদিকে জন্মগতভাবেই দুর্বল পাণ্ডু। তার পাণ্ডুর বর্ণ সেই সাক্ষ্যই বহন করে। এর উপর তিনি মৃগয়া করতে গিয়ে সঙ্গমরত এক হরিণদম্পতিকে হত্যা করে বসলেন! একে তো সঙ্গমরত প্রাণীকে হত্যা করা গুরুতর অপরাধ, তার উপর আবার এরা সাধারণ মৃগ ছিল না। এক ঋষিদম্পতি হরিণরূপে নিজেদের দাম্পত্য উপভোগ করছিলেন। মরবার আগে তারা অভিশাপ দিয়ে গেলেন – পাণডু আর কোনোদিনও কোন রমণীতে উপগত হতে পারবেন না। হলে নিশ্চিত মৃত্যু।

হতাশ পাণ্ডু রাজধানীতে ফিরে পত্নীদের সবকথা খুলে বললেন। কুন্তী এখন অনেক পরিণত। জীবন তাঁকে অনেক বিরুদ্ধ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে শিখিয়েছে। তিনি স্বামীকে বনবাসী হবার পরমর্শ দিলেন। তিনি জানেন রাজমাতা হবার এই একমাত্র পথ। অভিশপ্ত পাণ্ডুর এমনিতেই আর কিছু ভালো লাগছিল না। তিনি রাজি হয়ে গেলেন। ধৃতরাষ্ট্রকে সামনে রেখে রাজ্যের দায়িত্ব নিলেন সেই পিতামহ ভীষ্ম। ধৃতরাষ্ট্র মনে মনে খুশিই হলেন। কারণ গান্ধারী তখন সন্তানসম্ভবা। তাহলে তাঁর ছেলেই হবে হস্তিনাপুরের রাজা। বেদব্যাস নিজে বর দিয়েছেন তাঁর শতপুত্র হবে। কিন্তু কোন অজানা কারণে এই গর্ভধারণকাল খুবই দীর্ঘ। এদিকে বনে গিয়েই কুন্তী স্বামীকে দুর্বাসার বরের কথা জানালেন। অবশ্যই কর্ণের কথা গোপন করে। উল্লাসিত হয়ে উঠলেন পাণ্ডু। তিনি জানেন ক্ষেত্রজ পুত্র সংসারে স্বীকৃত এবং বৈধ। এমন কি তাঁরা দুভাইও তো......

তিনি কুন্তীকে বললেন একজন সত্যবাক, ন্যায়পরায়ণ এবং সমদৃষ্টিসম্পন্ন দেবতাকে আহ্বান করতে, যাতে ছেলেও একজন মহান রাজার সবগুণ নিয়ে জন্মায়। কুন্তী অনেক ভেবে আহ্বান করলেন ধর্মরাজ যমকে। জন্ম হল দ্বাপরের শ্রেষ্ঠ ধার্মিক পুরুষ যুধিষ্ঠিরের! বনের এ খবর হস্তিনাপুরেও এসে পৌঁছাল। গান্ধারীর তখনও প্রসব হয় নি। মনের দুঃখে তিনি নিজের পেটে আঘাত করে গর্ভপাত করালেন। কিন্তু ব্যাসদেব সেই অপরিণত মাংসখণ্ড ১০১ ভাগে ভাগ করে মাটির হাঁড়িতে রাখলেন।

পাণ্ডু পুত্র পেলেন বটে, কিন্তু তাঁর মন ভরল না। তিনি নিজে দুর্বল, শান্ত ধীর স্বভাবের ছেলেকে পছন্দ হলো না তাঁর। একজন যখন হয়েছে, তখন আরও একজন কেন নয়? তাই বলবান পুত্রের কামনায় কুন্তী এবার আহ্বান করলেন পবনদেবকে। জন্ম হলো ভীমের। সেই সময় একে একে মাটির কলসীতে রাখা মাংসপিণ্ডেরা প্রাণ পেতে আরম্ভ করেছে। প্রথম জন্ম দুর্যোধনের।

পাণ্ডু প্রথমে ভীমকে দেখে খুশি হয়ে উঠলেও শিগগিরই বুঝতে পারলেন এ ছেলে সরল আর গোঁয়ার। রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ বোঝা তার সাধ্যাতীত। অতএব আবার একবার। বহু চিন্তায় নির্বাচিত হলেন দেবরাজ ইন্দ্র। অর্জুনকে পেয়ে তুষ্ট হলেন পাণ্ডু। কিন্তু এদিকে কুন্তীকে দেখে মাদ্রীরও মা হবার বাসনা জেগে উঠল। তিনি ধরে পড়লেন পাণ্ডুকে। স্বামীর অনুরোধ ফেলতে পারলেন না কুন্তী। তিনি মাদ্রীকে একবারের জন্য মন্ত্রদানে সম্মত হলেন। এইখানে মাদ্রী একটা চালাকি করলেন। তিনি স্মরণ করলেন অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে। নকুল ও সহদেব নামে যমজ ছেলে হলো তাঁর। কুন্তী মনে মনে চটলেও তাঁর আর কিছু করার ছিল না।

ছেলেরা একটু বড় হলে মুনি ঋষিদের সঙ্গে পাঁচ ছেলে নিয়ে হস্তিনাপুরে উপস্থিত হলেন কুন্তী। মুনিদের সাক্ষ্যে পঞ্চপাণ্ডবের জন্মবৃত্তান্ত এবং যুধিষ্ঠিরের জ্যেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হলো। যুধিষ্ঠিরের জ্যেষ্ঠত্ব প্রমাণ হবার অর্থ হলো রাজ্যের উত্তরাধিকারের দাবী। এতদি ধরে যে সিংহাসন নিজের বলে জেনে এসেছেন দুর্যোধন, তাঁর পক্ষে এই পরিবর্তন কাম্য নয় মোটেই। তদুপরি তিনি ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসজাত, আর পাণ্ডবরা ক্ষেত্রজ। দুর্যোধনের বিচারে তাই কৌন্তেয়রা পাণ্ডব নন। সিংহাসনের দাবী তাঁদের থাকতেই পারে না। এই সময়ে অবশ্য তিনি সুবিধাজনকভাবে ভুলে যান তাঁর পিতার জন্মকথা।

যাই হোক, কুন্তী জানতেন এমনটাই হবে। প্রখর বুদ্ধিশালিনী এই রমণী বললেন – ছেলেরা সবাই তো এখন অনেক ছোট।কাজেই এখন এনিয়ে আন্দোলন করে লাভ নেই। এখন তাঁদের বিদ্যালাভের সময়। রাজা তো এখন ধৃতরাষ্ট্রই। এ ব্যবস্থার কোনও বদলের দাবী তিনি করতে তিনি আসেননি। বরং এই বংশের বাকী পাঁচটি ছেলেকেও শিক্ষার সমান সুযোগ দেবার অনুরোধটুকুই জানাচ্ছেন তিনি।

কুন্তীর এই চমৎকার বুদ্ধিতে সব গোলযোগ থেমে গেল। ফুটফুটে পাঁচটি শিশু এরই মধ্যে তাদের বিনম্র উপস্থিতিতে কুরুবংশের গুরুজনদের মন জয় করে নিয়েছিল। কাজেই তাদের গ্রহণে আর কোন বাধা রইলো না। কুন্তী প্রাসাদের অংশও দাবী করলেন না। তিনি তাঁর প্রিয় দেবর বিদুরের গৃহে আশ্রয় নিলেন। এইভাবে তিনি শুধু তাঁর নির্লোভ ব্যক্তিত্বই প্রমাণ করলেন না; সন্তানদের নিরাপত্তাও সুনিশ্চিত করলেন। রাজনীতিতে গুপ্তঘাতকের অভাব তো কোনকালেই ছিল না! তিনি জানেন তাঁর দেবাংশী পুত্রেরা বিদ্যায়, পরাক্রমে ও বুদ্ধিতে সবাইকে ছাড়িয়ে উঠবেই। আর সিংহাসন লাভের জন্য সেটাই হবে তুরুপের তাস। আর এই কাজের জন্য প্রয়োজন জ্যেষ্ঠভ্রাতা যুধিষ্ঠিরের উপর বাকি চার ভাইয়ের অসীম আনুগত্য। তা এই বোধ তিনি ছোট থেকেই তাদের মধ্যে দৃঢ়প্রোথিত করেছেন। তাঁর জীবনের এখন একটাই লক্ষ্য – সন্তানদের তাদের পিতার সিংহাসন ফিরিয়ে দেওয়া। (চলবে)

1 comment: