0

প্রবন্ধ - ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্ত্তী

Posted in

প্রবন্ধ


কমলাকান্ত উবাচ
ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্ত্তী


উবাচ-৩

মন ভাল নেই। একদম ভাল নেই। 

একে তো গতমাসে কমলাকান্ত দেখা না দেওয়ার ফলে আমার লেখার তৃতীয় কিস্তি জমা পড়েনি। সেই দিয়ে মন খারাপের শুরু। তার ওপর কিছুদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখা একটা ছবি মনটাকে আরও খারাপ করে দিয়েছে। এখনও ছবিটার ভয়াবহতা থেকে নিজেকে বের করে আনতে পারিনি। তাই আমার দৈনিক কর্মকাণ্ডেও মন খারাপের প্রভাবটা থেকে যাচ্ছে। আর তার ফলে জনগন আমার ওপর যারপর নাই রুষ্ট হয়ে পড়ছেন। 

এই সময়ে আমার কাছে কমলাকান্তের প্রয়োজন অতিব জরুরী বোধ হচ্ছে। আমি যতই এই আফিমসেবী, ঠোঁটকাটা, অপ্রিয় সত্যভাষী ব্রাহ্মণকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করিনা কেন, পরে ভেবে দেখেছি যে কমলাকান্তের IQ, EQ এবং SQ অত্যন্ত উচ্চমার্গে বিরাজমান। আমার মতো সাধারণ মানুষকে তার নাগাল পেতে গেলে “সন্ধানে ধন্ধায় নবাবে” করে ঘুরে বেড়াতে হবে। এই মুহূর্তে, সত্যি বলছি, আমি কমলাকান্তকে বড্ড বেশী মিস করছি। ওর সংগে একটু সময় কাটাতে পারলে মানসিক চাপটা থেকে মনে হয় মুক্ত হওয়া যেত।

কে জানে নেশার তাড়নায় সে এখন কোন ঠেকে আফিমের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। 

যাইহো্‌ কমলাকান্তের আশা ছেড়ে দিয়ে লেখার কাজে মন দেওয়া যাক।

হ্যাঁ, যেকথা বলছিলাম, সোশ্যাল মিডিয়ার ছবির ব্যাপারটা নিয়ে একটু বিশদে আলোচনা করা দরকার। 

আমাদের মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রদের সোশ্যাল মিডিয়াতে একটা আখড়া আছে। সেখানে আমরা নিজেদের মধ্যে “ছায়ার সাথে যুদ্ধ করে গাত্রে হল ব্যাথা”র মতো মারামারি, ঝগড়া করা ছাড়াও সারা বিশ্বে ঘটমান ঘটনার সংগে নিজেরা পরিচিত হই। অবশ্য তার মধ্যে সত্যি-মিথ্যের সীমানা ছাড়িয়ে “হাতে রইল পেন্সিলের মতো” যেগুলো পড়ে থাকে, সেগুলোর মধ্যে একটা ছবি দেখে আমি একই সঙ্গে ভীত এবং সন্ত্রস্ত।

ছবিটা পাঠিয়েছিল পৃথ্বীশ। এমনিতে পৃথ্বীশ খুব কমই আমাদের আখড়ার ইধার কা মাল উধার আর উধার কা মাল ইধার ব্যবসায়ে জড়িত থাকে, তবে যেগুলো সে আখড়ায় পরিবেশন করে থাকে, সেগুলোর গভীরতা আমাদের ভাবিয়ে তোলে। তা সেরকমই একটা ছবি পৃথ্বীশ পাঠিয়ে ছিল আমাদের আখড়ার মাণ্ডিতে। 

তারপরে অবশ্য এই ছবিটা আমি খবরের কাগজেও দেখতে পাই। 

একটা বড় তিমি মাছ বার বার নরওয়ে দেশের সমুদ্রের তীরের দিকে চলে আসছে দেখে সেই দেশের সমুদ্র উপকূল বাহিনী তাকে গভীর সমুদ্রে ছেড়ে দিয়ে এলেও কয়েকদিন পর তার মৃতদেহ সেই উপকূলে আবার ফিরে আসে। 

তারপর তাকে পোষ্টমর্টেম করে তার পেট থেকে কয়েক মেট্রিক টন পলিথিন পাওয়া যায়। পলিথিনের সেই বর্জ্যকে সেই সমুদ্র পাড়ে পাশাপাশি ছড়িয়ে দিয়ে দেখা যায় তা বেশ কয়েক মাইল লম্বা জায়গা জুড়ে অবস্থান করছে। 

ভয় পাবার মতো ঘটনাই বটে। 


(২)

“Beat Plastic pollution” – এটাই ছিল এই বছরের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের থিম। আমাদের দেশ ভারতবর্ষ এবার বিশ্ব পরিবেশ দিবসের আয়োজক ছিল। সেই সূত্রে গত পাঁচই জুন, ২০১৮ আমার শহর হায়দ্রাবাদে সারা বিশ্বের পরিবেশ বিজ্ঞানীরা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে যেসব তথ্য বিশ্বের সাধারণ মানুষের নজরে এনেছেন, তার ভয়াবহতা বোধহয় পারমানবিক যুদ্ধের ভয়াবহতার সংগে তুলণীয়। তাঁরা সবাই একত্রে বলে গেছেন যে প্ল্যাস্টিক বম্বের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা এটম বম্বের থেকে কিছু কম নয়! 

Jenna Jambeck একজন পরিবেশ বিজ্ঞানী, যিনি জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। রিসার্চ করে চলেছেন, যে বিপুল পরিমাণ প্ল্যাস্টিক সমুদ্রের তলদেশে জমা হচ্ছে, তার প্রভাবের ওপর। 

তাঁর মতে মানুষসহ সমস্ত প্রাণী আজ জনজীবনে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণহীন প্ল্যাস্টিক ব্যবহারের ফলে নিজেদের অস্তিত্বের সঙ্কটের সন্মুখীন। পৃথিবীতে প্রতিদিন যে পরিমাণ সলিড ওয়েস্ট তৈরী হয়, তার শতকরা প্রায় দশ থেকে বারো ভাগই হচ্ছে প্ল্যাস্টিক। তার মধ্যে অনিয়ন্ত্রিত প্ল্যাস্টিক বর্জ্যের যে ভাগটা সমুদ্রে গিয়ে পরে, তার পরিমান বেশ কয়েক মিলিয়ন টন। সংখ্যাটা মারাত্মক। ২০১০ সালেই তার পরিমাণ ধরা হয়েছিল ৮ মিলিয়ন টন। আর আজকের হিসেবে তা প্রায় ১৩ মিলিয়ন টনের কাছাকাছি। 

সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত এই বিপুল পরিমাণ প্ল্যাস্টিক কিছু ভেসে বেড়ায়, কিছু ডুবে যায়। দেখা গেছে ভেসে বেড়ানো প্ল্যাস্টিক সামুদ্রিক বাতাসের বিচিত্র গতিপ্রকৃতির কল্যাণে একত্রিত হয়ে কৃত্রিম ভাসমান দ্বীপেরও সৃষ্টি করেছে। আর ডুবে যাওয়া প্ল্যাস্টিক সামুদ্রিক প্রাণীরা তাদের খাবারের সঙ্গে প্রতিনিয়ত গ্রহণ করে চলেছে। যার কারণে নরওয়ের সমুদ্র উপকূলে প্রাপ্ত হতভাগ্য তিমি মাছের পেটে আমরা কয়েক টন প্ল্যাস্টিক দেখতে পাচ্ছি। 

শুধু তাই নয়, যেসব সামুদ্রিক প্রাণী মানুষ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে, তাদের দ্বারা অসংখ্য পরিমাণ প্ল্যাস্টিক মাইক্রোবস মানুষের দেহে প্রবেশ করে চলেছে। আর তার পরিমাণ যে ভয়ঙ্কর, সেটা তো আর বলে বোঝনোর দরকার নেই। 

পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৫০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে ৮.৩ বিলিয়ন মেট্রিকটন প্ল্যাস্টিক তৈরি হয়েছে, যার শতকরা ৭৫ ভাগই বর্জ্য হিসেবে নিক্ষিপ্ত হয়েছে আমাদের এই ধরিত্রীতে, যা বিনষ্ট হয়নি। সেই পর্বত প্রমাণ প্ল্যাস্টিক এবং প্রতিদিনকার উৎপাদিত প্ল্যাস্টিক প্রতিনিয়ত আমাদের নদী, মাটি আর সমুদ্রকে আস্তে আস্তে গ্রাস করে ফেলছে।

Erik Solheim সাহেব, যিনি UN Environment Programme (UNEP)’র কর্ণধার, বলছেন যে, আমরা যদি আমাদের না বদলাই তবে সেই সময়ের আর বেশী দেরি নেই, যখন প্ল্যাস্টিক পলিউসান আমাদের শ্বাস রোধ করে ফেলবে। সারা পৃথিবীতে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে যে, খাবার জলে পর্যন্ত মাইক্রোপ্ল্যাস্টিক, যাকে মাইক্রোব বলা হয়, তা বিদ্যমান। নরওয়ে আর স্পেনের উপকূলের তিমি মাছ দুটির মৃত্যুর কারণ হচ্ছে প্ল্যাস্টিক। ভারতবর্ষের কেরালাতেও প্ল্যাস্টিক এক হাতীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এছাড়া আজ গরু, ছাগল, উট, সামুদ্রিক পাখী, মাছ, কচ্ছপ সবার খাদ্য চক্রেই প্ল্যাস্টিকের অবস্থান দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, যা অত্যন্ত ভয়াবহ।



(৩)


Solheim সাহেব ভারতবাসীকে আর একটা বড় সঙ্কটের কথা শুনিয়ে গেছেন। উনি বলেছেন যে, ক’য়েক বছরের মধ্যেই ভারতবর্ষ সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশী লোকসংখ্যার মালিক হতে চলেছে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে যে, আরও বেশী জনগণ প্ল্যাস্টিক ব্যবহার করবে। তাই ভারতবর্ষ যদি এখুনি প্লাস্টিক পলিউসনের দ্রুত গতিশীল চাকাটাকে উল্টো মুখে চালিত করতে না পারে, তাহলে শুধু ভারতবর্ষেরই নয়, সমগ্র পৃথিবীতেই সমূহ বিপদ আসন্ন।

Solheim সাহেবের অশনি সঙ্কেত মাথায় রেখে ভারতবর্ষের Plastic Pollution Picture-এর PPT-গুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। 

ভারতবর্ষ প্রতিদিন কমবেশী ৩৫৬০০ মেট্রিকটন প্ল্যাস্টিক উপভোগ করে, যার বাৎসরিক পরিমানটা ১৩ মিলিয়ন মেট্রিকটনের কাছাকাছি। এর মধ্যে ৯ মিলিয়ন মেট্রিকটনের কাছাকাছি প্ল্যাস্টিক বর্জ্যে পরিণত হয় @২৫০০ মেট্রিকটন প্রতিদিনকার হিসেবে। 

ভাবতে ভাবতে ভয় লাগতে লাগলো। হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে মনে হলো। জলের বোতলের দিকে হাত বাড়তে গিয়ে শুনতে পেলাম ঠাকুরদাদার ঘড়িতে রাত বারোটার ঘণ্টা পেটা শুরু হলো। জল খেতে খেতে ঘণ্টাগুলো গুনছি......এক, দুই, তিন...। ছোটবেলাকার স্বভাব। 

দাদুর কাছে মুখে মুখে এক-দুই আর ওয়ান-টু গোনা শিখেছিলাম ঘড়ির ঘণ্টা পেটার আওয়াজ গুনে গুনে। বিদ্যাসাগর মহাশয় মাইল ফলক দেখে ইংরেজি ওয়ান-টু শিখেছিলেন – এই তথ্যটাও দাদুই আমাকে দিয়েছিলেন আমাকে ইংরেজী সংখ্যার সংগে পরিচয় করাবার সময়। 

আর একটু বড় হয়ে ইস্কুলের উঁচু ক্লাসে উঠলে দাদু আর একটা তথ্য আমায় দিয়েছিলেন; না সেটাকে ঠিক তথ্য বলা যাবে না, বরং ওটা দাদুরই নিজস্ব একটা থিওরি বলা যেতে পারে, যেটা আমি পরবর্ত্তীকালে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কোনও জীবনীকারের লেখাতে পাইনি। 

দাদু আমায় বলেছিলেন, “দেখ দাদুভাই, আমরা সবাই বই পড়ে ইংরেজী সংখ্যা 1,2,3,4..ইত্যাদি এই ছন্দে শিখেছি। কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রথমে ইংরেজীর বড় সংখ্যা দিয়ে শুরু করে তারপর ছোট সংখ্যাগুলো শিখেছিলেন, মানে ধর 10, 9, 8, 7..... এই ছন্দে।”

আমি অবাক হয়ে তার কারণ জানতে চাইলে উনি আমায় বলেছিলেন, “বিদ্যাসাগর মশাই তাঁর বাবার সঙ্গে বীরসিংহ গ্রাম থেকে হেঁটে শহরে আসার সময় মাইল ফলক দেখে দেখে ইংরেজি সংখ্যাগুলো শিখে ফেলেছিলেন।”

আমার কাছে তাও ব্যপারটা পরিষ্কার হলো না দেখে তিনি বলেছিলেন, “বীরসিংহ গ্রামের বাড়ি থেকে বাবার সংগে বেরিয়ে বড়ো রাস্তায় পৌঁছে বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রথম যে মাইল ফলকটি দেখে বাবাকে প্রশ্ন করেছিলেন, তাতে কি লেখা থাকতে পারে বলে মনে হয়?”

মনে আছে আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম,“কেন, যেখানে যাচ্ছিলেন সেই জায়গার যতটা দুরত্ব মাইল ফলক তো ঠিক ততটাই দূরত্ব দেখাবে।”

“ঠিক তাই। মনে কর বিদ্যাসাগর মশাই প্রথম যে মাইল ফলকটা দেখেছিলেন সেটতে দূরত্ব লেখা ছিল 10Mile. তাহলে আবার এক মাইল হাঁটার পর বিদ্যাসাগর মশাই যে মাইল ফলকটার দেখা পেয়েছিলেন সেটাতে নিশ্চয় 9Mile লেখা ছিল। এইভাবে বিদ্যাসাগর মশাই প্রথমে ইংরেজি বড় সংখ্যা থেকে শুরু করে ক্রমে ক্রমে ছোট সংখ্যার সংগে পরিচিত হচ্ছিলেন আর মনে মনে সেটা মুখস্ত করে ফেলছিলেন। আমরা সবাই কিন্তু প্রথমে ছোট সংখ্যার সংগে পরিচিত হয়ে পড়ে বড়ো সংখ্যার সংগে পরিচিত হয়েছি, সেটাই কিন্তু দস্তুর।” 



(৫)


দাদুর মুখে সেই সময়ে এই কথাটা শুনে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। তারপর বড়ো হয়ে ভেবেছি যে দাদুর ধারণাটার সত্যি মিথ্যে জানা খুব মুশকিল, তবে একটা যে লজিক আছে সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই।

তাই আজও দাদুর ঘড়ির ঘণ্টা পেটা যখন শুরু হয়, তখন প্রত্যেকবার আমার দাদুর কথা মনে পড়ে। কি আশ্চর্য লজিক ছিল দাদুর!

ঠাকুদা-ঘড়ি ১২টা ঘণ্টা পেটা শেষ করতেই, আমার নাকে কস্তুরী মৃগের নাভির সেই বিশেষ গন্ধটা ধরা পড়ল। 

বুঝতে পারলাম, আজ কমলাকান্ত আমার ডেরায় উপস্থিত হয়েছে। 

জলের বোতলটা টেবিলের ওপরে রেখে চোখ তুলে তাকাতেই আমার চোখ একেবারে কপালে উঠে গেল!

কমলাকান্ত আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আর মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ বাঁধা। বাঁদিকের কোনায় একটু লালের ছোপ। মুখটা বেশ কৃশ।

কমলাকান্তের এই দশা দেখে আমি একেবারে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের কোনায় রাখা তার বরাদ্দ চেয়ারটা এনে তাকে বসতে বললাম। অভ্যেস মতো কাঁধের উড়ুনিটা দিয়ে চেয়ারটাকে একটু ঝেড়ে কমলাকান্ত তার সিগনেচার পোজে বসে জলের বোতলটার দিকে হাত বাড়াতে গিয়েও হাত সরিয়ে নিল। আমি একছুটে রান্নাঘরে গিয়ে তার কাঁসার ঘটিটাতে এক ঘটি জল এনে তার সামনে ধরতেই সে আলগোছে ঘটির জলটা পুরোটাই শেষ করে ফেলে ঘটিটা টেবিলের ওপর রেখে দিল। 

বুঝলাম আজ কমলাকান্ত বেশ ক্লান্ত। 

আমি তাকে কোনওরকম প্রশ্ন করে বিরক্ত না করে একটু স্পেস দেব ঠিক করলাম। একটু জিরিয়ে নিক আগে। 

কিছুক্ষণ পর নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে একটু ম্লান হাসল সে। এবার আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,“তোমার এই দশা হলো কি করে।”

“বহুদিন পর আমার কাঁঠালপাড়া গ্রামে আমার পৈতৃক ভিটাতে যাইবার ইচ্ছা হইয়াছিল। দুর্ভাগ্যবশতঃ গ্রামে ঢুকিতে গিয়া দেখি ওইস্থানে কুরুক্ষেত্র চলিতেছে। চারিদিকে বিস্ফারিত পটাকার আওয়াজ কানে আসিতেছে। কিংকর্তব্যবিমুঢ় অবস্থা। এই অবস্থায় প্রসন্নর দেখা পাইলাম। এক বৃক্ষতলে হতাশ হইয়া বসিয়াছিল। সে বলিল, ঠাকুর তুমি অতি সত্বর এই স্থান ত্যাগ কর। তাহার কাছে জানিতে পারিলা্‌ গ্রামে পঞ্চায়েত ভোট চলিতেছে। আমি তাহার মর্ম জিজ্ঞাসা করিলে প্রসন্ন কহিল যে, সাহেবরা ভারতবর্ষ ত্যাগ করিয়া যাইলে স্বাধীন ভারতবর্ষে একটি ভোটপূজা নামক আমোদের আবির্ভাব ঘটিয়াছে। আমি বলিলাম, তা পূজাকর্মে এত হাঙ্গামা হইতেছে কেন? সে বলিল, এই পূজাতে নাকি এটাই দস্তুর।”

একটানা অনেক কথা বলে কমলাকান্ত দম নেবার জন্য একটু থামল। আমি তাকে কোনওরকম বিরক্ত করলাম না। সময় নিয়ে সেই নিজেই বলুক। 

দম নেবার পর কমলাকান্ত শুরু করল, “প্রসন্নর কথার কোনওরূপ মাথামুণ্ড না বুঝিয়া আমি আমার পৈতৃক গৃহের দিকে পা বাড়াইলাম। প্রসন্ন আমার পিছনে পিছনে কিছুদূর চলিতে চলিতে আমায় বারংবার অগ্রসর হইতে নিষেধ করিতে লাগিল। কিন্তু আমি তাহার কথায় কর্ণপাত করিলাম না। আসিয়া পড়িয়াছি যখন, তখন একটিবার পৈতৃক ভিটাটি দর্শন করিয়াই যাইব। প্রসন্ন আমাকে অভিসম্পাত করিয়া নিজের জায়গায় প্রত্যাবর্তন করিল। তাহারপর আমি কিছুদূর অগ্রসর হইতেই আমার কর্ণপটহ বিদারিত করিয়া একটি পটাকা বিস্ফারিত হইতেই কিসের আঘাতে যেন আমি চৈতন্য হারাইয়াছিলাম।

তাহারপর আমার আর কিছুই মনে নাই। কতকাল পর চক্ষু খুলিয়া প্রসন্নর চিন্তান্বিত মুখমণ্ডল দর্শন করিলাম, তাহা আমার স্মরণে নাই। তাহারপর মাসাধিক কাল শয্যাশায়ী থাকিয়া প্রসন্নের সেবা যত্নে কিছুটা সুস্থ্য বোধ করিলে তোমার কথা মনে পড়িতেই আজ আসিয়া হাজির হইলাম।”

কমলাকান্তের মুখে ঘটনার বিবরণ শুনে আমি যাকে বলে স্তম্ভিত। নির্বিচারী সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণের ওপর যে রাজনৈতিক আক্রমণ হতে পারে, এটা আমার স্বপ্নেরও অতীত ছিল। কিন্তু গণতন্ত্রের তান্ত্রিকদের বর্তমান সামাজিক কর্মকাণ্ডের জেরে আজ আমার মাথা হেঁট করতে হলো কমলাকান্তের কাছে। 

আমার অবস্থা বুঝে কমলাকান্ত হেসে আমায় সান্ত্বনা দেবার জন্য বলে ওঠে, “তুমি লজ্জিত হও কেন লেখক। ইহা আমার প্রাপ্য ছিল বলিতে পার। আমার বিষয় পরিত্যাগ করিয়া তুমি কি লিখিতেছ বল।”

আমি প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললাম, “লেখার কাজ মাথায় উঠেছে। প্ল্যাস্টিক দূষণের খবরাখবর পড়ে আমার অবস্থা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরু হবার আগে অর্জুন বিষাদযোগ-সম। অতি সম্প্রতি প্রকৃতি দূষণের ওপর আমার শহরে একটি আন্তর্জাতিক আলাপ আলোচনা সম্পন্ন হয়েছে। সেই আলোচনা থেকে যে সব তথ্য নজরে এল, তা দেখছি অতিমাত্রায় ভয়াবহ।”

এই বলে, আমি কমলাকান্তকে Jenna Jambeck মেমসাহেব আর Erik Solheim সাহেবদের কথা বললাম। ওঁরা যে সব তথ্য দিয়েছেন, সেগুলো যখন কমলাকান্তকে বলছি, তখন একবার চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি সে একদৃষ্টে আমার জলের বোতলের দিকে তাকিয়ে আছে। 

আমার কথা শেষ হলে সে জলের বোতলের দিকে দৃষ্টি রেখেই আমাকে বললো, “তোমাদের সাহেব আর মেমসাহেব আরও দু-একটি তথ্য উল্লেখ করিতে ভুলিয়া গিয়াছেন বলিয়া মনে হয়।”

“কি সেই তথ্য?” আমার প্রশ্ন।

এইবার কমলাকান্তের মুখে সেই রহস্যময় হাসিটা দেখা পেলাম। ঠোঁটের ওপর তার সেই বিখ্যাত হাসিটা ঝুলিয়ে রেখে সে বলে ওঠে, “তোমার জলের বোতলটি দেখিয়া আমার তথ্যটি স্মরণে আসিল। তুমি অবগত হইয়া আশ্চর্য্য হইবে বোধকরি যে, প্রতি পলে সমগ্র পৃথিবীতে এই প্রকার দশ লক্ষ্যাধিক পাণীয় জলের বোতল বিক্রীত হইতেছে। আর তোমাদের ওই দূষণ সৃষ্টিকারি পেটিকার বাৎসরিক সংখ্যাটা জান? পাঁচ লক্ষ্য কোটি এবং ইহা প্রতিনিয়ত অবলা ধরিত্রীর বুকে নিক্ষিপ্ত হইতেছে। এই সকল দূষিত বস্তুর সিংহ ভাগ সমুদ্রতলে আশ্রয় পাইতেছে।”

কমলাকান্তের জ্ঞানের পরিধি দেখে আমি যাকে বলে স্তম্ভিত!

তবুও একবার গুগুল জেঠু আর উইকি মাসীর তথ্য ভাণ্ডারে উঁকি দিয়ে দেখতে পেলাম কমলাকান্তের তথ্য এক্কেবারে অক্ষরে অক্ষরে সত্য। প্রতি মিনিটে সমগ্র পৃথিবীতে বিক্রীত প্ল্যাস্টিক বোতলের সংখ্যা কমবেশী one million আর বছরে single use disposable ব্যবহৃত প্ল্যাস্টিক ব্যাগের সংখ্যা five trillion! 

আমার স্তম্ভিত ভাবটা লক্ষ্য করে কমলাকান্ত বলে ওঠে, “বিজ্ঞান দ্বারা সৃষ্ট অজড় অমর এই বস্তুর ক্ষয় নাই, লয় নাই। মৃত্তিকার উর্ব্বরা শক্তি নষ্ট করিয়া এই প্ল্যাস্টিক নামক বস্তুটি ধীরে ধীরে ফসল ফলাইবার জমির মৃত্যু ঘটাইতেছে। ইহার ফল বড়ই সুদূর প্রসারী।”

কমলাকান্ত দম নেবার জন্য থামলে আমি বলে উঠলাম, “এই আত্মনিধনকারী বস্তুর হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার কি কোনওই উপায় নেই?”



(৬)


কমলাকান্ত বলে, “সস্তা সুখের সন্ধানে বর্ত্তমান মনুষ্য সমাজ প্রতিনিয়ত আপন কবর খনন করিয়া চলিয়াছে।”

আমার মুখে কোনও কথা নেই। কমালাকান্তও দেখছি গভীর চিন্তামগ্ন। ঘরে একটি আলপিন পড়লেও শব্দ শোনা যাবে মনে হয়। কিছুক্ষণ পর গুরুগম্ভীর পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে কমলাকান্ত বলে ওঠে, “মহাভারতের মুষল পর্বের কাহিনী তো বিস্মৃত হও নাই নিশ্চয়।”

এবার আমার অবাক হবার পালা। কোথায় plastic pollution আর কোথায় মহাভারত!

কমলাকান্ত তার ঠোঁটের কোণে আবার সেই রহস্যময় হাসিটা ফিরিয়ে এনে বলে, “মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ উত্তর কালে শ্রীকৃষ্ণের যদুবংশ ধ্বংসের পেছনে মুষলের প্রভাব অনস্বীকার্য। শত চেষ্টা করিয়াও মুষলের হাত হইতে নিস্তার পায়নি যাদবকুল। সর্বশেষে সেই মুষলের প্রভাবে উৎপাদিত নল খাগড়ার বনে আত্মহননকারি যুযুধান যদুবংশের সমাপ্তি ঘটে। বিজ্ঞানের আশীর্বাদ না অভিশাপ অজড় অমর এই প্ল্যাস্টিক বস্তুটি আজ মুষলরূপ ধারণ করিয়া তোমাদের এই আধুনিক যুগের সমাপ্তি ত্বরান্তরিত করিতেছে। যত শীঘ্র সম্ভব এই বস্তুটির ব্যবহার হইতে পৃথিবীবাসীকে নিরস্ত হইতে হইবে নচেৎ এই সভ্যতার মৃত্যুঘণ্টার পদধ্বনিই শুধু আমার কানেই বাজিতেছে না, সেই সঙ্গে আমাদের এই সুজলা সুফলা ধরিত্রী যে এক নিস্ফলা অনুর্বর বধ্যভূমিতে পরিণত হইতে চলিতেছে, তাহা আমি যেন প্রত্যক্ষ করিতেছি।”

আমি কি বলব বুঝে উঠতে পারছি না। কমলাকান্তের প্রতিটি কথায় আমি যেন Erik Solheim সাহেবের আর Jenna Jambeck মেমসাহেবের বক্তৃতার প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছি! কি অসাধারণ বিশ্লেষণ এই সাধারণ ব্রাহ্মণের! ভাবতেও অবাক লাগছে যে, দুর্জনে এই high IQ সম্পন্ন ব্রাহ্মণকেই নিরক্ষর, নেশাখোর বলে হেয় করে থাকে! 

আমি এই শুভ্রকান্তি ঋষি প্রতিম মানুষটির দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখ দুটি সজল হয়ে উঠেছে। হয়তো আমাদের এই প্রিয়তম গ্রহটির ভবিষ্যতের কথা ভেবে।

আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে একটু হেসে কমলাকান্ত বলে ওঠে, “বুঝলে হে লেখক চূড়ামণি, ইহার কারণেই বাঙলা ব্যাকারণে যমক অলঙ্কারের একটি অতি প্রসিদ্ধ উদাহরণ হইল – যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে।” 

আমি এই প্রথম কমলাকান্তের মুখে চলিত বাঙলা ভাষার ব্যবহার লক্ষ্য করলাম। 

কমলাকান্ত আমার বোতলের দিকে হাত বাড়িয়েও হাত সরিয়ে নিল। আমি তাড়াতাড়ি তার বরাদ্দ ঘটিটা খালি দেখে সেটা নিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। ঘটিটায় জল ভরতে ভরতে বুঝতে পারছি আমার মাথার মধ্যে কমলাকান্তের প্রতিটা কথা ঘুরপাক খেয়ে চলেছে। 

ঘটিতে জল ভরে নিয়ে আবার আমার ষ্টাডি রুমে ফিরে এসে দেখি কমলাকান্ত প্রস্থান করেছে। তৃষ্ণার্ত কমলাকান্ত জল না খেয়ে আমার এখান থেকে চলে যাওয়াতে মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল। তারপর আমার জল ভরা প্ল্যাস্টিক বোতলের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম যে, আমার মতো তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ প্ল্যাস্টিকের বোতলে জল খেতে খেতে প্ল্যাস্টিকের বিরুদ্ধে মন্তব্য করছি – এই হিপক্রাসিটার বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ জানিয়ে চলে গেছে সে। 

লাখ সেলাম তোমায় কমলাকান্ত, লাখ লাখ প্রণাম তোমায়।

0 comments: