0

ধারাবাহিক - সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক


এক কিশোরীর রোজনামচা - ২৮
সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়




Diary Entry - 26
29 October, 1942, Thursday.


প্রিয় কিটী, 

মনটা ভাল নেই। বেশ উদ্বিগ্ন। আমার বাবার জ্বর হয়েছে। গায়ে বেশ ভাল রকম টেম্প্যারেচার আছে। তার সাথে আবার সারা শরীরে লাল লাল র‍্যাশ বেরিয়েছে। মায়ের সন্দেহ "হাম" হয়েছে। বিশেষ করে গায়ের লাল র‍্যাশগুলো "হামের" মতই দেখতে। ভাবতে পার, আমার বাবা এতটাই অসুস্থ, চুপচাপ বিছানায় শুয়ে আছে, তবুও আমরা কোন ডাক্তার ডাকতে পারব না। ডাক্তার ডাকার ক্ষমতা বল, বা সাহস বল, যাই হোক না কেন, এর কোনটাই আমাদের নেই। মা বারবার ভিজে কাপড় দিয়ে বাবার সারা শরীরটা মুছে দিচ্ছেন। কপালে ভিজে কাপড়ের পট্টি দিয়ে গায়ের জ্বরটাকে কমানোর চেষ্টা করে চলেছেন। আশা করা যায়, এ'তে বাবার গায়ের টেম্পারেচারটা কিছুটা কমবে, বাবাও কিছুটা আরাম পাবে। 

আজ সকালে মিয়েপের কাছ থেকে খবর পেলাম মিঃ ভ্যান ড্যানদের বাড়ি থেকে সরকারের গেস্টাপো বাহিনীর লোকেরা সমস্ত আসবাবপত্র বের করে নিয়ে গেছে। মিয়েপ কথাটা আমাদেরই বলেছে। আমরা এখনও কথাটা মিঃ ভ্যান ড্যানকে জানাইনি। এমনিতেই শ্রী মতি ড্যান মনের দিক থেকে বেশই দুর্বল প্রকৃতির। একটু কিছু হলেই অস্থির হয়ে পড়েন। শক্ত মনে বিষয়গুলো নিতে পারেন না। তারপর যখন শুনবেন, ওনাদের বাড়ি থেকে সুন্দর "বোন-চায়নার" বাসনপত্রও, কাঠের চেয়ার, খাট, যেগুলো ওনারা রেখে, বাধ্য হয়ে এই অ্যানেক্সে এসেছিলেন, সেগুলো সব নির্বিচারে বের করে নিয়ে চলে গেছে, তখন শুরু হবে ওনার চাপা বিলাপ আর কান্না। অবশ্য সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। জিনিষগুলোর সঙ্গে ত’ ওনাদের ভাললাগা ভালবাসা, স্মৃতি সর কিছুই জড়িয়ে আছে। আসলে আমরা আমাদের সব দামি আর প্রিয় জিনিষগুলোর মায়া আর মোহ ত্যাগ করে নিজেদের বাঁচানোর জন্যে এই গুপ্তগৃহে আশ্রয় নিয়েছি, বা, নিতে বাধ্য হয়েছি। তাই এখন সেগুলো সরকারী প্রশাসন বেদখলী জিনিষ হিসাবে যদি বের করে নেয়, কিংবা বের করে ফেলে দেয় বা কাউকে দিয়ে দেয়, তাহলে আমাদের কী'বা আর করার আছে? আমরা কেবল প্রতিকারহীন আক্রোশে বিড়বিড় করে বিলাপ করতে পারি কিংবা চাপা কান্না দিয়ে নিজেদের মধ্যে, প্রিয় কিছু জিনিষ হারানোর দুঃখকে প্রকাশ করতে পারি। আর কিছুই করতে পারি না। বেশী জোরে চীৎকার করতে পারি না, আইনের আশ্রয় নিতে পারি না, কিংবা প্রতিবাদ করতে পারি না। কারণ আমরা ত’ আর মানুষ নই, আমরা শুধুই পালিয়ে বেড়ানো, লুকিয়ে থাকা কিছু “জীব” মাত্র। 

বেশ কয়েকদিন হল, আমি প্রাপ্তবয়স্কের বই পড়ার পরোক্ষ অনুমতি পেয়েছি। আমি এখন Nico van Suchtelen এর লেখা Eva's Youth (বইটার প্রচ্ছদের ছবি নীচে সংযোজিত করা হয়েছে---- অনুবাদক) নামের বইটা পড়ছি। একটি স্কুল ছাত্রীর জীবনের প্রেম কাহিনী ছাড়া, বইটাকে আর কোনভাবেই চিহ্নিত করা যায় না। অবশ্য বইটাতে আরও কিছু নিষিদ্ধ বিষয়ের বর্ণনা আছে। যেমন, বইটাতে দেখানো হয়েছে, কিভাবে একজন মহিলা রাতের অন্ধকারে গোপন গলি রাস্তায় এক অপরিচিত পুরুষের কাছে তার দেহ বিক্রী করছে ; আর তার বিনিময়ে মহিলাটি ঐ অপরিচিত পুরুষের কাছ থেকে এক ব্যান্ডিল অর্থ নিচ্ছে। আমায় যদি এ'রকম কিছু করতে হতো, তা'হলে কিছু করার আগেই আমি লজ্জায় মরে যেতাম। বইতে লিখেছে, ইভার, মাসের একটা নিয়মিত সময়ে রক্তস্রাব হত। বিষয়টা বেশ রোমাঞ্চকর। আমি চাই আমারও যেন ওর মতোই মাসের একটা সময়ে রক্তস্রাব হয়। আমি জানি মেয়েদের ক্ষেত্রে এটা খুবই জরুরি আর গুরুত্বপূর্ণ। 

বাবা আমার পড়ার জন্যে, গ্যোটের লেখা নাটক আর Schiller এর লেখা নাটক অফিসের বড় বইয়ের র‍্যাক থেকে নিয়ে এসেছিলেন। বাবা মন থেকে চান, আমি যেন সব বই পড়ি। আমি এখন Schiller এর লেখা “ডন কার্লোস” নামক নাটকটা পড়ছি। 

বাবার দেখাদেখি, মা’ও আমায় বই পড়াতে হঠাতই আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। মা তাঁর প্রার্থনার বইটা আমার হাতে দিয়ে, পড়ে দেখতে বললেন। মায়ের নির্দেশ কোনভাবেই অগ্রাহ্য কয়রা যায় না। তাই মায়ের কথামত, মায়ের প্রার্থনার বইয়ের, জার্মান ভাষায় লেখা প্রায় সব স্তোত্রগুলোই আমি পড়েছি। কিছু কিছু আবার মুখস্তও হয়ে গেছে। প্রতিটি স্তোত্রই বিশেষ বিশেষ অর্থপূর্ণ। এবং আমাদের জীবন বোধ বিষয়ে বেশ কিছু অর্থবহ উপদেশ স্তোত্রগুলির মধ্যে আছে। আমি জানি না, মা আমায় হঠাত এত ধার্মিক করে তুলতে চাইছেন কেন? 

আগামীকাল প্রার্থনার জন্যে আমরা প্রথম অগ্নিপ্রজ্জ্বালন অনুষ্ঠান পালন করব। আমি জানি এরপর অতিরিক্ত ধোঁয়াতে আমাদের নিঃশ্বাসের কষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবুও ধর্মীয় অনুষ্ঠান আমাদের জীবনে নতুন প্রেরণা জোগাবে। তবে ধুয়ো নির্গমনের যে চিমনীটা আছে, সেটা পরিষ্কার করা হয়নি বহুদিন। আশা করি, তাসত্ত্বেও ওখান থেকে অন্ততঃ বেশ কিছুটা ধুঁয়ো নির্গত হবে। আর তার জন্যে চিমনীটাকে একটু পরিষ্কার করে অন্ততঃ কাজ চলার মতো করে নিতে হবে। 

ইতি,
অ্যানি। 




অনুবাদকের সংযোজনঃ- 

Image result for Details of Eva's Youth a Story book by Nico van Suchtelen
Nico van Suchtelen লেখা Eva's Youth নামক পুস্তকের প্রচ্ছদ। 


Dom Carlos 1787.jpg

ডন কার্লোস (ইংরাজীর বানান Don Carlos; জার্মান বানান Don Karlos ) একটি ঐতিহাসিক বিচ্ছেদ মূলক নাটক। Friedrich Schiller নাটকটি ১৭৮৩ সাল থেকে ১৭৮৭ সালের মধ্যে রচনা করেন। ১৭৮৭ সালে হ্যামবুর্গে নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয়। নাটকটির মুখ্য চরিত্র হল ডন কার্লোস। তিনি ছিলেন অস্ট্রিয়ার যুবরাজ। ষোড়শ শতাব্দীতে স্পেনের সম্রাট দ্বিতীয় ফিলিপসের সময়কালের পটভূমিতে নাটকটি লেখা। প্রেক্ষাপট ঐতিহাসিক হলেও নাটকটিতে ইতিহাসকে কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয় নি। নাটকের প্রয়োজনে ইতিহাস নাটকটির মধ্যে এসেছে। ইতিহাসের প্রয়োজনে নাটকটি লেখা হয় নি। ডন কার্লোস ছিলেন সম্রাট দ্বিতীয় ফিলিপসের সন্তান। পিতা-পুত্রের বিরোধই হলো নাটকের মূল বিষয়বস্তু।

0 comments: