1

সম্পাদকীয়

Posted in

সম্পাদকীয়

নৈরাজ্যবাদীরা সমাজের অর্থনৈতিক সংগঠনের রূপরেখা যেভাবে ভেবেছেন, তার থেকে সমাজবাদীদের চিন্তা খুব একটা ভিন্ন নয়; শাসনের প্রক্রিয়া সম্বন্ধে তাঁদের ধারণাটাই শুধু আলাদা। নৈরাজ্যবাদীরা মনে করেন যে, সরকার সমস্ত শাসিত জনগণের মতের উপরে ভিত্তি করে চলবে, শুধুমাত্র সংখ্যা গরিষ্ঠের নয়। অস্বীকার করা যায় না যে, সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনও সংখ্যালঘিষ্ঠের শাসনের মতোই মানবিক স্বাধীনতার পরিপন্থী। সংখ্যাগরিষ্ঠের 'অনুপম' ক্ষমতার কারণ মতবাদের গোঁড়ামি ছাড়া আর কিছুই নয়। একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তার সেই সমস্ত শ্রেষ্ঠ নাগরিকদের দমন-পীড়নে পর্যুদস্ত করতে পারে, বিশেষত যাঁদের স্বাধীন চিন্তার বিকাশ প্রগতির পক্ষে অপরিহার্য উপাদান হিসাবে পরিগণিত হয়, যা অবশ্যই অত্যন্ত গুরুতর এক চিন্তার বিষয়। তবে এ ইতিহাস নতুন নয়। এই গভীর দুশ্চিতার পরিপ্রেক্ষিতে এনকাউন্টার বা এন আর সি/ক্যাব ঠিক কিনা-কে উপলক্ষ্য বলেই প্রতিভাত করা যায়, মূল উদ্দেশ্য কখনই নয়! এমতাবস্থায় শুধু প্রত্যাশা এইটুকুই যে, দেরিতে হলেও সব কিছু সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই সমস্ত পক্ষেরই নিদ্রা ভঙ্গ হবে।

সচেতন থাকুন, সাবধান থাকুন

শুভেচ্ছা নিরন্তর

1 comments:

2

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in

গৌরচন্দ্রিকাঃ

আজকে বুড়োদের আড্ডায় চা হয় ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছ, নয় পাজামা লুংগিতে ছলকে পড়ছে, তবু কারও হেলদোল নেই। তর্ক-বিতর্ক শেষ হয়ে এখন যা হচ্ছে তাকে ভারতীয় তর্কশাস্ত্রের ভাষায় বিতণ্ডা বললেই ঠিক হয়, অথবা কোন চ্যানেল বিশেষের বাগযুদ্ধ। কেউ কারও কথা শুনছে না, শুধু নিজের ডেসিবেল চড়িয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হল অ্যাস্টেরিক্স কমিকের পাতা থেকে বেরিয়ে এসে গান ধরেছে ক্যাকোফোনিক্স।

এরমধ্যে মিত্তির, ভবানীপুরের ঘটি , আমাকে মিষ্টি করে জিগাইলেন—খুব গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ? বলি কাগজপত্তর ঠিক আছে তো? আফটার অল, তোমরা তো ওপার থেকে এয়েচ!

আমার ভ্যাবাগঙ্গারাম চেহারা দেখে উনি টীকা করলেন—আরে এন আর সি হলে প্রমাণ দিতে হবে না যে তুমি আসলে তুমিই, কোন অনুপ্রবেশকারী নও, বিদেশি নও? কাগজ আছে তো? 

আরেকজন সদ্য দেশপ্রেমিক খিঁচিয়ে উঠলেন। 

--ফালতু ভয় পাওয়াবেন না তো, সত্যজিৎ রায় যদি ভারতের নাগরিক হন তো শ্রীমান রঞ্জন রায়ও নাগরিক। হিন্দু, কায়স্থ এবং আদি বাড়ি, মানে বাপ-ঠাকুর্দার ভিটে অবিভক্ত ভারতের ময়মনসিং জেলার গ্রাম।

-- ও, তাহলে বাঙালী হিন্দুদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই বলছ? যত ঝামেলা শুধু মোচলমানের?

আমি সাততাড়াতাড়ি সবার চেহারা দেখে নিলাম। এই গলিতে কোন মুসলমান প্রতিবেশি নেই। আমার বন্ধু আবদুল মতীনের বাড়ি দু-কিলোমিটার দূরে, অন্য পাড়ায় ।

--দেখুন, মাননীয় কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রী স্পষ্ট করে বলেছেন যে এই নতুন সংশোধনী বিল বা ক্যাব কারও বিরুদ্ধে নয় । ভারতীয় মুসলমানদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এই বিল কাউকে বাদ দেওয়ার জন্যে নয় , তিনটে পড়শি দেশে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত রিফিউজিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্যে। 

--বেশ, তাহলে আসামে যে এন আর সি হল তাতে ১৯ লাখ লোক সন্দেহের তালিকায় ঢুকল, কিছু ডিটেনশন ক্যাম্পে গেছে। তাদের মধ্যে হিন্দুই বেশি। এটা কী করে হয়?

--দেখুন, এন আর সি আলাদা আর ক্যাব আলাদা। দুটো গোলাবেন না । ওটা সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশে ওদের নজরদারিতে হয়েছে। এবার গোটা দেশে হবে।

--হ্যাঁ, হ্যাঁ, মাননীয় এটাও বলেছেন যে খুঁজে খুঁজে সবকটা অনুপ্রবেশকারীকে ধরে দেশের বাইরে ছুঁড়ে ফেলব। এগুলো হল ঘুণপোকা।

--ভুল কি বলেছেন? সব পিলপিল করে কাঁটাতারের ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে পড়ে। শস্তায় ঘরের কাজ, চা -পান-বিড়ির দোকান শুরু করে , আধার কার্ড, ভোটার কার্ড বানায়। তারপর খাবড়াগড়ের মত বোম বানায়। অথচ ভোটব্যাংকের তাগিদে দিদি বলছেন এন আর সি বঙ্গে হতে দেব না।

রিটায়ার্ড ইকনমিক্সের অধ্যাপক বাঁড়ুজ্জে হাত তুললেন।

--এইসব আইসোলেটেড ঘটনা নিয়ে ফোবিয়া তৈরি করে এড়িয়ে যাচ্ছেন যে জিডিপি নামতে নামতে ৪% হচ্ছে, ৪৫ বছরের মধ্যে এমপ্লয়মেন্ট সবচেয়ে কমেছে। ব্যাংকে ফ্রড আর ব্যাড লোন বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রাজস্ব ঘাটতি। জিডিপি কালেকশন কমছে। শিক্ষা খাতে বাজেট কমছে। ভাঁড়ে মা ভবানী অথচ গোটা দেশে এন আর সি করে যজ্ঞে ঘি ঢালতে হবে?

--মানে? 

--- আসামের যা খরচা হয়েছে (১২৫০ কোটি টাকা) তাকে জনসংখ্যা ৩ কোটি দিয়ে ভাগ করলে পাই মাথাপিছু খরচা ৪০০ টাকা। তাহলে ১৩৭ কোটির দেশে সবকটা রাজ্যে এন আর সি নামক অশ্বমেধের ঘোড়া দৌড়লে মোট খরচা হবে ৫৪৮০০ কোটি টাকা। বঙ্গে ৯ কোটি জনসংখ্যা; খরচা দাঁড়াবে অন্ততঃ ৩৬০০ কোটি টাকা। রাজকোষের যা হাল তাতে এটাই কি এখন টপ প্রায়োরিটি?

--- দেখুন, ভারত এখন ফাস্টেস্ট গ্রোইয়িং ইকনমি। এতবড় দেশ, তার কাছে পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন হাজার কোটি কতটুকু? মনরেগা প্রোগ্রামেও প্রায় অতটাই লাগে না? দেশের সুরক্ষা আগে; ঘুণপোকা না মারলে ভেতর থেকে ধ্বসে যাবে ।

পুরনো সিপিএম হালদার দেখলেন এই সুযোগ।

--আসামের অভিজ্ঞতা কী বলে? জেলে যাচ্ছে গরীব গুর্বো, খেটে খাওয়া মানুষেরা। যারা বুঝতেই পারেনি কি কি কাগজ চাই, কেন চাই, কোথায় পাওয়া যাবে? তাই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বুড়োও জেলে যায়, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির ফকরুদ্দিন সাহেবের পরিবারের লোকেরও একই হাল। এত খরচা করে হল কি! এখন শাসক দল বলছে ভুল হয়েছে, আর একবার করতে হবে। লে হালুয়া! 

আমার কান ঝালাপালা। আমি বুঝভম্বুল। আমি ক্রেংকটাকৃষ্ট হয়ে মিত্তিরের এঁটো চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কমরেডের আধখাওয়া পানামায় একটা কষে টান মেরে কাশতে থাকি। সভা হল নিস্তব্ধ।

মিনমিন করে বলি—আমাকে একটু সময় দিন। কালকের আড্ডায় আমি পেশ করব আমার দলিল, মানে ভারতে নাগরিক আইন কি বলে? মানে কারা এই দেশের নাগরিক আর কারাই বা অনুপ্রবেশকারী? এন এন আর সি আর ক্যাব ব্যাপারটা কী? খায় না মাথায় দেয়? এটাও দেখব সংবিধান কী বলে? আর কারও ভয় পাওয়ার কোন কারণ আছে কিনা।

মিত্তির ওঁর আধ কাপ চা মেরে দেওয়ায় খচে গেছলেন।

--বাঙাল আমাদের হাইকোর্ট দেখাবে? তুমি কে হে? কবে থেকে উকিল হলে?

আমি সবিনয়ে জানাই যে আমি উকিল-টুকিল নই, হরিদাস পাল। জ্ঞানগম্যি বিশেষ নেই। তবে আইনের স্নাতক, ওই টুকে পাশ করা। এই আড্ডায় কমনসেন্সের কথা বলব। বাকি আপনারা দেখে নেবেন। চোখে আঙুল দিয়ে ভুল ধরিয়ে দেবেন।


আমার দলিলঃ

ভাগ-১ (প্রশ্নোত্তরে সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট)

প্রশ্নঃ ভারতের নাগরিকত্ব আইন কবে তৈরি হল? তাতে কী কী পদ্ধতিতে নাগরিকত্ব পাওয়ার কথা বলা হয়েছে, একটু ঝেড়ে কাশো দিকি।

উত্তরঃ প্রথমে বলা দরকার যে ভারতে নাগরিকত্ব ‘রক্ত সম্পর্কের অধিকার’ নীতি (জাস স্যাঙ্গুইনিস) মেনে তৈরি, ‘জন্মস্থানের অধিকার’ ( জাস সলি) নীতি মেনে নয়। উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। আমেরিকার নাগরিকত্বের ধারণার ভিত্তি হল ‘জন্মস্থানের অধিকার’ (জাস সলি) নীতি, অর্থাৎ যেকোন দেশের অধিবাসী বা ভিন দেশের নাগরিকের কোন সন্তান যদি আমেরিকায় জন্মায় তাহলে বাচ্চাটি স্বতঃ আমেরিকান নাগরিক হবে, তার বাবা-মা’র নাগরিকতা এখানে বিচারণীয় নয়। কিন্তু ভারতবর্ষের নাগরিকতা মূলতঃ ভারতবর্ষীয় মূলের লোকজনের জন্যে। অর্থাৎ বাপ-মা যদি ভারতীয় উপমহাদেশের লোক বা স্বাধীনতার আগের বৃটিশ ভারতের লোক হয় তবেই সন্তান ভারতের নাগরিকতা পেতে পারে। এমনকি সে ভারতের বাইরে জন্মালেও বিশেষ শর্তের মোতাবিক। বিদেশি নাগরিকের সন্তান ভারতের নাগরিকত্ব পেতে হলে তাকে দীর্ঘকাল এদেশে নিয়মিত বাস করতে হবে এবং অন্যদেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করে আবেদন করতে হবে। ভারত একাধিক দেশের নাগরিকত্ব স্বীকার করে না। 

ইন্ডিয়ান সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট ১৯৫৫ অনুযায়ী চারভাবে এদেশের নাগরিক হওয়া যায়; জন্মসূত্রে বা ভারতে জন্মালে, ভারতীয় নাগরিকের বংশজ হওয়ার সূত্রে, পঞ্জীকরণের সূত্রে এবং ন্যাচারালাইজেশন বা দীর্ঘকাল ভারতে বসবাসের সূত্রে।

ধারা-৩ জন্মসূত্রে।

ক) (ভারতীয় মূলের) কেউ যদি ২৬শে জানুয়ারি, ১৯৫০ বা তার পরে এবং ১লা জুলাই, ১৯৮৭ পর্য্যন্ত ভারতে জন্মেছে তবে তাকে ভারতের নাগরিক বলে গণ্য করা হবে।

খ) পরে সংশোধিত হয়ে (ভারতীয় মূলের) যারা ১লা জুলাই, ১৯৮৭ থেকে নাগরিকতা সংশোধন আইন, ২০০৩ অনুযায়ী ৩রা ডিসেম্বর, ২০০৪ পর্য্যন্ত ভারতে জন্মেছে তারাও ভারতের নাগরিক বলে গণ্য হবে যদি তাদের মাতা-পিতার মধ্যে কোন একজন ভারতের নাগরিক হয়ে থাকে।

গ) নাগরিকতা সংশোধন আইন, ২০০৩ অনুযায়ী যারা ৩রা ডিসেম্বর, ২০০৪ এর পরে জন্মেছে তারা গণ্য হবে যদি বাবা-মা’র দুজনই ভারতীয় নাগরিক হয় বা একজন ভারতীয় নাগরিক এবং অন্যজন বেআইনি অনুপ্রবেশকারী না হয়।

টীকা ১ খেয়াল করুন, পাকিস্তানের নাগরিকও মূলতঃ আদি ভারতীয় উপমহাদেশের লোক; সে ধর্মে ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ এবং ক্রিশ্চান—সবই হতে পারে । 

টীকা-২ তাহলে বে-আইনি অনুপ্রবেশকারী কে ? 

উত্তরঃ কোন বিদেশি যে যাতায়াতের বৈধ দস্তাবেজ, যেমন পাসপোর্ট-ভিসা, ছাড়া এ দেশে ঢুকেছে।

অথবা, যে বৈধ কাগজ পত্র নিয়ে এলেও অনুমোদিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় এদেশে রয়েছে।

ধারা -৪ বংশসূত্রেঃ

যে লোকটি ভারতের বাইরে জন্মেছে এবং জন্মের সময় তার বাবা-মার অন্ততঃ একজন ভারতীয় নাগরিক ছিল; সে যদি জন্মের ১ বছরের মধ্যে নিকটস্থ ভারতীয় দুতাবাসে পঞ্জীকরণ করিয়ে থাকে তাহলে আবেদন করে এই ধারা অনুযায়ী নাগরিকত্ব পেতে পারে।

ধারা -৫ পঞ্জীকরণ সূত্রেঃ

এটা তাদের জন্যে প্রযোজ্য যারা বিয়ে বা পারিবারিক সূত্রে কোন ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে যুক্ত।

ধারা-৬ ন্যাচারালাইজেশন বা দীর্ঘকালীন বসবাসের সূত্রেঃ

নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫ এর ধারা ৬ বলছে আবেদককে প্রাকৃতিকবিধির অধীন নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র দেওয়া যেতে পারে যদি সে ক) বে-আইনি অনুপ্রবেশকারী নয়, খ) আবেদনের ঠিক আগে লাগাতার ১২ মাস ভারতে বসবাস করেছে, গ) ওই ১২ মাসের আগের ১৪ বছরে অন্ততঃ ১১ বছর ভারতে বাস করেছে।

ঘ) নতুন সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ২০১৯ বা ক্যাব এ ওই ১১ বছর কমিয়ে ৫ বছর করে দেওয়া হয়েছে।

ব্যতিক্রমঃ ভারত সরকার যদি মনে করে যে আবেদক বিজ্ঞান, দর্শন, কলা, সাহিত্য বা বিশ্ব শান্তির ব্যাপারে বিশেষ অবদান রেখেছে তাহলে ওপরের সবকটি শর্ত সরিয়ে দিয়ে তাকে নাগরিকত্ব প্রদান করতে পারে । তিব্বতি ধর্মগুরু দলাইলামা এবং পাকিস্তানি গায়ক আদনান সামী এই নিয়মের অধীন ভারতের নাগরিক হয়েছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিখ্যাত বৃটিশ বায়োলজিস্ট এবং স্ট্যাটিস্টিশিয়ান যে জে বি এস হ্যালডেন প্রশান্ত মহলানবিশের অনুরোধে কোলকাতায় নবগঠিত ইন্ডিয়ান স্ট্যাস্টিস্টিক্যাল ইন্সটিট্যুটে যোগদান করেন। পরে তিনি বৃটিশ নাগরিকত্ব ছেড়ে ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন—এই ধারায়।

মিত্তিরমশায় একটু গলেছেন। নরম সুরে বললেন—তাহলে ভায়া আমরা কোন ধারায় পড়ব, আর কেউ এসে ক্যাঁক করে চেপে ধরলে কী কাগজপত্তর দেখিয়ে বলব – হিন্দু হ্যায় হম, বতন হ্যায় হিন্দোস্তাঁ হমারা।

হালদার লাফিয়ে উঠেছেন—ধীরে ধীরে রজনী, ধীরে। অত উতলা হবেন না। ইকবালের লেখা ওই গানটার লাইনটি হল ‘হিন্দি হ্যায় হম’, হিন্দু-টিন্দু নেহি। ইকবাল ধর্মে মুসলমান ছিলেন । 

নবীন দেশপ্রেমিক মিনমিন করে বললেন—কিন্তু আমি যে সংস্কারভারতীর শাখায় ‘হিন্দু হ্যায় হম’ গাইতে শুনেছি।

প্রফেসর মুচকি হাসলেন। --ওরা ইতিহাস থেকে শুরু করে অনেককিছুই নিজেদের সুবিধেমত পালটে নিচ্ছে। ‘বন্দে মাতরম’ গানটিও গায় ‘কোটি কোটি কন্ঠ কলকলনিনাদকরালে ,কোটি কোটি ভুজইধৃতখরকরবালে’। কারণ ‘সপ্তকোটি’ কন্ঠ গাইলে ধরা পড়ে যাবে বঙ্কিম গানটি আদৌ গোটা দেশের কথা ভেবে লেখেননি, ওঁর সময়ের অবিভক্ত বাংলার জনসংখ্যার কথা ভেবে লিখেছিলেন। ক্রস চেক করুন, দাড়িদাদুর ‘সাতকোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী

মিত্তির ফের খচে গেলেন,- কাজের কতা হোক, আমার প্রশ্নের জবাব পেলুম নাকো।

--চিন্তা করবেন না । আমরা এখানে যারা গুলতানি করছি তারা সবাই ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ এর পরে এবং ১লা জুলাই, ১৯৮৭ তারিখের আগে জন্মেছি। কাজেই আমরা সবাই জন্মসূত্রে ভারতের নাগরিক—ইন্ডিয়ান সিটিজেনশিপ, অ্যাক্ট, ১৯৫৫এর ধারা ৩ (১) (ক) অনুযায়ী। প্রমাণ হিসেবে আধার কার্ড, ভোটার আইডি, পাসপোর্ট এর যেকোন একটাই যথেষ্ট; কিন্তু আধার ও পাসপোর্টের ওজন বেশি। অধিকন্তু ন দোষায়। তবে দেখে নেবেন—নামের বানানটান যেন ইউনিফর্ম থাকে। মুখার্জি বা মুখোপাধ্যায়, যাই পছন্দ করুন সবজায়গায় একরকম হতে হবে। মোহম্মদ, মুহম্মদ বা মোঃ –কোন একটা সব কাগজে হওয়া চাই। সংশোধনের পদ্ধতি আছে, অনলাইনেও হয়। এটা একটু দেখে নেবেন।

সরকার খুশি হয়ে বললেন—ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো ভায়া। চা আনাও, আমি পয়সা দেব। কিন্তু ছেলেমেয়েরা? সবাই ভারতে জন্মেছে কিন্তু।

--যদি ১ জুলাই, ১৯৮৭র পরে না জন্মে থাকে তবে আপনার মতই –ধারা ৩(১)ক। যদি ১ জুলাই, ১৯৮৭ থেকে ৩রা ডিসেম্বর, ২০০৪এর মধ্যে জন্মে থাকে তাহলে ধারা ৩(১)খ। মানে ওর জন্মের সার্টিফিকেট এবং আপনার বা গিন্নির (বাবা-মা) আধার কার্ড যথেষ্ট। আর আপনার নাতি-নাতনী? যদি ৩রা ডিসেম্বর, ২০০৪ এর পরে ভারতে জন্মে থাকে, অর্ত্থাৎ ধারা ৩(১)গ, তাহলে ওদের বার্থ সার্টিফিকেট এবং আপনার ছেলে ও ছেলেবৌ –দুজনেরই আধার ও ভোটারকার্ড লাগিয়ে দেবেন। আবার বলি, এসব ক্ষেত্রে অধিকন্তু ন দোষায়।

সবার মুখে হাসি ফুটেছে। কিন্তু অধ্যাপক মাথা চুলকোচ্ছেন। হল কী? 

--এই সব লেকচার আমার কোন কাজে লাগবে না। কারণ আমি জন্মেছি ৭ই জানুয়ারি, ১৯৫০। আমার কী হবে?

সবাই চুপ। 

উনি বিড়বিড় করতে থাকেনঃ সংবিধান জন্ম নিল ২৬শে জানুয়ারি, ১৯৫০ আর আমি জন্মালাম ১৯ দিন আগে। ক্যান? আর উন্নিশদিন পরে জন্মাইলে কি হইত? কেডা মাথার দিব্যি দিছল?

মিত্তির গুণগুণ করেন—ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন মুণ্ড কোথায় পেলি? সত্যিই তো, ভারত স্বাধীন হল, দেশভাগ হল। কিন্তু যারা সংবিধান হওয়ার আগে মাউন্টব্যাটেন জমানায় জন্মালো তাদের জন্যে আম্বেদকর কোন ব্যবস্থা করেননি? একি অনাসৃষ্টি!

নবীন দেশপ্রেমিক জোরগলায় বলেন সেইসব ভুল, অব্যবস্থা দূর করতেই তো মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী “ক্যাব” সংশোধন এনেছেন। যারা পাকিস্তান থেকে এসে সত্তর বছর ধরে নাগরিকতা পায়নি তারা এবার পাবে।

একটা ঝগড়া শুরু হয় আর কি! আমি প্রায় রায়ট পুলিশের মত ঝাঁপিয়ে পড়ি।

--আপনারা থামবেন? ওঁরা এত বোকা ছিলেন না। একবার সংবিধান সভার ডিবেটগুলো পড়বেন। ওগুলো ইন্টেলেকচুয়াল অ্যাসেট।

যাকগে, সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের বিষয় হল নাগরিকত্ব-- আর্টিকল ৫ থেকে আর্টিকল ১১ পর্য্যন্ত । 

আর্টিকল ৫(ক) বলছে সংবিধান পাশ হওয়ার সময় যারা ভারতের ভুখন্ডে জন্মেছে এবং ভারতে স্থায়ী ভাবে বসবাস করেছে তারা সবাই ভারতের নাগরিক। আপনি তো জন্মের পর থেকে ভারতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন, পড়াশুনো, চাকরি সব এখানে। ভোটার কার্ড, আধার সবই হয়েছে, কোথাও আটকায়নি?

--না; এমনকি পাসপোর্ট বানিয়ে আটালান্টাতে ছেলের কাছে গিয়ে নাতির মুখেভাত করিয়ে এসেছি।

--দেখলেন তো? আপনি আর্টিকল ৫(ক) হিসেবে নাগরিক। নইলে পাসপোর্ট দিত? আরও দেখুন। আর্টিকল ৬ অনুযায়ী যাদের বাবা-কাকারা ১৯শে জুলাই, ১৯৪৮ এর আগে পাকিস্তান থেকে ভারতে এসেছেন তারা সবাই ভারতের নাগরিক হিসেবে গণ্য হবে।

এবার হালদারের অবাক হওয়ার পালা। আমার বাবা তো জানুয়ারি ১৯৪৯ সালে খুলনা থেকে কোলকাতায় এলেন। কিন্তু ওঁর ভোটার কার্ড হয়েছিল। সেটা কি বে-আইনি?

--আদৌ নয়। উনি নিশ্চয়ই আসার ছ’মাস পরে নিয়মমাফিক ভারত সরকারের অধিকৃত অফিসারের কাছে নিয়মমাফিক আবেদন করেছিলেন, তাই রেজিস্টারে নাম উঠেছিল।। (আর্টিকল ৬(খ)(১) (২)।

--আচ্ছা, আমার নাতি তো আমেরিকার আটালান্টায় জন্মেছে? ওর জন্যে কী করতে হবে?

--কিচ্ছু করতে হবে না। আমেরিকার সংবিধান অনুযায়ী ও জন্মসূত্রে ( জাস সোলি) ওদেশের নাগরিক। বাকিটা ওর বাবা-মাকে ভাবতে দিন। আপনার কিসে ইল্লি হচ্ছে? কমরেডের নাতি সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার নাগরিক? ধুত্তেরি! সে রামও নেই , সে অযোধ্যাও নেই।

-- এবার এন আর সি, ক্যাব এবং আসাম নিয়ে দু’পহা হোক।

--কালকে; আজ গলা শুকিয়ে গেছে।


ভাগ-২ 

নাগরিক পঞ্জী, ক্যাব এবং আসাম সমঝোতা ১৯৮৫

ভারতে প্রথম ১৯৫১ সালে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী বা ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন (এন আর সি) শুরু হয়। তারপর কোন সরকারই ওই পঞ্জী বা রেজিস্টার আপডেট করার প্রয়োজন অনুভব করেনি। 

কিন্তু নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫ বেশ কয়েকবার সংশোধিত হয়েছে। যেমন, ১৯৮৬, ১৯৯২, ২০০৩। ওই ২০০৩ এর সংশোধন সরকারকে এন আর সি ম্যান্ডেটরি বলে নির্দেশ দিল। কেন? এ না হলে আসাম সমঝোতা ১৯৮৫ অনুযায়ী ‘বিদেশি’চিহ্নিত করা যাচ্ছিল না।

তাহলে আগে আসাম সমঝোতা ১৯৮৫ নিয়ে কথা বলা দরকার। এটি পূর্ব পাকিস্তান/বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের (পড়ুন মুখ্যতঃ বাঙালী হিন্দু) বে-আইনি অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ছ’বছর গণ আন্দোলনের ফসল। এই সমঝোতায় ১৫ অগাস্ট, ১৯৮৫ তারিখে ভারত সরকার, আসাম রাজ্য সরকার, অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন এবং আসাম গণ সংগ্রাম পরিষদ দস্তখত করে। 

আপনাদের খারাপ লাগতে পারে কিন্তু দার্জিলিং এর গোর্খাদের মত আসামীদেরও ভয় যে বাঙালীরা( হিন্দু বা মুসলিম), বিশেষ করে যারা বাংলাদেশ থেকে জীবিকার বা আশ্রয়ের খোঁজে আসামে প্রবেশ করছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে গেলে খোদ আসামীদের জীবিকা, সংস্কৃতি এবং স্বতন্ত্র পহচান বিপন্ন হবে।

আসাম সমঝোতা ১৯৮৫ এবং নাগরিকতার রাষ্ট্রীয় পঞ্জীকরণ (এন আর সি)

.১ ওই সমঝোতার ফলে আসামের জন্যে নাগরিকত্বের কাট -অফ ডেট হল ১লা জানুয়ারি ১৯৮৭ না হয়ে ২৪ মার্চ, ১৯৭১। কারণ, ১৯৭১এ স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের সময় তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে হিন্দু (বাঙালী) শরণার্থী আসামে ঢোকে ।স্থানীয় অভিবাসীদের ভয় এরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে গেলে বাঙালী সংস্কৃতির আগ্রাসনে অহোমিয়াদের পরম্পরাগত ভাষা ও সংস্কৃতির অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। তাই ২৪ মার্চ ১৯৭১ এর পরে বাইরে থেকে যাঁরা আসামে এসেছেন তাঁদের আসামে বে-আইনি অনুপ্রবেশকারী ‘বিদেশি’ বলে গণ্য করা হবে। 

২ আসামের জন্যে এন অ্যার সি বা নাগরিকত্বের রাষ্ট্রীয় পঞ্জীকরণের তারিখটিও ওই ২৪ মার্চ ১৯৭১। এর মানে যাঁরা আসামে বসবাস করছেন কিন্তু এখানকার স্থানীয় বাসিন্দে নন, তাঁদের দস্তাবেজী প্রমাণ দিতে হবে যে তাঁরা ২৪ মার্চ ১৯৭১ বা তার আগে থেকেই আসামে এসেছিলেন বৈধ নাগরিক হিসেবে বা উপযুক্ত কাগজপত্র নিয়ে ।

নইলে তাঁদের অনুপ্রবেশকারী ধরে নিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে পুরে দেওয়া হবে। তার আগে এইসব চিহ্নিত মানুষজনদের ফরেন ট্রাইব্যুনালের কাছে আপিল করে নিজেদের বৈধ অধিবাসী বলে প্রমাণ করার সুযোগ দেওয়া হবে।

আসাম সমঝোতার ধারা ৫.৮ অনুযায়ী ২৫শে মার্চ, ১৯৭১ বা তার পরে আসামে অনুপ্রবেশ করা বিদেশিদের চিহ্নিত করে ভোটার লিস্ট এবং নাগরিক পঞ্জী থেকে তাদের নাম কেটে দেওয়া হবে এবং শেষে তাদের রাজ্য থেকে বের করে দেওয়ার বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

বিদেশি চিহ্নিতকরণের পদ্ধতিটি বে-আইনি অনুপ্রবেশকারী (ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে) আইন, ১৯৮৩তে বর্ণিত রয়েছে, তবে এটা শুধু আসামের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এই আইনটি ২০০৫ সালে সুপ্রীম কোর্ট সংবিধানের পরিপন্থী বলে খারিজ করে দেয়। আবেদক সর্বানন্দ সোনওয়াল (বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী) তখন বলেছিলেন যে এর ধারাগুলো এমন কড়া যে বাস্তবে এর সাহায্যে বে-আইনি অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিতকরণ এবং নির্বাসন প্রায় অসম্ভব। 

২০১৩ সালে ‘আসাম পাবলিক ওয়ার্কস নামে একটি এনজিও’র আবেদনে রায় দিয়ে সুপ্রীম কোর্টের খবরদারিতে আসামে এই কাজ শুরু হয়। শেষ হলে দেখা গেল ৩ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ১৯ লক্ষ চিহ্নিত হলেন অনাগরিক হিসেবে। ফলে ১০০ কোটি টাকা বাজেটে বরাদ্দ করিয়ে নতুন করে অনেক ডিটেনশন ক্যাম্প বানানো হচ্ছে। বিজেপির মুসলিম অনুপ্রবেশের সমস্ত গল্পকে ভুল প্রমাণ করে দেখা গেল এদের মধ্যে বেশিরভাগই বাঙালী হিন্দু। অসমিয়ারা চান ওই ১৯ লক্ষ ‘বিদেশি’দের আসাম থেকে গলাধাক্কা দিতে; আপাততঃ সব নাগরিক সুবিধে থেকে বঞ্চিত করে ডিটেনশন ক্যাম্পে। কিন্তু বিজেপি যে বাঙালি হিন্দুদের ‘তোমাদের কিচ্ছু হবে না প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট নিয়েছিল!

হতাশ বিজেপি নেতৃত্ব বললেন এই সার্ভে ভুল। আবার নতুন করে হোক। সুপ্রীম কোর্ট রাজি নয় । তখন দ্রুত এল আরেকটি সংশোধন—সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল বা ক্যাব, যা ১২ ডিসেম্বর, ২০১৯ তারিখে রাষ্ট্রপতির মোহর লেগে আইন হয়ে গেছে। এর সঙ্গে আসাম সমঝোতা, ১৯৮৫র এবং আসামে বর্তমান ক্যাব বিরোধী আন্দোলনের সম্পর্ক নিয়ে এরপরে বলছি ।

ক্যাব বা নাগরিকত্ব সংশোধন বিল, ২০১৯

এই সংশোধন অনুযায়ী প্রতিবেশী নির্দিষ্ট তিনটি রাষ্ট্র, যথা পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪ এবং তার আগে ধর্মীয় উৎপীড়নের ফলে আগত হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, পার্সি এবং ক্রিশ্চানদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এতে মুসলিমরা বাদ।

বলা ভাল যে ভারতে বেআইনি শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া বা শরণার্থী বলে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে কোন রাষ্ট্রীয় নীতি ছিল না। স্বরাষ্ট্র দপ্তর রিফিউজি বলে দাবি করা বিদেশের নাগরিকদের ব্যাপারে কেস-টু-কেস ভিত্তিতে বিচার করে হয় ওয়ার্ক পারমিট (তিব্বতি রিফিউজি, চাকমা শরণার্থী) বা দীর্ঘকালীন ভিসা দিত (তসলিমা নাসরিন)। লক্ষণীয় যে ভারতের নাগরিকত্ব আইনে (১৯৫৫) অল্পসংখ্যক বা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কোন ধারা ছিল না। বর্তমান সংশোধনে সেই অভাব দূর হল; কিন্তু নাগরিকতা প্রদান করার ভিত্তি হল ধর্মীয় পরিচয় যা সংবিধানের মূল ভাবনার পরিপন্থী। তবে ভারতের সংবিধানের আর্টিকল ৬ অনুযায়ী প্রাক্তন পশ্চিম(বর্তমানে শুধু পাকিস্তান) ও পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ) থেকে জুলাই, ১৯৪৮এর আগে ভারতে আগত শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে তাতে শরণার্থীদের মধ্যে ভাষা বা ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে কোন বিভেদ করা হয়নি। 

এই প্রথম এবিষয়ে একটি আইন করা হল। কিন্তু মুসলিমরা বাদ কেন ?

কারণ হিসেবে সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে ওই তিনটি রাষ্ট্র ঘোষিত ভাবে ইস্লামিক দেশ। ফলে সেখানে মুসলিমদের ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হবার প্রশ্ন ওঠে না। এবং এই তিনটি দেশে মুসলিমরা সংখ্যালঘু হতে পারে না। সত্যিই কি তাই?

লক্ষণীয়, পাকিস্তানে আহমদিয়া সম্প্রদায়কে দ্বিতীয় সংবিধান সংশোধন আইনে মুসলিম বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। ওদের পক্ষে পাকিস্তানে নিজেদের মুসলিম ঘোষণা করা দণ্ডনীয় অপরাধ। ওদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া পাকিস্তানে ইসলামের সুন্নী শাখাকে একমাত্র খাঁটি ইসলাম বলে রাষ্ট্রীয় ধর্মের স্বীকৃতি দেওয়ায় অল্পসংখ্যক শিয়া শাখার অনুগামীরাও উৎপীড়নের শিকার হয়ে থাকেন। আফগানিস্তানে হাজিরাদের উপর অত্যাচার নিয়ে ‘কাইট রানার’ উপন্যাস এবং সিনেমা এখন গোটা বিশ্বের নজরে। আর বর্তমান বাংলাদেশে নাস্তিকতার কারণে উগ্র ইসলামিক সংগঠন যাদের হত্যা করেছে তাদের মধ্যে হিন্দু এবং মুসলিম দুইই আছেন। প্রশ্ন ওঠে, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ তো বন্ধু রাষ্ট্র। তাদের সরকারের কাছে আমরা সংখ্যালঘুদের নির্যাতন নিয়ে কিছু বলেছি কিনা। 

বাদ যাওয়া অন্য প্রতিবেশি দেশগুলো - 

বাদ গেছ শ্রীলংকা, মায়ানমার এবং চিনের নামও।

চিনে উইঘুর উপজাতি মুসলিমদের উপর অত্যাচারের কথা কয়েক দশক ধরে প্রকাশ্যে আসছে। ইদানীং বিখ্যাত জার্মান ফুটবলার মেসুট ওজিল এ নিয়ে প্রতিবাদ করে হইচই ফেলে দিয়েছেন। 

২০১৬ সালে আমেরিকার কমিশন ফর ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা আইনের উল্লংঘনের দায়ে টিয়ের-১ দেশ বোলে চিহ্নিত করেছে। এই কমিশনই আবার ডিসেম্বর ২০১৯শে ভারতের ক্যাবকে ডিস্ক্রিমিনেটরি বলে সমালোচনা করেছে। অগাস্ট ২০১৯শে ইউ এস, ইউকে এবং কানাডা চিন ও পাকিস্তানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর উৎপীড়ন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গিয়া মুসলিমদের উপর অত্যাচার নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা চলছে। শ্রীলংকায় তামিলদের উপর অত্যাচারএর ইতিহাস তো কয়েক দশকের। ইদানীং মুসলিমদের উপরও শুরু হয়েছে। শ্রীলংকা এবং ভূটানের স্টেট রিলিজিয়ন হল বৌদ্ধধর্ম। অমিত শাহের যুক্তি তাতে কি, ইসলাম তো নয়।

তাহলে একমাত্র ইসলামিক দেশে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার হয়?

অমিত শাহ সংসদে জোর গলায় তিনটে কথা বলেছেন।

এক, কোন রোহিঙ্গিয়া মুসলিম শরণার্থীকে ভারতে আশ্রয় দেওয়া হবে না । 

দুই, ভারতের সমস্ত রাজ্যতে এন আর সি করিয়ে সমস্ত অনুপ্রবেশকারী ঘুণপোকাদের ঝেঁটিয়ে বিদেয় করা হবে।

তিন, ভারতের নাগরিক মুসলমানদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

দ্বিতীয় এবং তৃতীয় উক্তিগুলিকে আমরা একটু খুঁটিয়ে দেখব।

লক্ষণীয় যে মুখে যাই বলা হোক, মূল আইনের টেক্সটে ‘ধর্মীয়’ না বলে কেবল ‘উৎপীড়িত সংখ্যালঘু’ বলা হয়েছে।

প্রশ্নঃ বর্তমান ভারতে অনুপ্রবেশকারী কে ও কারা? কারা সেই ঘুণপোকা?

প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন পাকিস্তান-বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান থেকে আসা লক্ষ কোটি অমুসলিম শরণার্থী এদেশে ‘রাষ্ট্রহীন’ পরিচয়ে চিহ্নিত হয়ে নাগরিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে হীন জীবন যাপন করছেন। এই সংশোধনের ফলে তাদের নাগরিকত্ব দিয়ে মানবিক দায়িত্ব পালন করা হবে। বেশ কথা। কিন্তু সরকারের চোখে এই শরণার্থীদের বাস্তব সংখ্যাটি কত? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক থেকে ২০১৬ সংসদে জানানো হয়েছিল যে ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪ পর্য্যন্ত এই সংখ্যাটি হল ২,৮৯,৩৯৪। এর মধ্যে সব ধর্মের লোকই আছে।

রাষ্ট্র শরণার্থী

বাংলাদেশ        ১,০৩,৮১৭
শ্রীলংকা          ১,০২,৪৬৭
তিব্বত              ৫৮, ১৫৫
ম্যানমার            ১২, ৪৩৪
পাকিস্তান             ৮,৭৯৯
আফগানিস্তান      ৩,৪৬৯
অন্যান্য                   ২৫৩
_______________
মোট              ২,৮৯,৩৯৪

(সূত্রঃ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৯, পৃ-১৬)।

দেখুন, শ্রীলংকা এবং মিয়ানমার বাদ! তাহলে আসল ব্যাপারটা কী?

প্রশ্নঃ এই আইন কি ভারতের সব রাজ্যে সমান ভাবে প্রভাবশীল হবে?

উত্তরঃ না ; বাদ যাবে সিকিম (আর্টিকল ৩৭১এর উপধারায় বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত রাজ্য), এবংত্রিপুরা, মিজোরাম, মেঘালয় এবং আসামের চিহ্নিত আদিবাসী অঞ্চলটুকু (সংবিধানের ষষ্ঠ তালিকায় আছে বলে)। এছাড়া বেঙ্গল ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রেগুলেশন ১৮৭৩ এর অধীন ইনার লাইন পারমিট (যাতে বাইরের লোকের এলাকায় ঢুকতে বেরোতে স্পেশাল পারমিট নিতে হয়) ব্যবস্থার ফলে প্রায় সম্পূর্ণ নাগাল্যান্ড, মিজোরাম এবং অরুণাচল প্রদেশ এই আইনের আওতার বাইরে থাকবে।

প্রশ্নঃ এই আইনে কাদের লাভ? কাদের লোকসান?

উত্তরঃ আফগানিস্থান, পাকিস্থান এবং বাংলাদেশ থেকে ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪ সালের আগে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্শি এবং ক্রিশ্চান সম্প্রদায়ের লোকজন যদি ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪ সালের আগে ভারতে প্রবেশ করে নাগরিকত্বের জন্যে আবেদন করে তবে তাদের কোনরকম দস্তাবেজি প্রমাণ ( কোন তারিখে ভারতে প্রবেশ করেছে এবং ধর্মীয় কারণে প্রতাড়িত হয়েছে তার প্রমাণ?)ছাড়াই চটপট নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়া হবে।

ইদানীং আসামে যে এন আর সি হয়েছে তাতে দস্তাবেজি প্রমাণের অভাবে যে ১৯ লক্ষ লোককে ‘বিদেশি’ দেগে দিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে ফেলে রাখা হয়েছে তাদের বৃহৎ অংশটিই হিন্দু। তারা এই নতুন সংশোধনের ফলে মুক্ত হয়ে কোন দস্তাবেজ ছাড়াই নাগরিক হয়ে যাবে। তাদের আবেদনে খালি বলতে হবে যে তারা ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে অমুক দেশ (ওই তিনটির কোন একটি) থেকে পালিয়ে এসেছে।

কিন্তু দেগে দেওয়া মুসলিমরা এই সুযোগ পাবে না। ফলে তাদের বন্দী হয়ে থাকতে হবে নইলে অন্য কোন দেশে ঠেলে দেওয়া হবে। কে নিতে চায়?

প্রশ্নঃ আসামের লোকজনের ,বিশেষ করে বিজেপির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা দলগুলির এই আইন নিয়ে রাগারাগির কারণ কী?

উত্তরঃ দেখুন , শাসক দলের মন্ত্রীরা বলছেন এন আর সি এবং এই ক্যাব বা সংশোধনী আইন আলাদা। কিন্তু আসামের লোকজন সেটা মানছে না । বলছে ওদের দাবিতে এইমাত্র এন আর সি হল। আসাম সমঝোতা অনুযায়ী ১৯ লক্ষ অনাবাসীদের চিহ্নিত করা গেল, এবার বের করে দেওয়া যাবে। এ’ব্যাপারে ওদের হিন্দু-মুসলিম নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। অনাবাসী বাঙালীদের বের করতে হবে। কিন্তু এই সংশোধনী আইনের ফলে হিন্দু বাঙালীরা, মানে ১৯ লক্ষের সিংহভাগ লোকজন নাগরিকত্ব পেয়ে আসামে মৌরসীপাট্টা গেড়ে বসবে। এ তো আসাম সমঝোতা ১৯৮৫র মূল ভাবনার পায়ে কুড়ুল মারা! এ তো বলতে গেলে বিশ্বাসঘাতকতা!

প্রশ্নঃ ভারতের মুসলিমদের আদৌ ভয় পাওয়ার কোন কারণ আছে?

উত্তরঃ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বারংবার বলছেন—ভয় নাহি, ভয় নাহি, রে ভয় নাহি! এই সংশোধনের উদ্দেশ্য কাউকে দেশ থেকে বের করা নয়, বরং কিছু সহায়সম্বলহীন শরণার্থীদের সসম্মানে নাগরিকের স্বীকৃতি দেওয়া। এতে মুসলমানদের ক্যান ইল্লি হচ্ছে?

ঠিক কথা, এই আইনে আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মুসলমানের বিরুদ্ধে একটিও শব্দ নেই; তবে?

কিন্তু উপরের আসামের উদাহরণ থেকেই স্পষ্ট যে এন আর সি হয়ে দস্তাবেজের অভাবে ডিটেনশন ক্যাম্পে যাওয়া মুসলমানদের জন্যে এই সংশোধনে কোন গাছের ছায়া নেই। এবং অমিত শাহ সমানে হুঙ্কার দিচ্ছেন যে আসামের পর সমস্ত রাজ্যে ওভাবেই এন আর সি হবে আর বে-আইনি অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে দেশের বাইরে বের করে দেওয়া হবে।অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে অশিক্ষিত গরীব খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে ঠিকমত কাগজপত্র সামলে রাখা এবং অফিসারের সামনে পেশ করা বেশ কঠিন। তাই ওই ১৯ লক্ষের মধ্যে ওরাই বেশি। ভবিষ্যৎ এন আর সিতেও এই গরীবগুর্বো চাষাভুষো কুলিমজুরের দলই বেশি করে সন্দেহভাজনের তালিকায় উঠবে। তাদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম-শিখ-ইসাই সবাই থাকবে কমবেশি। কিন্তু নতুন সংশোধনীর সুযোগে রেহাই পাবে অন্য সবাই। আটকে যাবে মুসলিমরা। ওরা কোথায় যাবে? পাকিস্তানে? বাংলাদেশে?

সবচেয়ে বড় কথা, এই আইন মুসলিমদের বুঝিয়ে দিচ্ছে যে তোমরা বাকি সবার থেকে আলাদা। তোমাদের অস্তিত্বকে আমরা ভুলে যাই বা কোনরকমে সহ্য করি। 

সন্নাটা! সন্নাটা!

গলা খাঁকারি দিয়ে হালদার বললেন—একটা কথা। আমার ছেলে কাল আটালান্টা থেকে ফোনে বলল যে এই আইনে নাকি ‘ও সি আর’ কার্ড হোল্ডারদের সুবিধে দেওয়া হয়েছে যে তারা বিনা ঝামেলায় ভারতে আসা যাওয়া, পড়াশুনো বা কোন প্রজেক্টে কাজ করতে পারবে?

--অ, তাহলে আপনার পার্টির ডাকা প্রতিবাদ মিছিলে যাচ্ছেন না ?

-- কি যে বলেন মিত্তিরদা!

2 comments:

0

প্রবন্ধ - জ্যোতিপ্রসাদ রায়

Posted in

২৯ শে আগষ্ট বিদ্রোহী কবির মৃত্যু দিন। তার সপ্তাহ খানেকের মধ্যে গুরু-প্রণাম। পোষাকি নাম—শিক্ষক দিবস। প্রায় হারিয়ে যাওয়া, নিরাসক্তভাবে ছাড়াই-বাছাই করা অনেক অচেনা তথ্য সমৃদ্ধ এম. আবদুর রহমানের লেখা, ‘কিশোর নজরুল’-এর(১৯৬৩) পোকায় কাটা পাতা ওলটাতে ওলটাতে বেরিয়ে এল কবির ছাত্রজীবনের কত ধুলো-পরা ‘কথা’ এবং ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের কত অপরিচিত ‘সাবেকি’ উত্তাপ! যা, একালের নিরিখে অবিশ্বাস্য; তবে সব ক’টি প্রদীপ নিভে যায়নি বলেই কোনো কোনো ছাত্রের কাছে হয়ত আকর্ষণীয় হতে পারে। 

মেঘ ছাড়া বৃষ্টিপাত হয় না, তেমনি ‘গুরু বিনে’ সাফল্যের ‘সোনার গৌর’ অধরা— এই লোকায়ত বিশ্বাস-সংস্কার আজও ছড়িয়ে আছে গ্রামবাংলার আকাশে-বাতাসে। কারো মনে যদি সৎ পথে ও হাড়ভাঙা খেটে পাওয়া ‘সাফল্য’-কে স্থায়ী করার বাসনা থাকে, ‘হৃদ-মাঝারে’ ধরে রাখার আকুতি থাকে, তাহলে গুরুর জীবনমুখী ধ্যান-ধারনা,রীতি-নীতি,আদর্শ ও সৌজন্যবোধের ধারাবাহিক অনুশীলন দরকার। এমন নিষ্ঠাবান জীবনচর্চায় মিলতে পারে কালোত্তীর্ণ পরিসরে নন্দিত মনুষ্যত্বের মহিমা। আর তখন, একদা সাদামাটা ক্ষণস্থায়ী জীবনের দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসে রকমারি কৌতূহল ও চেনা-জানার আগ্রহ। কালের বাঁকে বাঁকে চলমান জীবন সন্ধান করে, বেঁচে থাকার পুঁজি ও পাথেয়। প্রথাগত বিদ্যাচর্চার আঙিনায় ছাত্র নজরুলের জীবনেও শিয়ারসোল-দরিরামপুর-মাথরুন হাইস্কুলের শিক্ষকদের অবদান তাঁর লেখনীতেই স্বীকৃত। গুরুকুল তাঁর মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন ভাবীকালের একজন প্রতিভাবান বাঙালির কায়া ও ছায়া; অন্যদিকে নজরুল তাঁদের স্নেহ-ভালবাসার সান্নিধ্যে নিজেকে গড়ে-পিটে নিচ্ছিলেন দেশের তথা দশের জন্য একাকী নির্জনে। 

বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের প্রথাগত ছাত্রজীবন যেমন কিংবদন্তি নির্ভর, তেমনি চিত্তাকর্ষক। পেয়েছেন অনেক গুণী শিক্ষকের স্নেহ-ভালবাসা-আশীর্বাদ। শ্রেণি কক্ষে পাঠ্যবস্তুর বাইরে কোনো শিক্ষক তাঁকে অণুপ্রাণিত করেছেন সাহিত্য চর্চায়, কেউ আবার নিজের কাছে বসিয়ে তালিম দিয়েছেন সঙ্গীতের সুর,তাল,লয় (সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল)। কারো উৎসাহ ছিল, তাঁকে ভাল করে শিখিয়ে দেবেন পার্সী ভাষার পাঠ ও বর্ণমালা(দ্বিতীয় মৌলবী নূরুন্নবী)। কারো কাছে পেয়েছেন নিবিড় দেশভক্তিজনিত আত্মত্যাগের আনন্দ-কস্তুরী (নিবারণচন্দ্র ঘটক)। সব মিলিয়ে ছেলেবেলায় বিদ্রোহী কবির শিক্ষক-ভাগ্য ছিল ঈর্ষণীয়। তাঁর প্রতিভার বিকাশ ও প্রসারের অনুকূল। উল্টোদিকে ছাত্র নজরুল ইসলাম, তাঁর গুণগ্রাহী অভিভাবক তুল্য শিক্ষিককুলের চরণে মাথা ঝুঁকিয়ে শুধু সমকালে নিখাদ শ্রদ্ধা-সম্মান-ভক্তি নিবেদন করেন নি; দেশ-জোড়া কবি খ্যাতি অর্জনের পরেও শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রাবস্থার স্মৃতিবাহিত আবেশে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বারংবার তাঁদের সঙ্গে দেখা করেছেন। তাঁদের দিনযাপনের খোঁজ-খবর নিয়েছেন। সুযোগ পেলেই যথাযোগ্য সম্মান জানিয়ে গর্বিত করেছেন নিজেকে। 
এবার কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যাক। শিয়ারসোল স্কুলের শিক্ষক ভোলানাথ স্বর্ণকারের অবসরের দিনে (১৬ জুলাই, ১৯১৬) অভিনন্দন পত্র রচনার ভার পড়ে নজরুলের ওপর। সেদিন বিদায়ী কবিতার ছত্রে ছত্রে কিশোর-কবি নজরুল উজাড় করে দিয়েছেন শিক্ষকের উদ্দেশ্যে তাঁর প্রণত অন্তরের অপরিমেয় শ্রদ্ধা-ভক্তি। ছাত্র-নজরুলের কাছে শিক্ষক’রা হলেন আশ্রয়,প্রশয় আর জীবন গঠনের দক্ষ কারিগর। লিখলেন ভোলানাথ বাবু’র সম্মাননা পত্রে : ‘ সন্তানে ফেলিয়া পিতা কখন যায় কি কোথা ?’ কিংবা ‘ উঠরে বালক দল মুছিয়া আঁখির জল / করে নে বরণ ডালা দে গলে পরিয়ে মালা / চরণ ঢাকিয়া দে রে প্রসূণ রাশিতে / পাবি না আর যে কভু এ ভাল্‌বাসিতে।’ এ ত গেল ছাত্র থাকাকালীন পূজনীয় শিক্ষকদের প্রতি তাঁর দৃষ্টিপাতের ধ্রুবপদ। অন্তঃস্থলের বেল-জুঁই, শিউলি-বকুল। কিন্তু বিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়া শিক্ষকদের প্রতি উত্তরকালে যশ-খ্যাতির নিরিখে প্রতিষ্ঠিত কবি-গীতিকার নজরুলের মানসিকতা যেন আরো বেশি পরিমানে সামাজিকতায়, স্বতঃপ্রণোদিত দায়িত্ব-কর্তব্য বোধে উন্মুখর। আন্তরিকতায় ও বিনীত নম্রতায় রোদ ঝলমল। পারস্পরিক স্নেহ-ভালবাসায়, প্রীতির বন্ধনে ভাস্বর। তাই একদা কাটোয়ার মাথরুনের নবীনচন্দ্র ইন্সটিটিউসনের প্রধান শিক্ষক কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিককে নজরুল পত্রে লেখেন(৬.৪.১৯৩৬) : 
“ শ্রীচরণারবিন্দেষু, 

বহুদিন আপনার শ্রীচরণ দর্শন করিনি।...আমি বর্তমানে H.M.V. Gramophone Co.-এর Exclusive Composer… আপনার ‘অধরে নেমেছে মৃত্যু কালিমা’ গানটির permission (রেকর্ড করার জন্য) চান কোম্পানী।... আপনার অনুমতি পেলেই কোম্পানী আপনাকে Royalty দেওয়ার অঙ্গীকার পত্র পাঠিয়ে দেবে।... প্রণত : নজরুল ইসলাম।” 
এই পত্রের সম্বোধন থেকে শেষ পর্যন্ত--- প্রতিটি উচ্চারণের খাঁজে-ভাঁজে লুকিয়ে আছে ছাত্রসুলভ স্নেহ-ছায়া লাভের ‘মিনতি’ (যদিও তাঁদের দুজনের প্রথামাফিক ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের কালসীমা অতিক্রম করে গেছে দু’দশকের ওপর; তবু নজরুলের অন্তরে এখনো বহমান, অগ্রজের স্নেহ-ভালবাসাসহ অমেয় কৃপালাভের আকুতি !) 

ছাত্র নজরুলের দিক থেকে অনুরূপ শ্রদ্ধা-ভক্তির নমুনা যথারীতি পরিস্ফুট হয়েছে ময়মনসিংহের দরিরামপুর হাইস্কুলের শিক্ষক মহিমচন্দ্র খাসনবিশ, শিয়ারসোল হাইস্কুলের শিক্ষক সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল, হরিশঙ্কর মিশ্র, মৌলবী হাফেজ নূরুনব্বী, নিবারণচন্দ্র ঘটক, বিপিন বিহারী গঙ্গোপাধ্যায় এবং অবশ্য এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়দের শ্রীচরণে। শিক্ষক নিবারণচন্দ্র ঘটক ও বি.বি. গাঙ্গুলির কাছ থেকে গোপনে ‘সর্বহারা’র কবি পাঠ নিয়েছিলেন, পরাধীন দেশকে নিঃস্বার্থে ভালবাসার মন্ত্র ও শক্তি। তাঁদের নিখাদ দেশ-ভক্তির মহত্তর প্রেরণায় জীবনের মূল্য তুচ্ছ জ্ঞান করে হঠাৎ একদিন বিদ্যালয়-ছুট কিশোর নজরুল, ৪৯ বেঙ্গলি রেজিমেন্টে যোগদানের উদ্দেশ্যে উঠে পড়েন করাচিমুখী ট্রেনে। ট্রেন ছেড়ে দেয়। বাইরের দৃশ্যপট মতো একে একে তাঁর জীবন থেকে ক্রমশ দূরে সরে সরে যায় ক্লাসে প্রথম স্থানাধিকারী ছাত্রের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নসম্ভার আর স্নায়ুজুড়ে ঘাই মারে দেশোদ্ধারের কঠিন সাহস ও নিভৃত শপথের অস্থির অনুভূতি।

জ্যোতিপ্রসাদ রায়  - অধ্যাপক, কোচবিহার পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়

0 comments:

0

প্রবন্ধ - অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in

(প্রথম পর্ব) 

প্রশ্ন দিয়েই শুরু হোক এই প্রবন্ধ। প্রশ্নটা হল – বাংলা ভাষা কাকে বলে? বস্তুত বাংলা ভাষা কাকে বলে, তার সংজ্ঞা দেওয়া খুব মুশকিল। বাংলা ভাষা কোনটা? কলকাতার মান্য ভাষা? ঢাকার মান্য ভাষা? নাকি সিলেট বা চট্টগ্রামের বাংলা ভাষা? নাকি মেদিনীপুর বা বর্ধমানের বাংলা ভাষা? সবই যদি বাংলা ভাষা হয়, তবে কেন নোয়াখালির বাংলা ভাষা মেদিনীপুরের বাঙালি বোঝে না? বর্ধমানের বাঙালি কেন ঢাকার ভাষা বোঝে না? 

বোঝেন কি? দেখুন তো – একজন লোকের দুটি ছেলে ছিল (কলকাতা), এক লোক্কার দুটা পো থাইল (মেদিনীপুর), য়্যাকঝোন্ ম্যানশের দুটা ব্যাটা ছিল (মালদাহ), এক লোকের দু বেটা রাহে (রাঁচির সরাকি), এক লোকের দুটা বেটা ছিল (মানভূম), এক লোকের দুটা ছা ছিল (সিংভূমের ধলভূম), অ্যাক জন মানশির দুটো ছাওয়াল ছিল (খুলনা, যশোহর), য়্যাক ঝনের দুই ব্যাটা ছৈল আছিল (বগুড়া), একজন মানশের দুইকনা ব্যাটা আছিন্ (রংপুর), একজন মানশের দুইডা পোলা আছিল (ঢাকা), য্যাক জনের দুই পুৎ আছিল (ময়মনসিংহ), এক মানুশর দুগুয়া পুয়া আছিল (সিলেট), একজন মানুশর দুগুয়া পুয়া আছিল (কাছাড়), মুনি আগোর পুতো দুগো আসিল (মায়াং), এগুয়া মানশের দুয়া পুয়া আছিল (চট্টগ্রাম), একজন তুন দিবা পোয়া এল (চাকমা), একজনের দুই হুত আছিল (নোয়াখালি)। দেখুন একটিই বাক্য, তার কত রূপ। সবগুলিই বাংলা ভাষা হলে একজন আর-একজনের ভাষা শুনে মুখ টিপে হাসে। 

আদি বাংলা ভাষার যে রূপ, সেই ভাষাই-বা কে বোঝে? আদি বাংলা ভাষা বলতে বোঝায় চর্যাপদগুলিকে, যা বৌদ্ধগান ও দোহা বলেও পরিচিত। প্রায় ৪০০ বছর আগের বাংলা হরফে লেখা সেই বাংলা হল – “কেহো কেহো তোহোরে বিরুআ বোলই/বিদুজণলোঅ তোরেঁ কণ্ঠ ন মেলই।” অথবা “শাখি করিব জালন্ধরি-পাএ/পাখি ণ রাহঅ মোরি পাণ্ডিআচাএ।” অথবা “কাহ্নে গাই তু কামচণ্ডালী/ডোম্বিত আগলি ণাহি চ্ছিণালী।” বাংলা ভাষার এই রূপকে বলা হয় বাংলা ভাষার শৈশব অবস্থা। 

তারপর সময়ের স্রোতে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। যুগে যুগে ভাষাবিদরা এসেছেন এবং ভাষা সংস্কার করে রূপ বদল করেছেন।এ বিষয়ে সবচেয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যিনি নিয়েছিলেন, তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তবে সমসাময়িক মদনমোহন তর্কালংকারের ভূমিকাকেও অস্বীকার করা যায় না। বিদ্যাসাগর না জন্মালে মদনমোহন তর্কালংকারই হতেন আধুনিক বাংলা ভাষার পথ-প্রদর্শক। বাংলা ভাষার দুটি রূপ – একটি সাধু, অপরটি চলিত রূপ। সাধু রূপ অভিজাত রূপ, চলিত রূপ সাধারণের। মানুষের মুখের ভাষা যেমন পৃথকভাবে সাধু ভাষার চল ছিল, তেমনি চলিত ভাষার চলও ছিল। চলিত ভাষায় সাধু ভাষার মিশ্রণও ছিল। এখনও আছে, তবে মুখের বা কথ্য ভাষায়। সাধু ভাষা যখন লেখ্য হয়, তখন সাধু-চলিত মিশ্রণ গুরুচণ্ডালী দোষ বলে পরিত্যাজ্য। সাধু ভাষা হিন্দু বাঙালি পণ্ডিতদের ভাষা। তাঁদের বাংলা যে উচ্চবর্গীয় ভাষা, সেটা প্রমাণ করার জন্যই চলতি বা কথ্য বাংলা থেকে তারা পৃথক একটা ধারা গড়ে নিলেন। সেটাই সাধু ভাষা বলে পরে স্বীকৃতি পেল। এখানে শুধু যে ইতরজনকে অগ্রাহ্য করার মানসিকতা ছিল, সেটাই নয়। ঘোরতর সাম্প্রদায়িক মনোভাবও ছিল। বাংলা যাত্রা-থিয়েটার-সিরিয়াল-নাটকে আমরা দেখেছি ইংরেজ চরিত্রগুলি এক বিশেষ ধরনের বাংলা বলেন। যেমন -- ‘হামি ঠোমাকে যাইটে ডিবে না’ অথবা “এই ঘোষণা ডিকে ডিকে ছড়াইয়া দাও।” কোম্পানির সিভিলিয়ানরা এদেশে আসার পর স্থানীয়দের সঙ্গে কথোপনের তাগিদে তাঁদের অবশ্যই বাংলা আর হিন্দুস্তানি শিখতে হত। প্রথমে বারাসাত ক্যাডেট কলেজ আর তারপর ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে। শেখাতেন কারা ? হিন্দু পণ্ডিতরা। বাংলার আম-জনতা যে ভাষায় কথা বলেন, সেখানে বহু ফারসি ও আরবি শব্দ ঢুকে পড়েছিল মুসলিম সংস্কৃতির প্রভাবে। সমগ্র ভারতে মুসলিম শাসনের ফলে অন্যান্য ভারতীয় ভাষার মতো বাংলা ভাষাতেও আরবি ও ফারসি শব্দের প্রবেশ ঘটেছিল। মুসলিম শাসনামলে ফারসি ভাষাই ছিল সরকারি ও কাজের ভাষা। তাই ইংরেজ শাসনামলে ইংরেজি শিক্ষার মতো মুসলিম শাসনামলে ধর্ম-জাতি নির্বিশেষে ফারসি ভাষা শিখতে হত। মুসলিমরা তো বটেই, বহু শিক্ষিত বাঙালিও ফারসি শিখেছিলেন। রামমোহন রায়ের সাহিত্যে ফারসি ভাষার প্রাবল্য দেখা যায়। আবার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভাষা যেন সংস্কৃত ঘেঁষা। প্রচুর তৎসম শব্দের ব্যবহার। এখনকার বাঙালিদের কাছে সেই ভাষা অতি দুর্বোধ্য এবং সমাসবদ্ধ। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যে সংস্কৃত অনেকটা সরিয়ে দিয়ে বাংলা ভাষা অনেকটা প্রাঞ্জল হল, সুমধুর হল। 

রামমোহন রায় – “উত্তর বেদার্থনির্ণয়কর্ত্তা মুনিগণের বাক্যে পরস্পর বিরোধ আছে এ নিমিত্ত যদি বেদ বিচারণীয় না হয়েন তবে পরস্পরবিরুদ্ধ যে ব্যাসাদি ঋষিবাক্য তাহা কি রূপে বিচারণীয় হইতে পারে অতএব এই যুক্তির অনুসারে পুরাণ এবং [৯] ইতিহাস প্রভৃতি যাহা ঋষিবাক্য তাহাও বিচারণীয় না হইয়া সকল ধর্ম্মের লোপাপত্তি হয় দ্বিতীয়ত এ স্থলে জিজ্ঞাস্য এই যে দুর্জ্ঞেয় নিমিত্ত বেদ যদি ব্যবহায্য না হয়েন তবে আপনারা গায়ত্রী সন্ধ্যা দশ সংস্কার প্রভৃতি বেদমন্ত্রে করেন কি পুরাণবচনে করিয়া থাকেন।” (গোস্বামীর সহিত বিচার, ১৮১৮) 

বিদ্যাসাগরের বাংলা – “নবজলধরকলেবর মহাবল পরাক্রান্ত অসুরেরাও গিরিনিক্ষেপ দ্বারা দেবদল দলন করিতে আরম্ভ করিল। তখন আকাশমণ্ডল হইতে অতি প্রকাণ্ড ভয়ানক ভূধর সকল পরস্পরাভিঘাতপূর্বক বহুবিধ জলধরের ন্যায় সমস্ততঃ পতিত হইতে লাগিল। এইরূপ অবিরত অদ্রিপাতে অভিহতা হইয়া সদ্বীপা সকাননা পৃথিবী বিচলিতা হইল।” (মহাভারতের উপক্রমিকা, ১৮৬০) 

বঙ্কিমচন্দ্রের বাংলা – “পরাণ দেখিল সর্ব্বস্ব গেল। মহাজনের ঋণও পরিশোধ করিতে পারিব না, জমীদারের খাজানাও দিতে পারিব না, পেটেও খাইতে পারিব না। এত দিন পরাণ সহিয়াছিল – কুমীরের সঙ্গে বাদ করিয়া জলে বাস করা চলে না। পরাণ মণ্ডল শুনিল যে, ইহার জন্য নালিশ চলে। পরাণ নালিশ করিয়া দেখিবে।” (সাম্য, ১৮৭৯) 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – “অন্নপূর্ণাকে বিহারী দেবীর মতো ভক্তি করিত। অবশেষে অন্নপূর্ণা বিহারীকে নিজে ডাকিয়া কহিলেন, “সে কি হয় বাছা। না দেখিয়া বিবাহ করিবে, সে কিছুতেই হইবে না। যদি পছন্দ না হয় তবে বিবাহে সম্মতি দিতে পারিবে না, এই আমার শপথ রহিল।” নির্ধারিত দিনে মহেন্দ্র কলেজ হইতে ফিরিয়া আসিয়া মাকে কহিল, “আমার সেই রেশমের জামা এবং ঢাকাই ধুতিটা বাহির করিয়া দাও।” মা কহিলেন, “কেন, কোথায় যাবি ?” (চোখের বালি, ১৯০৩) 

এখানে চারজন বিখ্যাত লেখকের সাধু ভাষায় লিখিত বিভিন্ন সময়ের বাংলা ভাষার নমুনা তুলে ধরলাম। লক্ষ করলেই বুঝতে পারবেন কতটা পরিবর্তন হচ্ছে বাংলা ভাষায়। রামমোহনের উদ্ধৃতাংশটি ভালোভাবে লক্ষ করুন। দীর্ঘ বাক্যের উদ্ধৃতি এবং কোনো ছেদচিহ্নের ব্যবহার নেই বাক্যশেষে একটি দাড়িচিহ্ন ছাড়া। ভাষারও অনেক তফাৎ লক্ষ্যণীয় আছে। সময় যত এগিয়েছে ততই বাংলা ভাষা সহজ থেকে সহজতর হয়েছে, আড়ষ্টতা মুক্ত হয়ে বাংলা ভাষা ক্রমশ মিষ্টি হয়ে ওঠেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে বাংলা ভাষা অনন্য সাধারণ রূপ পায়। বাংলা ভাষা বিবিধ ভাব-কল্পনার আদর্শ বাহন হয়ে ওঠে। তাঁর ভাষা হয় সংগীতময় ও সংকেতময়। তবে সমসাময়িক সাহিত্যিক বা বাংলা ভাষার সাধকরা কেউ কেউ তাঁকে অনুসরণ করলেও বেশিরভাগই তাঁর সুচারু ধারা অনুসরণ করেছেন, তা বলা যায় না। তখনো মান্য বাংলা ভাষা গড়ে ওঠেনি। যে যে-ধারা পারছে সে সেই ধারায় লিখছে। ডি এল রায় বা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বাংলা ভাষার কথাই ধরি না কেন। ১৯০৯ সালে তিনি লিখলেন ‘সাজাহান’ নাটকটি। দ্বিজেন্দ্রলাল লিখলেন চলিত ভাষায়। 

চলিত ভাষার প্রচলন অবশ্য টেকচাঁদ ঠাকুরের লেখনী ধরে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ নানা কারণে উল্লেখযোগ্য। এই বছরটাকে বলা যায় যুগসন্ধি।এই সময়ে নানা দিক দিয়ে যুগের পরিবর্তন শুরু হয়ে যায়। তাঁর মধ্যে টেকচাঁদ ঠাকুরের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থটি ভাষার প্রকাশে রীতির পরিবর্তনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ব্যাপক উন্নতির সূচনা হয়। আলালের ঘরের দুলালের মধ্য দিয়ে শুরু হল চলিত ভাষার দুরন্ত যাত্রা। আলালের ঘরের দুলালকে চলিত ভাষার মাইলস্টোন বলা যায়। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থটি পরিবর্তন যুগের স্মরণ চিহ্ন স্বরূপ আজও আক্ষয় মহিমায় বিরাজ করছে। এই ভাষা-রীতিকে সেই যুগসন্ধিক্ষণের স্মারক গ্রন্থ এবং নতুন ধারার জয়স্তম্ভ বললেও অন্যায় হয় না। ‘মাসিক পত্রিকা’ বাংলা সাহিত্যজগতে যাঁরা বিপর্যয় ঘটিয়েছিল, তার মধ্যে প্যারীচাঁদ অন্যতম। প্যারীচাঁদ ছাড়াও আর-একজন ভাষা-বিপ্লবী হলেন রাধানাথ। এছাড়া কিশোর কালীপ্রসন্নের হাত ধরে সেটাই প্রবল আকার ধারণ করে প্রাচীনপন্থীদের চিত্তবিক্ষোভের কারণ হয়েছিল। সমসাময়িক ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকায় সেই বিক্ষোভের পরিচয় পাওয়া যায়। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে রামগতি ন্যায়রত্ন তাঁর ‘বাঙ্গালা ভাষা ও বাঙ্গালা সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’ গ্রন্থে আলালি ভাষা ও রুচির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। চলিত ভাষাকেই আলালী ভাষা বলা হত। চলিত ভাষাকে ‘আলালি ভাষা’ হিসাবে এটাই সর্বপ্রথম প্রয়োগ। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে রাজনারায়ণ বসু তাঁর ‘বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা’ গ্রন্থে আলালি ভাষার সার্থকতা স্বীকার করেন। নতুন ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রক্ষিতে আচার্য কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন – “বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সংস্কৃত-বহুল রচনার বিরুদ্ধে একটা revolt হইয়াছিল। বোধ হয়, ১৮৫৪-৫৫ খ্রিস্টাব্দে রাধানাথ সিকদার ‘মাসিক পত্রিকা’ নামে একখানি কাগজ বাহির করেন, তাহাতে অনেক চলিত ভাষা ব্যবহৃত হইত। একটা প্রবন্ধের মধ্যে ‘Xenophon থেকে ভাঙ্গা’ এই শব্দযোজনা ছিল। তিনি তাঁহার ‘আলালের ঘরের দুলাল’-এ সেই tendency-র চূড়ান্ত করিয়া যান।” শুধু রাধানাথ শিকদারই নয়, শিবনাথ শাস্ত্রীও এ বিষয়ে মতামত দিয়েছেন। তিনি তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে লিখলেন – “একদিকে পণ্ডিতপ্রবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অপরদিকে খ্যাতনামা অক্ষয়কুমার দত্ত – এই উভয় যুগপ্রবর্ত্তক মহাপুরুষের প্রভাবে বঙ্গভাষা যখন নবজীবন লাভ করিল, তখন তাহা সংস্কৃত-বহুল হইয়া দাঁড়াইল। … অনেকে এরূপ ভাষাতে প্রীতিলাভ করিলেন বটে, কিন্তু অধিকাংশ লোকের নিকট, বিশেষতঃ সংস্কৃতানভিজ্ঞ শিক্ষিত ব্যক্তিদের নিকট ইহা অস্বাভাবিক, কঠিন ও দুর্ব্বোধ্য বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। … যখন বিদ্যাসাগর মহাশয় ও অক্ষয়বাবুর সংস্কৃত-বহুল বাঙ্গালার ভার দুর্ব্বহ হইতে লাগিলে, তখন ১৮৫৭, কি ৫৮ (১৮৫৪) সালে, ‘মাসিক পত্রিকা’ নামে এক ক্ষুদ্রকায়া পত্রিকা দেখা দিল। …টেকচাঁদ ঠাকুরের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বাঙ্গালার প্রথম উপন্যাস। …আলালের ঘরের দুলাল বঙ্গসাহিত্যে এক নবযুগ আনয়ন করিল। এই পুস্তকের ভাষার নাম ‘আলালী ভাষা’ হইল।তখন আমরা কোনও লোকের ভাষাকে গাম্ভীর্য্যে হীন দেখিলেই তাহাকে আলালী ভাষা বলিতাম। এই আলালী ভাষার উৎকৃষ্ট নমুনা ‘হুতুমের নক্সা’। … এই আলালী ভাষার ভাষার সৃষ্টি হইতে বঙ্গ-সাহিত্যে গতি ফিরিয়া গেল। ভাষা সম্পূর্ণ আলালী রহিল না বটে, কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্রী রহিল না, বঙ্কিমী হইয়া দাঁড়াইল।” রাজা রামমোহন রায় সে সময়ের প্রথম গদ্য লেখক। তার পর যে গদ্যের সৃষ্টি হল, তা লৌকিক বাংলা ভাষা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপের। বাংলা ভাষা দুটি স্বতন্ত্র ভাষায় পরিণত হয়েছিল। একটির নাম সাধুভাষা, অর্থাৎ সাধুজনের ব্যবহার্য ভাষা। আর অন্যটি অপর ভাষা, অর্থাৎ সাধু-ভিন্ন অপর ব্যক্তিদের ভাষা। এখানে ‘সাধু’ অর্থে ‘পণ্ডিত’ বুঝতে হবে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘বাঙ্গালা সাহিত্যে প্যারীচাঁদ মিত্রের স্থান” প্রবন্ধে লিখছেন -- “আমি নিজে বাল্যকালে ভট্টাচার্য্য অধ্যাপকদিককে যে ভাষায় কথোপকথন করিতে শুনিয়াছি, তাহা সংস্কৃতব্যবসায়ী ভিন্ন অন্য কেহই ভালো বুঝিতে পারিতেন না। তাঁহারা কদাচ ‘খয়ের’ বলিতেন না, -- ‘খদির’ বলিতেন; কদাচ ‘চিনি’ বলিতেন না -- ‘শর্করা’ বলিতেন। ‘ঘি’ বলিলে তাঁহাদের রসনা অশুদ্ধ হইত, ‘আজ্য’-ই বলিতেন, কদাচিৎ ‘ঘৃত’-এ নামিতেন। ‘চুল’ বলা যাইবে না, -- ‘কেশ’ বলিতে হইবে। ‘কলা’ বলা হইবে না, -- ‘রম্ভা’ বলিতে হইবে। ফলাহারে বসিয়া ‘দই’ চাহিবার সময় ‘দধি’ বলিয়া চীৎকার করিতে হইবে। আমি দেখিয়াছি, একজন অধ্যাপক একদিন ‘শিশুমার’ ভিন্ন ‘শুশুক’ শব্দ মুখে আনিবেন না, শ্রোতারা কেহ শিশুমার অর্থ জানে না, সুতরাং অধ্যাপক মহাশয় কি বলিতেছেন, তাহার অর্থবোধ লইয়া অতিশয় গণ্ডগোল পড়িয়া গিয়াছিল। পণ্ডিতগণের কথোপকথনের ভাষাই যেখানে এইরূপ ছিল, তবে তাঁহাদের লিখিত বাঙ্গালা ভাষা আরও কি ভয়ঙ্কর ছিল, তাহা বলা বাহুল্য। এরূপ ভাষায় কোনও গ্রন্থ প্রণীত হইলে, তাহা তখনই বিলুপ্ত হইত; কেন না, কেহ তাহা পড়িত না।” 

সংস্কৃত পণ্ডিত হওয়া সত্ত্বে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিজে খুব একটা সংস্কৃত লিখতে চাইতেন না। কিন্তু সংস্কৃত ভাষার প্রয়োজনীয় প্রজ্ঞাকে বাংলা ভাষার মাধ্যমে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন বটে। কেনই-বা তিনি সংস্কৃতের প্রয়োজনীয় বিষয়কে বাংলা ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন, তার উত্তর পাওয়া যায় প্রাচীন ভারত ও সংস্কৃত ভাষা সম্বন্ধে বিদ্যাসাগরের যুক্তিবাদী কাণ্ডজ্ঞানের মধ্যে। বিদ্যাসাগর এই সংস্কৃত বিষয়ক হিঁদুয়ানিকে মোটেই স্বীকার করেন না। এমনকি সংস্কৃতকে অজর-অমর-আদি-অকৃত্রিম ভারতীয় ভাষা বলেও মনে করেন না। তিনি মনে করতেন সংস্কৃত ভাষাও বহিরাগত। বিদ্যাসাগর সংস্কৃত ভাষার প্রকাশক্ষমতা সম্বন্ধে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন একথা অবশ্য সত্য। সেই ভাষার সাহিত্যও তাঁর মনোহরণ করেছিল। পাশাপাশি সংস্কৃতকে অপরিবর্তনশীল হিন্দু-ভারতের সম্পদ হিসেবেও তিনি বাঙালিদের ঘাড়ের উপর মোটেই চাপিয়ে দিতে চাননি। শ্রদ্ধা আলাদা বিষয়, আর সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামি আর-এক বিষয়। বিদ্যাসাগর বরাবরই সেটাকে পৃথকভাবেই দেখতেন। 

অপরদিকে জয়গোপাল তর্কালঙ্কার ১৮৩৮ সালে ‘পারসিক অভিধান’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। জয়গোপাল তর্কালঙ্কার, যিনি যে সংস্কৃত কলেজের ছাত্র ছিলেন, বিদ্যাসাগর সেই সংস্কৃত কলেজেরই পণ্ডিত ছিলেন। জয়গোপাল তর্কালঙ্কার কেন এই বিশেষ অভিধানটি লেখার প্রয়োজন বোধ করলেন ? বস্তুত এই অভিধানটির উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডার থেকে আরবি-ফারসি শব্দগুলিকে বর্জন করে ফেলা। বাংলা শব্দ ভাণ্ডারে যে যে শব্দগুলি (যেমন – দোকান, পর্দা ইত্যাদি) সমৃদ্ধ হয়ে আছে, সেগুলি যে ‘অসংস্কৃত’ উৎস থেকে এসেছে জয়গোপাল তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন যবনদের হাতফেরতা হয়ে আসা এই শব্দগুলিকে বাংলার ভাণ্ডার থেকে বাতিল করা উচিত। কারণ যবনরা বহিরাগত। তার বদলে চালু করা হোক পরিশুদ্ধ সংস্কৃত উৎস-জাত শব্দ। রক্ষণশীল জয়গোপাল মনে করতেন দোকানের বদলে ‘বিপণী’ লিখলেই হিন্দু তাঁর অতীতকে ফিরে পাবে, হিন্দুত্বকে পুনর্নির্মাণ করা যাবে। বিদ্যাসাগর তাঁর পাণ্ডিত্য ও যুক্তিবোধ দিয়ে জয়গোপালের এই অতীতচারী হিন্দু-মনোভাবের বিরোধিতা করেছিলেন। জয়গোপাল আরবি-ফারসিকে বহিরাগত ভাষা হিসাবে দেখেন এবং সংস্কৃতকে প্রাচীন হিন্দু-ভারতের ভাষা হিসেবে অটল ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চান। কিন্তু সেই পথে হাঁটেননি। সংস্কৃত ভাষা সম্বন্ধে বিদ্যাসাগরের ধারণা তাঁর ‘সংস্কৃতভাষা ও সংস্কৃতসাহিত্যশাস্ত্রবিষয়ক প্রস্তাব’ নিবন্ধে স্পষ্ট করেছেন। তাঁর বক্তব্য – “সংস্কৃত ভারতবর্ষের আদিম নিবাসী লোকদিগের ভাষা নহে; সংস্কৃতভাষী লোকেরা, পৃথিবীর অন্য কোন প্রদেশ হইতে আসিয়া, ভারতবর্ষে আবাস গ্রহণ করিয়াছেন।” এই প্রসঙ্গে পণ্ডিত কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের বক্তব্যও স্মতর্ব্য। তিনি বলেছেন – “এক হিন্দিভাষী পণ্ডিত এক বার তাঁর কাছে এসে সংস্কৃত ভাষায় কথা-বার্তা বলছিলেন। বিদ্যাসাগর তাঁর কথার জবাব সংস্কৃতে না-দিয়ে হিন্দিতে দিচ্ছিলেন। তিনি জানতেন যে নব্য ভারতীয় ভাষাগুলি ক্রমে বিকাশ লাভ করছে, সেই ভাষাগুলিকে মর্যাদা দিতে হবে। সংস্কৃত আদি ভাষা বলে মাননীয় ও অপরিবর্তনীয় ভাবে অনুসরণযোগ্য, এই একভাষাসূত্র অর্থহীন। 

ফলে শুরু হল বাংলা ভাষার ভাঙাগড়া। মোট কথা সে সময়ে বাংলা ভাষা সংস্কৃতের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে মানুষের মুখের ভাষাই লেখ্য ভাষা হয়ে উঠতে থাকল। বাংলা ভাষা আর পাণ্ডিত্যের সাধু ভাষা (লেখ্য ভাষা) হয়ে থাকতে চাইল না। মানুষ যে ভাষারীতিতে কথা বলে বাংলা সাহিত্যের ভাষারীতিও সেই পথেই ক্রমশই সাবলীল হতে থাকল। সেই ট্র্যাডিশন আজও অব্যাহত, পরমাদরে। 

যে আলালের ঘরের দুলালের ভাষারীতি নিয়ে এতগুলো কথা বলা হল, সেই ভাষারীতি সামান্য চাক্ষুষ করব না ! আলালের ঘরের দুলাল গ্রন্থে চলিত ভাষার আদি রূপ – “মুনসি সাহেবের দুর্গতির কথা শুনিয়া বাবুরাম বাবু বলিলেন – মতিলাল তো আমার তেমন ছেলে নয় – সে বেটা জেতে নেড়ে – কত ভাল হবে ? পরে ভাবিলেন যে ফার্সির চলন উঠিয়া যাইতেছে, এখন ইংরাজী পড়ান ভালো। যেমন ক্ষিপ্তের কখন কখন জ্ঞানোদয় হয় তেমনি অবিজ্ঞ লোকেরও কখন কখন বিজ্ঞতা উপস্থিত হয়। বাবুরাম ঐ বিষয় স্থির করিয়া বিবেচনা করিতে লাগিলেন আমি বারাণসী বাবুর ন্যায় ইংরাজী জানি – “সরকার কম স্পিক নাট” আমার নিকটস্থ লোকেরাও তদ্রূপ বিদ্বান্, অতএব একজন বিজ্ঞ ব্যক্তির নিকট পরামর্শ লওয়া কর্ত্তব্য।” 

এই হল আদি চলিত ভাষার আঁতুরঘর। চলিত ভাষার প্রচলন বটে, কিন্তু সাধু-বর্জিত হল না মোটেই। সাধু ভাষার খোলস ছেড়ে সাধু-চলতি মিশ্রিত এক বিজাতীয় ভাষার উদ্ভব হল, যা গুরুচণ্ডালি দোষ বলে চিহ্নিত হল। গুরুচণ্ডালি দোষে দুষ্ট হয়ে কয়েক যুগ কেটেও গেল। আজও বহু বাঙালি সাধু-চলিত মিশ্রিত ভাষায় লেখালেখি করে থাকেন। তবে গুরুচণ্ডালী দোষযুক্ত বাংলা পরীক্ষার হলে লিখলে নম্বর কাটা গেলেও তার বাইরে গুরুচণ্ডালী দোষে দুষ্ট বাংলাভাষাকে সাধারণ মানুষ তেমন ধষ্টব্যের রাখেন না। 

বাংলা ভাষার বিবর্তন অবশ্যই জারি থাকল সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে। সাধারণ মানুষ গুরুচণ্ডালী দোষে দুষ্ট বাংলা ভাষা লিখলেও ক্রমশ বাংলা সাধু-বর্জিত হয়ে প্রকৃত চলিত ভাষায় রূপান্তরিত হল বাংলা সাহিত্যে। প্রকৃত চলিত ভাষার একটি নমুনা – “কী ভুলো মন দেখুন আমার। নিজের কথাই বকে মরছি। কিন্তু আমার কথা তো জানতে চান নি আপনারা। চেয়েছেন তাঁর কথা জানতে। সুতরাং আমার কথা থাক। আমি শুধু প্রসঙ্গক্রমে বলতে চাইছিলাম যে আমি ভারতীয় সেনা কিনা সে বিষয়ে সে বিষয়েই যথেষ্ট সন্দেহ ছিল আমার। জীবনের বিশটা বছর সে কথা আমার খেয়াল ছিল না। জানলাম প্রথম – যেদিন তামিলনাদের এই নায়ার পরিবারটিকে জাহাজে ঠাঁই দেওয়া হল না, আমরা ভারতীয় বলে।”(আমি নেতাজিকে দেখেছি, নারায়ণ স্যানাল) 

আজকের পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের যে বাংলা ভাষা, তা একান্তই হিন্দু বাঙালিদের ভাষা। সংস্কৃত-মুক্ত বাংলা ভাষা। পাশাপাশি আর-একটি বাংলা ভাষারীতি বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত আছে। সেই ভাষাতে আরবি-ফারসির শব্দ-আধিক্য লক্ষ করা যায়। হিন্দু বাঙালিরা সংস্কৃত মুক্ত বাংলা ভাষায় লেখ্য ভাষা ও কথ্য ভাষায় সংস্কৃত-মুক্ত চলিত ভাষা ব্যবহার করলেও, মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষরা আরবি-ফারসি মুক্ত হতে পারেনি। বরং বেশি বেশি করে আঁকড়ে ধরেছে। হিন্দু বাঙালির বাংলা ভাষা আর মুসলিম বাঙালির বাংলায় পৃথকীকরণ সম্পন্ন হয়েছে। সেই কারণেই বোধহয় হিন্দু বাঙালিদের মুখে শোনা যায় --- “আমরা বাঙালি, ওরা মুসলমান”। অর্থাৎ মুসলিমরা বাঙালি নন। কেন বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়ের বাংলা ভাষা আর বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের বাংলা ভাষা পৃথক হল ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আরও অনেক পিছনের দিকে হাঁটতে হবে। (চলবে)

0 comments:

2

বইঘর - পল্লববরন পাল

Posted in

“ঘুমোই চশমা চোখে” – এক নির্জন আমি আবিষ্কার
পল্লববরন পাল

প্রাণ কি বুদ্বুদ তবে, তেপান্তর থেকে একা ভূমি ও হাওয়ায় 
গড়িয়ে এসেছে আজ এত দূর? নাকি সাত সমুদ্রের জলে
আর তেরো নদীকূলে ভেসে উড়ে হেঁটে দৌড়ে সূর্যাস্ত পেরিয়ে 
রমণীয় দিবালোকে রামধনুর রঙে জ্বলে আশ্চর্য ঝিলিকে?... ... [ভাসা]


বইয়ের প্রথম কবিতার প্রথম চারটি পংক্তি। বিখ্যাত ইংরেজি প্রবাদটা মনে পড়ছে, কিন্তু এ বই পড়ার পরে উচ্চারণ করতে ইচ্ছে করছে না – তাই বাংলা করে বলি - ভোরই জানে সারাদিনের ঠিকানা। ওপরের কবিতার নাম ‘ভাসা’। হ্যাঁ, তেপান্তর তো বটেই। সুদূর চট্টগ্রাম থেকে ভূমি ও হাওয়ায় ভেসে উড়ে নাকি জলরাস্তায় হেঁটে দৌড়ে প্রাণ পৌঁছে গেছে আমার শহর কলকাতার মহাপ্রাণে। নিমগ্ন পাঠক ইতিমধ্যেই রামধনুর অতিকায় দিগন্তদৈর্ঘ্যে এবং সরল বক্রতায় ঋদ্ধ হয়ে উপাসনা ঢঙে পা মুড়ে বসেছেন কবি খালেদ হামিদীর মুখোমুখি। কবির মুখোমুখি? – নাকি তাঁর সৃষ্টির? বইয়ের নাম ‘ঘুমোই চশমা চোখে’। চার ফর্মা। ক্রাউন মাপ। প্রকাশক ঋতবাক। প্রথম প্রকাশ ২০১৯ জানুয়ারি। তৃতীয় পংক্তির শেষে সূর্যাস্ত পেরিয়ে যে গোধূলিকাল – লক্ষ্য করুন পাঠক – কবি হামিদী তাকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলছেন ‘রমণীয় দিবালোক’ – বইয়ের চতুর্থ পংক্তিতেই কলমের প্রবল স্বাস্থ্যে পাঠক আশ্বস্ত ও মগ্নতর অবগাহন প্রত্যাশী। 

গত শতাব্দীতে কৃত্তিবাস যুগ থেকেই আস্তে আস্তে বাঙলা কবিতায় ভৌত ও রাসায়নিক বদলের সন্তর্পন শুরু। কবিতা আদতে কবির নিভৃত আত্মরতির ফসল। তাই সময়ের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের সুবাদে এবং স্বাভাবিক রতিধর্ম অনুযায়ী সেও বড়ো আপাত অস্থির ও বিশৃঙ্খল। সাধারণ সাহিত্য পাঠকের অভিযোগ – এই অস্থিরতার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো ধৈর্যশীল সময় আজকের জীবনী আর নেই। তাই কবিতা ক্রমশ পাঠকের কাছে দুর্বোধ্য। আমাদের যাপনের মধ্যেও তো অসংখ্য দুর্বোধ্যতা – আর, কবিতা তো যাপনেরই একটা বিশেষ ভঙ্গিতে অনুবাদ। প্রথম বাঙলা কবিতা বলে স্বীকৃত চর্যাপদের ভাষাকে বলা হতো সন্ধ্যাভাষা – অর্থাৎ গোধূলির ছায়াময় আলোআঁধারি বা কবি হামিদীর ভাষায় ঐ ‘রমণীয় দিবালোক’ বাঙলা কাব্যের জন্মাবধি বৈশিষ্ট্য। এই দুর্বোধ্যতার অভিযোগের প্রতিবাদে কিম্বা অভিমানে শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘ধর্মেও আছো জিরাফেও আছো’ বইটি উৎসর্গ করেছিলেন ‘আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্য পাঠক’কে। 

সিনেমা বা শিল্পকলার মতো কবিতারও নিজস্ব ভাষা আছে – নিজস্ব প্রকাশভঙ্গী আছে – নির্মাণশৈলী আছে। গত শতাব্দীর মধ্যভাগে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের উত্তরাধিকার সূত্রে আশির দশক বাঙলা কবিতায় সঙ্কেত ও প্রতীকের ব্যবহারে আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে। প্রবন্ধের মতো কবিতার শেষে পাদটীকা লাগানোর নিয়ম নেই। লাগানো যায়ও না। সেগুলি খুঁজে নেওয়া মগ্ন পাঠকেরই দায়িত্ব। বিষ্ণু দে’র কবিতার ইতিহাস ও সমাজচেতনার নাগাল পেতে হলে পাঠককে শিক্ষিত হতে হবে। সুধীন্দ্র নাথের ভাষায় ‘যে দুরূহতার জন্ম পাঠকের আলস্যে, তার জন্য কবিকে দোষারোপ অন্যায়’ – তাই তাঁর ‘নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনার’ কাছাকাছি পৌঁছোতে পাঠককে তৎসম শব্দ ভেদী মানসিক পরিশ্রম করতেই হবে। বোধগম্যতার নিরিখে এগুলিকে কবির দুর্বোধ্যতা বলা ঠিক নয় বরং বলা উচিত আধুনিক পাঠকের মেধা ও মননের কাছে কবির মাননীয় ও মর্মান্তিক দাবি। 

ও বি হামিংবার্ড,
তুমি কি হাভানা থেকে আসো খুব উড়ে,
নিজের চারদিকে নাকি আমি মরি ঘুরে!
পরিযায়ী পাখি নও ভুলেও কখনো;
তথাপি উড়াল তোর ক্রমাগত ঘন।... ... [ও বি হামিংবার্ড]

এখানে ‘তথাপি’ শব্দটা উচ্চারণে একটা আলাদা সমীহ নিজের অজান্তেই পাঠক ঘোষণা করে ফেলে। এই ধরণের না-চলতি সাধু তৎসম শব্দ প্রয়োগ কবি খালেদ হামিদী এই কাব্যগ্রন্থে একাধিকবার করেছেন – অর্থাৎ সচেতনভাবেই এই সদ্যপ্রাচীন শব্দসমূহ প্রয়োগে বিষ্ণু দে’র উত্তরাধিকারী এই কবি তাঁর কবিতার সময়কালকেও চুইংগামের মতো বিস্তৃত করেছেন। তাই নিউটন থেকে নেইমার – আপেল থেকে উরুসন্ধি – কবি হামিদী পাশাপাশি সকাল আটটার রোদ্দুরের মতো ভীষণ রকম সাম্প্রতিক ও উষ্ণ। 

...শার্ট খুলে ভালোবাসা দেখাতেই চাই তবু কার প্রহরায়?
বৃষ্টিহীন বহু দূরে দ্বাদশী চাঁদের নিচে ছাতার আড়ালে,
ম্লান বস্ত্রে হেঁটে যান কে? রবীন্দ্রনাথ? বঙ্গবন্ধু? দূরতর
নমঃশূদ্র বংশপিতা নাকি, নতশির, যিনি দেখেননি তাঁদের! ...[ভালোবাসা দেখাতেই চাই] 

এ বইয়ের পাতায় পাতায় অনেক দুর্গম চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন কবি হামিদী – যার মধ্যে অনেক অর্থস্তর আছে – সঙ্কেত আছে – আমাদের আটপৌরে রোজকার যাপন-টুকরো দিয়ে গাঁথা – যেখানে পাঠকের নিবিড় মগ্নতায় বাধ্য হয়ে দ্রবীভূত হয় এক তীব্র বিহ্বল আগ্রাসন - 

জল না ফুরালেও অগ্নি নিভুনিভু।
এ কোন্‌ রসায়ন শোনাও তবে আজ?
জানার পুরোভাগে নাভিতে হাত কার
পাখির সংবাদে যে পোড়ে বিদ্যুতে? ...
তাহলে ডর কিসে, তোমারও কোথা জয়?
পানি কি আগ নয়, গীতেই বরাভয়? ... [জল না ফুরালেও] 

অথবা আরো দুর্গম জটিল চিত্রকল্পের গহন অরণ্যে অবধারিত পাঠককে অমোঘ চুম্বকে টেনে নিয়ে যান দুর্নিবার আকর্ষণে –

...তোমারই পরম গর্ভে আমার পুরোনো জন্ম, নবজন্ম
কি পুনর্জন্মের মাঝে আর মধ্যে কতো 
বহিরাগতের ভাসমান প্রাণিত সাঁতার!
এসবেরও ঢের পরে নখ ভেঙে যায় প্রেক্ষাপটে;
কাটা পড়ে স্বপ্নাদিষ্ট অমর আঙুলও। ... [প্রেক্ষাপট] 

পাশাপাশি কী নিটোল অনায়াস স্পষ্টতায় কবি হামিদী গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সেই হামিংবার্ড নারীর প্রেরিত প্রেমপত্র বুকে নিয়ে সঠিক নাম খোঁজেন আর পতঙ্গসম পাখির উড়ানে হাজারো ফুল, প্রতিদিন, ছন্দে-লয়ে, বর্ণের বাগান অতিক্রমনের স্বপ্ন দেখেন। সহজ এবং প্রাচীন মাত্রাবৃত্তে লেখেন – ...পক্ষীকুল পোশাকহীন, তথাপি না-নগ্ন

তাই দাও পালকগুচ্ছ, হই মিলনমগ্ন। ... [নারিকেল তলে] 

আবার ‘তথাপি’ – দেখেছেন পাঠক? এরকম আরো অজস্র উদাহরণ আছে – এই কবিতার নামটাই তো ‘নারিকেল তলে’ – জীবনানন্দকে মনে পড়ে না? আবার অন্যত্র যেন ঢোল বাজাতে বাজাতে বা নাচতে নাচতে অতি পরিচিত ছড়ার ছন্দে লিখছেন – 

তাজ মহলের গায়
ছিদ্র দেখা যায়।
কাহার আঁধার, কাহার আলোক, লজ্জা কে লুকায়! ... [তাজ মহলের গায়]

এখানে ‘ছিদ্র’ ও ‘কাহার’! ‘আমি কোন্‌ কেতনতলে চুমু আঁকলে / আমার, তোমার সঙ্গে শুরু হয় অবিরল জীবন বদল?’ [আমার চুম্বন মাত্র]। ‘তুমি কোথা! আমি পানি, গড়াই কর্দমে’ [পুলিশি ট্রাকের নিচে]। ততসম শব্দ নিয়ে বাঙলা সাহিত্যে এ ধরণের কাজ সম্ভবত শেষ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। এই সাধু-অসাধু শব্দের মিশেলে আজকের বাংলা সাহিত্যে বিরল এক সম্পূর্ণ নিজস্ব কাব্যশৈলী তৈরি করেছেন কবি হামিদী। 

“Man is least himself when he talks in his own person. Give him a mask, and he will tell you the truth.” (Oscar Wilde) দাড়িপাল্লা হাতে কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে সত্য প্রকাশের রীতি বিচারালয়ে। কবিরও দায় সত্য কথনের। একমাত্র মুখোসের আড়াল থেকে লেখা হয় বলেই শেষ অবধি কবি ও পাঠক উভয়ের কাছেই কবিতা সৎ ও সার্বজনীন।

...আমি কাজী নজরুল অনুধাবনে বিফল বলে
প্রাচীন কবর থেকে উঠে
শীর্ণ গোরস্তানের সীমান্তে একাকী দাঁড়িয়ে
ডুকরে কাঁদছেন আমার বংশপিতা। ... [আমি কাজী নজরুল অনুধাবনে ব্যর্থ]

এই কবিতাটির মধ্যে আরো কিছু কিছু অভিনব আলোর ইঙ্গিত আছে, যা পাঠক হিসেবে আমাকে ঋদ্ধ করেছে – 
...জগদ্ব্যাপী এমন মহত্ত্ব
না ঘটলে আমারই চক্ষু এতো কালো কিংবা
রক্ত এভাবে মন্দ্রিত হতো কিনা মালুম হবার
খানিক আগেই আছড়ে-পড়া ঢেউয়ের কিনারে
আমিই সটান, মৃত। তবুও পর্যাপ্ত খোলা আমারই দু’চোখ জুড়ে
মা তাঁর নামাজ শেষে দৈনন্দিন বাজারমুখো ঋণগ্রস্ত পিতার
হাতে নির্দ্বিধায় গুঁজে দেন সংরক্ষিত কাবিনের অংশ
স্বর্ণালংকারের
কয়েকটি টুকরো। 

প্রথম কথা, যা আগেই বলেছি, কবি হামিদীর তৎসম-ঝোঁক ও সাধু-অসাধু শব্দ নিয়ে বিপজ্জনক খেলা এবং প্রত্যেকবারেই সগৌরবে জিতে যাওয়ার নেশা – ‘চক্ষু’র পাশে ‘চোখ’ অথবা ‘পিতা’র পাশাপাশি ‘মা’ – এ তো আছেই। তৎসহ এ কবিতায় কবির পংক্তিবিভাজনও চলতি বিন্যাস পদ্ধতির থেকে একদম অন্যরকম ও দুর্দান্ত সাহসী। লক্ষ্য করুন পাঠক, অন্য যে কোনো কবি এই একই শব্দশৃঙ্খলে লিখতেন এইরকম বিন্যাসে – জগদ্ব্যাপী এমন মহত্ত্ব না ঘটলে / আমারই চক্ষু এতো কালো কিংবা / রক্ত এভাবে মন্দ্রিত হতো কিনা / মালুম হবার খানিক আগেই / আছড়ে পড়া ঢেউয়ের কিনারে / আমিই সটান মৃত। ... কিন্তু হামিদীর কবিতার চরিত্রও কবি হামিদীর মতো স্বতন্ত্র। উনি প্রথম পংক্তি ভাঙলেন মহত্ত্ব শব্দের পরে – কেন? জগদ্ব্যাপী মহত্ত্বের বিপুল পরিসর বোঝাতে কি ঐ শূন্য স্পেস দিলেন মহত্ত্ব শব্দের পরে? আবার তৃতীয় পংক্তিতে’উপলব্ধি-টব্ধি’ নয় – একেবারে সাদামাটা যেন চা-দোকানের লঘু আড্ডা থেকে তুলে আনা ‘মালুম’ শব্দটা এই চক্ষু বা পিতার তৎসম ভীড়ে কী অনায়াসে স্বচ্ছন্দ! এবং রক্তের মন্দ্রতাকে মালুম করা তো আর চাট্টিখানি ব্যাপার নয় – তাই ‘মালুম হবার’-এর পরে শূন্য স্পেস। তেমনি ‘ঋণগ্রস্ত পিতা’র অসহায়তার প্রতিধ্বনি চাইলেন ষষ্ঠ পংক্তির শেষের শূন্য স্পেসে। স্বর্ণালংকারের – একটা আপাত দীর্ঘ শব্দ – একটা আস্ত পংক্তি। ‘কয়েকটি টুকরো’ যেন পৃথক পরিচ্ছেদ – পৃথক নির্মাণ। সর্বোপরি, মৃত্যুও কিন্তু এই কবিতায় কবির কাছে ততোটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যে সে একটা পংক্তিচ্ছেদ দাবি করতে পারে! এই রকমই পংক্তিবিন্যাসের আর একটা উদাহরণ দিই –

বর্ণিল মোড়কে ঢেকে তদুপরে সরু
ফিতের ফুটিয়ে ফুল লাল, বলিনি তো
এরকম শরমসজ্জা বিলকুল তোমার
পক্ষে অসম্ভব ব’লে আমিই পুরুষ।... ... [পুলিশি ট্রাকের নিচে] 

শুধু তৎসম শব্দই নয়, কবি হামিদী বিশ্বায়ন পরবর্তী সময়ের কবি, তাই বিদেশী আদব ও শব্দ আমার দেশজ আঙ্গিকে অনায়াস আত্মীকরণে প্রবম মুন্সিয়ানা তাঁর – 

...সব দূর্গার সমস্ত হাত খসিয়ে কবিতাপুর
ফিরিয়ে নে আজ;- অল্প ভোজনে স্বল্প পানীয়ে নাচি,
ঘরে ও বাহিরে অধিক রমণে অসি-ট্যানট্রামে বাঁচি। ... [ও বন্ধু মহিষাসুর]

অথবা এই কবিতার শিরোনাম শব্দই তো বিদেশী ভাষার। থেকেই লক্ষ্য করুন পাঠক - 

...কোথা উঠিবো, কাঁহা ছুপাঁউ, বলো তুমি হে সারথি;
না কহিলেও নর-নারীর বসবাস কি, ডরোথি,
বুঝে নেবোই নারকীয়ই! ...
তু সঙ্গম, মে রঙ্গম, আযা পুকারি জসম;
ঘর ছোড়কে দিল্‌ দুঙ্গা, মেরা আঁসু কি কসম। ... [তামান্না]

বিভিন্ন শৈলীর কাব্যছন্দের কবিতার মধ্যে এ বইয়ে পাঁচটি টানা গদ্যে লেখা কবিতা আছে – এই পাঁচটি কবিতা স্টাইলে যেমন, বক্তব্যেও স্বতন্ত্রতা দাবি করে। কেন টানা গদ্যে লেখা? পাঠক হিসেবে আমার উপলব্ধি নিম্নরূপ - 

আমাদের আধুনিক বিশ্বায়িত জীবন ও তার যাপন প্রণালী ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। আমরা জানতাম, প্রত্যেক প্রাপ্তবয়সী মানুষের মধ্যেও তার শৈশব লুকিয়ে থাকে, যা আগাপাশতলা এক সহজ সরল জল-স্বচ্ছ যাপন অভিজ্ঞতা। সেই শৈশবও তো আজকাল আর নেই। জীবন অত্যন্ত কর্কশ ও গদ্যময়। আধুনিক বাংলা কবিতাও তাই সেই জটিল নাগরিক জীবন যাপনের প্রতিচ্ছবি। 
...আশাতীতরূপে জনাকীর্ণ হয়ে-ওঠা ওই সভাস্থলে, মঞ্চের দূরস্থিত বিপরীত দিকে হতে লোকতরঙ্গের ভেতর দিয়ে ধীর বেগে মঞ্চমূখো গতিশীল রবি ঠাকুরের জামার পকেটে, সমাবিষ্ট প্রত্যেকেরই অজ্ঞাতে কে যেন পিস্তল রেখে দেয়। ...[রবি ঠাকুরের পকেটে পিস্তল] 

... আর, যারাইবা আমাকে সবান্ধব ষোলো ঘন্টা হাজতবাসে বাধ্য করে, তাদের পূর্ব ও পরবর্তী ন্যুনপক্ষে আঠারো প্রজন্মেরও অবগতির বাইরে থেকে যায় লেনিন কেন দৈনিক ষোলো ঘন্টা অধ্যয়নে অভ্যস্ত থাকেন এবং কেনইবা তাঁর উৎপাটিত মহান ভাস্কর্যের ওপর মূঢ়দের নৃত্যদৃশ্য কারুর স্মৃতিকে রক্তাক্ত করে ফের। ...[পুলিশেরও বোধগম্য নয়]

মোট ছাপ্পান্নটি কবিতা নাগাড়ে একবার দুবার নয়, বারবার পাঠ করে যে কোনো সচেতন পাঠকের বাসনা – শব্দ বুনে বুনে যে সামগ্রিক কবিতা শরীর, তাকে দেখে ছুঁয়ে কবির বোধকে স্পর্শ করা – যে কোনো সৃষ্টিমাধ্যমই আসলে তো সৃষ্টিকারের ব্যক্তিগত বাথরুমের আয়না – আমরা কবিতার মধ্যে সেই মানুষটাকেই খুঁজি – ‘ঘুমোই চশমা চোখে’ পড়ার পরে অজস্র ক্রোধ, হতাশা, রাজনীতি ছাপিয়ে শেষ অবধি কবি হামিদীর রোমান্টিক প্রেমিক সত্ত্বাই কিন্তু নায়ক হয়ে ওঠে - 

...আমার পাঁজর গলে কে তুমি বেরিয়ে এসে, কোমরে কলস,
ধীরে হেঁটে যাও তবু দিগন্তের দিকে?
খালি কলসি কাঁখে কি হেতু চলিষ্ণু তবে?
তোমার অযোগ্য আমি মলিন একখানা ছোট থলে হাতে বসে
চাওয়া-না-পাওয়ার পয়সা গুনি চিরভিখিরির হেন।
অথচ ভ্রুকুটি ছুঁড়ে জলকে নয়, দৃপ্ত চলো তুমি
আকাশ ও মৃত্তিকার বিরান বিবাহস্থলে,
কেঊ পৌঁছুবার আগে যেখানে নিবিড় বাজে হাওয়ার সানাই
আর জ্বলে অসংখ্য তারার মিটিমিটি শামিয়ানা। ... [তোমার অযোগ্য আমি]

কবি হাহাকার করছেন ‘প্রেমের কবিতা আমি লিখতে পারি না, তবু’ শিরোনামে – অন্যদিকে লিখছেন ‘বর্তুল বুকের জোড়া কিশমিশ অথবা / লিপস্টিকময় দুই ঠোঁটের বহুত্ববাদ / স্পর্শের আলপনা আঁকে আমারও নানান / অনুভবে শুধু নয়, শিরার রক্তেও’। পাঠ শেষে উঠে হেঁটে যেতে যেতে অসাধারণ একটি প্রেমের কবিতার গন্ধ অমর হয় পাঠকের মগ্ন সত্ত্বায় – 

...তোমারই শোবার ঘরে সারা রাত বৃষ্টি হয়েছিলো।
কে ছিলো তোমার সঙ্গে অথবা কী?
দীর্ঘ শস্যগুচ্ছ আর ঘামের সৌগন্ধে পূর্ণ আমার বগল,
যৌবনের কথিত রাজপুত্র এ আমারই
যুগল অপরিণত গৌর স্তন,
দিঘল গোঁফের যতো কন্টক-শলাকা
নাকি নিম্নবর্তী ওই যুদ্ধবাজ অমঙ্গল? ...
অথচ এখনো ভেজা তোমারই বিলকুল সেই রাত্রির জামায়
মুখ ঘষেও আমার জানা হলো না 
কিভাবে বাংলার 
বিগত সমস্ত বর্ষা কেবল মাত্র
সে-রাতেই একযোগে
তোমার শয়নকক্ষে অমন নির্ঘাত ঝরেছিলো। ...[তোমার শয়নকক্ষে বৃষ্টি হয়েছিলো] 

‘ঘুমোই চশমা চোখে’-র প্রচ্ছদ ভালো, যদিও কালো রঙে আমার প্রবল আপত্তি। অজস্র ভালো কবিতার মধ্যে বেখাপ্পা দু-একটি ছাপার ক্ষমাযোগ্য ভুল। কিন্তু কবিতার শিরোনামের ফন্ট হঠাৎ দুটি কবিতায় [‘পঁচিশে জানুয়ারি’(পৃ ৬১) ও ‘জল না ফুরালেও’(পৃ ২০)] সহসা অসম্ভব বড়ো – এটা দৃষ্টিকটু, ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ বলে মনে হয়েছে।

শ্রেষ্ঠ শব্দাবলীর শ্রেষ্ঠ বিন্যাসে সৃষ্ট কবিতা সময়ের সাথে সাথে শ্রেষ্ঠ বিবর্তনের পরেও সাহিত্যের সবচেয়ে সূক্ষ এবং জটিল শাখা। কেননা কবিতার মধ্যে শব্দাবলী সচরাচর নতুন অর্থের ব্যঞ্জনায় বহুমাত্রিক। আর এখানেই দক্ষ শিল্পীর সার্থক কারু কাজ। শিল্পী-কবি খালেদ হামিদীকে সশ্রদ্ধ কুর্নিশ – কারণ, এ বই পড়ে ইতিমধ্যেই আমি আরো অনেকের মতো ঋদ্ধ হয়েছি ও মানুষ হিসেবে আরো দীর্ঘকায় হয়ে উঠেছি। বাঙলার প্রতিটি শোবার ঘরে খুব শিগগিরই আপনার কবিতা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়বে – এই আশায় রইলাম। 

2 comments:

2

জংলা ডায়েরি - শিবাংশু দে

Posted in
 













১০


" সবুজ কাগজে
সবুজেরা লেখে কবিতা
পৃথিবী এখন তাদের হাতের মুঠোয়"
(বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)

মহাভারতের কালে অঙ্গ ও বঙ্গদেশ শুধুই অরণ্য ছিলো। কিন্তু বাঙালির অরণ্যপ্রীতির ইতিহাস বিশেষ প্রাচীন নয়। রাজা রামমোহন বেশ কিছুদিন চাতরার জঙ্গলমহলে আমিন ও মুন্সির কাজ করেছিলেন প্রায় দু'শো ব্ছর আগে। যে চাতরা আজকের দিনেও প্রায় দুর্গম একটি অরণ্যপ্রদেশ। অগম্য, সন্ত্রাস অধ্যুষিত সবুজের স্বর্গ। কিন্তু তাঁর কোনও লেখায় চাতরার ভূপ্রকৃতি নিয়ে কোনও উল্লেখ নেই। স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র দীর্ঘকাল মেদিনীপুরের দক্ষিণে গভীর জঙ্গল পেরিয়ে ভদ্রকে গিয়ে ডেপুটিগিরি করতেন। কপালকুণ্ডলায় সামান্য উল্লেখ ব্যতিরেকে আর কোথাও কিছু লেখেননি। রবীন্দ্রনাথ পল্লীগ্রাম নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন। কিন্তু অরণ্য নিয়ে নয়। সঞ্জীবচন্দ্রের 'পালামৌ' য়ুরোপীয়দের ভারতদর্শন, তবে বাংলায়। বড়ো লেখকদের মধ্যে তো আর কারো নাম মনে আসছে না, যিনি সমুচিত আগ্রহ ও ভালোবাসা দিয়ে অরণ্যবৃক্ষের মর্যাদা দিতে চেয়েছিলেন। প্রকৃতির এই বিস্ময়টি নিয়ে প্রথম যিনি প্রকৃত শিল্প সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন, তিনি বন্দ্যকুলোদ্ভব কবি বিভূতিভূষণ। একটা গল্প শুনেছি। বিভূতিভূষণ ঘাসমাটিতে আক্ষরিকভাবে কান পেতে কিছু শুনতে পেতেন। কী শুনতেন, তা আমরা হয়তো বুঝতে পারবো না। কিন্তু তাঁর ভালোবাসার মাত্রাটি সামান্য হলেও অনুভব করতে পারি। মাত্র দশটি বই নিয়ে যদি নির্বাসনে যেতে হয়, তবে তার একটি তো অবশ্যই 'আরণ্যক'। অরণ্যকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করে তার আগে তো কেউই কিছু লেখার চিন্তা করতে পারেননি। পরে লেখা হয়েছে, কিন্তু তা আরণ্যকের ধারেকাছে যেতে পারেনি। তাই বাঙালির অরণ্যচর্চার মুখ ও প্রধান প্রতিনিধি বিভূতিভূষণ। যেহেতু তিনি জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় বিহারের বনজঙ্গলের মায়ায় বুঁদ হয়েছিলেন, তাই বিহারি হিসেবে আমিও তাঁর চলাচলের পথে ধুলো ঘেঁটে বেড়াবো, তাই তো স্বাভাবিক। 

----------------

বিভূতিভূষণের 'আরণ্যকে'র জঙ্গল দিয়ে শুরু করা যায়। খেলাত ঘোষের চাকরি নিয়ে যখন তিনি ভাগলপুর যা'ন, তখনও ঐ প্রান্তটি মহাভারতের কর্ণের পড়ে পাওয়া অঙ্গরাজ্যের থেকে বিশেষ নগরায়িত ছিলোনা। এখন তিনটে জেলা হয়েছে বাঁকা, গোড্ডা, দুমকা। এই সব এলাকাগুলোতে জঙ্গল ছড়িয়ে ছিলো সেকালে। বিভূতিবাবুর (বিহারে এভাবেই বলা হয়) লবটুলিয়া বইহারের কল্পনা আসলে পুর্নিয়ার উত্তরে আরারিয়া থেকে ফর্বেসগঞ্জ, তরাইয়ের বনজঙ্গল। সতীনাথ ভাদুড়ি আর ফণীশ্বরনাথ রেণুর রাজপাট। আপাততঃ ভাগলপুর থেকে পূর্বদিকে জগদীশপুর পেরিয়ে বাঁকার পথে বইসির কাছে দক্ষিণের বনভূমি যেতে হবে। ছোট পাহাড়ের রেঞ্জ একটা । শাল-সেগুন-গামারের বনভূমি। যেখানে পূর্ণিমারাতে পরিরা খেলা করতে আসে। এখানেই তাঁর মহালিখারুপ অরণ্যানী। 'মহালিখারুপ' নামটি উনি নিয়ে ছিলেন সিংভূমের 'মহালিমরুপ' পাহাড়ের নাম অনুকরনে। সিংভূমে তাঁর চলার পথ খুঁজতে গেলে আসতে হবে জামশেদপুর থেকে দক্ষিণপূর্বে রাখামাইন্স, গালুডি, চাপড়ি পেরিয়ে সুর্দা মাইন্সের দিকে রুয়ামের জঙ্গল। জামশেদপুরের প্রত্যন্ত শহরতলি সুন্দরনগর পেরোলেই একটু একটু করে সবুজের রাজত্ব শুরু হয়ে যায়। করিমসাহেবের পুকুর পেরিয়ে সুন্দরনগরের দিকে বাঁদিকে বাঁক নিলেই নরোয়া পাহাড়, ভাটিন মাইনসের রাস্তা। রাস্তাটি পৌঁছোবে জাদুগোড়া মোড়ে। যখন জাদুগোড়া থাকতুম তখন এই রাস্তাটি ছিলোনা। ছিলোনা বললে ভুল হবে। ভাটিনের পর থেকে দু'টো পাহাড়ের মাঝখান থেকে সরু পায়ে চলার পথ ছিলো। ট্রেকিং করার জন্য আদর্শ। মুর্গাঘুটু, হরতোপা থেকে রাজদোহার দীঘি। নরওয়াপাহাড়ে মাইনিং শুরু হবার পর ইউরেনিয়াম কর্পোরেশনের কলোনি হলো, অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের কমপ্লেক্স বসলো। জঙ্গলের মধ্যে গ্রাম গুলো জুড়ে জুড়ে চওড়া রাস্তা। আধঘন্টা-পৌনে ঘন্টার মধ্যে জাদুগোড়া কলোনি। তবে পুরোনো রাস্তাটি সত্যিই পুরোনো। জামশেদপুরের দক্ষিণে রেলস্টেশন পেরিয়ে সেই সুন্দরনগর হয়েই সোজা হাতা মোড়। ঐ মোড়টির নকটার্নটির সঙ্গে অনেক চেনা নাম জড়িয়ে আছে। বাঁদিকে গেলে সঁকরদা, কালিকাপুর পেরোলেই সিংভূমের আদি জঙ্গল । পাহাড়ের গায়ে রংকিনীদেবীর মন্দির। এই লোকজ দেবীটিকে নিয়ে নানা রোমাঞ্চকর গপ্পোগাছা রয়েছে। বিভূতিভূষণের লেখায় এই দেবী বহুবার এসেছেন। এই রাস্তাটিও গিয়ে পড়ছে জাদুগোড়া মোড়ে। পাহাড়ের দক্ষিণদিক দিয়ে। এটাই ছিলো জামশেদপুর থেকে ঘাটশিলা যাবার আদি রাস্তা। কলকাতা যাবার জন্যও। এই পথেই পঞ্চাশ সালের এক হেমন্তের বিকেলে জরুরি তলব পেয়ে জামশেদপুরের বিধান রায়, ডঃ ব্রহ্মপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, অনিঃশেষ পাহাড় আর ঘন জঙ্গল পার করে ঊর্ধশ্বাসে তাঁর কালো অস্টিন গাড়িটি ছুটিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন ঘাটশিলার ডাহিগোড়ায়। কিন্তু ততোক্ষণে বিভূতিভূষণ দেবযানে সওয়ার হয়ে গেছেন। হাতের কালোব্যাগটি আর খুলতে হয়নি তাঁকে। প্রণাম করে বেরিয়ে চলে এসেছিলেন। 

---------------------

হাতা মোড় থেকে ডানদিকে ঘুরলেই চাইবাসা হয়ে পশ্চিম সিংভূমের অন্দরমহলের আঁকাবাঁকা পথ। গোবিন্দপুর, রাজনগর, কুজুনদী। চাইবাসা পেরিয়ে ঝিকপানি, হাটগামারিয়া, নোয়ামুন্ডি, বড়াজামদা, বড়বিল, বোলানি, মহিষানি, কিরিবুরু, বরাইবুরু, মেঘাতুবুরু। আবার হাতামোড় থেকে নাকবরাবর গেলে হলুদপুকুর পেরোলেই ওড়িশার সীমান্ত। তিরিং আর বাহালদার পাশে পাশে রয়েছে বাঁকা'র জঙ্গল। সোজা রাইরংপুর, বিসো'ই, বাংরিপোসি হয়ে বারিপদা। গোটা এলাকাটি ছিলো বিভূতিভূষণের নখদর্পণে। তিরিশ-চল্লিশের দশকে এসব জায়গা ছিলো মানচিত্রের বাইরে গভীর অরণ্যানী। অগম্য, বিপজ্জনক। কিন্তু তাঁর কা্ছে জঙ্গলের কিছুই নেতিবাচক নয়। বাংলাসংস্কৃতিতে জঙ্গলকে অনন্ত রোমান্টিক ভাবমূর্তি দেবার একটা সচেতন প্রয়াস তো তাঁর চিরকালই ছিলো। জানিনা তা ভালো না মন্দ। তিনি তো জন্মেছিলেন রাজা মিডার স্পর্শশক্তি নিয়ে। কিন্তু তাঁকে অনুসরণ করে যাঁরা জঙ্গলকে রোমান্সের স্টুডিও ফ্লোর করে তুলেছেন পরবর্তীকালে, তাঁদের জন্য থাক দু'চারটে দীর্ঘশ্বাস।

-------------------------

জাদুগোড়া থেকে পথটি সুর্দা পর্যন্ত গিয়ে দুদিকে ঘুরে যায়। একদিকে মৌভান্ডার, ঘাটশিলা, অন্যদিকে মুসাবনি, আদি কপার ক্যাপিটাল অফ ইন্ডিয়া। গোটা পথটির সঙ্গেই জঙ্গল জড়াজড়ি করে এগিয়ে গেছে। রুয়াম রেঞ্জ। অনন্ত সিং , অমলেন্দু সেন আর মেরি টাইলারের গপ্পো একালেও কেউ কেউ মনে রাখেন। চাপড়ি, নেত্রা, কেঁদাডিহ, সোহদা, মাঝে মাঝে তামার খনি। জঙ্গলটি চিরে সুবর্ণরেখা দুলে দুলে বয়ে যায়। সুবর্ণরেখা আমাদের গঙ্গা। রুয়াম থেকে নদী পেরিয়ে পূর্বদিকে গেলে গালুডির বাঁধ। ঘাটশিলায় ডাহিগোড়ার বাড়ি থেকে বিভূতিভূষণ হেঁটে হেঁটে এই গালুডির সুবর্ণরেখা পেরিয়ে পশ্চিমে রুয়ামে পাহাড়ের উপরে সিদ্ধেশ্বর শিবের মন্দিরে সবুজের ভাষা শুনতে যেতেন। ভয়ঙ্কর সুন্দর বনরাজিনীলা পেরিয়ে চড়াইয়ের পাকদণ্ডি ধরে তাঁর এগিয়ে যাওয়া। ওখানে এ তল্লাটের সব চেয়ে বেশি শঙ্খচূড়ের আস্তানা। বাবুজি ধীরে চলনা। ওখানকার জঙ্গলে একটু মন দিই যদি তবে আরণ্যকের বায়োস্কোপ, চোখে সবুজ, মনে সিপিয়া, শুধু মিলিয়ে নেওয়াটুকুই বাকি। 

-------------------------------

এই নদী, এই নীলসবুজ, এই জোড় লাগা নাগিনীর মতো বনপথ, সব মিলিয়েই তো জংলাভৈরবীর ঢিমে বড়ত। কসুর পতিয়ালার সবাই গেয়েছেন "নৈন মোরে তরস রহে, আজা বালম পরদেশি।" মাটির কুমারী মেয়ে তার সব মায়ামোহমদিরতা নিয়ে এভাবেই সম্পূর্ণা নারী হয়ে ওঠে, অরণ্যে বেফিক্র লাপতা হয়ে যাওয়ার টান, হারিয়ে যাওয়ার স্বাদ। যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের.....। পৃথিবীর যাবতীয় আততি, আশ্লেষ, আমূল থেকে খোঁজা, খুঁজে যাওয়া। সৌন্দর্যের সঙ্গে কথাবার্তা, সে তো হবেই। সে অন্যপূর্বা কি না কখনও ভাবিনি। তবু ও গাঁয়ে আমারও কিছু ঘরবাড়ি আছে। কবি যখন বলেন আমার প্রিয় লাইনগুলো, তখন ভাবি এতো আমার কথা, তিনি না হয় লিখেই দিয়েছেন,

বিভূতিভূষণও সৌন্দর্যকে দেখতে দেখতে কাছ দিয়ে হেঁটে চলে যান, মহাপ্রস্থানের পথে। আর আমি যুধিষ্ঠিরের কুকুরের মতো তাঁর পিছু পিছু।

এই মানুষজন্ম, এভাবেই চেয়েছি চিরদিন .....

" সৌন্দর্যের সঙ্গে ফের দেখা হলো, দেখলাম সৌন্দর্যের সিঁথিতে সিন্দুর

তার মানে সম্প্রতি সে বিবাহ করেছে, আমি সৌন্দর্যের সঙ্গে প্রায়শ কথাবার্তা বলতাম এককালে, এখন সে বিবাহ করেছে বলে আমি

আর কথা বলিনি তো, শুধু তার কাছ দিয়ে হাঁটলাম বহুক্ষণব্যাপী...."

(সৌন্দর্য- বিনয় মজুমদার)














(শেষ)

2 comments: