ধারাবাহিক - সুবল দত্ত
Posted in ধারাবাহিক
৯
গোরাচাঁদ
কিছুক্ষনের মধ্যেই ঝিলের পাড়ে সবাই এসে জড়ো হল। আকাশে তখন উজ্জ্বল খয়েরী রঙের মেঘ অন্ধকার করে আসছে।এমন মেঘ কেউ কখনো দেখেনি। এই এতগুলো লোক এখানে আসার আগে চরম কষ্টের মুখে থাকতো। এতোদিন ধরে ওরা অস্তিত্বের সংকট থেকে বাঁচতে নির্বিবাদে রোগ অসুখ প্রাকৃতিক বিপর্যয় সরকারি প্রশাসন এইসবের সাথে লড়াই করতো। এখানে এসে স্বর্গীয় সুখে বাস করতে করতে সেই যন্ত্রনা ভুলেছিল।এখন প্রত্যেকের মুখ এক অজানা ভয়ে শুকিয়ে গেছে। সবাই দেখল ওই মৃতদেহের হাত পা ও সারা গায়ে গোল চাকা চাকা ক্ষত। গোরাচাঁদ একটু ঝুঁকে খুব ভালোকরে মৃতকে দেখে নিজের মনেই বলতে লাগলেন,আমি একেবারে নিশ্চিত এইলোকটি দীর্ঘ সময় ধরে আর্সেনিকে এক্সপোজড হয়ে ছিল। সম্ভবত ওই পাহাড়ের গুহার ভিতরে লুকিয়ে ছিল।বিস্ফোরণের পর ওর দেহ ভেসে এসেছে এখানে। ওই লোকটা সেই পালিয়ে যাওয়া গুনিন। আগেই দুজন মারা গেছে,একজন এখনো অসুস্থ।আরেকজন নিশ্চয়ই বেঁচে নেই। এদের যে পরিণাম খুব খারাপ হবে সেটা সবাই আন্দাজ করেছে।
কিন্তু এই মৃতদেহ যে ওদেরই একান্ত নিজেরজন,জলে ভাসছে, তাতে কারো খুব একটা দুশ্চিন্তা হচ্ছেনা।ঝিলের জল অনেকটা কমে এসেছে আর জলের উপর একটা বাদামি আস্তরন পড়েছে। এই জল সরাসরি পানের জন্য ব্যবহৃত হয়। শুধু তাই নয়,মৃতের পাশে বেশ কয়েকটা মরা মাছ ভেসে উঠেছে। পেরো একটা শুকনো গাছের ডাল কুড়িয়ে এনে সেটা দিয়ে মৃতের পাশে থাকা একটা আধমরা সাপ উঠিয়ে ডাঙ্গায় ফেলল।একটু ঝুঁকে দেখে বলল,-আমার মনে হচ্ছে এই গুনিন লোকটাই ছিল ভগৌড়ে লোকগুলোর লিডার। ও নিশ্চয় ওই পাহাড়ের সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়েছিল। তাই এর গায়ে বিষাক্ত দাগ।দক্ষিণ দিকে এখনো কালো মেঘ।জোহা সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে বলল,-হ্যাঁ গুরুজি,ওদিকের পাহাড়টার ভিতরটা পুরোটাই ফাঁপা ছিল। ভিতরে বিশাল গর্তের মতো সুড়ঙ্গ ছিল। মনেহয় পুরো পাহাড়টা উড়ে গেছে। আর এই ঝিলের জল ওই গর্তের ভিতরে বয়ে যাচ্ছে। গুরুজি,আমাদের এখানে ঝিলের জলই বাঁচার একমাত্র সাধন। এই ঝিলের জল শেষ হয়ে গেলে আমরা শেষ হয়ে যাবো।
গোরাচাঁদ উঠে দাঁড়ালেন। আকাশের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললেন,শুধু জল নয় ওই দেখ আকাশে দুটো পাখি কেমন লাট খাচ্ছে। ওরা অসুস্থ এখুনি জলে পড়বে। পাড়ের উপরে ওই যে বড় গাছের গোড়ায় দেখ কতগুলো পাখি মরে পড়ে আছে। বিষাক্ত খনিজ ধুলো এখন আকাশে বাতাসে। জানিনা আমরা এখন কতটা সুস্থ।খনি ব্যবসায়ীরা নিশ্চয়ই আন্ডার গ্রাউন্ড খনির নিষ্কাশন ওপেন কাস্ট করতে শক্তিশালী ডিনামাইট কার্টিজ দিয়ে পাহাড়ের মাথাটা উড়িয়ে দিয়েছে। আমি নিশ্চিত ওরা গোপনে চোরাপথে ধাতু নিষ্কাশনের জন্য খনি বিশেষজ্ঞ ও জিয়োলজিস্টকে দিয়ে সার্ভে করেনি।তাহলে হয়তো ওরা আর্সেনিকের পার্সেন্টেজ বেশি দেখে খনন কাজ বন্ধ রাখতে পারতো।
পেরো ম্লান হেসে বলল,-না গুরুজি। টাকার জন্যে ওইসব মানুষ পারলে পৃথিবীটাকে পুড়িয়ে ফেলবে।আপনি দেখছেন তো চোখের সামনে এই স্বর্গ কেমন নরক পাতালপুরী হতে বসেছে?আমরা কার কী ক্ষতি করেছি যে আমাদের এমন শাস্তি হোলো?এখন আমরা কী করবো কোথায় যাবো গুরুজি? এতোগুলো মানুষকে নিয়ে?
জোহা কাঁদতে কাঁদতে পেরোকে জড়িয়ে ধরলো। গোরাচাঁদ চুপ করে বসে রইলেন। কয়েকজন জলে নেমে মৃতদেহ পাড়ে উঠিয়ে আনলো। গোরাচাঁদ দেখলেন কয়েকটা মাছ লাফিয়ে ডাঙ্গায় পড়ল। কারো কিন্তু ওগুলো ধরার ইচ্ছে হলোনা। মাছেরাও বুঝেছে জলাশয়ের জল কমে আসছে,জল খারাপ হয়ে গেছে। জল আর বাসপোযোগী নয়। তাই জল ছেড়ে ডাঙ্গায় মৃত্যুবরণ করেছে। গোরাচাঁদ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এখন আমরা? আমরা কোথায় যাবো? কি করবো? আমরা নাহয় একে একে বিষক্রিয়ায় শেষ হয়ে যাবো, কিন্তু এই অপরূপ অত্যাশ্চর্য বিরল মনোরম অমৃততুল্য প্রকৃতি? এর কি হবে?
আকাশে এখন থোকা থোকা খয়েরি মেঘ। পশ্চিমের দিক থেকে কালো মেঘ এসে এই খয়েরি ধুলো মেঘের দিকে উড়ে আসছে। সব সুক্ষ্ম বিষ মাটিতে পড়বে। অমৃত ভেষজ আনাজ ফল ফুল সব বিষাক্ত হবে। যত সময় যাবে এক একজনের শ্বাসকষ্ট হবে। আর জল? জলের কি ব্যবস্থা হবে? নাঃ এখন বসে থাকলে চলবে না। খুব তাড়াতাড়ি এতোগুলো মানুষের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। গোরাচাঁদ উঠে দাঁড়ালেন। পেরো ও জোহাকে দুহাত ধরে তুলে দাঁড় করালেন। -এখন শোকের সময় নয়। জোহা,যখন তুমি জানোই বাঁচতে হলে আমাদের এই কুনিহা গ্রাম ছেড়ে যেতেই হবে,তখন যত শীঘ্র সম্ভব তৈরি হও,সবাইকে বলো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গোছগাছ করে তৈরি হতে। দাঁড়াও, সবচেয়ে আগে তোমরা প্রত্যেকে একটুকরো কাপড় দিয়ে নাক মুখ বেঁধে নাও। তাহলে হয়তো কিছুটা বাঁচার আশা থাকবে। পেরো, কি দেখেছিস? দক্ষিণের পাহাড়টা বেমালুম সাফ হয়ে গেছে? ও তো হবারই কথা। জানিনা শিমুলিয়ার আবহাওয়া কতটা বিষাক্ত হয়েছে। ঢাক বাজিয়ে ম্যাসেজ ছড়িয়ে দিতে হবে। অরণ্যবাসীরা যেন শিমুলিয়া ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যায়। আর একটা কাজ। পেরো তুই জন বিশেক লোক নিয়ে একটা কুয়ো খুঁড়তে লেগে পড়। একদিনের ভিতরেই খুঁড়ে ফেলতে হবে। নাহলে পিপাসায় জীবন যাবে। আর জোহা,তোমার গুনিনদের বলো মাটিসহ এখানের বিশেষ জড়িবুটির চারাগাছ সংগ্রহ করতে। আমরা যেন সব অমূল্য গাছগাছড়া শুকনো ফল বীজ তেল মধু ও গাছের ছাল এখান থেকে নিয়ে যেতে পারি।
শোকাচ্ছন্ন মানুষগুলির কারো মুখে রা নেই। আকাশের রঙ দেখে যে কোনো প্রাণী আতঙ্কিত হবে আর এরা তো অরণ্যবাসী। এদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ভীষণ সজাগ। যারা এখানে এসেছে ওষুধের প্রভাবে অতীত জগত তাদের কাছে স্বপ্নময়। তাই কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা এই কুনিহা ছেড়ে অন্য কোনো বাস্তব জগত রয়েছে। যারা এখানের বাসিন্দা,তারা ঝটপট উঠে দাঁড়িয়ে পেরোর কাছে এলো। পেরো যথারীতি তাদের নির্দেশ দিলো কি করনীয়। গোরাচাঁদ লক্ষ্য করলেন জলস্তর দ্রুত কমে আসছে। পদ্মপাতাগুলি নেতিয়ে পড়েছে। পাড়ের উপর শ্যাওলা ভেজা পাথরগুলো সব দেখা যাচ্ছে। ওই দক্ষিণ দিকে যদি শিমুলিয়া হয় তবে বস্তিগুলো নিশ্চয়ই জলমগ্ন হয়ে গেছে। এখন ওদিকে যাওয়ার চেষ্টা বৃথা। শিমুলিয়ার মাটি আর্সেনিকে বিষাক্ত হলে ওখানের দুর্লভ বিশল্যকরণী ভেষজ গাছ আর কোনোদিন মানুষের কাজে লাগবে না। গোরাচাঁদ ভাবলেন,আমি কেবল সৌমেনকেই জনজাতির দুশমন ভেবেছি,কিন্তু দেখছি শয়তান অনেক। রক্তবীজের বংশধর। চুড়ান্ত স্বার্থপর এরা।সামাজিকতার একসূত্রে এদের বাঁধা সম্ভব কি? শিমুলিয়া বনাঞ্চলের মানুষদের ওরা যত ঘৃণা ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে ততটাই এই খনিজ সমৃদ্ধ অঞ্চলের উপর লোভ।
হঠাত্ পাড়ের উপর কয়েকজনের মিলিত চিত্কার শুনে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। দেখলেন কয়েকজন জলে নেমে একটা লোককে পাড়ে তুলে আনছে। এই মানুষটা সম্ভবত পালিয়ে যাওয়া পঞ্চম জন। বেঁচে আছে,হাত পা নড়ছে। কিন্তু এরও সারা শরীর ফুলে উঠেছে,সারা গায়ে লাল লাল ঘা। দুজন দৌড়ে গিয়ে কুটির থেকে চন্দন পদ্মমধু ও একধরনের লেপ নিয়ে এল। ওর সারা দেহে কয়েকজন প্রলেপ দিতে লাগলো। কেউ কাউকে আদেশ বা অনুরোধ করছে না। যেন এই বিপদে কার কি করনীয় সবার জানা। একেই তো বলে সমাজ! গোরাচাঁদ ভাবেন। শিমুলিয়া এখন নিশ্চিত আর্সেনিক দূষিত জলে ডুবে আছে। আর না হলেও পুরো এরিয়া এখন ওপেন কাস্ট মাইন হয়ে থাকবে। যতদিন না খনিজ আকর শেষ না হয় ততদিন বাইরে থেকে লেবার আনিয়ে খনিজ নিষ্কাশন করিয়ে নেবে। বিষাক্ত ধাতুতে একদল কাজ করতে করতে ব্যাধিগ্রস্ত হলে ওদের তাড়িয়ে দেওয়া হবে। আসবে অন্য সুস্থ সবল শ্রমিক। তারাও কিছুদিনের মধ্যেই অসুস্থ হবে এবং এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকবে।
জোহা এসে গোরাচাঁদের হাত ধরে টানলো। - গুরুজি, একটু ঝিলের ওই পাড়ে চলুন,দেখবেন।
গোরাচাঁদ জোহার সাথে সেখানে গিয়ে দেখেন পাড়ের ওপর একটা বিশাল পাইথন লম্বা বিশাল একটা সেগুন গাছ অর্ধেকটা পেঁচিয়ে কেমন যেন নেতিয়ে পড়েছে। তার লেজটার কিছুটা জলে ডুবে। অনেকজন ভীড় করে ঘিরে দাঁড়িয়ে। কারো চেহারায় আতংক নেই,অনেকের চোখে জল। বোঝাই যায় এই সাপটি এখানের মানুষের পরিচিত। বাস্তুসাপ হবে। দু চার জন সাপের কাছে গিয়ে মাথায় গায়ে হাত বোলাতে লাগে। কি এখন করা যাবে কেউই বুঝতে পারছে না। ঝিলের জল যে মারাত্মক বিষাক্ত এটা আর কাউকে বোঝাতে হবে না। আকাশের অবস্থাও ভালো না। খয়েরী কালো মেঘটি এখন ঠিক মাথার ওপরে। থেকে থেকে বিদ্যুত্ চমকাচ্ছে। কি জানি,এই মেঘে এখন যদি বৃষ্টি হয় তবে সেটা হবে এসিড রেন। এক্ষুনি সবাইকে এখান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। গোরাচাঁদ জেরেকাকে বললেন একথাটা। জেরেকা কাছে গিয়ে উঁচু গলায় সবাইকে সাবধান করে দিয়ে নিজের নিজের কুটিরে ফিরতে বলল।
0 comments: