0

গল্প - সনাতন সিংহ

Posted in

( ১ )

মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে।লোক গিজ গিজ করছে প্ল্যাটফর্ম জুড়ে।ট্রেন চলাচল প্রায় বন্ধ।বারবার ঘোষণা হচ্ছে

...লাইনে জল জমার কারণে এই মুহূর্তে কোনো শাখার ট্রেন চালানো সম্ভব হচ্ছে না।

এই মাত্র একটা দূর পাল্লার ট্রেন শিয়ালদহের নয় এর সি প্ল্যাটফর্মে ঢুকল।

অমলের পিঠে ব্যাগ,হাতেও ব্যাগ।ভিড় দেখে সে হকচকিয়ে যায়।কি ব্যাপার? বুঝে উঠতে একটু সময় লেগেও গেল। ততক্ষণ সে দাঁড়িয়ে থাকে। কি ভেবে আবার ভিড় ঠেলে ঠেলে সাউথ সেকশনের দিকে আসতে লাগল। কিন্তু পারছে কৈ?আগে থেকেই লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখে মুখে উদ্বিগ্নতার ছাপ। বোর্ডের লাল আলোয় ঘন্টা খানেক আগের ট্রেনগুলোর নাম এখনও জ্বলজ্বল করছে।অমল একটু এসেই আটকে গেল। ভিতরে ঢুকতে পারল না। বৃষ্টির ঝাট এসে তাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে প্রায়। কতক্ষণে এ বৃষ্টি থামবে কে জানে?ঝাপটায় ভিজে যাওয়ার থেকে বাঁচানোর জন্য হাতের ব্যাগটাও পিঠে দিকে নিচ্ছে,এমন সময় একদল ছেলে চেঁচাতে চেঁচাতে লাফিয়ে এসে পড়ল নর্থ ও সাউথ সেকশনের ফাঁকা জায়গায়। সেড নেই। জলের উপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে ডুমুর ডুমুর হয়ে উঠছে।জলে টইটুম্বুর।টাইলস বসানো এই ফাঁকাটাতে বেশ জল জমে রয়েছে।

ছেলেরা তড়াৎ তড়াৎ করে লাফিয়ে আছড়ে পড়ছে সজোরে।পিছলে যাচ্ছে দূরে দূরে।সঙ্গে তাদের প্রাণোচ্ছল চিৎকার।তাদের ধরে কাছে যে সব উদ্বিগ্ন মানুষগুলো এতক্ষণ ছটফট করছিল, এই ভেবে যে কখন গাড়ি ছাড়বে? কখন বাড়ি ফিরবে? তাদের চোখ ডিসপ্লে বোর্ড ছেড়ে এখন সঙ্গী হল ঐ কচিকাঁচাদের জল-খেলায়।

হঠাৎ করে একজন পিছলে পড়ল সেই জলে।অন্যদের মতো তারও খালি গা।বর্ষায় উদ্বেলিত মাছ যেমন জলের উপর সোঁওওওও করে দূরে তীর গতিতে সাঁতরে যায়,ঠিক তেমনই,ছেলেটি জল কেটে তড়াৎ করে এগিয়ে এল অমলের দিকে।

অমল খিলখিল করে হেসে উঠল।তার চোখে ভেসে উঠছে সেই বৃষ্টি ভেজা মাঠ।সেও যেন পিছলে ছিটকে পড়ল সেই খেলার মাঠে।

ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে।জল-কাদায় মাঠ পিচ্ছিল।পায়ের উপর ভর দিয়ে ,আঙ্গুল টিপে টিপে দৌড়ানো যাচ্ছে না।বল যে পাচ্ছে সে অন্য পক্ষের গোলের দিকে এগোতে চাইলে কী হবে ,পিছন থেকে ,সামনে থেকে যে যার মতো লাফিয়ে তড়াৎ করে এসে তাকে সমেত নিয়ে জল-কাদায় লুটোপুটি খাচ্ছে।ফাউলের কে ধার ধারে?পাড়ার খেলা।ব্রেট-এর খেলা। যে দল হারবে অন্য দলকে খাওয়াতে হবে।

হারজিতটা বড় নয়,তার থেকে এমন বৃষ্টিতে খেলার আনন্দটাই আসল।পাড়া, গ্রাম,গঞ্জের কচিকাঁচারা সবাই যেন এমন বর্ষায় এমন বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করে।

বর্ষার বৃষ্টিতে তাদের আর পায় কে?বাবা-মা,বা বাড়ির বড়দের বারণ কে শোনে?ফুটবল হাতে চেঁচাতে চেঁচাতে পাড়ার রাস্তার জল ছিটাতে ছিটাতে সব বের হয়।এ পাড়ার জগা, রতন, ও পাড়ার ভোলা,চন্দন, মাঝের পাড়ার সঞ্জয় ,হিমে,বাসু ছাড়াও আরো আরো ঐ দলের সঙ্গে ভিড়ে যায়। 

আজও তাই হয়েছে।ধানের খেতেই এখন ওদের খেলার মাঠ।ছোটো ছোটো নাড়ার সঙ্গে মিশে আছে ব্রাহ্মী শাকের জট।ছুঁচো পাতি।আর লম্বা লম্বা সুচালো দূর্বা ঘাসের কচি কচি সবুজ ডগা।পাশের মাঠের কাঁকড়ার গর্তের ঢিপি করা মাটিই নেবুর গাঁট ডোবা জলে মাথা উঁচু করে জেগে আছে কাঁকড়ার পদচিহ্ন নিয়ে বৃষ্টি ঝরা আকাশের দিকে।

মাঠের এ প্রান্তে ওপ্রান্তে বলতে গেলে যে প্রান্তের দিকে তাকাও না কেন, সবুজ গাছে ঘেরা গ্রাম আর গ্রাম।কোথাও কোথাও মাঠ জলে থৈ থৈ করছে।আর তার মাঝখান দিয়ে মেঠো পথ আকাশবাণী, ঝাউ, অর্জুন খেজুর,তাল, বাবলা গাছ বুকে নিয়ে এ গ্রাম থেকে ও গ্রামকে ছুঁয়েছে।সেই গাছগুলো ঐ মেঠো পথের মাটির রস টেনে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দিনের পর দিন।আজ কেবল তারা থ হয়ে ভিজছে অনাবিল স্নিগ্ধতায়।

এদিকে খেলা বেশ জমে উঠেছে।দুই পক্ষই এখন দুই দুই।ঘড়ির সময় ধরে খেলা নয়।এই বৃষ্টিতে কেউ কোনো দিনই ঘড়ির সময় ধরে খেলে না...গ্রাম,গঞ্জে তো নয়ই।তাই গোল সংখ্যাই ম্যাচ হার জিতের চূড়ান্ত নির্ণায়ক।

অমলদের গায়ে কাদায় পরিপূর্ণ।চুলে কাদা লেগে যেন মোটা মোটা দড়ি পাকিয়ে রয়েছে।বৃষ্টির জলে তা ধুয়ে ধুয়ে চোখ মুখ বেয়ে বেয়ে গালেও এসে পড়ছে।

অমল তার মধ্যেও অন্যদের কাটিয়ে বল নিয়ে সঞ্জয়দের গোল বক্সের কাছেই প্রায় এসে পড়েছে।পায়ের টিপ রাখতে পারছে না।ঘন ঘন পিছলে যাচ্ছে।তবুও সে দৌড়ে আসছে।তার ডান পায়ে বল।সজোরে গোলে শর্ট রাখতে যাবে।সঞ্জয় দূর থেকে দৌড়ে আসছে আর চেঁচাচ্ছে

...ভোলা,এগিয়ে আয়।এগিয়ে আয়।

ভোলা গোলপোষ্ট ছেড়ে এগিয়ে আসার আগেই বিশ-পঁচিশ ফুট দূরে থেকে সঞ্জয় লাফিয়ে পড়ল জল-কাদায়।ওমনি সোঁওওওও করে কূল ছাড়া নৌকার মতো এসে আছড়ে পড়ল অমলের পায়ের উপর।পিছলে গেল দুজন।বল গেল দূরে কাদার মধ্যে আটকে। অমলও পড়ল তার গায়ের উপর।

অন্যরা ফাউল ফাউল করে চেঁচাতে লাগলো।কেউ বলছে 

...পেনাল্টি দিতে হবে।

কেউ বলছে
...ও জল-কাদার মাঠে এটা চলে।দু'পক্ষের মধ্যে চলল যে যার নিজের পক্ষের হয়ে সওয়াল করা।

কিন্তু এদিকে সঞ্জয় উঠছে না কেন?


( ২ )


বৃষ্টিধারা কমেছে।পুঁটি পুকুরের দিকটায় তখনও সাদা আর সাদা।দূরের গ্রাম যেন সাদা বৃষ্টির চাদরে ঢাকা পড়ে গেছে। এদিকে কিন্তু পুবে উড়ি হচ্ছে।

পুব দিকের ঢিপি করা গোলবস্কে দাঁড়িয়ে থাকা পটাইয়ের গলা ভেসে আসছে

…… 

আয় বৃষ্টি ঝেঁপে 
ধান দেব মেপে।
ধানের ভিতর পোকা
জামাই শালা বোকা।

পুরো ছড়াটাই তার আর বলা হল না,দেখে অমলরা সঞ্জয়কে টেনে তুলছে। তাদের কথা কাটি বন্ধ।সঞ্জয় যেন তার সমস্ত ভার ছেড়ে দিয়েছে।মুখে তার গোঁঙানির শব্দ।দাঁড়াতে পারছে না।পা মচকে গেছে।প্যান্ট গেছে কেটে। কাদার সঙ্গে রক্ত মিশে রয়েছে।কেউ কেউ গামছায় করে,ক্রোশ করে জল নিয়ে তার সেই কাটা অংশে দিচ্ছে।

ডান পায়ের হাঁটুর পিছন থেকে পাছা পর্যন্ত ধারালো কিছু দিয়ে যেন কেউ কেটে দিয়েছে বলে মনে হল।

বর্ষার জল পেয়ে শামুক বেরিয়েছে,মুখ এখন তার ছুরির মত ধারালো।কোনো কোনো শামুক সাদা সাদা ডিম নিয়ে আলের উপর বাসা বেঁধেছে।এ জমিতে তাদের কচি কাঁচা প্রতিনিধি চরে বেড়াচ্ছে যেখানে সেখানে।খেলতে খেলতে দু-একটা যে যেটাকে পেয়েছে,তুলে ছুঁড়ে ফেলেছে।হয়তো পড়ে থাকা তাদেরই কোনোটায় সঞ্জয়ের এমন অবস্থা।

বৃষ্টি থেমে গেছে।তাদের খেলাও বন্ধ।সঞ্জয়কে তিন-চার জনে কাঁধে করে নিয়ে চেলেছে।

আবার বাজ পড়া শুরু হয়েছে।তার আলোক ছটা একটার পর একটা ,কখনও বা একসঙ্গে কয়েকটা,চিঁড় চিঁড় করে আকাশ চিরে লম্বা লম্বা শিকড়ের মতো নেমে আসছে..... তাদের আশেপাশে,তাদের গ্রামে,বাবুদের পাড়ে, দূরের গ্রামে গ্রামে।সঙ্গে গুড় গুড় করা কান ফাটানো, হাড় কাঁপানো প্রলম্বিত শব্দ একপ্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে মিলিয়ে যেতে না যেতেই আবার মুখরিত হচ্ছে।

ভয় সেঁধিয়ে গেছে সবার ভেতরে।সঞ্জয় কাঁধে।জলকাদায় মেঠো জমির শক্ত পিঠে পায়ের টিপ সরে সরে যাচ্ছে ঘনঘন।জলে কাদায় মাখামাখি শরীর গুলোর একটা শরীর ছিটকে বেরিয়ে গেল।দৌড়ে যাচ্ছে বাবুদের পাড়ের দিকে।

হ্যাঁ,ওটা পটাই তো।জমা জল তার পায়ের স্পর্শে ছলাৎ ছলাৎ করে উছলে উঠছে।তবুও সে দৌড়াচ্ছে।

…আমি ওর বাবা-মাকে খবর দেই।তোরা আয়।

পাড়ের ওঠার আগেই সারা পাড়টা আলোয় ঝলসে উঠল।পাড়ের একটা নারকেল গাছের পাতা পট পট করে নুইয়ে পড়ল একে একে।ঝলসে গেল সবার চোখ।সবার চোখের সামনে তীব্র আলোর বলয় জ্বল জ্বল করছে।চোখ ঘষতে ঘষতে অমল তাকিয়ে দেখে চড়াৎ করে কান ফাটানো তীব্র শব্দ ছড়িয়ে পড়ার আগেই পটাই গড়িয়ে পড়ল পাড়ের গা দিয়ে ধান জমিতে।

সঞ্জয়কে নামিয়ে অন্যদের সঙ্গে তারা সেদিকে দৌড়ে গেল।

…পটাই ওঠ।পটাই ওঠ।ওঠ বলছি।

মনা, জগা,অমল তাকে সজোরে নাড়া দিচ্ছে।কোনো সাড় নেই।জলকাদা মাখা পটাইয়ের শরীর থেকে তখনও গরম উত্তাপ বেরিয়ে আসছে।

কারা কারা কেঁদে উঠল।ভয়ে কান্নায় পাড়ের কোলে তাদের অসহায় বেদনাবিধুর আর্তনাদ বৃষ্টির শব্দে, বাজ পড়ার শব্দে চাপা পড়ে যাচ্ছে।

অমল পটাইয়ের মাথাটা কোলের উপর তুলে নিল।বারবার তার মাথায় হাত বোলাচ্ছে।যত তার মাথায় হাত বোলাতে থাকল ততই পটাইয়ের জন্য তার প্রাণ হাহাকার করে উঠল।

এখন স্মৃতিগুলো কিলবিল করছে তার মাথায়।সে সেদিনের ছবিটা যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে

...মাঠ থেকে মাইকে ঘোষণা হচ্ছে এই খেলার পরবর্তী খেলা পটাশপুর মাকালী সঙ্ঘ বনাম তালপুকুর আমরা ক'জন।

অমল আর পটাই স্কুল থেকে ফিরে খেয়ে দেয়ে এই পাড়ের ভিতর দিয়ে আসছিল।বাবুদের বড় স্নানের পুকুর পিছনে ফেলে বাঁশ ঝাড়ের নিচ দিয়ে এগিয়ে চলেছে তারা।দুধারে পুকুর।পাড়ে কি গাছ নেই?

বাবুদের যেমন জমির অভাব নেই, তেমনি অভাব নেই টাকার। টাকা দিয়ে কত রকমের গাছ কিনে এনে তারা বসিয়েছে।নারকেল, সবেদা, জামরুল,কৎবেল,চালতা,এসব তো তাদের জানা।কিন্তু এছাড়া আরো আরো গাছ আছে তাদের নাম জানা নেই।

দু'পুকুরের মাঝখান দিয়ে যেতে যেতে পটাই বলল

…চালতাগুলো কেমন জলের উপর ঝুলছে দেখ।আরে,ঐ দেখখখ...,জামগাছের দিকে তাকা।কত্ত বড়ো বড়ো জাম দেখ,কালো কালো গাঁথাল গাঁথাল হয়ে ঝুলে আছে।চল পাড়ি !

বলেই দৌড়ে গেল গাছের দিকে।

…আরে,থাম থাম।

কে তার কথায় কান দিচ্ছে?তর তর করে জামগাছে উঠতে লাগল।জামের থোকা দেখে লোভ সংবরণ করা গেল না।অগত্যা অমল শুরু করল গাছে চড়তে।

অমলের কেমন যেন সন্দেহ হল

…এই ডালে এমন থোকা থোকা টুসটুসে কালো কালো জাম,অন্য ডালে নেই কেন?বাবুদের নয় অনীহা আছে,কিন্তু পাড়ার ছেলেদের চোখ এড়িয়ে গেল কি করে?

একের পর সন্দেহ তার মনকে প্রশ্ন করছে ঠিকই।ততক্ষণে পটাই সেই ডালে থোকার কাছাকাছি আর সে মাটি ছেড়ে প্রায় হাত সাতেক উপরে।

যেই না পটাইয়ের জামের থোকা ধরে টান দেওয়া, ওমনি বনবন করে ভিমরুলের উড়তে লাগল বাতাসে।পটাই আআ, উউ করছে।অমল তাকিয়ে দেখে তার খালি পিঠে কালো কালো ভিমরুল কামড়ে বসে আছে।সে তাদের কামড়ের যন্ত্রনায় যেমন চেঁচাচ্ছে তেমন এক হাত এদিক ওদিক ছুড়ে তাদের ছাড়ানোর মরিয়া চেষ্টা করছে।

এর মধ্যে অমলও বাদ যায়নি তাকেও কামড়ে দিল দুটো।গতিক ভালো না দেখে পটাইকে বলল

…পটাই লাফ মার,নাতো আরো আরো কামড়াবে।লাফা, লাফা রে।

বলেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ল পুকুরের খোলে।খানিকটা জলে ,খানিকটা জলের কিনারার কাদায়।

পটাইও লাফাতে গিয়ে ডালে আটকে চিৎপটাং করে পড়ল জলের কিনারায়।তার শরীরের কোমর থেকে পা পর্যন্ত এখন জলে।মুখে,বুকে কাদা গেল লেপে।মুখের কাদা আঙ্গুল দিয়ে ছাড়াতে ছাড়াতে হামাগুড়ি দিয়ে উঠছে।যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে।

…আ, মরে গেলুম রে,মরে গে...

পটাইয়ের অঙ্গভঙ্গি দেখে,

অমল নিজের যন্ত্রণাও ভুলে গেছে।হাসি চেপে রাখতে পারছে না।

…শালা, মর এবারে।ভিমরুলের চাককে বলে কিনা কালো কালো জাম?জাম বলে পাড়বি,আর সে ছেড়ে দেবে?খা শালা,ভিমরুলের কামড় খা।

অমল হাসতে হাসতে পটাইকে টেনে তুলল পাড়ের উপর।কচু গাছ টান মেরে ছিঁড়ে নিয়ে পরস্পর পরস্পরের গায়ে ঘষে ঘষে দিতে লাগল।

বাঁশ ঝাড়ের তলা দিয়ে পুঁটি ও টুম্পা আসছিল।মাঠে খেলা দেখতে যাবে বলে।ওরাও অমলদের হাইস্কুলে একই ক্লাসে পড়ে, সমবয়সী।অমলদের দেখে টুম্পা জিগ্যেস করল

…এই তোদের কি হয়েছে রে।কচু গাছ নিয়ে কি করছিস?

……ভিমরুল হুল ফুটিয়েছে।শালা টুস টুসে জাম খাবে,জামের থোকা না পেড়ে ভিমরুলের ঝাঁকে হাত দিয়েছে মনে হয়।আর ওরা ছেড়ে দেবে?আরে দেখনা পটাইয়ের গালে,বুকে,পিঠে কত বড় বড় জাম ফুলে উঠেছে।

টুম্পা আর পুঁটি কচু গাছ হাতে নিয়ে ওদের পিঠে ঘষে ঘষে দিচ্ছে আর মুচকি হাসছে।

পুকুরের ওপাড়ে কৎবেল গাছের তলায় দাঁড়িয়ে ছিল কালা বিশে।এ দৃশ্য দেখে তার টনক নড়ে গেল।বিড়ি ফুকতে ফুঁকতে বাঁশ ঝাড়ের তলায় তাদের দেখে কি ভেবে বারবার মাথা দোলাতে মাঠেই নেমে গেল।

এদিকে সঞ্জয়কে কাঁধে করে অন্যরাও পটাইয়ের কাছে এসে বসে পড়ল। অমলের চোখের জল আর বাধ মানছে না।বৃষ্টির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।

…এই সঞ্জয় তোর মনে আছে?সেই বৈশাখ মাসের জোৎস্না রাতে বাবুদের মিঠে আমগাছ থেকে মিঠে আম পাড় 

ছিলি তোরা। সেজবাবুর আর ছোটবাবুর মেয়ে টুকু আর পুটু সেজ বাবুকে নিয়ে তোদের ধরতে এল।গাছের তলায় এসে যখন টর্চ মেরে মেরে কাউকে দেখতে না পেয়ে চলে যাচ্ছিল ঠিক তখনই পটাইয়ের চটি দেখে টুকু চেঁচাতে লাগল

…এই শয়তান,পাজি ছেলে নাম বলছি।আম গুলো সব শেষ করে দিলি।অসভ্য, ছোটো লোক।

সেজ বাবু তোতলাতে তোতলাতে ক্ষোভ উগরে দিল

…ছোছোছোট লোক কিনা?জজজন্মের ঠিঠিঠিক নেই।ওওওদের বাপ-মায়ের ঠিঠিঠিঠিক আছে নাকি?

এসব কথা শুনে পটাইয়ের মাথা গেল বিগড়ে।ব্যাগ ভর্তি আম গুলো দিল উপর থেকে ঢেলে হুড় হুড় করে তাদের মাথার উপর।

সেজবাবু ক্ষেপে গিয়ে আরো তোতলাতে লাগল।রাগে কথা যেন সম্পূর্ণ করে উঠতে পারছে না।

…ভ ভ ভ ভ ভ ভয় দে দে দে দেখাচ্ছিস.....

তাঁর মুখের কথা শেষ না হতে হতে তড়াৎ করে পটাই লাফিয়ে পড়ল সেজ বাবুর গায়ে।টর্চ গেল ছিটকে পুকুরে।

টুকু,পুটু,আর সেজবাবু ভয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে পালাল।

…ভূ ভূ ভূতত... রাম রাম রাম...


( ৩ )


পাড়ার লোকজন এই বিপদ মাথায় নিয়েও বাবুদের পাড়ে এসে একে একে, দলে দলে হাজির হচ্ছে।পাড়টা এখন যেন কান্নায় ভিজছে।সকলের চোখের জলের সঙ্গে যেন কৎবেল গাছের জল ঝরে পড়ছে টপ টপ করে।কচু পাতায় পড়ে তা পিছলে যাচ্ছে নিমেষে।

পটাইকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে চলল তাদের বাড়ির দিকে পিছনে সেই ছেলের দল।মুখ থেকে কারোর যেন কথা বেরুচ্ছে না।


মদন দোকানদার কাকে যেন ফিসফিস করে বলছে

...এরাই কিন্তু এই খরকালে অক্ষয়কে ভয় দেখিয়ে ছিল।তাদের তার মূলে ছিল এই অমলাটা, আর পটাইটা।

এ কথাটা ফেলনা না।সত্যিও বটে।চৈত্রের ধান মাঠে থেকে উঠে গেছে।ডাকাতের উপদ্রব।প্রায় বছরই ডাকাতি হয় কারো না কারো বাড়িতে।পাড়ার ছেলেরা দল বেঁধে নাইট গার্ডের কাজ করে বিনা পয়সায়।হাতে তাদের টর্চ,বাঁশের লাঠি,থলে ভরা ইঁটের টুকরো।

তাদের এই সচেতনতায় দু বছর ডাকাতি হয়নি।অনেকেই নিশ্চিতে ঘুমালে কি হবে?এরা কারো কারোর নারকেল গাছের নারকেল, ডাব, সবেদা, লেবুর সর্বনাশ করতো।

অক্ষয়ের একটা পাতি লেবুর গাছ ছিল।পাড়ার ছেলেদের সে মুনে থাকতো।রাস্তার গায়ে লেবু গাছটা।রাতে শোবার আগে বিড়ি জ্বেলে উঠোনে পাক খেত।আবার কখনও মশারির ভেতরে ঢুকে মুন্ডুটা বের করে সামনে কেরোসিনের ল্যাম্প থেকে বিড়ি জ্বালাত পাক দিয়ে দিয়ে।

সেই রাতে ঐ রকম মুণ্ডটা বের করে বিড়ি পাক দিয়ে দিয়ে জ্বালাচ্ছিল।আর মাঝে মাঝে গলা খেঁকর দিচ্ছিল।টিমের নির্দেশ মতো পটাই আর অমল সেই সময় লেবু চুরি করার জন্য ওদের উঠোনের পাশে পুকুরের খোল থেকে উঠে লেবু গাছের কাছে যাবে।কিন্তু অক্ষয় যেন আজ কিছু টের পেয়ে গেছে।কিছুতেই ঘুমাতে যাচ্ছে না।ল্যাম্পও নিভাচ্ছে না।রাত প্রায় দুটো বাজে।পটাই আর ধৈর্য রাখতে পারছে না।পুকুরের খোল থেকে হুড়মুড় করে উঠে তেড়ে গেল অক্ষয়ের মশারির দিকে।

…শালা,শুয়ার,এখনো বিড়ি জ্বালান হচ্ছে?দেব একটা পেটো তো ঝেড়ে।

লাঠিটা নিয়ে বাঁশের খুঁটিতে দিল বার কয়েক।

অক্ষয়ের বাড়িতে সে রাতে তার ছেলে বউ কেউ ছিল না।পড়িমরি করে,মশারি ছিঁড়ে উঠে পালাতে গেল।মশারির কাপড়ে জড়িয়ে আছাড় খেয়ে পড়ল উঠোনে।পরনের লুঙ্গি গেল খুলে উলঙ্গ হয়ে দিল দৌড়।

...বাঁচাও, ডা ডা ডাকাত।বাঁচাও...

সে রাতে পাড়া তোলপাড় হলেও পটাই ও অমলদের উপর অনেকের সন্দেহের তীর নিযুক্ত ছিল।

বৃষ্টি থামতে সারা গ্রাম যেন উজাড় হয়ে এল।কান্নার হা-হুতাশের তোয়াক্কা না করে পটাইয়ের মার কোল থেকে পটাইকে কেড়ে নিয়ে রাতেই শশ্মানে তার নধর নীথর দেহ পুড়িয়ে বাড়ি ফিরল সবাই।

রাতে বিছানায় অমল ছটফট করছে।ঘুম আসছে না।পটাইয়ের জন্য চোখ ভিজে যাচ্ছে ।তার মনে পড়ছে বাবুদের চৈতেকালী পূজার রাতের কথা।

ভিডিও হচ্ছে বাবুদের বৈঠকখানার উঠোনে।খড়ের বিছানা করে সারা রাত ভিডিও দেখছিল।হঠাৎ ভোরের দিকে পটাই আর সঞ্জয় তার কাছে আসে।

…পেট চোঁ চোঁ করছে।এখন তো বাড়ি যাওয়া যাবে না।কিন্তু কিছু না খেলে মরে যাবো?

...ভাই কিছু একটা ব্যবস্থা করে দে।

…আমি কোথা থেকে পাবো?

পটাই অমলের পা ধরে বলে 

…আজ যদি এই খিদে পেটে মরে যাই,আমার এই অতৃপ্ত আত্মা সবসময় তোর কানের কাছে ফিসফিস করে বলে বেড়াবে …খাবার দে, খাবার দে...

…পাগল হলি নাকি সব।তবে একটা উপায় আছে।তোরা জেনারেটরের কাছে যা।স্নানের ঘাটের কাছে চলছে।কেউ এখন ওদিকে যাবে না।যেই হুলুস্থুল বাধবে তখন ওর চাবিটা নামিয়ে দিবি, বেশ।

ভিডিওতে তখন চলছে 'মর্দ'।অমল হটাৎ সাপ সাপ করে চেঁচিয়ে ওঠে।

…কই কই।

…ঐ যাচ্ছে ,ঐ যাচ্ছে।

কে আর ভালো করে দেখে।সঙ্গে সঙ্গে জেনারেটরের গেল বন্ধ হয়ে।ডিভিও গেল ধপ করে নিভে।চারদিকে অন্ধকার চেপে বসল।ছেলে-পুলে,মাদুর-ঝ্যাদলা নিয়ে যে যার মতো এদিক ওদিক লাফালাফি করতে লাগল।

অমল আর সেখানে নেই।

লোকও গেল কমে।ঐ হট্টগোলের মধ্য থেকে কেউ কেউ বলছে

…তেল নেই বোধহয়।তাই জেনারেটর বন্ধ হয়ে গেছে।

…না না, কেউ জেনারেটর বন্ধ করে দিয়েছে?কে?কে রে?

আর কে কোথায় ?

যখন জেনারেটর আবার জ্বলল, তখন অমল গেঞ্জির কোঁচর থেকে সঞ্জয়ের গামছায় কি এক গাদা দিল ঢেলে... ফলমূল,সন্দেহ,লুচি আর একটা মিষ্টির খাম।

এসব ভাবতে ভাবতে অমল কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল কে জানে?


( ৪ )


সে বছর খুব বৃষ্টি হয়েছিল।মাঠের ধান গাছ হেজে গিয়ে জলে মিশে গেল।গ্রামের কোলে কোলে পাড়ের গায় দু একজনের যা একটু আধটু ধান গাছ বেঁচে রইল।পুকুরের পর পুকুর ভেসে গেল।পুকুরের মাছ বেরিয়ে গেল মাঠে।খালে।এখন মাঠ, পুকুর, খাল,রাস্তা সব এক।মিলে মিশে একাকার।দিনের বেলায় ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ভাসতে দেখা যায়।কেউ কেউ জাল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

দূরে মহেশ গঞ্জের বাজারে যাতায়াত প্রায় বন্ধ।রাস্তা আছে ডুবে।কোথাও কোথাও ছিঁড়ে হয়ে আছে।রাস্তা না খাল বোঝা যায় না।

কারো কারো বাড়িতে সারাদিন উনুন জ্বালে না।পেটের জ্বালায় লোকজন হা হা করতে লাগল।বাবুদের গোলায় হামলে পড়ল অনেকেই।বাবুরা লোকজন জুটিয়ে এনে বেশ করে পিটিয়ে কারো কারো মাথা ফাটিয়ে দিল।

সরকার থেকে পাউডার দুধ আর চিড়ে-গুড় বিলি করার ব্যবস্থা হল।নৌকায় করে এল বস্তা বস্তা চিড়ে গুড়।বাবুদের বৈঠকখানা থেকে বিতরণ হচ্ছে।যতটুকু বিলায় তার বেশি চুরি করে।কিন্তু যায় কোথায়?

পাড়ায় পাড়ায় ছেলেদের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়

…সরকারের সাদা চিঁড়ে
বৈঠকখানায় যাচ্ছে উড়ে।
বস্তা বোঝাই ভেলি গুড়
সেজ বাবু মহিষাসুর।

কয়েক দিনে জল কমেছে।কিন্তু পেটের জ্বালা কমেনি।

ত্রাণ বিতরণের শালতি নৌকা নিয়ে ছেলেরা মাঝে মাঝে ভেসে যায় এমাঠে, সেমাঠে।

একদিন অন্ধকার প্রায় হয় হয়।সঞ্জয় অমলের কাছে এল।ফিসফিসিয়ে বলল

…বাবুদের আজ রাতেই আমি পুড়িয়ে মারবো।

নৌকা বাবুদের পাড়ের গাছে বাঁধতেই সঞ্জয় লাফিয়ে পালিয়ে গেল।


( ৫ )


গ্রামগুলো জ্যোৎস্নার ডুবে আছে।চারদিকে জল আর জল।বাতাসে ধাক্কায় তরতর করে ঢেউ উঠছে জলে। পূর্ণিমা চাঁদের অনাবিল ছটায় সেই ঢেউ যেন খিলখিল করে হাসছে আর ছলাৎ ছলাৎ করে দূরে সরে সরে যাচ্ছে।হঠাৎ কারা যেন চেঁচিয়ে উঠল 

…আগুনননননন, আগুনননন...

অনাহার ক্লিষ্ট শরীরে ঘুমই বা হয় কোথায়?হকচকিয়ে অনেকেই উঠে পড়ল।দেখে,দাউ দাউ করে জ্বলছে বাবুদের গোলা।ধানের গোলা থেকে ফটফট করে খৈ ফোটার আওয়াজ আসছে।বাতাসে পোড়া ধানের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে প্রতি মুহূর্তে।একটার পর একটা গোলায় আগুন ধরছে।বাবুদের সেই লোকগুলো বালতি বালতি করে জল ঢেলে আগুন নেভানোর চেষ্টা ঝরছে।

বাঁশের গাঁট ফাটছে থেকে থেকে।লোকজন জড় হয়েছে বেশ।কেউ কেউ হাসছে।কেউ কেউ বলছে

…ঠিক হয়েছে।ঠিক হয়েছে।

আগুন একটু কমে এসেছে।হটাৎ পবন চামচা চেঁচিয়ে উঠল

…বাবু পেয়েছি।ওই শালা ছোটো লোক নগেনের ছেলেটাই আগুন দিয়েছে।শোনামাত্র অমলের বুক কেঁপে উঠল।সেজবাবু রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে গর্জন করছে

…আন হাহাহারামজাদাকে পিষ মোড়া করে বেঁধে আন।

কারোর অনুরোধ শোনেনি সেজবাবু। না সঞ্জয়ের বাবার কথা,না কারো কথা।পরের দিন সকালে তাকে নাকি সদরে চালান করে দিয়েছে।সঞ্জয়ের কোনো খবর কেউ পায়নি।

পটাইয়ের মায়ের মাথার চোট এখন কাঁচা।দগদগে ঘায়ের মতো।সকাল থেকে তার মাথা ঘুরছে।ঘুরবেই না বা কেন, দিনের পর দিন না খেয়ে থাকলে তো তাইই হবে।পটাইয়ের ছোটো বোন আর ভাইটার মুখে তার মা-বাবা কিছুই ঠিক মতো তুলে দিতে পারেনি।তাদের পেটটা না ভরিয়ে নিজেরা বা গালে তুলে কি করে।

তবু এই কয়দিন খাম আলু তুলে তুলে তাই সিদ্ধ করে করে দিয়েছে।বড়দের এই সেদ্ধ আলু গলা দিয়ে নামে না,তো বাচ্চাদের?পটাইয়ের ভাইটা খাবে না বলে থালাটা ঠেলে দিয়েছিল।

তার মা আর নিজেকে সামলাতে পারেনি।ঠাস ঠাস করে চড় কষিয়ে দিল গালে।

…মর মর,একটা তো গেছে।তোরা দুটো গেলেই বাঁচি।

হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকে দরজা দিয়ে বসে ছিল।

বেশ কিছুক্ষণ পর একটা হাঁড়ি কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেল মাঠে।মাঠে বেশ শালুক হয়ে আছে।

পটাইয়ের মা এখন শালুক তুলছে ডুবে ডুবে।সন্ধ্যা হয় হয়।বাড়ি ফিরবে ফিরবে করছে।দেখে একটা হাঁস ধান গাছের সঙ্গে জড়িয়ে কাঁক কাঁক করছে।

কি যেন মাথায় একটা খেলে গেল তার।কি একটু ভেবে কাছে এসেই হাঁসটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে,দিল ঘাড় মটকে হাঁড়িতে ফেলে।ঘাস ঢাকা দিয়ে নিয়ে এল বাড়িতে।

আবছা অন্ধকার।কৃষ্ণ দ্বাদশীর মরা জোৎস্না ম্লান হয়ে পড়ছে।হঠাৎ আরো একবার শোরগোল পড়ে গেল।

অমল মার সঙ্গে পটাইদের উঠোনে গিয়ে দেখে, একটা হাঁড়ি পরে রয়েছে ,তার চারদিকে মাংসের ছড়াছড়ি।সনকার মা ডাকপোরে চেঁচাচ্ছে।

…হারামজাদি মাগি।আমার হাঁস মেরে খাওয়া।একটা ছেলের মাথা খেয়ে আশা মেটেনি তোর?আমার ডিম পাড়া হাঁসটা মেরে দিলি।

লোকজন জুটতে আর বাকি রইল না।

সেজবাবুও এসে বলে গেল 

…আজ যে যার বাড়ি যাও।কাল বিচার হবে।

একে একে সবাই চলে গেল।মাংস-হাঁড়ি তেমনি রইল পড়ে।মাথা নিচু করে ছোট মেয়েটার হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল পটাইয়ের মা।মুখে কোনো কথা নেই।অপমানে যেন সে মাটিতে মিশে যাচ্ছিল।

ধীরে ধীরে মেয়ের হাত ধরে বারান্দায় বসে পড়ল।মেয়েটা কোলে পড়ল ঘুমিয়ে।দূর থেকে মোরগ ডাকার আওয়াজ আসছে ভেসে।

অমল আর ঘুমালো না।বড়শি গুলো নিয়ে বেরিয়ে গেল মাঠে।অন্ধকারে একটার পর একটা বড়শি ফেলে ফেলে চলে গেল খাল পাড়ের দিকে।

খাল পাড়ে উঠে বসে রইল কিছুক্ষণ।ছেলে পোতা থেকে শিয়ালের ডাক ছড়িয়ে পড়ছে করুন ভাবে। শুনে অমলের গা কাঁটা দিচ্ছে।

পটাইয়ের কথা তার খুব মনে পড়ছে। সকালের আলো ফুটতে সে আবার নামলো জলে।

বেশ মাছ গেঁথেছে বড়শিগুলোতে।বেশ আনন্দ হচ্ছে তার মনে।বাবুদের পাড়ের কাছে এসে হাঁড়ি টেনে নিয়ে ডাঙায় উঠতেই কি একটা লাগল তার মাথায়।পিছন ফিরে দেখে পটাইয়ের মার শরীরটা ঝুলছে ঝাউগাছ থেকে। তার ধাক্কায় এখন সেটা এদিক ওদিক দুলছে।আর্ত চিৎকারে অমল বড়শি সমেত হাঁড়ি ফেলে দিল দৌড়।

দুপুর গড়িয়ে গেল।

ত্রাণের নৌকায় করে মৃত দেহ নিয়ে গেল মহেশগঞ্জে।

যখন সবাই সৎকার করে ফিরছে তখন কত রাত কে জানে? নৌকা আটকে গেল পানায়।অমল ঘুমিয়ে ছিল নৌকার খোলে।হটাৎ কি একটা লাফিয়ে পড়ল তার কোলে। চোখ মেলে দেখে চারদিকে জল আর জল।উপরে সাদা সাদা মেঘগুলো ভেসে যাচ্ছে দূরে দূরে।একটা তারা যেন তার দিকে জ্বল জ্বল করে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে।

রাজেন জ্যেঠু হ্যারিকেনের আলোটা বাড়িয়ে দিয়ে দেখে একটা চিংড়ি ছটফট করছে অমলের কোলে।

...ও অমল কতবড় চিংড়ি দেখ।ধর ওঠাকে।

অমল নিমেষের মধ্যে ওঠাকে ধরে দূরে ছুঁড়ে দিয়ে চেঁচাতে লাগল

...পটাই,পটাই রেএএএএ...

জলো হওয়ায় সেই স্বর ভেসে গেল দূরে দূরে...।




হঠাৎ লোকের ধাক্কার অমল সম্বিৎ ফিরে পায়।ঘোষণা হচ্ছে

... ডাউন ট্রেন লক্ষ্মীকান্তপুর

দশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে এখনই ছড়াবে।

ট্রেন শহর ছেড়ে চলল গ্রামের দিক।দুধারে জল চিকচিক করছে।কচি কচি ঘাস, বীজ ধানের চারা সাঁতরে সাঁতরে উঠতে চাইছে জলের উপরে।অমল সেই দিকে তাকিয়ে কাদের যেন খুঁজছে তো খুঁজছে।

সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সেও যেন তলিয়ে যাচ্ছে বারবার।

ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল আবার।একটা বাচ্চা ছেলে তার মার কোলে বসে জানলা থেকে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ধরছে আর বলছে

........

আয় বৃষ্টি ঝেঁপে
ধান দেব মেপে।
ধানের ভিতর পোকা
জামাই শালা বোকা।

শুনেই তার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল সঞ্জয়ের জন্য,পটাইয়ের জন্য।

কেমন যেন ঝাপসা গেল সবটা।আলতো হাওয়ায় তখন জলের ঢেউ বইছে তর তর করে।বৃষ্টি আছড়ে পড়ছে টাপুর টুপুর শব্দে।জলতরঙ্গে বৃষ্টির সেই অনুরণিত শব্দ যেন বাতাসে ভাসতে ভাসতে বলে বলে যাচ্ছে

…… 

"চলল সেথায় যে-দেশ থেকে
দেশ গেছে তার মুছে,
মা মরেছে, বাপ মরেছে,
বাঁধন গেছে ঘুচে।"

0 comments: