2

বইঘর - পল্লববরন পাল

Posted in

“ঘুমোই চশমা চোখে” – এক নির্জন আমি আবিষ্কার
পল্লববরন পাল

প্রাণ কি বুদ্বুদ তবে, তেপান্তর থেকে একা ভূমি ও হাওয়ায় 
গড়িয়ে এসেছে আজ এত দূর? নাকি সাত সমুদ্রের জলে
আর তেরো নদীকূলে ভেসে উড়ে হেঁটে দৌড়ে সূর্যাস্ত পেরিয়ে 
রমণীয় দিবালোকে রামধনুর রঙে জ্বলে আশ্চর্য ঝিলিকে?... ... [ভাসা]


বইয়ের প্রথম কবিতার প্রথম চারটি পংক্তি। বিখ্যাত ইংরেজি প্রবাদটা মনে পড়ছে, কিন্তু এ বই পড়ার পরে উচ্চারণ করতে ইচ্ছে করছে না – তাই বাংলা করে বলি - ভোরই জানে সারাদিনের ঠিকানা। ওপরের কবিতার নাম ‘ভাসা’। হ্যাঁ, তেপান্তর তো বটেই। সুদূর চট্টগ্রাম থেকে ভূমি ও হাওয়ায় ভেসে উড়ে নাকি জলরাস্তায় হেঁটে দৌড়ে প্রাণ পৌঁছে গেছে আমার শহর কলকাতার মহাপ্রাণে। নিমগ্ন পাঠক ইতিমধ্যেই রামধনুর অতিকায় দিগন্তদৈর্ঘ্যে এবং সরল বক্রতায় ঋদ্ধ হয়ে উপাসনা ঢঙে পা মুড়ে বসেছেন কবি খালেদ হামিদীর মুখোমুখি। কবির মুখোমুখি? – নাকি তাঁর সৃষ্টির? বইয়ের নাম ‘ঘুমোই চশমা চোখে’। চার ফর্মা। ক্রাউন মাপ। প্রকাশক ঋতবাক। প্রথম প্রকাশ ২০১৯ জানুয়ারি। তৃতীয় পংক্তির শেষে সূর্যাস্ত পেরিয়ে যে গোধূলিকাল – লক্ষ্য করুন পাঠক – কবি হামিদী তাকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলছেন ‘রমণীয় দিবালোক’ – বইয়ের চতুর্থ পংক্তিতেই কলমের প্রবল স্বাস্থ্যে পাঠক আশ্বস্ত ও মগ্নতর অবগাহন প্রত্যাশী। 

গত শতাব্দীতে কৃত্তিবাস যুগ থেকেই আস্তে আস্তে বাঙলা কবিতায় ভৌত ও রাসায়নিক বদলের সন্তর্পন শুরু। কবিতা আদতে কবির নিভৃত আত্মরতির ফসল। তাই সময়ের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের সুবাদে এবং স্বাভাবিক রতিধর্ম অনুযায়ী সেও বড়ো আপাত অস্থির ও বিশৃঙ্খল। সাধারণ সাহিত্য পাঠকের অভিযোগ – এই অস্থিরতার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো ধৈর্যশীল সময় আজকের জীবনী আর নেই। তাই কবিতা ক্রমশ পাঠকের কাছে দুর্বোধ্য। আমাদের যাপনের মধ্যেও তো অসংখ্য দুর্বোধ্যতা – আর, কবিতা তো যাপনেরই একটা বিশেষ ভঙ্গিতে অনুবাদ। প্রথম বাঙলা কবিতা বলে স্বীকৃত চর্যাপদের ভাষাকে বলা হতো সন্ধ্যাভাষা – অর্থাৎ গোধূলির ছায়াময় আলোআঁধারি বা কবি হামিদীর ভাষায় ঐ ‘রমণীয় দিবালোক’ বাঙলা কাব্যের জন্মাবধি বৈশিষ্ট্য। এই দুর্বোধ্যতার অভিযোগের প্রতিবাদে কিম্বা অভিমানে শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘ধর্মেও আছো জিরাফেও আছো’ বইটি উৎসর্গ করেছিলেন ‘আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্য পাঠক’কে। 

সিনেমা বা শিল্পকলার মতো কবিতারও নিজস্ব ভাষা আছে – নিজস্ব প্রকাশভঙ্গী আছে – নির্মাণশৈলী আছে। গত শতাব্দীর মধ্যভাগে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের উত্তরাধিকার সূত্রে আশির দশক বাঙলা কবিতায় সঙ্কেত ও প্রতীকের ব্যবহারে আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে। প্রবন্ধের মতো কবিতার শেষে পাদটীকা লাগানোর নিয়ম নেই। লাগানো যায়ও না। সেগুলি খুঁজে নেওয়া মগ্ন পাঠকেরই দায়িত্ব। বিষ্ণু দে’র কবিতার ইতিহাস ও সমাজচেতনার নাগাল পেতে হলে পাঠককে শিক্ষিত হতে হবে। সুধীন্দ্র নাথের ভাষায় ‘যে দুরূহতার জন্ম পাঠকের আলস্যে, তার জন্য কবিকে দোষারোপ অন্যায়’ – তাই তাঁর ‘নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনার’ কাছাকাছি পৌঁছোতে পাঠককে তৎসম শব্দ ভেদী মানসিক পরিশ্রম করতেই হবে। বোধগম্যতার নিরিখে এগুলিকে কবির দুর্বোধ্যতা বলা ঠিক নয় বরং বলা উচিত আধুনিক পাঠকের মেধা ও মননের কাছে কবির মাননীয় ও মর্মান্তিক দাবি। 

ও বি হামিংবার্ড,
তুমি কি হাভানা থেকে আসো খুব উড়ে,
নিজের চারদিকে নাকি আমি মরি ঘুরে!
পরিযায়ী পাখি নও ভুলেও কখনো;
তথাপি উড়াল তোর ক্রমাগত ঘন।... ... [ও বি হামিংবার্ড]

এখানে ‘তথাপি’ শব্দটা উচ্চারণে একটা আলাদা সমীহ নিজের অজান্তেই পাঠক ঘোষণা করে ফেলে। এই ধরণের না-চলতি সাধু তৎসম শব্দ প্রয়োগ কবি খালেদ হামিদী এই কাব্যগ্রন্থে একাধিকবার করেছেন – অর্থাৎ সচেতনভাবেই এই সদ্যপ্রাচীন শব্দসমূহ প্রয়োগে বিষ্ণু দে’র উত্তরাধিকারী এই কবি তাঁর কবিতার সময়কালকেও চুইংগামের মতো বিস্তৃত করেছেন। তাই নিউটন থেকে নেইমার – আপেল থেকে উরুসন্ধি – কবি হামিদী পাশাপাশি সকাল আটটার রোদ্দুরের মতো ভীষণ রকম সাম্প্রতিক ও উষ্ণ। 

...শার্ট খুলে ভালোবাসা দেখাতেই চাই তবু কার প্রহরায়?
বৃষ্টিহীন বহু দূরে দ্বাদশী চাঁদের নিচে ছাতার আড়ালে,
ম্লান বস্ত্রে হেঁটে যান কে? রবীন্দ্রনাথ? বঙ্গবন্ধু? দূরতর
নমঃশূদ্র বংশপিতা নাকি, নতশির, যিনি দেখেননি তাঁদের! ...[ভালোবাসা দেখাতেই চাই] 

এ বইয়ের পাতায় পাতায় অনেক দুর্গম চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন কবি হামিদী – যার মধ্যে অনেক অর্থস্তর আছে – সঙ্কেত আছে – আমাদের আটপৌরে রোজকার যাপন-টুকরো দিয়ে গাঁথা – যেখানে পাঠকের নিবিড় মগ্নতায় বাধ্য হয়ে দ্রবীভূত হয় এক তীব্র বিহ্বল আগ্রাসন - 

জল না ফুরালেও অগ্নি নিভুনিভু।
এ কোন্‌ রসায়ন শোনাও তবে আজ?
জানার পুরোভাগে নাভিতে হাত কার
পাখির সংবাদে যে পোড়ে বিদ্যুতে? ...
তাহলে ডর কিসে, তোমারও কোথা জয়?
পানি কি আগ নয়, গীতেই বরাভয়? ... [জল না ফুরালেও] 

অথবা আরো দুর্গম জটিল চিত্রকল্পের গহন অরণ্যে অবধারিত পাঠককে অমোঘ চুম্বকে টেনে নিয়ে যান দুর্নিবার আকর্ষণে –

...তোমারই পরম গর্ভে আমার পুরোনো জন্ম, নবজন্ম
কি পুনর্জন্মের মাঝে আর মধ্যে কতো 
বহিরাগতের ভাসমান প্রাণিত সাঁতার!
এসবেরও ঢের পরে নখ ভেঙে যায় প্রেক্ষাপটে;
কাটা পড়ে স্বপ্নাদিষ্ট অমর আঙুলও। ... [প্রেক্ষাপট] 

পাশাপাশি কী নিটোল অনায়াস স্পষ্টতায় কবি হামিদী গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সেই হামিংবার্ড নারীর প্রেরিত প্রেমপত্র বুকে নিয়ে সঠিক নাম খোঁজেন আর পতঙ্গসম পাখির উড়ানে হাজারো ফুল, প্রতিদিন, ছন্দে-লয়ে, বর্ণের বাগান অতিক্রমনের স্বপ্ন দেখেন। সহজ এবং প্রাচীন মাত্রাবৃত্তে লেখেন – ...পক্ষীকুল পোশাকহীন, তথাপি না-নগ্ন

তাই দাও পালকগুচ্ছ, হই মিলনমগ্ন। ... [নারিকেল তলে] 

আবার ‘তথাপি’ – দেখেছেন পাঠক? এরকম আরো অজস্র উদাহরণ আছে – এই কবিতার নামটাই তো ‘নারিকেল তলে’ – জীবনানন্দকে মনে পড়ে না? আবার অন্যত্র যেন ঢোল বাজাতে বাজাতে বা নাচতে নাচতে অতি পরিচিত ছড়ার ছন্দে লিখছেন – 

তাজ মহলের গায়
ছিদ্র দেখা যায়।
কাহার আঁধার, কাহার আলোক, লজ্জা কে লুকায়! ... [তাজ মহলের গায়]

এখানে ‘ছিদ্র’ ও ‘কাহার’! ‘আমি কোন্‌ কেতনতলে চুমু আঁকলে / আমার, তোমার সঙ্গে শুরু হয় অবিরল জীবন বদল?’ [আমার চুম্বন মাত্র]। ‘তুমি কোথা! আমি পানি, গড়াই কর্দমে’ [পুলিশি ট্রাকের নিচে]। ততসম শব্দ নিয়ে বাঙলা সাহিত্যে এ ধরণের কাজ সম্ভবত শেষ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। এই সাধু-অসাধু শব্দের মিশেলে আজকের বাংলা সাহিত্যে বিরল এক সম্পূর্ণ নিজস্ব কাব্যশৈলী তৈরি করেছেন কবি হামিদী। 

“Man is least himself when he talks in his own person. Give him a mask, and he will tell you the truth.” (Oscar Wilde) দাড়িপাল্লা হাতে কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে সত্য প্রকাশের রীতি বিচারালয়ে। কবিরও দায় সত্য কথনের। একমাত্র মুখোসের আড়াল থেকে লেখা হয় বলেই শেষ অবধি কবি ও পাঠক উভয়ের কাছেই কবিতা সৎ ও সার্বজনীন।

...আমি কাজী নজরুল অনুধাবনে বিফল বলে
প্রাচীন কবর থেকে উঠে
শীর্ণ গোরস্তানের সীমান্তে একাকী দাঁড়িয়ে
ডুকরে কাঁদছেন আমার বংশপিতা। ... [আমি কাজী নজরুল অনুধাবনে ব্যর্থ]

এই কবিতাটির মধ্যে আরো কিছু কিছু অভিনব আলোর ইঙ্গিত আছে, যা পাঠক হিসেবে আমাকে ঋদ্ধ করেছে – 
...জগদ্ব্যাপী এমন মহত্ত্ব
না ঘটলে আমারই চক্ষু এতো কালো কিংবা
রক্ত এভাবে মন্দ্রিত হতো কিনা মালুম হবার
খানিক আগেই আছড়ে-পড়া ঢেউয়ের কিনারে
আমিই সটান, মৃত। তবুও পর্যাপ্ত খোলা আমারই দু’চোখ জুড়ে
মা তাঁর নামাজ শেষে দৈনন্দিন বাজারমুখো ঋণগ্রস্ত পিতার
হাতে নির্দ্বিধায় গুঁজে দেন সংরক্ষিত কাবিনের অংশ
স্বর্ণালংকারের
কয়েকটি টুকরো। 

প্রথম কথা, যা আগেই বলেছি, কবি হামিদীর তৎসম-ঝোঁক ও সাধু-অসাধু শব্দ নিয়ে বিপজ্জনক খেলা এবং প্রত্যেকবারেই সগৌরবে জিতে যাওয়ার নেশা – ‘চক্ষু’র পাশে ‘চোখ’ অথবা ‘পিতা’র পাশাপাশি ‘মা’ – এ তো আছেই। তৎসহ এ কবিতায় কবির পংক্তিবিভাজনও চলতি বিন্যাস পদ্ধতির থেকে একদম অন্যরকম ও দুর্দান্ত সাহসী। লক্ষ্য করুন পাঠক, অন্য যে কোনো কবি এই একই শব্দশৃঙ্খলে লিখতেন এইরকম বিন্যাসে – জগদ্ব্যাপী এমন মহত্ত্ব না ঘটলে / আমারই চক্ষু এতো কালো কিংবা / রক্ত এভাবে মন্দ্রিত হতো কিনা / মালুম হবার খানিক আগেই / আছড়ে পড়া ঢেউয়ের কিনারে / আমিই সটান মৃত। ... কিন্তু হামিদীর কবিতার চরিত্রও কবি হামিদীর মতো স্বতন্ত্র। উনি প্রথম পংক্তি ভাঙলেন মহত্ত্ব শব্দের পরে – কেন? জগদ্ব্যাপী মহত্ত্বের বিপুল পরিসর বোঝাতে কি ঐ শূন্য স্পেস দিলেন মহত্ত্ব শব্দের পরে? আবার তৃতীয় পংক্তিতে’উপলব্ধি-টব্ধি’ নয় – একেবারে সাদামাটা যেন চা-দোকানের লঘু আড্ডা থেকে তুলে আনা ‘মালুম’ শব্দটা এই চক্ষু বা পিতার তৎসম ভীড়ে কী অনায়াসে স্বচ্ছন্দ! এবং রক্তের মন্দ্রতাকে মালুম করা তো আর চাট্টিখানি ব্যাপার নয় – তাই ‘মালুম হবার’-এর পরে শূন্য স্পেস। তেমনি ‘ঋণগ্রস্ত পিতা’র অসহায়তার প্রতিধ্বনি চাইলেন ষষ্ঠ পংক্তির শেষের শূন্য স্পেসে। স্বর্ণালংকারের – একটা আপাত দীর্ঘ শব্দ – একটা আস্ত পংক্তি। ‘কয়েকটি টুকরো’ যেন পৃথক পরিচ্ছেদ – পৃথক নির্মাণ। সর্বোপরি, মৃত্যুও কিন্তু এই কবিতায় কবির কাছে ততোটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যে সে একটা পংক্তিচ্ছেদ দাবি করতে পারে! এই রকমই পংক্তিবিন্যাসের আর একটা উদাহরণ দিই –

বর্ণিল মোড়কে ঢেকে তদুপরে সরু
ফিতের ফুটিয়ে ফুল লাল, বলিনি তো
এরকম শরমসজ্জা বিলকুল তোমার
পক্ষে অসম্ভব ব’লে আমিই পুরুষ।... ... [পুলিশি ট্রাকের নিচে] 

শুধু তৎসম শব্দই নয়, কবি হামিদী বিশ্বায়ন পরবর্তী সময়ের কবি, তাই বিদেশী আদব ও শব্দ আমার দেশজ আঙ্গিকে অনায়াস আত্মীকরণে প্রবম মুন্সিয়ানা তাঁর – 

...সব দূর্গার সমস্ত হাত খসিয়ে কবিতাপুর
ফিরিয়ে নে আজ;- অল্প ভোজনে স্বল্প পানীয়ে নাচি,
ঘরে ও বাহিরে অধিক রমণে অসি-ট্যানট্রামে বাঁচি। ... [ও বন্ধু মহিষাসুর]

অথবা এই কবিতার শিরোনাম শব্দই তো বিদেশী ভাষার। থেকেই লক্ষ্য করুন পাঠক - 

...কোথা উঠিবো, কাঁহা ছুপাঁউ, বলো তুমি হে সারথি;
না কহিলেও নর-নারীর বসবাস কি, ডরোথি,
বুঝে নেবোই নারকীয়ই! ...
তু সঙ্গম, মে রঙ্গম, আযা পুকারি জসম;
ঘর ছোড়কে দিল্‌ দুঙ্গা, মেরা আঁসু কি কসম। ... [তামান্না]

বিভিন্ন শৈলীর কাব্যছন্দের কবিতার মধ্যে এ বইয়ে পাঁচটি টানা গদ্যে লেখা কবিতা আছে – এই পাঁচটি কবিতা স্টাইলে যেমন, বক্তব্যেও স্বতন্ত্রতা দাবি করে। কেন টানা গদ্যে লেখা? পাঠক হিসেবে আমার উপলব্ধি নিম্নরূপ - 

আমাদের আধুনিক বিশ্বায়িত জীবন ও তার যাপন প্রণালী ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। আমরা জানতাম, প্রত্যেক প্রাপ্তবয়সী মানুষের মধ্যেও তার শৈশব লুকিয়ে থাকে, যা আগাপাশতলা এক সহজ সরল জল-স্বচ্ছ যাপন অভিজ্ঞতা। সেই শৈশবও তো আজকাল আর নেই। জীবন অত্যন্ত কর্কশ ও গদ্যময়। আধুনিক বাংলা কবিতাও তাই সেই জটিল নাগরিক জীবন যাপনের প্রতিচ্ছবি। 
...আশাতীতরূপে জনাকীর্ণ হয়ে-ওঠা ওই সভাস্থলে, মঞ্চের দূরস্থিত বিপরীত দিকে হতে লোকতরঙ্গের ভেতর দিয়ে ধীর বেগে মঞ্চমূখো গতিশীল রবি ঠাকুরের জামার পকেটে, সমাবিষ্ট প্রত্যেকেরই অজ্ঞাতে কে যেন পিস্তল রেখে দেয়। ...[রবি ঠাকুরের পকেটে পিস্তল] 

... আর, যারাইবা আমাকে সবান্ধব ষোলো ঘন্টা হাজতবাসে বাধ্য করে, তাদের পূর্ব ও পরবর্তী ন্যুনপক্ষে আঠারো প্রজন্মেরও অবগতির বাইরে থেকে যায় লেনিন কেন দৈনিক ষোলো ঘন্টা অধ্যয়নে অভ্যস্ত থাকেন এবং কেনইবা তাঁর উৎপাটিত মহান ভাস্কর্যের ওপর মূঢ়দের নৃত্যদৃশ্য কারুর স্মৃতিকে রক্তাক্ত করে ফের। ...[পুলিশেরও বোধগম্য নয়]

মোট ছাপ্পান্নটি কবিতা নাগাড়ে একবার দুবার নয়, বারবার পাঠ করে যে কোনো সচেতন পাঠকের বাসনা – শব্দ বুনে বুনে যে সামগ্রিক কবিতা শরীর, তাকে দেখে ছুঁয়ে কবির বোধকে স্পর্শ করা – যে কোনো সৃষ্টিমাধ্যমই আসলে তো সৃষ্টিকারের ব্যক্তিগত বাথরুমের আয়না – আমরা কবিতার মধ্যে সেই মানুষটাকেই খুঁজি – ‘ঘুমোই চশমা চোখে’ পড়ার পরে অজস্র ক্রোধ, হতাশা, রাজনীতি ছাপিয়ে শেষ অবধি কবি হামিদীর রোমান্টিক প্রেমিক সত্ত্বাই কিন্তু নায়ক হয়ে ওঠে - 

...আমার পাঁজর গলে কে তুমি বেরিয়ে এসে, কোমরে কলস,
ধীরে হেঁটে যাও তবু দিগন্তের দিকে?
খালি কলসি কাঁখে কি হেতু চলিষ্ণু তবে?
তোমার অযোগ্য আমি মলিন একখানা ছোট থলে হাতে বসে
চাওয়া-না-পাওয়ার পয়সা গুনি চিরভিখিরির হেন।
অথচ ভ্রুকুটি ছুঁড়ে জলকে নয়, দৃপ্ত চলো তুমি
আকাশ ও মৃত্তিকার বিরান বিবাহস্থলে,
কেঊ পৌঁছুবার আগে যেখানে নিবিড় বাজে হাওয়ার সানাই
আর জ্বলে অসংখ্য তারার মিটিমিটি শামিয়ানা। ... [তোমার অযোগ্য আমি]

কবি হাহাকার করছেন ‘প্রেমের কবিতা আমি লিখতে পারি না, তবু’ শিরোনামে – অন্যদিকে লিখছেন ‘বর্তুল বুকের জোড়া কিশমিশ অথবা / লিপস্টিকময় দুই ঠোঁটের বহুত্ববাদ / স্পর্শের আলপনা আঁকে আমারও নানান / অনুভবে শুধু নয়, শিরার রক্তেও’। পাঠ শেষে উঠে হেঁটে যেতে যেতে অসাধারণ একটি প্রেমের কবিতার গন্ধ অমর হয় পাঠকের মগ্ন সত্ত্বায় – 

...তোমারই শোবার ঘরে সারা রাত বৃষ্টি হয়েছিলো।
কে ছিলো তোমার সঙ্গে অথবা কী?
দীর্ঘ শস্যগুচ্ছ আর ঘামের সৌগন্ধে পূর্ণ আমার বগল,
যৌবনের কথিত রাজপুত্র এ আমারই
যুগল অপরিণত গৌর স্তন,
দিঘল গোঁফের যতো কন্টক-শলাকা
নাকি নিম্নবর্তী ওই যুদ্ধবাজ অমঙ্গল? ...
অথচ এখনো ভেজা তোমারই বিলকুল সেই রাত্রির জামায়
মুখ ঘষেও আমার জানা হলো না 
কিভাবে বাংলার 
বিগত সমস্ত বর্ষা কেবল মাত্র
সে-রাতেই একযোগে
তোমার শয়নকক্ষে অমন নির্ঘাত ঝরেছিলো। ...[তোমার শয়নকক্ষে বৃষ্টি হয়েছিলো] 

‘ঘুমোই চশমা চোখে’-র প্রচ্ছদ ভালো, যদিও কালো রঙে আমার প্রবল আপত্তি। অজস্র ভালো কবিতার মধ্যে বেখাপ্পা দু-একটি ছাপার ক্ষমাযোগ্য ভুল। কিন্তু কবিতার শিরোনামের ফন্ট হঠাৎ দুটি কবিতায় [‘পঁচিশে জানুয়ারি’(পৃ ৬১) ও ‘জল না ফুরালেও’(পৃ ২০)] সহসা অসম্ভব বড়ো – এটা দৃষ্টিকটু, ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ বলে মনে হয়েছে।

শ্রেষ্ঠ শব্দাবলীর শ্রেষ্ঠ বিন্যাসে সৃষ্ট কবিতা সময়ের সাথে সাথে শ্রেষ্ঠ বিবর্তনের পরেও সাহিত্যের সবচেয়ে সূক্ষ এবং জটিল শাখা। কেননা কবিতার মধ্যে শব্দাবলী সচরাচর নতুন অর্থের ব্যঞ্জনায় বহুমাত্রিক। আর এখানেই দক্ষ শিল্পীর সার্থক কারু কাজ। শিল্পী-কবি খালেদ হামিদীকে সশ্রদ্ধ কুর্নিশ – কারণ, এ বই পড়ে ইতিমধ্যেই আমি আরো অনেকের মতো ঋদ্ধ হয়েছি ও মানুষ হিসেবে আরো দীর্ঘকায় হয়ে উঠেছি। বাঙলার প্রতিটি শোবার ঘরে খুব শিগগিরই আপনার কবিতা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়বে – এই আশায় রইলাম। 

2 comments:

  1. বাঃ, বইটি পড়ার ইচ্ছে রইল।

    ReplyDelete
  2. ভালো লেগেছে আলোচনা
    আমার প্রিয় কবি, অনুবাদক,ও গদ্যশিল্পী।

    ReplyDelete