0

ধারাবাহিক - সায়ন্তন ঠাকুর

Posted in

একজনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল,এমনি,অরণ্য কথা। তিনি বলছিলেন আর আমি শুনছিলাম,অনেকদিন পর ভর শহরে কাউকে অরণ্যকথা কইতে শুনলাম। বলতে বলতে মানুষটির চোখদুটো পান্না হয়ে গেল। আমি সুদূর সেই দৃষ্টির সমুখে অপরাধীর মতো বসে রইলাম। 

আমাদের চারপাশে রঙিন উৎসবের স্রোত উঠেছে তখন,দামাল শিশুর মতো শহরটা উঠছে নামছে হাসি কান্নায় ঝলমল করছে। হলুদ শাড়ি পরে কার সঙ্গে যেন দেখা করতে বেরিয়েছে রোদ্দুর,মুখর রাস্তায় একটি পাঁচ ছ বছরের বালককে পলিথিনের চাদরে শুয়ে দিয়ে যুবতি মা হাত পেতে বসে আছে। খালি গা,মলিন পূরাতন কাপড় কোমরে জড়ানো,বালকের অভিমান নাই,চোখের পাতায় ঘুম হয়ে এসে বসেছেন স্বয়ং মহামায়া। ধূলিমাখা ছোট ছোট দুখানি হাত,মুঠিবন্ধ,কেউ তাকে কখনও কিছু দেয়নি,ভিক্ষান্ন জুটলে দেবী বোধনের রাতে খেতে পাবে নাহলে পাবে না। কাল সকালে দূর থেকে শুনবে অর্গলস্তোত্র,রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি!

সেই মানুষটি আমাকে বলছেন,জানো,চারটে পাঁচটা ছেলেমেয়ে,মা মরে গেছে,জঙ্গলের পাশেই ঘর, বাবাটা সারাদিন মহুয়া খায় আর পড়ে থাকে! 
গলার স্বর নিচু,কান পাতলে কান্নাটুকু বোঝা যায়। আমি জিগ্যেস করলাম
—তুমি এত অরণ্য ভালবাস ?
—আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না,কী যে হয় আমার,সকাল,তারপর ধরো দুপুর,আলোটা পড়ে গেল...
একটু চুপ করে থেকে বলে উঠলেন
—বনবাংলোর চৌকিদারের সঙ্গে আমার খুব ভাব!
—তাই ?
—হ্যাঁ,ও রান্না করে রাত্রে আর আমি পাশে বসে বসে গল্প করি! কতরকমের গল্প! 
হেসে জিগ্যেস করি
—কীরকম ?
—ওই যে মহুয়া গাছটা,গেলবার ফুল আসেনি,একটা মাদী সম্বর মরে গেল আচমকা,সে কী হইচই তাই নিয়ে,পরে জানা গেল সাপে কামড়েছে। সূরযের অল্প ক্ষেতে মকাই হয়েছে খুব ভালো! হাটে লোহার কড়াইয়ের কী দাম!

আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করি, তোমার তো অনেক জঙ্গলের গল্প! তা বলো না আমাকে একটা! 

সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে, বলতে শুরু করে একটি বিচিত্র আখ্যান। 

—তুদের কইখান মউলি লাগবে ? 
—এই বোতলটা ভর্তি করে দিলেই হবে! 
হাতে ধরা দু লিটারের খালি জলের বোতলটা তুলে দেখায় সৌম্য। একটা ধূসর রঙা প্যান্ট আর কালচে নীল হাফ শার্ট পরনে। লাল ধুলো লেগে আছে সারা শরীরে। ফাল্গুন মাসের প্রথমদিক কিন্তু এর মধ্যেই তেতে উঠেছে রোদ্দুর। শুকনো বাতাস বয়ে আসছে শনশন করে। 
—পিছলা সাল কা শুখা মউল,তুরা পারবি লাই খেতে অতখান!
—পিছলা সাল মানে গতবছরের? নতুন ফুলের মহুয়া তো খেতে বেশি ভালো! নেশাও বেশি!
সশব্দে সৌম্যর কথা শুনে হেসে ওঠে প্রৌঢ় মাঝিরাম। কালো পাথর কোটা শরীর। একখান সাদা কাপড় শুধু ল্যাংটের মতো করে জড়ানো শরীরে। 
—কুছু জানিস লাই তু! শুখা মউল খাইছিস কুখনও? এ মাইয়াকে পিলাস লাই! পারবেক লাই সাহমাল দিতি!
দাওয়ায় বসা নীলাঞ্জনাকে হাতের ইশারায় দেখায় মাঝিরাম। বছর পঁচিশের যুবতি সে-কথা শুনে খিলখিল করে হেসে ওঠে। 
—ভেবো না গো বুড়া,ঠিক পারব আমি! 
সৌম্য তাকায় একবার নীলাঞ্জনার দিকে। সবুজ রঙা একটা কুর্তি পরেছে আজ, নীল রংচটা জিন্স। খোলা দীর্ঘ চুলে আটকে আছে দু একটা শুকনো পাতা। অল্প কাজল চোখে। একটুকরো পাথরের নাকছাবিটা ঝকমক করছে মাঝে মাঝে আলো পড়ে।
—এ মাইয়া কে হয় তুর ?
সৌম্যকে জিজ্ঞেস করে এবার মাঝিরাম।
চুপ করে থাকে সৌম্য। মাঝিরামের দাওয়ার পাশে বড় কুসুম গাছের লাল পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ্দুরের আলো এসে পড়েছে উঠোনে। রুখু বাতাসে ধুলোর গন্ধ। পরিস্কার নিকোনো উঠোন, দুপাশে উদোম খেতি জমি। আরও একটু দূরে জঙ্গলের অস্পষ্ট আভাস।
—বুললি নাই তো, কে হয় তুর !
—ও বুলতি পারবেক নাই গো! 
তরল গলায় মাঝিরামের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয় নীলাঞ্জনা। তারপর সৌম্যর দিকে তাকায় একবার চোখ তুলে। সামান্য কৌতুকের হাসি লেগে আছে মুখে। বলে ওঠে
—কী গো! বলো কে হয় আমি তোমার ? 
—খুব শয়তান হয়েছ তুমি ! 
সৌম্যও হেসে ফেলে।
—তুরা বুস,মু মউলি জুগাড় করি লিয়ে আসি তুদের লিয়ে ! সাঁঝের আগেই ফিরতি হবি তুদের। 
—আর তোমাদের সেই দেবীর থান দেখাবে না ? 
মাঝিরামক জিজ্ঞেস করে নীলাঞ্জনা।
—জায়ের থান ? তু জানিস ? 
মাঝিরামের গলায় মৃদু বিস্ময়!
—জানি তো, সেই যে দুপাশে ঘন জঙ্গল আর তার মাঝে একটা আটচালা, তার নিচে জায়ের থান। 
—হাঁ! মউলের তেল আর সিন্দুর লাগাই মুরা জায়ের থানে। তু জানলি ক্যামনে ? তুর এই পত্থম আসা, লয় ?
—হ্যাঁ গো বুড়া প্রথমবার। এ গল্প কতবার শুনেছি তোমাদের ওই বাবুর মুখে!
সৌম্যকে হাত তুলে দেখায় নীলাঞ্জনা।
অল্প হাসে মাঝিরাম। চুপ করে থাকে কয়েক মুহূর্ত। তারপর সৌম্যর দিকে তাকিয়ে বলে
—তু ভুলিস লাই ? কুন কালের কুথা। তখুন জংলা কেটে সাফ করেনি কালেক্ট বাবু, হুই কুম্পানির লিগা মাটি কেটে রক্ত বার করে আনে লাই লুগ, শুকায় যাইনি মউল গাছগুলান, শাল গাছগুলান,লাল হয়ে যাই লাই কেঁচকি লদীর জুল! তু ভুলিস লাই ? 

চারপাশ কেমন চুপ হয়ে যায় মাঝিরামের কথায়। অনেক দূরে একটা ময়ূর ডেকে ওঠে, ক্যাঁও ক্যাঁও। কর্কশ গলার স্বর। দুপুর গড়িয়ে এসেছে। খসে পড়ে দু একটা বুড়ো লাল রঙা কুসুম পাতা। মানুষের কেটে ফেলতে থাকা শাল জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ছুটে বেড়ায় হাহাকারময় ফাল্গুনের বাতাস। মাঝিরামের মতোই তাদেরও যেন মনে পড়ে যাচ্ছে কত পুরনো দিনের কথা এই বিবর্ণ দ্বিপ্রহরে। তিরতির করে চঞ্চল হয়ে ওঠ কেঁচকি নদীর রোগা জলধারা।

—তু একখান কাম কর, এই মাইয়াকে লিয়ে যা জায়ের থান! তু চিনে নিতে পারবি লাই ?
সৌম্যকে জিজ্ঞেস করে মাঝিরাম। 
—তা পারব। কিন্তু তুমিও চলো 
—মু তুদের মউলি টো জুগাড় করে লিয়ে আসি। ফির ভাত রাঁধব শুয়ারের মাংস রাঁধব! সূয্যি ঢুলার আগেই ফিরে যাবিক।
—শুয়োর রাঁধবা বুড়া তুমি ?
নীলাঞ্জনা পরম উৎসাহে শুধোয়। এসব তার কাছে এতদিন গল্প হয়েই ছিল। কতবার শুনেছে সৌম্যর মুখে এমন নিরাভরণ জীবনের কথা। 
—হ! রাঁধব! মউলি খাবি, মাংস খাবি,রেতে বাঁশি বাজবে, ঢোল বাজবে, চাঁদ উঠবে আজ! লাচব সবাই! 
—নাচব ? 
নিজের মনেই যেন নিজেকেই জিজ্ঞেস করে নীলাঞ্জনা। কতদিন হয়ে গেল আর নাচে না সে। কোথায় হারিয়ে গেছে তার ঘুঙুর। শুধু সৌম্যকে বলেছিল, তাও কতদিন আগে, একবার তোমাকে দেখাব কেমন করে তৈরি হয় নাচ। আজই কি তবে সেইদিন ?
—হ! লাচবি! তু লাচবি! মু লাচব! মেয়ে মরদ লাচবে! আজ পরব হবে! দেখবি এই বুড়ার ঢোলে কেমন বোল ফুটিবেক আজ রেতে!

পায়ে পায়ে দুজন এগিয়ে যায় মাঝিরামের ঘর ছেড়ে। ধূ ধূ জমি পার হয়ে সরু রাস্তা। দুপাশে উদ্ধত শাল গাছের দল। নীল আকাশে পাতা শূন্য ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। পায়ের নিচে লাল ধুলোয় মাখা শুকনো পাতার স্তূপ। দুপুরের রোদ মাথার ওপর। উষ্ণ বাতাস বয়ে যাচ্ছে নিজের মনে।
—টুপিটা পরে নাও। এই রোদ লাগলে শরীর খারাপ হবে!
নীলাঞ্জনাকে বলে সৌম্য
—হোক। আমি টুপি পরি না! তুমি পরো! বুড়ো হয়ে গেছ এমনিতেও তুমি! মাঝিরাম কে বলতে তো পারলে না আমি কে হই তোমার !
—আজ ভারী শয়তানি করছিস তুই! 
—বেশ করছি! খুব খুশী আমি! এভাবেই তো আমাদের আসার কথা ছিল, বলো !
আনমনা শোনায় নীলাঞ্জনার গলা।
—তা ছিল হয়তো! কিন্তু কত কমে এসেছে গাছ।
—আরও ঘন ছিল না ?
—যা দেখছ তার থেকে আরও দশদিন বেশি! সেসব কবেকার কথা! পনেরো ষোলো বছর হল প্রায়। 
—বক্সাইট প্রজেক্ট।
—হ্যাঁ এবার শুকিয়ে যাবে সব।
—কেন ? শুকিয়ে যাবে কেন ?
—বক্সাইট স্পঞ্জের মতো জানো,জল ধরে রাখে। মাটি খুঁড়ে বের করে আনলে ফাঁপা হয়ে যায় নিচের জমি। মরে যায় সব গাছপালা। লাল রক্তের মতো পড়ে থাকে মরা মাটি শুধু। 
—পরিবেশবিদরা কিছু বলে না ?
—পয়সা! অনেক পয়সা! নীলাঞ্জনা,এই প্রোজেক্টে। মহুয়া গাছ এদের মায়ের মতো। সেগুলোও মরে যাবে।
—বড় লোভ আমাদের ! 
বিষণ্ণ স্বরে বলে নীলাঞ্জনা। 
—ওই দ্যাখো !
জমির একদিকে পরপর গভীর খাদ। দুপাশে শুকনো মরা শাল গাছের কঙ্কাল। লাল রক্তরঙা মাটি। যেন কোনও যুদ্ধ ক্ষেত্র। মৃত অরণ্যের প্রাচীন সমাধি। 
হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তার পাশে দুজন যুবক যুবতি। রোদ্দুরের রঙও যেন কিছু বিষণ্ণ। বাতাসে উড়ছে যুবতির চুলের রাশি। রোদে তামাটে মুখের রঙ। একচোখ জল নিয়ে নীলাঞ্জনা বলে ওঠে
—এই দেখাতে আমাকে তুমি নিয়ে এলে ? কেন নিয়ে এলে ?
কিছুই বলতে পারে না সৌম্য। চুপ করে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। যেন সব দোষ তার।
মাটিতে বসে পড়ে হঠাৎ নীলাঞ্জনা। হাত দিয়ে তুলে নেয় কিছু ঝুরো মাটি। লাল রক্তের মতো ধুলো লেগে গেছে তখন তার সারা জামা কাপড়ে, মাথার চুলে। বসেই থাকে। কোনও কথা বলে না। 
—ওঠো। এগোই আমরা।
কোনওমতে বলে সৌম্য।
—কী দেখতে আর যাব ? এই শ্মশান ? 
—সামনেই কেঁচকি নদী! চলো একবার যাই!
—সেই কেঁচকি ? যাকে তোমার আমার মতো মনে হয় ?
—হ্যাঁ! 
ফ্যাকাশে হাসি দেখা যায় সৌম্যর মুখে। 

সরু রাস্তা ধরে একটু এগোতেই হঠাৎ উদোম হয়ে যায় সামনের জমি। ঢালু হয়ে নেমে গেছে নদীর দিকে। ওপারে ঘন অরণ্য। এখনও বোধহয় হাত পড়েনি বক্সাইট প্রজেক্টের। সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে চারপাশ। বাতাসে জলের ছোঁয়া লেগেছে। হাসিতে মুখ ভরে ওঠে নীলাঞ্জনার। ভারী অদ্ভুত দেখাচ্ছে। সারা গায়ে চুলে লাল ধুলো। বালিকার মতো উচ্ছল।
—চলো চলো, আমি চান করব! চান করব নদীতে!
—আরে, জামাকাপড় আনো নি তো! কী করে করবে! 
—করব করব! ভিজে কাপড়েই থাকব! কিচ্ছু হবে না। বুড়ো লোক একটা! 

দুজনেই ছুটতে থাকে। যেন দুই বালক বালিকা। কবেকার খেলার সঙ্গী। কতদিন পর আবার দেখা হয়েছে দুজনের, এই নিভৃত অরণ্যে, এক অনামী নদীর কিনারে। বিস্মৃত
জন্মের ভালোবাসার টানে আবার। 

সামনেই বয়ে চলেছে কেঁচকি নদী। সরু জলধারা। জলের রঙ ঘন লাল! যেন মৃতের রক্ত বয়ে আনছে ওই নদী। সামনে ঘন সবুজ অরণ্য। মাথার ওপর অপরাজিতা রঙা আকাশ। তার নিচে মানুষের রচিত যুদ্ধক্ষেত্রের সাক্ষ্য বহন করে বয়ে চলেছে ওই নদী।

দুজনেই হতবাক দাঁড়িয়ে থাকে। একঝলক বাতাস ছুটে আসে নিজের মনে। দূরে কী এক নাম না জানা পাখি ডেকে ওঠে। বয়ে যায় সময়। কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে নীলাঞ্জনা বলে ওঠে
—তুমি জানতে চাও না বারবার কলকাতায় কী নাম আমাদের সম্পর্কের। বলিনি কখনও। আমি ভেবেছিলাম এই সরল অথচ তীব্র ভালোবাসারকোনও নাম হয় না। স্থির করে ছিলাম আজ বলব। এমন দিনেই হয়ত বলা যায়। 
আবারও চুপ করে থাকে। নিস্তব্ধ চারপাশ। কেউ কোথাও নেই। এই মহাশ্মশান রাজ্যে যেন তারা দুজনই শুধু জীবিত। 
—ভেবেছিলাম জীবনে একটিবার তোমায় গভীর চুমু খাব। কেঁচকি কে সাক্ষী রেখে। এই রক্ত নদীর ধারে কিন্তু কীভাবে ভালবাসব আমি ? কীভাবে ? কেন আনলে আমায় ?
কান্নায় ভেঙে পড়ে নীলাঞ্জনা। অবাক হয়ে এই বন চরাচর,জায়ের থানের অপরূপ দেবী দেখতে থাকেন সেই দৃশ্য। দুজন মানুষের চোখের জলে ধুয়ে যায় কেঁচকি নদীর বিষময় ক্ষত।

হঠাৎ ঘুম ভাঙে সৌম্যর। বড়ডিহা ফরেস্ট রেস্টহাউসের বিছানায় শুয়ে আছে। খর রোদ্দুর চারপাশে। একটা ব্রেন ফিভার পাখি ডেকেই চলেছে ক্রমাগত একঘেয়ে সুরে। ধূ ধূ বাতাস কেঁদে মরছে বাইরে নিজের মনে। উঠে বসে সিগারেট ধরায় একটা। মাঝিরাম! কবেই মরে গেছে নিশ্চয়। কতদিন যায়নি সে নিজেও। আর নীলাঞ্জনা ? মনে মনে একটু হাসে সৌম্য। সে এক বিস্মৃত অতীত। শুধু এমন সব দুপুরবেলা আবছা মনে পড়ে মুখের ডৌল। বড় বড় দুটো চোখ,উজ্জ্বল হাসি। সেসব কবেকার কথা! 

চিরকালের সব আখ্যানের মতোই এই গল্পও শেষ হয়ে আসে নিজের নিয়মে। আমি শুধোই, এ তোমার নিজের গল্প? সৌম্য’কে চেনো তুমি ?

সে কিছুই বলে না। চুপ করে থাকে, চোখদুটি ভুঁইয়ের দিকে নামানো। আমি মানুষটিকে দেখছি তখনও অপলক। অনেকদিন কাউকে দেখিনি যাঁর মাথায় শুকনো শালপাতার মুকুট পরানো আছে। জঙ্গলের কথা শুনলে ঈশ্বরকথা শুনলে বড় আনন্দ হয় এখনও। মনে হয় কথকের অন্তরমহলে একটি শীর্ণ ভালবাসার নদী শুয়ে আছে,বড় বাসনা হয় পা ডুবিয়ে বসার। 

এসব কথা ভাবি আর আমার দ্বিপ্রহরে বাঁকা আলো এসে পড়ে। ছাতিম ফুলের রেণু কাপাস গাছের বাতাস লুটোপুটি খায় বিছানায়। দুটো কাঠবেড়ালি গাছের ডাল বেয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে,বেনেবউ এসে বসে আছে পেছনের অশ্বত্থ গাছের উঁচু ডালে। মাকড়শার সরু তন্তুর ঘড়বাড়ি,বুনো জংলা লতায় ছাওয়া গাছখানির মাথা,সার সার কাঠপিঁপড়ে,কাকের ডিম রাখা খড়কুটো গোঁজা বাসায়,নাকি কোকিলের,তিরতিরে পাতা, আর ক’দিন পরেই হলুদ হয়ে খসে পড়বে। কী অনিত্য এই আয়োজন,তবুও সত্য বলে ভ্রম হয়।

অরণ্যের মানুষ পাঁচমিশালি ভিড়ে হারিয়ে যায়। আমি তাঁর মায়াবিভ্রম নিয়ে বসে থাকি,আলোর মধ্যে অন্ধকারের মতো। ওই আলো,যার দ্বারা সকল ভ্রমের কারণ অজ্ঞান চিরতরে বিলীন হয়ে যায়।

0 comments: