0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in

৪) আহিরণের পারে পিকনিক 

২৬ জানুয়ারি, রিপাবলিক ডে। আগের দিন চাপরাশি ঠুল্লুকে দিয়ে ওর রসেলু পটেলের দোকানে বলা হয়ে গিয়েছে যে কুড়ি টাকার জলেবি সামোসা ও সকাল বেলা বানিয়ে রাখতে। হাঁ জী, বাসি নহীঁ, তাজা হোনা চাহিয়ে। আর ঠুল্লু স্টোর থেকে বের করে ধুয়ে পরিষ্কার করেছে ঝাণ্ডার লৌহদণ্ড, যার মাথায় ছোট্ট পুলি; ধুয়ে ইস্তিরি করিয়ে রেখেছে ত্রিবর্ণ পতাকা। কিছু ফুল দরকার। ঠুল্লু বলল কিনতে হবে না,ওদের বাগান থেকে তুলে আনবে। আর পাঁচটাকায় একটু চিনি, গুঁড়ো দুধ ও চা পাতা যা হবে তাতে ও দশকাপ চা বানিয়ে দেবে। 

ব্যস, হয়ে গেল রিপাবলিক ডে উদযাপনের জন্যে হেড অফিসের বরাদ্দ করা ২৫ টাকার হিসেব। ব্যাংকের চাকরিতে রূপেশের এটা তৃতীয় রিপাবলিক ডে; এদিকে বলে গণতন্ত্র দিবস। স্বাধীনতা দিবসকে বলা হয় স্বতন্ত্রতা দিবস। সেদিন রূপেশ মকানমালিক কলেশরামকে ও প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টারকে ডাকে। প্রধান অতিথি হিসেবে হেডমাস্টারজীকে বলা হয় পতাকা উত্তোলন করতে, তারপর সরু মোটা সুরে ‘জন-গণ-মন’ গেয়ে সবাইকে জলেবি, সামোসা ও চা খাইয়ে ইতি করা হয়। কিন্তু রিপাবলিক ডে’র দিন ও কাউকে ডাকে না। পৌনে আটটা নাগাদ ব্যাংকের স্টাফের সামনে নিজে দড়ি টেনে ‘ঝান্ডা উত্তোলন’ করে তারপর সদলবলে স্থানীয় হাই স্কুলের প্রোগ্রামে হাজির হয়। সেখানে ছাত্র-শিক্ষক- স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ‘ভাষণ’ ও গান শেষ হলে ছাত্র ও মাস্টারমশাইদের প্রীতি ক্রিকেটম্যাচে মা’সাবদের দলের হয়ে খেলে ঘেমেটেমে ঘরে ফেরে। আর দিনের সেরা খিলাড়িদের প্রাইজ দেওয়ার ফান্ডে কিছু কন্ট্রিবিউট করে আসে। 

কিন্তু গতবার মামলা থোড়া গড়বড়া সা গয়া থা! 

পতাকার মধ্যে ফুল গুঁজে ওটিকে বেঁধে কায়দা করে এমন ভাবে দড়িতে গিঁট দেওয়া হয় যাতে একটি মুড়ো ধরে টানলে পতাকা উপরে উঠবে আর অন্যটি ধরে টানলে পতাকা খুলে ফুলের পাপড়ি হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়বে। রূপেশ ভুল ভাবে দড়ি টানায় না ফুল ছড়িয়ে গেল, না পতাকা উপরে উঠল। মাঝপথে মুখ ভেটকে গোঁসা করে ঝুলে রইল; শেষে ঠুল্লু হাত লাগিয়ে পতাকার সম্মান বাঁচালো। তারপর স্কুলের প্রোগ্রামে ওকে বলার সুযোগ দিতেই ও বলল যে একটা কথা বলা দরকার। প্রতি বছর সমস্ত বক্তা এই দিবসের গুরুত্ব ব্যাখ্যা না করে আজাদী কী লড়াইয়ের গল্প ফেঁদে বসেন। ফলে ছাত্রছাত্রীরা ১৫ই অগাস্ট ও ২৬শে জানুয়ারির মধ্যে কোন ফারাক দেখতে পায় না। এছাড়া রিপাবলিক ডে কে গণতন্ত্র দিবস বললে কিছুই বলা হয় না। ভারত গণতান্ত্রিক দেশ মানে, শাসককে জনতা ভোট দিয়ে ঠিক করে। কিন্তু রিপাবলিক ডে মানে আইনের চোখে সরপঞ্চ,পঞ্চায়েতের চাপরাশি, আমি ও ঠুল্লু সবাই সমান। আমাদের সমান অধিকার। ইংরেজ আমলে রায়বাহাদুর খেতাব পাওয়া ভদ্রলোক-- যিনি পাঁচ বছর বিলাসপুরে ওঁর কোঠিতে থাকেন -- এখান থেকে ভোটে দাঁড়ান। উনি আমাদের পিতামহের বয়েসী, সম্মাননীয়। তবে দেশটা রিপাবলিক হওয়ায় ভবিষ্যতে যে কেউ এমনকি চাপরাশি ঠুল্লুরাম ও ভোটে দাঁড়াতে পারে। মানে, আমি ওকে দাঁড়াতে বলছি না, তবে ওর ইচ্ছে হলে নিয়মে আটকাবে না। 

সবাই থম মেরে গেল, তারপর এখানে ওখানে খুক খুক করে হাসি শুরু হলো। হেডমাস্টার এক ধমক দিয়ে ‘রাষ্ট্রগান’ শুরু করিয়ে দিলেন। তারপর চা-জলখাবারের সময় ইংরেজির স্যার উপাধ্যায়জি উঁচু গলায় বললেন – ম্যানেজার সাব আজ বড়িয়া জোক মারা—ঠুল্লু বনেগা অপনা বিধায়ক? রায়বাহাদুর কো হরায়েগা? 

হাসির হররা। 

রূপেশ বলল—ম্যায় সির্ফ স্বতন্ত্রতা দিবস অউর গণতন্ত্র দিবস কা অন্তর বতানা চাহতা থা। ইয়ে তো এক উদাহরণ ভর থা। 

হ্যা-হ্যা-হ্যা! 

এমন উদাহরণ! কহাঁ রাজা ভোজ অউর কহাঁ গঙ্গু তেলি! 

রূপেশ ভেবেছিল যে ব্যাপারটা ওখানেই চুকেবুকে গেছে। 

কিন্তু খবর গেল বিলাসপুরে রায়বাহাদুরের কাছে। উনি গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে ফোন করে বললেন যে ম্যানেজারকে রাজনীতিতে নাক না গলিয়ে ব্যাংকের কাজ মন দিয়ে করতে নির্দেশ দেওয়া হোক, ওয়ার্না---! 

তাই রূপেশ ঠিক করেছে এবার স্কুলে না গিয়ে ব্যাংকে পতাকা তুলে সবাই মিলে আহিরণের ওপারে ঝোরা –সিরকি গ্রাম পেরিয়ে পাহাড়ের কোলে নদীর চরে সবাই মিলে পিকনিক করবে। নতুন ছেলে দুটো খুব খুশি। বস, ইঁহা ইতনা কাম, ইতনা কাম কি হম টেবিল সে সর উঠাকে কুছ দেখ নহীঁ সকে। অব নদিয়া কে পার জায়েঙ্গে? মজা আ জায়েগা। 

কিন্তু এবারেও গোলমাল বেঁধে গেল। বাঁধল নিজেদের মধ্যে। সকাল পৌনে আটটায় সবাই স্নান করে হি-হি কাঁপতে কাঁপতে ব্যাংকের ছাদে উঠেছে। শ্রীরাম ঘড়ি দেখে বলল টাইম হো গিস, অব শ্রীগণেশ করেঁ? 

রূপেশ মাপা পায়ে ঝান্ডার কাছে গিয়ে ঠুল্লুকে ইশারায় ডেকে নিয়ে বলল আজ আমাদের ব্যাংকের ধ্বজারোহণ করবেন শ্রীমান ঠুল্লুরাম পটেল, ব্যাংকের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি। সবাই হতবাক। ঠুল্লু ভয়ে দু’পা পেছিয়ে যায়। বিড়বিড় করে বলতে থাকে—নাহি সাহেব, নাহি সাহেব; এইসন মজাক ঝন করিহ; মোলা পাপ লগ যাহি। 

রাজন বলে হোয়াটস আপ? 

শ্রীরাম বলে এইসব পাগলামি করে আপনি রাষ্ট্রীয় ধ্বজ কী ইনসাল্ট কর রহে হ্যাঁয় স্যার! 

ডোঙ্গরে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে থাকে, কিছু বলে না। 

রূপেশ একটা নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দেয় যার নিগলিতার্থ হলো যদি ঠুল্লুকে পতাকা তোলার সম্মান না দেওয়া হয়, যদি তাতে পতাকার অপমান হয় তাহলে রিপাবলিক ডে’র মানে কি! 

হতাশ শ্রীরাম মাথা নাড়ে, ঠিক হ্যাঁয় স্যার, আপ ইঁহাকে বস হো, আপ জো করে ও কম হী হ্যাঁয়। 

রূপেশ অবিচলিত। এবার ডোঙ্গরে মুখ খোলে—ভইগে ভইগে! হয়েছে হয়েছে। স্যার যেমন বলছেন কর তারপর পিকনিক। ই সব বহসবাজি মে আজ কা মজা কিরকিরা ঝন করিহ। ফালতু তক্কাতক্কি করে আজকের দিনটা মাটি ক’র না। 

বেলা এগারোটা নাগাদ গোটা দলটা পৌঁছে গেছে ছুরিকলাঁ গাঁয়ের সরহদ পার করে শেষ মাথায় কালো পাথরের টিলায়। এখান থেকে পায়ে চলার একটি সর্পিল পথ এঁকেবেকে ক্রমশ নীচে নেমে গেছে আহিরণের কিনারায়। শীতের শেষ, জল কম পায়ের গোছ ছাড়িয়ে উপরে উঠবে না। আর টিলার গায়ে কালো পাথরের মধ্যে চিকচিক করছে অভ্রের কুচি। বিলাসপুরের দুই ট্রেনি দাঁড়িয়ে পরে। মুগ্ধ হয়ে চারদিকে তাকায়। ওদের কোন ধারণা ছিল না যে জায়গাটা এত সুন্দর। নদীর পারে বালি, তারপরে ঝোরা-সিরকি গাঁয়ের ধানের ক্ষেত, খুব সামান্য এলাকায়। এখনও কিছু পাকা ধান কাটা হয় নি। এর পরে ঘন বন। আর বনের পেছন থেকে একপাল আদিম প্রাগৈতিহাসিক হাতির মত চলেছে নীলপাহাড়ের সারি, যেন আকাশে মিশে গেছে। 

ওরা কোন কথা বলে না,শুধু চলতে থাকে। ওদের প্রাথমিক মুগ্ধতা এখনও কাটেনি। 

ঠুল্লু ব্যাংকের সাইকেল ঠেলে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। ওর ক্যারিয়ার আর হাতল থেকে ঝোলা থলিগুলোতে রয়েছে খাবার,আনাজপাতি, চা-চিনি, মশলা। 

হাতে চটি নিয়ে ওরা জলে নামে, কী ঠান্ডা জল! এবার সবার মুখে কথা ফোটে। 

হাসিমুখে শ্রীরাম বলে কিছু মনে করবেন না স্যার! আমাদের দু’মাস হতে চলল। মানে এ’মাসটাই শেষ। আপনি যদি আমাদের আরও একমাস এখানে রেখে দেন তাহলে ভাল হয়। কথা দিচ্ছি চারটে উইক এন্ডের দুটোতে বিলাসপুর না গিয়ে এখানে থাকব, ফিল্ডে যাব। আর শীত চলে যাওয়ার আগে এখানে এই আহিরণের চরে আরও দুটো পিকনিক করব। 

রূপেশ হাসে। ফলে সবটা আমার হাতে নেই,ডেপুটেশন হেড অফিস ঠিক করে। ঠিক আছে, দেখব’খন। এখন চটপট কাজে লাগা যাক। 

ঝোলা খালি করে জিনিসপত্র নামিয়ে প্রথমে ভিজে বালুর উপর একটা প্লাস্টিকের শিট বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা হলো। গ্ল্যাক্সো বিস্কিট আর চানাচুরের প্যাকেট খোলা হলো; এর সঙ্গে থার্মস থেকে গরম চা। রূপেশ সতর্ক করে, কেউ যেন সেলোফেন বা কাগজের ছেঁড়া প্যাকেট এখানে না ফ্যালে। একটা ঝোলায় সবগুলো জমা করা হবে, মায় পাতলা প্লাস্টিকের কাপ ও কাগজের প্লেট। 

খানিকক্ষণ পরে কথা হলো রান্না শুরু করা যাক। রূপেশ চেয়েছিল মাংসভাত পটেল হোটেলে রান্না করিয়ে সসপ্যানে মুখ বেঁধে সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসিয়ে আনা হবে। কিন্তু শ্রীরামের আবদার যে এখানে রান্নাকরা হবে, পুরোদস্তুর বনভোজন। কালকেই বলেছিল যে কিস্যু ভাবতে হবে না। জঙ্গল থেকে শুকনো কাঠকুটো কুড়িয়ে উনুন ধরাতে ও ভালই পারে। অনেক এনসিসি এন এস এস ক্যাম্প করা আছে। 

ডোঙ্গরে ঝকঝকে দাঁতে একগাল হেসে বলল মাংসভাত আমিই রাঁধব। রূপেশ হাসি চেপে গম্ভীর মুখে বলে—রান্নার এক্সপেরিয়েন্স? 

--স্কুলে পড়ার সময় থেকে। আসলে আমাদের সিরিগিট্টি পাড়ায় একটা গ্যাং তৈরি করেছিলাম। চরতে থাকা মুরগী ও ছাগল চুরি করে রেললাইনের ওপারে ক্ষেতের মধ্যে রান্না করে হাড়গোড় মাটিতে পুঁতে ফেলে চম্পট! অনেকবার আমাদের বিরুদ্ধে পঞ্চায়েতে শিকায়েত হয়েছে কিন্তু কখনও কেউ প্রমাণ করতে পারে নি। 

একবার তো উপ-সরপঞ্চের মুরগী কেটে ওকেই খাইয়ে দিলাম, টের পায় নি। 

টেরচা চোখে তাকায় শ্রীরাম, বলে আচ্ছা ফেক রহে ইয়ার! হম লপেট রহে। গুল মারার জায়গা পাস নি! 

রাজন জানতে চায় পাঁঠা কী করে চুরি করা হয়? ও তো ব্যা-ব্যা করে ডেকে সবাইকে জাগিয়ে দেবে। 

রহস্যটা হলো পাঁঠার কানের মধ্যে গোটা ছয় সরষে দানা ঢুকিয়ে দিন। ব্যস, ও চুপ করে যাবে, একেবারে রা’ কাড়বে না। 

ইতিমধ্যে ঠুল্লু থার্মস থেকে ছোট ছোট প্লাস্টিকের কাপে চা ঢেলে সবাইকে হাতে হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। সঙ্গে গ্ল্যাক্সো বিস্কুট ও গাঠিয়া ভাজা। 

শ্রীরাম ওর ঝোলা থেকে বের করে একটা ক্যাডবেরির প্যাকেটের মত লম্বা হটশট ক্যামেরা। ফটাফট নদী- ক্ষেত- জঙ্গল –পাহাড়ের দিকে তাক করে ফ্ল্যাশ চমকিয়ে বলল এবার একটা গ্রুপ ফোটো হয়ে যাক। আমি আগামী সপ্তাহে বিলাসপুরে আমার বন্ধুর স্টুডিও থেকে ওয়াশ করিয়ে সবাই একটা সেট দেব, খরচা আমার। 

রূপেশ বলে যে আগে রান্না খাওয়াদাওয়া ও এখানে একটু বেড়ানো হোক, অন্ততঃ আলো থাকতে থাকতে পাহাড়ের কোলে জঙ্গলে ঘোরা যাক। এইসময় মহুয়ার ফুল, তেন্দু ফল পাওয়া যেতে পারে। তোমাদের মন্দ লাগবে না, একটা এক্সপেরিয়েন্স হবে। 

রূপেশ জিনিসপত্তর আগলে ওখানেই বসে রইল, ওরা চারজন শ্রীরামের নেতৃত্বে গেল শুকনো কাঠকুটো কুড়িয়ে আনতে। প্রায় আধঘন্টা কেটে গেলে ওরা ফিরল এক এক আঁটি শুকনো ডাল নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে। ঠুল্লুর ছোট একটা কাটারি দিয়ে শ্রীরামের নির্দেশ মাফিক ওগুলো আরও ছোট ছোট টুকরো করা হলো। একটু পরে আগুন জ্বলে উঠল। দেখা গেল শ্রীরাম বাড়িয়ে বলে নি। ও হাওয়ার গতি দেখে সে দিকটা একটা টিন ও প্যাকেটের পিসবোর্ড দিয়ে আড়াল মত করে কাঠ সাজিয়ে চমৎকার আগুন জ্বালিয়েছে। ঠুল্লু নদীর জলে ধুয়ে ফেলেছে চাল, আর ডোঙ্গরে রসুন, পেঁয়াজ কুচি হলুদ, জিরে, ধনে তেজপাতা ও গরম মশলা একটা প্লেটে সাজাচ্ছে, মাংস চড়াবে। 

কিন্তু ঠুল্লু প্রাণপণে হাতড়ে চলেছে একের পর এক থলে আর প্যাকেট। একটু পরে রাজন ব্যাপারটা দেখে জিজ্ঞেস করল কী হয়েছে? কিন্তু জবাবে ও খালি মাথা নাড়ে এর বলে –কুছ নহীঁ। 

একটু পরে ও উঠে রাজনকে এক পাশে নিয়ে গিয়ে উত্তেজিত ভাবে কিছু বলছিল। শেষে সেই শলাপরামর্শে ওরা চারজনই যুক্ত হলো, রূপেশকে এড়িয়ে। এদিকে আগুনের তাপে কড়াই গরম হয়ে ধোঁয়া উঠছে। এবার রূপেশের নজর গেল সেদিকে। 

সবাই এদিকে এস, কড়াই পুড়ে যাচ্ছে যে! 

রাজন জানালো—নুনের প্যাকেট আসে নি। তেলের শিশি এসেছে, সঙ্গেই নুনের প্যাকেট কাগজে মুড়ে রাখা ছিল,কিন্তু এখানে এসে চোখে পড়ছে না। এখন উপায়! 

খিঁচিয়ে ওঠে শ্রীরাম—সব ঠুল্লুর দোষ, ওই যাক ফিরে ছুরির ব্যাংকে। নিয়ে আসুক ফেলে আসা নুনের প্যাকেট। 

মুখ কালো করে উঠে পড়ে ঠুল্লু, সাইকেলের দিকে এগিয়ে যায়। হাত তোলে রূপেশ। 

ওর মতে এটা কোন সল্যুশন হলো না। ওর যেতে আসতে পাক্কা একঘন্টার বেশি সময় লাগবে। তার চেয়ে কাছের ঝোরা সিরকি গাঁ থেকে কারও কাছ থেকে পয়সা দিয়ে কিনে আনুক। ঠুল্লুর সঙ্গে কেউ যাক। ডোঙ্গরে সঙ্গে সঙ্গে একটা ঝোলা নিয়ে ঠুল্লুর সাথে বেরিয়ে গেল। 

ওরা তিনজন বসে শীতের দুপুরে সদ্য জ্বালানো আগুনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বিশ মিনিট কেটে গেছে। রাজন ও শ্রীরামের ঘড়ির দিকে তাকানো দেখে রূপেশ আশ্বস্ত করল যে আর একটু, ব্যস –ওরা ফিরল বলে! 

ছুরিগাঁয়ে এইসময়টা কোন শীতটিত নেই, মকরসংক্রান্তির পর থেকেই ঠান্ডা কমতে থাকে। সন্ধ্যের দিকে গুলাবি জাড়া বা মিঠে শীত টের পাওয়া যায়। কিন্তু এখন এই নদীর পারে জঙ্গলের দিক থেকে হু হু করে হাওয়া এসে কাঁপুনি ধরাচ্ছে। ওরা একটু আগুনের দিকে ঘেঁসে এল। 

শ্রীরাম রাজনের সঙ্গে চোখে চোখে ইশারা করে উঠে গিয়ে একটা থলের থেকে হাতড়ে টাতড়ে একটা চ্যাপ্টা ছোট বোতল নিয়ে এল। রূপেশের চোখ কুঁচকে গেল। এসব কী? 

--প্লীজ আজকে রাগ করবেন না। এই নদীর পাড়, এই নীলচে পাহাড়,হাওয়ার কাঁপন, চিকেন রান্না হচ্ছে, এখন একটু ইয়ে না হলে চলে? আমরা তো ছুরিগাঁয়ের বাইরে, জঙ্গলের ধারে। কেউ আপনাকে দেখবে না। কেউ জানতে পারবে না। 

-- জিনিসটা কী? 

-- শুদ্ধ মহুয়া। লাইনপাড়ার পীলা যাদবের হাতে তৈরি। একেবারে হ্যান্ডলুম মাল। এতে মৌরি মেশানো আছে। 

-- কার বুদ্ধি? 

ওকে অবাক করে উত্তর আসে ক্লার্ক রাজনের থেকে। 

--আমাদের সবার। দেখুন, আপনাকে জানি, এটা কোন ব্যাঙ্কের বরোয়ারের থেকে পাওয়া ফোকটিয়া মাল নয়। পীলারাম যাদব আমাদের ক্লায়েন্ট নয়। দস্তুরমত পয়সা দিয়ে এনেছি। ইসমে কোই মিলাবট নহী হ্যাঁয়, কোঈ খতরা নহী। 

--স্যার, আজকের পিকনিকের সব খরচা তো আপনি দিচ্ছেন, কিন্তু এইটুকু আমাদের। মনে করুন এটা আসলে আমাদের ফেয়ারওয়েল পার্টি। আসলে আমাদের আপনাকে ভাল লেগেছে। আপনি কোন লন্দফন্দে নেই,কারও থেকে কোন ফেবার নেন না; জুয়ো খেলেন না। এমনকি, ছুটিতেও ভিলাইয়ে বাড়িতে যান না। সংসারে এই বয়সেই কেমন বৈরাগ্য এসে গেছে ভাব। 

রূপেশ একটু অবাক হয়েছে, কিন্তু মুখে কিছু বলছে না। ওরা তিনটে প্লাস্টিকের গ্লাসে মেপে ঢালে, তারপর বলে আপনার তো এই প্রথম, একটু জল মিশিয়ে দিই? 

ওরা গ্লাসে গ্লাস ঠেকিয়ে শুরু করে। রূপেশের ঠোঁটে মহুয়ার ঝাঁঝালো কষটে স্বাদ। ওরা চানাচুরের প্যাকেট এগিয়ে দেয়। 

খানিকক্ষণ পরে শ্রীরাম একটা সিগ্রেটের প্যাকেট বের করে। স্যার, যদি অনুমতি করেন! 

রূপেশের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে—আমাকেও একটা দাও। 

ওরা চমকে ওঠে, চেহারায় খুশির ঝলক। শস্তা ব্র্যান্ড স্যার, পানামা। এখানে অন্য কিছু পাওয়া যায় না। 

নদীর দিক থেকে আসা দামাল হাওয়ার প্রকোপ বেড়ে গেছে। শ্রীরামের হাত কাঁপে, দেশলাইয়ের কাঠি বার বার নিভে যায়। রূপেশ অভ্যস্ত হাতে হাত গোল করে আগুনের শিখা আড়াল করে। তারপর শ্রীরাম ও রাজনের সিগ্রেট ধরিয়ে দিয়ে যেই নিজেরটা ধরাতে যাবে, অমনি শ্রীরাম ঝাঁপিয়ে পড়ে হাতের ঝাপটায় কাঠিটা নিভিয়ে দেয়। 

রূপেশের বিরক্ত বিস্মিত চেহারা দেখে সাফাই দেয়। এক কাঠিতে তিনজন ধরাতে নেই। 

-- তৃতীয় ব্যক্তি মারা যাবে এই তো? যত বাজে কথা, বহুবার করে দেখেছি। বেড়ালের রাস্তা পার, সকালে মাকুন্দ অথবা কাণোয়া দর্শন, এসবে কিছু হয় না। ফালতু গপবাজি! 

-- আপনি না মানতে পারেন,আমি মানি। আমি কিছুতেই আপনাকে তিসরা আদমি হতে দেব না। 

রূপেশ হাল ছেড়ে হাত উলটে দেয়। 

একঘন্টা হয়ে গেছে। ওরা যে গেছে এখনও কোন খবর নেই। 

এদিকে সিগ্রেট ও মহুয়া দুটোই দু’রাউন্ড হয়ে গেছে। রাজন বলে স্যার, ওই জঙ্গলের দিকে কোন খতরা নেই তো? মানে ওরা— 

--আরে না না,বাঘ-ভালুক সব মানুষের উৎপাতে আরও গভীরে চলে গেছে। হ্যাঁ, রাতের বেলা হলে কথা ছিল। আর ঠুল্লু রাস্তা চেনে, পথ হারাবে না। গেছে জঙ্গলের এপাশে একটা গোটা কুড়ি পরিবার ঝোপড়া বানিয়ে থাকে, সেদিকে। 

ধীরে ধীরে সবার গলার স্বর ভারি হয়ে আসছে, ক্রমশঃ একটু মোটা হয়ে খাদের দিকে নামছে। রূপেশের হাতে ধরা সিগ্রেট পুড়তে পুড়তে আঙুলে ছ্যাঁকা লাগার অবস্থায়। শ্রীরাম আর একটা বাড়িয়ে দেয়, কিন্তু রূপেশ মাথা নেড়ে গ্লাসের দিকে ইঙ্গিত করে। 

অবাক হয়ে শ্রীরাম জিজ্ঞেস করে আগে কখনও মহুয়া খাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে কি না ? নইলে এবার থামা উচিত। উত্তরে রূপেশের ঠোঁটে একটি মৃদু হাসি খেলা করতে থাকে। ওরা অপেক্ষায় আছে দেখে প্রায় বিড়বিড় করে বলে হ্যাঁ, গ্রামীণ ব্যাংকের চাকরিতে এসে, ছ’মাস আগে। এখানে? না,এখানে নয়; ট্রেনিং পিরিয়ডে। 

ওরা সোল্লাসে প্রায় চেঁচায়—ইয়ে কিসসা জরুর সুননে কা লায়ক হোগী। বতাইয়ে না! 

আমার প্রোবেশন পিরিয়ড। প্রথম পোস্টিং। বলোদা বলে একটি ব্র্যাঞ্চে, দু’মাসের জন্যে। কাজ শেখাবেন স্টেট ব্যাংক থেকে ডেপুটেশনে আসা সিঙ্ঘানিয়া সাহেব। তা’ সেখানে গিয়ে প্রথম রাত্তিরে ভূত দেখলাম আর দশ দিনের মাথায় মহুয়ার নেশা। 

--ক্যা বাৎ! স্টেট ব্যাংকের অফিসার আপনাকে প্রেতসাধনা ও পঞ্চমকারে দীক্ষা দিলেন! উনি কি ভূতসিদ্ধ ? নাকি তান্ত্রিক? 

রূপেশ মাছি তাড়ানোর মতন করে হাত নাড়ে, মাথা নাড়ে। 

রাজন বিরক্ত হয়ে বলে—আঃ, স্যারের মুখ থেকেই শোন না ! 

গেলাস আবার ভর্তি। ও চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করে একটু হাসে তারপর ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে শুরু করে। 

৫ ভূত –পেত্নী-দত্যি-দানো 

ভিলাইয়ে সিভিক সেন্টারের পাশের মাঠে সেবার রঞ্জি ট্রফির ম্যাচ হচ্ছিল ইউ পি বনাম এম পি। কোনও টিকিটের বালাই নেই। এম পি দলের পক্ষে বিলাসপুরের থেকে সিলেক্ট হওয়া একটি নতুন ছেলে ভাল ব্যাট করছে। মন দিয়ে দেখছি এমন সময় পিঠে হাত, আমার লংগোটিয়া ইয়ার পানিগ্রাহী,খুব উত্তেজিত। এখনই বাড়িতে যেতে হবে, বড়ে ভাইয়া ডেকেছেন। বড়ে ভাইয়া স্টিল প্ল্যান্টে জেনারেল ফোরম্যান। আজ শনিবার বটে,কিন্তু এ’সময় বাড়িতে কেন? মার শরীর খারাপ হলো নাকি? প্রেশারের রুগী। 

বন্ধু বলল সেসব কিছু না,ভালো খবর। তোর চাকরি হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকে। পোস্টিং বলোদা বলে একটা গেঁয়ো ব্লক হেড কোয়ার্টারে। তুই তো বাড়ির ঠিকানা না দিয়ে আমার ঠিকানা দিয়েছিলি। আজ চিঠি আসতেই আমি তোদের বাড়ি দিয়ে এসেছি। মা মুঁহ মিঠা করিয়েছেন, ফোন পেয়ে বড়ে ভাইয়া প্ল্যান্ট থেকে চলে এসে তোকে ডাকতে পাঠিয়েছেন। 

আমার মাথার ভেতরে দিওয়ালির হাজার লড়ি চড়বড়ো করে ফাটতে থাকে। অন্ধ রাগে আমি পানিগ্রাহীর কলার ধরে ঝাঁকাতে থাকি। কেন? কেন তুই চিঠি আমার বাড়িতে দিতে গেলি? কেন আমার হাতে দিলি না ? এইজন্যেই কি করেস্পন্ডেন্স এর জন্যে তোর ঠিকানা দিয়েছিলাম! 

ও ভয় পায়। অতিকষ্টে আমার হাত ছাড়ায়। আমার চারদিকে ভীড় জমতে থাকে। আমি লজ্জা পাই। পাবলিককে বলি সব ঠিক ঠাক হ্যাঁয়। তারপর ওর হাত ধরে একপাশে সরে আসি। ও হাঁপায়, তারপর বলে—দু’হাজার টাকা সিকিউরিটি দিতে হবে যে! তাই তোর বাড়িতে গেলাম। বড়ে ভাইয়া টাকা তুলে এনেছেন। 

আমার গা চিড়বিড় করে। ও বলে কুছ ভী হো ইয়ার, তেরে অপনে বাপ-মা, খুদ কে ভাইয়া, কোই গ্যর থোড়ি। পুরানী বাতে ভুল জা, গুসসা থুক দে। অব তেরী নয়ী জিন্দগী শুরু হোগী। 

যদি ভুলে যাওয়া যেত! 

বাড়িতে ঢুকতেই বড়ী ভাবী হৈ হৈ করে উঠল। এসেছেন এসেছেন; তিনি এসে গেছেন। বাইরের ঘরে সবাই হাজির। ভাবী ইশারা করছিল – প্যার ছুঁও; কম সে কম বাবুজি অউর মাজী কে। 

যন্ত্রের মত ভাবীর আদেশ পালন করলাম। ভাইয়া এসে একটা খাম দিয়ে বললেন—তিন হাজার আছে। সিকিউরিটি দু’হাজার আর তোর প্রথম মাসের খাইখরচা বাবদ আরও এক হাজার। কাল রোববার দিনের বেলা রওনা হয়ে বিকেল নাগাদ হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে যা। সোমবার থেকে ডিউটি জয়েন করবি; নতুন ব্যাংক, প্রথম ব্যাচ, সিনিয়রিটি মার না খায়! 

--আমি আপনার টাকা নেব না। 

ঘরের মধ্যে বাজ পড়ল। ভাইয়া যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। 

- কী বললি? 

- ঠিকই শুনেছেন, নেব না। 

বাবা আস্তে আস্তে নীচু গলায় বললেন—সিকিউরিটি ডিপোজিটের টাকা কোথায় পাবে? 

--এখানে চেনাজানা লোকজনের থেকে ধার নেব। 

ভাইয়া এসে ঠাস করে এক চড় কষালেন। 

--ধার নিবি? আর চেনাজানা সবাই যখন আমাদের নামে ছি-ছি করবে? তাতে তোর কিছু আসে যায় না ? খালি নিজের জিদ! 

আমার আনন্দ হচ্ছে। চড়ের জ্বালা টের পাচ্ছি না। এই তো বদলা নেওয়ার শুরু! 

আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল—আর যেদিন চেনাজানা সবাই আমার নামে ছি-ছি করছিল সেদিন আপনারা কোথায় ছিলেন? ভুলে গেলেন! 

বড়ে ভাইয়া খামটা বাবার হাতে দিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। বাবা আমাকে ডেকে বললেন –টাকাটা আমি দিচ্ছি। তোমার যখন এতই আপত্তি তো ধার হিসেবেই নাও। মাসে মাসে শোধ দিও, যেমন পার। 

যাহোক, পরের দিন রোববার। সকাল দশটায় একটা কালো চামড়ার স্যুটকেস, একটা এয়ারব্যাগ ও হোল্ডঅল নিয়ে ছত্রিশগড় এক্সপ্রেসে চড়ে বসলাম। বাকি জনতা স্টোভ ,মগ, বালতি অকুস্থলে গিয়ে দেখা যাবে। জীবনে গাঁয়ে থাকি নি। কলেজে পড়ার সময় এন এস এস এর ক্যাম্পে গেছি বটে, তবে সেসব গ্রামসমাজের বাইরে ক’দিনের জন্যে পিকনিক। সঙ্গে বন্ধুবান্ধব,স্যারেরা। 

ট্রেন লেট ছিল,বিলাসপুরে নামলাম বিকেল সাড়ে তিনটে। তারপর সারদা ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির বাস ছাড়ল চারটে আর কয়েক জায়গায় রোববারের বাজার হাটের সামনে গড়িমসি করে ঢিকিস ঢিকিস করে রওনা দিতে দিতে যখন শেষ স্টপ বলোদায় নামলাম। তখন শীতের কুয়াশা ঘন হয়েছে। বাস থেকে নামতেই ঝপ করে আলো নিভে গেল। দেখলাম এটা বলোদার শনিচরি বাজার। পাওয়ার কাট নিয়মিত হয়, আলো কখন আসবে,আজ রাতে আদৌ আসবে কি না কেউ জানে না। 

নতুন খুলেছে গ্রামীণ ব্যাংক, দেখা গেল অনেকেই চেনে না। শেষে জানা গেল ওটা এক কিলোমিটার দূরে বুধবারি বাজারে দুর্গাবাড়ির সামনে। একটাকা মেহনতানার বদলে একজন রাউত বাঁকে করে আমার লাগেজ বয়ে নিয়ে চলল, পেছন পেছন আমি। 

কিছু কিছু ঘরে টেমি জ্বলছে, কোথাও হ্যারিকেন, কোথাও মোমবাতি। অধিকাংশ ঘরে কিছু জ্বলছে না। তল্পিবাহক জানাল যে বেশির ভাগ লোক এই রুটিনে অভ্যস্ত, খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। 

একটা একতলা পাকা বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে বলল –এটাই ব্যাংক। 

ভেতরে গিয়ে একটু দমে গেলাম। ব্যাংক বলতে যেমন কাউন্টার, কাঁচের আড়াল, সফিস্টিকেটেড পোশাক আশাক মনে হয়। তেমন কিছুই নেই। গোটা কয়েক কাঠের র‍্যাক, দুটো স্টিলের আলমারি, একটা তেজারতি কারবারিদের সিন্দুকের মত, তার ওপরে একটা সোনার দোকানের মত ছোট্ট দাঁড়িপাল্লা। 

বুঝলাম,বতক বা হাঁস যেমন পাখি নয়, গ্রামীণ ব্যাংকও তেমনি ব্যাংক নয়। 

তিন জোড়া চেয়ার টেবিল। তাতে হ্যাজাক বাতির সামনে একজন গুরুজি বা স্থানীয় মাস্টারমশাই একটি বছর নয়ের ছেলেকে ১৫ কে পহাড়া রটা রহে থে। উলটো দিকে পাজামা ও গেঞ্জি পরা এক ভদ্রলোক কোলে একটি বাচ্চাকে নিয়ে আদর করছেন। আমি ম্যানেজার সিংঘানিয়া সা’বের খোঁজ করায় উনি নিজের পরিচয় দিয়ে হ্যান্ডশেক করে বললেন আগেই আপনার পোস্টিং বিষয়ক চিঠি এসে গেছে। কাল সাড়ে দশটায় ব্যাংক খুলবে। এখন কিছু খেতে চাইলে পাশে মল্লু ভাঁচার (মল্লু ভাগনের) হোটেলে ভাত ডাল পেয়ে যাবেন। আমি বললাম আজ রাতের মত খাওয়া হয়ে গেছে। ওঁর ইশারায় একটি ছেলে এগিয়ে এল। এখানকার চাপরাশি গোরেলাল আদিত্য। বললেন ফিল্ড অফিসার অনিল উইক এন্ডে ওর ঘর রায়পুরে গেছে। গোরের কাছে চাবি। আপাততঃ ওখানে শুয়ে পড়ুন। কাল ঘরের ব্যবস্থা পাকাপাকি করব। আর হ্যাঁ, মোমবাতি ও দেশলাই নিয়ে যান। আমার কাছে টর্চ ছিল,তবু প্রথমদিনেই গুরুজনের অবাধ্য হব না ভেবে নিয়ে নিলাম। 

ঘর ছোট,দেয়ালের কুলুঙ্গিতে আধপোড়া মোমবাতি ও কোন দেবতার ছোট্ট ফটো। একটা নীচু তক্তপোষ, গোরে তাতে হোল্ড অল খুলে দিয়ে বলল –শুয়ে পড়ুন, সকাল সাতটায় আপনাকে ডেকে চা খাইয়ে পুকুরপাড়ে নিয়ে যাব, প্রাতঃকৃত্য মুখারি সব করে একেবারে স্নান সেরে ঘরে ফিরবেন। আর মাঝরাতে সু-সু পেলে দরজা খুলে বারান্দা থেকে নীচে নেমে রাস্তার ধূলোর ওপর সেরে নেবেন। এখানে সবাই তাই করে। 

দরজা বন্ধ করে আধপোড়া মোমবাতি জ্বালিয়ে ব্যাগ খুলে দেখি মায়ের হাতে তৈরি বেসনের লাড্ডু আর সুজির পুর দেয়া গুজিয়া কিছু বেঁচে আছে। খেয়ে নিলাম। তারপর মোমবাতি নিভিয়ে রজাই মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। 

গাঢ় ঘুমের মধ্যে কোথাও একটা পেরেক ঠোকার মত আওয়াজ মাথার মধ্যে অনবরত ঠোকাঠুকি করতে লাগল। চোখ যেন আঠা দিয়ে সাঁটা,কিন্তু আওয়াজ চলছে। ধীরে ধীরে চোখ খুললাম, এ কোথায় শুয়ে আছি? এইসা ঘুপ অন্ধেরা তো মেরে ঘর মেঁ কভি নহী হোতী? কিন্তু একটা আওয়াজ যে আসছিল? থেমে গেছে? না,ওই শুরু হলো। ইঁদুর ? আরশোলা ? উঁহু, শব্দটা আসছে বাইরে থেকে কেউ যেন দরজায় টরে টক্কা গোছের একটা তালে তালে টোকা দিচ্ছে। আর ফিসফিস ফিসফিস ! শহরের ছেলে, ভূতের ভয় নেই,কিন্তু এই অচেনা জায়গায়? এমন রাতে? কে হতে পারে ? ঘুমের ঘোরে টর্চের কথা ভুলে গেলাম। বিছানা থেকে নেমে হালকা হাতে দরজা খুলতেই এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া ঘরের ভেতরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল। আর একজোড়া কনকনে ঠান্ডা হাত আমার গলায় ফাঁস হয়ে জড়িয়ে গেল। একটা হিসহিসে স্বর কানের কাছে বলে চলেছেঃ 

উঃ, কতক্ষণ ধরে ডাকছি, ঘোড়া বেচে ঘুমুচ্ছিলে? আমি যে শীতে জমে গেলাম। 

ভয়ে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়। কোনরকমে হাতের বাঁধন খুলে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম—কৌন, কৌন হো আপ? 

দু’সেকেন্ড; চমকে উঠে সেই স্বর বলে উঠলঃ হায় দাইয়া! 

আর আমি খালি ঘরে কাঁপতে কাঁপতে ভাবছিলাম? স্বপ্ন দেখছিলাম কি? কিন্তু দরজা বন্ধ করার পর অনেকক্ষণ ঘরের মধ্যে ভাসছিল এক গেঁয়ো নেবুতেলের গন্ধ। 

এক মিনিট সবাই চুপ। রূপেশ নিজের শূন্য গ্লাসের দিকে তাকিয়ে। রাজন ইশারায় বোঝাল আর নেই। তারপর শ্রীরাম মুচকি হেসে বলল – ক্যা কিসমত লেকর আয়ে হ্যাঁয় স্যার! নৌকরি কে পহেলা দিন হী ভূতনী সে মূলাকাত? পর আপ ছোড় দিয়ে কিউঁ? আমি হলে জাপটে ধরতাম পেত্নীকে, টর্চের আলোয় দেখে নিতাম ওর চেহারা। 

রূপেশ লজ্জা পেয়ে বলে ধ্যেৎ! 

রাজন বলে তারপর? সিংঘানিয়া সা’ব কো বতায়েথে? কহাঁ মরনে কে লিয়ে ভেজ দিয়ে থে আপ কো? আখির ও স্পিরিট কে হাত আপ কে গর্দন তক --! 

ও কথা শেষ করতে না পেরে দুদিকে মাথা নাড়তে থাকে। 

না,ম্যানেজার সা’বকে নয়; সকালে স্নানে যাবার সময় চাপরাশি গোরেলালকে বলেছিলাম। ও একচোট হেসে নিল। তারপর বলল যে কাউকে এ নিয়ে কিছু বলার দরকার নেই। আর আপনি তো আজ থেকে অন্য ঘর পেয়ে যাবেন। আজ অনিল এসে যাবে। ওটা ওর ব্যাপার, ও বুঝবে। 

খাসা গল্প; এবার জীবনে প্রথম মহুয়া খাওয়ার কিসসাটাও হয়ে যাক। রূপেশ মুচকি হেসে চুপ করে। এত কথা এদের বলে ফেলে কেমন ক্লান্ত লাগছে, আর একটু অস্বস্তি। 

শ্রীরাম চেঁচিয়ে ওঠে—আরে,আমাদের স্কাউটের দল ফিরে আসছে। বেওকুফলোগ নমক লানে কে লিয়ে ডান্ডি মার্চ করকে আ রহে শায়দ। 

তারপর নীচুগলায় বলে—দেখিয়ে সাব, এক ভূতনীকো ভী সাথ লা রহে হ্যাঁয়। 

সামনের দুটো কোসম গাছের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে আসছে ডোঙ্গরে ও টুল্লু। হাতে একটা বড়ো ব্যাগ, কিন্তু সঙ্গে একটি মেয়ে, মুখে সলজ্জ হাসি। কাছে এলে চোখে পড়ল কপালে একটা তেরছা কাটা দাগ। সেভিংস ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নাম্বার ১/১০; দ্রুপতী বাঈ। 

দলটা এসে হাতের ঝোলা নামিয়ে ধপ করে ঘাসের উপর বসে পড়ে। সবার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ওদের দেখে ভুলে থাকা খিদে যেন নতুন করে চাগিয়ে উঠল। 

তোদের ব্যাপারটা কী? আজ কি চায় – নাস্তার পিকনিক? 

ডোঙ্গরে ঢক ঢক করে জল খায়,তারপর জানায় যে আচ্ছা চক্করে ফেঁসে গেছল। ওই পাড়াটা অত কাছে নয়; রাস্তাও তথৈবচ। তারচেয়ে বড়ো ব্যাপার হলো গাঁয়ে কোন মুদি দোকান নেই। ওদের কিরানা সামান ছুরিকলাঁ গাঁ থেকেই আসে। আর কোন পরিবার ঘরের নুন বেচবে না; বলে এমনি নিয়ে যাও। যত বলি আমাদের সা’ব মিনি মাগনা কিছু নেন না ওরা মাথা নাড়ে। কিন্তু নুন না নিয়ে ফেরত আসি কী করে ? 

শেষে জঙ্গলের পথে এই মেয়েছেলেটার সঙ্গে দেখা; ঠুল্লু চেনে, বলল ও নাকি আমাদের কাস্টমার। মেয়েটা সব শুনে নিজের ঘর থেকে নুন তেল আরও কিছু নিয়ে এল। বলল অনেক বেলা হয়ে গেছে আমাদের সঙ্গে এসে মাংস রেঁধে দেবে। 

রূপেশ অস্বস্তি বোধ করে। তারপর দ্রুপতীকে ধন্যবাদ দিয়ে বলে যে রান্নাটা ডোঙ্গরে সাহাব করবে, আগে থেকে ঠিক হয়ে আছে। 

দ্রুপতী হার মানবার পাত্র নয়। গলা চড়িয়ে বলে –তা ডোঙ্গরে সা’ব এতক্ষণ কী করছিল? দুটো বেজে গেছে। শীতের দুপুর। চারটের পর সূর্য পাহাড়ের আড়ালে চলে গেলে এখানে তাড়াতাড়ি অন্ধকার নেমে আসবে। আপনারা ঘরে ফিরবেন না ? 

শ্রীরামের মাত্রাটা বোধহয় একটু বেশি হয়ে গেছল। একটা কৃত্রিম চেরা আওয়াজে বলে – না হয় নাই ফিরলাম, তোর ঘরে মেহমান হই যদি? থাকতে দিবি তো? 

রূপেশের চোয়াল শক্ত হয়। দ্রুপতী শ্রীরামের অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে রূপেশকে বলে যদি ওর হাতে খেতে সাহাবের আপত্তি না থাকে তো জিদ না করে ওর কথাটা মেনে নেওয়া হোক। ওর অনেক গুরুজির বাড়িতে রান্না করে অভ্যেস আছে। এইসব নৌসিখিয়াদের উপর ভরসা করলে সারাদিন উপোস করে থাকতে হবে। 

৬) “ লে চল পার, লে চল পার” 

দ্রুপতী বাঈ দ্রুত হাতে গরম ভাত, ডাল, আলুভাজা ও মুরগীর পাতলা ঝোল নামিয়ে ফেলে। কিন্তু তার আগে ঝগড়া বাঁধে। ওকে সাহায্য করতে এসে ডোঙ্গরে ও ঠুল্লু একগাদা রসুন পেঁয়াজ ছুলে ও লাললংকা কেটে একটা ডেকচির থালায় সাজিয়ে দিয়েছিল। দ্রুপতী দেখে প্রথমে মুখ বাঁকায়, তারপরে সেগুলোর চারভাগের তিনভাগ ডোঙ্গরে ঠুল্লুর হাঁ হাঁ করে ওঠা অগ্রাহ্য করে একপাশে সরিয়ে রাখে। বলে এত গরম জিনিস দিয়ে রান্না হলে সাহেবদের পেট গরম হবে। হতাশ ঠুল্লু বলে –ইতনী কম! সোয়াদ কেইসে হোগী? 

--আরে বজ্রমুরখ! সির্ফ মশল্লা ঠুস দেনে সে সোয়াদ হোতে? তোলা কউন বাতাইস? 

--মোর হোটেল কে খানা পাকানেওয়ালে! 

-- ওমন শাম কো দারুহামন কে লিয়ে এইসন পাকাথে! 

ওরা যত মদোমাতালদের জন্যে ওইরকম মশলাদার ঝাল ঝাল রান্না করে। 

কিন্তু রান্না নামলে সবাই চেটেপুটে খেল, ডোঙ্গরে বিড় বিড় করল –ভুখ লগনে পর সবকুছ স্বাদিষ্ট লগতে হ্যাঁয়। 

ডোঙ্গরে, ঠুল্লু ও দ্রুপতী একটু আলাদা করে বসে আড়াল করে খাচ্ছিল। কারণটা একটু পরে বোঝা গেল। নুন-তেলের সন্ধানে বেড়িয়ে ওরা মহুয়া চাখার সুযোগ পায় নি, তাই। 

রাজন ও শ্রীরাম রূপেশকে সিগ্রেট বাড়িয়ে দিয়ে বলে –স্যার, এই মওকায় আপনার মদ খাওয়ার ট্রেনিং এর গল্পটা বলে ফেলুন। কে দিল ট্রেনিং? স্টেট ব্যাংকের সিঙ্ঘানিয়া সা’ব? 

--ধ্যাৎ, সিংঘানিয়া সা’ব সাত্ত্বিক রুচির মানুষ। পাক্কা ফ্যামিলি ম্যান। দারু-সিগ্রেট কুছ নহী চলতা। সির্ফ চায় অউর পান,মিঠিপাত্তি –উসমে লং, ইলাইচি, কত্থা, চুনা, কিমাম, রিমঝিম ব্যস। 

তবে উনি এক মঙ্গলবার আমাকে ওঁর চ্যালা ভাগবত সোনীর সঙ্গে পান্তোরা গ্রামে হাটের দিন কিছু দোকান ইন্সপেকশন করতে আর রিকভারি আনতে পাঠালেন। সেদিন গাঁয়ে ‘রাত্রিবাস’ করতে হবে। কী আপদ! তবে ভাগবতজী আশ্বস্ত করল যে ওসব নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। ওই আমার গার্জিয়ান হবে। ও নিজে ওই হাটে সুনারি ধান্ধা, মানে রূপো আর ডালডার নকল গয়না নিয়ে বসে। চাষি বৌদের গছিয়ে কিছু কামিয়ে নিয়ে ফেরে। 

আমি মল্লু ভাঁচার হোটেলে দুপুরের ডাল ভাত খেয়ে সাইকেলে চড়ে রওনা দিলাম। সঙ্গে ব্যাংকের রিকভারি বুক, দোকানের লিস্ট ইত্যাদি ঝোলায় নিয়ে পিওন গোরেলাল। ওর সাইকেল আমার আগে আগে, পথ দেখিয়ে চলেছে। পান্তোরা বড়ো গাঁ, অকালতরা রাজ পরিবারের এক বংশজের জাগিরদারি, দলহা পাহাড়ের নীচে। মাইলস্টোন দেখে জানলাম ২৪ কিলোমিটার দূর। কতক্ষণ লাগবে? এই দু’ঘন্টা; রাস্তা খারাপ যে! 

আমি প্যাডল করতে শুরু করি। জীবনে দশ থেকে পনের কিলোমিটারের বেশি চালাইনি। হ্যাঁ, রাস্তা নতুন তৈরি হচ্ছে, লুজ মোরাম, বড়ো বড়ো পাথর এবং খোয়ার টুকরো। পাশে মাঠে নেমে শর্টকাট করতে চাইলে ধানক্ষেতের আল বড়ো বাধা, এছাড়া রয়েছে ধানকাটার পর খোঁচা খোঁচা ধানের গুঁড়ি। পেরিয়ে যাই ভেলই, খিসোরা গ্রাম। রাস্তা ক্রমশঃ খারাপ থেকে আরও খারাপ হচ্ছে। 

আমার অবস্থা দেখে গোরেলাল সান্ত্বনা দেয় – আর একটু, এর পর ক্যানাল আর ব্যারেজ পড়বে। ব্যারেজের পাশ দিয়ে শেষ আট কিলোমিটার আরামে সাইকেল চালাতে পারবেন। 

কিন্তু ব্যারাজ পৌঁছুতে পৌঁছুতে আমার অবস্থা কাহিল। পা চলছে না,ঘামে ভেজা প্যান্ট সিটের সঙ্গে যেন লেপটে গেছে। নড়লে চড়লে পশ্চাতদেশে জ্বালা করছে। কয়েক গজ এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছি, গোরেলাল আগে গিয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমি আস্তে আস্তে প্যাডল করে ওকে ধরে ফেলি, ও হেসে বলে শীতের সন্ধ্যে তাড়াতাড়ি নামে। এভাবে চললে--! 

দুঃখের কালী রাত ও আখির গুজর জাতী হ্যাঁয়। আমরা পান্তোরা হাটে যখন পৌঁছে গেলাম তখন সূর্যের রঙ গোলাপি। আমি সাইকেল থামিয়েছি, নামতে পারছি না। গোরে এসে আমাকে ধরে ধরে নামায় ও সাইকেল স্ট্যান্ডে রাখে। আমার লাগছিল যেন পাছার চামড়া গুটিয়ে গেছে। কোথা থেকে হাজির হয় ভাগবত সোনী। গোরের থেকে রিকভারি পর্চি বুক, পেন ও খাতকের লিস্ট নিয়ে আমাকে ওর সঙ্গে যেতে বলে। গোরে আরেকটা বুক নিয়ে অন্যদিকে পা চালায়। 

আমাকে বোঝায় যে পৌঁছুতে দেরি করে ফেলেছেন স্যার। তাই দু’জন দু’দিকে গেলে বেশি ইউনিট ইন্সপেকশন হবে। গোরের সব দোকান চেনা আছে। আপনাকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। বাকি কাল সকালে হবে। আগে একটু চা খেয়ে নিন। 

আমরা চা ও চিনির কটকটি এবং ভাজিয়া খেয়ে নিই। দাম দিতে গেলে সোনীজি হাত চেপে ধরে। বলে এখন প্রোবেশন চলছে। যখন পুরো ম্যানেজার হবেন, তখন দাম দেবেন। আর এটুকু আমার হাটে দোকান লাগালে পকেট খরচা, হিসেবে ধরা আছে। 

তারপর ভাগবত সোনী আমাকে প্রায় হাত ধরে গোটা পাঁচেক দোকানের সামনে এক এক করে নিয়ে গেল। ওরা তখন ভাঙা হাটে পসরা গোটাতে ব্যস্ত। পরিচয় পেয়ে সবাই আমাকে হাত কপালে ঠেকিয়ে বলে ‘জয় রাম সাহাব’। কিন্তু কিস্তির কথা তুললেই বলে আজ বিক্রিবাটা ভাল হয় নি। কাল ব্যাংকে গিয়ে দিয়ে আসবো। আমি আনাড়ি, হাল ছেড়ে দিই। কিন্তু সোনী মুচকি হেসে বলে ইনি প্রথমবার তোমার দ্বারে এসেছেন, সাঁঝের বেলা, খালি হাতে ফিরিও না; যা হোক কিছু দাও। 

এতে কাজ হলো, শুধু একজন মহাঢিট বাদে। তারপর সোনী বলে --চলুন,আমাদের রৈনবসেরা বা রাত্রিবাসের জায়গায়। একটা ছোট ঘর আমরা ভাড়া নিয়ে রেখেছি। আমরা মানে বলোদা গাঁয়ের চার ব্যাপারি; বলতে পারেন চার বন্ধু। আমি, সদনলাল রেডিমেড জামাকাপড়ের ধান্ধা, চন্দ্রিকা দর্জি আর হেমন্ত গুড়াকুওয়ালা, অর্থাৎ গুড় তামাক মিশিয়ে দাঁতে ঘষার ‘মিশি’ বিক্রিওলা। আমরা সপ্তাহে চার জায়গার হাটে দোকান লাগাই। সবখানেই ঘর ভাড়া নিয়ে রেখেছি যাতে রাত্রে বাড়ি না ফিরে এখানেই খাওয়াদাওয়া করে এক ঘুম মেরে গায়ের ব্যথা দূর করে পরের দিন সকালে বাড়ি ফিরি। 

চলতে চলতে চোখে পড়ে এক অশত্থ গাছের নীচে ব্যাংকের চাপরাশি গোরেলাল।। একটি মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আলাপচারিতায় মগ্ন। আমি উৎসাহিত হয়ে ওর নাম ধরে ক’বার চেঁচালাম, কিন্তু ও শুনতে পেল না। সোনী আমার হাত ধরে টানে। ও এখন শুনতে পাবে না। গোরে ‘খুবসুরতি’ (সৌন্দর্য) দেখায় ব্যস্ত। ও ঠিহায় পৌঁছে যাবে, আপনি চলুন তো! 

চলার পথে জানতে চায় আমি খুবসুরতি দেখতে আগ্রহী কি না ! আমি রেগে গিয়ে জানতে চাইলাম যে ওদের কি খারাপ অসুখ-বিসুখ হওয়ার ভয় নেই ? তাতে সোনীজি আহত অভিমানে বলল—আপনি কি ওদের বেশ্যা ভেবেছেন? ভুল। ওরা গেরস্ত ঘরের কৃষকবধূ। খালি ‘নজরে দো চার’ ! নয়নে নয়ন মিললেই হলো। আপনার যদি ভাল লাগে তাহলে --! ওরা শুধু ভালবাসা চায়। এটা ভালবাসার সম্পর্ক। 

--আচ্ছা? এই ভালবাসাবাসির আয়ু কতদিন? 

ও যেন আমার গলায় ব্যঙ্গের সুর খেয়াল করেনি। বলে যে আমি যতদিন চাইব, ততদিন। হাত জোড় করে বলি এই অভিনব ভালবাসা আপনাদেরই মুবারক হো। আমি ওতে নেই। একটি খাপরা ছাওয়া বাড়ির মাটির উঁচু দাওয়ায় উঠে দেখি সবাই হাজির। সদনলাল, চন্দ্রিকা, হেমন্ত, মায় গোরে পর্য্যন্ত। ও নাকি ওই মেয়েটির সঙ্গে একটা মুরগী নিয়ে দরদাম করছিল। আমি কি তাহলে ভুল বুঝলাম? কিন্তু হেমন্ত একটি থলের থেকে পা বাঁধা দুটো মুরগী বের করে। গোরেলাল নিয়ে আসে এক লোটা জল ও একটি হাঁসুয়া। হেমন্ত এক পা দিয়ে মুরগীর পা চেপে ধরে হাঁসুয়ার দুই পোঁচে পাখির গলাটা আলগা করে দেয়। কবন্ধ ডানা ঝটপট করে, ছিন্নমুন্ড খাবি খেতে খেতে চোখ বুজে ফেলে। গোরে আমার দিকে জলের মগ এগিয়ে দেয়। আমি কী করতে হবে বুঝতে পারি না। 

সবাই দেখি আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। কেন? 

হেমন্ত আমাকে সম্বোধন করে—সাহাব, পানি পিলাইয়ে। 

কাকে? 

কাকে আবার, পাখিটাকে। 

কেন? 

ফের কেন? আরে পাখিটা মরে অন্য দুনিয়ায় চলে যাচ্ছে,শেষ সময়ে মুখে জল দিতে হয় না ? কিছুই জানেন না নাকি? ওই দেখুন, তেষ্টায় কেমন ঠোঁট দুটো বার বার খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে! 

আমার তথাকরণ। সবাই জয় রাম বলে ছাল ছাড়াতে আর মশলা পিষতে লেগে যায়। আমি ওদের জানাই যে সারা গায়ে খুব ব্যথা, হাত পা নাড়লেও ব্যথা। রাতে ঘুমুতে পারবো না। কারো কাছে অ্যানালজিন বা ডেসপিরিন আছে কি না ? 

নাঃ,কারও কাছে ওসব কিস্যু নেই। আর হাটের কাছে যে দাওয়া দুকান তার ঝাঁপ সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেছে। এখন উপায়? 

সবাই একযোগে জানায় যে একটাই দাওয়াই আছে। গোরের সঙ্গে গিয়ে হাটের আরেক মাথায় দেশি মদের দোকান থেকে এক গেলাস গিলে আসুন, গায়ের ব্যথা পেইলে যাবে, রাত্তিরে নাক ডাকিয়ে ঘুমোবেন। 

অসহায় ভাবে গোরের দিকে তাকাই, ও মাথা কাত করে বলে ৫০ এম এল, তার বেশি নয়। দুরুদুরু বুকে রওনা দিই। হাটের দোকান প্রায় উঠে গেছে। কোথাও কোথাও বোঁচকা বাঁধা হচ্ছে, টেমি জ্বলছে; কাছেই বৈলগাড়িতে অথবা সাইকেলের পেছনে মাল তোলা হচ্ছে। কিন্তু বাজারের এক কোনায় কাপড় দিয়ে ঘেরা তাঁবুতে বিজলি আলো! 

কাছে গিয়ে দেখি লাইন দিয়ে লোকে ঢুকছে আর ক’পাত্তর গিলে গোঁফ মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসছে। আর এঁটো প্লাস্টিকের গ্লাস একটা বালতির পাশে নামিয়ে লাগছে। বালতির জল এরমধ্যেই ঘোলা হয়ে গেছে। সেই গোণাগুনতি গ্লাসেই সবাই এঁটো করে খাচ্ছে। আমার অন্তরাত্মা রী রী করে ওঠে। আর গেলাস নেই,দুনিয়াভরের লোকের এঁটো মদ খেতে হবে? 

কাউন্টারের ওপাশে মাঝবয়সী বিক্রেতা শুনতে পেয়ে খিঁচিয়ে ওঠেঃ রাখুন তো মশাই আপনার এঁটো! শুনিয়ে শ্রীমান, আওরত অউর দারু কভি ঝুটা নহীঁ হোতে! 

নারী ও মদিরা কখনও এঁটো হয় না। 

এক চুমুক খেয়েই মনে হলো –না,না; ইটা চইলবেক নাই। 

পাশ থেকে গোরে বলে নাক টিপে ওষুধ ভেবে বাকিটা খেয়ে ফেলুন। সবাই অপেক্ষা করে আছে, রান্না নামতে আর বেশি দেরি নেই। 

রাত বাড়ে। মাটিতে কাগজ বিছানো হয়েছে। তার উপর একটা করে চাদর পেতে সবাই একটা চাদর গায়ে দেয়। এসবই চাদর-গামছা-জামাকাপড় বিক্রেতা সদনলালের বদান্যতায়। ওর মাল থেকে লেবেল সাঁটা চাদরের পিন খুলে আমাদের দিয়েছে। সকালে আবার ভাঁজ করে পিন লাগিয়ে যথা পূর্বং। 

কখন যেন দ্রুপতী ঠুল্লু ও ডোঙ্গরে এসে পেছনে দাঁড়িয়ে হাঁ করে ম্যানেজারের কারণবারিতে দীক্ষাগ্রহণের গল্প শুনছিল। এবার নীচু গলায় দ্রুপতী জানায় রওনা হওয়া দরকার। ভিজে হাওয়া, মনে হচ্ছে পাহাড়ে বৃষ্টি হয়েছে। নদীতে জল বেড়ে যাবে। 

জিনিসপত্র গুছিয়ে নদীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়াতেই চিত্তচমৎকারা! জলের নিশানা দেওয়া 

কাঠিগুলো ডুবে গেছে। কারও মুখে কথা নেই। পাহাড় থেকে নেমে আসা জল মিশে এখন জল বেশ ঘোলাটে। কোথায় কত গভীর কী করে বোঝা যাবে? 

শ্রীরাম বলে আমরা হাতে হাত ধরে জলে নামব, এক-পা এক-পা করে এগোবো। 

সবাই সমর্থনের আশায় রূপেশের দিকে তাকায়। ও এক এক করে সবাইকে দেখে। খেয়াল হয় একজন কম, দ্রুপতী যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। যাকগে, ওকে কি নিজেদের দলের মধ্যে ধরা ঠিক হবে? তায় ওর কুঁড়েঘর তো এ পারেই; নিঘঘাৎ নিজের ঘরে গেছে, ঠিকই করেছে। 

ও জানতে চায় ক’জন সাঁতার জানে, ও নিজে জানে না। শ্রীরাম বিলাসপুরের সরকারি সুইমিং পুল ‘সঞ্জয় তরণ পুষ্কর’ এ কোচের কাছে শিখেছে। কিন্তু সে তো স্থির নীল জল। তার গভীরতা জানা আছে। এ যে পাহাড়ি নদী, তায় জলের মধ্যে ছোট ছোট ঘুর্ণি। এই নদীই কি ওরা সকালে ছপছপিয়ে পেরিয়ে এসেছিল! অন্ধকার নামছে দ্রুত, অতি দ্রুত। হাওয়ার বেগ বাড়ছে। টর্চ কার কাছে? 

সমাধান নেই,কারও মাথায় কিছু আসছে না। গুজগুজ ফুসফুস; অন্য কোন দিক দিয়ে রাস্তা খুঁজে নদী পেরোলে হয় না ? ধ্যাৎ, অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে! বাওরা হো ক্যা? তাহলে? এখানেই কোথাও রাতকাটানো? দূর! এই গ্রামটা হতচ্ছাড়া। গ্রাম কোথায়,খালি কয়েকটা ঝুপড়ি। তাহলে? 

এমন সময় জলে ছপ ছপ শব্দ। আবছা অন্ধকারে একটা ডিঙি নৌকো ধীরে ধীরে ওদের দিকেই এগিয়ে আসছে। ওরা গা ঘেঁষাঘেষি করে। চালক লগি মেরে ডিঙিটাকে ওদের কাছাকাছি ভিড়িয়ে দিয়ে পাড়ে নামল। ওদের মুখে কথা নেই কারণ চালক একটি মেয়ে—দ্রুপতী। 

প্রাথমিক বিস্ময়ের ধাক্কা কাটিয়ে উঠে ওরা চেঁচায়—কোথায় গেছলি তুই? আমাদের না বলে? 

দ্রুপতী বিরক্তিতে খিঁচিয়ে ওঠে। ই হমর গাঁও, তুমন পহুনা। মোলা কাবর কোনো লা বতাকে জানা পড়ি! 

এটা আমার গাঁ, তোমরা হলে অতিথি। আমি কেন কাউকে বলে যাব? 

গাছের গুঁড়ি থেকে তৈরি এই ডোঙা আমাদের গাঁয়ের। জল বাড়লে পারাপার করার জন্যে। এখন চল, তোমাদের ওপারে পৌঁছে দিয়ে আমি আবার এটা নিয়ে ফিরে এসে পাড়ে বেঁধে রাখব। একজন একজন করে উঠে পড়, বসার জায়গা নেই, মাঝখানে সারি দিয়ে দাঁড়াতে হবে। সবার আগে ঝোলা নিয়ে ঠুল্লু ও ডোঙ্গরে ওঠে। তারপর সন্তর্পণে রূপেশ। দ্রুপতী হাত বাড়ায়, রুপেশ ইতস্তত করে। দ্রুপতী বোঝায় এলোমেলো ভাবে চড়লে ডিঙি দুলবে, উলটে যেতে পারে। তারপর রাজন এবং সবার শেষে শ্রীরাম। শ্রীরামের কি পেটে মহুয়া বেশি চলে গেছে? টলে গিয়ে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছে ? নদী বেশি চওড়া নয়। অভ্যস্ত হাতে লগি ঠেলে চলে দ্রুপতী। ডিঙি সহজে ওপারে পৌঁছে যায়। সবাইকে হাত ধরে নামাতে থাকে দ্রুপতী। শ্রীরাম স্খলিত স্বরে বলে –এই অন্ধকার রাতে কোথায় ফিরে যাবি? আজ রাতে তুইও আমাদের পহুনা হয়ে ছুরিতে থাক। কাল ফিরে যাস। 

দ্রুপতী হেসে ওঠে। সাহাবমন, তুমন জুম্মা জুম্মা ছুরি আয়ে হো। মোর নাম ‘ভালুমার দ্রুপতী’, মেঁহা অপন মন কী রাণী। জহাঁ মন লাগিস উঁহা চল দেথন। কমর ম এক হাঁসুয়া রাখে হন। ই অন্ধেরা ই জানবর মোলা কা ডরাহি? 

সাহেব, নতুন নতুন ছুরিতে এসেছ, তাই জান না। আমার নাম ‘ভালুমারা দ্রৌপদী’। আমি নিজের মনের রাণী। যেখানে মন চায় চলে যাই। কোমরে সব সময় একটা হাঁসুয়া গোঁজা; এই অন্ধকার, জানোয়ার?— আমার কিসের ভয়? 

অন্ধকারে লগির ছপ ছপ আওয়াজ ক্রমশঃ মিলিয়ে যায়। 

রাত্তিরে রূপেশের অনেকক্ষণ ঘুম আসে না। কোন একটা কাজ পেন্ডিং? উঠে নিজের ব্রিফকেস খোলে। ব্যাংকের লেটার প্যাড বের করে তাতে দুটো কার্বন লাগিয়ে চিঠি লেখে। 

এতদ্বারা প্রধান কার্যালয়কে সূচিত করা হইতেছে যে আপনাদের পূর্ব পত্র ক্রমাংক অমুক দিনাংক তমুকের মাধ্যমে প্রাপ্ত নির্দেশানুসার নিম্ন উল্লিখিত দুই ট্রেনি অফিসার, যথাক্রমে, শ্রীমান শ্রীরাম চিত্তাওয়ার ও শ্রীমান বিপুল ডোঙ্গরেকে দুই মাস ট্রেনিং ও ডেপুটেশন যথাযথ পূর্ণ হওয়ায় আজ কার্যালয়ীন সময়ের শেষে বর্তমান শাখা হইতে দায়িত্বমুক্ত করিয়া অবিলম্বে প্রধান কার্যালয়ে রিপোর্ট করিতে নির্দেশ দেওয়া হইতেছে। 

ভবদীয় 

শাখা প্রবন্ধক

ঘরের কোণায় রাখা কুঁজো থেকে এক গেলাস জল গড়িয়ে ঢক ঢক করে খায় রূপেশ। তারপর লাইট নিভিয়ে বিছানায় শোয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়ে।

0 comments: