0

প্রবন্ধ - জ্যোতিপ্রসাদ রায়

Posted in

২৯ শে আগষ্ট বিদ্রোহী কবির মৃত্যু দিন। তার সপ্তাহ খানেকের মধ্যে গুরু-প্রণাম। পোষাকি নাম—শিক্ষক দিবস। প্রায় হারিয়ে যাওয়া, নিরাসক্তভাবে ছাড়াই-বাছাই করা অনেক অচেনা তথ্য সমৃদ্ধ এম. আবদুর রহমানের লেখা, ‘কিশোর নজরুল’-এর(১৯৬৩) পোকায় কাটা পাতা ওলটাতে ওলটাতে বেরিয়ে এল কবির ছাত্রজীবনের কত ধুলো-পরা ‘কথা’ এবং ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের কত অপরিচিত ‘সাবেকি’ উত্তাপ! যা, একালের নিরিখে অবিশ্বাস্য; তবে সব ক’টি প্রদীপ নিভে যায়নি বলেই কোনো কোনো ছাত্রের কাছে হয়ত আকর্ষণীয় হতে পারে। 

মেঘ ছাড়া বৃষ্টিপাত হয় না, তেমনি ‘গুরু বিনে’ সাফল্যের ‘সোনার গৌর’ অধরা— এই লোকায়ত বিশ্বাস-সংস্কার আজও ছড়িয়ে আছে গ্রামবাংলার আকাশে-বাতাসে। কারো মনে যদি সৎ পথে ও হাড়ভাঙা খেটে পাওয়া ‘সাফল্য’-কে স্থায়ী করার বাসনা থাকে, ‘হৃদ-মাঝারে’ ধরে রাখার আকুতি থাকে, তাহলে গুরুর জীবনমুখী ধ্যান-ধারনা,রীতি-নীতি,আদর্শ ও সৌজন্যবোধের ধারাবাহিক অনুশীলন দরকার। এমন নিষ্ঠাবান জীবনচর্চায় মিলতে পারে কালোত্তীর্ণ পরিসরে নন্দিত মনুষ্যত্বের মহিমা। আর তখন, একদা সাদামাটা ক্ষণস্থায়ী জীবনের দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসে রকমারি কৌতূহল ও চেনা-জানার আগ্রহ। কালের বাঁকে বাঁকে চলমান জীবন সন্ধান করে, বেঁচে থাকার পুঁজি ও পাথেয়। প্রথাগত বিদ্যাচর্চার আঙিনায় ছাত্র নজরুলের জীবনেও শিয়ারসোল-দরিরামপুর-মাথরুন হাইস্কুলের শিক্ষকদের অবদান তাঁর লেখনীতেই স্বীকৃত। গুরুকুল তাঁর মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন ভাবীকালের একজন প্রতিভাবান বাঙালির কায়া ও ছায়া; অন্যদিকে নজরুল তাঁদের স্নেহ-ভালবাসার সান্নিধ্যে নিজেকে গড়ে-পিটে নিচ্ছিলেন দেশের তথা দশের জন্য একাকী নির্জনে। 

বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের প্রথাগত ছাত্রজীবন যেমন কিংবদন্তি নির্ভর, তেমনি চিত্তাকর্ষক। পেয়েছেন অনেক গুণী শিক্ষকের স্নেহ-ভালবাসা-আশীর্বাদ। শ্রেণি কক্ষে পাঠ্যবস্তুর বাইরে কোনো শিক্ষক তাঁকে অণুপ্রাণিত করেছেন সাহিত্য চর্চায়, কেউ আবার নিজের কাছে বসিয়ে তালিম দিয়েছেন সঙ্গীতের সুর,তাল,লয় (সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল)। কারো উৎসাহ ছিল, তাঁকে ভাল করে শিখিয়ে দেবেন পার্সী ভাষার পাঠ ও বর্ণমালা(দ্বিতীয় মৌলবী নূরুন্নবী)। কারো কাছে পেয়েছেন নিবিড় দেশভক্তিজনিত আত্মত্যাগের আনন্দ-কস্তুরী (নিবারণচন্দ্র ঘটক)। সব মিলিয়ে ছেলেবেলায় বিদ্রোহী কবির শিক্ষক-ভাগ্য ছিল ঈর্ষণীয়। তাঁর প্রতিভার বিকাশ ও প্রসারের অনুকূল। উল্টোদিকে ছাত্র নজরুল ইসলাম, তাঁর গুণগ্রাহী অভিভাবক তুল্য শিক্ষিককুলের চরণে মাথা ঝুঁকিয়ে শুধু সমকালে নিখাদ শ্রদ্ধা-সম্মান-ভক্তি নিবেদন করেন নি; দেশ-জোড়া কবি খ্যাতি অর্জনের পরেও শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রাবস্থার স্মৃতিবাহিত আবেশে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বারংবার তাঁদের সঙ্গে দেখা করেছেন। তাঁদের দিনযাপনের খোঁজ-খবর নিয়েছেন। সুযোগ পেলেই যথাযোগ্য সম্মান জানিয়ে গর্বিত করেছেন নিজেকে। 
এবার কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যাক। শিয়ারসোল স্কুলের শিক্ষক ভোলানাথ স্বর্ণকারের অবসরের দিনে (১৬ জুলাই, ১৯১৬) অভিনন্দন পত্র রচনার ভার পড়ে নজরুলের ওপর। সেদিন বিদায়ী কবিতার ছত্রে ছত্রে কিশোর-কবি নজরুল উজাড় করে দিয়েছেন শিক্ষকের উদ্দেশ্যে তাঁর প্রণত অন্তরের অপরিমেয় শ্রদ্ধা-ভক্তি। ছাত্র-নজরুলের কাছে শিক্ষক’রা হলেন আশ্রয়,প্রশয় আর জীবন গঠনের দক্ষ কারিগর। লিখলেন ভোলানাথ বাবু’র সম্মাননা পত্রে : ‘ সন্তানে ফেলিয়া পিতা কখন যায় কি কোথা ?’ কিংবা ‘ উঠরে বালক দল মুছিয়া আঁখির জল / করে নে বরণ ডালা দে গলে পরিয়ে মালা / চরণ ঢাকিয়া দে রে প্রসূণ রাশিতে / পাবি না আর যে কভু এ ভাল্‌বাসিতে।’ এ ত গেল ছাত্র থাকাকালীন পূজনীয় শিক্ষকদের প্রতি তাঁর দৃষ্টিপাতের ধ্রুবপদ। অন্তঃস্থলের বেল-জুঁই, শিউলি-বকুল। কিন্তু বিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়া শিক্ষকদের প্রতি উত্তরকালে যশ-খ্যাতির নিরিখে প্রতিষ্ঠিত কবি-গীতিকার নজরুলের মানসিকতা যেন আরো বেশি পরিমানে সামাজিকতায়, স্বতঃপ্রণোদিত দায়িত্ব-কর্তব্য বোধে উন্মুখর। আন্তরিকতায় ও বিনীত নম্রতায় রোদ ঝলমল। পারস্পরিক স্নেহ-ভালবাসায়, প্রীতির বন্ধনে ভাস্বর। তাই একদা কাটোয়ার মাথরুনের নবীনচন্দ্র ইন্সটিটিউসনের প্রধান শিক্ষক কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিককে নজরুল পত্রে লেখেন(৬.৪.১৯৩৬) : 
“ শ্রীচরণারবিন্দেষু, 

বহুদিন আপনার শ্রীচরণ দর্শন করিনি।...আমি বর্তমানে H.M.V. Gramophone Co.-এর Exclusive Composer… আপনার ‘অধরে নেমেছে মৃত্যু কালিমা’ গানটির permission (রেকর্ড করার জন্য) চান কোম্পানী।... আপনার অনুমতি পেলেই কোম্পানী আপনাকে Royalty দেওয়ার অঙ্গীকার পত্র পাঠিয়ে দেবে।... প্রণত : নজরুল ইসলাম।” 
এই পত্রের সম্বোধন থেকে শেষ পর্যন্ত--- প্রতিটি উচ্চারণের খাঁজে-ভাঁজে লুকিয়ে আছে ছাত্রসুলভ স্নেহ-ছায়া লাভের ‘মিনতি’ (যদিও তাঁদের দুজনের প্রথামাফিক ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের কালসীমা অতিক্রম করে গেছে দু’দশকের ওপর; তবু নজরুলের অন্তরে এখনো বহমান, অগ্রজের স্নেহ-ভালবাসাসহ অমেয় কৃপালাভের আকুতি !) 

ছাত্র নজরুলের দিক থেকে অনুরূপ শ্রদ্ধা-ভক্তির নমুনা যথারীতি পরিস্ফুট হয়েছে ময়মনসিংহের দরিরামপুর হাইস্কুলের শিক্ষক মহিমচন্দ্র খাসনবিশ, শিয়ারসোল হাইস্কুলের শিক্ষক সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল, হরিশঙ্কর মিশ্র, মৌলবী হাফেজ নূরুনব্বী, নিবারণচন্দ্র ঘটক, বিপিন বিহারী গঙ্গোপাধ্যায় এবং অবশ্য এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়দের শ্রীচরণে। শিক্ষক নিবারণচন্দ্র ঘটক ও বি.বি. গাঙ্গুলির কাছ থেকে গোপনে ‘সর্বহারা’র কবি পাঠ নিয়েছিলেন, পরাধীন দেশকে নিঃস্বার্থে ভালবাসার মন্ত্র ও শক্তি। তাঁদের নিখাদ দেশ-ভক্তির মহত্তর প্রেরণায় জীবনের মূল্য তুচ্ছ জ্ঞান করে হঠাৎ একদিন বিদ্যালয়-ছুট কিশোর নজরুল, ৪৯ বেঙ্গলি রেজিমেন্টে যোগদানের উদ্দেশ্যে উঠে পড়েন করাচিমুখী ট্রেনে। ট্রেন ছেড়ে দেয়। বাইরের দৃশ্যপট মতো একে একে তাঁর জীবন থেকে ক্রমশ দূরে সরে সরে যায় ক্লাসে প্রথম স্থানাধিকারী ছাত্রের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নসম্ভার আর স্নায়ুজুড়ে ঘাই মারে দেশোদ্ধারের কঠিন সাহস ও নিভৃত শপথের অস্থির অনুভূতি।

জ্যোতিপ্রসাদ রায়  - অধ্যাপক, কোচবিহার পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়

0 comments: