গল্প - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
Posted in গল্প
তার সাথে প্রথম দেখা ফাগুনদিনেই। তখন বয়সে সবে উন্মেষের ফুল একটা দুটো ফুটতে শুরু করেছে। পরের দিন ছিল দোলপূর্ণিমা। কলেজে ছুটি দুদিন, বারটা ছিল বৃহস্পতির। আমরা ক্লাস শেষের পর কিঞ্চিৎ আবির রঞ্জিত হবার বাসনায় জড়ো হয়েছি প্রাঙ্গণের একপাশে। সে এল তখনই! সবুজ শাড়ীতে তার বসন্তের হিল্লোল। আমার গালে একমুঠো আবির মাখিয়ে দিয়েই হঠাৎ আসা ঝড়ের মতন সে চলে গেল সহসা। বাকি সহপাঠীদের উল্লাসধ্বনি মিশল ছদ্মবিদ্রুপের আবহে ! সে দিন তার নাম জানলাম 'অনিতা'।
পরেরবার দেখা লাইব্রেরীতে। একজামিনের সমুদ্রলঙ্ঘনের উচ্চাশায় রত্নাকর মন্হন করতে গিয়ে। আমি খুঁজছিলাম সেই বহুচর্চিত বইটি। সুনীতিবাবুর ORDBL টি তার জিম্মায় ছিল তখন। বই দেয়ানেয়ার ছলে ডাকাডাকিটা এবার একটু নিকটে এল যেন।
তারপর আবার দেখা একজামিনের শেষদিনে। সামান্য পুঁজি সম্বল করে একটি ইভনিং শো'তে বায়োস্কোপ। ছবি দেখা হল কম ! নৈকট্য এল সুগম হয়ে। হাতখানি নিভৃতে ধরবার অধিকার মিলল পারিতোষিকে।
রেজাল্ট বেরোনোর দিন হল চারচক্ষের ভাববিনিময়। সুপ্রাচীন কলেজ বিল্ডিং এর একদিকে ঔপনিবেশিক যুগের গম্ভীর করিন্থীয় স্হাপত্য। সেখানেই এক নিরালা কোণ খুঁজে নিলাম। চোখে চোখ রাখলাম চিরকালের দূর্নিবার আকর্ষণে। সে ঝোলার ভিতর থেকে একটি দোপাটির চারা উপহার দিয়ে বললে 'আমাদের এই ভাব বিনিময়ে অন্ততঃ একটি জীবিত সাক্ষী থাকুক অভিজ্ঞান হয়ে'। তার বাড়িতে নাকি এই পুষ্পগুচ্ছ মঞ্জরীত হয়েই থাকে। বলল বাড়ি যাচ্ছে ছুটিতে ! সেই চারমাস পর আবার ফিরবে। এতদিনের অদর্শনের কারণ জিজ্ঞাসায় বললে 'বাবার তলব'।এমন কি তার বিয়ের পিঁড়িতে বসার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া গেলনা কোনওমতেই।
চারাটি বাসায় ফিরে রোপণ করলাম।নিত্য পর্যবেক্ষণ আর চর্যায় সেটি বৃদ্ধি পেল যথাসময়েই সঙ্গে দাত্রীর সাথে অদর্শনে বাড়লো দুর্নিবার বিরহ। এরই মধ্যে একদিন পত্রযোগে এল দুটি লেফাফা। প্রথমটির ভিতরে অদর্শনজাত কিঞ্চিৎ আক্ষেপ আর দ্বিতীয়টিতে একটি দূর্যোগের পূর্বাভাস। বুকের একটি অসুখ ধরা পড়েছে তার, হৃদযন্ত্রে ছন্দপতন আর সংজ্ঞাহীনতাই তার মূল উপসর্গ। চিন্তায় মন ভারাক্রান্ত হল। পত্রদুটিরই শেষে ছিল সেই দোপাটিচারাটির কথা। অভিজ্ঞানকে অস্বীকার না করার অঙ্গীকার আদায়ের সনির্বন্ধ অনুরোধ।
তারপর আরও একটি পত্র এলো দেরীতে। ভাবলাম আরোগ্যের সুবাতাস হয়তো বইবে। কিন্তু যা সংবাদ এল তা বিভ্রান্তের।সে লিখেছে হাসপাতালে শুয়ে, অপারেশান করবার আগের রাত্রে। শরীর তার খারাপ হয়েছে দ্রুত। অন্ধকার আকাশ ঘনিয়ে আসছে চোখে ! জীবনের সঞ্চয় তার ফুরিয়ে এল বুঝি? তবে কি না ফেরার ঠিকানাই হবে তার আগামী গন্তব্য! পত্রের একদম শেষদিকে কম্পিত অক্ষরে তার বাড়ির দোপাটি গাছে নতুন ফুল আসার কথা।
সেই শেষ। তারপর আর কখনো আসেনি তার কাছ থেকে কোনও মুখবন্ধ লেফাফা। ভেবেছি হয়তো আরোগ্যের পর সে বিস্মৃত হয়েছে তার এইসব ছেলেমানুষি বা হয়তো সত্যিই না ফেরার ঠিকানা থেকে মেঘের দেশের ডাকপিয়ন একদিন তার বিলম্বিত পত্রাঘাত বয়ে আনবে এমনই কোনও হেমন্তবিকেলে !
তবে তার অভিজ্ঞানটি সযত্নে বর্ধিত হয়েছে এই ক'মাসে। তাতে এসেছে লাল ফুলের অকাল বসন্তের নির্ঘোষ, তার স্বহস্তে দেওয়া প্রথম দিনের আবীরের মতোই।
0 comments: