0

গল্প - স্বাতী রায়

Posted in

।।১।।

একটা জানলা। অবশ্য একটা জানলাও বলা ভুল। কারণ জানলাটা ঠেসে বন্ধ করা। শুধু উপরে কোন কালে একটা শিকল দিয়ে লাগানোর বন্দোবস্ত ছিল বোধহয়। সে শিকল আর নেই। জানলার উপরের কাঠে শুধু আংটাটা রয়ে গেছে। সাক্ষী হিসেবে। এখন তো জানলায় উপরে নীচে দুখানা খিল দিয়ে বন্ধ করা। সেই শিকলের জায়গায় এক খাবলা গর্ত রয়ে গেছে। একটা টুল টেনে এনে দুজনে তার উপর উঠেছিল। তারপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল সেই এতটুকু ফুটোর উপর। এগারো আর চোদ্দো। ওইটুকুই এখন তাদের দুনিয়া। ফুটোটা তেরচা। একফালি সবুজ ঘাস আর উঠে যাওয়া একটা গাছের গুঁড়ি ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। তবু খোলা মাঠ তো! 

চোদ্দো তবু জানে, চেনে ওই মাঠটা। চেনে ওই মাঠের ওপারের, আজকের চোখের সীমানার বাইরে থাকা, গাছগুলোকেও। তিনদিন আগেও ওই গাছগুলোর মাঝে কাজ করছিল সে। ওরা। মাত্র তিনদিন আগে। তখন সব কিছু অন্যরকম ছিল। ঠিক ঠাক। ওরা ঝড়ের বেগে ফল পাড়ছিল। বাক্স বন্দী করছিল। এইবারই প্রথম ওর এ মুলুকে আসা। অবশ্য চোদ্দো এখানে চোদ্দো নয়। খাতায় কলমে পনেরো। নাহলে কাজ মেলে না। বাপ মরা, তিনটে গেঁড়িগুড়ি ভাই বোন ওলা ছেলের বয়স আগে, না কাজ আগে! তাও ভাগ্যিস মা-টা গিয়ে রফিক শেখের পা আঁকড়ে ধরেছিল! না হলে তো ওর রোগা ডিগডিগে চেহারা দেখে রফিক শেখ প্রথমে ওকে দূর দূর করে তাড়িয়েই দিয়েছিল। জব্বার মিয়াঁর থেকে ধার করা টাকা, মার ছেঁড়া আঁচলে চোখের জল মোছা, হামা-টানা বোনটার লালা মাখানো চুমু- তারপর ট্রেন, বাস কতকিছু করে এসে পৌঁছান এখানে। 

রোজ পেট পুরে খেতে পাওয়া। তার টানেই আসা। সে আর জুটছিল কোথায় গ্রামে! এখানে কাজ অনেক, সারাদিন মুখ তোলার জো নেই – কিন্তু খাবার জোটে পেট ভ’রে। আবার মজুরীর টাকাও জমা হচ্ছে বাট সাহেবের ঘরে। আল্লার দয়া! আর কি চাই! না চাইতেও পেয়েছে অবশ্য আরেকটা জিনিষ। প্রথম পাহাড় দেখা। সারাজীবন শুধু মাঠ আর বিল দেখেছে সে। ম্যাপের হিসেবে নদীর দেশের লোক। তবু নদীও সে আগে দেখে নি। এবারই প্রথম ট্রেনের থেকে নদী দেখেছে। আর আসার পথে ট্রেনে দলের বাকীদের থেকে গল্প শুনেছে অনেক। পাহাড়ের। পাইন গাছের। সবুজের। নুড়ি পাথরের মধ্যে ছলকে চলা নদীর। ঝকঝকে আকাশের। প্রথম দেখার অবাকভাব তবু যায় না! বাসে করে উঠে এসেছে সেই পাহাড়ের মধ্যে। তবু সে পাহাড় তেমন পাহাড় তো নয়। জুম্মাবারে ওরা দল বেঁধে নামাজ পড়তে যায় যখন, তখন সবাইকে ছাড়িয়ে হনহনিয়ে হেঁটে বাঁকের মুখে গিয়ে একটু দাঁড়ায়। সামনে খাদের থেকে উঠে আসা খোঁচা খোঁচা গাছের মাথা। তার ওপারে দূরে দূরে পাহাড়ের সারি। দূরের গুলোর মাথায় সাদা বরফের টুপি। কি সুন্দর! ভালো লাগায় বুকের মধ্যে কেমন যেন খিমচে ধরে! মুখে প্রকাশ করতে পারে না – শুধু দলের বাকীরা এসে পৌঁছালে তাদের দিকে ফিরে বোকা হাসি হাসে, বলে, “কেমন খাড়াই পাহাড় না, ঝকমক করে কেমন!” গোমড়া মুখে রফিক চাচা ধমক দেয়, “প্যাখনা গজাইছে? বার বার করে বলতেছি দিনকাল ভালো না, ফের তুই দল-বল ছেড়ে একা হাঁটছস!” চড়-থাপ্পড় জোটে কটা! 

।।২।।

প্রথম পাহাড় দেখে ভালো লেগেছিল এগারো-রও। সে অবশ্য উঁচু নিচু ঢেউএর মত পাহাড় দেখেছে অনেক। খুব কাছে না, তবু খুব দুরেও না। গাঁয়ের শেষে ক্ষেতির জমি গিয়ে শেষ হয় ওই পাহাড়ের গায়েই। তার গাঁয়ের দোস্ত করণের নানার ঘর ওই পাহাড় ডিঙ্গিয়ে। তবু সে পাহাড় আর এ পাহাড়! কিসে আর কিসে! প্রথম যখন দেখেছিল চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল! সন্ধ্যের সময় বাপুর সীটের পিছনের কাঠের বেঞ্চিতে ঘুমোচ্ছিল ও। বাপু গাড়ী চালাচ্ছিল। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায়। বাপুর পাশের সীটে লছমন চাচা বকর বকর করছিল। ও শুয়ে শুয়ে খানিক লছমন চাচার কথা শোনার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কিছুই বুঝছিল না। খিদে পেয়েছিল। কিন্তু কিছু বললে বাপুর চোখ লাল হয়ে যাবে। বাপু তো ওকে আনতেই চায় নি। এতদিনের পথে কেউ বাচ্চা নিয়ে বেরোয় নাকি! কিন্তু ও নাছোড়বান্দা। সেই যে টিভিতে ক’দিন ধরে জায়গাটার ছবি দেখাচ্ছিল, তখন দাদী ঘুরছিল, ফিরছিল আর কিষণজীকে ডাকছিল। বাপু যেন ভালোভাবে বাড়ী ফেরে! বাপু তো কদিন পরে বাড়ী ফিরে হেসেই অস্থির। আরে, ঝামেলা থাকলে সরকার যেতে দেবে কেন! আগেই গাড়ী থামিয়ে দেবে না! আর আমরা কত দরকারী জিনিষ নিয়ে যাই, না যেতে দিলে তো ওদেরই নুকসান। এবারও তো আসার আগে দাদী খুন খুন করে কান্না জুড়েছিল। তখন বাপু দাদা দুজনে মিলে বোঝাল যে এখন সব ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কোন ঝামেলা নেই। সকাল বিকাল সব সরকারী অপসররা তো টিভিতে সেই কথাই বলছে। বাপু দাদীর খাটিয়ার পাশে বসে বসে বলছিল, “ছোটি সফর হ্যায় আম্মী। এক হপ্তেমে লৌট আয়েঙ্গে। তু চিন্তা মত কর।“ সেই শুনেই তো ও বায়না ধরল। দশ বছর হয়ে গেছে, ও কি আর বাচ্চা আছে? টিভির জায়গাটা ও একবার চোখে দেখবেই দেখবে। মা-মরা ছেলের দিনরাতের বায়নায় বাপু অস্থির হয়ে উঠল। বাধ্য হয়ে রাজী হল। তবে তখনই বাপু শাসানি দিয়েছিল, “রাস্তেমে ভুক লাগা বোলকে রোয়েঙ্গে না, তব এক ঝাপড় দেঙ্গে!” তাই পেটে কিল মেরে শুয়ে ছিল ও। মন ঘোরান’র জন্য জানলার বাইরে তাকিয়েছিল। একটা গোল থালার মত চাঁদ উঠেছে। ফটফটে সাদা আলো গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে রাস্তায় এসে পড়েছে। ঠিক যেমনটা পড়ে দাদী চুলার পাশে, রাতের বেলা রোটি পাকানোর সময়। রোটির কথা ভেবে আবার পেটে একটা মোচড় পড়ছিল, ঠিক তখনই বাপু স্টিয়ারিং বাগিয়ে ধরে বাঁক ঘুরল। আর ও খিদের কথা বেমালুম ভুলে গেল! কি দারুন! হালকা স্লেট রঙের ঢেউ এর মত উঠে গেছে সোজা আকাশের বুকে। আর তাদের মাথায় আলো ঝলকাচ্ছে! হাঁ করে চেয়েই রইল। আবার পাহাড় যখন হারিয়ে গেল পথের বাঁকে, তখনও ও জানলার ছোট্ট ফাঁকটা থেকে মুখ সরাতে পারছে না। এমনকি শেষমেশ বাপু যখন খানা খেতে থামল, তখনও ওর মুখে কথা নেই। বাপু রকম দেখে লছমন চাচাকে বলল, “উসকো পাহাড় নিগল গ্যয়া!” সে সব কিছু ওর কানে ঢোকে নি। 

এমনকি পরের দিন যখন বাপু এখানে এসে গাড়ি থামাল, তখন ও বাপুকে বলে চলে এসেছিল এই চালাটার পিছনে। পাহাড় দেখতে। ট্রাকে তখন আপেলের পেটি বোঝাই হচ্ছে। লছমন চাচা ছিল বাপুর সঙ্গে সঙ্গে। দুজনে ঘরে ঢুকে কিসব কথা বলছিল। বাপু চেয়ারে বসে ছিল। উল্টোদিকে আরেকজন। বাপু চিনিয়ে দিয়েছিল। বাট সাহেব। বাগানের মালিক। তারপরই তো শব্দ হতে থাকল, ট্যার ট্যার ট্যার ট্যার – লোকজনের চিৎকার। ও চমকে জানলা দিয়ে ঘরের মধ্যে তাকাল। দুটো লোক তখন বাপু আর লছমনচাচার পিছনে বন্দুক উঁচিয়ে ওদের ঘরের থেকে বার করছে। বাকী ক’জন বাট সাহেবকে ঘিরে আছে। চেয়ারগুলো মাটিতে উলটে পড়ে। টেবিলখানা ছত্রখান। ভয় পেল ও। গাছের পিছনে লুকিয়ে পড়ল। সেখানেই ছিল। কিছু ক্ষণ পরে ট্যার ট্যার শব্দটা থামল। বাতাস ভারী হল পোড়া ডিজেলের গন্ধে । তবু ও বসেই রইল। অনেক পরে ওর শীত করতে লাগল। তখন ও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। 

।।৩।।

চোদ্দো এগারোকে খুঁজে পেয়েছিল ওখানেই। গাছের পিছনে হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে বসে আছে। বাইকে করে বন্দুকওলারা এসেছিল। তারা চলে গেছে অনেকক্ষণ। ট্রাকে পেটি বোঝাই করছিল জনা তিনেক। তারা এদিক ওদিক পালিয়েছিল। আবার ফিরে এসেছে। আপেলের পেটিগুলো পুড়ে আংরা। অফিসঘরের সামনে পড়ে আছে ট্রাকের খালাসী। কপালে, বুকে গুলির ফুটো। অফিসঘরের ভিতর কোণে বাট সাহেবের শরীরটা পড়ে। দুমড়ে মুচড়ে। রক্তাক্ত। আধা জ্ঞানে। তবে জান আছে তখনো। আপেল বাগানের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল মজুরের দলও। তারাও ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে। জড়ো হয়েছে অফিসঘরের সামনের চত্বরে। 

গ্রামের লোকও এসে জড়ো হয়েছে। তারা দেখে এসেছে। ট্রাক রয়েছে বড় রাস্তার উপরে। জ্বলছে দাউ দাউ করে। ডিজেল ছড়িয়ে পড়েছে রাস্তা জুড়ে। একটু দূরে ড্রাইভার। মাটিতে। উপুড় হয়ে। মাথা পিঠ গুলিতে ঝাঁঝরা। তারপর পুলিশ, মিলিটারী এল। বাট সাহেবের ছেলে, ভাতিজারা এল। ধরাধরি করে বাট সাহেবকে নিয়ে গেল বাড়ীতে। সেখানে ডাক্তার এসেছেন। পুলিশের অনন্ত জিজ্ঞাসাবাদ। অফিসঘরের সামনে তখন নিচু গলায় আলোচনা। ওরা ফরমান দিয়ে গেছে। বাইরের লোকের এখানে থাকা চলবে না। কিছুতেই না। একদিনের মধ্যে বাগান ছেড়ে চলে যেতে হবে। নাহলে ওরা আবার ফিরে আসবে। 

এ বাগানে বাঙ্গালী জনা ছয়েক। রফিক চাচা ওদের মুরুব্বী। আসলে দলের বাকীরা কাশ্মিরী অল্পস্বল্প বোঝে। বলতে গেলে আটকায়। হিন্দীও তেমন ভালো না। রফিক চাচা দুটো ভাষাতেই কাজ চালাতে পারে। ফলে তার উপর সব দায়িত্ব। সবাই রফিক চাচার দিকে চেয়ে আছে। তাহলে তো ফিরেই যেতে হয়। জানের মায়া আছে সকলেরই। কিন্তু টাকা পয়সা সবই তো বাট সাহেবের কাছে জমা। হাতে টাকা না এলে ফিরবে কি ভাবে? শেষকালে উঠে দাঁড়ালো রফিক চাচাই। বিড়বিড়িয়ে বলল, চল সবাই মিলে একবার সাহেবেদের সঙ্গে কথা বলি। কি করা যায় আলোচনা করি। এখনো তো অফিসঘরেই আছেন সব। দল বেঁধে সব অফিসঘরে ঢুকল। ঢোকার মুখেই ফোঁপানির শব্দ কানে আসে চোদ্দো’র। পায়ে পায়ে সে এগিয়ে যায়। শব্দের উৎসে। 

অফিসঘরে তখন পুলিশের কর্তারাও ছিলেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে রফিকের দলের তো আক্কেলগুড়ুম। বাসেও নাকি হামলা হয়েছে। কর্তারা বলেছেন কদিন একটু গা ঢাকা দিয়ে থাকতে। আশে পাশের বাগানে, কারখানায় আরও কিছু ভিন রাজ্যের লোক আছে, আলোচনা চলছে কিভাবে তাদের নিরাপদে ফেরার ব্যবস্থা করা যায়। কর্তারা খবর দেবেন। এ কটা দিন খুব সাবধান। বাড়ির বাইরে একদম নয়। সবার মুখ চুন। কিন্তু একদিনের মধ্যেই যে বাগান ছেড়ে চলে যাওয়ার নিদান! না হলে যে জানে মেরে দেবে বলে গেছে ওরা। অনেক আলোচনা হল। তারপর ঠিক হল ওরা যে ঘরে ভাড়া থাকে সে ঘর ছেড়ে দেবে ওরা। আজই। সবাই জানবে ওরা দেশে ফিরে যাচ্ছে। পুলিশের গাড়ি আসবে। তাতে করে রওনা দেবে। তারপর অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে এসে উঠবে আরেকটি ঘরে। বাগানের পাশে বড় মাঠ। তার ওপারেই। বাট সাহেবের বাড়ির লাগোয়া। সেখানেই অপেক্ষা করবে। যতক্ষণ না পুলিশ কিছু ব্যবস্থা করে ওঠে। 

কথা শেষ। গাড়ীতে ওঠেন পুলিশ সাহেব। দলবল নিয়ে। বাটসাহেবের বাড়ীর গাড়িও বেরোয় একই সঙ্গে। সার দিয়ে দাঁড়িয়ে তাদের সেলাম বাজায় রফিকের দল। কৃতজ্ঞতায়। কতটা যে বিপদ মাথায় নিলেন বাট সাহেবের পরিবার! সেটা বুঝেছে সবাই। ভয়ে কারোর মুখে কথা নেই! তবু সামনে অনেক কাজ। সব কিছু ব্যাগে পুরতে হবে। ঘর ছাড়তে হবে। ততক্ষণে চোদ্দো এগারোকে নিয়ে এসেছে। ঠকঠকিয়ে কাঁপছে এগারো। চোদ্দো তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। নিজের শরীরের ওমে গরম করতে চাইছে। এগারোকে দেখে বড়রা তো অবাক। এ কে? কোথা থেকে এল? কাঁপছে কেন এমন করে? কোন প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারে না এগারো। শুধু চোদ্দোকে আঁকড়ে ধরে। চোদ্দোও ছাড়াতে পারে না। শেষমেশ এগারোকে নিয়েই আসতে হয় ওদের। কোথায় ফেলে আসবে ওইটুকু ছেলেকে! 

দলের কয়েকজন আপত্তি করেছিল। বলেছিল নিজেদের মাথায় বিপদ, তার মধ্যে পরের বাচ্চা নিয়ে কি আরও বিপদে পড়ব? চোদ্দোর ততক্ষণে মায়া পড়ে গেছে। বুকের কাছে কেমন গুটি সুটি মেরে আছে দ্যাখো। মিনতি করে বলেছিল, “ওরে একটু সময় দাও। আগে বোল ফুটুক। তারপর পাঠাইও যেথায় খুশি। এখন পুলিশের হাতে দিলে বেঘোরে মারা পড়বে বাচ্চাডা। দ্যাখছ না গায়ে একটা গরম জামাও নেই। আমি দেখব ওরে। কারোর কিছু করবার লাগব না।“ তারপর তো সে ঘর ছেড়ে এঘরে এসে ওঠা। এগারো রয়েছে ওদের সঙ্গেই। চোদ্দোর গায়ের সঙ্গে লেপ্টে।

চোদ্দোই নিজের ভাগের খাবার খাইয়েছে ওকে। ধীরে ধীরে, একটু একটু করে। অনেক কষ্টে একটু পেটে ঢুকেছে। তারপর চোদ্দোর কম্বলের তলায় ঘুমিয়েছে। সারাটা সকাল এক কোণে চুপ করে বসে থেকেছে। চোদ্দো পাশ থেকে উঠে গেলে জুল জুল করে তাকিয়ে থেকেছে ওর দিকে। মুখে কথা নেই। যতক্ষণ না ফের পাশে এসে বসছে। ঘরের আর সবাই চুপ করে দেখেছে এগারোকে। দুপুরের দিকে রফিক চাচা এসে বসেছে পাশে। প্রথমে কাশ্মীরিতে। উত্তর নেই। তারপর হিন্দীতে। তাও উত্তর নেই। তবু রফিক চাচা ছাড়ে না। ধীরে ধীরে প্রশ্ন করেই চলেছে, ও কে, কোথা থেকে এসেছে, কার সঙ্গে, গায়ে গরম জামা ছিল না কেন... শেষ প্রশ্নটা শুনে হঠাৎ আবার ফুঁপিয়ে উঠেছে এগারো, ”মেরা নয়া জ্যাকিট! উয়ো ট্রাকমে”... তারপর গল্পটা বুঝতে আর অসুবিধা হয় নি কারোর। আর কোন প্রশ্ন নেই। সবার সব বোঝা হয়ে গেছে। কে যেন অস্ফুটে বলে উঠেছে, “হায় খোদা!”

তারপরেও কেটেছে দু রাত। এগারো একটু স্বাভাবিক হয়েছে। চোদ্দোর গায়ে একটু কম লেপ্টে থাকছে। তবু মুখে কথা নেই এখনো। অবশ্য কথা নেই কারোর মুখেই। পুলিশের তরফে কোন খবর নেই এখনো। সবাই অস্থির হয়ে উঠেছে। এইটুকু ঘরের মধ্যে হাত পা কোলে করে বসে থাকা। সহ্য হচ্ছে না আর কারোরই। অথচ কিছু করার নেই। ঘরের বাইরে থেকে তালা মারা। যেমন অন্য সময় থাকে। যাতে কারোর কোন সন্দেহ না হয়। রাতের অন্ধকারে বাট সাহেবের বাড়ী থেকে খাবার দিয়ে যায়। তখন যার যা প্রাকৃতিক কর্ম সারা। অন্য সব সময় ঘরের ভিতর। চোদ্দোর দম বন্ধ লাগছে যেন। এই ফুটোটার সন্ধান পেয়েছে আজই। সেই থেকে টুলের উপর চড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে ফুটোটার উপর। আকাশ না দেখা যাক, খোলা মাঠ তো! ওর দেখাদেখি এগারোও। সেই থেকে দুজনে টুলের উপরই খাড়া। একবার এ চোখ লাগায়, আরেকবার ও। 




।।৪।।

এক এক করে সবাই এসে একবার করে চোখ লাগিয়েছে ফুটোতে। ওই সবুজটুকুই দুনিয়া। আল্লার মেহেরবানী যে এটুকুও তারা দেখতে পাচ্ছে। ভয় কেটে বসেছে বুকের ভিতর। বোবা ভয়। চোখ বন্ধ হলেই কানে বাজছে সেদিনের ট্যার ট্যার শব্দ। এ বিপদে একমাত্র আল্লাই ভরসা। সবাই মন প্রাণ দিয়ে তাকে ডেকে যাচ্ছে। সেই জন্যেই হয়ত এল সুখবর। বেলার দিকে দরজা খোলার শব্দ। সবাই চমকে উঠল। অসময়ে, তবে কি মরণ ঘনিয়ে এল? না। খবর এল। বাট সাহেব ডেকেছেন। ওরা সবাই নিঃশব্দে চলল বাট সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি জানালেন পুলিশ খবর দিয়েছে। ভালো খবর। পরের দিন ভোরে ওদের নিয়ে যাবে। জম্মুতে। বঙ্গাল সরকার ব্যবস্থা করেছে, সব বাঙ্গালী মজুরদের বাংলায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। সবার হাতে হাতে বকেয়া মজুরী তুলে দিলেন। সেই সঙ্গে শুকনো খাবার কিছু। পথের জন্য। ওরা কৃতজ্ঞতায় নুইয়ে পড়ল। বাট সাহেবের প্রতি, সরকারের প্রতি, সবার উপরে আল্লার প্রতি। খোদা মেহেরবান। 

ঘরে ফিরেই হুড়োহুড়ি। ব্যাগপত্র চেন লাগিয়ে, জামাজুতো ঝেড়ে ঝুড়ে সবাই পথের জন্য তৈরি। রফিক চাচা একটু পরে ঘরে এল। বাট সাহেবের সঙ্গে আলাদা কথা ছিল কিছু। তারপর তো প্রহর গোনা! কখন ভোর হবে। তারপর লাইন দিয়ে পুলিশের জিপে ওঠা। দম বন্ধ করে দেড় কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়া। বড় রাস্তায় অপেক্ষায় ছিল মিলিটারির কনভয়। আশেপাশের সব বাগান থেকে, ইঁট ভাঁটা, প্লাই ঊডের কারখানা থেকে ভিনদেশীরা সব চলে এসেছে। একেক রাজ্যের, ছত্তিশগড়, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ- হিন্দু মুসলমান স...ব- শুধু এক জায়গাতেই মিল – সবাই ভয়ে জড়সড়। ভালোয় ভালোয় এই ন ঘণ্টার পথ পার করে দাও। কেউ ডাকছে রামজীকে। কেউ আবার আল্লাকে। শুধু এগারো নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে চোদ্দর গায়ে ঠেস দিয়ে। 

এই কদিনে রফিক চাচা অনেক প্রশ্ন করেছে এগারোকে। আস্তে আস্তে ভয় ভেঙ্গেছে। মুখ খুলেছে এগারো। দাদা, বাপু,সবাই ওকে বাচ্চু বলে ডাকে। ওদের বাড়ীতে রোজ কিষণজীর পুজো হয়। ওর দাদী খালি ওকে প্যারসে নন্দলালা বলে। বাপুর নাম, দাদার নাম, গাঁও এর নাম সব বলেছে। শুধু বলতে পারে নি কিভাবে সেখানে পৌঁছানো যায়। বড় রাস্তার উপর বাবুল গাছের তলায় নামিয়ে দিলে ও এক ছুটে বাড়ি চলে যেতে পারবে, তাও বলেছে। খালি সে বড় রাস্তা কোথা থেকে শুরু, যায়-ই বা কোথা-তক – তা আর বলতে পারে নি। রফিক চাচা চিন্তায় পড়েছে, এ ছেলেকে কি ভাবে তার ঘরে ফিরিয়ে দেবে! চোদ্দো হিন্দী বলতে বা বুঝতে পারে না। এই তো প্রথম বার ঘরের বাইরে বেরিয়েছে। রফিক চাচা যখন এগারোর সঙ্গে কথা বলেছে, তখন মন দিয়ে শুনেছে। বার বার রফিক চাচাকে বিরক্ত করেছে, চাচা এটা কি বলল ও? শুনেছে এগারোর মা নেই। আর থাকতে পারে নি। বাংলাতেই এগারোকে বলেছে। “ভাবিস না রে । আমার সাথে যাবি। আমার মায়ের কাছে থাকবি। কিচ্ছু ভাবিস না।“ এগারো কি বুঝেছে কে জানে, আবার জড়িয়ে ধরেছে চোদ্দোকে। 

রফিকের কপালের ভাঁজ কিন্তু মেলাচ্ছে না। বাট সাহেবকে ও জিজ্ঞেস করেছিল। কিন্তু না, তিনিও ড্রাইভার কোথাকার লোক, ঠিকানা কি সেসব জানেন না। যে কোম্পানির ট্রাক তাদের কাছে নিশ্চয় খবর থাকবে! কিন্তু ওই বাচ্চার ঝামেলা আর তিনি নিতে চান নি। বলেছেন সোজা পুলিশের হাতে তুলে দিতে। তারাই ব্যবস্থা করবে। ঠিকানা খুঁজে বার করে ওকে পাঠিয়েও দেবে। বাট সাহেবকে দোষ দেয় না রফিক। তিনি অনেক করেছেন ওদের জন্য। চলে এসেছে রফিক। শুধু ট্রাকের কোম্পানির ফোন নম্বর আর ঠিকানাটা নিয়ে এসেছে বাট সাহেবের থেকে। 

এগারো পুলিশের নাম শুনে আবার শক্ত হয়ে যায়। চোখের ভাষা পালটে যায় । ভয়ের গাঢ় ছায়াটা ফিরে আসে। ছটফটিয়ে ওঠে চোদ্দোও। রফিকের চিন্তাও কিছু কমে না। ঠিকানা খুঁজে বার করা । এমন কিছু কঠিন কাজ না। পুলিশ পারবে। কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই ডামাডোলের সময়। কাজটা করার সময় পাবে তো ! তাড়া দেওয়ার মত কেউ তো থাকবে না! আর বাচ্চাটা থাকবে কোথায় ততদিন? ওই থানাতে? মন মানে না রফিকেরও। তার থেকে চলুক ওদের সঙ্গে। কোম্পানির ঠিকানাটা তো জম্মুর। নাহয় ফোনে খোঁজ-খবর করা যাবে। 




।।৫।।

বাস এসে থামল জম্মু স্টেশনে। বেঁচে থাকার আনন্দে ক্লান্ত মুখগুলো চকচক করছে। হুড়মুড়িয়ে নামতে নামতে শুনল, “বাঙ্গালীলোগ ডাহিনা চলো, কাউন্টার পে নাম লিখাও, তব ট্রেন কা টিকেট মিলেগা। জলদি কর, আভি ট্রেন ছুটেগা। প্ল্যাটফরম পর ওয়েট কর রহাঁ হ্যয়।“ রফিক চাচার দলের সবাই ঝটপট দাঁড়িয়ে পড়ল সেই লাইনে। অনেক লোক, সামনেও অনেক, ওদের পিছনেও দেখতে দেখতে লোক জমে গেল। সব মিলিয়ে শ’ দেড়েকের বেশি ই হবে, কম না। রফিক একটু ব্যাপারটা বুঝে নেয়। সবাইকে আলাদা আলাদা নাম ধাম বলে টিকিট নিতে হচ্ছে। এই তাড়াহুড়োর মধ্যে আর এগারোর বাড়ির খোঁজ নেওয়া হবে না। ঘরে ফিরেই যা করার করতে হবে। রফিক চুপি চুপি চোদ্দোকে বলে, বলবি ও তোর ভাই, নাম বাচ্চু। চোদ্দ কাউন্টারে পৌঁছায়, বলে “দো টিকিট”।। কাউন্টারের বাবু মুখ তোলে না। বলে, “নাম বাতাও। অউর উমর”। রফিক খোঁচা মারে, “ নাম আর বয়স বল”। চোদ্দ বলে, “সাকিল খান, বয়েস চোদ্দ না না পনের আর বাচ্চু, বয়স এগারো”। এগারো শুনে বাবু মুখ তোলেন। সামনে তাকিয়ে দেখেন, ছোট মানুষ দাঁড়িয়ে। টিকিট বাড়িয়ে দিয়ে খানিকটা মজা করেই জিজ্ঞেস করেন, আপকা শুভ নাম? রিনরিনে গলায় উত্তর আসে, জী কিষণলাল। ওর গ্রামের স্কুলে মাস্টারজী শিখিয়েছেন না কিভাবে নাম বলতে হয়! 

কাউন্টারের বাবুটি চমকে ওঠেন। কিষনলাল! তা কি করে হয়! চোদ্দো বার বার বলতে থাকে, “ও বাচ্চু, ওর বয়েস এগারো। আমার ভাই।“ বাবুটি আরও ঘেঁটে যান। সাকিল খানের ভাই কিষণলাল! ভুরু কুঁচকে যায় তার। ব্যাপারটা বুঝতে হবে। তীক্ষ্ণ স্বরে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় প্রশ্ন করেন, “তুমার ঘর কুথায়?” এগারো ঘাবড়ে যায়। বুঝতেও পারে না। আর রা ফোটে না! টিকিটবাবু বোঝেন ডালমে কুছ কালা হ্যায়! এদিকে পিছনের ভিড় অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে। এরপর যদি ট্রেন ছেড়ে দেয়। হট্টগোল শুরু হয়। ঝামেলা মেটাতে আর পি এফ আসে। চোদ্দো আর এগারোকে ধরে নিয়ে যায়। বাধ্য হয়ে রফিকও যায় সঙ্গে সঙ্গে। পুরো ঘটনাটা বলে। ভাগ্যিস বাট সাহেবের দেওয়া ঠিকানাটা ছিল। সেটাও দেখায়! এবং কি আশ্চর্য, আর পি এফ রফিকের কথা বিশ্বাস করে। বোধহয় সদ্য ঘটে যাওয়া ঘটনা বলেই। বা ঘটনার নৃশংসতায় বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়। কিন্তু এগারোকে তারা ছাড়ে না। রফিককে বলে, “তুম দোনো যাও। আপনা ঘর ভাগো। ইস টিকিটমে সির্ফ বঙ্গালী ঔর অসমিয়া কো যানা হ্য্যয়। ইয়ে তো তুমহারা আপনা লেড়কা নেহি হ্যায় না! ইয়ে ইধার-ই রহেগা। হাম উসকো ঘর ভেজেঙ্গে - ক্যায়া বেটা, আপনা ঘর নেহি জানা চাহতে হো?” 

এগারো চোদ্দকে জাপটে ধরে। রফিক মুখ খুলতে যায়। আর পি এফ তাকে ধমকে ওঠে, “বকওয়াস মত করো, নেহি তো কিডন্যাপিং কা চার্জ দে দুঙ্গা ঔর তুম দোনোকো লকআপমে ঘুসা দুঙ্গা।“ তখনই ট্রেনটা দুলে ওঠে। রফিকের আর কিছু করার থাকে না। সে জোরসে চোদ্দকে ছাড়িয়ে নিয়ে টানতে টানতে গিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ে। চোদ্দো কঁকিয়ে ওঠে, “বাচ্চু, বাচ্চু রে!” আর পিএফের মুঠোর মধ্যে ছটফট করে এগারোর হাত। আর্তনাদ করে ওঠে, “ভাইয়া, মুঝে ছোড়কে মৎ যানা!” ট্রেনের চাকার ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস শব্দে চাপা পড়ে যায় কান্না। 



আর পি এফের ঘরে ডাইরিটা খুলে ঘসঘস করে লিখতে বসেন চৌবেজী। নাম কিষণলাল উমর জ্যারা সাকিন ... আরে এই খানেই তো রেখেছিলেন লোকটার দেওয়া ট্রাক কোম্পানির ঠিকানা লেখা কাগজটা, সেখানে ফোন করতে হবে। গেল কোথায় কাগজটা!

0 comments: