Next
Previous
Showing posts with label কৈশোরনামা. Show all posts
0

কৈশোরনামা - কর্ণ শীল

Posted in


কৈশোরনামা


স্যমন্তক আর তুষারকন্যা 
কর্ণ শীল 



(এক)

এ দেশে বোধহয় ফুলগাছ নেই। কিন্তু সাদা বরফের স্তম্ভে, সাদা বরফের ফুল ফুটে আছে। এ দেশে বোধহয় পাখিও নেই। তবুও ঝকঝকে আকাশে ভেসে বেড়ানো তুষারকণা থেকে সুরের লহরী ভেসে আসে মাঝে মাঝে হাওয়ার অদৃশ্য কোটর পার হয়ে। বরফের আদিগন্ত প্রান্তরের এখানে ওখানে হঠাৎই জেগে ওঠে সুগন্ধি ফোয়ারা। কোনওটিতে চন্দনের গন্ধ, আবার কেউ কেউ পদ্মগন্ধা।

বরফের বিরাট প্রাসাদের চূড়ায় দুপুরের উজ্জ্বল সূর্য বর্শা গেঁথে রেখেছেন যেন। ধোঁয়ার মতো জলীয় বাষ্প প্রাসাদের গা বেয়ে উঠে জানালায় জানালায় ছড়িয়ে যায়। কোনও ঘরে শিকলবাঁধা বিরাট পাথুরে দৈত্য রামছাগলের ঠ্যাং চিবুতে চিবুতে সাদা চোখে সূর্যের দিকে তাকায়। কোনও ঘুলঘুলি দিয়ে দেখা যায় শূন্যে ডানা মেলে ভেসে আছে ডানাওয়ালা সাদা ঘোড়া। নাকের ওপর একটি শিং। লেজটিও তার সাদা।

সরু পাথরের সিঁড়ি অন্ধকার অন্ধকার। ঘুরে ঘুরে নেমে গেছে নীচে। অনেক নীচে নেমে একটি বিরাট বইয়ের আলমারির দরজা খুলে বেরিয়ে আসতে হবে এক বিরাট অলিন্দে। তার পাশে সারি সারি ঘর। দুধসাদা দেয়াল। সাদা মখমলি পর্দা।

পাহাড়ি হাওয়া সোঁ সোঁ করে ছুটে এসে পর্দা সরিয়ে দিল। ঘরের ভেতরে সাদা স্ফটিককূড্য থেকে গলগল করে ধোঁয়া বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে পড়ছে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা নারী পুরুষমূর্তির সাদা পোশাকের ভাঁজে ভাঁজে। সাদা গোলাকার বিছানা। পুরু সাদা চাদরে পেঁজা মেঘের মতো জাদুঘুমের ধোঁয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। 

ধোঁয়ার চাদরের ফাঁক দিয়ে হঠাৎ দেখা গেল পারস্যের তলোয়ারের মতো একটি পা। স্পন্দনহীন। রক্তশূন্য। পায়ের বুড়ো আঙুলটিতে একটি লাল পাথরের আঙটি।

সমগ্র সাদা বর্ণহীন দেশে ওই একটি রঙের বিন্দু!

স্যমন্তককুমারের বুকটা ধক করে উঠলো। চোখ খুলে গেল। বুঝলো, এ তো স্বপ্নমাত্র। পূর্বে লাল আকাশ। একলা কোকিল আমডালে গান গাইছে। মন্দিরে প্রভাতবন্দনার সুর। 

এমন সময় পরিচারিকা ছুটে এলো। এক নিশ্বাসে বললো "যুবরাজ তাড়াতাড়ি চলুন ...রাণীমার শরীর খুব খারাপ।"


(দুই)

মহারাণীর ঘরে চিন্তান্বিত বৈদ্যরাজ। ভ্রু কুঞ্চিত মহারাজের। রাজজ্যোতিষী মাথা নেড়ে বললেন, "এ বড় অপার্থিব লক্ষণ। শুভ না অশুভ ধরা যাচ্ছেনা।"

স্যমন্তক দেখলো মায়ের ডানপায়ের ফরসা বুড়ো আঙুলে একটি একটি লাল রঙের জড়ুল দেখা দিয়েছে। 

ও তো আগে ছিলনা কোনওদিন!

রাজবৈদ্য কইলেন এমন অদ্ভুত ব্যধির কথা শোনেননি কোনওদিন। মায়ের ডানপা টি অসাড় হয়ে গেছে। নাড়তে গেলে গলার শিরাগুলো ফুলে উঠছে শুধু। 

মায়ের দিকে তাকালো স্যমন্তক।মায়ের বাঁ চোখ দিয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে স্যমন্তকের হাতে পড়লো। সে সজলনয়নে রাজজ্যোতিষীকে জিজ্ঞাসা করলো, "ঠাকুর, আমার মা ভালো হবেনা? তোমার কড়ি, গ্রহ, তারা কি বলে?"

-সে বড় অদ্ভুত উত্তর যুবরাজ। অর্থ খুঁজে পেলুম না। 

-কি সে উত্তর, বল আমায়। দেবাদিদেবকে ধরে আনতে হলে আনবো প্রয়োজন হলে আমার মায়ের জন্য।

-আমার কথাবলা কড়ি কি বললো শোনো,

"অনেক উঁচু অনেক কাছে
নিজের মাঝেই সে জন আছে,
ডাক পাঠালে বুঝবে নিজে
চারপায়ে আর ডানার ভাঁজে"

স্যমন্তক সবার মুখের দিকে চাইলো, সবাই নির্বিকার। এর অর্থ, তাঁরা আগেই শুনেছেন এ নিদানের কথা।

সে মাথায় হাত দিয়ে শ্বেতপাথরের মেঝের ওপর বসে পড়লো। 


(তিন)

শিকারে গিয়ে স্যমন্তকের মন লাগেনা। মন লাগেনা বুনো রুপোলি শেয়ালের পিছু নিতে। মন্ত্রীপুত্র আর কোটালপুত্র পাঁশুটে নেকড়ে মেরে তার চামড়া দিয়ে শীতের আলখাল্লার গলাবন্ধ বানিয়ে নিয়েছে। শ্রেষ্ঠীর দস্যিমেয়েটা আবার পাহাড়ি শকুনের বাসায় হানা দিয়ে নিয়ে এসেছে উড়ুক্কু সবুজ খরগোসের হাড়। তাই দিয়ে বানিয়েছে এক আশ্চর্য বাঁশি। জ্যোৎস্নায় চুল এলিয়ে বসে সে বাঁশি বাজায় তার চন্দ্রশালায়।

স্যমন্তক বসে থাকে সারাদিন ছবিঘরে। তুলি দিয়ে লালরঙের একটি ফোঁটা দেয় মাঝে মাঝে সাদা তুলোট কাগজে। আর মায়ের কথা খুব মনে পড়ে। 

এটা ওটা ভাবতে ভাবতে ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়ায় সারারাতের ক্লান্তি জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল স্যমন্তক। কাঁধের সাদা বার্তাবহ পায়রাটি হঠাৎই উড়ে গেল রানীমায়ের ঘরের দিকে।

মাহেন্দ্রক্ষণে আবার সেই স্বপ্নটা চোখ ভরে এলো।সেই সাদার দেশ। সাদা থামগুলোতে একদম আলতো, হালকা লালের রেশ লেগেছে মনে হচ্ছে। খুব খুঁটিয়ে না দেখলে নজরে পড়ে না। 

পাথুরে দৈত্যের চিবুনো রামছাগলের ঠ্যাঙটাও যেন একটু রক্তমাখা।পক্ষীরাজ ঘোড়াটা ডানা ঝাপটে একগাদা গোলাপ পাপড়ি ছিটিয়ে দিল হালকা গোলাপি রঙের। রাজহাঁসের পায়ের মতো রঙের পর্দা আজ। আর ভোরের সাদালাল মেঘের মতো ধোঁয়া ।

আর আজ ওই ধোঁয়ার ফাঁকে দেখা গেল একটি কাঞ্চনফুলের পাপড়ির ভেতরের দিকের রঙের মরালগ্রীব মানবী কন্ঠ। 

স্যমন্তক বুঝলো আজ তার মায়ের গলার স্বরটি হারিয়ে যাবে চিরদিনের মতো। সে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরলো সুন্দর গলাটি আর একরাশ অন্ধকারের মধ্যে পড়ে গেল।


(চার)

কতক্ষণ অন্ধকারের মধ্যে স্যমন্তক পড়েছিল মনে নেই তার। উঠতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেল। হাঁটতে গিয়ে পারলো না। অনেক চেষ্টা করার পর হাল ছেড়ে দিয়ে হামাগুড়ি দিতে লাগলো। তাও হাঁটু আর হাতের তালু সড়াৎ সড়াৎ করে হড়কে যেতে লাগলো।

সূর্য উঠলো দশদিক জুড়ে। স্যমন্তক দেখলো এ দেশে কাচের। কাচের গাছে কাচের ফল। কাচের পাতা। কাচের ফুলের পাপড়ি তে বসে আছে ফিনফিনে কাচের ডানা মেলে কাচের প্রজাপতি। নীল আকাশ আর স্যমন্তকের ছায়া পড়েছে আদিগন্ত কাচের প্রান্তরে।

সূ্র্যের রশ্মি প্রতিফলিত হয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল স্যমন্তকের। ধীরে ধীরে তার দু চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো আর ঝলসে যেতে লাগলো গায়ের চামড়া।কাচের পাখির ডানার ঝটপটানির ঝনঝন শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়।

-ও খোকা, চোখে ব্যথা পেলে নাকি?

খুনখুনে হাসি শুনে স্যমন্তক সামনে হাত বাড়িয়ে দিল। একটা শক্ত অস্থিসার হাত তার হাতটা ধরলো। আকাশে উড়ে গেল তারা। আর সঙ্গে সঙ্গে কানের পাশ দিয়ে সাঁই সাঁই করে বয়ে যেতে লাগলো ঊনপঞ্চাশ বায়ু।একটা চিল স্যমন্তকের তলোয়ারের খোঁচা খেয়ে একটা চ্যাঁ করে চেঁচিয়ে উঠলো। একসময় মাটিতে নেমে থিতু হলো তারা।

কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়ায় বরফকুচি ছুরির মতো ছুটে এসে তার চামড়ায় গেঁথে গেল যেন। স্যমন্তক বুঝলো এ দেশ অনেক ওপরের।

ওর পাশেই এক আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ো। তার পা দুটো তার হরিণের। মুখটা সিংহের। হাতদুটোর জায়গায় দুটো বটগাছের সরু ডাল। চোখের জায়গায় দুটো নীল মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে। মুচকি মুচকি হেসে স্যমন্তক কে সে বললো, "আর কেন হে দেরি? /যাও না তাড়াতাড়ি /পাহাড়পুরের তুষার ঘরে /নিদান বসত করে।"

স্যমন্তক হাঁ করে চেয়ে আছে দেখে বুড়ো কেশর নেড়ে নেড়ে খিলখিলিয়ে হাসতে লাগলো। স্যমন্তকের হাতে দুটি কড়ি দিয়ে সে বললো সুর করে করে,

"অনেক উঁচু অনেক কাছে
নিজের মাঝেই সে জন আছে,
ডাক পাঠালে বুঝবে নিজে
চারপায়ে আর ডানার ভাঁজে"

তখনি সোঁ করে আকাশের বরফঝরা দৃশ্যপট চিরে মন্মথ উপত্যকায় নেমে এলো এক পক্ষীরাজ ঘোড়া। নাকের শিংটি ঝলমল করে উঠলো সন্ধ্যাবেলার স্বর্ণপ্রদীপের আলোর ছোঁয়ায় মায়ের নাকছাবির মতো।

স্যমন্তক বুঝলো এ পক্ষীরাজ সেই তুষারপুরীর দূত। ঝটপট ঘোড়ার পিঠে উঠতেই সে দেখলো সেই বুড়ো একটা কালো মাথা সাদা গায়ের ঈগল হয়ে সাঁ করে মেঘের ভেতরে উড়ে গেল।

তার ডানার হাওয়া পক্ষীরাজের ডানায় এসে লাগতেই সেও কদমচালে ছুটে গিয়ে বাতাসে ঝাঁপ দিল। ডানার প্রবল আন্দোলনে রুপালি পাহাড়ের চুড়া, বরফঢাকা সরলবর্গীয় ত্রিকোণ গাছের বনের মাথা ছাড়িয়ে পক্ষীরাজ উড়ে চললো পাহাড়পুরের তুষারপ্রাসাদের পথে। 


(পাঁচ)

পাথরের ঘরের সামনেটায় গুঁড়ো গুঁড়ো বরফ জমে জমে স্তূপীকৃত হয়ে আছে। নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে পাথুরে দৈত্যটা। তার বরফের শিকলটা আস্তে আস্তে গলে যাচ্ছে। তার সামনে স্থির হয়ে গেল স্যমন্তক। 

ন যযৌ ...ন তস্থৌ...

নাকের ভেতর থেকে একটা শব্দ করলো ঘোড়াটা। যেন বললো, "স্যমন্তক, তাড়াতাড়ি করো!"

পাথরের সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে স্যমন্তক দেখলো অসংখ্য পাতা পড়ে আছে ছড়িয়ে। তাদের অর্ধেক বরফ আর অর্ধেক সবুজ। 

তার বুকের মধ্যে কেমন একটা ব্যথা খামচে ধরলো। 

সিঁড়ি শেষ হয়েছে নীচু ছাদপর্যন্ত একটা পাথরের দরজার সামনে। ঠেলতেই খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে স্যমন্তক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল।

এ তো তাদের প্রাসাদের গ্রন্থাগারের "অপরূপগাথা "বিভাগের দরজা! শুধু উলটো দিক থেকে খুলে সে ভেতরে এসেছে।

এ যে তাদেরই প্রাসাদ!

শুধু অন্যরূপ। অনন্যরূপে তার সামনে অপরূপকথার ধাঁচে অন্য তল থেকে ধরা দিয়েছে। তার মায়ের হাজার গল্পের জাদুরা সত্যি রূপ নিয়ে তার জীবনে এসেছে। আর ধীরে ধীরে তার মায়ের জীবনীশক্তি নিয়ে নিয়ে মূর্ত হয়ে উঠছে। 

একটা দরজার সামনে থেকে গোলাপী সাদা ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে। এক অমোঘ আকর্ষণে সেদিকে ছুটে গেল স্যমন্তক।

এমন সময় প্রাসাদের ওপরের অংশ থেকে ভেসে এলো ভয়ানক গর্জন আর ধাতব শেকল ছেঁড়ার প্রচণ্ড শব্দ।

পাথুরে দানবের ঘুম ভেঙেছে।

স্যমন্তককুমার একছুটে সেই মায়াময় ঘরে ঢুকলো। আজ ঘরের ধোঁয়ার আস্তরণ তার স্বপ্নদৃষ্ট ধোঁয়ার চেয়ে অনেক পাতলা। 

দেখা যাচ্ছে ধোঁয়ার নীচে এক অনিন্দ্যসুন্দর নারীমূর্তি। সুপ্ত।নিরাবরণ। দেহের শুধুমাত্র ঠোঁটদুটি তুষারকঠিন।বাকি দেহজুড়ে সে কি অপরূপ লাবণ্য! 

নবনীতকোমল চামড়ায় কে যেন আনারদানার রস দিয়ে নক্সা এঁকেছে।

এত সুন্দর দৃশ্যে কিন্তু স্যমন্তকের বুক হিম হয়ে এলো। সে উপলব্ধি করতে পারলো তার মায়ের বর্তমান পরিস্থিতি। এবং এও বুঝলো মেয়েটির ঠোঁটদুটি যদি রক্তমাংসের হয়ে যায়, সে চিরকালের মতো তার মাকে হারাবে। 

প্রচণ্ড শব্দ করে অলিন্দে নেমে এসেছে ভয়ানক পাথুরে দৈত্য। কেঁপে কেঁপে উঠছে ঘর, জানালা, মেঝে, নারীমূর্তি। বিরাট এক লাফে শুভ্রফেননিভ বিছানায় পড়ে মেয়েটির ঠোঁটে নিজের ঠোঁট মিশিয়ে দিল স্যমন্তক।

মেয়েটি চোখ মেলে চাইল!

পাথুরে দানবের দেহ মুহূর্তে টুকরো টুকরো হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেল গ্রীষ্মরাতের দুঃস্বপ্নের মতো। 

চোখের সামনে হাসতে হাসতে জেগে উঠলো সব তুষারমূর্তির দল।

বরফের ফুলে প্রজাপতি এসে বসলো আর তারা রঙীন পাপড়ি মেলে উপত্যকায় বিছিয়ে গেল। প্রাসাদচূড়ার বরফ গলে সোনা ঝিকিয়ে উঠলো।

ঈগলসাজা বদ্যিবুড়োর পিঠে চড়ে মা এলো তুষারপুরে। তুষারকন্যার চিবুক তুলে মুখ আর সলজ্জ হাসি দেখে খুব খুশি হলো আর স্যমন্তকের কানটি দিল মুলে। 

মিষ্টি হেসে মা বললো, "আজ থেকে রূপকথা বন্ধ।"

তারপর সবাই আবার "অপরূপকথা" আলমারির দরজা খুলে ফিরে এল স্যমন্তকের আপন বাড়ি। তুষারমেয়ে রইলো মায়ের কাছে।

সে এখন চুল বাঁধা আর ডালের বড়ি দেওয়া শেখে
0

কৈশোরনামা - প্রতিমা সেনগুপ্ত

Posted in


কৈশোরনামা


নেংটি আর কেলটি ঘরে ফিরল
প্রতিমা সেনগুপ্ত


তখন সবে সন্ধ্যা নেমেছে। চতুর্দিকে দিনের আলো মিলিয়ে যেতেই অন্ধকার ঘিরে ধরল। নেংটি একটু একটু করে নিজেদের ডেরা থেকে বেরিয়ে এলো বাইরে। ওরা ছোটো ইঁদুর। মাত্র তিন মাস বয়স। সাধারণত মায়ের সঙ্গেই বের হয় দু’জনে। কিন্তু আজ মা দিন–দুপুরে কোথায় যেন চলে গেছে! মা – আকারে ওদের চেয়ে অনেক বড়। চলাফেরায় অনেক চটপটে। আর রাস্তা–ঘাট সব মা’র চেনা। মা না থাকাতে, আজ ওরা দু’জনে গুটি গুটি বেরিয়ে পড়ল ওদের আস্তানা থেকে।

একটা মস্ত বড় বাড়ির এক্কেবারে উপরে চিলেকোঠার ঘর। সে ঘরে মেলা জিনিস। একটার উপর অন্যটা চাপানো। বাক্স–প্যাঁটরা, ভাঙা হাঁড়ি–কলসি, খবরের কাগজ, বইয়ের স্তূপ, বেঁটে–মোটা কাগজের পেটি, ভাঙা কোদাল, পুরানো ঠাকুরের মূর্তি এইসবে ভর্তি। তারই মধ্যে একটা মস্ত পেটি, সেটা ছিল একটা পুরানো টিভির বাক্স। তার ভিতর রাজ্যের খড়ের কুচি, কাগজের কুচি আরও নানা কিছু। এই বাক্সের ভিতরেই মা’র সঙ্গে থাকতো ওরা দুই ভাই। কেলটি একটু বড় আর নেংটি একটু ছোটো।

রোজ সন্ধ্যে নামলে, ওরা বাক্স থেকে বেড়িয়ে পড়ে মা’র সঙ্গে। আগে গোটা চিলেকোঠা ঘুরে বেড়াতো। তারপর চিলেকোঠা থেকে বেড়িয়ে ছাদে এবং নীচে নামতে শিখেছে। জলের পাইপ বেয়ে কেমন করে ছাদ থেকে দোতালায়, আবার দোতালা থেকে একতলায় নামা যায়, জানালার কার্নিশ থেকে এক লাফে নারকেল গাছের গুঁড়ি ধরে এক্কেবারে মাটিতে নেমে পড়া যায়, তা মা তাদের শিখিয়েছে। কিন্তু একা একা দু’জনে মিলে চিলেকোঠা ছেড়ে বের হয়নি কখনও।

আজ সাহস করে, দু’জনে মিলে মার দেখানো পথে প্রথমে ছাদে নামে, ছাদ তখন একদম সুনসান। একটু বাদে কেলটি এগিয়ে যায় জলের পাইপের কাছে। সঙ্গে নেংটিকেও ডেকে নেয়। তারপর দুই ভাই মিলে জলের পাইপ বেয়ে নীচে নামতে থাকে। দোতালার কার্নিশ বাঁচিয়ে নেমে যায় একতলায়। একতলার বাথরুমের কার্নিশের উপর দু’ভাই জড়াজড়ি করে বসে ছিল। এরপর কি করবে, ঠিক বুঝতে পারছিল না। ঠিক সেই মুহূর্তে পাশের কার্নিশ থেকে দু’টো চোখ জ্বল জ্বল করে উঠল। বিড়াল! এখন কি করে? কোনও মতে দু’জনে কাঁপতে কাঁপতে পিছু হঠতে থাকল। কিটকিট কিটকিট শব্দে দু’জনের দাঁতে দাঁত লেগে কর্তাল বেজে চলল। হুলোটা সেই মুহূর্তে উঠে দাঁড়িয়ে, বিষম রকমের চোখ পাকিয়ে, গোঁফ ফোলাতে আরম্ভ করল। নেংটি এক লাফে জলের পাইপ ধরে দু’পা নীচে নেমে, বাথরুমের জানালা দিয়ে সুড়ুত করে বাথরুমের ভিতরে ঢুকে পড়ল। সেই দেখে কেলটিও পিছন পিছন গিয়ে বাথরুমে উপস্থিত। জানলা দিয়ে ঢুকে দু’জনে মিলে এক দৌড়ে কমডের সিস্টার্নের পিছনে গিয়ে উপস্থিত হলো। যাই হোক, এভাবে বিড়ালের হাত থেকে কোনওমতে প্রাণ বাঁচলেও, কি–রকম সোঁদা সোঁদা, ভিজে ভিজে গন্ধের সম্পূর্ণ অপরিচিত – নতুন জায়গায় এখন কি করবে, কিভাবেই বা ওখান থেকে বেরোবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। দু’জনে জড়াজড়ি করে, সিস্টার্নের পিছনে, যেখানে দেওয়ালের সঙ্গে স্ক্রু দিয়ে জোড়া, তার উপর কোনও মতে বসে রইল।

হঠাৎ একটা জোর শব্দ হয়ে বাথরুমের দরজাটা খুলে গেল। তারপর আলো জ্বলে উঠল বাথরুমে। কেলটি আর নেংটির বুকের ভিতর ঢিপ্ ঢিপ্ শব্দ হতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে, সিস্টার্নের হাতলে জোর চাপ পড়ে। সিস্টার্নটা কাঁপতে কাঁপতে, প্রবল বেগে, সশব্দে প্রচুর জল বেরিয়ে যায়। কেলটি আর নেংটি সেই ঝাঁকুনিতে মাটিতে পড়ে যেতে যেত, কোনও মতে সামলে নেয়।

বাথরুমের লাইট নিভে গিয়ে, দরজা বন্ধ হয়ে গেলে, কেলটি নেংটিকে বলে, ‘ভাই নেংটি, এ কিরকম অদ্ভুত জায়গারে? শিগগির চল পালাই।’

নেংটি বলে, ‘কোথায় যাবি রে? বাইরে বেরলে গোদা হুলো, আমাদের দু’জনকেই খেয়ে ফেলবে।’

কেলটি ঢোক গিলে বলল, ‘কিন্তু এটা কোন জায়গা বলতো? মা’র সঙ্গে এরকম কোনও জায়গায় তো আমরা আসিনি কখনও। এখান থেকে বেরবো কি ভাবে? চিলেকোঠায় ফিরবো কি করে? মা যদি চলে আসে – আমাদের তো দেখতে পাবেনা, বল? নেংটি বলল, ‘কোন দিকটা দিয়ে ঢুকলাম, এখন আর মনে করতে পারছি না। চল, কোথা দিয়ে বেরনো যায়, সেটা খুঁজে দেখি’।

দু’জনেই সিস্টার্ন থেকে নামলো মাটিতে। গোটা মাটিটা ঘুরে দেখল – কেবল একটা বালতি ভর্তি জল আর জল বেরোবার গর্ত, তাও ঝাঁঝরি দিয়ে বন্ধ। হঠাৎ বাথরুমের দরজার ছিটকিনি খোলার শব্দ হলো, দু’জনেই এক লাফে কমডের উপর উঠে পড়ল। কিন্তু সিস্টার্নের পিছনে পালাবার সময় ছিলনা। তাই দু’জনেই নেমে পড়ল কমডের ভিতর। নীচে নামতেই জল এবং তারপর একটা গর্ত। দু’জনেই গলে গেল সেই গর্ত দিয়ে। কিছুটা যাওয়ার পর পাইপটা যেখানে বেঁকে গেছে, বাঁকের ধারে দু’জনে মিলে বসে রইল। খানিক বাদে প্রচণ্ড জোর, সশব্দে, প্রচুর পরিমাণ জল ওদেরকে স্নান করিয়ে গায়ের উপর দিয়ে চলে গেল অনেক নীচে! আর একটু হলে দু’জনে জলের সঙ্গে ভেসেই যাচ্ছিল আর কি! কতক্ষণ যে দু’জনে মিলে দাঁতে দাঁতে কর্তাল বাজিয়ে কেটে গেল তার ঠিক নেই। তারপর এক সময় সব কিছু চুপচাপ দেখে, দু’জনে মিলে আস্তে আস্তে উঠে এলো উপরে।

কেলটি বলল, ‘যে করেই হোক এখান থেকে বেরোবার কোন উপায় বার করতে হবে রে।’

সারা রাত্রি, দু’জনে গোটা বাথরুম ঘুরেও সেই রাস্তাটা খুঁজে পায়নি যেটা দিয়ে তারা বাথরুমে ঢুকেছিল। ভোরের মুখে আবারও বাথরুমের দরজা খোলার আওয়াজে, দু’জনে মিলে ঢুকল গিয়ে পাইপের ভিতর এবং বারংবার জলস্রোত ওদেরকে ভিজিয়ে দিয়ে গেল।

দুপুরের দিকে বাথরুম খানিক শান্ত হলে, দু’জনে পাইপের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো। দু’জনেরই বেজায় খিদে পেয়েছে। বাথরুম থেকে বেরোবার পথও বার করতে হবে।

আশ্চর্য, বাথরুমের দরজাটা খোলা। দু’জনে গুটিগুটি বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে। একটা বড় ঘরের মধ্যে পৌঁছে দু’জনে ছুটে গিয়ে ঢুকল ফ্রিজের তলায়। কিন্তু এ জায়গাটা নিরাপদ নয়। তাছাড়া, খাবারের খোঁজ করাও দরকার। চারিদিক শান্ত দেখে, ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়ল একটা আলমারির পিছনে। আবারও ইনভার্টারের পিছনে। এমনি ঘুরতে ঘুরতে এক সময় রান্না ঘরটা খুঁজে পেল। এ ঘরে কিছু খাবারের গন্ধ নাকে আসছিল। ঘরটা একদম ফাঁকা, তাই এক লাফে চড়ে বসল গ্যাস ওভেনের উপর। তারপর সিঙ্কের উপর। সিঙ্কের ঝাঁজরির মুখে কিছু ভাত পড়ে ছিল। দু’জন মিলে সে’কটি খেয়ে ফেললো। সিঙ্কের পাশে, একটা কালো রঙের প্যাকেটে কিসব? গুচ্ছের চা–পাতার পিণ্ড পেরিয়ে খুঁজে পেল আধ–খাওয়া আলু আর মাছের কাঁটা। দু’জনে এতেই খুশি। ঠিক তখনই, কাদের জুতো পায়ে চলাফেরার শব্দ শোনা গেল। দু’জনেই সিঙ্ক থেকে এক লাফে নেমে গ্যাস সিলিন্ডারের পিছনে গিয়ে লুকল। পায়ের শব্দ কমে যেতেই, আবারও রান্না ঘর থেকে বড় ডাইনিং–এ এসে ইনভার্টারের পিছনে চুপ করে বসে রইল। সন্ধ্যে নাগাদ কেলটি বুঝি একটু ঘুমিয়ে পড়ে ছিল। হঠাৎ কি একটা গায়ে লাগতেই, তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল। কেউ ঘর ঝাঁট দিচ্ছে। ঝাঁটার মাথাটা ইনভার্টারের নীচে ঢুকে কেলটিকে জাগিয়ে দিল। কিন্তু নেংটি কোথায় গেল? এদিক ওদিক কোন দিকেই নেংটিকে দেখা গেল না। না ফ্রিজের তলায়, না ইনভার্টারের পিছনে। নাই শো–কেসের পাশে। ডাইনিং টেবিল আর টিভি স্ট্যান্ডের পিছনেও খুঁজে দেখল। নাহ! নেংটি কোথাও নেই। ঘরের মধ্যে আবারও চলা–ফেরার শব্দ হয়। চুপ করে টিভি স্ট্যান্ডের পিছনে বসে থাকে কেলটি। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত্রি নামে। সুযোগ বুঝে কেলটি ডাইনিং থেকে সরে আসে বেডরুমে। মস্ত খাটের তলায় এক তারা খবরের কাগজ, ঝাঁটা টপকে কতগুলি দলা পাকানো প্লাস্টিকের পিছনে গিয়ে বসে। হঠাৎ মনে হলো, খাটের পাশে আলমারির নীচে কি যেন নড়ল? ঐ তো নেংটি। নেংটিকে দেখে আহ্লাদ আর ধরেনা। ওদিকে নেংটি এক লাফে, পাশের কাবার্ডের আধা খোলা দরজা দিয়ে গলে গেল কাবার্ডের ভিতর। বেরিয়ে এলো কাবার্ড থেকে, আবারও ঢুকে গেল। ঠিক সেই সময় বেডরুমে পায়ের শব্দ এবং কাবার্ডের পাল্লা খোলার শব্দ হল। সর্বনাশ, নেংটি তো ওটার ভিতরেই রয়েছে। কিন্তু নেংটিকে দেখা গেলনা। মনে হয় দরজা খোলার শব্দেই ও ভেতরে ঢুকে গেছে। কিছুক্ষণ পরে কাবার্ডটা বন্ধ হয়ে গেল।

কিছুটা সময় কেটে যাওয়ার পর, সব চুপচাপ দেখে কেলটি গুটিগুটি কাবার্ডের দিকে এগিয়ে আসে। কাবার্ডের দরজাটা খোলার জন্য হাতড়ায়। নেংটি তো ভেতরেই রয়ে গেল। কিন্তু দরজাটা এতো শক্ত করে বন্ধ – কোনও মতেই খোলা যাচ্ছে না।

কাবার্ডের ভিতর থেকে কে যেন দরজায় ধাক্কা দিল। ঐ তো, নেংটি কাবার্ডের ভিতর দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে। দরজার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে, লাফালাফি করে ধাক্কা দিতে লাগল। কেলটি বুঝতে পারল, নেংটি ভিতরে আটকা পড়ে গেছে। সে বাইরের থেকে দরজার পাল্লা টানাটানি করার চেষ্টা করল। কিন্তু কোন ভাবেই খোলা যাচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করে দু’জনেই ক্লান্ত হয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ সব কিছু চুপচাপ। আবারও নেংটি একবার দরজার মাঝখানে ধাক্কায় আবার অন্য কোণায়। ক্লান্ত হয়ে পড়ে। চুপ করে বসে থাকে কাবার্ডের একটা তাকে। তাকে গুচ্ছের বই–খাতা। একটা ফাইলের কোণা দাঁত দিয়ে চিবিয়ে কুচিকুচি করে। এদিকে কেলটি বাইরের থেকে অনেক চেষ্টা করে দরজা সামান্য ফাঁক করতে পারল না। তখন গোটা দরজাটার সমস্ত কোণাগুলো খুঁজতে থাকে – কোথাও কোন ফাঁক আছে কিনা? দরজার একদম উপরে এক জায়গায়, দু’টো পাল্লার মাঝে কয়েকটা ট্রেনের টিকিট ভাঁজ করে গোঁজা। কেলটি আস্তে আস্তে টিকিট গুলো দাঁত দিয়ে কাটতে আরম্ভ করল। বেশ কিছুক্ষণ পরে, যখন টিকিটের বেরিয়ে থাকা অংশ প্রায় কুচি কুচি করে ফেলেছে, দুই পাল্লার মধ্যে ফাঁক হয়ে গেল। কেলটি তো মহা খুশি। এক লাফে কাবার্ড থেকে মাটিতে নেমে পড়ল। আর ঠিক তখনই ঘরের বাতিটা জ্বলে উঠল। মানুষের পায়ের শব্দ বেড়ে গিয়েছে। কেলটি এক দৌড়ে দেওয়াল ঘেঁসে ডাইনিং–এ পালিয়ে এলো, তারপর দরজা ফাঁকা পেয়ে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল।

বাথরুমের বালতির পিছনে গিয়ে চুপ করে বসে ছিল কেলটি। কিছুক্ষণ বাদে বাথরুমের লাইট জ্বলে ওঠে। কেলটি ভয় পেয়ে এক লাফে সিস্টার্নের পিছনে পালিয়ে যাওয়ার সময়, সিস্টার্নের উপর রাখা কমড পরিষ্কার করার হাতল ওয়ালা ব্রাশে ধাক্কা খায়। ব্রাশটা গিয়ে কমডের ভিতরে পড়ে। কেলটি কোনওমতে সিস্টার্নের পিছনে চলে যায়। কিন্তু কে যেন সিস্টার্নের উপর লাঠির বাড়ি মারে। সেই শব্দে কেলটি ভয়ানক চমকে ওঠে। বুকের ভিতর ধড়াস্ ধড়াস্ শব্দ হতে থাকে। কিছুক্ষণ পর সিস্টার্নের ঢাকনি খোলার শব্দ হয়। কেউ কিছু খুঁজছে। ঢাকনি খোলার ঝাঁকুনিতে কেলটি মাটিতে পড়ে যায়। তার সামনে একটা মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে কেলটিকে দেখে লাঠিটা মাটিতে ঠোকে। কেলটি এক লাফে কমডে উঠে, পাইপে ঢুকে পড়তে চায়। কিন্তু কমড পরিষ্কার করার ব্রাশটা পড়ে ওটার মুখ আটকে ফেলেছিল। নিরুপায় কেলটি, এক লাফে সিস্টার্নে চড়ে বসতে গেলেই, ঢাকনা খোলা সিস্টার্ন ভর্তি জলের মধ্যে ঝপাৎ করে পড়ে যায়। মানুষটি কেলটিকে খুঁজে না পেয়ে সিস্টার্নের ঢাকনা খুলেছিল। তাই কেলটি সোজা গিয়ে জলে পড়েছে। কিন্তু জলে পড়েই সে এক লাফে সিস্টার্নের ধারে উঠে বসে। চুপচুপে ভেজা কেলটির সারা শরীরের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। বেচারা ভয়ও পেয়েছে খুব। কোথায় পালাবে? হঠাৎ উপর দিকে তাকাতেই জানলাটা চোখে পড়ল। এই জানলাটা দিয়ে ওরা বাথরুমে ঢুকেছিল। এক লাফে জানলাটায় চড়ে বসে। কিন্তু জানলাটা বন্ধ। এবার কি করবে? দুই পায়ে ভর দিয়ে জানালার তাকে বসে, দুই হাতে চোখ ঢেকে বসে থাকে কেলটি। বাঁচার আর কোন রাস্তা নেই! কিছুক্ষণ এভাবে বসে থেকে আবারও জানলা থেকে এক লাফে কমডে নামে। কিন্তু এবার কমডের মুখটা খালি ছিল। ব্রাশটা কেউ তুলে ফেলেছে। কেলটি সোজা ফুটো দিয়ে পাইপের মধ্যে চলে যায়। খানিক বাদে প্রচুর জলস্রোত তাকে ভিজিয়ে দিয়ে চলে যায়।

পাইপের ভিতর বসে কেলটি ভাবতে থাকে বাথরুমের জানলাটা বন্ধ কেন? ওটা দিয়েই তো ওরা বাথরুমে ঢুকেছিল। ওটা খোলা থাকলে, ওটা দিয়ে বেড়িয়ে জলের পাইপ বেয়ে চিলেকোঠায় চলে যাওয়া যাবে। মা কি করছে? ওদের কথা ভাবছে নিশ্চয়। নেংটি কি কাবার্ড থেকে বেরোতে পারল? কাবার্ডের দরজাটা কেলটি খুলে ফেলেছিল। সাত–পাঁচ ভাবতে ভাবতে কেলটি ঘুমিয়ে পড়ল।

হঠাৎ কে যেন তাকে ধাক্কা দিল। চোখ মেলে দেখে নেংটি বাসে আছে। দুই ভাইয়ের সে কি আনন্দ। দু’জনে মিলে খানিক নেচে নিলো। এরপর ওদের চিন্তা হলো, বাথরুম থেকে কিভাবে বেরোবে? জানলাটা খুঁজে পাওয়া গেলেও সেটা যে বন্ধ! গুটি গুটি দু’জনে পাইপ বেয়ে উঠে এলো একবারে সিস্টার্নের মাথায়। এক লাফে জানালার তাকে চড়ে বসল। আশ্চর্য! জানলাটা খোলা! কেলটি ডেকে নেয় নেংটিকে। জানলা দিয়ে বেরিয়ে, এক লাফে চড়ে বসে জলের পাইপে। তখন চারিদিক অন্ধকার। রাত্রি কাটতে এখনও অনেক সময় বাকী। দু’জনে মিলে এক দৌড়ে জলের পাইপ বেয়ে চলে আসে ছাদের কার্নিশে। চিলেকোঠার ঘরে মা নিশ্চয় খুব চিন্তা করছে ওদের জন্য। ওদের দেখে, মা যে খুশিতে কি করবে – তাই ভাবতে ভাবতে আর নাচতে নাচতে দুই সোনার টুকরো ছেলে, চলল চিলেকোঠার দিকে।
0

কৈশোরনামা - অনসূয়া

Posted in


কৈশোরনামা


প্রিন্সেস
অনসূয়া

সেদিন ছুটির দিন ছিল।তাই এসপ্ল্যানেড গেছিলাম কিছু জিনিষ কিনতে। রাস্তার পাশে ফুটপাথের ওপর কত্ত কি বিক্রি হচ্ছে। পাপোশ, ব্যাগ, কানের দুল, রুমাল, পাজামা, জুতো, চুড়ি, ছোট্ট টেবিল, গামছা থেকে শুরু করে নাকের নথ অবধি কি নেই। সেসবই দেখতে দেখতে হাঁটছিলাম। দেখি এক দাদু বসে আছে এক নিরিবিলি কোনায়। সেখানে লোকের ভীড় নেই।সারি সারি গাড়ি দাঁড়ানো। তাদেরই এক কোণে দাদু বসে বসে চাবি দিচ্ছে আর গামলার জলে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট্ট স্পীড বোট। সাদার উপর নীল বর্ডার। মাথার উপর সোনালী অক্ষরে ছোট্ট করে লেখা, প্রিন্সেস। তীর বেগে জল কেটে গোল গোল ঘুরপাক খাচ্ছে। দেখেই আমার মনে পড়ে গেল, রামসায়রের মাঠে কালিপুজোয় কেমন মেলা বসতো। জিলিপি, মোমো, এগরোল চিনিকাঠি, রেউড়ি আরও কত খাবারের দোকান। থরে থরে গজা, খাজা, জিলিপি, মালপোয়া সাজানো থাকতো।আমি পেটু বলে খাবারের দোকানেই আগে নজর যেত। তারপর গয়নার দোকান, খেলনার দোকান, কাঁচের বাসন, কাঠের জিনিশ, মাটির পুতুল কত কি থাকতো।এরকম একটা নৌকা দেখেছিলাম। সেটার চাকা ছিল। চাবি দিলে মাটির ওপরই সাঁই সাঁই করে দৌড়তো। কিন্তু এই দাদুর কাছের বোট একেবারে আসলের মতো। এমন সত্যিকারের বোট দেখেছিলাম, সেবার গঙ্গার পারে। কি এক নেভি অফিসারের পরিবার আসাতে তাদের জন্য নিরাপত্তা আর এমন এক বোটের ব্যবস্থা হয়েছিল। এই ছোট্ট বোটটা হুবহু সেরকম।
আমায় হাঁ করে থাকতে দেখে দাদু ফিচিক করে পানের পিক ফেললো প্রথমে। তারপর আরেকটা পান মুখে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, নিবে নাকি মামনি? ঘোর কাটা চোখে বললাম, না পয়সা নেই। বোটটা তখনও বোঁঁ ও ও ও করে ঘুরে চলেছে। ফিচ ফিচ করে হেসে উঠলো দাদুটা। বেজায় ফিচেল হাসি। বলে, ন্যাহ ট্যাকা নেই। ষোল টাকার রোল খেয়েছ পাশের গলিতে। পকেটে এখনও পাঁচশোর তিনটে নোট কড়কড় করছে। একটা পঞ্চাশও আছে। মা দিদির জন্য ব্যাগ কিনতে বলেছে। নিজে কিনবে বটুয়া। বলে আবার, পয়সা নেই।
কথা শুনে আঁতকে উঠলাম। বলে কি? কি করে জানলো? গুণীন টুনীন নয়তো, কি মেয়ে ধরা? মা বলেছিল, যেখানে সেখানে যাওয়া মেয়েদের ঠিক না। শুনিনি। বোধহয় ধরে নিয়ে মেয়েদের মাথা মুড়ে চুল বিক্রি করে ষ্টেশনের পাশের ঝুপড়িতে ফেলে রাখে। আর ট্রেনে ট্রেনে গান গাইতে হয় হারমোনিয়াম বাজিয়ে। আর বাকি সময়ে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখে। কিচ্ছু বলার যো নেই কাউকে। ভাবতেই গা শিউড়ে উঠলো। সেটাও টের পেয়ে গেল নাকি দাদুটা। বলল, ভয়ের কিছু নেই। রুস্তমের সাথে থেকে থেকে এসব বলা টলা অভ্যাস হয়ে গেছে। এই বোট একটাই আছে। নেবে নাকি? দশ টাকা।
রুস্তম কে? জ্যোতিষ টোতিষ নাকি? বাবা এসবের ঘোর বিরোধি। মা লুকিয়ে মন্দিরের বাবাজীর কাছে যায়, আমার কবে আক্কেল হবে জানতে। বাবাজীর বিশাল কাঁচাপাকা দাঁড়ি। শক্ত কাঠ কাঠ। দেখলেই গাল কুটকুট করে। ইয়া বড়ো সিঁদুরের টিপ আঁকা কপালে।গলায় বিশ পঁচিশটা রুদ্রাক্ষের মালা। লাল লাল চোখ আধবোজা। গায়ে লাল কাপড়ের শালু জড়ানো।নাকি তারাপীঠ থেকে পাশ করা জ্যোতিষী। একবার গেছিলাম মায়ের আর মাসির সাথে তারাপীঠে। বড্ড ভীড় আর নোংরা। কোথাও কোন কলেজ দেখতে পাইনি। বড়মামা সাথে ছিল। জিজ্ঞেস করেছিলাম। মামা হো হো করে হেসেছিল। কে জানে বাবা। হাসির কি আছে? শুধু তো বলেছিলাম, আমিও পড়তে চাই। ফর্ম কোথায় মিলবে?
রুস্তম কেমন জ্যোতিষ কে জানে? নাম শুনে কেমন ফকির টকির লাগছে। 
- নেবে নাকি??
- নাহ।
ওই বোট নিয়ে কি করবো? তাই না বলে ঘুরে চলে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ শুনি,দাদু চেঁচাচ্ছে, না নেবে তো আমার এতো সময় নষ্ট করলে কেন। সময়ের দাম নেই নাকি? এই বোটের মতো সময় ঘোরে কিন্তু এক জায়গায় আর ফেরে না। বলি যেমন আমার সময় পিছিয়ে দিলে, থাকো এবার বোটের মতো ঘুরতে। তাও যদি দশ টাকা দিয়ে বোটখানা কিনতে। 
বলে কি? পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, দাদু কোথায়, বোট কোথায়, গামলা কোথায়। কোত্থাও কিচ্ছু নেই।
প্রতিটা গাড়ি দেখলাম। আর তাদের নীচটাও। নাহ কোত্থাও নেই। কাছাকাছি কোন গলিও নেই যে তাতে ঢুকে পড়বে। পুরোটাই দেওয়াল। 
খানিক মাথা চুলকে, ঘাবড়ে মেট্রোর দিকে পা বাড়ালাম। ব্যাগ ট্যাগ তখন শিকেয় উঠেছে। টিকিট কেটে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামলে তবে প্ল্যাটফর্ম। আজ খুব ভীড় মেট্রোয়। থিক থিক করছে মানুষ। শুধু মাথা আর মাথা। যেন দুর্গাপুজো চলছে। টিকিটঘরের সামনেও লম্বা লাইন। যা হোক করে টিকিট কেটে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামলাম। ট্রেন এলেই বেড়িয়ে পড়বো। ওমা দেখি সেখানেও লম্বা লাইন। ট্রেনের লাইনটাও দেখতে পেলাম না। যা ভীড়। চুপচাপ লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। লাইন এগোতে দেখি সবাই টিকিট কাটছে। আরে আমার কি মাথা খারাপ হলো? স্বপ্ন দেখলাম যেন একটু আগে টিকিট কাটলাম। দাদুর জন্য বোধহয় মাথাটা গড়বড় করছে। যাই হোক টিকিট কেটে, গেট দিয়ে ঢুকে নীচে নামলাম সিঁড়ি দিয়ে। ট্রেন এলেই উঠে পড়বো। ভীড়ে দমবন্ধ হবার জোগাড়। লাইন পড়েছে। লাইনে দাঁড়ালাম। লাইন এগোচ্ছে। ট্রেন এখনও এলো না। দেখতে না পেলেও আওয়াজ তো পাবো। আমি এগিয়ে চললাম লাইনের সাথে। আমার পালার বিশ পঁচিশজনের আগেই দেখি, একি আবার টিকিটঘর কোত্থেকে এলো? এই তো টিকিট কাটলাম। ব্যাগপত্তর আঁতিপাঁতি করে ঘেঁটে, সব নামিয়ে গুচ্ছের কাগজ, হজমোলা, কফি বাইটের প্যাকেট সব পেলাম। টিকিট পেলাম না। প্লাস্টিকের গোল চাকতি। ব্যাগে তিনটে পাঁচশোর নোট ছিল। চারটে দশ। সেগুলোও বহাল তবিয়তে ব্যাগেই আছে। মানে চুরি যায়নি কিছু।
এবার মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করলো। আরও একবার টিকিট কাটলাম এবারও একই ব্যাপার। কি করবো বুঝলাম না। ভীড়টায় তাকালাম। যেন কারুর সাথেই এমনটা হচ্ছে না। সবাই নিজের মতো ব্যস্ত। কাউকে চেনাও মনে হচ্ছে না। কি করি, বুকের ভেতর খুব ধড়ফড় হচ্ছে। দাদুর কথা কি তাহলে ফলে গেল নাকি? বোটের মতো ঘুরছি আমি? এবার তাহলে কি করবো? দাদুকে এখন কোথায় পাই? রোলটা না খেয়ে বোটটা কিনে নিলেই হতো। কাঁদবো কিনা মনে হতেই দেখি আলখাল্লা পরা এক ফোকলা পাগল গোছের লোক এসে আমার জামার হাতা ধরে খুব হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়ালো। যেন কতদিনের চেনা। বলল, বোটটা কিনিসনি বেটি? তাই তো? 
তুমি কে? জিজ্ঞেস করতেই বললো, আমি রুস্তম পাগলা। আমার ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিল তোর। ওকে বলি জাদু করিসনা। ছেড়ে দে। তা শোনে না। আমাদের গুরুর বারণ আছে। আমরা ভিক্ষে করে খাই। ভাইটা বোট বেচে খায়। তা ওই একখানাই বোট। যে কিনলো, কিনলো। না কিনলেই ওর রাগ। 
আমার তো চক্ষু চড়কগাছ। সব ভুলে, রুস্তমের পায়ে পড়ে গেলাম, বাবা আমায় বাঁচাও। আমি বাড়ি যাই। আর কক্ষনো করবো না এমন। 
রুস্তম বলল,বোটটা চাই যে।
- সে কোথায় পাবো।আমি তো এখান থেকে বেরোতেই পারছি না। 
- আমার কাছে আছে। পঞ্চাশ টাকা দে।
- অ্যাঁ পঞ্চাশ? দশ চাইলো যে তখন?
- সময় নিয়েছিস,তার দাম ধরবি না বুঝি? সময়ের দাম খুব। সোয়া পাঁচ মিনিট প্রতি দেড় টাকা করে এখন। 
- সে কে ঠিক করে?
- সময় নিজেই ঠিক করে। ব্যাণ্ডেল চার্চে গেলে জানতে পারবি। ওখানে অনেক বড় বড় পুরোনো ঘড়ির সময় আছে। এখন দে দেখি পঞ্চাশটা টাকা।
বলে যেই পঞ্চাশ টাকা বের করে দিয়েছি হাতে। অমনি দেখি ঝোলা থেকে একটা গামলা বের করেছে, তাতে জল ভরা। এতো জলসুদ্ধু ঝোলায় ভরেছিল কেমন করে?
তারপর দেখি সেই বোটটা। সাদার ওপর নীল বর্ডার। তাতে সেইরকম ভাবেই লেখা 'প্রিন্সেস'। গামলার জলে সেটাকে চাবি দিয়ে ছেড়ে বললো, তাকিয়ে দেখ। আমি হাঁটু মুড়ে গামলার পাশে বসে পড়ে দেখতে লাগলাম। 
দেখতে দেখতে দেখতে দেখতে আমার চোখ বন্ধ হয়ে এলো।
ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি বিছানায় রোদ পড়েছে জানলা দিয়ে। পাশের ঘরে দিদি, পুলিকে খাওয়াচ্ছে আর মা ওকে গান গেয়ে শোনাচ্ছে।
চাদরটা পেঁচিয়ে ওই ঘরে গিয়ে দাঁড়ালাম। শুনি, মা পুলিকে বলছে, দেখো মিমি কি এনেছে! বোট, দেখো কেমন ঘুরছে।
দেখি,পুলির স্নানের গামলায় সাঁতার কাটছে সাদার ওপর নীল বর্ডার দেওয়া একটা বোট। হাতে তুলে দেখি বোটটার মাথায় সোনালী অক্ষরে অবিকল এক নাম লেখা। প্রিন্সেস।
ঘড়িতে টুংটুং করে তখন ন'টা বাজলো। আজ আর অফিস যাব না। ভাবছি ব্যাণ্ডেল চার্চে একবার ঘুরেই আসি।

0

কৈশোরনামা - রাজীব চক্রবর্ত্তী

Posted in




কৈশোরনামা


গবা পাগলার গল্প 
রাজীব চক্রবর্ত্তী


ছেলেরা তখনো আসেনি। গবা মন্দিরের চাতালে বসে মাঠের দিকে চেয়ে একমনে কিছু একটা শুনছে। কিছুক্ষণ পরেই ছেলের দল হৈ হৈ করতে করতে এসে পড়ল। সবাইকে মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করিয়ে হাতের ইশারায় বসতে বলল গবা। মাঠের একদম শেষ প্রান্তের বুড়ো বট গাছটার দিকে দেখিয়ে বলল, শুনতে পাচ্ছিস? ছেলেরা বলে উঠল, কোকিলের ডাক? গবা বলল ডাক নয়,গান। দু:খের গান। মনের ব্যথা গানের সুরে প্রকাশ করছে। 

ছেলেরা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, কোকিলের আবার কিসের দু:খ? গবা হেসে উঠল। হাসি থামিয়ে ধীরে ধীরে বলল, কোকিল হলো স্বভাব শিল্পী। আর জাত শিল্পীর দু:খ থাকবেই। তোরা যে কোকিলের ডাক শুনছিস ওটা আসলে দুটো কোকিল। বর - বৌ দুজনে মনের দু:খে জঙ্গল ছেড়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে ঐ গাছে।

গল্পের গন্ধ পেয়ে ছেলেরা নড়েচড়ে বসল। গবাও শুরু করল, কোকিল দুটো থাকত দূরের এক জঙ্গলে। সকাল দুপুর সন্ধ্যে যখন ইচ্ছে হতো মনের আনন্দে গান গেয়ে বেড়াত। সারাদিন শিকার খুঁজে ক্লান্ত পশুরা যখন গাছের তলায় কিংবা জলার ধারে ঝোপে বিশ্রাম নিত, ভেসে আসা কোকিলের গান তাদের প্রাণ জুড়িয়ে দিত।

বনের রাজা সিংহমশাই বয়সের সাথে সাথে আয়েসি হয়ে পড়েছেন। সারাদিন গুহার মধেই বসে বসে ঝিমান। শিকার করতে বাইরে যান না। অবশ্য তার প্রয়োজনও পড়ে না। তার সবসময়ের সঙ্গী এক শিয়াল। সিংহের খাবার জোগাড়ের দায়িত্ব তার। ধূর্ত শিয়াল ছোট, বড়, মাঝারি যখন যেমন পশুকে সামনে পায় তার সাথে আলাপ জমিয়ে ভুলিয়ে নিয়ে আসে সিংহের গুহায়। সিংহ ওঁত পেতেই থাকে। এক ঝটকায় পশুটাকে কব্জা করতে তার বেশি সময় লাগে না। সিংহ মশাই পেট পুরে খেয়ে বাকিটা দিয়ে দেন শিয়ালকে। শিয়াল মরা পশুর দেহটা নিয়ে আসে তার মহল্লায়। তারপর শিয়ালের দল মহানন্দে খায় রাজার প্রসাদ। তাদের উল্লাসে নিশুতি রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে জঙ্গলের আকাশ বাতাস ভরে যায় হুক্কা - হুয়া শব্দে।

নিয়মিত ভাল মন্দ খাইয়ে শিয়াল তার দলের মাথা হয়ে উঠল। পশুরাজের সাথে দহরম মহরম থাকায় সবাই তাকে সমীহও করত। ক্রমে ক্রমে শিয়াল নিজেকে বনের রাজা ভাবতে শুরু করল। সবাইকে বলে বেড়াত রাজামশাই আমার কথা শুনেই কাজ করেন। বনের ভালমন্দ আমিই ঠিক করব। পশুরাজ সিংহের সাথে তার সম্পর্কের কথা ভেবে কেউ আর মুখ খুলত না। আর শিয়ালের দল তাকে নেতা মেনে মাথায় করে রাখত। 

একদিন, সূর্য তখন মধ্য গগনে। শিয়াল দৌড়তে দৌড়তে এসে বসল একটা বড় গাছের ছায়ায়। ক্লান্ত হলেও মনে বেশ খুশি খুশি ভাব। একটা বুনো মোষের বাচ্চা পৌঁছে দিয়ে এসেছে সিংহের গুহায়। আজ সন্ধ্যের ভোজটা বেশ জমাটি হবে। এখন একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যাক - এই ভেবে চার হাত পা ছড়িয়ে গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে শরীর এলিয়ে দিল। চোখ বন্ধ করার আগে গাছের উপর দিকে তাকিয়ে দেখল কোকিল দম্পতি বসে আছে। মনে মনে ভাবল, ভালই হলো গান শুনতে শুনতে ঘুমানো যাবে। কোকিলদের দিকে মুখ করে বলল, দুজনেই আছিস দেখছি। একটা গান শোনা। 

কোকিল জোড়া সকাল থেকেই মনমরা হয়ে গাছে বসে। ভোরবেলা দুজনে গিয়েছিল কাকের বাসায় ডিম পাড়তে। মুহূর্তের অসাবধানতায় ডিম মাটিতে পড়ে ভেঙে যায়। মনের দু:খে কোকিলরা ফিরে আসে। সারাদিন দুজনে খাওয়া দাওয়া করেনি, গান গায়নি। শুধু চুপ করে বসে আছে গাছের ডালে। শিয়ালের কথায় তারা বেশ বিরক্ত হলো। তবু মুখে কিছু বলল না। শিয়াল যথেষ্ট ক্ষমতাশালী। হয়ত পশুরাজকে বলে তাদের বন থেকেই বের করে দেবে। শান্ত স্বরে তারা বলল, মাফ করো শিয়ালদাদা। আজ মনমেজাজ ভাল নেই। গান গাইতে বোল না। একটা ব্যঙ্গের হাসি হেসে শিয়াল বলল, তোদের আবার দু:খ কি রে? খাচ্ছিস দাচ্ছিস আর গান গেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। গান শুনিয়ে আনন্দ দেওয়াই তোদের কাজ। শ্রোতারা আনন্দ পেলেই তোর গানের সার্থকতা। দেরি করিস না। ধর একটা মিষ্টি দেখে গান। কোকিলরা অনেক অনুনয় বিনয় করল - আজ থাক দাদা। অন্য একদিন তোমায় শুনিয়ে দেব। আজ ছেড়ে দাও। শিয়ালও ছাড়ার পাত্র নয়। আমি গান শুনতে চেয়েছি এটা তোদের সৌভাগ্য। শিয়ালের কথায় কোকিলদের শিল্পী অভিমান জেগে উঠল। তারা আরো জোড়ালো স্বরে বলল, না। ক্রমে বাদানুবাদ তীব্র হলো। শিয়াল হুমকি দিল, তোদের ভাল হবে না। শেষবার বলছি - গান গাইবি কিনা বল? কোকিলরাও গলা উচিয়ে জবাব দিল, আমরা কারো মর্জির গোলাম নয়। একথা বলে তারা উড়ে গেল অন্য গাছে। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে কি যেন চিন্তা করল শিয়াল। তারপর উঠে দৌড়ল জলার পিছনে শিয়াল মহল্লার দিকে।

পরের দিন ভোরবেলা কোকিল দুটো আবার ফিরে এল বড় গাছে। বসন্তের দখিণা বাতাস বইছে। চারিদিক শান্ত। তখনো বনের জন্তুরা জাগেনি। মনের দু:খ অনেকটা সামলে নিয়েছে কোকিল দম্পতি। গলা ছেড়ে তারা গান ধরল - বহে দখিণা পবন / হলো ব্যাকুল মন ...

হঠাত্‍ দেখে দলে দলে শিয়াল এগিয়ে আসছে গাছের দিকে। গাছের নিচে শিয়ালের দল গোল হয়ে বসল। গানের তালে তালে মাথা দোলাতে লাগল ডাইনে বায়ে। কোকিলরা খুব খুশি। শিয়ালটা খারাপ নয় মোটেও। সবাইকে তাদের গান শুনতে পাঠিয়ে দিয়েছে। মনের দু:খ ভুলে আরও উত্‍সাহ নিয়ে গাইতে লাগল তারা। কোকিল দম্পতির দ্বৈত সঙ্গীতে আকাশ বাতাস ভরে উঠল। ভুল ভাঙল একটু পরেই। গান যখন জমে উঠেছে শিয়ালের দল একসাথে চিত্‍কার করে উঠল। হুক্কা হুয়া ডাকে আকাশ বাতাস ভরে গেল। কোকিলের গান গেল থেমে। গান থামতেই শিয়ালদের চিত্‍কারও বন্ধ হয়ে গেল। একটু পরে তারা গান ধরতেই আকাশ বাতাস জুড়ে আবার হুক্কা হুয়া ডাক। কোকিলরা শিয়ালের ফন্দি বুঝতে পারল। তাদের বিরুদ্ধে সব শিয়ালদের লেলিয়ে দিয়েছে সিংহরাজার চামচা। কোকিলরা উড়ে গিয়ে বনের শেষপ্রান্তে পাহাড়ের দিকে চলে গেল। দৌড়ে এল শিয়ালদের সর্দার । খুশিতে ডগমগ হয়ে মুখে করে আনা বনমুরগীটা সবার সামনে রেখে বলল, তোরা আমার মান রেখেছিস। গাছের ডালে একটা বাঁদর বসে পিঠ চুলকাচ্ছিল। শিয়ালের ইশারায় নেমে এল গাছ থেকে। বাঁদরের কানে কানে কিছু একটা বলে শিয়াল হেলে দুলে চলে গেল ঝোপের দিকে।

পরের দিন সকালবেলা। পাহাড়ের থেকে আসা ঠান্ডা হাওয়া শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছে। পাহাড় চূড়ার আড়াল থেকে সুয্যিমামা তার নরম আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে গাছের মাথায়। বুড়ো বট গাছের ডালে বসে কোকিল যেই না গান ধরেছে - প্রভাত রবি জাগাল প্রাণে .... কোথা থেকে বাঁদরটা এসে হাজির। কোকিল গলা সপ্তমে তুলে তখন গাইছে, ভোরের আলো ঘুচিয়ে দিল .... বাঁদর গাছের ডাল ধরে দোল খেতে লাগল। কোকিল যে ডালে বসে গান গাইছিল, তার উপর লাফাতে লাগল। গান গেল থেমে। বাঁদর খ্যাঁক করে হেসে গা চুলকাতে লাগল। কোকিল বুঝে গেল এও শিয়ালের চাল। 

ধীরে ধীরে কোকিলের গান গাওয়াই মুশকিল হয়ে উঠল। গান ধরলেই হয় শিয়ালরা এসে হল্লা করে নয়তো বাঁদরের দল এসে হুটোপাটি করে। নিঝুম রাতে যদি কখনো পুকুর পাড়ের গাছে বসে গান গায়, নিমেষের মধ্যে ব্যাঙের দল ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ শুরু করে দেয়। হতাশ কোকিল গান গাইতে না পেয়ে ছুটল সিংহরাজার কাছে।

সব শুনে সিংহ ডেকে পাঠাল শিয়ালকে। গুহা কাঁপিয়ে হুংকার ছেড়ে শিয়ালকে বলল, তোমায় গান শোনায়নি বলে কোকিলের পেছনে লেগেছ? ভেবেছ কি? তোমায় ভালবাসি বলে যা খুশি করে বেড়াবে? এক থাবড়ে ধড় থেকে মুন্ডু আলাদা করে দেব।

শিয়াল মাথা চুলকে বলল, অপরাধ নেবেন না মহারাজ। আসলে কোকিল গান ধরলেই তার মধুর গান শুনে অন্য জীবজন্তুদেরও গান গাইতে ইচ্ছে হয়। তখন তারা কোকিলের সাথে গলা মেলাতে চেষ্টা করে। সিংহ জানতেও পারল না শিয়ালের ফন্দির কথা। কেশর ঝাঁকিয়ে বলল, আমার রাজ্যে সবাই সমান। সকলেই যাতে গান গাওয়ার সমান সুযোগ পায় তার ব্যবস্থা করো। 

বড় একটা সেলাম ঠুকে সিংহের গুহা থেকে বেরিয়ে শিয়াল মনের আনন্দে গান ধরল। মহারাজ তাকে অনেক বড় সুযোগ করে দিয়েছেন। কেউ বুঝতেও পারবে না, অথচ কোকিলদের গান গাওয়া চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।

সবাইকে গান গাওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য শিয়াল একটা সভা ডাকল। সব পশুপাখিদের সিংহের আদেশ জানিয়ে দিয়ে বলল তার পরিকল্পনার কথা। প্রত্যেক পশুপাখির জন্য আলাদা আলাদা সময় নির্দিষ্ট থাকবে। সেই সময়ের বাইরে কেউ গান গাইতে পারবে না। ভোরবেলা গান গাইবে মুরগির দল। তারপর একে একে কুকুর, গরু -মোষ আর ছাগলেরা। একটু বেলায় হাঁসেরা গান গাইবে। আর রাত্রে গান শোনাবে ব্যাঙের দল। শিয়াল জানত সন্ধ্যেবেলা পশুপাখিরা বিশ্রাম করতে করতে কোকিলের গান শোনে। তাই সন্ধ্যেবেলা গান গাওয়ার সুযোগ দিল শিয়ালের দলকে। আর কোকিলের গান যাতে কেউ শুনতে না পারে তাই তাদের জন্য বরাদ্দ করল দুপুরবেলার সময়।

দুপুরবেলা কারোর সময় নেই। সবাই ব্যস্ত খাবারের সন্ধানে। ফলে কোকিলের গান শোনার জন্য বনে শ্রোতা প্রায় নেই বললেই হয়। দু' একটা বৃদ্ধ আর অসুস্থ পশু যাদের শিকার করার ক্ষমতা নেই, কিংবা পশু পাখীদের ছোট ছোট ছানারাই ছিল কোকিলের শ্রোতা। শ্রোতার অভাবে কোকিল গান গাওয়ার উত্‍সাহ হারাল। শিয়ালের কথা অনুযায়ী কে কখন গান গাইবে তা নাকি রাজার আদেশেই ঠিক হয়েছে। রাজার আদেশ অমান্য করার উপায় নেই। কোকিল আর কি করে! অভ্যেস বজায় রাখার জন্য অল্পক্ষণ গান গেয়েই থেমে যায়।

সপ্তাহ দুয়েক পরেই পরিস্থিতি বদলে গেল। কোকিল দেখল ধীরে ধীরে শ্রোতা বাড়ছে। একটা দুটো করে সব ধরণের পশুই হাজির তার গান শুনতে। কেবল শিয়াল আর বাঁদর ছাড়া। আসলে সন্ধ্যেবেলা সারাদিনের খাটুনির শেষে বিশ্রামের সময় শিয়ালের গান শুনে সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। শান্তির আশায় তারা শুনতে চাইত কোকিলের গান। তাই নিজেরাই ব্যবস্থা করে নিল নিজেদের মতো করে। সব কাজ ফেলে দুপুরে কয়েক ঘন্টার জন্য ফিরে আসত নিজেদের ডেরায়। কোকিলের গান শুনতে শুনতে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার বেড়িয়ে পড়ত শিকারের সন্ধানে। 

কয়েক দিন পরের ঘটনা। তখন বেলা প্রায় বারোটা। সিংহের জন্য পশুর জোগাড় করে উঠতে পারেনি শিয়াল। দূর থেকে একটা গাধাকে দেখতে পেয়ে ছুটল তার দিকে। কিন্তু হায়! অনেক চেষ্টা করেও গাধাকে ভুলিয়ে সিংহের গুহার দিকে নিয়ে যেতে পারল না। খাবারের লোভ দেখিয়েও লাভ হলো না। গাধা শুধু বলে সকাল থেকে অনেক পরিশ্রম হয়েছে। এখন গাছতলায় বসে কোকিলের গান শুনে প্রাণটা আগে জিরাবো তারপর অন্য কথা। শিয়াল পড়ল ফ্যাসাদে। কোকিলের গান গাওয়া বন্ধ তো হলোই না, তার উপর সিংহের জন্য দুপুরে পশু পাওয়াই মুশকিল হলো। ধীরে ধীরে অনেক পশুপাখিই দুপুরবেলা জড়ো হতে লাগল কোকিলের গান শুনতে।

শিয়াল রেগে গেলেও কিছু করতে পারল না। তার বানানো নিয়মের জালেই আজ সে বন্দী। একটা ব্যাপার বুঝে গেল কোকিলকে গান গাইতে দিলে অন্যদের গান আর কেউ শুনবে না। অথচ কোকিলকে জব্দ করার জন্য শিয়াল চায় অন্য পশুপাখিদের দিয়ে নিজের ইচ্ছামতো গান গাওয়াতে। ধূর্ত শিয়াল ফন্দি আঁটতে লাগল। 

দুষ্টের ছলের অভাব হয় না। আর ছলনা সব সময়ই আসে সুন্দর সাজে। শিয়াল কয়েকদিন পরে সব পশুপাখিদের ডেকে ধন্যবাদ জানাল। বলল, বনে এমন সুশৃঙ্খলভাবে সবাই শিল্প চর্চা করছে দেখে পশুরাজ খুব খুশি হয়েছেন। আগামী দিনে আরো অনেক পশু-পাখী, কীট-পতঙ্গ সঙ্গীত চর্চায় এগিয়ে আসবে বলে তার বিশ্বাস। বনের শিল্প-সংস্কৃতির মান বাড়ানোর জন্য সিংহ মশাই শিয়ালকে সভাপতি করে এক কমিটি তৈরী করে দিয়েছেন। নিজেকে সভাপতি ঘোষণা করে শিয়াল গর্বের সাথে লেজ নাড়িয়ে উঠল। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠল, এবার একটু কাজের কথা হোক। সবাই নড়েচড়ে বসল। নিশ্চয়ই কোন মতলব আছে। বিনয়ের সাথে শিয়াল বলল, এই একমাসে আপনারা সবাই নানা ধরণের গান শুনিয়ে আমাদের আনন্দ দিয়েছেন। সবাই আরো ভাল গান করুন। একটা বিষয়ে আশা করি আপনারা একমত হবেন - কোকিলের থেকে ভাল গায়ক এই বনে আর নেই। ব্যাঙ যদিও আগের থেকে অনেক উন্নতি করেছে তবুও কোকিলের মতো এখনো গান গাইতে শেখেনি। গানের কিছুই না বুঝলেও গম্ভীর গলায় শিয়াল বলতে লাগল - রাত্রে যখন ঘুম আসে না তখন ব্যাঙের গান পারে না ঘুম এনে দিতে। কিন্তু কোকিলের বেহাগ, মাল্লার, ভৈরবী শরীর মন শান্ত করে ঘুম এনে দেয়। তাই অনেক ভেবে আমি ঠিক করেছি এখন থেকে দুপুরবেলা ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ করবে ব্যাঙ আর রাত্রে গান গেয়ে আমাদের ঘুম পাড়াবে এই বনের শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পী কোকিল। শিয়ালের কথা শুনে কোকিলের চোখমুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। 

রাত্রিবেলা সবাইকে গান শোনাতে পারবে ভেবে কোকিল খুব খুশি। এইবারও ধরতে পারল না শিয়ালের চাল। কয়েক দিন পর বুঝতে পারল কেন শিয়াল এত প্রসংশা করে তাকে রাত্রে গান গাইতে পাঠিয়েছে! একটা দুটো গান গাইতে না গাইতেই কোকিলরা দেখে বনের বাসিন্দারা ঝিমোচ্ছে। চারটে বড়জোর পাঁচটা গানের পর সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। বাঘমামা গুরর্ - গুর - ফরাত্‍ করে বিকট শব্দে নাক ডাকতে শুরু করে। হতাশ কোকিল গান থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে। ধীরে ধীরে কোকিলরা বুঝল দুপুরবেলা কিছু শ্রোতা থাকলেও, রাত্রে তাদের গানের শ্রোতা প্রায় নেই। হতাশ কোকিল দম্পতি মনের দু:খে গান গাওয়া প্রায় ছেড়েই দিল। দিনে দিনে হয়ে গেল মনমরা। কয়েকদিন পরে কোকিলরা বুঝল গান ছাড়া তারা বেঁচে থাকতে পারবে না। আর বনে তাদের গান গাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। নিরুপায় হয়ে কোকিল জোড়া অনেক দু:খে বন ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে মাঠের ধারের ঐ গাছে। এই পর্যন্ত বলে গবা থামল।

গাছের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে গবা বলল, তোরা কোকিলের গান শোন আমি চলি। চাতাল থেকে নেমে গবা গুনগুন করতে করতে হাঁটা লাগাল - যতদিন প্রাণ, ততদিন গান ...।
0

কৈশোরনামা - সোমা মুখার্জী

Posted in



কৈশোরনামা


সাতভাই চম্পা

সোমা মুখার্জী


এক যে ছিলেন রাজা মশাই, সাতটি তাহার রাণী
ধনরতনে শষ্যে ভরা রাজার রাজ্যখানি
কিন্তু মনে সুখ ছিলনা, এ ধন কাদের জন্যে?
ভোগ করবে, তেমন, রাজার নেই যে পুত্র কন্যে।
ছ'টি রাণী দুষ্টু, তাদের দেমাক ভরা মন
ছোটরাণী শান্ত শিষ্ট লক্ষ্মীরই মতন।

অনেক পূজা, দান, ধ্যান আর যাগযজ্ঞের পরে,
একটি মেয়ে হলো রাজার ছোটরাণীর ঘরে।
হিংসুটি ছয়রাণীর মনে বড্ডো জ্বলুনি
ছোট্ট মেয়ে ছাইয়ের গাদায় পুঁতলো তখনি।
এমন করে আরও সাতবার, সাতটি হলো ছেলে
পাঁশতলাতে ফেলে দিল ছয়টি রাণী মিলে।
ছোটরানী কেঁদে বলেন ছেলে দেখা, দিদি,
ছয় রাণীতে রেগে বলেন, "ফের বলেছিস যদি! "
প্রতিবারই রাজা শুধান, "ছেলে কোথায় বলো?"
ছয় রানীতে বলে, "সবই কাঁকড়া, ইঁদুর, ছিল।"
রাক্ষসী নাম দিয়ে, তখন সেই দুঃখী রাজা,
ছোটরাণীকে দিলেন, কঠিন নির্বাসনের সাজা।
শুকিয়ে গেল লক্ষ্মী রাণীর মুখের সব হাসি।
ছিলেন রাণী, এবার হলেন ঘুঁটে কুড়ানি দাসী।
দিনের পরে দিন কেটে যায়, রাজ্যে নেই তো সুখ
নেই আনন্দ, নেই উৎসব, খাঁ খাঁ সবার বুক।
এমনি করে সাত সাতটি বছর হলো পার
ফুল ফোটেনা, ফল ফলে না গাছপালাতে আর।
ছয়রাণীরই পাপে রাজ্যে শূন্য হলো ফুল,
নিত্যপূজা বন্ধ, জমে মন্দিরেতে ধুল।


সাতটি বছর পরে হঠাৎ খবর রাজার কাছে
ফুল ফুটেছে! ছাই গাদাতে, আটটি রঙিন গাছে।
রাজা দেখেন, সাতটি চাঁপা, একটি পারুল চারা
ছাইগাদাতে দাঁড়িয়ে দেয় হাওয়ায় মাথা নাড়া।
তাই দেখে যেই, রাজার মালী ফুল তুলতে গেল
অমনি সেসব ছোট্ট চারা লঅম্বা হয়ে গেল
এলেন যত মন্ত্রী, সান্ত্রী, বদ্যি, সেপাই,পাত্র,
পুরুত, প্রজা, কেউ পেলনা, একখানি ফুল মাত্র
একে একে এলেন এবার, দুষ্টু সে ছয়রাণী
কিছুতে ফুল দেয়না ধরা, কেন, তা কি জানি?
রাজামশাই নিজেই এবার এগিয়ে এলেন যেই
আটফুলেতে দোলায় মাথা, তেমনি উঁচুতেই !
চুলকে মাথা, মন্ত্রী বলেন, ছোটরাণীকে ডাকো।
এ ফুল পাড়তে পারেন কিনা, পরখ করে দ্যাখো।


থাকেন রাণী বনের মাঝে ছোট্ট কুঁড়ে বেঁধে
রাজা সেথায় চতুর্দোলা পাঠিয়ে দিলেন সেধে।
রাণী এসে যেই দাঁড়ালেন, অমনি পারুল বলে,
"মা এসেছেন, ও চাঁপাভাই, এবার এসো চলে।
মায়ের দুঃখ ঘুচাও এবার মোছাও মায়ের চোখ,
রাক্ষসী নন মা আমাদের, জানুক সকল লোক।"
দেখল সবাই অবাক হয়ে, টুপটুপিয়ে ভুঁয়ে
পড়ল ঝরে, সেই আটফুল, রাণীর চরণ ছুঁয়ে।
সাতটি ছেলে, একটি মেয়ে মা মা করে ডেকে,
উঠল এসে ছোটরাণীর কোলে, পিঠে, কাঁখে।

অনেকদিনের পরে আবার রেগে উঠে রাজা
ছয় রাণীকে দিলেন এবার শূলে চড়ার সাজা।
ছোটরাণী শুনে, ধরেন জড়িয়ে রাজার পা
বলেন "ওদের মাফ করে দাও, শাস্তি দিওনা।
মেনে নিলেন রাজামশাই, ছোটরাণীর কথা
দেখে শুনে ছয় দেমাকীর হেঁট হলো যে মাথা।
বলেন রাজা, শোনো সবাই, যা পাপ, যা অন্যায়
চিরটাকাল সেসব কিছু গোপন নাহি রয়।
আসুক বিপদ, তবুও জেনো, নেই সত্যের লয়
মিথ্যার নাশ হবেই হবে, জয়, সত্যের জয়।
তারপরে, সেই সাত চাঁপাভাই একটি পারুল বোন।
সাতটি মা আর বাবার সঙ্গে, কাটায় সুখে জীবন।
0

কৈশোরনামা - শুভ্রা ভট্টাচার্য

Posted in


কৈশোরনামা


টেলিফোন 
শুভ্রা ভট্টাচার্য



আচমকা টেলিফোনটা ঝনঝনিয়ে উঠলো। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলেন রজত। বেড সুইচটিপে আলোটা জ্বাললেন। ঘড়ি বলছে এখন কাঁটায় কাঁটায় রাত ২ টো। ফোনটার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। ফোনটা বাজছে তো বাজছেই। কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে খাট থেকে নেমে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে ফোনটার দিকে যেই না হাত বাড়িয়েছেন অমনি সব চুপচাপ। ফোনের রিং বেমালুম থেমে গেলো। হঠাৎ একটা নিস্তব্ধতা নেমে এলো ঘরের মধ্যে। ঘড়ির কাঁটা বলছে টিক টিক টিক। খাটের খুব কাছ থেকে একটা টিকটিকি বলে উঠলো ঠিক ঠিক ঠিক। এইসব কিছু ছাপিয়ে রজত নিজের হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি শুনতে পাচ্ছেন।

এই নিয়ে পর পর দু-দুটো রাতে বিশ্রী অভিজ্ঞতা হলো রজতের। কি যে মাথায় ভূত চেপেছিল তার, এই তাঁবুতেই থাকবেন। ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আর মুখ্যমন্ত্রী অবধি অনুরোধ করেছিলেন এখানে না থাকার জন্য। কিন্তু দীর্ঘ বছর ধরে থর মরুর বুকে কয়েকটা তাঁবু তালা বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে কেবল মাত্র কয়েকটা ভুতুড়ে ঘটনার কারণে, এ কথাটা আর যেই হোক অন্তত আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ডাইরেক্টর রজত বোস বিশ্বাস করেননি। নানান সার্ভের কাজে তার সহকারীদের প্রায়শই আশের পাশের তাঁবুগুলোতে থাকতে হয় অথচ তাঁদেরই মাঝখানে ভানগড় ফোর্টের মতো এই তাঁবুগুলোকে এত বছর ধরে সবাই এড়িয়ে যাচ্ছেন। আবার পরপর দু রাত যে অভিজ্ঞতা হলো, তা-ও ফেলে দেওয়ার নয়। প্রতি রাতে ঠিক ২ টোয় টেলিফোন বেজে ওঠে। ধরতে গেলেই সঙ্গে সঙ্গে কেটে যায়। অথচ রজত জানেন, ফোনের লাইন কাটা। ব্যাপারটা আপাত ভৌতিক হলেও এর পেছনে যেন অন্য রহস্যের গন্ধ পান রজত।

জয়সলমীরের সকালটা একদম জমজমাট। দেশি বিদেশী টুরিস্টরা ক্যামেরা নিয়ে খুচুক খুচুক ছবি তুলেই চলেছেন। সকাল ৭টাতেই বালি বেশ গরম হয়ে উঠেছে। চারিদিকের হৈচৈ-এ রাতের আতংকটা দিব্বি ভুলে থাকা যায়। চট করে মুখ হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলেন রজত। এই ‘রুকস্যাক’ তাঁবুর মালিক মিস্টার তিলক বর্মার বাড়িতে আজ চায়ের নেমন্তন্ন। বর্মা মানুষটি বেশ হাসিখুশি। চা, কেক, লুচি, বেগুনভাজায় আড্ডা জমে উঠলো। লুচি শেষ করে আরেক দফা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রজত জিজ্ঞেস করলেন,
-বর্মা সাব, এই তাঁবুর গল্প আমি অনেকের কাছে শুনেছি। আর আমি তো আপনাকে আগেও বলেছি এই গল্প আমি বিশ্বাস করিনি। কিন্তু এ ঘটনাটা তো আপনার সামনেই ঘটেছিলো নাকি?

-হাঁ সাব। একদম আমার চোখের সামনে ঘটা। এখনও ভাবলে আমার গায়ে কাঁটা দেয়।

-তাহলে আপনার কাছ থেকে আমি ঘটনাটা ডিটেলে আরেকবার শুনতে চাই।

বর্মা চায়ের কাপ টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে শুরু করলেন, 
-ঘটনার সূত্রপাত সাত-আট বছর আগে। তখন এই তাঁবুগুলো ছিল টুরিস্টদের হৈহৈ করার জায়গা। মরুভূমি দর্শন আর থাকার জন্যে আমার রুকস্যাক-তাঁবুগুলোই ছিল টুরিস্টদের প্রথম পছন্দের। বুঝতেই পারছেন যে যথেষ্ট রমরমা বাজার ছিল আমার। সে বছর অনেক পার্টির মধ্যে এক সদ্য বিবাহিতা দম্পতিও ছিলেন। তারা এই তাঁবুটিতে উঠেছিলেন এক রাত্রে। পরদিন সকালে সবাই মিলে উটে চড়ে মরুভূমি দর্শনে বের হন। সেদিনই ঘটে সেই দুর্ঘটনা। খানিক দূর যাওয়ার পরই চালকরা টের পায় যে মরুর ঝড় খুব দ্রুততার সাথে ধেয়ে আসছে তাদের দিকে। অতএব উটের মুখ ঘুরিয়ে যত দ্রুত সম্ভব সবাইকে তাঁবুতে ফিরিয়ে আনা হয়। যে যার তাঁবুতে নিরাপদ ভাবে ফিরে এলেও ফিরে আসেননি সেই নব্য বিবাহিতার স্বামী। উটটিও বেপাত্তা। ঝড়ের তাণ্ডব থামলে পরে সবাই চতুর্দিকে খোঁজা খুঁজি আরম্ভ করেন। পরিশেষে সেই উটটি মেলে বটে কিন্তু ভদ্রলোকের সন্ধান পাওয়া যায়নি। পরের দিন রেস্কিউ টিম খোঁজাখুঁজি করে মাঝ মরুভূমি থেকে একটা মৃতদেহ পায়। সেই খবর আমরা সে মহিলাকে জানাতেই তিনি উন্মাদের মতো কান্নাকাটি করতে করতে হঠাৎ হার্টফেল করে মারা যান। আর তারপরেই আমরা সেই লোকটার বডি পাই আর দেখি যে সেটা আসলে অন্য এক বিদেশী টুরিস্টের বডি। আকস্মিক এরকম দুর্ঘটনায় সবার মধ্যেই একটা শোকের ছায়া নেমে আসে।

এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পর সবাই সব ভুলে যায়। এমনকি আমিও প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম। ঐ তাঁবুতে আবার অন্য যাত্রীরা আসতে থাকেন। সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে যায়। তারপর প্রায় বছর খানেক বাদে একদিন ঐ তাঁবুর নামে একটা অভিযোগ আসে। যাত্রীরা অভিযোগ করতে থাকেন যে প্রতি রাতেই ঐ তাঁবুর টেলিফোনে কেউ একজন ফোন করে তার স্ত্রীকে চান। তারা প্রথম প্রথম ভাবতেন যে কেউ ভুল করে এই নম্বরে ফোন করছে। পরে ভাবতে লাগলেন যে কেউ ইচ্ছে করে রোজ গভীর রাতে ফোন করে রীতিমতো বিরক্ত করছে তাদের। ব্যাপারটা বুঝে দেখতে আমি একদিন রাতে ফোনটা ধরলাম। তখন রাত প্রায় দুটো। একটা ফ্যাসফ্যাসে গলার মালিক ফোনের ওপার থেকে অদ্ভুত কাঁপা কাঁপা গলায় তার স্ত্রী-এর খোঁজ করছিলেন। আমি যথারীতি বললাম যে, ‘আপনি বোধহয় ভুল নম্বরে ফোন করছেন বারে বারে’।

-এটা রুকস্যাক হোটেল না?

-হ্যাঁ ঠিক। কিন্তু এখানে আপনার স্ত্রী নেই।

-আমিও জানি যে আমার স্ত্রী এখানে নেই।

-আপনি জানেন? তাহলে জেনে শুনে কেন ফোন করেছেন?

-আমি জানতে চাই যে আমার স্ত্রী কোথায়?

আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়লাম। তাও মাথা ঠাণ্ডা রেখে বললাম,
-আরে মশাই, আমরা কি করে জানব যে আপনার স্ত্রী কোথায়?

ওপারের স্বর কাঁপতে কাঁপতে বললো,
-বিশ্বাস করুন আমি সব জায়গায় খুঁজেছি কিন্তু কোথাও ওকে খুঁজে পাইনি।

-তাহলে পুলিশে জানান। এখানে ফোন করলে কি আমরা আপনার স্ত্রীকে খুঁজে দিতে পারবো?

-কিন্তু আমার স্ত্রী তো এখান থেকেই হারিয়েছে।

-কি আশ্চর্য। আপনার স্ত্রী কি বাচ্চা মেয়ে নাকি যে হারিয়ে যাবে? আর আমাদের হোটেল থেকে কেউ হারায়নি।

-হারিয়েছে। মনে করে দেখুন। ঠিক এক বছর আগে। আমি আর আমার স্ত্রী আপনার হোটেলে উঠেছিলাম। মনে পড়ে?

তখন আমার খটকা লাগে।
-কি হয়েছিলো বলুন তো?

-মনে পড়লো? সেই যে একটা মরু ঝড়ে পড়েছিলাম সব যাত্রীরা। তখন আমার উটটা হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে অন্য রাস্তা ধরে ছুটতে শুরু করলো। আমি চিৎকার করে আমার স্ত্রীকে ডাকছিলাম কিন্তু ততক্ষণে তার আর অন্যান্য উটগুলো পুরো উলটো পথে রওনা দিয়ে দিয়েছিল। আর আমার ডাক কেউ শুনতেই পেল না।

-তারপর?

-তারপর আমি হঠাৎ উটের পিঠ থেকে ছিটকে পড়ে গেলাম। প্রচণ্ড বালির ঝড় আমার উপর দিয়ে বয়ে যেতে লাগলো আর আমি বালিচাপা পড়তে থাকলাম। তারপর একসময় আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।

আমি স্তব্ধ হয়ে শুনে যাচ্ছি আর ফোনের ওপারের জন একটানা বলে চলেছে ,
-জ্ঞান হতে দেখি তখন অনেক রাত। আকাশে ঝিকমিক করছে তারারা। আর আমি মরুভূমির মাঝে শুয়ে। উঠে দেখলাম আমি হাওয়ায় ভাসছি। আমার আত্মা আমার দেহ ছেড়ে দিয়েছে। সেই থেকে আমি আমার স্ত্রীকে খুঁজছি। এই এক বছর ভর খুঁজে চলেছি। গোটা শহরে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি এমনকি আমার নিজের বাড়িতেও! কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলাম না।

এরপর বিশ্বাস করুন রজত সাহাব ঐ ফোন আর আমি হাতে ধরে রাখতে পারিনি। আমি তাড়াতাড়ি ফোন রেখে দিয়েছিলাম আর সবাইকে ঐ টেন্টগুলো ফাঁকা করে দিতে বলে আমি নিজেও ওখান থেকে পালিয়ে চলে এসেছিলাম। তারপর আমি নিজেই দায়িত্ব নিয়ে সব ফোনের লাইন কাটিয়ে দিই। পুরনো ফোন, তাই ভাবলাম এখন পড়ে থাক পরে নয় সময় করে সরিয়ে দেবো। কিন্তু কোথায় কি? আবার সেই ফোনই রাত দুটোয় বাজতে শুনেছে বেয়ারা চম্পকলাল। তারপর প্রতিদিন রাত দুটোয় ওটা বাজে। আর আমার ব্যবসা তো লাটে উঠলো।বাধ্য হয়ে আমাকে সব তাঁবু সিল করে দিতে হলো।

এতক্ষণ পর রজত মুখ খুললেন,
-সিল করে দিলেন কেন? তাঁবুগুলো খুলে ফেললেই তো ল্যাঠা চুকে যেতো।

-না বাবু না। অতো সোজা হলো না। আমি তাঁবু খুলতে গেলেই মনে হতো কিছু একটা আছে ভেতরে। আমি তাঁবু খুলতে গেলেই আমাকে টুঁটি চেপে ধরবে। আর সাত বছর ধরে অমনি করেই ফেলে রাখতে হলো।

বলেই ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস নিয়ে হাঁপাতে লাগলেন। আপন মনেই মাথা নেড়ে বিড়বিড় করে বললেন,
-সে অনেক বছর আগের কথা জনাব। এখন আর সে ভূত ধরা দেবে না, দেবে না। 



**** 



বর্মার বাড়ি থেকেই হোটেলগুলো দেখা যায়। সেই যাত্রায় যে সমস্ত উট চালকেরা ছিল তারাও নিশ্চয়ই সেই ঘটনার সাক্ষী। সেই গোটা ঘটনায় আরও কিছু ঘটেছিল বলে তার বিশ্বাস। কিন্তু সমস্ত ঘটনা একজনের থেকে জানা কখনই সম্ভব নয়। তাই রজত ঠিক করলেন সেই দিনের মরু ঝড়ে যে উট চালকরা সঙ্গে ছিলেন তাদের সঙ্গে কথা বলবেন।

কিন্তু সবার সঙ্গে কথা বলেও বিশেষ কিছু লাভ হলো না। সবাই কম বেশি সেই একই সুর গেয়ে যাচ্ছে। রজতের বারে বারে মনে হচ্ছে কেউই যেন সবটা খুলে বলছে না। কিছু কথা চেপে যাচ্ছে। দুপুরের খাঁ খাঁ রোদে মরুতট প্রায় শূন্য। টুরিস্টরা যে যার তাঁবুতে আছেন অথবা অন্যত্র ঘুরতে গেছেন। এসব ভাবতে ভাবতে রজত বালির ওপর দিয়ে হাঁটছিলেন। হঠাৎ খেয়াল হলো, তিনি মূল মরুভূমির ভেতর ঢুকে পড়েছেন। রজতের কাছে যদিও কম্পাস রয়েছে তবু, তার মনে হলো যেন তিনি রাস্তা হারিয়েছেন। হঠাৎ চারদিক কেমন শান্ত চুপচাপ হয়ে গেলো। যেদিকেই তাকাও শুধু বালি আর বালি। এভাবে অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়াটা তার একদম উচিত হয়নি। কম্পাসটা পকেট থেকে বের করতে যাবেন আচমকা একটা বিকট শব্দে বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো। চমকে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলেন দুটো শকুন ঘোরাঘুরি করছে আর বিশ্রী শব্দে ডাকছে। যাক, শকুন। অন্য কিছু নয়। এরকম শুনশান একটা জায়গায় শকুনের ডাকও কত ভয়ানক শুনতে লাগে।

কিন্তু, কোন দিকে যাবেন কিছুতেই বুঝতে পারছেন না যে। কম্পাসের কাঁটা বলছে উত্তর-পশ্চিমে এগিয়ে এসেছেন। তাঁবুতে ফিরতে হলে তাকে আরও উত্তরে যেতে হবে। কয়েক পা হাঁটতে হাঁটতেই তার মনে হলো শকুনগুলোও যেন তার পিছু পিছু চলেছে। তিনি আরও কিছুটা এগোলেন আর কি আশ্চর্য শকুনগুলোও নিঃশব্দে তাকে অনুসরন করে চললো। এবার তারএকটু একটু ভয় করছে। তিনি ঠিক রাস্তায় এগোচ্ছেন তো? রাস্তা যে আর ফুরোয় না। আর শকুনগুলোও তার মাথার ওপরে ঘুরেই চলেছে। পায়ে সমস্ত জোর এনে রজত এবার উত্তরদিক বরাবর ছুটতে আরম্ভ করলেন। কতটাই বা হেঁটে এসেছেন তিনি? এখন যত দ্রুত সম্ভব তাঁবুতে ফেরা দরকার। কিন্তু বালির ওপর দিয়ে পা আটকে যাচ্ছে। এদিকে গলা শুকিয়ে কাঠ। চোখ জ্বালা করছে। দরদর করে ঘামছেন। হঠাৎ কিছুতে যেন পা বেঁধে গিয়ে দুড়ুম করে মুখ থুবড়ে পড়লেন। মুখে চোখে বালি ঢুকে যা তা কাণ্ড। চোখ মুখ থেকে বালি ঝেড়ে তাকিয়ে দেখে আঁতকে উঠলেন। একটা কঙ্কালের কয়েকটা হাড়ে তার পা আটকে হোঁচট খেয়েছিল। শুধু পা টাই যা দেখা যাচ্ছে তার, আর বাকি শরীর তো বালির নীচে ডুবে আছে। দেখে তো মনে হচ্ছে মানুষেরই পা।

ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন রজত। মনে হচ্ছে এটা কোনও মহিলার কঙ্কাল। পায়ে বালি মাখা ধাতব নূপুর পরা। বালির নীচ থেকে হলদে রঙের শাড়ীর একটু অংশও বেরিয়ে রয়েছে। কঙ্কালটা কতটা বালির নীচে ডুবে আছে দেখার কৌতূহল হলো তার। আশপাশের বালি সরাতে লাগলেন তিনি। পা ধরে অনেক টানাটানি করলেন কিন্তু না এ তোলার ক্ষমতা তার নেই। রীতিমত শাবল দিয়ে বালি তুলে তবে বের করতে হবে। আহারে কোন অভাগী হয়তো কোনও বিপদে তার মতই রাস্তা হারিয়ে তারপর এখানেই মারা গেছে। ভাবলেন কাউকে নিয়ে এসে যদি তোলানো যায়। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়লো তিনি এখান থেকে বেরোবেন কি করে? রাস্তা হারিয়ে ফেলেছেন তো। কম্পাসটা যতটা সম্ভব উঁচুতে তুলে দেখার চেষ্টা করলেন কিন্তু উত্তর বরাবর চলতে চলতে তিনি যে কখন আবার পশ্চিমে চলে এসেছেন বুঝতেই পারেননি। শকুনগুলোরও পাত্তা নেই। এখন বেশ বুঝতে পারছেন যে ঐ শকুনগুলোই ওকে এই পথে টেনে এনেছে। তবে দূরে মনে হচ্ছে কিছু উট আসছে। ভাগ্য খুব ভালো বলতে হবে যে উটগুলো ঠিক এদিকেই আসছে। সে দিকে হাত দেখিয়ে ছুটে গেলেন রজত। অনেকগুলি উট নিয়ে কিছু যাত্রী তখন মরুভ্রমণে বেরিয়েছে। ঘড়ির কাঁটাও দুপুর গড়িয়ে বিকেলের পরে এসে ঠেকেছে।

উটের চালক দলের মধ্যে একটা ষোল সতেরো বছরের ছেলে ছিল। রজত তাকে বললেন,
-আমাকে তুই হোটেলে নিয়ে যেতে পারবি?

-জী সাহাব। জরুর পারবে।

-আর তারপর যদি তোকে নিয়ে এখুনি আবার এখানে ফিরে আসি তুই ঠিক এই জায়গাটাই আমাকে চিনিয়ে দিতে পারবি।

-হাঁ পারবে তো। এ জাগাহ জেয়াদা দূর নহি হেয় সাহাব।

-দেখ ভাই ঠিক এই জায়গাটাতেই ফিরে আসতে হবে কিন্তু। পারবি তো?

-জী জনাব। পারবে পারবে। জরুর পারবে।

-চল তালে। জলদি চল।

এই বলে তারা একটা উট নিয়ে ছুটল হোটেলের দিকে। কিছু লোক, কোদাল আর শাবল নিয়ে আধা ঘণ্টার মধ্যেই আবার ফিরে এলো সেই জায়গায়। কিন্তু কই? কই? কই? কঙ্কালেরচিহ্ন অবধি নেই। সবাই চতুর্দিক তোলপাড় করে খুঁজলো কিন্তু কঙ্কাল নেই।

তাঁবুতে ফিরে আসতে বেশ রাত হয়ে গেলো। কিন্তু রজতের ছটফটানি ভাবটা কিছুতেই যাচ্ছে না। একটা গোটা মানুষের কঙ্কাল বালির নীচে আবার চাপা পড়ে যেতে পারে কিন্তু ভোজবাজির মতো উড়ে যাবে কি করে? সে অস্থির ভাবে গোটা ঘরময় পায়চারী করতে লাগলো। টেলিফোনটা যেন একটা জ্যান্ত দানব। ঘরের এক কোণা থেকে রজতের প্রতিটা গতিবিধি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে লক্ষ্য করে যাচ্ছে যেন। ঘড়িতে এখন সাড়ে সাতটা। নাহ এমন কিছু রাত তো নয়। ঝপাঝপ গায়ের সোয়েটারটার ওপর একটা শাল জড়িয়ে হাতে একখানা বড় টর্চ নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। কিন্তু, এই টেলিফোন রহস্য তাকে সমাধান করতেই হবে আজ। একগাদা প্রশ্ন তার মাথায় জমাট বেঁধে রয়েছে তার উত্তরগুলো খুঁজে বের করতেই হবে।



*****



আচমকা কোনও খবর না দিয়ে আসায় বর্মা একটু হকচকিয়ে গেছেন। কিন্তু, যথাসম্ভব মুখে সেই পুরনো হাসিটা টেনে এনে, ভেতরে আসতে বললেন। হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে এসে রজত বললেন,
-আমি বসতে আসিনি বর্মা। আমাকে কয়েকটা খবর জানাতে পারবেন?

-হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। বলুন না।

-আচ্ছা বর্মা, আপনি তো বললেন সেই মৃত স্বামীর খবর পেয়েই নাকি মহিলা হার্টফেল করেন, তাই না?

-হাঁ বিলকুল।

- তো তারপর সেই বডির কি করলেন ?

- জি সেই বডি পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। আর পুলিশ সেই বডি...

-আর পুলিশ সেই বডি? কি করেছিল সেই বডির?

-আজ্ঞে পুলিশ তো মনে পরছে যদ্দুর সেই বডি তার অরজিনাল ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয়।

-তার মানে পুলিশ জানতে পেরেছিল তাদের আসল ঠিকানা?

-তাই তো জানতাম।

রজত শ্যেনদৃষ্টিতে বর্মার দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে তিনি বললেন,
-জী আপনি পুলিশকে জিজ্ঞেস করতে পারেন লোকাল থানায় গিয়ে। তারাই তো সব ব্যবস্থা করেছে।

রজত দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
-আমার সেটাই সবার আগে করার উচিত ছিল। পাপ করলে তার শাস্তি পেতেই হয় বর্মাজী।

বলেই ধাঁ করে বেরিয়ে গেলেন। বর্মা স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তার চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

থানাটা বড্ড দূর। রজত নিজের মনে মনেই নিজেকে ধিক্কার দিলেন। তার সবার আগে উচিত ছিল লোকাল থানাতেই পুরো বিষয়টা খতিয়ে দেখার। যদিও তিনি গোড়াতে ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে চাননি। কিন্তু, পর পর ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা পুরোপুরি অসংলগ্ন হতে পারে না। থানায় গিয়ে কিছু জিনিস জানা গেলো। তার আসল পরিচয় জেনে ও.সি তাকে যথেষ্ট খাতিরযত্ন করলেন। আর এও জানালেন যে, ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কথা অমান্য করে তিনি ঐ টেন্টে থেকে মোটেই ভালো কাজ করেননি। যদি কিছু হয়ে যেতো তাহলে তারা উপরমহলের কাছে কি জবাবদিহি করতেন? কিন্তু, রজতের এখন এসব ভাবার সময় নেই। তিনি আজ সারা দিনে যা যা ঘটেছে সমস্ত সবিস্তারে ও.সিকে বললেন। জানতে পারলেন যে, সেই ঘটনার পর সেই মহিলার বডি শনাক্ত করতে কোলকাতা থেকে তার বাবা মা আসেন আর তাদের হাতেই সেই মৃতদেহ তারা তুলে দেন। কিন্তু, সেই লোকটার বডি অনেক খুঁজেও আর পাওয়া যায়না।

-কিন্তু তারাই যে অরিজিনাল মা বাবা সে ব্যাপারে আপনারা নিশ্চিত? মানে তারা কি সেরকম প্রমাণ নিয়ে এসেছিল?

-দেখুন এসব ক্ষেত্রে আমাদের যা প্রাথমিক তদন্ত তা করেই আমরা বডি ছেড়ে দিই। কিন্তু মা বাবা বলে পরিচয় দিয়ে কান্নাকাটি করে যারা মৃতদেহ সনাক্ত করলো তাদের পরিচয় আর অতো খবর নিয়ে দেখিনি আমরা।

হাতের মুঠো পাকিয়ে টেবিলের ওপর সজোরে একটা ঘুসি মেরে রজত বললেন,
-এই কাঁচা কাজটা আপনারা করতে পারলেন? ড্যাম ইট।

-কি করি বলুন তো মশাই? সেই মুহূর্তে অন্য স্টেটের এক টুরিস্ট কি বিচ্ছিরি ভাবে মারা গেলেন। যার স্বামীও নিরুদ্দেশ। সঙ্গে আরেক টুরিস্ট যিনি আবার স্কটল্যান্ড থেকে এসেছিলেন তিনিও ঐ একই মরুঝড়ে মারা গেলেন। তাদের বডি নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে যে কোনো অবস্থায় বডি শনাক্ত হয়ে গেলেই আমরা বেঁচে যাই আর কি। তো তার জন্যেই তাড়াহুড়োয়...

রজতের অসহ্য লাগছিলো এসব। থানা থেকে বেরিয়ে দ্রুত তাঁবুর দিকে পা বাড়ালেন। চোখের সামনে শুধু বারবার ভেসে উঠছিল বালির ভেতরে ডুবে থাকা একটা বেওয়ারিশ কঙ্কাল। পুলিশকে সে কথা বলে বিশেষ লাভ হলো বলে তো মনে হলো না। উফফ কি অসহ্য। তাঁবুর কাছাকাছি আসতেই তার যেন মনে হলো খুব কাছেই কয়েকজন কথা বলছে। একাধিক নারীপুরুষের কণ্ঠস্বর যেন। প্রথমে ভাবলেন কে কথা বলছে তা নিয়ে তার মাথা ব্যাথা হওয়ার দরকার নেই। কিন্তু, তিনি যতই তাঁবুর দিকে এগোচ্ছেন মনে হচ্ছে শব্দগুলো সেদিক থেকেই আসছে যেন। তার তাঁবুর সামনে এসে মনে হলো যেন পেছনের তাঁবুটাতেই কেউ কথা বলছে। কিন্তু, পেছনের তাঁবু তো ফাঁকা। কারো তো থাকার কথা নয়। তিনি দেখার জন্যে এগিয়েই বুঝলেন যে কথাগুলো আসলে তারও পেছনের তাঁবুটা থেকে আসছে। এভাবে একটা করে তাঁবু এগোতে এগোতে তিনি শেষ তাঁবুটাতে এসে দেখলেন সেখানে কেউ নেই কিন্তু মনে হচ্ছে কথাগুলো যেন সামনেই কোথাও থেকে ভেসে আসছে তার কানে। তিনি কৌতূহল দমন করতে না পেরে আরেকটু এগিয়ে গেলেন। তারপর আরেকটু। খানিকক্ষণ বাদে টের পেলেন যেমরুভূমি তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেও থামতে পারছেন না কিছুতেই। ক্রমেই এগিয়ে চলেছেন গাঢ় অন্ধকারের দিকে। মরুভূমি এখানে ঘন থেকে ঘনতর হচ্ছে।উপায়ন্তর না দেখে রজত হাতের টর্চটা জ্বাললেন। তার পা দুটো যে তাকে কোন দিকে টেনে নিয়ে চলেছে তা ঠাওর করার কোনও উপায় নেই। চলতে চলতে হঠাৎ দেখলেন মরুভূমির মাঝখানে ধিকি ধিকি আগুন জ্বলছে। আর তিনিও ক্রমে সেই দিকেই এগিয়ে চলেছেন। একসময় গতি ধীর হলো। আগুনের কিছুটা আগেই তিনি থামলেন। আগুনের সামনে বসে আছে একটা লোক। তার সামনে কোশাকুশি থেকে ক্রমাগত কী সব যেন ঢেলে যাচ্ছে নিজের মাথায়। উবু হয়ে বসে সেই আগুনের আঁচও মাথায় নিচ্ছে। একসময় লোকটা ঘাড় ঘুরিয়ে তারদিকে চাইলো। সেই দৃষ্টিতে রজতের বুকের রক্ত হিম হয়ে গেলো। চোখ তো নয় যেন কঙ্কালসার মুখের কোটরে লাল টুনিবাল্ব জ্বলছে। হাত পা অস্বাভাবিক রকম সরু। লোকটা ওর চোখ থেকে মুখ ফেরালো আবার আগুনের দিকে। রজতের পা দুটো যেন বালির সাথে গেঁথে রয়েছে। সর্বাঙ্গ অসম্ভব ভারী ঠেকছে। নড়াচড়া করার ক্ষমতা অবধি নেই। লোকটা ফ্যাসফ্যাসে গলায় অদ্ভুত সব প্রলাপ বকে চলেছে। একটা কথা বারে বারে ঘুরে ফিরে বলছে “আর থাকবেনা। আর থাকবেনা।” সেই কথা শুনতে শুনতে রজতের কান লাল হয়ে উঠলো। চোখজ্বালা করতে লাগলো। সারা শরীরে আগুন গরম রক্ত বইতে থাকলো।



*****



যখন রজতের চোখ খুললেন, তিনি দেখলেন তাকে ঘিরে অনেক লোক দাঁড়িয়ে জটলা করছে। উঠতে গিয়ে টের পেলেন গায়ে খুব জ্বর। সারা শরীর যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। জানতে পারলেন উটের সারি তাকে মাঝ মরুভুমিতে পড়ে থাকতে দেখে নিয়ে আসে তাঁবুতে। জয়সলমীর থানার ও.সি তার জ্ঞান ফিরতে দেখে কাছে আসেন। জানতে চান গত রাতে তিনি বর্মার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন কিনা। কারণ তারপর থেকেই তাকে নাকি আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রজত মাথাটা দু'হাতে ধরে উঠে দাঁড়ালেন। তার কথা বলার শক্তি প্রায় নেই বললেই চলে। পুলিশকে তার পিছু পিছু আসতে বলে তিনি মরুভূমির দিকে আবার পা বাড়ালেন। জ্বরে তার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। আওয়াজ শুনে আকাশের দিকে মুখ তুলে দেখলেন দু'টো শকুন তাদের মাথার ওপর ঘোরাঘুরি করছে। রজত জানেন ওরাই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। খানিকটা পথ গিয়ে সবাই থামলেন। একটা জায়গায় বালির ওপর কয়েকটা সোনার আংটি, হার, দুল এসব পড়ে আছে। সেই জায়গার বালি খুঁড়তেই বেরিয়ে এলো বর্মার মৃতদেহ। কেউ আসুরিক শক্তি প্রয়োগ করে তার মাথাটা ছিঁড়ে ধর থেকে আলাদা করে দিয়েছে। যাকোনও মানুষের কাজ হতেই পারে না। পাশে আরও কঙ্কাল। তার হাতে চুড়ি, টুকরো শাঁখা, পলা, পায়ে নূপুর, গায়ে জড়ানো হলুদ ছিন্ন কাপড়।

রজত নিজে দাঁড়িয়ে থেকে শব দেহ আর কঙ্কালের শেষকৃত্য করালেন। দুটি আত্মাই এবার শান্তি পাবে। গত রাতে দেখা সেই কঙ্কালসার লোকটিই সাত বছর আগের আকস্মিক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া সেই মহিলার স্বামী। সেই দুর্ঘটনায় আরও দু'জন মারা যান। যাদের একজন বিদেশী টুরিস্ট, তার দেহ শনাক্ত হয়। কিন্তু, আরও এক অভাগী সেদিন সেই বালিতে চাপা পড়ে দম বন্ধ হয়ে মারা যায়। তার দেহই বদল করা হয়েছিল সেই নব বিবাহিতা বধুর মৃতদেহের সঙ্গে। টাকা দিয়ে কিছু মানুষের মুখ বন্ধ করে সবার চোখের আড়ালে সেই দেহ পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। আর কিছু লোককে তার বাড়ির লোকজন সাজিয়ে একটা মিথ্যে গল্প রচনা করা হয় যে সে হার্টফেল করে মারা গেছে। পুলিশের তদন্তেও তাইই ধরা পড়ে। কিন্তু, আসল ঘটনা হলো যে সেই বউটি স্বামীর শোকে ভয়ে আতঙ্কে তাঁবুর ভেতরেই গলায় দড়ি দিয়েছিল। পাছে অপঘাতে মৃত্যুর দোষে হোটেলের বদনাম হয় ও ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায় তাই বর্মা নিজেই সেই লাশ মাঝ মরুভূমিতে পুঁতে দিয়ে পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এত বছরেও তাদের বাড়ির লোকজন কোনও খোঁজ কেন করেননি সেটাই বিরাট বিস্ময়।

সমস্ত কাজ মিটিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ও.সি রজতকে জিজ্ঞেস করলেন,
-আমি শুধু একটাই প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাচ্ছিনা। সেই মৃতার স্বামীর তবে কি হলো? তার অতৃপ্ত আত্মা কি তবে কোনও কালেই শান্তি পাবে না?

রজত হেসে বললেন ,
-সে ব্যবস্থা সে নিজেই করে গেছে। কাল রাতে আমার চোখের সামনেই সে নিজের শেষক্রিয়া করে তার অতৃপ্ত আত্মাকে মুক্তি দিয়ে গেছে। আর সে কথা দিয়েছে কোনও টেলিফোন উৎপাতও আর হবে না।

সূর্য তখন মাঝ আকাশে পুরো দমে তার তেজ বিকিরণ করছে। রজত কপালে দু হাত দিয়ে চোখ ঢেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলেন দু'টো শকুন ওদের মাথার অনেক উঁচু দিয়ে কর্কশ স্বরে ডাকতে ডাকতে উড়ে যাচ্ছে গভীর মরুভূমির দিকে।
6

কৈশোরনামা - ধূপছায়া মজুমদার

Posted in


কৈশোরনামা


মিশকুন আর বন্ধু-রা
ধূপছায়া মজুমদার


এক যে আছে ছোট্ট ছানা হাতি, নাম তার মিশকুন। তার কাছে আছে লম্বা একখানা শুঁড়,দুটো ক্ষুদে ক্ষুদে চোখ, মাথার দু’পাশে দুখানা লতপতে কান, সেগুলো আবার ফটাফট নাড়ানো যায়। আর আছে চারটে গোবদা পা, আর একখানা পুঁচকে লেজ। ওহো, আসল কথাটাই ভুলে গিয়েছি বলতে, শুঁড়ের দু’পাশ দিয়ে উঁকি মারছে ছোট্ট দুটো সাদা দাঁত। এইসব জিনিসপত্তর নিয়ে সে তার মায়ের পায়ের ফাঁকে ফাঁকে হেঁটে-চলে বেড়ায়। এখনো অতটা বড় হয়নি কিনা, তাই মা-কে জিজ্ঞেস না করে এদিক-সেদিক যাওয়া বারণ। হ্যাঁ, জঙ্গলের চেনা রাস্তায় যেতে মানা নেই, সেখানকার জীবজন্তুরা সবাই মিশকুনকে চেনে, দেখতে পেলে আগলে রাখবে, কিন্তু অচেনা রাস্তায় যাওয়া বারণ। তবে মিশকুন তো লক্ষ্মীছানা, তাই সে মায়ের কথার অবাধ্য হয় না। 

একদিন সকালবেলায়, মায়ের সঙ্গে মিশকুন নদীতে নামলো চান করতে। শুধু কি চান, চানের আগে বালিতে গা ঘষা, নদীতে নেমে মায়ের দেখাদেখি শুঁড়ে করে জল নিয়ে ফোয়ারার মতো করেচারপাশে জল ছড়ানো, জলে গা ডুবিয়ে চুপটি করে বসে বসে ঢেউয়ের দোল খাওয়া, চানের সময় এমন কত্ত খেলা করা যায়! সেসময় মা-ও ভারি খুশি থাকেন, তাই বকুনি খাওয়ার ভয়ও মিশকুনের থাকে না। 

তা, নদীতে হুটোপাটি করে চানপর্ব চলছে। মিশকুন, মা, আর বাবা তো আছেনই, আরও কত মামা-মাসি-কাকু-পিসি-রা আর তাদের ছানাপোনারা রয়েছে। মিশকুনের চান হয়ে গেছে, ওর আর জলে থাকতে ইচ্ছে করছিলো না, মাকে জিজ্ঞেস করলো, 

“মা, মা, চান তো অনেক হলো, এবার ডাঙ্গায় উঠি?”

মা বললেন, “আচ্ছা, উঠে পড়, কিন্তু এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াবি না”।

সে “ঠিক আছে মা” বলে গুটিগুটি পায়ে জল থেকে উঠে এলো।পাড়ে এসে কিছুক্ষণ রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে গা-মাথা শুকিয়ে, জল ঝেড়ে ফেলে হাঁটা লাগালো জঙ্গলের পথে। মায়েরা তখনও জলের ফোয়ারা নিয়ে খেলা করছে। 

জঙ্গলের এই রাস্তা মিশকুনের চেনা, তাই এখানে আসতে মোটেই বারণ নেই। সে দিব্যি হেলেদুলে এ-গাছ, ও-গাছ দেখতে দেখতে এগিয়ে চললো। বুনো গাছ আর ফলফুলুরির গন্ধ তার খুব ভালো লাগে। 

একটা উঁচু গাছের দিকে চোখ পড়তেই সে দেখলো, ও মা, বাবুইদিদি ঠোঁটে করে দুটো খড়কুটো নিয়ে কি যেন সাজাচ্ছে। ভালো করে নজর করতেই দ্যাখে, কেমন সুন্দর উল্টোনো কুঁজোর মতো দেখতে একটা জিনিস গাছের পাতার আড়ালে ঝুলছে, আর বাবুইদিদি ঠোঁটে করে খড়কুটো নিয়ে সেটার ভেতর একবার ঢুকছে, একবার বেরোচ্ছে। মিশকুন ভারি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,

“বাবুইদিদি বাবুইদিদি, করছো তুমি কী?”

বাবুই হেসে বললো,

“এই দ্যাখো না কেমন মজার বাসা বেঁধেছি!”

মিশকুন ভাবে এ তো আজব কাণ্ড। ঠোঁটে করে কুটো বয়ে এনে গাছের ডালে কেমন বাসা বেঁধেছে দ্যাখো! আচ্ছা, মিশকুন পারবে অমনটা, যদি চেষ্টা করে? মা-কে জিজ্ঞেস করতে হবে, ভাবতে ভাবতে মিশকুন এগিয়ে চলে। 

একটু দূরে গিয়ে একটা কাঠবাদাম গাছের দিকে নজর পড়লো। একটা কাঠবেড়ালি গাছের ডালে বসে দু’হাতে করে কি যেন ধ’রে আছে, আর মাঝেমাঝে সেটায় কুটকুট করে কামড় বসাচ্ছে। তার ঝাঁকড়া লেজটা মাঝেমাঝে তিরতির করে কেঁপে উঠছে। 

মিশকুন তাকে শুধোলো, 

“কাঠবেড়ালি কাঠবেড়ালি খাচ্ছো তুমি কী?”

কাঠবেড়ালি ‘কিচ-কিচ’ করে বলল, 

“এই দ্যাখো না আমি কেমন বাদাম চিবোচ্ছি!”

মিশকুন ভাবলো, বাঃ, বেড়ে মজা তো! গাছের ডালে বসে তারিয়ে তারিয়ে কেমন বাদাম খাচ্ছে দ্যাখো! কই, তার মা-মাসিরা তো কক্ষনও অমন গাছে উঠে খাওয়া-দাওয়া সারে না? আজকেই মা’কে বলতে হবে, মিশকুনও এবার থেকে গাছের ডালে বসেই জলখাবার খাবে।

এই কথা মনে ক’রে বেজায় খুশি হয়ে সে এগিয়ে চললো। একটু পরেই দেখতে পেলো একটা গাছের ডালে হাত-পা এলিয়ে দিয়ে বাঁদরদাদা দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুম দিচ্ছে। মিশকুন শুঁড় উঁচিয়ে হাঁক দিলো,

“বাঁদরদাদা বাঁদরদাদা করছো তুমি কী?”

অমনি ধড়মড়িয়ে ঘুম ভেঙ্গে লজ্জায় একহাত জিভ কেটে বাঁদরদাদা বলল, 

“এঃ! দ্যাখো দেখি কেমন ঘুমিয়ে পড়েছি!”

মিশকুনের মনটা ভারি খারাপ হয়ে গেল। বাবুইদিদি, কাঠবেড়ালি, বাঁদরদাদা—এরা সব কেমন গাছে বাসা বেঁধে থাকে, গাছেই ঘুমোয়, খাওয়া-দাওয়া সেখানে বসেই সারে! মিশকুনও যদি ওদের মতো তরতরিয়ে গাছ বাইতে পারতো! ওরাযে কেন শুধু মাটিতেই হাঁটাচলা করে, সে বোঝে না। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে সে ধীর পায়ে নদীর ধারে মায়ের কাছে ফিরে আসে। মা কত খুঁজে খুঁজে জিভে জল আনা লতাপাতা জোগাড় করেছেন মিশকুন খেতে ভালবাসে ব’লে, কিন্তু খেতে বসে সে এক গ্রাসও মুখে তুলতে পারে না। গায়ে-মাথায় শুঁড় বুলিয়ে মা জিজ্ঞেস করতেই তার চোখ দিয়ে জল ঝ’রে পড়ে টুপটুপ।

“কি হয়েছে মিশকুনসোনা? মা’কে বলো বাবু। মা শুনলে তোমার সব কষ্ট মুছিয়ে দেবে।একবার বল্‌ সোনা কাঁদছিস কেন?”

মায়ের কাকুতি-মিনতিতে মিশকুন আর পারলো না, ফোঁপাতে ফোঁপাতে সব বলে ফেললো। 

মা বুঝলেন গাছে উঠতে পারে না ব’লে তার ছানার মন বেজায় খারাপ হয়ে রয়েছে। তিনি তখন মিশকুনকে বললেন,

“খেয়ে নিয়ে জঙ্গলে ঢোক্‌ আবার, বাবুই, কাঠবেড়ালি আর বাঁদরকে বলে আয় আজ বিকেলে আমাদের বাড়িতে ওদের সবার নেমন্তন্ন। যে যার বাবা-মায়ের হাত ধ’রে যেন তাড়াতাড়ি চলে আসে”।

মিশকুন তো আহ্লাদে আটখানা। তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে জঙ্গলে ঢুকে নেমন্তন্ন-পর্ব চুকিয়ে এলো।

বিকেল একটু গড়াতে মা-বাবার হাত ধ’রে অতিথি-রা সবাই এসে হাজির। মিশকুনরা তো খশিতে ডগমগ একেবারে। 

মিশকুনের মা সবাইকে বললেন, 

“চলো বন্ধুরা আর ছানাপোনা-রা, আমরা নদীর ধারে গিয়ে বসি। ঠাণ্ডা হাওয়ায় প্রাণ জুড়োবে, আর নদীর জলে আমরা বেশ নিজেদের ছায়া দেখতে দেখতে গল্প-সল্প করব। 

বাবুই-বাঁদরদের মায়েরাও সমস্বরে বলে উঠলেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, সে-ই ভালো, চলো চলো”।

দল বেঁধে নদীর পাড়ে গিয়ে বসা হলো। ব’সে এ-গল্প, সে-গল্প, দু’চারটে গানের কলি গেয়ে ওঠা, এইসব চলছিল, এমন সময় মিশকুনের চোখ পড়ল নদীর জলে। সেখানে দেখা যাচ্ছে মিশকুন, বাবুইদিদি, কাঠবেড়ালি আর বাঁদরদাদার আয়না-ছবি, শক্ত কথায় যাকে বলে প্রতিবিম্ব। 

চারজনে মিলে খেলাধুলো হয় মাঝেমাঝে, কিন্তু এমন করে আয়নার সামনে বসে এ-ওকে তো দেখা হয়নি কখনও, তাই মিশকুন অবাক হয়ে জলের দিকে তাকিয়ে থাকে। দ্যাখে কি, তার মাথাটা ইয়াব্বড়, তাতে আবার দুলছে একখানা লম্বা শুঁড়, শুঁড় আর মুখের মাঝে বেরিয়ে আছে দুটো কচি সাদা দাঁত। তারপরে দ্যাখো, মস্ত বড় পিঠ, তাতে বাবুই-কাঠাবেড়ালির বাড়ির সব্বাই বেশ আরাম ক’রে বসতে পারবে, ওদের বইতে তার কষ্টও হবে না বিশেষ। মিশকুনের পিঠের নিচে আবার আছে গাছের গুঁড়ির মতো চারটে পা, সব মিলিয়ে চেহারাখানাকে দশাসই বলাই যায়। সেখানে বাবুইদিদির চেহারাটা দ্যাখো! মিশকুন মন দিয়ে জল-আয়নাটা দেখতে থাকে। 

বাবুইদিদির ছোট্ট মাথা, ছোট্ট ঠোঁট, এইটুকুনি পেট, আর তার নিচে কাঠির মতো সরু সরু দু’খানি পা। দুটো ডানা আছে বটে তার, যেটা মিশকুন, কাঠবেড়ালি বা বাঁদরদাদা --- কারোরই নেই, তবে সে ডানাদুটোও বড্ড ছোট। সব মিলিয়ে বাবুইদিদি এতটাই হাল্কা, সে যদি মিশকুনের পিঠে উঠে বসে, তবে ও টেরও পাবে না। অমন হাল্কা চেহারা ব’লেই কি বাবুইদিদি গাছের ডালে ঝুলে ঝুলে বাসা বানাতে পারে?

“আমি হলে তো এতবড় চেহারা নিয়ে গাছের ঐ পলকা ডালে উঠতেই পারতাম না”, মনে মনে ভাবতে ভাবতে মিশকুন কখন যেন মুখ ফুটে কথাটা ব’লে ফেলেছে। 

“ঠিক বলেছ মিশকুনভাই”, বাঁদরদাদা যে পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে, বুঝতেই পারেনি সে।

“তোমার মনে বুঝি দুঃখ হয়েছে তুমি গাছে চড়তে পারো না ব’লে?”দাদার প্রশ্নের উত্তরে ঘাড় নাড়ে মিশকুন।

“একটা কথা বলো, তুমি যেমন নদীতে নেমে শুঁড়ে ক’রে জল নিয়ে ফোয়ারা-ফোয়ারা খেলতে পারো, অমনটা কি আমরা পারি? আমাদেরও মনে হয় একটা শুঁড় থাকলে কত্তো মজা হতো, কিন্তু কি আর করা যাবে!” কাঠবেড়ালির মনটাও ভারী হয়ে আসে শুঁড় না থাকার দুঃখে।

“আহাহা, তুমি কেমন কিচ্‌-কিচ্‌ করে এডাল-ওডাল ঘুরে ফলপাকুড় পেড়ে নিয়ে খেতে পারো সেটা বলো! হাতিরা তো তা পারে না। আবার বড় বড় পাথর, গাছের গুঁড়ি পায়ের এক ঠেলায় গড়গড়িয়ে নদীতে নামিয়ে দিতে পারে মিশকুন, তুমি-আমি কেউ অমন পারবোই না”।

“তাহলে? কি বোঝা গেল বন্ধুরা? মিশকুন পারে না, এমন অনেক কাজ তুমি বা আমি বা বাবুই খুব ভালোভাবে করতে পারি, আবার ও যেসব কাজে তুখোড়, সেগুলোর বেশিরভাগই আমরা করতে পারি না, তাই না?”

গা-ভর্তি বাদামী লোম, লম্বা ল্যাজ আর চারটে পা সামলে ভারি তড়বড়ে বক্তৃতা দিলো বাঁদরদাদা।

ওদিকে মিশকুন তখন মন দিয়ে কাঠবেড়ালির লেজ নিরীক্ষণ করছে। আহা,কেমন ঝাঁকড়া বাহারি লেজখানা! তারপরে দ্যাখো গায়ে কেমন ডোরাকাটা দাগও আছে। সেই এক বাঘমামা ছাড়া আর কারও গায়ে এমনটা দেখাই যায় না। ইস্‌, তার যদি এমনটা থাকত! এটা ভেবেই মনে মনে জিভ কাটে মিশকুন। নাহ্‌, আর সে এসব ভাববে না। তারও তো লম্বা শুঁড় আছে, দুধ-সাদা দাঁত আছে, তবে? আসলে তারা সবাই সুন্দর, একেকজনের রূপ একেকরকম। তারা সবাই কত্ত রকমারি কাজ করতে পারে। খামোখা “আমার লেজ ঝাঁকড়া নয়”, “ও কেমন ডালে ডালে লাফিয়ে বেড়ায়”, এসব ভেবে মন খারাপ করা কেন বাপু? তার চেয়ে বরং বাবুইদিদিদের সঙ্গে একটা শলা করা যাক। এই না ভেবে মিশকুন তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের নিয়ে বৈঠকে বসলো। 

কি কথাবার্তা হলো সে তো জানা গেল না, তবে খানিকক্ষণ পরে ওরা চারমূর্তিতে বেড়াতে বেরোলো। বাবা-মায়েরা দূর থেকে দেখলেন, মিশকুন দুলকি চালে হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গলে ঢুকছে, তার পিঠে বসে আছে বাবুই, কাঠবেড়ালি আর বাঁদর। উঁচু কোনও গাছের মগডালে ফলপাকুড় ঝুলছে দেখলেই মিশকুন শুঁড় বাড়িয়ে সেগুলো পেড়ে আনছে, সে যেখানে নাগাল পাচ্ছে না, বাঁদর ‘হুপ হুপ’ ব’লে লাফ দিয়ে সেসব ডালে উঠে ফল পেড়ে আনছে, আর চারমূর্তিতে মিলে চলছে মহানন্দে মহাভোজ।।