কৈশোরনামা - কর্ণ শীল
Posted in কৈশোরনামা
কৈশোরনামা
স্যমন্তক আর তুষারকন্যা
কর্ণ শীল
(এক)
এ দেশে বোধহয় ফুলগাছ নেই। কিন্তু সাদা বরফের স্তম্ভে, সাদা বরফের ফুল ফুটে আছে। এ দেশে বোধহয় পাখিও নেই। তবুও ঝকঝকে আকাশে ভেসে বেড়ানো তুষারকণা থেকে সুরের লহরী ভেসে আসে মাঝে মাঝে হাওয়ার অদৃশ্য কোটর পার হয়ে। বরফের আদিগন্ত প্রান্তরের এখানে ওখানে হঠাৎই জেগে ওঠে সুগন্ধি ফোয়ারা। কোনওটিতে চন্দনের গন্ধ, আবার কেউ কেউ পদ্মগন্ধা।
বরফের বিরাট প্রাসাদের চূড়ায় দুপুরের উজ্জ্বল সূর্য বর্শা গেঁথে রেখেছেন যেন। ধোঁয়ার মতো জলীয় বাষ্প প্রাসাদের গা বেয়ে উঠে জানালায় জানালায় ছড়িয়ে যায়। কোনও ঘরে শিকলবাঁধা বিরাট পাথুরে দৈত্য রামছাগলের ঠ্যাং চিবুতে চিবুতে সাদা চোখে সূর্যের দিকে তাকায়। কোনও ঘুলঘুলি দিয়ে দেখা যায় শূন্যে ডানা মেলে ভেসে আছে ডানাওয়ালা সাদা ঘোড়া। নাকের ওপর একটি শিং। লেজটিও তার সাদা।
সরু পাথরের সিঁড়ি অন্ধকার অন্ধকার। ঘুরে ঘুরে নেমে গেছে নীচে। অনেক নীচে নেমে একটি বিরাট বইয়ের আলমারির দরজা খুলে বেরিয়ে আসতে হবে এক বিরাট অলিন্দে। তার পাশে সারি সারি ঘর। দুধসাদা দেয়াল। সাদা মখমলি পর্দা।
পাহাড়ি হাওয়া সোঁ সোঁ করে ছুটে এসে পর্দা সরিয়ে দিল। ঘরের ভেতরে সাদা স্ফটিককূড্য থেকে গলগল করে ধোঁয়া বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে পড়ছে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা নারী পুরুষমূর্তির সাদা পোশাকের ভাঁজে ভাঁজে। সাদা গোলাকার বিছানা। পুরু সাদা চাদরে পেঁজা মেঘের মতো জাদুঘুমের ধোঁয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ধোঁয়ার চাদরের ফাঁক দিয়ে হঠাৎ দেখা গেল পারস্যের তলোয়ারের মতো একটি পা। স্পন্দনহীন। রক্তশূন্য। পায়ের বুড়ো আঙুলটিতে একটি লাল পাথরের আঙটি।
সমগ্র সাদা বর্ণহীন দেশে ওই একটি রঙের বিন্দু!
স্যমন্তককুমারের বুকটা ধক করে উঠলো। চোখ খুলে গেল। বুঝলো, এ তো স্বপ্নমাত্র। পূর্বে লাল আকাশ। একলা কোকিল আমডালে গান গাইছে। মন্দিরে প্রভাতবন্দনার সুর।
এমন সময় পরিচারিকা ছুটে এলো। এক নিশ্বাসে বললো "যুবরাজ তাড়াতাড়ি চলুন ...রাণীমার শরীর খুব খারাপ।"
(দুই)
মহারাণীর ঘরে চিন্তান্বিত বৈদ্যরাজ। ভ্রু কুঞ্চিত মহারাজের। রাজজ্যোতিষী মাথা নেড়ে বললেন, "এ বড় অপার্থিব লক্ষণ। শুভ না অশুভ ধরা যাচ্ছেনা।"
স্যমন্তক দেখলো মায়ের ডানপায়ের ফরসা বুড়ো আঙুলে একটি একটি লাল রঙের জড়ুল দেখা দিয়েছে।
ও তো আগে ছিলনা কোনওদিন!
রাজবৈদ্য কইলেন এমন অদ্ভুত ব্যধির কথা শোনেননি কোনওদিন। মায়ের ডানপা টি অসাড় হয়ে গেছে। নাড়তে গেলে গলার শিরাগুলো ফুলে উঠছে শুধু।
মায়ের দিকে তাকালো স্যমন্তক।মায়ের বাঁ চোখ দিয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে স্যমন্তকের হাতে পড়লো। সে সজলনয়নে রাজজ্যোতিষীকে জিজ্ঞাসা করলো, "ঠাকুর, আমার মা ভালো হবেনা? তোমার কড়ি, গ্রহ, তারা কি বলে?"
-সে বড় অদ্ভুত উত্তর যুবরাজ। অর্থ খুঁজে পেলুম না।
-কি সে উত্তর, বল আমায়। দেবাদিদেবকে ধরে আনতে হলে আনবো প্রয়োজন হলে আমার মায়ের জন্য।
-আমার কথাবলা কড়ি কি বললো শোনো,
"অনেক উঁচু অনেক কাছে
নিজের মাঝেই সে জন আছে,
ডাক পাঠালে বুঝবে নিজে
চারপায়ে আর ডানার ভাঁজে"
স্যমন্তক সবার মুখের দিকে চাইলো, সবাই নির্বিকার। এর অর্থ, তাঁরা আগেই শুনেছেন এ নিদানের কথা।
সে মাথায় হাত দিয়ে শ্বেতপাথরের মেঝের ওপর বসে পড়লো।
(তিন)
শিকারে গিয়ে স্যমন্তকের মন লাগেনা। মন লাগেনা বুনো রুপোলি শেয়ালের পিছু নিতে। মন্ত্রীপুত্র আর কোটালপুত্র পাঁশুটে নেকড়ে মেরে তার চামড়া দিয়ে শীতের আলখাল্লার গলাবন্ধ বানিয়ে নিয়েছে। শ্রেষ্ঠীর দস্যিমেয়েটা আবার পাহাড়ি শকুনের বাসায় হানা দিয়ে নিয়ে এসেছে উড়ুক্কু সবুজ খরগোসের হাড়। তাই দিয়ে বানিয়েছে এক আশ্চর্য বাঁশি। জ্যোৎস্নায় চুল এলিয়ে বসে সে বাঁশি বাজায় তার চন্দ্রশালায়।
স্যমন্তক বসে থাকে সারাদিন ছবিঘরে। তুলি দিয়ে লালরঙের একটি ফোঁটা দেয় মাঝে মাঝে সাদা তুলোট কাগজে। আর মায়ের কথা খুব মনে পড়ে।
এটা ওটা ভাবতে ভাবতে ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়ায় সারারাতের ক্লান্তি জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল স্যমন্তক। কাঁধের সাদা বার্তাবহ পায়রাটি হঠাৎই উড়ে গেল রানীমায়ের ঘরের দিকে।
মাহেন্দ্রক্ষণে আবার সেই স্বপ্নটা চোখ ভরে এলো।সেই সাদার দেশ। সাদা থামগুলোতে একদম আলতো, হালকা লালের রেশ লেগেছে মনে হচ্ছে। খুব খুঁটিয়ে না দেখলে নজরে পড়ে না।
পাথুরে দৈত্যের চিবুনো রামছাগলের ঠ্যাঙটাও যেন একটু রক্তমাখা।পক্ষীরাজ ঘোড়াটা ডানা ঝাপটে একগাদা গোলাপ পাপড়ি ছিটিয়ে দিল হালকা গোলাপি রঙের। রাজহাঁসের পায়ের মতো রঙের পর্দা আজ। আর ভোরের সাদালাল মেঘের মতো ধোঁয়া ।
আর আজ ওই ধোঁয়ার ফাঁকে দেখা গেল একটি কাঞ্চনফুলের পাপড়ির ভেতরের দিকের রঙের মরালগ্রীব মানবী কন্ঠ।
স্যমন্তক বুঝলো আজ তার মায়ের গলার স্বরটি হারিয়ে যাবে চিরদিনের মতো। সে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরলো সুন্দর গলাটি আর একরাশ অন্ধকারের মধ্যে পড়ে গেল।
(চার)
কতক্ষণ অন্ধকারের মধ্যে স্যমন্তক পড়েছিল মনে নেই তার। উঠতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেল। হাঁটতে গিয়ে পারলো না। অনেক চেষ্টা করার পর হাল ছেড়ে দিয়ে হামাগুড়ি দিতে লাগলো। তাও হাঁটু আর হাতের তালু সড়াৎ সড়াৎ করে হড়কে যেতে লাগলো।
সূর্য উঠলো দশদিক জুড়ে। স্যমন্তক দেখলো এ দেশে কাচের। কাচের গাছে কাচের ফল। কাচের পাতা। কাচের ফুলের পাপড়ি তে বসে আছে ফিনফিনে কাচের ডানা মেলে কাচের প্রজাপতি। নীল আকাশ আর স্যমন্তকের ছায়া পড়েছে আদিগন্ত কাচের প্রান্তরে।
সূ্র্যের রশ্মি প্রতিফলিত হয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল স্যমন্তকের। ধীরে ধীরে তার দু চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো আর ঝলসে যেতে লাগলো গায়ের চামড়া।কাচের পাখির ডানার ঝটপটানির ঝনঝন শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়।
-ও খোকা, চোখে ব্যথা পেলে নাকি?
খুনখুনে হাসি শুনে স্যমন্তক সামনে হাত বাড়িয়ে দিল। একটা শক্ত অস্থিসার হাত তার হাতটা ধরলো। আকাশে উড়ে গেল তারা। আর সঙ্গে সঙ্গে কানের পাশ দিয়ে সাঁই সাঁই করে বয়ে যেতে লাগলো ঊনপঞ্চাশ বায়ু।একটা চিল স্যমন্তকের তলোয়ারের খোঁচা খেয়ে একটা চ্যাঁ করে চেঁচিয়ে উঠলো। একসময় মাটিতে নেমে থিতু হলো তারা।
কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়ায় বরফকুচি ছুরির মতো ছুটে এসে তার চামড়ায় গেঁথে গেল যেন। স্যমন্তক বুঝলো এ দেশ অনেক ওপরের।
ওর পাশেই এক আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ো। তার পা দুটো তার হরিণের। মুখটা সিংহের। হাতদুটোর জায়গায় দুটো বটগাছের সরু ডাল। চোখের জায়গায় দুটো নীল মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে। মুচকি মুচকি হেসে স্যমন্তক কে সে বললো, "আর কেন হে দেরি? /যাও না তাড়াতাড়ি /পাহাড়পুরের তুষার ঘরে /নিদান বসত করে।"
স্যমন্তক হাঁ করে চেয়ে আছে দেখে বুড়ো কেশর নেড়ে নেড়ে খিলখিলিয়ে হাসতে লাগলো। স্যমন্তকের হাতে দুটি কড়ি দিয়ে সে বললো সুর করে করে,
"অনেক উঁচু অনেক কাছে
নিজের মাঝেই সে জন আছে,
ডাক পাঠালে বুঝবে নিজে
চারপায়ে আর ডানার ভাঁজে"
তখনি সোঁ করে আকাশের বরফঝরা দৃশ্যপট চিরে মন্মথ উপত্যকায় নেমে এলো এক পক্ষীরাজ ঘোড়া। নাকের শিংটি ঝলমল করে উঠলো সন্ধ্যাবেলার স্বর্ণপ্রদীপের আলোর ছোঁয়ায় মায়ের নাকছাবির মতো।
স্যমন্তক বুঝলো এ পক্ষীরাজ সেই তুষারপুরীর দূত। ঝটপট ঘোড়ার পিঠে উঠতেই সে দেখলো সেই বুড়ো একটা কালো মাথা সাদা গায়ের ঈগল হয়ে সাঁ করে মেঘের ভেতরে উড়ে গেল।
তার ডানার হাওয়া পক্ষীরাজের ডানায় এসে লাগতেই সেও কদমচালে ছুটে গিয়ে বাতাসে ঝাঁপ দিল। ডানার প্রবল আন্দোলনে রুপালি পাহাড়ের চুড়া, বরফঢাকা সরলবর্গীয় ত্রিকোণ গাছের বনের মাথা ছাড়িয়ে পক্ষীরাজ উড়ে চললো পাহাড়পুরের তুষারপ্রাসাদের পথে।
(পাঁচ)
পাথরের ঘরের সামনেটায় গুঁড়ো গুঁড়ো বরফ জমে জমে স্তূপীকৃত হয়ে আছে। নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে পাথুরে দৈত্যটা। তার বরফের শিকলটা আস্তে আস্তে গলে যাচ্ছে। তার সামনে স্থির হয়ে গেল স্যমন্তক।
ন যযৌ ...ন তস্থৌ...
নাকের ভেতর থেকে একটা শব্দ করলো ঘোড়াটা। যেন বললো, "স্যমন্তক, তাড়াতাড়ি করো!"
পাথরের সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে স্যমন্তক দেখলো অসংখ্য পাতা পড়ে আছে ছড়িয়ে। তাদের অর্ধেক বরফ আর অর্ধেক সবুজ।
তার বুকের মধ্যে কেমন একটা ব্যথা খামচে ধরলো।
সিঁড়ি শেষ হয়েছে নীচু ছাদপর্যন্ত একটা পাথরের দরজার সামনে। ঠেলতেই খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে স্যমন্তক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল।
এ তো তাদের প্রাসাদের গ্রন্থাগারের "অপরূপগাথা "বিভাগের দরজা! শুধু উলটো দিক থেকে খুলে সে ভেতরে এসেছে।
এ যে তাদেরই প্রাসাদ!
শুধু অন্যরূপ। অনন্যরূপে তার সামনে অপরূপকথার ধাঁচে অন্য তল থেকে ধরা দিয়েছে। তার মায়ের হাজার গল্পের জাদুরা সত্যি রূপ নিয়ে তার জীবনে এসেছে। আর ধীরে ধীরে তার মায়ের জীবনীশক্তি নিয়ে নিয়ে মূর্ত হয়ে উঠছে।
একটা দরজার সামনে থেকে গোলাপী সাদা ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে। এক অমোঘ আকর্ষণে সেদিকে ছুটে গেল স্যমন্তক।
এমন সময় প্রাসাদের ওপরের অংশ থেকে ভেসে এলো ভয়ানক গর্জন আর ধাতব শেকল ছেঁড়ার প্রচণ্ড শব্দ।
পাথুরে দানবের ঘুম ভেঙেছে।
স্যমন্তককুমার একছুটে সেই মায়াময় ঘরে ঢুকলো। আজ ঘরের ধোঁয়ার আস্তরণ তার স্বপ্নদৃষ্ট ধোঁয়ার চেয়ে অনেক পাতলা।
দেখা যাচ্ছে ধোঁয়ার নীচে এক অনিন্দ্যসুন্দর নারীমূর্তি। সুপ্ত।নিরাবরণ। দেহের শুধুমাত্র ঠোঁটদুটি তুষারকঠিন।বাকি দেহজুড়ে সে কি অপরূপ লাবণ্য!
নবনীতকোমল চামড়ায় কে যেন আনারদানার রস দিয়ে নক্সা এঁকেছে।
এত সুন্দর দৃশ্যে কিন্তু স্যমন্তকের বুক হিম হয়ে এলো। সে উপলব্ধি করতে পারলো তার মায়ের বর্তমান পরিস্থিতি। এবং এও বুঝলো মেয়েটির ঠোঁটদুটি যদি রক্তমাংসের হয়ে যায়, সে চিরকালের মতো তার মাকে হারাবে।
প্রচণ্ড শব্দ করে অলিন্দে নেমে এসেছে ভয়ানক পাথুরে দৈত্য। কেঁপে কেঁপে উঠছে ঘর, জানালা, মেঝে, নারীমূর্তি। বিরাট এক লাফে শুভ্রফেননিভ বিছানায় পড়ে মেয়েটির ঠোঁটে নিজের ঠোঁট মিশিয়ে দিল স্যমন্তক।
মেয়েটি চোখ মেলে চাইল!
পাথুরে দানবের দেহ মুহূর্তে টুকরো টুকরো হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেল গ্রীষ্মরাতের দুঃস্বপ্নের মতো।
চোখের সামনে হাসতে হাসতে জেগে উঠলো সব তুষারমূর্তির দল।
বরফের ফুলে প্রজাপতি এসে বসলো আর তারা রঙীন পাপড়ি মেলে উপত্যকায় বিছিয়ে গেল। প্রাসাদচূড়ার বরফ গলে সোনা ঝিকিয়ে উঠলো।
ঈগলসাজা বদ্যিবুড়োর পিঠে চড়ে মা এলো তুষারপুরে। তুষারকন্যার চিবুক তুলে মুখ আর সলজ্জ হাসি দেখে খুব খুশি হলো আর স্যমন্তকের কানটি দিল মুলে।
মিষ্টি হেসে মা বললো, "আজ থেকে রূপকথা বন্ধ।"
তারপর সবাই আবার "অপরূপকথা" আলমারির দরজা খুলে ফিরে এল স্যমন্তকের আপন বাড়ি। তুষারমেয়ে রইলো মায়ের কাছে।
সে এখন চুল বাঁধা আর ডালের বড়ি দেওয়া শেখে
0 comments: