প্রবন্ধ - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
রামায়ণের মহিলা কবি—সুবর্ণনলিনী দেবী
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
ইদং পবিত্রং পাপঘ্নং পুণ্যং বেদেশ্চ সম্মিতম্।
যঃ পঠেন রামচরিতং সর্বপাপৈঃ প্রমুচ্যতে।।
অর্থাৎ এই পবিত্র পাপনাশক পুণ্যজনক বেদতুল্য রামচরিত যে পাঠ করে, সে সর্ব পাপ থেকে মুক্ত হয়।
বাল্মীকি রামায়ণের সূচনায় রামায়ণ সম্বন্ধে এই উপদেশ ও বাণী আপামর ভারতবাসীর সকল কর্মে ও ধর্মে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
বিশাল এই দেশ ভারতবর্ষ। তার আনাচে কানাচে পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য গল্পগাথা, শৌর্য-বীর্যের ইতিহাস, নানা কাহিনী, যার অনেকটাই ঘিরে আছে রামায়ণ ও মহাভারত এই দুই মহাকাব্য। মহাভারত যুদ্ধের কাহিনী। কপটতা, দণ্ডনীতি, রাজনীতির নিপুণখেলা দেখি সমগ্র মহাভারতের কাহিনী জুড়ে। অপরদিকে, রামায়ণ হলো ঘরের মেয়ের দুঃখগাথা। রাজনীতি, কপটতা এখানেও যে নেই তা নয়। কিন্তু সব ছাপিয়ে প্রধান হয়ে উঠেছে ঘরের মেয়ে সীতার দুঃখগাথা। জনমদুখিনী সীতার দুঃখে, অপমানে, যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয় আপামর ভারতবাসী। রামায়ণের অনুপ্রেরণায় রামের সুশাসনের আশায় বুক বাঁধে মানুষ। ভাই এর সৌহার্দ্য, পিতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য, প্রজার প্রতি রাজার স্নেহ, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর অনুরাগ, ভক্তি এসব দেখে বিগলিত হয় সাধারণ মানুষের মন। প্রেম, প্রীতি, ভক্তি ও শ্রদ্ধার আদর্শ রূপায়ণ হলো রামায়ণ। রামায়ণ তাই এত প্রিয় সকলের কাছে।
দেশে ও বিদেশে নানান ভাষায় অনূদিত হয়েছে রামায়ণ। হয়েছে নানান টীকা, বিশ্লেষণ। দেশের প্রায় সমস্ত অঞ্চলের আঞ্চলিক কবিরা রচনা করেছেন রামায়ণ নতুন করে, নতুন দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে, আবার কেউ কেউ আঞ্চলিক ভাষায় অনুবাদ করেছেন বাল্মীকির সমগ্র রামায়ণ। এই সব আঞ্চলিক ভাষায় অনূদিত এবং রচিত রামায়ণের সংখ্যা প্রায় তিনশোরও বেশী।
আশ্চর্য্যের বিষয় রামায়ণের টীকাকার বা রামায়ণ রচয়িতা হিসাবে পুরুষ কবিদের নাম যেভাবে জানা যায়, মহিলা কবি প্রায় নেই বললেই চলে। বিংশ শতাব্দীর একেবারেই গোড়ার দিকে প্রথম জানা যায় রামায়ণের মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর কথা। ইনিই রামায়ণের প্রথম মহিলা কবি। এই মহিলা কবির নাম সর্বসমক্ষে প্রচারের কৃতিত্ব চন্দ্রকুমার দে মহাশয়ের। ইনি ছিলেন ‘মৈমনসিংহ গীতিকারের’ সংগ্রাহক। বাংলা ১৩২০ (ইংরাজি ১৯১৩ খ্রীঃ) সালে চন্দ্রাবতীর রচনা প্রকাশিত হয়। সে সময়ে দীনেশচন্দ্র সেন এই রচনার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং দীনেশচন্দ্র সেন ও চন্দ্রকুমার দে উভয়ের যৌথ প্রচেষ্টায় চন্দ্রাবতীর রচনা প্রকাশিত হয়।
অধুনা সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেনের গবেষণাপত্র থেকে আমরা জানতে পারি আরও দুই মহিলা রামায়ণ রচয়িতার কথা। একজন হলেন মোল্লা কবি, যাঁর রচনা ‘মোল্লা রামায়নম্’ এবং আর একজন হলেন রঙ্গনায়াকাম্ম, যাঁর রচনা হলো ‘রামায়ণয়ম্ বিষবৃক্ষম্’। দুজনেই দক্ষিণের কবি। চন্দ্রাবতী হলেন প্রথম মহিলা রামায়ণ রচনাকার যিনি বাংলা ভাষায় রামায়ণ রচনা করেন। তাঁর জন্ম ১৫৫০। চন্দ্রাবতী ছাড়াও এই বাংলায় রামায়ণ রচনা করেন আরও এক মহিলা কবি, যাঁর নাম প্রায় অজানা। চন্দ্রাবতীর জন্মের প্রায় সোয়া তিনশো বছর পর তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাঁর নাম সুবর্ণনলিনী দেবী (১৮৭৬)। চন্দ্রাবতীর মতো ইনিও প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে যান। লক্ষণীয়, মহিলা কবিদের রামায়ণ রচনার পিছনে বেশিরভাগ সময়েই রয়েছে মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি এবং সমাজের কটুক্তি, অবহেলা, দুঃখ থেকে উত্তরণের পথ হিসাবে কলমকে বেছে নেওয়া। চন্দ্রাবতীর মতো ইনিও জীবনের দুঃখ, কষ্টের পরিত্রাণ হিসাবে কাব্য রচনা এবং রামায়ণ রচনাকেই বেছে নেন। যেখানে সেকালে ‘গৃহিণীরূপে বিরাজ করাই হিন্দু রমণীগণের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য’, ‘পরিবার পরিচালনোপযোগী যাবতীয় শক্তি নিচয়ের যথাযথ অনুশীলনই স্ত্রী শিক্ষার সার্থকতা’ ছিল মহিলাদের জীবনের একমাত্র আরাধনা, সেখানে সংসারের মধ্যে থেকে রামায়ণ রচনার মতো এমন একটি কাজে নিজেকে সমর্পণ করা যে অত্যন্ত দুরূহ কাজ একথা অবশ্যস্বীকার্য। দক্ষিণের মোল্লা রচিত রামায়ণ সেখানকার ব্রাহ্মণ সমাজ রাজসভায় পঠন ও পাঠের জন্য অনুমোদন করেননি। কারণ মোল্লা ছিলেন একজন শূদ্র রমণী। রঙ্গনায়কাম্মা রচিত রামায়ণ সামাজিক ভাবে প্রচন্ড বাধার সম্মুখীণ হয়, কারণ কবি মহাকাব্যটিকে আঘাত করেছেন এমন ধারণা করা হয়েছিল এবং তার জন্য কবিকে অনেক বাধা সহ্য করতে হয়েছিল। চন্দ্রাবতীর রামায়ণ দুর্বল ও অসমাপ্ত রচনা বলে গ্রাহ্য করা হয়নি। অনুরূপভাবে সুবর্ণনলিনী দেবীর রামায়ণও বহুল প্রচলিত নয়, যদিও কারণ জানা যায় না। এই রচনাটিও একরকম প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে যায়, সেও কি মহিলা কবির রচনা বলে? জানতে ইচ্ছে করে সেকথা।
সুবর্ণনলিনী দেবীর জন্ম বাংলা ১২৮২ সনে (ইংরাজি ১৮৭৬) বীরভূমে। সেই অর্থে সুবর্ণনলিনীকে আধুনিক যুগের রামায়ণ রচয়িতা বলা যায়। পিতা আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আদিনিবাস ছিল চন্দননগর, যদিও তিনি চাকুরী সূত্রে ছিলেন বীরভূমে। সুবর্ণনলিনী দেবীর বাল্যকাল ও কৈশোরকাল কাটে বীরভূমে, এরপর তিনি উত্তরপাড়ায় হিতকরী সভার ‘অন্তঃপুর পরীক্ষায়’ সর্বোচ্চ স্থান লাভ করেন ও স্বর্ণ পদক লাভ করেন। এরপরেই তাঁর বিবাহ হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাঁর স্বামীর ও একমাত্র পুত্রের মৃত্যুর আঘাত তাঁর জীবনে নেমে আসে। স্বামীর মৃত্যু, একমাত্র পুত্রের(পনেরো বৎসর বয়সে) মৃত্যু তাঁকে বিচলিত করলেও তিনি সরস্বতীর সাধনাতেই মনোনিবেশ করেন ও বাংলা ভাষাতেই রামায়ণ রচনা করেন। চন্দ্রাবতী, দক্ষিণের মহিলা কবি মোল্লা এবং সুবর্ণনলিনীর মধ্যে মিল এই যে তাঁরা তিনজনেই মাতৃভাষায় রামায়ণ রচনা করেন।
রামায়ণ, মহাভারত, মঙ্গলকাব্য, চৈতন্যচরিতামৃত কিংবা এই ধরণের রচনায় দেখা যায় একই বিষয় নিয়ে অনেক কবির রচনা এবং তার ফলে অনেক কবি ও রচয়িতার নাম আমরা জানতে পারি। আবার এই সব কবিদের অনেকেই স্ব স্ব আরাধ্য দেব-দেবী অথবা কোন দেবতার দ্বারা স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে কাব্য রচনা করেছেন এমন কথাও জানা যায়। সুবর্ণনলিনী দেবীর রচনাতেও ঠিক এই ধরণের বক্তব্য জানা যায়। রামায়ণ রচনার কারণ হিসাবে তিনি স্বপ্নাদেশের কথা নিজেই বলেছেন---
রামনবমী তিথি আছি উপবাসী।
কহিলেন করুণাময় শিহরিয়া বসি।।
কত নিদ্রা যাও মাতঃ উঠ অতঃপর।
কহি রামগুণগাথা যুড়াও অন্তর।।
করিলা আদেশ তুমি নিশি অবসানে।
কথাগ্রে ’ক’ দিয়া গ্রন্থ লিখিবে যতনে।।
লিখ সপ্তকাণ্ড রামায়ণ এইভাবে।
করিব কামনা পূর্ণ জানিবে গো ভবে।।
স্বপন দেখিয়া নিদ্রা হইল ভঞ্জন।
যাইনু ভগিনীর কাছে কহিতে স্বপন।।
সুবর্ণনলিনী দেবীর রামায়ণের বৈশিষ্ট্য হলো, সমগ্র রামায়ণটি রচিত হয়েছে প্রতিটি পংক্তির শুরুতে ‘ক’ অক্ষরটির ব্যবহারে। এ বড় কম কথা নয়! উদাহরণ হিসাবে দেওয়া যেতে পারে...
কাণ্ড তিন গেল পুঁথি রামের মাহাত্ম্য।
কহি আর তিন কাণ্ড রাবণ চরিত্র।।
প্রতিটি পংক্তির শুরু ‘ক’ অক্ষর দিয়ে। তাঁর রামায়ণে আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি সমগ্র রামায়ণটিকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন, প্রথম খণ্ডে রামের মাহাত্ম্য বর্ণন এবং দ্বিতীয় খন্ডে রাবণ চরিত্র বর্ণন। গ্রন্থের উপসংহারে মাত্র দুটি পংক্তি ব্যবহার করেছেন---
কহি সপ্তকাণ্ডর কথা অমৃতের খণ্ড।
করিনু সমাপ্ত প্রভু এ উত্তরাকাণ্ড।।
সুবর্ণনলিনী দেবী সম্বন্ধে যেটুকু তথ্য জানা গেছে সেটি নবপর্যায় বীরভূমি, ভাদ্র ১৩১৮, (প্রায় একশত দুই বৎসর আগেকার) নামক একটি পত্রিকায় তাঁর সবন্ধে আলোচনা প্রসঙ্গে। রচনাটি ‘বীরভূম সাহিত্য পরিষদের’ দ্বিতীয় বর্ষের ৪তুর্থ বার্ষিক অধিবেশনে (২৮শে শ্রাবণ, ১৩১৮) পঠিত হয়। এ সম্বন্ধে আর বিশেষ কিছুই এখনও পর্য্যন্ত জানা যায়নি। চেষ্টা চলছে, চলা উচিৎ।
চন্দ্রাবতী পরবর্তী বাংলা রামায়ণের অন্যতম মহিলা কবি সম্বন্ধে আর কোন তথ্য পাওয়া না গেলে সে লজ্জ্বা আমাদের।
তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন কিশোর কুমার দাস। এই লেখক তাঁর কাছে সবিশেষ কৃতজ্ঞ।
সম্পূর্ণ অজানা।
ReplyDelete