প্রচ্ছদ নিবন্ধ - শিশির রায়
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধ
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
মৃত্যুচিন্তা চমৎকারা
শিশির রায়
রক্তের সম্পর্কের ভিতরে ও বাইরে যে প্রিয়জনেরা, যাঁদের অত্যাগসহন বলে ভাবি, তাঁরা জেনে শিউরে উঠতে পারেন। তবু বলি, আমি প্রায়শই ‘মৃত্যুচিন্তা’ করি। নিজের মৃত্যুকে নিয়ে চিন্তাই ‘মৃত্যুচিন্তা’, এ রকম একটা শব্দার্থ চালু আছে। মানুষ তার পরিবেশ-প্রতিবেশ, মন-মানসিকতা, পক্ষপাত, সংস্কার— নানান কিছুর ছাঁচে ফেলে একটা শব্দের মানে দাঁড় করায়। আমার ক্ষেত্রে ‘মৃত্যুচিন্তা’ শব্দটির ব্যাপকার্থ; আমি নিজের, এমনকি প্রিয়জনদেরও ‘মৃত্যুচিন্তা’ করি। আচ্ছা ঠিক আছে, যাতে আতঙ্ক একটু হলেও কমে, বাকি লেখাটুকু পড়ার দিকে এগোনো যায়, তাই নরম করে বললাম— ‘নিজের ও প্রিয়জনদের মৃত্যু নিয়ে ভাবি’। ‘ভাবি’ মানে এখানে ‘কল্পনা করি’ বুঝতে হবে। মৃত্যুর ক্ষণটির যত না, তারও বেশি মৃত্যু-পরবর্তী সময়ের কল্পনা। যে মুহূর্তটিতে আমার মৃত্যু ‘হচ্ছে’, সেটি তো এক ঘটমান বর্তমান, সেই সময়ে তো আমি আছি। কিন্তু যেই মরে গেলাম, শেষ প্রশ্বাসটি নিলাম বা নিশ্বাসটুকু ছাড়লাম, তখন আমি অতীত (অজর অমর আত্মার প্রসঙ্গে অন্তত এ লেখায় যাচ্ছি না)। যেহেতু তখন প্রাণ নেই, ইন্দ্রিয়গুলো নিষ্ক্রিয়, তাই ধরে নিচ্ছি সে সময় আমার মৃত্যুতে আমার প্রিয়জনদের কী প্রতিক্রিয়া, আমি দেখতে, শুনতে, বুঝতে পারব না। পারব না-ই তো। আর ঠিক সেই কারণেই নিজের ‘মৃত্যুচিন্তা’ করতে— মানে আমি যাঁদের ভালোবাসি, আমার মৃত্যুর পর তাঁদের প্রতিক্রিয়া কল্পনা করতে— আমার খুব লোভ হয়। অমুক কি খুব কাঁদবে? খুউউব? তমুক কি পাথর হয়ে যাবে শোকে? নাকি বাইরে দিব্যি স্বাভাবিক, হয়তো সব ব্যবস্থাপত্র করছে সহজতায়, কিন্তু ভিতরে নদীর পাড় ভাঙছে হাউহাউ করে! আমাকে ঘিরে-থাকা প্রিয়জনদের সেই মুহূর্তের চোখমুখমগজঅন্তরের রেখচিত্রগুলি দেখার তীব্র ইচ্ছা হয় আমার। আমি অবসরে-অনবসরে সেই ‘মৃত্যুচিন্তা’ করি।
একই ভাবনা আসে প্রিয়জনের ক্ষেত্রেও। হয়তো একসঙ্গে হাঁটছি, খাচ্ছি রেস্তরাঁয় তাঁর বা তাঁদের সঙ্গে, দল বেঁধে হাহাহিহি করছি, কথা বলছি বা নিশ্চুপ সঙ্গযাপন চলছে, তখনও এই ভাবনা আসে: আচ্ছা, এই যে এই মানুষটাকে এত ভালোবাসি, ইনি তো বয়সের স্বাভাবিক নিয়মে আর কিছু দিন পরেই থাকবেন না। তখন কী করব আমি? কোনও প্রিয়জনের জীবন এমনই দ্রুতিময়, আশঙ্কা হয়, এই দ্রুতিই দুর্ঘটনা হয়ে জীবনান্তের কারণ হয় যদি? তাঁর নিঃসাড় শবদেহটি দেখে কেমন হবে আমার বুকের ভূগোল? নিজের সেই সময়ের মুখটি দেখতে ইচ্ছে করে আমার। শ্মশান, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াস্থল ছবি তোলার সুস্থান নয়, নয়তো প্রিয়বিয়োগের আবহে একটা ‘ফোটোগ্রাফি প্রোজেক্ট’ ভাবা যেতে পারত। শোকে অন্তত আমাদের মন-মুখ(মণ্ডল) এক থাকে কি না, ধরা কি পড়ত না সেই সব ছবিতে?
আমার জীবনে প্রথম মৃত্যু দেখার অভিজ্ঞতা শৈশবে, যখন ঠাকুমা মারা গেলেন। আজ থেকে দু-আড়াই দশক আগেও বাঙালি মধ্যবিত্ত বাড়িতে দাদু-ঠাকুমারা অপরিহার্য অনস্বীকার্য ছিলেন, মৃত্যুর সঙ্গে পরিবারের শিশুটির প্রথম দেখাসাক্ষাৎ হত সাধারণত এঁদের কারও চলে যাওয়ার সূত্র ধরেই। মনে পড়ে, ঢাকা শহরের সেই একতলা ভাড়াবাড়িটির বাইরের ঘরের খাটেই শয্যাশায়ী ছিলেন তিনি। বাইরের ঘরেই কেন, তা মনে পড়ছে না। কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে ঘরের গন্ধটা। অসুখের গন্ধ। ওষুধের গন্ধ। পক্ষাঘাতে শরীরের একটা দিক অসাড়, মানুষটা শুয়ে থাকেন লংক্লথের উপরে, সেখানেই পেচ্ছাপ। সেই গন্ধ। যখন মৃত্যু এগিয়ে আসছে, আমি বুঝতে পারিনি, কিন্তু বুঝতে পেরেছিলাম, গন্ধটা পাল্টাচ্ছে। রোগ, জরা, ক্লান্তি, প্রতীক্ষা, বার্ধক্যের গন্ধ মিলেমিশে কি মৃত্যুর গন্ধ তৈরি হয়? এক দিন দেখা গেল, বাড়িতে খুব ভিড়। আমার সব কাকা-পিসিরা এসেছে, আরও অনেক চেনা-অচেনা মানুষ। ঠাকুমাকে নিয়ে চলে গেল অনেকে, ডেটল-জলে ধুয়েমুছে এতদিনকার গন্ধটাও কোথায় চলে গেল এক দিন। আমার কোনও শোক হয়নি। শিক্ষা হয়েছিল। দূর থেকে দেখা একটি মৃত্যু আমাকে মৃত্যুর গন্ধ কেমন হয়, চিনিয়ে দিয়েছিল। প্রাচীন কোনও প্রিয়জনের কাছে গেলে, বসলে— এখন অস্বস্তি হয় আমার। ভয় হয়, সেই গন্ধটা ফিরে আসবে না তো, ঠাকুমার ঘরের সেই গন্ধটা!
মিশনের ইস্কুলে পড়ছি, গরমের ছুটিতে হস্টেল থেকে বাড়ি। কোথায় পুরুলিয়া, আর কোথায় ঢাকা! এক দেশ থেকে আর এক দেশ, মাঝখানে কাঁসাই-গঙ্গা-ইছামতী-রূপসা-পদ্মা, কত জল, কত জনপদ! কী কারণে আমরা খুলনা হয়ে ফিরছিলাম, বাবা আর আমি। দূরপাল্লার বাস, উঁচু হাইওয়ে দিয়ে হুহু ছুটছে। আমি জানলার ধারে, বাবা পাশের সিটে, প্যাসেজের দিকে। জানলা দিয়ে দেখছি, হাইওয়েটা ইংরিজি ইউ-অক্ষরের মতো বেঁকে গিয়েছে। আমরা আছি এ-পাশের হাতায়, ও-পাশের হাতাটা দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট। মাঝখানে ঢালু খাদ, নীচে মাঠের মতো, ছাড়া-ছাড়া ঝোপঝাড়। ইউ-এর ঠিক তলাটা দিয়ে যখন বাঁক নিচ্ছে বাস, কী একটা হয়ে গেল। কয়েকটা সেকেন্ড মাত্র, অন্ধকার, আলো-আঁধারি। তার পর, চার দিকে চিৎকার। একটা বাচ্চা কাঁদছে তারস্বরে। নানান জন ডাকছে আরও নানান জনকে। আর আমি, বাবাকে দেখতে পাচ্ছি না। হাত বাড়াতে নরম, গোল কী একটা ধরলাম। একটা থ্যাঁতলানো কমলালেবু! আমি কোথায়? বাবা? আমার ব্যাগ কোথায়, তার মধ্যে বইপত্র আছে, হোমওয়ার্কের অপেক্ষায় থাকা খাতা!
ধাতস্থ হতে বোঝা গেল, অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে! আমাদের বাসটা এই মুহূর্তে খাদে। মাঠে। বাসের দরজা, যে দরজায় খালাসি গোছের একটা অল্পবয়সি ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল, সেই দরজাটা এখন মাটির সঙ্গে লেগে আছে। বাসের সামনের বিরাট উইন্ডশিল্ড ভেঙে বেরোচ্ছে আতঙ্কিত মানুষ। দুটো হাত কোথা থেকে এসে আমাকে ধরল, আমি জানি ওগুলো বাবার হাত। বাবার জামায় কী সুন্দর গোল গোল, লাল লাল বুটি! কিন্তু বাবা এমন পোলকা ডটওয়ালা জামা পরবে কেন? বাবার জামা তো সাদা! বাইরে এসে বুঝলাম, গোল, লাল বুটিগুলো আসলে রক্ত! অন্য মানুষের রক্ত। বাবার কিচ্ছু হয়নি, বুকের উপরে কার একটা বিরাট স্যুটকেস ধড়াম করে এসে পড়া ছাড়া। বাসভর্তি অজানা আহত মানুষের রক্তের দাগের নকশা মেখে বাবা আমাকে সুদ্ধু, আমাদের ব্যাগসুদ্ধু বাইরে নিয়ে এল। ভ্যানে চাপিয়ে কোথায় নিয়ে যাওয়া হলো আমাদের। একটা ডাক্তারখানা। ডেটলের গন্ধ। আমি বাঁ কনুই বাসের জানলার পাশে ঠেকিয়ে দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম, বাস খাদে পড়ে পাল্টি খাওয়ার সময় জানলার কাচ ভেঙে ঢুকে গেছে কনুইয়ে। হাঁ হয়ে যাওয়া চামড়া ঝুলছে খানিকটা। সেই হাঁ-মুখ বোজানো হলো সেলাই দিয়ে। সেলাই করার সময় ক্লাস সেভেনে পড়া আমি চিৎকার করিনি, দাঁতে দাঁত চেপে বাবার জামায় রক্তের বুটিগুলো গুনছিলাম মন ঘোরাতে। ৩৭টা রক্তের বুটি— বারবার। সে দিন যখন ভ্যানে চেপে বাসস্ট্যান্ডে ফিরছি আবার ঢাকার বাস ধরার জন্য, পাশের ভ্যানে একটা ‘বডি’ আমাদের সঙ্গী ছিল। বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই খালাসি ছেলেটা!
সে বার এত কাছ থেকে মৃত্যু দেখে হতভম্ব হওয়া গিয়েছিল। কিন্তু শোকের অনুভূতি হয়নি, কারণ বাসের সেই ছেলেটির সঙ্গে আমার অপরিচয়ের দূরত্ব ছিল। অপরিচয় করুণা জাগায়, সমানুভূতি জাগায় না তত। কিন্তু কলেজবেলায় একটি মৃত্যু আমাকে প্রথম (ও সম্ভবত শেষ) বারের মতো শোকের সন্তাপ দিল। সে আমার প্রিয় বন্ধু, হস্টেলে রুমমেট। অনার্সের রেজাল্ট বেরিয়েছে সদ্য, সিনিয়র এক দাদা ইউনিভার্সিটিতে র্যাঙ্ক করেছে আমাদের কলেজ থেকে। আমরা তাকে ধরেছি, খাওয়াও! দল বেঁধে যাওয়া হচ্ছে গড়িয়াহাট মার্কেটে, সেখানে একটা হোটেলে জমিয়ে ইলিশ মাছ-ভাত খাব আমরা। নরেন্দ্রপুর থেকে অটোয় গড়িয়া, সেখান থেকে গড়িয়াহাট যাওয়া হবে। আমরা পাঁচ জন একটা অটোয় উঠলাম, আমার সেই বন্ধু আর একটা অটোয় ড্রাইভারের ডান দিকে বসেছিল। গড়িয়া মোড় আসার আগে একটা ম্যাটাডোরের সঙ্গে ধাক্কায়... ওদের অটোর আর কারও কিছু হয়নি, শুধু ওরই। গড়িয়াহাটের বদলে বাঙ্গুর হাসপাতালে গেলাম আমরা। আমি আমার বন্ধুকে দেখতে পাইনি। দেখতে দেওয়া হয়নি। ওরা বলল, দেখতে পারবি না তুই, সহ্য করতে পারবি না। মাথার একটা দিক...
এই মৃত্যু আমার জীবনকে বদলে দিয়েছিল। আমি ডুবে গিয়েছিলাম শোকে। শোক শুধু এ কারণে নয় যে আমার প্রিয় বন্ধু চলে গেল। শোক এ জন্যে, মৃত্যুর ক’দিন আগে থেকেই আমি কী কারণে সেই বন্ধুর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ও অনেক চেষ্টা করেছিল কথা বলার, আমি বলিনি। ডাইনিংয়ে না। ক্লাসে না, খেলার মাঠে না। রুমে দুই মুখোমুখি দেওয়াল ঘেঁষে আমাদের চৌকি— ও এমনকি খাট টেনে কাছে নিয়ে এসেছিল, যদি আমি একটু কথা বলি, গল্প করি। করিনি। তার পরেই এই আকস্মিক দুর্ঘটনা, ওর চলে যাওয়া। মৃত্যুশোককে সহ্য করা যায়, অপরাধবোধের গ্লানি মিশে-থাকা মৃত্যুশোক অসহ। একটা মানুষ, আমার প্রিয় বন্ধু, আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল, আমি বলিনি— তারুণ্যের বন্ধুতায় আকছার ঘটা এই তুচ্ছ ঘটনাটিকে আমার শোকাকুল অপরাধী মন সাজাল এই ভাবে: তুই কথা বললি না, মানুষটা মরে গেল! কী হতো একটু কথা বললে? এখন কোথায় পাবি তাকে? কথার ঝুড়ি নিয়ে বসে আছিস একা, কী কথা বলবি এখন?
এই প্রিয়জনমৃত্যুটি আমাকে জীবনের দুটি শ্রেষ্ঠ শিক্ষা দিয়ে গিয়েছে। এক: মৃত্যুশোকের অনুভূতিরও তারতম্য হয়, সব মৃত্যুশোক সমান নয়। যে মৃত্যুশোকগুলি আমার জন্য অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে প্রতীক্ষমাণ, তারা আমাকে বিচলিত করবে ঠিকই, কিন্তু এই বন্ধুটির মৃত্যুশোকের মতো অভিভূত করতে পারবে না। দুই: কোনও আশঙ্কা থেকে নয়, তবু আমি পারতপক্ষে বন্ধু বা বন্ধুপ্রতিম কারও সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করি না। যদি বা করেই থাকি তা হলে বুঝতে হবে, একসঙ্গে পথ চলতে চলতে জীবন হয়তো তাকে বন্ধু ঠাউরেছিল, কিন্তু বন্ধু সে ছিল না কোনও কালেই।
এই যে বললাম আর কোনও মৃত্যুই আমাকে ‘সে ভাবে’ স্পর্শ করবে না, প্রমাণ পেয়েছি বলেই বললাম। আমার অগ্রজ সহোদরটি ক্যান্সারে চলে গেলেন কয়েক বছর আগে। চেন্নাইয়ের হাসপাতালে তাঁর মস্তিষ্ক থেকে কোষ তুলে দেখে ডাক্তারের নিদান: বাসা বেঁধেছে টিউমার। প্রাথমিক স্তর অনেক দিনই পেরিয়ে গিয়ে সে এখন দ্বিতীয় পর্যায়ে। এমন জায়গায়, অপারেশন করা যাবে না, নাড়াঘাঁটা হলেই বিপদ। মস্তিষ্কের স্নায়ু ছিন্ন হয়ে হয়তো মানুষটা বেঁচে থাকবে বোধহীন এক জড়পিণ্ড হয়ে! এখান থেকে যাত্রা শুধু সামনের দিকে, মৃত্যুর দিকেই। সমস্ত রিপোর্ট হাতে পেতে আরও ক’দিন সময় লাগবে, অচেনা শহরে শুধুই বসে থাকা কয়েকটি মনখারাপিয়া মানুষের। এক শনিবার আমি চলে গেলাম পন্ডিচেরি। একা। ছোট্ট সুন্দর শহর, মানুষের মুখমণ্ডলে প্রশান্তির ছাপ। সমুদ্র আমার ভালো লাগে না, কিন্তু এই সমুদ্র কী নিরভিমান, বিনয়ী! তার বাঁধানো পাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, ছবির মতো সুন্দর কাফেতে বসে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে আমার মনে পড়ে গেল সেই কলেজের বন্ধুটিকে। আর এক আসন্ন মৃত্যু-অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড়িয়ে আমি মনে মনে তাকে বললাম, আর তো ভয় করি না, তুই তো আমাকে শিখিয়ে গিয়েছিস মৃত্যুশোকের মানে।
আমার অগ্রজ এর পর বছর দেড়েক বেঁচে ছিলেন। ফেব্রুয়ারির এক রাতে যে দিন ফোনে মৃত্যুসংবাদ এল তাঁর, আমি শান্তমনে গ্রহণ করেছি, গভীর সন্তোষে ঘুমিয়েছি বাকি রাত।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা পাড়া দুটো পাড়া হেঁটে মেট্রো ধরতে যাই রোজ। অলিগলিপথের বাঁক, টিউবওয়েলে জল নিতে আসা বুড়ি, এফএম শুনতে শুনতে সেলাই-দোকানে কাজ করা মেয়ে— এরা রোজ ঘটে যায় জীবনে, উপলক্ষহীন। ছোট্ট ছিমছাম এক লন্ড্রির দোকানের বাইরে বসে থাকেন মধ্যবয়সি এক মানুষ। আমি যখন তাঁর দোকান পেরোই, তিনি এক কাপ লাল চায়ে চুমুক দেন। জানি লাল চা, কারণ কাপটা স্বচ্ছ, দেখা যায়। চায়ের উপর কয়েক ফালি আদাও দৃশ্যমান। বুঝতে পারি, এই তাঁর রোজকার রুটিন। দোকান খুলে বসে, এক পাত্র চায়ে চুমুক দেওয়ার এইটুকু নির্লোভ, ব্যক্তিগত বিলাস। রোজ আমি তাঁর দোকান পেরোই, আর ওঁর চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া দেখে, ঘড়ির দিকে না তাকিয়েই বলে দিতে পারি, এই মুহূর্তে ক’টা বাজে। কাঁটার একটুও এদিক না, ওদিক না।
এক দিন, কাজের দিনেই— দোকান বন্ধ। মানুষটাও বসে নেই। পরের দিনও নেই। তার পরের দিনও না। কিছু হলো? তাঁর সঙ্গে কোনও দিন কথা হয়নি, কথা হওয়ার কথাও ছিল না। কাউকে জিজ্ঞেস করব? বাড়ির নীচেই দোকানটা, কলিংবেল টিপব বাড়ির? যাঃ, হয় নাকি তাই? কে কী ভাববে! হয়তো বেড়াতে গেছেন! ডাক্তার দেখাতে চেন্নাই-ব্যাঙ্গালোর হয়তো! নাগরিক অস্বস্তিতে রোজ পথটুকু পেরোই, হাতঘড়ি দেখতে দেখতে। নেই, নেই। এক সপ্তাহ, আট দিন, দশ দিন পেরোয়, দোকান খোলে না। লাল চায়ে আদা ভাসে না।
তার পর এক দিন, পথচলতি আমাকে স্তম্ভিত করে দেয় ধবধবে সাদা কাপড়ের একটা গেট। তার গায়ে গোল গোল সাদা ফুলের রিং। ‘ওঁ গঙ্গা’ লেখা কাগজ। সেই ঝাঁপ ফেলা দোকানটার সামনে। একটা মানুষ, রোজ সময় মেনে যে লন্ড্রির দোকান খুলত, লাল চায়ে কয়েক কুচি আদা ছাড়া জীবনে স্পষ্টত দৃশ্যমান চাহিদা বলে যার কিছু ছিল না, মরে গেল? আমি তাঁকে চিনি না, নাম জানি না, কথাও হয়নি কোনও দিন। তবু মনে হলো, এটা ঠিক হলো না। এই ভাবে না বলেকয়ে চলে যেতে হয়? আদা দেওয়া এক কাপ লাল চায়ে চুমুক দিয়ে এই শহরের এক নাগরিক-মুখে যে পরিতৃপ্তির মানচিত্র ফুটে ওঠে, তা থেকে আমাকে বঞ্চিত করাটা অন্যায় নয়?
এখন অন্য গলি ঘুরে অফিস যাই রোজ।
besh bhalo... likhe ja... ar laal cha kheye ja... aada bhasuk ba na bhasuk
ReplyDeleteমৃত্যুর পর কার মনের অবস্থা কীরকম হবে, শোকের আবেগে কার কী প্রতিক্রিয়া হবে, এই ভাবনা মনকে নাড়া দেয়নি এরকম লোক, বিশেষ করে চিন্তাশীল লোক, মনে হয় সকলেই। অলস মনে এ ভাবনা আসতেই পারে, আসেও। এটা এক ধরনের বিলাসিতা, বিশেষ করে নিজের মৃত্যুর পর আত্মীয় পরিজনদের প্রতিক্রিয়া ভাবনা। এই ভাবনা দিয়েই শিশিরের লেখা শুরু। ওর লেখা বলেই আগ্রহ বেড়ে গেল কল্পনার জালটা কিভাবে বিস্তার পায় জানার জন্যে। কিন্তু এ ভাবনায় ইতি টেনে কয়েকটা মৃত্যু-জনিত ঘটনার মধ্যে সুন্দর লেখনীর মাধ্যমে আবেগে ধাক্কা মারল। 'মৃত্যুচিন্তা'টা আসলে ঠিক কী ও কার, সেটা অপূর্ণ থেকে গেল বলে মনে হোলেও ঘটনাগুলোর আবেগ মনে দাগ টানে।
ReplyDeleteএই বিলাসিতা আমার মায়ের মধ্যে দেখেছি। আমার মধ্যেও বর্তেছে সেটা। অভাগীর স্বর্গে আমরা খুব সুন্দর ভাবে পাই।
Deleteএটা ত খুব সত্যি, মাঝেমাঝেই ভাবি যে আমি ম'লে এই যে এত প্রিয়জন তাদের কার কার কিরকম অভিব্যক্তি হবে। আমি যাদের অপ্রিয় তারাই বা কি বলবে!
এই মৃত্যুর গন্ধটা এখন ঘরের ভিতর থেকে বাইরে - এমনকি আমাদের সাংস্কৃতিক আবহাওয়াতেও খুব সন্তর্পনে মিশে যাচ্ছে -
ReplyDeleteশিশির,ডাক্তার হয়ে ওঠো - এই মৃত্যুচিন্তা থেকে আমাদের বাঁচাও।
"মৃত্যু নয়, ধ্বংস নয়,নহে বিচ্ছেদের ভয়, শুধু সমাপন।/ উদার বৈরাগ্যময় বিশাল বিশ্রাম।"
ReplyDeleteশিশির রায়ের লেখাটি পড়েছি দু তিন বার। কয়েকদিন আগেই।. ..' মৃত্যুচিন্তা চমৎকারা"শীর্ষক লেখাটি বেশ অচিরাচরিত অভিজ্ঞতার। .... তাই একে শুধু 'লেখা বা রচনা' বললে, ঠিক হবে না।. ...এ আসলে অন্য রকমের এক উপলব্ধি আর দর্শন। লেখকের এই অভিজ্ঞতা-র যাত্রাপথে এঁকে রাখা মৃত্যুর ধুসর পান্ডুলিপি। .... " সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দোয়েলের মতো এসে জাগে / ধূসর মৃত্যুর মুখ "..... ।....... ' আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে....।