1

প্রবন্ধ - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


‘হাতে পাঁজি মঙ্গলবার’  
উপলক্ষ্য মুদ্রিত পঞ্জিকার দুশো বছর

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় 

প্রাক-কথন : ২০১৮ অর্থাৎ এই বছরটি মুদ্রিত পঞ্জিকার দ্বিশতবার্ষিকী। দৈবজ্ঞ স্মার্ত পণ্ডিতদের গণনা, পূজার্চনা ও ধর্নাচরণের বিধান সম্বলিত হাতে-লেখা ‘পুঁথি-পঞ্জিকা’ মুদ্রিত পঞ্জিকার চেহারা পেয়েছিল ছাপাখানা আসার পর। পঞ্জিকা গবেষকরা জানিয়েছেন যে ১২২৫ বঙ্গাব্দে বা ইংরাজি ২০১৮ সনে জনৈক শ্রীযুক্ত রামহরি প্রথম বাংলা পঞ্জিকা ছাপিয়ে প্রকাশ করেন, পঞ্জিকার সংকলক ছিলেন দুর্গাপ্রসাদ বিদ্যাভূষণ। ১৩৫ পৃষ্ঠার পঞ্জিকাটিতে একটি ছবি ছিল। গবেষকরা জানিয়েছেন পঞ্জিকাটির একটিমাত্র সংখ্যা জাতীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। অতয়েব বাংলা মুদ্রিত পঞ্জিকার প্রথম প্রকাশের দুশো বছর উপলক্ষ্যে আমার এই অকিঞ্চিতকর তথ্যানুসন্ধান ‘হাতে পাঁজি মঙ্গলবার’। 

পাঁজি বা পঞ্জিকার কথা উঠলেই একটা প্রশ্ন ধেয়ে আসে। পঞ্জিকা মানেই কুসংস্কারের আঁতুড়ঘর। পঞ্জিকা নিয়ে লেখা মানেই তো কুসংস্কারের আঁতুড় ঘরেই উঁকি মারা। আধুনিক বিজ্ঞানসচেতন মননে এমনতর ভাবনা অস্বাভাবিক নয় মোটেই। বিশেষ করে এই সময়ে যখন ধর্মীয় উন্মাদনা আমাদের শুভবুদ্ধিকে, সংস্কারমুক্ত মনকেই আচ্ছন্ন করতে চাইছে। মেনে নেওয়া ভালো যে,পঞ্জিকা মানুষের ধর্মীয় বোধ-বিশ্বাস-সংস্কারকে লালন করে ঠিকই কিন্তু সে ধর্মীয় উন্মাদনায় ইন্ধন যোগায় না, অলৌকিত্বের দাবী করে না। পঞ্জিকা নির্ধনকে ধনবান করার ফন্দি-ফিকির বলে না। ১৯৫৬র গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকায় সম্পাদকের একটা অকপট স্বীকারোক্তি দেখছি, পঞ্জিকা সম্পাদক মশাই লিখেছেন “প্রাচীন ঋষিগণ ধর্ম-কর্মের কাল নিরুপনের জন্যই তিথ্যাদিগণনার আবশ্যকতা বোধ করিয়া ছিলেন – বর্তমান যুগের মানুষের বৈজ্ঞানিক কৌতুহল নিবারণের জন্য ঐরূপ গণনা তাহারা করেন নাই”। ভাবের ঘরে চুরি করতে আমরা খুবই দড়। তাই পাঁজি হলো কুসংস্কারের ডিপো, এ’ কথাটা সকলেই বলতে পারি কিন্তু জীবনের প্রতিটি পর্বে – জন্ম থেকে মৃত্যু প্রতিটি স্তরে পাঁজির বিধানকে অস্বীকার করার সাহস পাই না। বিবাহের দিন ঠিক করি পাঁজির বিধান মেনে, নবনির্মিত গৃহের ভিত্তিস্থাপন কিংবা গৃহপ্রবেশের দিন নির্ধারণ করি পাঁজি মেনে, কর্মক্ষেত্রে পূজো-পার্বণের ছুটি উপভোগ করি পাঁজির বিধান মেনেই। আমাদের সামাজিক জীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে পঞ্জিকা বা পাঁজি। সেই পাঁজির মধ্যে বাস করে তার উদ্ভব, বাড়বাড়ন্ত ও প্রভাব বুঝতে চেয়ে আলোচনা না করে এড়িয়ে যাবো, তা কি করে সম্ভব! এ দেশে যে কোন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের সূচনা হয় নারকেল ভেঙ্গে, পঞ্জিকা নির্ধারিত দিনক্ষণ মেনে। এমন যার সর্বব্যাপি প্রভাব তাকে শুধু কুসংস্কারের সমার্থক মনে করে এড়িয়ে যাই কি করে! বাংলা পঞ্জিকা শুধুমাত্র ধর্ম-কর্মের কাল নির্নয় সহায়িকা কিংবা পূজার্চনা ও সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের নির্ঘন্টের গ্রন্থ নয়, বরং বাংলার সমাজ ও লোকজীবনের, সংস্কৃতির চলমান বিস্ময়। দুশো বছর আগে মুদ্রিত পঞ্জিকার যুগ শুরু হওয়ার বহু আগে থেকেই পঞ্জিকাকে আশ্রয় করে লোকজীবনের বহুমুখী সংস্কার গড়ে উঠেছিল, যেগুলি তার আন্তরিক জীবনাচরণ ও বিশ্বাসের অন্তর্গত। আমি মানি বা না মানি, পঞ্জিকাকে বাঙালির সমাজজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করার কথা ভাবা যায় না। 

পাঁজি শব্দটি এসেছে পঞ্জি থেকে, যার চলতি অর্থ বিবরণ বা তালিকা। ‘ভারতকোষ’এ পঞ্জিকার সংজ্ঞা দেওয়া আছে - ‘যে পুস্তকে বৎসরের প্রতি দিনের তারিখ, তিথি, পর্বদিন শুভদিন ইত্যাদি থাকে তাকে পঞ্জিকা বা পাঁজি বলে’। অর্থাৎ বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ ও করণ এই পঞ্চ অঙ্গের সমাহারে নির্মিত পুস্তকই পঞ্জিকা বা পাঁজি। আমাদের পঞ্জিকা জ্যোতির্বিজ্ঞানের সূক্ষ্ম ধারার ওপর দাঁড়িয়ে আছে আর তার সঙ্গে মিশেছে বৈদিক অনুশাসন, বিশ্বাস ও ধর্মীয় নিদান। এক কথায় বলতে হয় আমাদের পঞ্জিকা বা তার বিবর্তনের ইতিহাসের মধ্যে রক্ষিত হয়েছে হিন্দু সংস্কৃতির প্রায় সমস্ত দিক। 

সভ্যতা বিকাশের প্রথম যুগেই মানবসমাজে কাল বিভাগের প্রয়োজনীতা অনুভূত হয়েছিল। ভারতে বৈদিক ঋষিরা বিভিন্ন যজ্ঞানুষ্ঠান করার জন্য সূর্যের উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ণ গতি পর্যবেক্ষণ করে বৎসরকে ১২টি মাসে ভাগ করেছিলেন। এক হাজার খৃষ্টপূর্বাব্দ সময়কালকে ‘বেদাঙ্গ জ্যোতিষ’কাল বলা হয় , এই সময় থেকেই নাকি পঞ্জিকা গণনা শুরু হয়েছিল। বলা হয়, মহাভারতে পাণ্ডবদের বনবাস ও অজ্ঞাতবাসের সময়পূর্তির হিসাব বেদাঙ্গ জ্যোতিষ গণনা পদ্ধতিতেই করা হয়েছিল তারপর খ্রিষ্টীয় ৪র্থ শতকে ৫৫০ অব্দে রচিত জ্যোতির্বিদ বরাহমিহিরের ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ অবলম্বনে পঞ্জিকাগণনা পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়। এখনও সূর্যসিদ্ধান্ত পদ্ধতিতেই পঞ্জিকার গণনা হয়। 

মানুষের পঞ্জিকা নির্ভরতা অতি প্রাচীন। দুশো বছর আগে মুদ্রিত পঞ্জিকার যুগ শুরু হবার আগে আদিতে পঞ্জিকা ছিল জ্যোতির্বিদ্যার গ্রন্থ। মুদ্রিত পঞ্জিকার যুগে এতে ফলিত জ্যোতিষশাস্ত্রের অনেক কিছুর অনুপ্রবেশ ঘটেছে এবং প্রাধান্য লাভ করেছে। রাশিগত বর্ষফল,বর্ষগত লগ্নফল, রাষ্ট্রগত বর্ষফল এখনকার পঞ্জিকার অতি আবিশ্যিক বিষয়। বাংলাতেও পঞ্জিকাগণনার ইতিহাস অতি প্রাচীন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রকাশিত ভারতকোষ-৪র্থ খণ্ডে পঞ্জিকা বিষয়ক আলোচনা থেকে জানতে পারছি “এ সম্বন্ধে নবদ্বীপ পঞ্জিকার নাম জানতে পারা যায়। মনে হয়, স্মার্ত রঘুনন্দন প্রথম উহার গণনা আরম্ভ করেন। তৎপর মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময় হইতে রামরুদ্র বিদ্যানিধি নামক এক পণ্ডিত এই গণনাকার্য সম্পাদন করিতে থাকেন। তৎপরে বিশ্বম্ভর জ্যোতিষার্ণব এই কার্যভার গ্রহণ করেন। ইহার অল্পকাল পরেই এই নবদ্বীপ পঞ্জিকা বন্ধ হইয়া যায়। তৎপরে ইংরাজ আমলে তদানীন্তন সমাহর্তার চেষ্টায় বিশ্বম্ভর জ্যোতিষার্ণব পঞ্জিকার প্রনয়ণকার্য চালাইয়া যাইতে থাকেন। এইসকল পঞ্জিকা পুঁথির আকারে লিখিত হইত এবং কয়েকটি অনুলিপিও প্রস্তুত হইত। এই পঞ্জিকা ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে সর্বপ্রথম মুদ্রিতাকারে প্রকাশিত হয়। উহা এখন ‘গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা’ নামে প্রচলিত। ইহার অল্পকালের মধ্যেই সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ ও দৃকসিদ্ধ পঞ্জিকা গণনার প্রয়োজনীয়তা পণ্ডিতসমাজ বিশেষভাবে উপলব্ধি করেন। ফলে ১২৯৭ বঙ্গাব্দ হইতে ‘বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা’র প্রকাশনা আরম্ভ হয়”। তাতেও অবশ্য পঞ্জিকাগণনা নিয়ে পণ্ডিত সমাজের বিরোধ নিরসন হয়নি। ১৯৫২তে ভারত সরকার বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে পঞ্চাঙ্গ শোধন সমিতি বা ক্যালেন্ডার রিফর্ম কমিটি গঠন করে পঞ্জিকা গণনা পদ্ধতির সংস্কার সাধনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। মেঘনাদ সাহা কমিটির সুপারিশ অনুসারে একটি রাষ্ট্রীয় পঞ্জিকা প্রকাশিত হতে থাকে ১৯৫৭ থেকে, বিভিন্ন ভাষায়। এতৎসত্বেও বাংলা পঞ্জিকায় গণনার ভিন্নতার নিরসন হয়েছে এমন নয়। ১৩৬৩ (বা ১৯৫৬) সনের গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকায় দেখছি পঞ্জিকা সম্পাদক রামরূপ বিদ্যাবাগীশ দাবী করেছেন “ধর্মবিশ্বাসী হিন্দুগণের নিকট আমাদের নিবেদন এই যে, আমাদিগের গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকাই প্রকৃত সূর্যসিদ্ধান্তসম্মত গণনা বিশিষ্ট ও ধর্মশাস্ত্রানুসারে ব্যবস্থাপিত পঞ্জিকা, এই অনুসারে ধর্মকর্ম করিলেই ধর্মকার্য নিঃসংশয়ে সিদ্ধ হইবে। অন্য কোন প্রকার গণনা ধর্মশাস্ত্রসম্মত নহে – ইহাই সিদ্ধান্ত”। এমন আত্মপ্রচার অবশ্য সব পঞ্জিকাই করে আসছে। বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকার সাম্প্রতিক সংখ্যায় দেখছি তাঁর ছবির নিচে পরিচয় লেখা হছে ‘ডক্টর অফ ধর্ম’ বলে। 

ছাপা পঞ্জিকা আর বাংলা বই প্রায় সমবয়সী। পঞ্জিকাও তো বইই। ছাপাখানার যুগ শুরু হওয়ার পর পঞ্জিকা হয়ে গেল বাঙালি জীবনের বিশ্বস্ত সঙ্গী। যে বাঙালীর ঘরে কখনও বই ঢোকেনি, সেখানেও হয়তো একটা বই পাওয়া যাবে সেটি পঞ্জিকা। এখনও যে ঘরে স্কুলের পাঠ্যবই ভিন্ন বই ঢোকেনা, সে ঘরে একটা পঞ্জিকা ঢোকে। পঞ্জিকা যেন বাঙালীর জ্ঞানের সেরা উৎস! ছাপাখানা আসার আগেও পঞ্জিকা ছিল, তবে সেই পঞ্জিকা তো সকলের নাগালে আসতো না। তখন হাতে লেখা পঞ্জিকা নিয়ে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা বাড়িতে বাড়িতে ঘুরতেন, বিধান দিতেন। তালপাতায় হাতে লেখা পঞ্জিকা নানান বিবর্তনের মধ্য দিয়ে মুদ্রিত পঞ্জিকার চেহারা পেল উনিশ শতকের গোড়ায়, যখন সবে বই ছাপা শুরু হয়েছে। জানা যায়, ১৮১৮সনে মুদ্রিত জনৈক রামহরির পঞ্জিকাকেই সবচেয়ে প্রাচীণ মুদ্রিত পঞ্জিকার মান্যতা দেওয়া হয়। “১৩৫ পৃষ্ঠার এই পঞ্জিকায় একটিমাত্র ছবি ছিল। পরের বছর দুর্গাপ্রসাদ বিদ্যভূষণ একটি পঞ্জিকা প্রকাশ করেন” (“উনিশ শতকের পঞ্জিকার দু চার কথা’/ আশিস খাস্তগীর – ‘অনুষ্টুপ’ প্রাক-শারদীয় সংখ্যা ২০১৬)। ছাপাখানা চালু হওয়ার পর সেই ১৮১৮ সন থেকে এ পর্যন্ত কত প্রকাশক বা ব্যক্তি কত পঞ্জিকা প্রকাশ করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। অনুষ্টুপ পত্রিকার প্রাক-শরদীয় ২০১৬ সংখ্যায় একটি প্রবন্ধে দেখছি ১৮১৮ থেকে ২০১০ পর্যন্ত এই ২০০ বছরে ১০০টি পঞ্জিকা প্রকাশিত হয়েছে। তার অনেকগুলিই কালের নিয়মে হারিয়ে গেছে, আবার দেড়শো বছরেরও বেশি সময় ধরে অনেক পঞ্জিকাই আজও স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। এখন ঘরে ঘরে যে পঞ্জিকাগুলি শোভা পায় তার মধ্যে গুপ্তপ্রেস ডাইরেক্টরী পঞ্জিকা ১৮৬৯ সন থেকে প্রকাশিত হয়ে চলেছে, পি এম বাকচি ডাইরেক্টরী পঞ্জিকা প্রকাশিত হয়ে চলেছে ১৮৮৩ সন থেকে, বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকার বয়স এখন ১২৮ বছর (প্রথম প্রকাশ ১৮৯০)। ১৯১৮ সনে প্রকাশিত পূর্ণচন্দ্র শীলের পঞ্জিকার নাম পরে হয় বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকা, যেটি আজও বাঙালীর ঘরে ঘরে। পঞ্জিকা ব্যবহারকারীর অগাধ বিশ্বাস এবং সেই কারণে বিপুল বিপণন না হলে পঞ্জিকাগুলির এতো দীর্ঘকাল ধরে টিকে থাকা সম্ভব হতো না। 

পঞ্জিকার বিবর্তনের বিষয়টিও বেশ চমকপ্রদ। পঞ্জিকা প্রকাশের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল জনসাধারণকে তারিখ, তিথি, রাশি গ্রহের অবস্থান ইত্যাদি জ্ঞাত করা, অর্থাৎ জ্যোতির্বিজ্ঞানের সঙ্গে জ্যোতিষ শাস্ত্রের মিশেল দেওয়া একটা ব্যাপার। তারপর প্রকাশকের ব্যবসাবুদ্ধি এবং ব্যবসাবুদ্ধির প্রতিযোগিতায় পাঁজিতে যোগ হলো মানুষের কাজে লাগে এমন নানান তথ্য রেলের সময়সারণী, কোর্টের তথ্য, ছুটির তালিকা, খনার বচন, দেব-দেবীর পূজার মন্ত্র, বিধি, ইত্যাদি, পঞ্জিকায় এল নানান বৈচিত্র্য। তিথি, রাশি, পূজা-পার্বণের নির্ঘন্ট সম্বলিত সাদামাটা পঞ্জিকায় বৈচিত্র আনলেন প্রথম কিশোরীমোহন বাকচি। কিশোরীমোহন পিতার পি এম বাকচি নামে ১৫২০ পৃষ্ঠার বিপুলায়তন ডাইরেক্টরী পঞ্জিকা প্রকাশ করলেন ১৮৯৯ সনে। ঐ পঞ্জিকা নাকি ছাপা হয়েছিল ৭০০০০কপি। 

শুধু নানান তথ্যের সমাবেশই নয়, নানান লৌকিক আচার, অনুষ্ঠান বিশ্বাস যেগুলি স্মৃতিশাস্ত্র নির্ভর ব্রাহ্মণ্যধর্মের আওতায় ছিল না, সেগুলিও পাঁজিতে যায়গা করে নিয়েছে, নিয়ে চলেছে। একশো বছর আগে যে লৌকিক ব্রতগুলি পাঁজিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল না সেগুলি পরবর্তি সময়ে পাঁজিতে স্থান করে নিয়েছে। আসলে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বহু অবৈদিক,অ-পৌরাণিক পূজার্চনা ব্রতকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আওতায় নিয়ে এসেছে। এখন পঞ্জিকা শুধুমাত্র দৈবজ্ঞ পণ্ডিতদের গণনা, শাস্ত্রীয় লোকাচার ও বৈদিক দেবদেবীর অর্চনা বিষয়ক সংকলন নয়, বৈদিক আচার-বিচারের পাশাপাশি যায়গা করে নিয়েছে নানান লৌকিক দেব-দেবী, লৌকিক বিশ্বাস, সংস্কার, ব্রতকথা। পঞ্চাশ বা একশো বছর আগেও যেসব লৌকিক ধর্মাচার, ব্রত পঞ্জিকাতে স্থান পেত না, সেগুলিও এখন পঞ্জিকাতে যায়গা করে নিয়েছে। আদিতে ইতুপূজা, তাল নবমি, পুণ্যিপুকুর, বিপত্তারিণী ব্রত - এইসব লৌকিক ব্রতগুলি পঞ্জিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল না, স্মার্ত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সম্প্রসারণের ফলে এইসব লৌকিক ব্রত পঞ্জিকাতে যায়গা করে নিয়েছে আর সেগুলির ওপর শাস্ত্রীয় বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে ‘বাঙালির ইতিহাস’ (আদিপর্ব) নীহাররঞ্জন রায়ের পর্যবেক্ষন উল্লেখ করি। লিখেছেন – “বাংলাদেশে সমস্ত আদি ও মধ্যযুগ ব্যাপিয়া শতাব্দীর পর শতাব্দীর ভিতর দিয়া বহু অবৈদিক, অস্মার্ত,অপৌরাণিক ব্রতানুষ্ঠান এইভাবে ক্রমশ ব্রাহ্মণ্যধর্মের স্বীকৃতি লাভ করিয়াছে; আজও করিতেছে। ...আমাদের চোখের সন্মুখেই দেখিতেছি পঁচিশ বৎসর আগে গ্রামাঞ্চলে যে সব ব্রতানুষ্ঠানে পুরোহিতের প্রয়োজন হইত না আজ সে-সব ক্ষেত্রে পুরোহিত আসিয়া মন্তর পড়িতে আরম্ভ করিয়াছেন, অর্থাৎ সেই সব ব্রত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের স্বীকৃতি লাভ করিয়াছে”। এই প্রক্রিয়া এখনও চলছে নিরন্তর। নব নব দেব-দেবীও আবির্ভূত হচ্ছেন আর চলে আসছেন পঞ্জিকার আওতায়। নবীনতম দেবী সম্ভবত সন্তোষী মা। তিনি অবশ্য এখনও পঞ্জিকার কোন তিথি দখল করতে পারেননি। বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকায় দেখছি লোকনাথ বাবার পাঁচালী ও হনুমান চালিশা যায়গা করে নিয়েছে। দুটি লৌকিক প্রথা বা অনুষ্ঠান ‘ভাইফোঁটা’ ও ‘জামাই ষষ্ঠী’ পুথি-পঞ্জিকা যুগে পাঁজির আওতায় ছিলনা,এ’দুটি আচার অনুষ্ঠানের কোন পুরোহিত লাগে নয়া, কোন সংস্কৃত মন্ত্রপাঠ হয় না। কে বলতে পারে কোনদিন এই দুটি অনুষ্ঠানেও ব্রাহ্মণ পুরোহিতের ডাক পড়বে না! 

সেই শুরুর সময় থেকেই পঞ্জিকার নামকরণের বিষয়টও বেশ কৌতুহল জাগায়। অধিকাংশ পঞ্জিকার নামকরণ হয়েছে ছাপাখানার মালিক তথা প্রকাশকের নামে, দুর্গাচরণ গুপ্তর ছাপাখানায় মুদ্রিত পঞ্জিকার নাম ‘গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা’ , পি এম বাকচি পঞ্জিকা, পূর্ণচন্দ্র শীল, বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকা ইত্যাদি, যদিও সব পঞ্জিকার ক্ষেত্রেই এক বিদগ্ধ পণ্ডিতমণ্ডলির অবদান থাকে। পঞ্জিকার প্রথম পৃষ্ঠাতে মুদ্রিত হতো সেই পঞ্জিকার প্রধান অনুমোদক পণ্ডিত মহোদয় এবং দেশের নানান প্রান্তের অনুমোদক পণ্ডিতমণ্ডলীর নাম। ১৯৫৬র গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকায় দেখছি ২৭ পৃষ্ঠা জুড়ে পণ্ডিতমণ্ডলির নাম। এখন পঞ্জিকায় দৈবজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের তেমন বোলবোলাও নেই, এখনকার অনেক পঞ্জিকাতেই অনুমোদক পণ্ডিতমণ্ডলির তালিকা পরিহার করা হয়েছে। আসলে এখন পঞ্জিকা এমন এক বিশ্বাসের যায়গা অর্জন করেছে যে অনুমোদক পণ্ডিতমণ্ডলির নাম অতিরিক্ত মাত্রা যোগ করে না। এখন দেখছি বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকায় প্রতিষ্ঠাতা বেণীমাধব শীলের পরিচয় দেওয়া হয় ‘ডক্টর অফ ধর্ম’ বলে। 

পঞ্জিকার সাত-সতেরোর খোঁজখবর নিতে গেলে যে বিষয়টি না বললেই নয়, সেটি পঞ্জিকার বিজ্ঞাপন। ষাট বছরেরও বেশি আগে শৈশব-কৈশোরে যখন পাঠ্য বইয়ের বাইরে অন্য বইয়েরের সঙ্গে পরিচয় হতে শুরু করেছে, তখন কিছু বুঝি না বুঝি পাঁজির পাতা উল্টে অনেক সময় কেটে যেত। আকর্ষণ থাকতো পাঁজির বিজ্ঞাপনের। বাংলা বিজ্ঞাপন ও বিজ্ঞাপনভাষার বিবর্তন সম্পর্কে যারা আগ্রহী তাদের কাছে ষাট-সত্তর বছর কিংবা তারও আগেকার পঞ্জিকা-বিজ্ঞাপনগুলির ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। বিজ্ঞাপনগুলি থেকে আমরা নিশ্চিতভাবেই জানতে পারি সেই সময়ের মানুষের পণ্যরুচি, পণ্যচাহিদা, দৈবনির্ভরতা এমনকি সহজে প্রতারিত হওয়ার অশিক্ষাজনিত সরলতা। মনে রাখা দরকার, মুদ্রিত পঞ্জিকার যুগের শুরু থেকেই পঞ্জিকার বিপুল বিপণন হতো, আজও হয়। সে যুগে সুলভে বিজ্ঞাপনের মাধ্যম হিসাবে পঞ্জিকার কোন বিকল্প ছিল না, দীর্ঘদিন ধরেই ছিল না। রেভারেণ্ড জেমস লঙের উক্তি ‘পঞ্জিকা হলো বাঙালির কাছে পান তামাকের মত’। এহেন বাঙালীর অন্দরমহলে ‘যাহা ইচ্ছা করিবেন তাহাই পাইবেন’ ঘোষণা করা যাদু আংটি, কিংবা ‘আসল মহাকালী কবচ, বিফলে ১০০০টাকা পুরষ্কার’, ‘নিজের ভূত-ভবিষ্যৎ জানিতে পারা’র আজব আয়না’র মনোহারী বিজ্ঞাপন পৌছে যেত। এইসব লোক ঠকানো সব বিজ্ঞাপনেই থাকতো জলন্ধর সিটির ঠিকানা,পোষ্ট বক্স নম্বর অর্থাৎ সশরীরে উপস্থিত হয়ে পরখ করে ‘আজব আয়না’ কিংবা ‘আড়াই টাকায় হাতঘড়ি’ কেনার সুযোগ ছিল না। বছরের পর বছর সম্মোহনী রুমাল’, ‘৫টাকায় জগৎবিখ্যাত ক্যামেরা’, ‘ফুল আপনার ভাগ্য বলিয়া দিবে’, ‘ঐন্দ্রজালিক সুগন্ধী’ ইত্যাদির বিজ্ঞাপন পঞ্জিকার পৃষ্ঠায় শোভা পেত। ১৯৫৬’র ৩৫০ পৃষ্ঠার গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকায় ছিল পূর্ণ পৃষ্ঠা,অর্ধ পৃষ্ঠা ও ১/৪ পৃষ্ঠা মিলিয়ে ১১৮টি বিজ্ঞাপন। পঞ্জিকায় ‘জলন্ধর সিটি’ মার্কা বিজ্ঞাপনগুলি ছাড়া চিৎপুর এলাকার প্রকাশকদের বইয়ের বিজ্ঞাপন,যেগুলিকে বলি বটতলার বই, নার্সারির বিজ্ঞাপন হোমিওপ্যাথি ও আয়ুর্বেদিক ওষুধের বিজ্ঞাপন ইত্যাদি। সত্তরের মাঝামাঝি কিংবা আশির দশক থেকে পঞ্জিকাগুলির বিজ্ঞাপনভাবনায় বদল এলো। ১৯৭০এর পঞ্জিকাতেও ‘ঐন্দ্রজালিক সুগন্ধী’, ‘সম্মোহনী রুমাল’ ‘আজব আয়না’ ইত্যাদির বিজ্ঞাপন দেখেছি। কিন্তু আশির দশক থেকে এইরকম বিজ্ঞাপন পঞ্জিকার পৃষ্ঠা থেকে প্রায় উধাও হয়ে গেল। বদলে জাঁকিয়ে বসতে লাগলো ভাগ্য গণনা, হাত দেখা ও জ্যোতিষ সম্পর্কিত বিজ্ঞাপন। ২০১৫ (১৪২২ বঙ্গাব্দ)র ৩৬০ পৃষ্ঠার বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকায় দেখছি ১৫০ট ভাগ্যগণনা ও জ্যোতিষ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন। 

এখন পঞ্জিকা শুধুমাত্র দৈবজ্ঞ পণ্ডিতদের গণনা, শাস্ত্রীয় লোকাচার ও বৈদিক দেবদেবীর অর্চনা বিষয়ক সংকলন নয়, বৈদিক আচার-বিচারের পাশাপাশি যায়গা করে নিয়েছে নানান লৌকিক দেব-দেবী, লৌকিক বিশ্বাস, সংস্কার, ব্রতকথা। পঞ্চাশ বা একশো বছর আগেও যেসব লৌকিক ধর্মাচার, ব্রত পঞ্জিকাতে স্থান পেত না, সেগুলিও এখন পঞ্জিকাতে যায়গা করে নিয়েছে। আদিতে ইতুপূজা, তাল নবমি, পুণ্যিপুকুর, বিপত্তারিণী ব্রত - এইসব লৌকিক ব্রতগুলি পঞ্জিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল না , স্মার্ত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সম্প্রসারণের ফলে এইসব লৌকিক ব্রত পঞ্জিকাতে যায়গা করে নিয়েছে আর সেগুলির ওপর শাস্ত্রীয় বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে ‘বাঙালির ইতিহাস’ (আদিপর্ব) নীহাররঞ্জন রায়ের পর্যবেক্ষন উল্লেখ করি। লিখেছেন – “বাংলাদেশে সমস্ত আদি ও মধ্যযুগ ব্যাপিয়া শতাব্দীর পর শতাব্দীর ভিতর দিয়া বহু অবৈদিক, অস্মার্ত, অপৌরাণিক ব্রতানুষ্ঠান এইভাবে ক্রমশ ব্রাহ্মণ্যধর্মের স্বীকৃতি লাভ করিয়াছে ;আজও করিতেছে। ...আমাদের চোখের সন্মুখেই দেখিতেছি পঁচিশ বৎসর আগে গ্রামাঞ্চলে যে সব ব্রতানুষ্ঠানে পুরোহিতের প্রয়োজন হইত না আজ সে-সব ক্ষেত্রে পুরোহিত আসিয়া মন্তর পড়িতে আরম্ভ করিয়াছেন, অর্থাৎ সেই সব ব্রত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের স্বীকৃতি লাভ করিয়াছে”। এই প্রক্রিয়া এখনও চলছে নিরন্তর। নব নব দেব-দেবীও আবির্ভূত হচ্ছেন আর চলে আসছেন পঞ্জিকার আওতায়। নবীনতম দেবী সম্ভবত সন্তোষী মা। তিনি অবশ্য এখনও পঞ্জিকার কোন তিথি দখল করতে পারেননি। বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকায় দেখছি লোকনাথ বাবার পাঁচালী ও হনুমান চালিশা যায়গা করে নিয়েছে। 

আমি বুঝতে চেয়েছি পঞ্জিকার বিবর্তন এবং আমাদের সংস্কৃতির কত গভীরে এঁর শিকড় রয়েছে। গ্রন্থাগারে বসে গত পঞ্চাশ ৭০/৭৫ বছরের পঞ্জিকার সাত-সতেরো তথ্য জানার জন্য খান পাঁচেক পঞ্জিকার পাতা ওল্টাচ্ছি দেখে গ্রন্থাগারের এক চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী জানতে চাইলেন আমি হাতের রেখা বিচার করি কি না! পঞ্জিকার পাতা ওল্টাছি মানে নিশ্চই আমি হাত দেখতেও পারি! এটা বলা এইজন্য যে এ থেকে বোঝা যায় পঞ্জিকাকে ঘিরে মানুষের কি অগাধ বিশ্বাস, সংস্কার। বাঙ্গালি পাঁজিকে তার বইয়ের আলমারিতে অনেক বইয়ের মাঝে রাখেনা, রাখে পৃথকভাবে যখন প্রয়োজন তখনই পাওয়া যাবে এমন স্থানে। পাঁজি যে তার দরকার যখন-তখন - আমাবস্যা-পূণিমা-একাদশিতে, পূজা-পার্বণ, বিয়ে-শাদি,গৃহপ্রবেশ কিংবা দূরযাত্রার শুভক্ষণ দেখতে কিংবা চড়কপূজা থেকে সন্তোষীমায়ের ব্রত সবেতেই পঞ্জিকা, প্রবাদসিদ্ধ হাতে ‘পাঁজি মঙ্গলবার’।

1 comment:

  1. তৃতীয় পংক্তিতে একতা ভুল আছে ১৮১৮ হবে । লেখা হয়েছে ২০১৮ ।

    ReplyDelete