ধারাবাহিক - সুবল দত্ত
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত
॥২২॥
ভুল করে দরজা দিয়ে ঢোকে অপরিচ্ছন্ন আলো ও আঁধার/ঢোকে লাবণ্যহন্তা হাতিয়ার
পেরো
অন্ধকার সর্পিল সঙ্কীর্ণ পিছল গুহাপথ। একসাথে দুজনের বেশি পা ফেলা যায়না। তবু জোহা ও পেরো একসাথে জড়াজড়ি করে এগিয়ে চলেছে। পায়ের নিচে বরফ শীতল জলস্রোত। কোথাও বেশি কোথাও কম। কখনো উজানে কখনো নিচু। পা হড়কে যায়। সাবধানে নামতে হয়। দমকা শীতল হাওয়ায় থেকে থেকে পেরো কেঁপে কেঁপে উঠছে। জোহা আরো জোরে জড়িয়ে ধরছে তাকে। পেরোর সারা অঙ্গ জোহার প্রতি অঙ্গের উষ্ণতার সাথে পরিচিত হচ্ছে। যেন এই চলাতে আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। শরীরে শরীর মেলানো ছাড়া আর কোনো গন্তব্য নেই। মাঝে মাঝে জল ঢোডার ছপ ছপ করে লাফানো আর বুনো ইদুরের লাল লাল চোখ দেখে একটু থেমে ওদের চলে যেতে দেওয়া,এইসব চলছিল। হঠাত্ হঠাত্ উত্কট মাংস পচা গন্ধ আর কখনো বা অজানা ফুলের মায়াময় সৌরভ।
বেহুশের মতো পড়তে উঠতে এইভাবে চলতে চলতে কখন যে অন্ধকার সরু সুড়ঙ্গ পথ শেষ হয়ে একটা বাঁক নিতেই পথ শেষ। দেখাগেল প্রায় দুশো ফুট নিচে উজ্জ্বল হালকা নীলচে সবুজ ডিম্বাকার জলাশয়। চারদিকে কুম্ভের ভিতরের মতো মসৃণ পাথরের দেওয়াল। অনেক উঁচুতে গোলমতো খোলা আকাশ দেখা যায়। সেখান থেকে আলোরশ্মি ছটা জলাশয়ে পড়ে সেটাকে দ্যুতিময় করে তুলেছে। সুড়ঙ্গমুখ থেকে জলস্রোত দুধের মতো সাদা ঝর্ণা হয়ে গড়িয়ে পড়ছে নিচে।পেরো দেখল ওদের সাথীরা সবাই পাশে একটা ঢালু পাথরের স্তুপ বেয়ে ধীরে ধীরে নামছে। পাথরগুলি স্ফটিক পাথরের মতো মসৃণ। পাহাড় দেওয়াল সমতল মসৃণ চাট্টান। পাথরের ছাদ থেকে নেমে এসেছে অসংখ্য স্ট্যালেগমাইট স্ট্যালেকাইট এর ঝুরি। মোটা ঝুরিগুলো কোনটা গাছ কোনটা মানুষ কোনটা সাপের আকার নিয়েছে।
পেরো জলাশয়ের কিনারায় গিয়ে আঁজলা ভরে খানিকটা জল খেল। দেখল জোহা পাথরের গাত্রে খোদাই করা কিছু লিপি দেখতে দেখতে পিছনে হাত বাড়িয়ে ওকে ডাকছে। পেরো কাছে গিয়ে দেখল তাদের বহু আগের পূর্বপুরুষদের লিপি যত্ন করে খোদাই করা রয়েছে। অলচিকি ও মুণ্ডারি ভাষার আদি সংমিশ্রণ। প্রতিটি শব্দের পাশে হেয়ারোগ্লিফিক্সের মতো ছবি আঁকা রয়েছে সেই শব্দের উচ্চারণ ও তার মানে। বিশাল পাথর দেওয়াল জুড়ে এই চিত্রণ। একজায়গায় আদি অস্ট্রিক মুণ্ডারি ভাষায় লেখা কবিতা। পেরো অলচিকি ও মুণ্ডারি লিপির সাথে ঘনিষ্ট পরিচিত। গুরুজি এই অক্ষরের পাঠ পড়িয়েছেন। উনি বলতেন,আজকাল এই উত্তর আধুনিক জীবনযাত্রায় অনেক ভাষা অব্যবহৃত হয়ে লোপ পেয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে এই দুটি ভাষা। তার কারণ অস্তিত্ব বজায় রাখতে দলে দলে আদিবাসী ভাইয়েরা ধর্মান্তরিত হয়েছে ও হচ্ছে। অনেকে হীনমন্যতার শিকার হয়ে নিজস্ব জাতি ধর্ম গোপন করছে। সরকারি জনজাতি ও জনউপজাতির কোটাতে পড়াশুনো ও চাকরির লোভে নিজস্ব ভাষা ত্যাগ করছে। পেরো, এই বিপন্ন সময়ে নিজের মাকে বাঁচা। প্রায় লোপপেতে বসা এই ভাষাকে তুইই পারবি উদ্ধার করে ভবিষ্যতে এগিয়ে নিয়ে যেতে। জোহা পেরোর কোমর জড়িয়ে ধরে প্রস্তরলিপি কবিতাটি একসময় জোরে চেচিয়ে আবৃতি করতে লাগলো। পেরো অভিভূত হয়ে গলা মেলালো। অন্যেরাও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গাইতে লাগলো। ওদের উদাত্ত কোরাস পাথরের দেওয়ালে ঘুরপাক খেতে খেতে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। প্রায় নিস্তরঙ্গ শান্ত উজ্জ্বল নীল জলাশয়ে ছোট ছোট ঢেউ উঠল।
0 comments: