undefined
undefined
undefined
গল্প - স্নেহাশিস ভট্টাচার্য
Posted in গল্প
গল্প
চানঘর
স্নেহাশিস ভট্টাচার্য
আরে, বাথরুমের দরজায় একটা ফুটো রেখেছো তো। মুখার্জিদার সহাস্য মন্তব্য। মল্লিকাদিও মুখ টিপে হেসে ফেললেন। আজও দেরী করে অফিসে এসেছে কীর্তিধর। রোজের অভ্যাস ওর। কাজের ক্ষেত্রেও খুব সক্রিয় ভূমিকায় থাকেনি কোনও দিন। রোজই বিভিন্ন বিদ্রুপ আর এইরকম মন্তব্যের শিকার হতে হয় ওকে। শোনো বাথরুমে ফুটো থাকলে বউকে চান করতে দেখবে, আরে শরীর ভাল থাকবে মনও। আবার হাসির রোল। কীর্তিধর মুখের সামনে খবরের কাগজটা মেলে ধরলো।
রোজই রাতে এই ভেবে ঘুমোতে যায় কীর্তিধর যে কাল ঠিক সকাল সকাল অফিস পৌঁছবে। তবে সেটা ইচ্ছে হয়েই রয়ে গেছে। অফিসে রোজই কিছু না কিছু শুনতে হয়, কিন্তু আজ যেন সব কিছু পেরিয়ে গেলো। অফিস থেকে বিষণ্ণ মন নিয়েই বাড়ীর দিকে রওয়ানা হলো কীর্তিধর।
ট্রেন ধরে গন্তব্য সেই বাদু। প্রচণ্ড ভিড় ট্রেনেও মুখার্জিদার কথাগুলো কানে গরম সিসে ঢেলে দিচ্ছিল। আজকে একটু তাড়াতাড়িই বাড়ী ফিরলো ও।
বাগানঘেরা একতলা ছোট্ট একটা বাড়ী। দুটো ঘর, রান্নাঘর, আর বাথরুমও একটাই। নিঃসন্তান দম্পতি কীর্তিধর আর পরমা।
বাড়ীও কীর্তিধরের নিজের বানানো নয়। বাপ ঠাকুর্দার আমলের। তবে কীর্তিধর যত্ন করে বাড়ীর। আর বাগানটা হলো প্রাণ। নিজের হাতে বসানো গাছ, কিছু সব্জী, ফুল, প্রাণ ভরে গন্ধ নেয় ও। সন্তান স্নেহে হাত বুলিয়ে দেয় ওদের গায়ে।
পরমা সিরিয়াল দেখছিল। কীর্তিধর বেরিয়ে গেলে না ফেরা পর্যন্ত ওই টিভিই সঙ্গী ওর। বই পড়ার অভ্যাসটা আর আগের মতো নেই। আর এই মেগা সিরিয়ালগুলো মনটাকে খুব উদাস হতে দেয় না। অমুক বাড়ীর বউটার কি হবে বা পাহাড় থেকে খাদে পড়ার পর বাঁচলো কি না এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই সময় কেটে যায়।
চা নিয়ে এসে অবাক হয়ে পরমা জিজ্ঞেস করলো, কি গো এখনও বাগানে, ফ্রেশ হবে না? চা হয়ে গেছে তো। যেন সম্বিৎ ফিরে পেলো কীর্তিধর। বাড়ী ফিরে ব্যাগটা রেখেই বাগানে চলে এসেছিল ও। মন ভালো করার এটাই সবচেয়ে ভালো উপায় ওর।
হ্যাঁ, দাও। বলে তাড়াতাড়ি মুখ হাত ধুয়ে ঘরে এল। এই ঘরটায় টিভি নেই। একটা বহু পুরোনো পূর্বপুরুষের গ্রামোফোন আছে। কাঠের একটা টেবিল, কাঠেরই চেয়ার, একটা ট্রানজিস্টরও আছে। খাট আছে একটা ছত্তি দেওয়া। খাটের পাশেই জানলা। মন মাতানো ফুলের গন্ধ, দক্ষিণ খোলা জানলা দিয়ে গোটা শরীরে হাত বুলিয়ে দেওয়া বাতাস, কখনও গ্রামোফোনে বেগম আখতারের গান। কীর্তিধর সব ভুলে যায় তখন।
আদা দেওয়া বেশী চিনি দেওয়া দুধ চা, একটা বাটিতে আম তেল দিয়ে মাখা মুড়িতে বালিতে ভাজা বাদাম ছড়ানো, সঙ্গে পিয়াঁজ কুচি। কি হয়েছে বলতো তোমার? মুখ চোখটা একটু অন্যরকম। শরীর ঠিক আছে তো। কীর্তিধর মুড়ি আর চা খেতে খেতে ঘাড় নাড়লো, সব ঠিক আছে। পরমা কথা না বাড়িয়ে অন্য ঘরে চলে গেলো টিভি দেখতে। চা মুড়ি শেষ করে ক্যাপস্টান এর পাউচ্টা নিয়ে বানাতে বসলো কীর্তিধর। তারপর অনেকটা ধোঁয়া বুকের মধ্যে ভরে নিয়ে উঠে পড়ল বাগানের যাবার জন্য। হঠাৎই চোখ চলে গেলো বাথরুমের দিকে। কিরকম গাটা শিরশির করে উঠলো ওর।
টিভিতে সিরিয়ালের আর্তনাদ ভালো লাগে না ওর। বোঝে পরামাই বা কি করবে। বাগানের ভিতর দিয়ে হাঁটতে লাগলো ও। সামনেই পূর্ণিমা বোধহয়। আকাশে চাঁদটা ধীরে ধীরে পূর্ণাবয়ব নিচ্ছে। বাগানের আলোটা বন্ধ করে দিলো ও। জ্যোৎস্নার মায়াবী আলো গ্রাস করে নিচ্ছে সময়টাকে। দূরে ট্রেনের আওয়াজ শোনা গেল। নাম না জানা কোনও পাখী করুন সুরে ডেকে উঠলো। পাশের বাড়ীর হুলোটা একবার পাঁচিলের গা বেয়ে নেমে আবার উঠে বসলো। একটু শ্রান্ত লাগছে আজ। পাউচ্ হাওয়া না পেলেই নিভে যায়। দেশলাইএর খোঁজে পকেট হাতড়িয়ে না পেয়ে ওটা ফেলেই দিলো ও। আজ যেন ওই কথাটা ওকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। বাথরুমের দরজায় ফুটো থাকলে বউকে চান করতে দেখতে পাবে।
অনেকগুলো বছর আগে, হ্যাঁ, দেখতে দেখতে কুড়িটা বছর তো পেরোলো ওদের সম্পর্কের। কলকাতায় পড়তে যেতে হতো। কীর্তিধর আর পরমার আলাপ কোচিং ক্লাসেই। পরমা অসাধারণ রূপসী নয়। কীর্তিধর বরাবর ই সুন্দর চেহারার মানুষ। হালকা চাপা রঙ গায়ের, দির্ঘদেহী, আর চেহারায় একটা কাঠিন্য আছে। প্রকৃতিগত ভাবে কিন্তু নরম মনের। পরমার ব্যাক্তিত্বই চোখ টানে ওর। আলাপ যখন ধীরে ধীরে দেড় বছরের মাথায় ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয় তখন জানতে পারে পরমা অপূর্ব গান গায়। কত দিন শুধু ওর গান শুনেই কাটিয়েছে কীর্তিধর। কীর্তিধর খুব ভালো মাউথ অর্গান বাজাত, পরমা অবাক হয়ে শুনতো ওই সুর। কীর্তিধরের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি এসে থেমে গেলো। আচ্ছা কত দিন হলো পরমা গান গায় না, ও নিজেও তো বের করে না মাউথ অর্গানটা।
গঙ্গার ধারে ওদের বহু সময় কেটেছে। সেদিনের কথাটা হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেলো কীর্তিধরের। হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছিল গঙ্গার দিকেই, ধর্মতলা থেকে আকাশবাণী ভবনের পাশ দিয়ে বাবুঘাটের দিকে এগোতে এগোতেই আকাশ যেন ভেঙে পড়ল, ডানদিকের হাইকোর্ট এর রাস্তা, বা দিকে নেতাজী ইনডোর, রাস্তাটা নিমেষেই জনমানবশূন্য, পরমা আর ও ভিজিয়ে নিচ্ছিল নিজেদের, গঙ্গার ধারে এসে যখন পৌঁছলো তখন বৃষ্টির সঙ্গে দোসর হয়েছে ঝোড়ো হাওয়া। পরমা কীর্তিধরের হাতটা ধরে রেখেছিল শক্ত করে। এইভাবে কখনও পাশাপাশি আসেনি ওরা। কি যেন হয়ে গেলো ওর, পরমার ঠোঁটে মিশিয়ে দিলো ওর ভেজা উষ্ণ ঠোঁট, থর থর করে কাঁপছিল পরমা, ভেজা চোখে তখন অশ্রুধারা। চমকে সরে গেছিল কীর্তিধর। খানিকটা বিদ্যুৎ চমকের মতো সময়। কীর্তিধরকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটের সমস্ত উষ্ণতা ছড়িয়ে দিতে থাকলো পরমা।
কীর্তিধরের মনে হলো যেন ওর জ্বর আসছে। বাগান থেকে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে কীর্তিধরের চোখের সামনে ভেসে উঠলো পরমার স্তনসন্ধিতে আঁকা বাদামী রঙের তিলটা। নিজের ঘরে ফিরে এল ও। পরমা রান্নাঘরে। কিছু একটা আঁচ করেছে সেও। রাতের খাওয়া মিটলে রোজের অভ্যাস এর ব্যতিক্রম ঘটিয়ে আজ কীর্তিধর একটু তাড়াতাড়ি বিছানায়। পরমাও রান্নাঘরের কাজ সেরে একটু তাড়াতাড়িই এল। বহু বছর পর আজ কীর্তিধর পাশ ফিরল।।
পরের দিন অফিসে সবাই অবাক। কীর্তিধর সকলের আগেই এসেছে। মন দিয়ে ইন্টারনেট সার্ফ করছে। সকলের চোখে মুখেই জিজ্ঞাসা। খানিক বাদে কীর্তিধর বেরিয়ে গেলো, আর ফিরে এল একটা নতুন স্মার্টফোন হাতে। মুখার্জিদা এটা কিনলাম আপনার বৌদির জন্য। আর হ্যাঁ বাথরুমের ফুটোটা করিয়েই ফেললাম। চোখ টিপে কাজে বসে গেল কীর্তিধর।
Khub valo laaglo
ReplyDelete