0

সম্পাদকীয়

Posted in






ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৫ নম্বর ধারা। যে বিষয়গুলির ঢাল হয়ে উঠে অধঃপতনের গহ্বর থেকে সমাজকে রক্ষা করার কথা, তার প্রথম অবশ্যই মূল্যবোধ আর তার নীতিনিষ্ঠ প্রয়োগই একদিন জন্ম দিয়েছিল এই আইন নামক বিষম বস্তুটির। প্রণেতারা নিশ্চয়ই একথাই ভেবেছিলেন, যখন মানুষের অপরাধী প্রবৃত্তি মূল্যবোধের লক্ষণরেখা ভঙ্গ করবে, সমাজের গা দিয়ে চুইয়ে পড়বে পুঁজরক্ত, সেই ক্ষতস্থানের নিরাময়ের জন্য দরকার হবে আইনের। 

সেইসময় একথা তাঁরা অবশ্যই মনে রাখেননি যে প্রাণীকূলে মানুষই সবচেয়ে ধূর্ত এবং বিপদে পড়লে, একটি বিশেষ পরিস্থিতিকে নিজের আয়ত্বে আনার জন্য অন্য অনেক প্রাণীর মতোই চকিতে বদলে ফেলতে পারে বাহ্যিক চেহারা। 

আইনের অনুশাসন সৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আবিস্কৃত হল তার চোরা ফাঁকফোকরগুলি। বিষয়টি অধিক আক্ষেপের হয়ে ওঠে যখন রক্ষকই ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। যে ন্যায়ালয়ের দায়িত্ব সাধারণ মানুষের কাছে সুবিচার পৌঁছে দেওয়া এবং প্রমাণ করা আইন 'অন্ধ' হলেও তা নিরপেক্ষ, পবিত্র সেই স্থানটি থেকে একটি বিশেষ আইনের পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যা করা হল। এই দেশেই। 

৩৭৫ নম্বর এই বিশেষ ধারাটিতে স্পষ্ট বলা আছে কোনও নারীর অসম্মতিতে যে কোনও রকম যৌন সম্পর্ক স্থাপনের অর্থ ধর্ষণ এবং একমাত্র ধর্ষণই। এই একই আইনে এতদিন অবশ্য বৈবাহিক সম্পর্ককে এই ব্যাখ্যার আওতায় রাখা হয়নি, ছাড় দেওয়া হয়েছিল 'স্বামী দেবতাকে'। 

সম্প্রতি দেশের দুই প্রান্তের দুটি হাইকোর্ট আলাদা একই গোত্রের দুটি মামলায় এমন রায় দিলেন যাতে 'ধন্দ' শব্দটির যথার্থ মানে অনুধাবন করা গেল। একজন বিচারপতি বললেন, নারীর অসম্মতিতে যৌন মিলন হলে তা ধর্ষণই, বিবাহিত দম্পতির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবে না। আর অন্যজন বললেন, আলোচ্য ক্ষেত্রে মেয়েটির বয়স যদি হয় আঠারো বা তার অধিক, তাকে ধর্ষণ বলে গ্রাহ্য করা যাবে না। 

সমাজের অভিমুখ কোনদিকে এর পর নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না! 'সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ'।

সুস্থ থাকুন, সৃজনে থাকুন

শুভেচ্ছা নিরন্তর

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in







শীতল স্মৃতি 

আমরা যারা দক্ষিণ বঙ্গের এই জনাকীর্ণ শহরের অলিতে গলিতে প্রথম নিঃশ্বাস নিয়েছি , এবং হয়ত শেষ নিঃশ্বাস ও নেবো , তাদের কাছে শীত একটা উৎসব । না , শহরে প্রথম তুষারপাত জাতীয় ঘটনা ঘটেনা বটে , তবে যেটুকু শীত আসে তা আমরা উদযাপন করি ষোল আনা । কতই বা নামে পারদ ? দশের নীচে তো নয়ই , অধুনা তাও হয়না । বসন্তের আমেজ মাখানো একটা শীত শীত ভাব । কি কষ্ট কি কষ্ট ! তোরঙ্গ দেরাজ থেকে রঙবেরঙের শীতপোশাক , মাফলার টুপি বের করা হয়না । দশবছর আগে মাসতুতো দিদির শ্বাশুড়ী যে দারুণ সাদা ধবধবে কার্ডিগানটা বুনে দিয়েছিলেন, এবছর তার সঙ্গে ম্যাচ করে একটা শিফন কিনেছিলাম । সঙ্গে মুক্তোর গয়না । শীতের বিয়েবাড়ির আগাম ফ্যাশান । সে গুড়ে বালি । এ তো রীতিমত গরম ! কার্ডিগান পরে কে ? তবুও অভ্যাসের ফলে ছাতে যাই । দিনের প্রথম নরম রোদ্দুর বের হলেই বাক্স টেনে ছাতে এনে ফেলি । ডালা খুলে দিই । ভেতর থেকে উঁকি দেয় আমার আদুরে শীতবস্ত্র । অবিশ্যি বাই ল আমি এখন এক মফস্বলের বাসিন্দে । কলকাতা থেকে পঁচিশ কিলোমিটার দূরে গঙ্গাতীরবর্তী এক মফস্বল । এখানে বসত ঘন হলেও কলকাতার মত বাড়েনি । নানা অসুবিধেতে জীবনযাত্রা আর সরল হয়না । ফলে এখান থেকেই মানুষের ঢল নামে দেশের সব শহরে । এখানে অপেক্ষাকৃত ভাবে শীত তাই প্রবল । কলকাতার মতন ঘাম প্যাচপ্যাচে শীত নয় মোটেই । কালীপুজোর পরপরই আমরা গায়ে দেবার জন্য বিছানায় কাঁথা রাখি । আর সত্যি সত্যি শীত টের পাই অঘ্রানের নবান্নের ঘ্রাণে । নবান্নের দিন সকালে ঠাকুরদালান থেকে প্রসাদ বয়ে এনে দেয় সুখোদা । কাঁচা দুধ , নতুন গুড় , কড়াইশুঁটি, গোবিন্দভোগ চাল , মূলো , আদা , কমলালেবু , আপেল , বেদানা , কিশমিশ দিয়ে তৈরি আমাদের নিজস্ব ফ্রুট ডেজার্ট । কি অপরূপ স্বাদ আর সুবাস ! বিশবছর আগে আমার শ্বাশুড়ীমা , আমি ভালোবাসতুম বলে বিশেষ করে , বাড়িতে নিজের হাতে আমাকে তৈরি করে দিতেন এই ডেজার্ট । প্রসাদ তো কণিকামাত্র । এখন অবশ্য প্রসাদেই কুলিয়ে যায় । কারণ ও বস্তুটির স্বর্গীয় আস্বাদ গ্রহণে পরিবারের বাকি সদস্যরা অসমর্থ । আর দ্বিতীয় যে কারণ তা হলো এমন শীত আর পড়েনা নবান্নে যে শীতসুবাসিত নলেন গুড় ডেজার্ট এর স্বাদ বাড়াবে ।
তখন তখন আমরা শীতকালে ছাত থেকে মোটেই নামতে চাইতুম না । রুটিনটা মোটামুটি এরকম ছিল - সকালে কাঁপতে কাঁপতে লেপের তলা থেকে উঠে বসে গায়ে সোয়েটার চাদর জড়ানো । ( আহা ! সাদা মোটা সুতির মশারীও তখন কত আরামদায়ক ছিল !) তারপর সাহস সঞ্চয় করে বিছানার বাইরে আসা । মুখ ধোবার জলে হাত ঠেকানো মাত্র তড়িত্ চমক । গরম চায়ের মত এমন অমৃত আর ছিলনা । জীবনদায়ী । ঘরের জানলা দিয়ে সামনে গঙ্গার দিকে তাকালে কেবল এপারের ঘাটটা দেখা যেত । সাদা কুয়াশার চাদরে ঢাকা গঙ্গার ওপার একেবারেই দৃষ্টির বাইরে । মনে হত যেন সাগরপার । আর গঙ্গার রং ও শীতে সাগরঘেঁষা । হালকা নীল ও ধূসরের মাঝামাঝি । জলের কাজকর্ম সেরে রান্নাঘরের দিকে ছুটতাম সকলে । আগুন পোহানোর স্নিগ্ধতার কি কোনও তুলনা হয় ? আর বেলা একটু গড়ালেই বাগান নয়ত ছাত আমাদের বৈঠকখানা । গান, গল্প, লুডো খেলা , শুকনো কাপড় ভাঁজ করা , কমলালেবু খাওয়া , রোদ্দুরে দেওয়া লেপ কম্বল উল্টোনো , উলবোনা , - যেন নিত্যদিনের বনভোজন । ঠিক তিনটের পর রোদ্দুর ফিকে হতে শুরু করলেই ছাতজোড়া সংসার গুটোতে হত । আস্তে আস্তে নেমে আসতাম আমরা । কিন্তু সন্ধ্যে হলেই আমরা বিছানাআশ্রিত হয়ে পড়তাম । রাতের খাবার গরম করে পরিবেশন করা যেন ফাঁসির সাজার থেকেও বেশি দণ্ড মনে হত । তবু শীত চাইতাম আমরা । আমাদের এবাড়ির পাথরের মেঝেতে , গঙ্গামাটির গাঁথনির ত্রিশ ইঞ্চির দেওয়ালে শীত ঠাকুরানী বনেদী বাড়ির ঠাকুরঝির মত রয়ে যেতেন আরও কিছুকাল । সবচেয়ে মারাত্মক শীত পড়ত পৌষে । সংক্রান্তিতে । সাগরের এলোমেলো মরারোদের হাওয়া খড়খড়ি নড়িয়ে , ঘুলঘুলি দিয়ে , শার্সির ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ত শোবার ঘরের বিছানায় । রোদের অভাবে ঠান্ডা লেপের মধ্যে ওম তৈরি হতনা । হি হি করে কাঁপতুম সকলে । তবে এর চেয়েও কঠিন ছিল পৌষের লক্ষ্মীপূজোর দিন । কাকভোরে লক্ষ্মী পাতা নিয়ম । ভোরবেলার সেই স্নান যে কি বিভীষিকা ছিল ! তবে সারাদিন বেশ ঝরঝরে হয়ে থাকতাম সেদিন । এখন আর তেমন শীত পড়েনা । আর শীতের কষ্ট পোহাতে হয়না । বাড়ির লোকজন অবশ্য বলে উচ্চরক্তচাপহেতু আমি শীত বোধ করি কম ।
বহু আগে , চল্লিশ বছর তো হবেই , কলকাতা শহরেও কিঞ্চিদধিক শীত পড়ত । খেলে ফেরবার সময়ে দেখতাম ফুটপাতে জড় হয়ে গরীব গুর্বো মানুষ আগুন পোহাচ্ছেন । তখন শীত মানে দুপুরের ময়দান । শীত মানে চিড়িয়াখানা । শীত মানে নাহুমের কেক । শীত মানে বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন । শীত মানে দিদির জন্মদিন । শীত মানে আমার জন্মদিন । এর সাথে শীত আমাদের জন্য আরও একটু বাড়তি আনন্দ বয়ে আনত । আমাদের মামারবাড়ি ছিল বিহারে । ছোটনাগপুরের এক অল্পখ্যাত রেলওয়ে জংশন , চক্রধরপুর । পাঁচ মামার মধ্যে দুই মামা রেলের চাকরিতে এখানেই পোস্টেড ছিলেন সারাজীবন । বড়মামার কোয়ার্টার বেশ লোভনীয় হলেও আমরা ঘাঁটি গাড়তাম ন’ মামার বাসাবাড়িতে । কারণ দিদিমা ওখানেই থাকেন । বেশির ভাগ রাতের গাড়িতেই আমরা যেতাম মামার বাড়ি ।
ভোর রাত্রে ট্রেন নামিয়ে দিত স্টেশনে । ঘুম জড়ানো চোখে ঠান্ডায় জমতে জমতে আমরা রিকশা চেপে যেতাম প্রেম নিবাসে । মামার বাড়ির পোশাকী নাম । তখনও অন্ধকার আকাশে । রিকশার হর্ণ শুনতে পেয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে মামা এসে জাফরীর দরজা খুলে দাঁড়াত । আমরা ওই আধঘুমের মধ্যেই যথেষ্ট স্নেহ আদর সঞ্চয় করে ঢুকে পড়তাম লেপের তলায় । মায়িমা , মাসি , দিদিমার সদ্য ছেড়ে যাওয়া ওম্ ধরা লেপের তলায় । আবার ঘুমিয়ে পড়তাম আরামে । সকালে ঘুমচোখ খুলে নিজেরই বিশ্বাস হতোনা যে সত্যি সত্যি পৌঁছে গেছি মামার বাড়ি । সূর্য উঠলেই কিন্তু দারুণ উপভোগ্য হয়ে উঠত জায়গাটা । আমরা বাড়ির সামনের লম্বা ফালি ঘাসজমিতে খেলাধুলো করতাম । সামনে দিয়েই চলে গেছে চাইবাসা রোড । যার ডানদিকে চাইবাসা আর বাঁদিকে এতোয়ারি বাজার । ছোটবেলায় ওই রাস্তা , ওই গন্তব্য যেন কি রহস্যময় লাগত । ভিড়ে ঠাসা বাস দেখে মনে হত কোন সুদূরের যাত্রী এরা ! মামার বাড়ির পাশেই গায়ে গায়ে ছিল সরকার জেঠুদের বাড়ি । জেঠুর ছিল শিকারের নেশা । জেঠুর জিপে চড়ে এই শীতকালেই তো আমরা যেতাম টেবোপাহাড়ে । সেসব দিন শিকার করতনা জেঠু । জঙ্গলে জঙ্গলে ধুলো মেখে ঘুরে বেড়ানোই তখন আনন্দ ছিল আমাদের । একবার ফেরবার সময়ে জিপের পেছনে একদম ধারে বসেছি । জিপ ছুটছে । পিচরাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন ঘোর লেগে গেলো । গাড়ি থেকে একটু ঝুঁকে গেলাম আর ছিটকে পড়ে গেলাম । ঠোঁট কেটে গেলো । কেমন করে যেন ছোটবেলায় হাজার চোট পেলেও হাতপা ভাঙতনা । সেভাবে কেটেকুটেও যেতনা । ফেরবার পর দিদিমা বললেন - আর জঙ্গলে যেতে হবেনা । এই অবেলায় সারাদেহ ধুলোয় রাঙা করে ফিরলেন সব । দিদিমা খাঁটি সর্ষের তেল ঘষে ঘষে মাখিয়ে দিতেন গায়ে । চান করে সে কি আরাম ! অমন গন্ড গাঁয়ে কি করে আর নাহুমের কেক পাওয়া যাবে ! অগত্যা মামা একবার ওপরে বালি নীচে বালির খোলা করে উনুনের আঁচে কেক বানালো । কি যে স্বাদ তার ! আজও ভুলিনি । সেবছর পয়লা জানুয়ারি আমরা মামার বাড়িতে । দিদির জন্মদিন । সব পাঁচ সাতের খোকা খুকু আমরা । সকালবেলা মামা ভাবছে মাংস ভাত রান্না হবে আজ । মুশকিল হলো দিদিমা বামুনের ঘরের বিধবা । রাঁধবেন বাড়বেন কিন্তু অবেলায় স্নানও করবেন । হঠাত্ খেলতে খেলতে দেখি স্টেশনের দিক থেকে যে রাস্তাটা এসে মিশেছে চাইবাসা রোডে , তার মুখে বাবা দাঁড়িয়ে । রাস্তা পেরোলেই আমাদের হাতের নাগালে চলে আসবে । বাবার হাতে ঝুলছে দড়িবাঁধা একটা বাঁধাকপি । সবাই অবাক ! দিদি হতাশ । নাকিসুরে মাকে বলছে - ওঁমা দেঁখোনা ! বাবা কিঁ এনেছে । মা বিরক্ত । এই ভবঘুরে অসংসারী মানুষটাকে আর মানুষ করা গেলোনা । বাঁধাকপি ঝুলিয়ে এই ডবল উৎসবে কেউ শ্বশুরবাড়ি আসে । দিদির জন্মদিন আর নতুন বছর একসাথে । বাবা ততক্ষণে নাগালে চলে এসেছে । রহস্যময় হেসে মামার হাতে বাঁধাকপিটা দিতেই মামা একটু ঝুঁকে পড়ল । ওজনটা বুঝতে পারেনি মামা । অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল - এত ভারী কেন গো ? বাবা বলল - ওটা কেক । বাবির জন্মদিন তো আজ ! সব্বাই খুউব অবাক । এই বাঁধাকপি কপি নয় ? কেক ? সেই নাহুমের ? খুব মজা হলো সেদিন । মায়েরও মুখটা আলোকিত হয়ে উঠেছিল ।
আজ কিছুকাল হলো পৌষ আমার কাছে তেমন সুখস্মৃতি বয়ে আনেনা । এরকমই এক পৌষের শীতে গিয়েছিলাম মামার বাড়ি । সেবছর ডিসেম্বরের একুশে চলে গেলেন দিদিমা । মামার বাড়ির সব মায়া যেন একাই নিয়ে চলে গেলেন । আর তারও পর , এরকমই এক তীব্র শীতের রাতে , পৌষের শেষে চলে গেলেন শ্বশুরমশাই । তাঁর শীতের ব্যবহারের নানান সরঞ্জাম পড়ে রইল খাট জুড়ে , ঘর জুড়ে , আর আমাদের চেতনা জুড়ে । আর এইতো সেদিন ! দার্জিলিং পাহাড়ে শেষ ডিসেম্বরের সোনাঝরা রোদ্দুরে শ্বেতাম্বর কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ঐশ্বরিক মহিমায় অনুভব করছি , হঠাত্ জানতে পারলাম জন্মদাতা চলে গেলেন ওই উচ্চতম শৃঙ্গেরও ওপরে । সেদিন ওই মহিমময়ের উপস্থিতিও আমার শোককে এতটুকু ঘোচাতে পারেনি । বয়স যত বাড়তে থাকছে পৌষমাস আর শীতকাল ততই মৃত্যুর তীব্রতা বহন করে আনছে । শীতের সুখময় স্মৃতি দ্রুত অপসৃয়মান । এখন তাই উষ্ণতা টুকুই চাই । আপনজনের , প্রিয়জনের সান্নিধ্যে , আলিঙ্গনের নিরাপত্তাজনিত উষ্ণতা । মৃত্যুর মতন হিমশীতল শীত আর চাইনা ।

[সৃজন ওয়েবজিন শীত সংখ্যা ২০১৭]

0 comments:

0

প্রবন্ধ - সব্যসাচী মজুমদার





















১.


অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তী ভূমিকা লিখতে গিয়ে জানাচ্ছেন,


“কোনও নির্দিষ্ট সারস্বত লক্ষ ছিল না বলেই তাঁর রবীন্দ্রবিচার জাতীয় জীবনের উদ্বোধনের নামান্তর।হয়তো সেইজন্যেই তিনি একসঙ্গে রবীন্দ্রবাণীর মধ্যে আবিষ্কার করেন ইবসেন, হুইটম্যান ও ব্রাউনিং-এর মতো পরস্পর বিরোধী মানস-সংযোগ,যা খুব স্হিতধী ও বিবেচক সাহিত্য চিন্তায় টেঁকে না।“(আঠেরো/ভূমিকা)


এবং এই প্রসঙ্গে নিজের যুক্তির স্বপক্ষে সুধীর বাবু তুলে ধরছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠিকে,


“হুইটম্যানের সঙ্গে তুলনা করলে রবীন্দ্রনাথের মর্যাদা হানি হয় কিনা সে প্রশ্ন উঠতে পারে।এ প্রসঙ্গে বিজয়লালকে লেখা রবীন্দ্রনাথের এক অপ্রকাশিত চিঠি বেশ কৌতূহলপ্রদ,যেখানে তিনি হুইটম্যান সম্পর্কে খুব প্রসন্ন মন্তব্য করেননি। রবীন্দ্রনাথ ৩০আষাঢ় ১৩৪৪ তারিখে লিখছেন,

তোমাদের হুইটম্যানের কাব্যালোচনার প্রচেষ্টা জয়যুক্ত হোক,এই ইচ্ছা করি। প্রকাণ্ড একটা খনি,ওর মধ্যে নানান কিছুর নির্বিচারে মিশেল আছে, এরকম সর্বগ্রাসী বিমিশ্রণে প্রচুর শক্তি ও সাহসের প্রয়োজন-আদিমকালের বসুন্ধরার সেটা ছিল-তার কারণ তখন তার মধ্যে আগুন ছিল প্রচণ্ড-এই আগুনে নানা মূল্যের জিনিস গলে মিশে যায়।হুইটম্যানের চিত্তে সেই আগুন যা তার কাণ্ড করে বসেচে। জাগতিক সৃষ্টিতে যেরকম নির্বাচন নেই ,সংঘটন আছে,এ সেইরকম -ছন্দোবদ্ধ সব লণ্ডভণ্ড-মাঝে মাঝে এক -একটা সুসংলগ্ন রূপ ফুটে ওঠে আবার যায়, মিলিয়ে।যেখানে কোনও যাচাই নেই, সেখানে আবর্জনাও নেই, সেখানে সকলের সব স্হানই স্বস্হান।এক দৌড়ে সাহিত্যকে লঙ্ঘন করে গিয়েছে এইজন্য সাহিত্যে এর জুড়ি নেই -মুখরতা অপরিমেয় -তারমধ্যে সাহিত্য অসাহিত্য দুই সঞ্চরণ করচে আদিম যুগের মহাকায় জন্তুদের মতো।এই অরণ্যে ভ্রমণ করতে হলে মরিয়া হওয়ার দরকার।


রবীন্দ্রনাথ সুকৌশলে হুইটম্যানের কাব্যধর্ম সম্বন্ধে যা বলেছেন বিজয়লালের রবীন্দ্রবিচার বিষয়ে হয়তো কারও সেই একই কথা মনে আসতে পারে।“(আঠারো/উনিশ/ভূমিকা)


এই আলোচনার পর হয়তো,বিষয়টিকে নিয়ে আর কিছু বলার থাকতো না,যদি না, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এর সম্পূর্ণ বিপরীত মত পোষণ করতেন।বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় প্রণীত রবীন্দ্র বিষয়ক চারটি গ্রন্হ-বিদ্রোহী রবীন্দ্রনাথ, রিয়লিস্ট রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্র সাহিত্যে পল্লি-চিত্র,রবিতীর্থে এবং অগ্রন্থিত আলোচনা’কবিগুরুর কৈফিয়ৎ’ সম্পাদনা করে একত্রে এনেছিলেন সত্যজিৎ চৌধুরী আর সুধীর চক্রবর্তী। সঙ্গে বিজয়লালকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলিকে গ্রন্হভুক্ত করে নাম দিলেন,’রবীন্দ্রনাথ’।মে, উনিশশো একানব্বই সনে প্রকাশিত গ্রন্থের ভূমিকা রচনার ভার নিয়েছিলেন সুধীর বাবু স্বয়ং।সেখানেই বিজয়লালের গদ্য এবং তার স্বরূপ সন্ধানে সুধীর বাবু উদ্ধৃত মন্তব্যগুলি প্রাসঙ্গিক বলে মনে করলেন।


বিজয়লালের রচনায় কী ছিল,আর কোন প্রসঙ্গে কবি এবং সম্পাদকের আপত্তি-ঘটনাটিতে প্রবিষ্ট হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে,অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত প্রণীত ‘সুন্দরের অভ্যর্থনা’গ্রন্হের কিছু অংশ মনে করে নেওয়া আশু প্রয়োজন। বিদগ্ধ রবীন্দ্রবিক্ষক ও .সি.গাঙ্গুলীর একটি ধারণার সঙ্গে তর্কের অবকাশে অলোকরঞ্জন লিখছেন,


“... কিন্তু মোডে বর্ণিত এই অনুচ্ছেদে রবীন্দ্রসমগ্রেরই একটি অনিবারণীয় অভিক্ষেপ হিসেবে চিত্রকলাকে দেখবার যে আয়োজন আছে,সেটি আমাদের কাছে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সমগ্রের মধ্যেই তো আছে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,’আত্মপ্রতিবাদের ঐক্য ‘,হুইটম্যানের সেই উন্মোচন যে,

Do I contradict myself?

Very well,then I contradict myself,

I am large, I contain multitude


ফলতঃ রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে ‘his pictorial experiments reveal a new personality which contradicts his political genius,his highly developed intellectual talents,”ও.সি-র এই অসহায় গোঁড়ামির প্রতিপাদ্য চূর্ণ হয়ে যায়।“(সুন্দরের অভ্যর্থনা:অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ,৩৯)


অলোকরঞ্জনের এই অভিজ্ঞান যেন যুগপৎ তছনছ করে দিতে চায় রবীন্দ্রনাথের অভিযোগ এবং সুধীর চক্রবর্তীর প্রণিধান।এই একই গ্রন্হে,এর পূর্ববর্তী প্রহরেই অলোক বাবু আরও এক কদম এগিয়ে রবীন্দ্রনাথ, প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং জীবনানন্দের ‘অন্তরঙ্গ ‘ হিসেবে হুইটম্যানকে উল্লেখ করে লিখছেন,


“তখনই রবীন্দ্রনাথ-প্রেমেন্দ্র-জীবনানন্দের অন্তরঙ্গ হুইটম্যানের ‘ভারতবর্ষের দিকে ‘কবিতাটিকে কেন্দ্র করে আমাদের মানসে কৌতুহল থাকে।পর-পর তিনটি বিস্ময়বোধক চিহ্ন প্রণয়ন করে তৎক্ষণাৎ তাদের পরিশিষ্টে তিনটি অমীমাংসিত প্রশ্নচিহ্ন বুনে দিয়েছিলেন:

আমরা কি গাছের মতো প্রোথিত হয়ে থাকিনি দীর্ঘ দিন?

লাঞ্ছনায় কাটেনি বুঝি নিছক জন্তুর মতো ক্ষুধা আর তৃষ্ণার তৃপ্তায়নে আমাদের কাল?

পুঁথি পড়ে যুগ যুগ আমরা কি হতবুদ্ধি আর তিমিরাচ্ছন্ন হয়ে থাকিনি?”...


আরও প্রতিবাদের মুখে পড়ে সুধীর চক্রবর্তী কৃত ভূমিকাটি।এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের হুইটম্যান ভাবনাও।বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়ের স্বপক্ষেই যেন নিজের চিন্তা স্বস্হ করলেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত।একই সঙ্গে দেখিয়ে দিতে চাইলেন,রবীন্দ্রনাথ যে অভিযোগ হুইটম্যানের কাব্য সম্পর্কে স্হাপন করেছেন,তার অনেকটাই সত্য হয়ে যায়,তাঁর সামগ্রিকে।


‘সুন্দরের অভ্যর্থনা’গ্রন্হের প্রণেতা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হুইটম্যানকে খুঁজে পাচ্ছেন তাঁদের, রবীন্দ্র কথিত,’আত্মপ্রতিবাদের ঐক্যে’। এই সূত্র ধরেই তবে বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়ের ধারণাকে, হুইটম্যান ও রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে, দেখে নেওয়া জরুরি বলেই বোধকরি। লিখছেন বিজয়লাল,


“আমেরিকার সাহিত্যে হুইটম্যান যে নূতন সুরটিকে জাগালেন,বাংলার সাহিত্যে সেই সুর জাগিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।হুইটম্যানের কবিতায় আমেরিকা যেমন তার পর্বত এবং সমুদ্র, অরণ্য এবং প্রান্তর,নদী এবং উপত্যকার পটভূমিতে সাধারণ মানুষকে নিয়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যেও বাংলাদেশ তেমনি তার পল্লবঘন আম্রকানন,দীগন্তব্যাপী উদার প্রান্তর নদীতীরের ছায়াময় নীলবনরেখা, জনহীন ভগ্নমন্দির...চখাচখির কাকলি-কল্লোলের পটভূমিতে সাধারণ বাঙালিকে নিয়ে জীবন্ত হয়ে দেখা দিয়েছে।“(রবীন্দ্র সাহিত্যে পল্লি-চিত্র; পৃঃ ১৫৯)।

হ্যাঁ,এ ভাষাকে ‘নন-একাডেমিক’বলতে দ্বিধা হয় না,যেমন বলেছেন ভূমিকা লেখক। আবার অতি উপমাময়,কাব্যিক বলেও আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। বিশ্লেষণাত্মক আলোচনাও নয়। অনেকাংশেই রবীন্দ্র সম্পর্কিত আলোচনার প্রাক্-পর্বের সংকটে আপন্ন হয়েছে এই ভাষা সঞ্চার,দর্শনও,সেটি একান্তই মুগ্ধতার সংকট। মনে পড়তে পারে, এক্ষেত্রে, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্র জীবনীর কথা। অপীচ,একই সঙ্গে একটি অতিদুরূহ সমস্যার সম্মুখীন করে দেয় উদ্ধৃত অংশের মূলপাঠখানি ,অর্থাৎ ‘রবীন্দ্র সাহিত্যে পল্লি-চিত্র’।


ভূমিকাতেই, অর্থাৎ সুধীর চক্রবর্তীর লিখনেই জানতে পারা যায়,

“রবীন্দ্র সাহিত্যে পল্লি-চিত্র ‘পড়ে তিনি(রবীন্দ্রনাথ) লিখেছেন,

...তোমাকে এই চিঠিতে আশীর্বাদ না করে থাকতে পারলুম না। আমার পল্লিচিত্র সম্বন্ধে তোমার বইখানি পড়ে বিশেষ খুশি হয়েছি তার কারণ এ নয় যে তুমি আমাকে প্রশংসা করেছ।“(বার/ভূমিকা)


অথচ,এই বইয়েই আগাগোড়া, প্রাবন্ধিক, আলোচনা করেছেন হুইটম্যানকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাযুজ্যে,সামীপ্যে। হ্যাঁ,এটাও একই সঙ্গে মনে পড়ছে যে,সেই রবীন্দ্র অসূয়ার যুগে,যিনিই রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা করেছেন,তাঁকেই কবি জানিয়েছেন সাধুবাদ এবং অনেক সময় শুধরেও দিয়েছেন। সুধীর বাবুর দীর্ঘ ভূমিকা সেই ইঙ্গিতও দেয়। কিন্তু, সমস্যাটা তৈরি হয় স্বতন্ত্র অবকাশে।হুইটম্যানের সঙ্গে তুলনা সত্ত্বেও ,আপত্তির পরেও রবীন্দ্রনাথকেও হয়তো একটি আত্মপ্রতিবাদের ঐক্যে আসতে হলো প্রশংসা বাক্যে! তাহলে, কি রবীন্দ্রনাথ ধরতে পারেননি হুইটম্যানের কবিতার মূল সুরকে এবং সেই ভ্রান্তির অনুগমন করলেন, ভূমিকা লেখকও?নাকী বিজয়লালের ভাবনা,অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের প্রণিধান তবে ‘স্হিতধী ও বিবেচক ‘সাহিত্য ভাবুক নন!


আরও বেশ কয়েকটি পরিসরে তৈরি হয় দ্বন্দ্ব।পল্লিচিত্র তো বটেই এমনকি উনিশশো বাষট্টিতে প্রকাশিত ‘রবিতীর্থে’ও মিলিয়ে দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ও হুইটম্যানকে।যার অনেকগুলো প্রবন্ধই যেমন,পলাতকা,জ্যাঠামশায় রবীন্দ্রপ্রশংসিত।গ্রন্হের শেষে ‘সংযোজন’ অংশে ব্যবহৃত রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি পত্র থেকে জানা যায়,কবি বিশেষ প্রীতিবোধ করতেন ১৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দে ‘দেশ ‘পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসেবে কর্মরত বিজয়লালের রবীন্দ্রবিচারের ওপর।


‘দেশ’পত্রিকার সহ-সম্পাদনাকালীন সময়ে বারংবার কবির সঙ্গে তাঁর পত্র আদান-প্রদানের বিশেষ পরিচয় রয়েছে সুসম্পাদিত গ্রন্হটিতে।এই কার্যকাল সম্পর্কে জানাচ্ছেন অন্যতম সম্পাদক সুধীর চক্রবর্তী,


“সম্পাদনার পাশাপাশি ‘দেশ’পত্রিকায় বেশ কয়েক সংখ্যা ধরে তাঁর রবীন্দ্র সাহিত্য সমালোচনা প্রকাশিত হতে থাকে।‘দেশ’পত্রিকায় প্রকাশিত বিজয়লালের রবীন্দ্রবিষয়ক রচনার সবকটি রবীন্দ্র -তোষণ নয়।, বরং অনেক ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্যের বিরোধিতাবহুল।তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ১৯৩৫ সালের ১১মে সংখ্যা ‘দেশ’পত্রিকায় প্রকাশিত বিজয়লালের রচনা ‘কবিগুরুর কৈফিয়ৎ ‘।“(ভূমিকা/৫)


এবং লক্ষ্যনীয় বিষয়,এই প্রবন্ধেও উপস্থিত হচ্ছেন হুইটম্যান।যদিও এই অবকাশে ‘দেশ’পত্রিকার সহ-সম্পাদক তথা ‘আনন্দবাজার’-এর সাংবাদিক বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় ‘জন ক্রিস্টোফার’কে সামনে রেখে ‘চার অধ্যায়’সম্পর্কে স্পষ্টতঃই জানাচ্ছেন,


“তিনি চারিদিকের লোকজনের অস্তিত্ব সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ হইয়া উক্ত উপন্যাসখানি সৃষ্টি করিয়াছেন।“(সংযোজন:৪২১)


সে স্বতন্ত্র প্রসঙ্গে প্রবেশ না করে,অলোকরঞ্জন -বিজয়লালের সহমত্যের আরেকটি জোরদার সাযুজ্য দেখে নেওয়া যাক। মনে রাখতে হবে অলোকরঞ্জন বাবু রবীন্দ্রনাথের ‘আত্মপ্রতিবাদের ঐক্যে’-র প্রসঙ্গে যে কবিতাটির অনুষঙ্গ ব্যবহার করলেন তা হুইটম্যানের ‘songs of myself ‘,অব্যবহিত পূর্বেই বিজয়লাল এই একই কবিতার সঙ্গে,অর্থাৎ উনিশশো বাষট্টিতে প্রকাশিত ‘রবিতীর্থে’, মিলিয়ে দিচ্ছেন,

রবীন্দ্রনাথের “জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ।

ধন্য হল ধন্য হল মানব জীবন”কে।উদ্ধার করছেন হুইটম্যান রচিত

‘swiftly arose and spread around me the peace and knowledge that pass all the argument of the earth,...”কে।


অর্থাৎ হুইটম্যান অনুরক্ত বিজয়লাল একটি বিতর্কের অবকাশ আজও জারি রাখছেন। হুইটম্যান ও রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে তাঁর ও অলোকরঞ্জনের প্রণিধানের সঙ্গে মধুর বিরোধ তৈরি হচ্ছে সুধীর চক্রবর্তীর বিজয় বাবুর এই চিন্তা সম্পর্কে ঈষৎ অবজ্ঞার। এবং যথারীতি ‘আত্ম-প্রতিবাদ’ সমেত হলেও সুধীর বাবু পাশে পেয়ে যাচ্ছেন স্বয়ং কবিকে।


২.

‘চারণকবি’ হিসেবে খ্যাত হয়েছিলেন আজন্ম রাজনৈতিক কর্মী বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়। জীবনানন্দের সমবয়সী কবি আঠেরোশো নিরানব্বইএর সেপ্টেম্বর মাসে কৃষ্ণনগরে। মূলত তিরিশের দশকে কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ।‘সবহারাদের গান ‘,’কালের ভেরী’ও ‘ডমরু ‘প্রকাশিত হয়,তখন তিনি ‘বঙ্গবাণী’পত্রিকার সহ-সম্পাদকের পদে কার্যরত।

এরপর উনিশশো তিরিশে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হলে বিজয়লাল সাংবাদিকতা ছেড়ে নদীয়াতেই আবার ফেরেন কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে। এইসময় অর্থাৎ উনিশশো একত্রিশে ‘বিদ্রোহী রবীন্দ্রনাথ ‘প্রকাশিত হয়। সুধীর চক্রবর্তী ভূমিকা থেকে জানা যাচ্ছে,


“বইটি ১৯৩২সালের ১৫ এপ্রিল বাজেয়াপ্ত হয় [section 19 of the Indian press (emergency power) ordinance act XXIII of 1931]”(চার/ভূমিকা)


উনিশশো বত্রিশে স্বগৃহে অন্তরীণ থাকার সময় গোপনে কৃষ্ণনগর পরিত্যাগ করে গ্রামান্তরে চারণের দায়িত্ব পালন করার সময় কারারুদ্ধ হন। অবশেষে ছয় জানুয়ারি, উনিশশো চৌত্রিশ থেকে ‘দেশ’পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। উনিশশো চল্লিশ পর্যন্ত আনন্দবাজার,প্রবাসী ও ভারতবর্ষের সঙ্গে সাংবাদিক হিসেবেও সংযোগ রেখেছিলেন বিজয়লাল। কিন্তু অদ্ভুতভাবে একটি বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে, তাঁর চারণ স্বভাব ছিল মূলগত।ভারভারা রাওয়ের মৃত্যুর এই অন্তর্বর্তী প্রহরে মনে করতে ভালো লাগে,বিজয়লাল চল্লিশের সেই আগলভাঙা টানে নিরাপত্তা অস্বীকার করে আবার রাস্তাতেই বিশ্বাস বাসলেন। নদীয়ার হাঁসখালী অঞ্চলে কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে শুরু করলেন চারণ আন্দোলন।তার জন্য সংগঠন গড়ে তোলা কিংবা চারণগান রচনা -সমস্ত ভারই ন্যস্ত করেছিলেন স্বস্কন্ধে। মনে রাখতে হবে ইতিপূর্বে তাঁর রচিত প্রতিটি কাব্যই কিন্তু বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। বিশেষ করে ‘সবহারাদের গান ‘তো পরবর্তী কালে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে,



গলায় জড়ায়ে ফাঁসীর রশিটি, অধরে করুণ হাসি, তরুণ পথিকা ব’লে যাও মোরে কারে এত ভালবাসি’। এমন করিয়া বিবাগী হইয়া ফাঁসীরে করিয়া নিলে, যৌবন-তরী মরণ-সাগরে হেলায় ভাসায়ে দিলে। তরুণ বয়স, রূপ-রস-ভরা এই ধরণীর গেহ, ধন জন মান, পরিচিত কত আপন জনার স্নেহ, তোমারে বাঁধিতে পারিল না কেহ, বীর সন্ন্যাসী, তুমি গাহিতে গাহিতে চ’লে গেলে “মোর জননী জন্মভূমি। স্বরগের চেয়ে গরীয়সী তুমি, পরাণ-শীতল করা, সকল সুখের বড় সুখ মাগো। তোমার লাগিয়া মরা।” ফাঁসীর মঞ্চে আজিকে তোমারে হেরি অপরূপ বেশে;(বিপ্লবীর প্রতি/সবহারাদের গান)


সমকালের রসিক পাঠকের কাছে এ কবিতা বিশেষ স্ফুর্তির কারণ হয়তো হতে পারবে না। রবীন্দ্রনাথ -নজরুলের অনুপ্রাণিত একটি ভাষা পাঠকের রুচিতে সাব্যস্ত হবে, সেইসাথে কবিতার কাব্যিক মূল্যও অনেকাংশে মিশে যাবে রবীন্দ্র অনুসরণের অভিধায়। এমনকি ১১/৩/৪১ তারিখে ১০/১/বি,আর.জি.কর রোড থেকে প্রেরিত একটি পত্রে রবীন্দ্রনাথের প্রতি একটি সনেট লিপিবদ্ধ করেন বিজয়লাল।‘রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্হে সংকলিত সে সনেটের পাঠ নিলেও অনেকটা একই অভিজ্ঞতা হয়

“দুর্গম পথের যাত্রী করিলে তাহারে

মৃত্যুর বন্দনা তব সংগীত -ঝংকারে।

নব্য ভারতের বুকে তব শঙ্খ রব

আনিল যুগান্তকারী বিপুল বিপ্লব।“


এ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলার অবকাশ অবশ্যই থেকে যায়। আমাদের পাঠপ্রক্রিয়া বহুরৈখিক।বহুবিধ সাপেক্ষ সূচকে একটা টেক্সটকে বিচার করতে হয় আমাদের।কোনও কোনও টেক্সট তাই ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে সার্থক হয়ে যায়।মনে রাখতে হবে,বিজয়লাল ছিলেন বিশেষ হুইটম্যান অনুরক্ত। তাঁর রচিত ‘বিদ্রোহী হুইটম্যান ‘সেই সাক্ষ্যই দেয়। ফলতঃ বিজয়লাল সমকালীন আন্তর্জাতিক কবিতা ও সাহিত্য সম্পর্কে বিশেষ অবগত ছিলেন,এ কথা অস্বীকার করা যায় না। বিশেষতঃ ‘রবীন্দ্রনাথ’গ্রন্হের ইতিউতি যখন ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর পাণ্ডিত্য ।এজরা পাউন্ড,রোমা রলা, ইবসেন,ব্রাউনিঙের নিবিড় প্রসঙ্গ,আরও অস্বীকার করা যায় না বিজয়লালের পাঠের ব্যাপ্তীকে।হ্যাভেলক এলিসের যৌন বিজ্ঞানও তাঁর পরিধির আওতায় ছিল। ফলতঃ এহেন,পাঠক,যখন কবির ভূমিকা পালন করছেন , এবং লিখছেন তাঁরই বহুপাঠপ্রাণিত,কিছুটা অনুসৃত লেখা,ধরে নেওয়াটা খুব অন্যায় হবে না,এটা ইচ্ছাকৃত।


আসলে কবিতার নান্দনিক বিনির্মাণে নিয়োজিত হওয়ার চাইতেও কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় অধিক আগ্রহী ছিলেন চারণধর্ম পালনে -বিশ্বাস করতে ভালো লাগে। রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরের রচনা সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন,

“কর্মজীবনের প্রলেপের মতো।“সেই টিপ্পনী যেন আরও প্রাসঙ্গিকতা পায় বিজয়লালের কবিতার পরিসরে। একান্তই টপিক্যাল করে তুলেছিলেন কবিতাগুলিকে। নজরুলের আত্মস্ফূরণ ও রোমান্টিকতার দ্বিরালাপকেও অনুপস্থিত দেখা যায়। প্রবন্ধ রচনা, সংগঠন,চারণ আন্দোলন ও রাজনীতিতে অধিক সক্রিয়তার কারণেই হয়তো কবিতার প্রতি তাঁর মনোযোগের অভাব টের পাওয়া যায়। কিন্তু ‘অভাব’বলাও কী যায়!টপিক্যাল কবিতা যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তা তো মাননীয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা বাংলা একাডেমি প্রাপ্তি বুঝিয়ে দেয়।


বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় উনিশশো বাহান্ন আর ষাটের নির্বাচনে কংগ্রেসের বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হন। উনিশশো ষাটে যক্ষারোগাক্রান্ত হন। উনিশশো চুয়াত্তরের আঠেরো ফেব্রুয়ারি পরলোক গমন করেন।

বিজয়লালের জীবন সম্পর্কে সুধীর চক্রবর্তীর একটি মন্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন,


“বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রসাহিত্য নিয়ে যাঁরা আলোচনা করেছেন এবং রবিকর-রেখা যাঁদের জীবনের পথ -নির্দেশ করেছে, তাঁদের মধ্যে বিজয়লালের জীবন সম্ভবতঃ সবচেয়ে ঘটনাবহুল,সক্রিয়, বিতর্কিত, বিচিত্র কর্মে উত্তাল এবং পরস্পরবিরোধী ভাবাদর্শে উদ্বেল।“(ছয়/ভূমিকা) আর এই কারণেই হয়তো বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় সমস্ত রবীন্দ্র আলোচকদের চাইতে স্বতন্ত্র হিসেবে মনে করছেন অনুজ কৃষ্ণনাগরিক সুধীর চক্রবর্তী।


এই আলোচকের আরও একটা নাম মনে পড়ছে, হরিনাথ মজুমদার। অবশ্য একই পঙক্তিভুক্ত হতে পারেন, ইতোপূর্বের হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ও। তিনজনের কাছেই সাংবাদিকতা আর সাহিত্য ছিল আক্ষরিক অর্থেই তলোয়ার। অনিঃশেষ লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন,এখানে ‘ইংরেজ’ বলে শাসক বা শাসনকে সীমাবদ্ধ করতে চাইছি না,শাসকের বিরুদ্ধে। হরিশ্চন্দ্র -হরিনাথ-বিজয়লাল,তিনজনেই এই একটি ক্ষেত্রে সামীপ্য তৈরি করলেও কবি-ধর্মে অবশ্য বিজয়লাল -হরিনাথের সম্পর্ক অধিক নিকট।


৩.

হয়তো বা যুগের প্রয়োজনে বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় কবি হিসেবে চিহ্নিত হবেন। কিন্তু তাঁর সারাজীবনের সাহিত্য -চিন্তার মূল প্রেক্ষণটি ছিল কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে লক্ষ করেই। এবং এ কথা বলা, বিশেষ অসংগত হবে না যে, রবীন্দ্রনাথের প্রয়োজন ছিল বিজয়লালকে। এখানে ব্যাক্তি সার্থের প্রসঙ্গ আসছে না। বোধহয় এভাবে বললে সার্থকতা আসতে পারে, রবীন্দ্র সাহিত্যের প্রয়োজন ছিল বিজয়লালের দেখার চোখ।


একটি তথ্য দিলে, বক্তব্যটি বিশদ করতে সুবিধা হবে।বিজয়লালের ‘বিদ্রোহী রবীন্দ্রনাথ ‘(১৯৩১)

প্রকাশের আগে, মুষ্টিমেয় রবীন্দ্রবিষয়ক গ্রন্হের সন্ধান পাওয়া যায়।তার মধ্যে অবশ্যই অজিত কুমার চক্রবর্তীর রবীন্দ্রনাথ (১৯১২) উল্লেখযোগ্য।এ প্রসঙ্গে আবারও সুধীর চক্রবর্তী সমীপে গেলে, তিনি জোরের সঙ্গেই জানান,


“যাঁদের আমরা প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্রসাহিত্য সমালোচক বা রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ বলে জানি তাঁদের মধ্যে কেউই বিজয়লালের আগে উল্লেখযোগ্য রবীন্দ্রবিষয়ক গ্রন্হ লেখেননি।এই তালিকায় চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়,নীহাররঞ্জন রায়,প্রমথনাথ বিশী,প্রবোধচন্দ্র সেন প্রভৃতি আরও আছেন।“(আট/ভূমিকা)


এবং আরও এক পা এগিয়ে বিজয়লালের রবীন্দ্র আলোচনার তিনটি উল্লেখযোগ্য বিশেষত্ব আরোপের পর, তৃতীয় বিশেষত্বটির ওপর জোর দিয়ে জানান,যখন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য পাঠকের কাছে, সমালোচকের কাছে সংশয়-স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের মোহন ফাঁদে হাবুডুবু খাচ্ছে আলোচনা,বিজয়লাল আন্তরিক মৌলিকতায় ও দ্বিধাহীন দৃঢ়তায় রবীন্দ্র সাহিত্যের বহুব্যাপ্তিকে ফুটিয়ে তুলেছেন।


সেইসাথে এইটুকুও যোগ করা যায়, তাঁর আপাত –‘নন-একাডেমিক’ চিন্তাগুলিও প্রবলভাবে আচ্ছন্ন করে পরবর্তী আলোচকদেরও।অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের প্রণিধান এই সংযুক্তিকে সমর্থন করবে।


সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা উল্লেখযোগ্য সংযোজন প্রয়োজন। সম্ভবতঃ ‘রিয়লিস্ট রবীন্দ্রনাথ ‘রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্যের আলোচনার পূর্ণাঙ্গ গ্রন্হ।ইতিপূর্বের আলোচনাগুলি প্রধানত রবীন্দ্রনাথের কবিতাকেই লক্ষে রেখে রচিত হয়েছে।ফ্রয়েডের সূত্রানুযায়ী বিশ্লেষণে সম্ভবত প্রীত রবীন্দ্রনাথ লেখককে একটি চিঠিতে লেখেন,

“তোমার ‘মনের খেলা ‘বইয়ে সরল ভাষায় সরসভাবে মনস্তস্ত্ব আলোচনা করেছ –‘রিয়লিস্ট রবীন্দ্রনাথ ‘গ্রন্হে সেই তত্ত্ব বিচারকে যেন রান্নাঘর থেকে এনে ভোজের সভায় সাজিয়েছ।“(শান্তিনিকেতন:৭/১০/৩৬)।


এই গ্রন্হের ‘দুই বোন ‘, ‘মালঞ্চ ‘,’বাঁশরী’,’চার অধ্যায়’,’শেষের কবিতা ‘সম্পর্কে আলোচনা রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিকতার দিকে বাঙালির পাঠষ্ক্রিয়াকে এগিয়ে দিয়েছিলো। রবীন্দ্রনাথ কেবল কবি নন,নাটককার,সংগঠক, ছোটোগল্পকার,প্রাইমার রচয়িতা, ছোটগল্প লেখক,ঔপন্যাসিক,চিত্র শিল্পী, প্রাবন্ধিক -এই সমস্তটা মিলিয়েই তবে রবীন্দ্রনাথ।একটি পুঞ্জ পুঞ্জ রঙের সামগ্রিক সমাহার।সর্বজনীনতায় তাঁকে না পড়লে,অধিত করতে পারার বিশেষ সম্ভাবনা নেই বলেই বিশ্বাস। আবার এই প্রসঙ্গে ‘রবিতীর্থে’-র ‘জ্যাঠামশায়’নামক নিবন্ধটিকে বিশেষভাবে স্মরণ করা যায় ‌‌‌‌,


“জ্যাঠামশায়ের ভাষায়”আমাদের নাস্তিকের ধর্মশাস্ত্রে ভালো কাজের জন্য নিন্দার নরকভোগ বিধান।“যারাই সমাজের পুরাতন আদর্শকে বর্জন করে নূতন আদর্শকে সৃষ্টি করবে তাদের ভাগ্যেই নিন্দা আর লাঞ্ছনা অনিবার্য।এই সত্যকে নীটসে অনেক দিন আগেই ঘোষণা করেছেন।“the good must crusify him that inventeth for himself his own virtue! That is truth.”।(জ্যাঠামশায় /রবিতীর্থে/২৫৮-৫৯)


সত্যের এই সূত্রে নাস্তিক্য ধর্মের উদগাতা,ধর্মের স্বরূপে আঘাত হানা জ্যাঠাশায়কে নীটশের সঙ্গে একীভূত করে দেন কেবল তাই নয়, ভাঙনের প্রবণতায় তিনি জ্যাঠামশায়ের মধ্যে পেয়েছিলেন নীটশের এই আহ্বানবাণীকে,


“Break,break the good and righteous!o my brethren, have ye understood this word?”(জ্যাঠামশায়/ রবিতীর্থে/২৫৯)


এই বজ্রঘোষণাকে রবীন্দ্রনাথ মূর্ত করেছিলেন তুমুল নাস্তিক্য ধর্মের প্রেরণায়। বস্তুত সজীবের প্রতি প্রীতিমানসে জ্যাঠামশায় যে বিবর্তিত কালের ধ্রুব স্বরূপ তা বুঝতে পেরেছিলেন লোকজ্ঞান সম্পন্ন বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়। মানুষের,লোক মানুষের দৃষ্টি যেদিকে ফিরছে এবং যেদিকে ফিরবে,তা, বুঝতে দ্বিধা করেননি বলেই জ্যাঠামশায়কে অদূরযুগচরিত্র হিসেবে, চিহ্নিত করে, রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিপন্ন করতে পেরেছিলেন। আবার লক্ষ করা যায়, এরপরের আলোচনা ‘চতুরঙ্গের রবীন্দ্রনাথ ‘-এ অনাসক্তির আদর্শে শচীশ আর ঔপন্যাসিককে এক করে দিচ্ছেন।শচীশ আত্মোপলব্ধির গভীর রাতে যে কথাগুলো শ্রীবিলাস আর দামিনীকে বলেছিল,তারই প্রতিধ্বনি শুনতে পান ‘religion of man’-এ,

“The abinding cause of all misery is not so much in the lack of the life’s furniture as in the obscurity of life’s significance.”(রবিতীর্থে/২৬৭)


আসলে, একটা টেক্সট অজস্র সাবটেক্সটের দাবি করে। এবং তার পাঠপ্রক্রিয়ার সময় সেই টেক্সটগুলো তুলনাত্মকতা তৈরি করলে পাঠের সামগ্রিক নির্মীত হতে পারে। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি তো অত্যন্ত জরুরি। অন্ততঃ এই গ্রন্হের পাতায় পাতায় অজস্র রেফারেন্সে তাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন।এই গ্রন্থ পাঠের সঙ্গে সঙ্গে পাঠককেও শিক্ষিত হয়ে উঠতে হয়।


এই সূত্রেই ‘বিদ্রোহী রবীন্দ্রনাথ ‘আলোচিত হওয়া প্রয়োজন। অন্ততঃ এই কৌতুহলের তাগিদে তো বটেই -গ্রন্হের নিষিদ্ধকরণ দুর্লভ না হলেও গ্রন্হের আলোচনার বই বাজেয়াপ্ত হয়েছে,এ সচরাচর জানা যায় না। হয়তো এ কারণেই বাজেয়াপ্ত হয়েছিল -বিজয়লাল ‘ফাল্গুনী’র রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ‘songs of the open road -এর রবীন্দ্রনাথকে মিলিয়ে দিয়ে লেখেন,


“বাংলার যৌবনের কানে বিদ্রোহের বাণী দিয়াছেন রবীন্দ্রনাথ।যেখানে পুথির শাসন ছিল সেখানে তিনি প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন প্রাণের রাজত্ব...”।(বিদ্রোহী রবীন্দ্রনাথ/৪৫)

হয়তো বা রবীন্দ্রসাহিত্যের স্বরূপ প্রতিষ্ঠানের সার্থগুলির সঙ্গে একমত হচ্ছিল না। কিন্তু এই আলোচককের আগ্রহ এই গ্রন্হেরই অন্যত্র।


চতুর্থ প্রস্তাবে গ্রন্হকার রবীন্দ্রনাথের তত্ত্ব নাটক গুলির অন্যতম ‘মুক্তধারা’এবং ‘রক্তকরবী’ সম্পর্কে প্রসঙ্গক্রমে আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন। ‘মুক্তধারা’র বিভূতির স্বরূপ নির্ণয় করতে গিয়ে বলছেন,


“বিভূতি কলকারখানাবহুল শক্তিমদমত্ত পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতীক”(বিদ্রোহী রবীন্দ্রনাথ/৩১)

ঠিক একইভাবে বিভূতিকে নির্ণয় করছেন পরবর্তীর রবীন্দ্র আলোচকেরা, এবং বিভূতি যে একটি প্রতীক চরিত্র,তারও নিশ্চয়াত্মক আলোচনা দুর্লভ নয়,যার সূত্র লেখা পাওয়া যায় বিজয়লালের চকিত আলোচনা গুলিতে।আরও একটি বিষয় এক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়,যে প্রতীক প্রবণতা হেতু রবীন্দ্র তত্ত্ব নাটকগুলোর সাংকেতিকতা এবং রূপক ধর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।যে শ্রেণির নাটককে প্রমথনাথ বিশী ‘তত্ত্বনাট্য’বলে নির্দিষ্টিকৃত করতে চেয়েছেন, তার উল্লেখ সেই রবীন্দ্র আলোচনার প্রথম প্রহরেই তুলে ধরছেন বিজয়লাল এবং একই সঙ্গে বিস্মিত হই , ‘মুক্তধারা’আর অভিজিতের সম্পর্কের আভ্যন্তরীন ব্যপ্তীকে স্পর্শ করেন বিজয়লাল কোনও রকম তাত্ত্বিক আভাস ব্যতিরেকেই। সহজাতভাবে বলে দেন রবীন্দ্রনাথের তত্ত্ব নিরপেক্ষ ব্যখ্যা,


“অভিজিৎ যন্ত্রাসুরকে আঘাত করিলেন,যন্ত্রাসুরও তাঁহাকে সেই আঘাত ফিরাইয়া দিল।তখন মুক্তধারা সেই আহত দেহকে মায়ের মতো কোলে তুলিয়া লইয়া চলিয়া গেল।“(বিদ্রোহী রবীন্দ্রনাথ/৩১)


এই ভাষ্যেই কথা বলে ওঠেন যেন পরবর্তীর রবীন্দ্র গবেষকও,


“ইহাতে কি (অভিজিতের) মৃত্যু হইল ?আহা তো মৃত্যু নয়,আহা যে মায়ের কোলে প্রত্যাবর্তন। সন্তানের এত বড় মুক্তি -সাধনার পর মা তাহাকে আর দূরে রাখিতে পারিল না, নিজের স্নেহশীতল বুকের মধ্যে টানিয়া নইল।(বাংলা নাটকের ইতিহাস: রবীন্দ্রনাথ: পৃঃ ৩০৮:ড.অজিতকুমার ঘোষ,১৯৪৬)।


আনন্দের এখানেই বিজয়লালের তথাকথিত ‘নন-একাডেমিক’আলোচনাও কিন্তু একাডেমিক তাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণের অনুপ্রেরণা বলছি না,পূর্বসূত্র হয়ে যেতে পারে। আবার দেখুন,আমরা,নাটকটিকে যাঁরা দেখছি,বা,পড়ছি, তাঁদের কাছে, অভিজিতের মুক্তধারায় ঝাঁপিয়ে পড়াটা মৃত্যুর দ্যোতনা এনে একটি পরিশুদ্ধি ঘটায়। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, দেখুন,এই দুই রবীন্দ্র -চাক্ষিকই কিন্তু অভিজিতের আত্ম’বলিদান’স্বীকার করছেন না। একধরনের রেজারেকশন দিতে চাইছেন। অভিজিৎ -কে প্রতীকে ভাবতে গেলে এই দৃষ্টি ব্যতীত গত্যন্তর ছিল না হয়তো।


৪.

রবীন্দ্রনাথকে তাঁর সম্পূর্ণতায় পড়ার চেষ্টা করেছিলেন বিজয়লাল। বুদ্ধদেব বসু আমাদের রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পের সঙ্গে ‘ছিন্নপত্র’কে মিলিয়ে পড়তে শিখিয়েছিলেন ‘ রবীন্দ্রনাথ : কথাসাহিত্য’(১৯৫৫)-তে। তাঁরই সমকালীন আলোচক বিজয়লালের ‘রবিতীর্থে’(১৯৬২) সংকলিত ,পূর্বে রচিত ,’ছিন্নপত্রের রবীন্দ্রনাথ ‘ শীর্ষক নিবন্ধে আমরা সেই চিন্তারই আভাস পেয়ে থাকি।‘ছিন্নপত্র’-এর সঙ্গে ‘সোনার তরী’,’বলাকা’-কে মিলিয়ে নেওয়ার পর ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে কালীগ্রাম থেকে লেখা সেই বিখ্যাত চিঠির,


“এই-যে মস্ত পৃথিবীটা চুপ করে পড়ে রয়েছে, ওটাকে এমন ভালোবাসি...(ছিন্নপত্রাবলী। ) অনুরাগের সঙ্গে মিল পেয়ে যাচ্ছেন ‘কাবুলিওয়ালা’-র রহমতের । আবার ১৮৮৮ খ্রীষ্টাব্দে শিলাইদহ থেকে লেখা চিঠির বর্ণনার সঙ্গে মিল পাচ্ছেন ‘চতুরঙ্গ’-এ বর্ণিত সেই বালুচরের বর্ণনাটির।যেখানে অভুক্ত দামিনী হাঁটু জল ভেঙে খাবারের থালা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে শচীশের কাছে।


বুদ্ধদেব বসুর মতোই বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়ও রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য অনুভবের জন্য ‘ছিন্নপত্র’কে অত্যন্ত জরুরি পাঠ বলে মনে করিয়ে দিয়ে বলছেন,

“ছিন্নপত্রে-র মধ্যে”ছায়াময় নদীস্নেহবেষ্টিত প্রচ্ছন্ন”বাংলার পল্লি-প্রকৃতির যে বিচিত্র বর্ণনার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে,সেই বর্ণনাগুলিই রবীন্দ্রনাথের নানা উপন্যাসে ,নানা কবিতায়,নানা সংগীতে নব নব ভঙ্গিতে প্রকাশ পেয়েছে।তফাত কেবল ভাষায়,বর্ণণার বিষয়বস্তু একই‌।এই faculty of absorption প্রতিভার একটি বৈশিষ্ট্য।“( রবিতীর্থে/৩৫২/ছিন্নপত্রের রবীন্দ্রনাথ)।


রবীন্দ্র-সাহিত্যে এই faculty of absorption টি ভীষণ ভালোভাবে নির্ণয় করতে পেরেছিলেন বিজয়লাল। আগাগোড়া প্রাবন্ধিক বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় এই নির্ণয়টিকে স্হির রেখে এগিয়েছেন। ফলতঃ রবীন্দ্র আলোচনার প্রাক -পর্বে রবীন্দ্রনাথের ব্যাপ্তীকে নির্ণয়-ঋত্বিক হিসেবে বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়কে চিহ্নিত করাই যায়।




৫.

কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় বিশদ পাঠ্য নন এখন। এমনকি তাঁর প্রবন্ধের বইগুলোও আর পাওয়া যায় না।সবেধন নীলমণি এই ‘রবীন্দ্রনাথ’সংকলনটি। অত্যন্ত সুসম্পাদিত,প্রত্যেকটি রচনার সালতামামি সহ পরিচয় নিখুঁত। সঙ্গে বাড়তি পাওনা রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলি। কিন্তু এই বইও এখন সহজপ্রাপ্য নয়।অথচ রবীন্দ্রআলোচনার প্রাক পর্বের চিন্তা হিসেবে এ গ্রন্হের ভূমিকা যেমন অপরিসীম, তেমনই ভারতীয় স্বাধীনতা পর্বের ইতিহাসে বাড়তি তথ্য -রবীন্দ্রনাথের কাব্য আলোচনাকেও নিষিদ্ধ করতে হয়েছিল। রবীন্দ্র সাহিত্য কেবল নয় সাহিত্য আলোচনাও তখন এতটাই স্পর্শকাতর হয়ে পড়েছিল! রবীন্দ্র কথাসাহিত্য আলোচনার সূত্রপাত হয় সম্ভবতঃ যে গ্রন্হে ,তার নিবিড় পাঠ এই জরুরি বোধহয়। কেননা, রবীন্দ্রনাথ আসলে সামগ্রিক এক বিশ্ব,যার নির্মাণ -বিনির্মাণ এবং প্রতিনির্মাণ সঞ্চিত রয়েছে তারই অভ্যন্তরে, রবীন্দ্রনাথ পাঠ কেবল রবীন্দ্রনাথেই সীমাবদ্ধ থাকে না,এই চিন্তা আরও বিকল্পের দিকে নিয়ে যায়-এই বক্তব্য বাঙালির পাঠপ্রক্রিয়ায় ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন প্রাবন্ধিক বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়ের অধুনালুপ্ত বইটি ফিরে আসুক নতুন করে। রবীন্দ্র চর্চায় তৈরি হোক নতুন তর্ক।



গ্রন্থপঞ্জী:


রবীন্দ্রনাথ:বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়: সম্পাদনা -,সত্যজিৎ চৌধুরী সুধীর চক্রবর্তী: পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ মে ১৯৯১
সুন্দরের অভ্যর্থনা:অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত: রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়: কলকাতা:১৯৯৭
বাংলা নাটকের ইতিহাস:ড.অজিতকুমার ঘোষ: চতুর্থ দে’জ সংষ্করণ: সেপ্টেম্বর ২০১৪
রবীন্দ্র রচনাবলী:১২৫ তম রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ:পৌষ ১৪১৫
রবীন্দ্রনাথ: কথাসাহিত্য: বুদ্ধদেব বসু:নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড:২০০২

0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in

 














৩৫



ফিঙ্কের সম্পত্তির বহর দেখে ফাইনহালসের চোখের পলক পড়ছিল না। সামনে অবশ্য অপরিসর একটা পুরনো বাড়ি, যেটার গায়ে সাইনবোর্ড লাগানো আছে… ‘ফিঙ্কের পানশালা ও সরাইখানা ১৭১০ সালে প্রতিষ্ঠিত’। একটা লড়ঝড়ে সিঁড়ি, যেটা রেস্তরাঁয় উঠে গেছে। দরজার বাঁয়ে একটা জানালা, ডানদিকে দুটো জানালা। ডানদিকের শেষের জানালার পর থেকেই শুরু হচ্ছে ওয়াইনের খামার। একটা সরু গেট সবুজ রঙ করা, যার মধ্য দিয়ে অতিকষ্টে একটা গাড়ি ঢুকতে পারে।

কিন্তু এখন, গেট খুলে ভেতরে ঢুকে সামনের করিডোর পেরিয়ে বিশাল উঠোনটা দেখে সে থমকে দাঁড়াল। চতুষ্কোণ উঠোন ঘিরে নতুন ঝকঝকে কিছু বিল্ডিং। দোতলায় কাঠের রেলিং দেওয়া টানা বারান্দা সব কটা বিল্ডিংএ। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে আরেকটা গেট খুলে দিলে আরেকটা উঠোন। সেটা ঘিরে কিছু ছাউনি দেওয়া ঘর। ডানদিকে একটা একতলা বাড়ি। দেখে মনে হচ্ছে একটা বিশাল হলঘর সেই বাড়িটার মধ্যে। সে সবকিছু ধীরে সুস্থে দেখতে লাগল; কান পেতে শুনবার চেষ্টা করল কোনো শব্দ পাওয়া যায় কি না। তারপর দু’ জন আমেরিকান রক্ষীকে দেখে আবার থমকে দাঁড়াল। দ্বিতীয় উঠোনের সামনে এরা পাহারা দিচ্ছে। একটা নির্দিষ্ট ছন্দে কিছুক্ষণ পর পর একজন আরেকজনকে অতিক্রম করে যাচ্ছে পায়চারি করতে করতে। বন্ধ খাঁচার মধ্যে দু’খানা জানোয়ার একসঙ্গে থাকলে এমন হয়, দেখেছে ফাইনহালস। একজন চশমা পরা, ঠোঁট নড়ছে ক্রমাগত, কিছু মুখে নিয়ে চিবাচ্ছে লোকটা। আরেকজন সিগারেট খাচ্ছে। দু’জনেরই ইস্পাতের হেলমেট একটু আলগা করে পেছনে হেলানো। দু’জনকেই ভারি ক্লান্ত দেখাচ্ছে।

ফাইনহালস বাঁয়ে দরজাটার পাল্লায় একবার ধাক্কা দিল। দরজাটার গায়ে লেখা আছে ‘ব্যক্তিগত’। ডানদিকের দরজার গায়ে অতিথিশালার সাঙ্কেতিক চিহ্ন আঁকা আছে। দুটো দরজাই বন্ধ। সে কিছু সময় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করল। রক্ষীদের পায়চারি করা দেখল। নৈঃশব্দ্যের মধ্যে দূরে কোথায় যেন বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল। বল ছোঁড়ার মত গ্রেনেড ছোঁড়া শুরু হয় অনেক সময়। দরকার না থাকলেও ছোঁড়া হয়। লড়াইয়ের জন্য নয় সব সময়; কতকটা হল্লা করার জন্য, শব্দ করে করে ভয়টা জিইয়ে রাখবার জন্য। যেন ঘোষণা হয়ে চলেছে সব সময়… ‘যুদ্ধ, এটা যুদ্ধ। হুঁশিয়ার, যুদ্ধ!’ পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে শব্দগুলি প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। ফলে এমনিতেই শব্দ বেড়ে যাচ্ছিল। কিছু সময় পরে ফাইনহালস বুঝতে পারল যে জার্মানদের দিক থেকে কোনো গোলাগুলি ছোঁড়া হচ্ছে না। আমেরিকানরা একতরফা গ্রেনেড ছুঁড়ে যাচ্ছে।

সেই অর্থে কোনো গুলিবিনিময় হচ্ছে না কোথাও। একতরফা ভাবে বিস্ফোরণের শব্দ নদীর ওপারে শান্ত পাহাড়ি প্রকৃতির মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন হুমকির পরিবেশ জারি রাখবার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। ফাইনহালস ধীরে ধীরে করিডোরের একদম অন্ধকার প্রান্তে গিয়ে দাঁড়াল। বাঁয়ে একটা সিঁড়ি মাটির নিচে সেলারের দিকে গেছে। ডানদিকে একটা ছোট দরজা, যেটার উপরে একটা কার্ডবোর্ড পেরেক দিয়ে আটকানো আছে। কার্ডবোর্ডের উপরে লেখা ‘রান্নাঘর’। ফাইনহালস রান্নাঘরের দরজায় টোকা দিল।

খুব ক্ষীণ একটা শব্দ শুনতে পেল সে… ‘ভেতরে আসুন।’

হাতল ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকে সে চারটি মুখ দেখতে পেল। চারটি মুখের মধ্যে দু’টি মুখের সঙ্গে সেই মুখটির সাদৃশ্য দেখে সে চমকে উঠল। কতটুকুই বা সে দেখেছিল সেই প্রাণহীন, ক্লান্ত মুখটিকে? হাঙ্গেরিয়ান গ্রামের এক তৃণভূমিতে, লালচে আগুনের আভায় সে দেখেছিল তাকে। এখন এখানে মুখে পাইপ নিয়ে জানালার কাছে বসে থাকা এই বৃদ্ধ লোকটিকে দেখতে অনেকটা সেই মুখের মত; সেও এমনি রোগা আর বুড়োটে গড়নের হালকা চেহারার ছিল আর চোখে ছিল এক ক্লান্ত জ্ঞানী ভাব। দ্বিতীয় যে মুখের সঙ্গে সেই মুখটির সাদৃশ্য দেখে সে ভয় পেল এখন, সেটা হল একটা বাচ্চা ছেলের মুখ। কত আর বয়স হবে বাচ্চাটার? বছর পাঁচ ছয়েক। বাচ্চাটা হাতে একটা কাঠের খেলনাগাড়ি নিয়ে মেঝেতে কুঁকড়ে বসে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। বাচ্চাটারও রোগাপাতলা গড়ন। মুখের ভাব কেমন বুড়োটে, ক্লান্ত, জ্ঞানী ধরনের; গাঢ় রঙের চোখের মণি, একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকে দেখে তারপর উদাসীনভাবে চোখ নামিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে খেলনাগাড়িটা মেঝেতে ঘষে ঘষে চালিয়ে খেলতে থাকে বাচ্চাটা।

দু’জন মহিলা টেবিলে বসে আলুর খোসা ছাড়াচ্ছিল। একজন বয়স্ক, তার মুখ চওড়া, বাদামি গায়ের রঙ, ভালো স্বাস্থ্য। খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে অল্প বয়সে খুব রূপ ছিল তার। পাশে যে মহিলা বসে আছে, সে ফ্যাকাসে আর বুড়োটে চেহারার। খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে যতটা বুড়োটে দেখাচ্ছে, সে আসলে তত বয়স্ক নয়। আসলে মহিলার বয়স অল্প। কিন্তু খুব ক্লান্ত আর বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। হাতের নড়াচড়াও ক্লান্ত এবং দ্বিধাগ্রস্ত। ব্লন্‌ড সোনালি চুলের গোছা ফ্যাকাসে কপাল পেরিয়ে এলোমেলো হয়ে মুখের উপরে পড়েছে। কিন্তু বয়স্ক মহিলার চুল আঁচড়ে সুন্দর পরিপাটি করে বাঁধা।

‘সুপ্রভাত!’ বলল ফাইনহালস।

‘সুপ্রভাত!’ তারা উত্তর দিল। ফাইনহালস ঘরে ঢুকে তার পেছনে দরজাটা বন্ধ করল। একটু ইতস্তত করে সে প্রথমে একটা খাঁকারি দিয়ে গলাটা সাফ করে নিল। তারপর সে অনুভব করল যে সে ঘামছে। ঘামের স্রোতে পরনের শার্টটা বগলের কাছে আর পিঠের কাছে একেবারে তার শরীরে লেপটে বসেছে।



(চলবে)    





0 comments:

0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in




















(১১)

রামমোহন মূলতঃ তাঁর নৈশকালীন পাঠাভ‍্যাসেই আকৈশোর অভ‍্যস্ত বলে গভীর রাত্রের প্রায় তৃতীয় প্রহরের আগে তিনি দুগ্ধফেনিভ শয‍্যার আলিঙ্গনে সাড়া দিতে পারেন না। এই অদ্ভূত আচরণটিতে যদিও তাঁর পরিবারের সদস‍্যরা এখন আর বিশেষ অবাক হন না।

তাই সাধারণতঃ এমন পাঠনিবেশের প্রগাঢ় ইচ্ছে হলে এসব সময়ে তিনি পুস্তক পাঠের সাথে একটি স্ফটিক নির্মিত পাত্রে বিশেষ ধরণের একপ্রকার বিলাতী 'কনিয়াক্' জাতীয় পানীয় কখনো কখনো সামান‍্য পরিমাণে পান করে থাকেন।

অবশ‍্য তাঁর এই মদিরা পানের অভ‍্যাসটি যতটা মস্তিষ্কের চাঞ্চল‍্য দূরকারক ততটা অবশ‍্য সাধারণ শীধুপায়ীদের প্রচলিত নেশাচ্ছন্নতার জন‍্য নয়।

তিনি সম্প্রতি লোকমুখে শুনেছেন যে বন্ধুবর দ্বারকনাথও অল্পমাত্রায় শেরী পান করে কখনও কখনও ব‍্যবসা ও জমিদারী সংক্রান্ত ঐহিক ক্লান্তি দূর করে থাকেন।

.........

মৃদু আলোকোজ্জ্বল তাঁর এই বসবার ঘরটিতে রাখা মখমল শোভিত আরামকেদারাটিতে বসে মৃদু পানীয় সেবন সহ পাঠময়তা তাঁর মনোজগতে সর্বদা স্থিরতা এনে দেয় বলে তিনি কখনো নেশাতুর হননা।

বরং এইসব সময়ে অন‍্যসব স্নায়বিক দৌর্বল‍্য কাটিয়ে তিনি অনর্গল ও সাবলীল উচ্চারণে মার্কন্ডেয় পুরাণের সংস্কৃতভাষার শ্লোকগুলি অথবা পারস‍্যদেশীয় ভাষায় রচিত জরথুস্ট‍্রীয় ধর্মাবলম্বীদের ধর্মগ্রন্থ " জেন্দ - আবেস্তা " থেকে গূঢ় উদ্দীপক কথামালাগুলি সচেতনভাবে আবৃত্তি করতে পারেন বলে নিজেই ঈষৎ গর্ববোধ করেন।

.......

শেষরাতের মৃদু হাওয়ায় সূতিকার পর্দাগুলি কাঁপছিল বলে তিনি শান্ত পদক্ষেপে কেদারা থেকে উঠে এসে জানালার কাছটিতে এসে দাঁড়ালেন।

এখন তাঁর মস্তিষ্কের মধ‍্যে কেবল সতীদাহ প্রথার আপাত নির্মমতার আড়ালে বৈবাহিক সূত্রে লভ‍্য দূরাচারী আত্মীয়দের দ্বারা মৃত স্বামীর বিষয় সম্পত্তি থেকে বিধবা বধূটিকে বঞ্চিত করবার এই জঘন‍্য লোকাচারটির বিরুদ্ধমত সংগ্রহের সংবেদী তালিকাটি নিয়ে বিশেষভাবে আলোড়ন চলছে।



আসলে তিনি আর কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না দরিদ্র ও অশিক্ষিত জনসমাজের এই কলঙ্কটি উচ্ছেদ করতে গিয়ে যে বেশী সংখ‍্যক প্রতিপত্তিশীল মানুষদের এখন সহমত প্রয়োজন তারই অপ্রতুলতাজনিত বিরোধাভাসটিতে তিনি বড়ই আশাহত।

এ প্রসঙ্গে যেটুকু সমর্থন তিনি আজ অবধি যোগাড় করতে পেরেছেন তার পরিণামটিও বড় সামান‍্য যে সাগরের তুলনায় তার পরিমাণ গোস্পদের তূল‍্য বলা যায়।

....

বেলজিয়াম থেকে সংগৃহীত আরশির বুকে সহসা এক বধূবেশী কিশোরীর একটি মুখচ্ছবি ভেসে উঠতে দেখে তিনি আজ যেন বড় বিস্মিত বোধ করলেন। বিলীয়মান প্রতিবিম্বের মত সেই বালিকাটির অবয়ব যেন তাঁর খুব পরিচিত।

তখনই স্মরণে এল এই বালিকাটি তাঁর প্রাকযৌবনে খানাকুলের এক মাতৃহারা কিশোরী ব্রাহ্মণ তনয়া। বালিকাটি একদা তাঁর মাতা তারিণী দেবীর প্রশ্রয় পেয়ে তাঁকে প্রায়শই মাতৃজ্ঞানে সম্ভাষণ করত বলে তিনিও তাকে অনুজার তূল‍্যই প্রশ্রয়ে অনেকবার তার অতিপ্রিয় স্বাদু তিন্তিড়ি অথবা পেয়ারা সংগ্রহ করে এনে দিয়ে বড়ই মজা পেতেন।

ঘটনাচক্রে সেই কিশোরীর অগ্রদ্বীপ নিবাসী অন‍্য এক প্রবীণ ও প্রায় পিতৃবয়সী এক কূলীন ব্রাহ্মণের সাথে বিবাহ হয়ে গেলে তিনি মনে মনে বড়ই বেদনা অনুভব করলেও প্রকাশ‍্যে তার বিরোধাভাস করতে পারেন নি। আসলে সেই সময় তিনিও যে আজকের পরিণতমনস্ক ও ধী-মান যুবক রামমোহন হয়ে ওঠেন নি।

....

তবে তাঁর মনোজগতে তখন থেকেই প্রচলিত সমাজব‍্যবস্থার প্রতি বিপ্রতীপ ভাবনাগুলি সবেমাত্র জারিত হতে শুরু করেছে। এই অসমবয়সী বিবাহটির অব‍্যবহিত কাল পরে তাঁরই প্রত‍্যক্ষে ঘটে যায় ওই কুসুমিতা বালিকা বধুটির অকাল বৈধব‍্য ও ত‍ৎসহ সতীদাহের মর্মন্তুদ ঘটনাটি।

সেদিনের প্রত‍্যক্ষ অভিজ্ঞতায় হুতাশনলাঞ্ছিত বালিকাবয়সী দেবীবিসর্জনের ঘটনাটি আজও পরিণত বয়সে এসে যেন রামমোহনকে ভীষণ আচ্ছন্ন করে তোলে।

তাই রামমোহনের মনে হতে লাগল যে সেদিনের সেই অপাপবিদ্ধ কিশোরীটির বিদেহী আত্মাটি একবার প্রকট হয়ে যেন তাঁকে সতীদাহ বিরোধী পদক্ষেপের জন‍্য অগ্রিম জয়মাল‍‍্যে ভূষিত করতেই একবার চাক্ষুস দর্শনটি যেন উপহার দিয়ে গেল।

...........

ওদিকে ভীড় একটু আলগা হতেই গোলকপতি জমায়েতের দিকে এগিয়ে গেল। বেলা দ্বিপ্রহর পেরিয়ে গেলেও বৃদ্ধটি এখনও জীবিত আছে। দেখে যা মনে হচ্ছে যে কালকের মধ‍্যাহ্নের আগে অবধি তার শ্বাসবায়ুটি এখনো সচল থাকবে। সেজন‍্য আজ মধ‍্যাহ্নে অন্তত পরিকল্পিত সতীদাহটি আর সম্ভব হচ্ছে না।

গোলকপতির পরণে রাজবাড়ী থেকে দেওয়া ধুতি ও চাদর আর তার সঙ্গে কোমরবন্ধে বর্ধমান রাজের প্রতীকচিহ্নটি কষে বাঁধা। বলা বাহুল‍্য এই যে প্রায় অর্ধউলঙ্গ ও স্বাস্থ‍্যবান ব্রাহ্মণ সমাজপতিদের চেয়ে তাকে এখানে অন্তত বাহ‍্যিকভাবে আলাদা করে চিনে নেওয়াটা খুব কঠিন কাজ নয়। তাই গোলকপতিকে রাজবাড়ীর লোক বুঝতে পেরে একজন মাতব্বরগোছের লোক ওর দিকে এগিয়ে এল।

....

লোকটি অব্রাহ্মণ হলেও মুরুব্বিগোছের। সে চুপিচুপি গোলকপতিকে যা অত‍্যন্ত নীচুগলায় বলল তা যেন আগে থেকেই গোলকপতি জানত। ওরা সবাই ওই কমবয়েসী ও সর্বকনিষ্ঠা বধূটিকেই বৃদ্ধটির তেরো জন সপত্নীদের মধ‍্যে সতীদাহের জন‍্য আপাতত নির্বাচিত করেছে।

লোকটি এবার হাতের কড় গুণে হিসাব কষে গোলকপতিকে বলল যে আজ পর্যন্ত গোটা বর্ধমানে মোট পাঁচজন বিংশতিবর্ষের উর্দ্ধে বধূর সতীদাহের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। তাই আর একটি সম্পূর্ণ হলেই এখানে যেমন পুরো ছ'টি সতীদাহের সংখ‍্যাটি পূর্ণ হবে তেমনই এই পান্ডববর্জিত এলাকাটিও একটি সতী পীঠ হিসাবে উপযুক্ত পরিচিতি লাভ করবে। আর সেজন‍্য এই উপলক্ষ‍্যে গ্রামের সবাই একটি কালী মন্দিরও প্রতিষ্ঠা করার কথা ভেবে এই সমস্ত ক্ষেত্রটিকে " সতী কালীর মাঠ" নামে প্রচারের জন‍্য স্বয়ং মহারাজ তেজচন্দ্রের কাছে একটি সম্মিলিত মুচলেকা সই করে পাঠাবে বলে ভাবছে।

লোকটির পরিকল্পনা শোনার পরমুহূর্তেই গোলকপতির ভিতরমহলটি এক অব‍্যক্ত বেদনায় যেন শিউড়ে উঠল।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in
আট

হঠাৎ রত্না দি র ডাকে সুমন্ন্ত দার লুপ্ত চেতনা ফিরে এলো । দাদা বললেন , বসো বসো আমি একটু আসছি ।তারপর দুই কাপ চা এনে বললেন, দিদি চা খাও ।দাদা চা খুব ভালো করেন ।দিদি বললেন, দাদা চা খুব ভালো হয়েছে ।দাদা বললেন, ধন্যবাদ। তার পর কি খবর বলো ।দিদি বললেন, গতকাল এক ভদ্রলোক ফোন করেছিলেন বেড়াতে যাওয়ার জন্য।কোথায় ?বীরভূম জেলার সাঁইথিয়া র কাছে মথুরাপুর গ্রামে । দাদা নতুন জায়গা দেখতে ভালোবাসেন । ব্যাগ পত্তর গুছিয়ে পরের দিন দুজনে হাওড়া রামপুর হাট এক্সপ্রেস ট্রেনে চেপে বস লেন ।ট্রেনে বসে জানালা দিয়ে দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে যাওয়া অন্তরে এক অদ্ভূত অনুভূতির সৃষ্টি করে । এ রসে যে বঞ্চিত তাকে বোঝানো কঠিন । দাদা ও দিদিকে এই কথা গুলি বলছিলেন ।দিদি বললেন, সত্য কথা । ট্রেন জার্নির স্বাদ আলাদা ।তারপর বারোটার সময় ওনারা মথুরাপুর গ্রামে এসে গেলেন । পরেশবাবু ফোনে খবর পেয়ে আগে থেকেই তৈরি ছিলেন ।জলটল খাওয়ার পর পরেশবাবু দাদাও দিদিকে নিয়ে ময়ুরাক্ষী নদী দেখাতে নিয়ে গেলেন । নদীতে এখন বেশি জল নেই ।পায়ে হেঁটে ওনারা নদীর ওপাড়ে গেলেন ।পরেশবাবুর ব্যবহার দেখে দাদা ও দিদি খুব মুগ্ধ হলেন ।তারপর খাওয়া দাওয়া করে দুপুরে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার বিকালে গ্রাম ঘোরার পালা । কত কিছু দেখার আছে আমাদের দেশের গ্রামে । গাছপালা নদীনালা এই নিয়েই আমাদের গ্রাম । কবিগুরু তাই বলেছিলেন, " দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ... একটি ঘাসের শিষের উপর একটি শিশির বিন্দু "।আমরা আজীবন ঘুরে বেড়াই, আনন্দের খোঁজে । আর এই আনন্দ হলো জীবনের আসল খোঁজ । কথা গুলি জয়ন্ত দা বললেন ।দিদি পরেশ বাবু কে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করলেন । পরেশ বাবুও কথা বলে খুব আনন্দ পেলেন ।তার পর রাতে খাওয়া বেশ ভালোই হলো । পরেশ বাবুর বিরাট জায়গা জুড়ে বাগান ।অনেক হিম সাগর আম । গাছের টাটকা আম । আর সাঁকিরের পাড় থেকে আনা দৈ আর রসগোল্লা । রসিক মানুষ জয়ন্ত দা । বললেন, পরেশবাবু কব্জি ডুবিয়ে ভালোই খেলাম ।পরেশবাবু বললেন, আপনাদের খাওয়াতে পেরে আমি খুব খুশি ।ভোরবেলা তখন চারটে বাজে । জয়ন্ত দার ঘুম ভেঙ্গে গেলো । পরেশবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার এত কল রব কেন ?পরেশবাবু বললেন, আর বলবেন না । আমার বাগানে অনেক জবা গাছ আছে নানা জাতের । কোনোটা লঙ্কা জবা, পঞ্চ মুখী , গণেশ জবা , সাদা জবা, ঝুমকো জবা ,খয়েরী জবা , লাল, ঘিয়ে জবা প্রভৃতি।এখন একটা লাল জবা গাছে ঘিয়ে জবা হয়েছে । সবাই তাই ভোরবেলা পুজো দেয় । বলে , ঠাকুরের দয়া । তাই এক গাছে দুই রকমের ফুল ।দিদি দেখছেন প্রচুর মহিলা চান করে কাচা কাপড় পড়ে পুজো দিতে এসেছেন ।দাদা বললেন , এদের বোঝাতে হবে ।এটা বিজ্ঞান নির্ভর ব্যাপার ।দিদি বললেন , আপনারা শুনুন, এটা বিজ্ঞানের ব্যাপার ।তখন মহিলাদের একজন বললেন, একথা বলবেন না দিদি । পাপ হবে ।দিদি বললেন , পরাগ মিলনের ফলে লাল গাছের পরাগ রেণু ঘিয়ে গাছের পরাগ রেণুর সঙ্গে মিলিত হয় । এই কাজটি করে পতঙ্গ রা ।সংকারয়নের ফলে জটিল পদ্ধতি পার করে এইসব ব্যাপারগুলো হয় । সেসব বুঝতে গেলে আরও পড়াশুনা করতে হবে ।আরেকজন মহিলা বললেন, কই আর কোনো গাছে তো হয় নি ।দিদি বললেন, এত বড় বাগান ঘুরে দেখুন। নিশ্চিত দেখা যাবে ।দাদা জানেন সবাই প্রমাণ চায় । প্রমাণ ছাড়া এদের কুসংস্কার মন থেকে যাবে না ।দাদা ডাক লেন, আপনারা এদিকে আসুন । দেখুন এখানেও দুটি গাছে অই একই ঘটনা ঘটেছে।সবাই ওখানে গিয়ে দেখলেন, সত্য কথা তাই হয়েছে । লাল গাছে ঘিয়ে জবা ।দাদা বললেন ,মনে রাখবেন বিজ্ঞান অসম্ভব কে সম্ভব করে । বিজ্ঞান এর দৃষ্টি দিয়েই আমাদের সবকিছু বিচার করতে হবে ।সবাই বুঝতে পারলেন এবং খুশি হয়ে বাড়ি চলে গেলেন ।পরেশবাবু বললেন, এবার আপনাদের জন্য কফি নিয়ে আসি বর্ধমান জেলার সিঙ্গি গ্রামে কবি কাশীরাম দাসের জন্ম স্থান ।অই গ্রামে আমার এক আত্মীয় বাড়িতে ক্ষেত্রপাল পুজোর সময় বেড়াতে গেছিলাম ।এই পুজোর সময় এই গ্রামে খুব ধূমধাম হয় ।রতন আমার থেকে বয়সে একটু ছোটো হলেও বন্ধু র মতোই ভালোবাসি । যেখানে যাই আমরা দুজন একসাথে যাই ।আমার অনেক দিনের ইচ্ছা কিশোর মনোবিজ্ঞানের সহ সম্পাদক সুমন্ত ভট্টাচার্য ও সহ সম্পাদনা সচিব রত্না রায় কে এই সিঙ্গিগ্রামের পুজো দেখাবো । রতন কে আগেই বলে রেখেছি । দাদা ও দিদিকেও একমাস আগে বলে রেখেছি ।আজ তাঁরা আসবেন ।আমরা ক্ষেত্র পাল তলায় ঢাকের তালে মত্ত । হঠাৎ একটি ছোট ছেলে ছুটতে ছুটতে এসে সবাই কে বলছে, সবাই দেখে এসো মিত্র বাড়িতে ঠাকুর এসেছে ।আমরা ছেলেটির কথা শুনে কৌতূহল বশত মিত্র বাড়িতে গিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য ।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in





















ছাতের কামরাটি সংযুক্ত পরিবারের পাঠ্যপুস্তকের মত সবসময় খোলা পড়ে থাকে। ঘরের কো্নে একজোড়া মুগুর, মানে সরকারিভাবে ঘরটার মালিক বড়ছেলে বদ্রী পালোয়ান। তবে পরিবারের অন্য সদস্যরাও নিজেদের ইচ্ছেমত ঘরটার ব্যবহার করে থাকে। মহিলারা নানান কিসিমের কাঁচের বয়াম ও মাটির পাত্রে নানাধরণের আচার ভরে ছাতে রোদ খাইয়ে বিকেল হবার মুখে ঘরটার মধ্যে ভরে দেন। ছাতে শুকুতে দেয়া কাপড়চোপড়েরও একই হাল। কামরার ভেতরে এ’মুড়ো থেকে ও’মুড়ো অব্দি একটা দড়ি টাঙানো। তাতে সন্ধ্যের পর ল্যাংগোট ও চোলি, বক্ষবন্ধনী ও সায়া একসাথে দোলা খায়। বৈদ্যজীর ফার্মেসি থেকে একগাদা ফালতু শিশি একটা আলমারি ভরে রাখা। অধিকাংশই খালি। কিন্তু তাতে দু’রকম লেবেল সাঁটা—‘ওষুধ খাওয়ার আগে’ আর ‘ওষুধ খাওয়ার পর’। প্রথমটায় একটা অর্ধমানবের ছবি, পরেরটায় এমন চেহারা যার গোঁফে তা’, ল্যাঙ্গোট কষে বাঁধা। অর্থাৎ, বোঝা যায় যে এই সেই শিশি যা হাজার নবযুবকদের সিংহ বানিয়ে দিয়েছে। তবে কথা হল, এরা সব স্নানের ঘর এবং শোবার ঘরের মধ্যেই সিংহবিক্রমে চলা ফেরা করে, কিন্তু বাইরে বেরোলে নিরীহ ছাগলছানা হয়ে যায়।

একধরণের সাহিত্য আছে যার বিষয় ‘গুপ্ত’ এবং ‘ভারতে ইংরেজ রাজত্ব’ গোছের বইয়ের চেয়েও ভয়ংকর। কারণ এই ধরনের বই ছাপিয়ে ফেলা ১৯৪৭ সালের আগে তো নিষিদ্ধ ছিলই, এখনও অপরাধের আওতায় পড়ে। এই ধরণের সাহিত্য অফিসের গোপন ফাইলের মত গোপন হয়েও গোপন নয়, এবং এরা আহার-নিদ্রা ও ভয়ে ভয়ে কাটানো মানবজীবনে নিঃসন্দেহে এক আনন্দময় লিটারারি সাপ্লিমেন্টের কাজ করে। এছাড়া এরা সাহিত্যের কুলীন এবং জনপ্রিয় সাহিত্যের কৃত্রিম শ্রেণীবিভাগের বেড়া টপকে ব্যাপকহারে জনগণেশের হৃদয়ে আসন পাকা করে নেয়। এতে এমনকিছু রহস্য নেই। খালি বর্ণনা করা হয় যে কোন পুরুষ অন্য পুরুষ বা নারীর সঙ্গে কেমন করে কী কী করেছিল। অর্থাৎ কবি সুমিত্রানন্দন পন্থের দার্শনিক ভাষায় বললে ‘মানব মানবীর চিরন্তন সম্পর্কে’র বর্ণনা।

এই ঘরটা এমন সব সাহিত্য পড়ার জন্যেও কাজে আসে, আর বোঝা যায় যে পরিবারের একমাত্র ছাত্র হওয়ার ফলে এই সব অধ্যয়ন একমাত্র রূপ্পনবাবুই করে থাকেন। এটুকুই নয়, ঘরটা রূপ্পনবাবুর অন্য কাজেও লাগে। যে সুখ পেতে অন্যদের চাই রুটির টুকরো, গাছের ছায়া, পানপাত্র ও প্রেমিকা, তা’ উনি এই কামরাতেই পুরোপুরি আদায় করে নিতেন।

এই কামরায় পরিবারের সবার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পতাকা ওড়া দেখে লোকজন স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারে। এই ঘরটা একবার দেখলে নিঃসন্দেহ হবেন যে পূর্ব গোলার্ধে সংযুক্ত পরিবারে কোন দিক থেকেই কোন বিপদের আশংকা নেই।

রঙ্গনাথের এই কামরায় ঠাঁই হল। এখানে ও চার-পাঁচ মাস থাকবে। বৈদ্যজী ঠিক বলেছেন। এম এ পড়তে পড়তে রঙ্গনাথও অন্য সব ছাত্রের মত দুর্বল হয়ে গেছে। মাঝে মাঝেই জ্বর হত। সমস্ত গড়পড়তা হিন্দুস্থানী নাগরিকের মত রঙ্গনাথেরও আধুনিক ডাক্তারিতে বিশ্বাস নেই, তবু ওষুধ খাচ্ছিল, এখনও পুরোপুরি সেরে ওঠেনি। সব শহুরেদের মত ওরও বিশ্বাস যে শহরের ওষুধ আর গ্রামের হাওয়া্য কোন তফাৎ নেই। তাই ও এখানে মামাবাড়িতে কয়েকমাস থাকতে এসেছে। এম এ করার পর চাকরি না পেয়ে ও অন্য গড়পড়তা মূর্খদের মত পিএইচডি করতে নাম লেখাল। আবার সাধারণ বুদ্ধিমানদের মত ওর এটাও জানা ছিল যে রিসার্চ করতে হলে রোজ ইউনিভার্সিটিতে হাজিরা দেয়া এবং লাইব্রেরিতে বসে থাকার কোন মানে নেই। তাই ও ভাবল যে কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে থেকে আরাম করি, শরীর ভাল করি, পড়াশুনো করি, দরকার পড়লে মাঝে মাঝে শহরে গিয়ে বই পালটে নিয়ে আসি। আর মাঝে মাঝে মামাবাবু মানে বৈদ্যজীকে শিষ্ট ভাষায় এটা বলার সুযোগ করে দিই—হায়, আমাদের নবযুবকেরা অকর্মার ধাড়ি! নইলে আজ আমাদের মত বুড়োদের ঘাড়ে এতসব দায়িত্বের বোঝা চাপে !

উপরের কামরাটি বেশ বড়সড়। রঙ্গনাথ এসেইই ওর এক কোনায় নিজের রাজ্য আলাদা করে নিল। ঘরটা সাফসুতরো করিয়ে তাতে একটা চারপাই আর একটা বিছানা পাকাপাকি ভাবে পাতা হল। পাশের আলমারিটিতে ওর বইপত্তর ভরে তাতে গোয়েন্দা সিরিজ বা ‘গুপ্তজ্ঞান’ গোছের বই রাখা নিষিদ্ধ হল। কলেজ থেকে এসে গেল একটা ছোটখাট টেবিল আর চেয়ার। খাটিয়ার পাশে একটা জানলা যা খুললে বাগান এবং চাষের ক্ষেত চোখে পড়ে। এই দৃশ্য রঙ্গনাথের জীবনকে কবিত্বময় করে তুলল। কখনও কখনও ওর সত্যি সত্যি মনে হত ওর সামনে কত ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কত রবার্ট ফ্রস্ট, কত গুরুভক্ত সিং মিলে একটা অর্কেস্ট্রা বাজাচ্ছে।ওদের পেছনে রয়েছে অনেক স্থানীয় লেখক তুরী আর শিঙে ফুঁকতে ফুঁকতে যাদের বুক হাপরের মত উঠছে আর নামছে।

রূপ্পনবাবু কোত্থেকে কিছু ইঁটের টুকরো এনে জুড়ে টুরে একটা রেডিওর আকার বানিয়েছিলেন। কামরার ছাদের বাঁশ আর আশেপাশের গাছগাছালির সাহায্যে লম্বা লম্বা তার এমন ভাবে টাঙানো হয়েছিল যেন এই কামরাটি এশিয়ার সবচেয়ে বড় ট্রান্সমিশন সেন্টার। কিন্তু সেন্টারের ভেতরের রেডিওটি শুনতে কানে একটা হেডফোন লাগানো জরুরি। রঙ্গনাথ কখনও সখনও ওটা কানে লাগিয়ে স্থানীয় সংবাদ ও বৈষ্ণব সন্তদের কান্নাকাটিমার্কা ভজন শুনতে পেত। ও বুঝে যেত যে অল ইন্ডিয়া রেডিও দশবছর আগে যা ছিল এখনও তাই। এত গাল খেয়েছে তবু বেহায়ার মত জিদ ধরেছে যে - পরিবত্তোন চাইনে।

রঙ্গনাথের দৈনিক রুটিন বৈদ্যজীর পরামর্শে তৈরি হয়েছে।

সাতসকালে উঠতে হবে, উঠে ভাবতে হবে যে কালকের খাবার ঠিকমত হজম হয়েছে।

ব্রাহ্মে মূহুর্তে উত্তিষ্ঠেৎ জীর্ণাজীর্ণং নিরুপয়েৎ।

তারপর তামার লোটায় রাত্তিরে রাখা জল খাও, বেশ খানিকটা বেড়িয়ে নিত্যকর্ম ষেরে এস।কারণ সংসারে ওই একটা কাজই নিত্য, বাকি সব অনিত্য। তারপর রয়েছে হাত-মুখ ধুয়ে নিমের বা বাবুলের দাঁতন চিবোনো, হাত এবং দাঁত পরিষ্কার করা।

নিম্বস্য তিক্তকে শ্রেষ্ঠঃ কষায়ে বব্বুলস্তয়া।

এরপর একের পর এক-- কুসুম গরম জলে কুলকুচি করা, ব্যায়াম করা, দুধ খেয়ে পড়তে বসা, দুপুরের খাবার, বিশ্রাম, আবার পড়াশুনো, সন্ধ্যের মুখে একটু বেড়িয়ে আসা, ফিরে এসে সাধারণ ব্যায়াম, বাদাম-মুনক্কার শরবত, আবার পড়া, রাতের খাবার, পড়া এবং নিদ্রা।

রঙ্গনাথ এই রূটিন খুব নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলল। তবে তাতে সামান্য পরিবর্তন। পড়ার বেশিরভাগ সময় বৈদ্যজীর বৈঠকখানার দরবারে ‘গঞ্জহা’দের সঙ্গে খোশগল্পে কাটতে লাগল। বৈদ্যজী এই পরিবর্তনে অখুশি নন, কারণ এতে রঙ্গনাথের বীর্যরক্ষায় কোন ক্ষতির সম্ভাবনা নেই, বাকি সব মেনে চললেই হল। একদিকে এই দরবারে ভাগ্নের নিয়মিত হাজিরায় উনি খুশি, কারণ একজন লেখাপড়া জানা লোক তাঁর দরবারে রয়েছে এবং বাইরের লোকজনের কাছে গর্বের সঙ্গে পরিচয় করানো যাচ্ছে।

কিছুদিনের মধ্যে রঙ্গনাথের মনে হল যে যা কোথাও নেই তাও শিবপালগঞ্জে আছে, আর যা শিবপালগঞ্জে নেই তা কোথাও নেই; ঠিক মহাভারতের মত। এটাও বিশ্বাস হল যে ভারতবাসী সর্বত্র এক, আমাদের বুদ্ধিটুদ্ধি সবজায়গায় একই রকম। যেসব পাঁয়তারা প্যাঁচ-পয়জারের প্রশংসায় নামজাদা খবরের কাগজগুলো প্রথম পাতায় বড় বড় হেডলাইনে মোটা মোটা অক্ষরে রোজ চেঁচায়, যার ধাক্কায় বড় বড় নিগম, কমিশন এবং প্রশাসন ডিগবাজি খায়, ওসবের একগাদা অখিল ভারতীয় প্রতিভা শিবপালগঞ্জে কাঁচামালের মত এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে। ভেবে ভেবে ভারতের সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতি ওর আস্থা আরও মজবুত হল।

কিন্তু একটা জিনিস এখানে নেই।ও দেখেছিল যে শহরে পুরনো ও নতুন প্রজন্মের মধ্যে এক বিতর্ক শুরু হয়েছে। পুরনো প্রজন্মের বিশ্বাস আমরা অনেক বুঝদার, অনেক বুদ্ধিমান। আমাদের পরে গোটা দুনিয়ায় বুদ্ধি ব্যাপারটাই গায়েব হয়ে গেছে, নতুনের জন্যে ছিটেফোঁটাও বাঁচেনি। কিন্তু নতুন প্রজন্মের দৃঢ় বিশ্বাস যে পুরনোর দল হল অল্পে খুশি হওয়া স্থবির, সমাজের প্রতি দায়িত্বহীন। আর আমরা? আমরা সচেতন, কোন কিছুতেই সহজে সন্তুষ্ট হওয়ার বান্দা নই, নিজের স্বার্থের প্রতি নিষ্ঠাবান, এবং সমাজের প্রতি আস্থাহীন, কারণ সমাজ বলে আজ আর কিছু নেই।

এই সব তর্ক-বিতর্ক বিশেষ করে সাহিত্য ও শিল্পের ক্ষেত্রে বেড়ে উঠছিল, কারণ অন্য সব বিষয়ের জায়গায় সাহিত্য ও শিল্পের ক্ষেত্রের জাল অনেক বেশি ছড়ানো, কিন্তু সবচেয়ে কম লোকসানদায়ক। পুরানো দের চোখে নতুনরা মূর্খ আর নতুনদের চোখে প্রাচীনেরা সব ভাঁড়—ব্যাপারটা এদ্দুর গড়িয়েছে যে সাহিত্য-শিল্পকলা না হয়ে অন্য কিছু হলে এতদিনে গৃহযুদ্ধ বেঁধে যেত। রঙ্গনাথ প্রথমে ভেবেছিল নতুন-পুরনোর এই লড়াইয়ের শহুরে ব্যামো শিবপালগঞ্জে ছড়ায়নি। একদিন ওর ভুল ভেঙে গেল। দেখল এখানেও ওই নতুন-পুরনোর লড়াই। এখানকার রাজনীতি এব্যাপারেও কিছু কম নয়।

শুরু হয়েছিল একটি চোদ্দ বছরের ছেলেকে নিয়ে। এক সন্ধ্যার বৈঠকে একজন শিবপালগঞ্জের ওই ছেলেটির জীবন-চরিত ব্যাখ্যা করা শুরু করল।বোঝা গেল যে ছোঁড়াটার মধ্যে বদমাশ হওয়ার ক্ষমতা এতটাই প্রবল হয়ে উঠল যে বড় বড় মনোবৈজ্ঞানিক ও সমাজবিজ্ঞানী একে প্রভূর মায়া বলে মানতে বাধ্য হন। শোনা যায় যে আমেরিকায় পড়ে দেশে ফেরত আসা কিছু বিদ্বান ছেলেটার বিষয়ে রিসার্চ করেছিলেন। ওঁরা চাইছিলেন ওঁদের বইয়ের বাঁধা থিওরির —ভেঙে যাওয়া পরিবার, অসৎসঙ্গ, খারাপ পরিবেশ, বাপ-পিতামো’র ক্রিমিনাল রেকর্ড ইত্যাদি- ফ্রেমে ছেলেটাকে ফিট করাতে, কিন্তু সে ছেলে কোনমতেই ওই ফেমে বাঁধা পড়তে রাজি নয়।

এতে ওই পন্ডিতদের ব্যর্থতা নয়, বরং আমাদের দেশের যোগ্যতা প্রমাণিত হয়।আমরা আজকাল ধনবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি-বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান আদির ক্ষেত্রে এমন সব প্র্যাক্টিক্যাল সমস্যা এক তুড়িতে তৈরি করে দিই যে আমেরিকায় দামি কাগজে ছাপা মোটা মোটা বইয়ের দামি থিওরিগুলো হার মেনে যায় এবং ভারতীয় পন্ডিতেরা ঘাবড়ে গিয়ে ফের আমেরিকায় দৌড়তে বাধ্য হয়। এই ছোঁড়াটার কেস-হিস্ট্রিটা এমন হাঙ্গামা খাড়া করল যে এক নামকরা পন্ডিত ওঁর আগামী আমেরিকা প্রবাসের সময় এর সমাধান খুঁজে বের করার প্রতিজ্ঞা করলেন।

শিবপালগঞ্জের ইতিহাসের পাতায় ছেলেটা দু’তিন বছরের জন্যে হঠাৎ উদয় হয়ে সবার চোখ ধাঁধিয়ে দিল, তারপর পুলিশের মার, উকিলের যুক্তিতর্ক এবং ম্যাজিস্ট্রেটের দেওয়া শাস্তি নির্বিকার ভাবে স্বীকার করে নাবালক অপরাধীদের জেলখানার ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে গেল। পরের খবর হল ছেলেটার ব্যক্তিগত চরিত্র দেশের পন্ডিতদের জন্যে এক প্রহেলিকা মনে হওয়ায় সে রহস্যভেদ করতে ভারত ও আমেরিকার মৈত্রীর দোহাই দিয়ে সাহায্য চাওয়া হচ্ছে। খবরটা শিবপালগঞ্জে পৌঁছতে পৌঁছতে মিথ বা লোককথার চেহারা পেয়ে গেল। তখন থেকে ছেলেটার লীলা-প্রসংগ বড় গর্বের সঙ্গে বর্ণনা করা হয়।

রঙ্গনাথকে বলা হল যে ছোঁড়াটা দশবছর বয়সেই এমন জোরে দৌড়ুত যে পনের বছরের ছেলেছোকরারা ওর নাগাল পেত না। এগার বছরের মাথায় ও রেলে বিনা টিকিটে চড়ায় এবং টিকিট চেকারদের বোকা বানানোর খেলায় পাকা খেলুড়ে হয়ে উঠল। আরো এক বছর যেতে না যেতে ও যাত্রীদের মালপত্তর গায়েব করায় এমন হাত পাকালো যেন দক্ষ সার্জন লোক্যাল অ্যনাস্থেশিয়া দিয়ে কারও অপারেশন করছে এবং টেবিলে শোয়া রোগী টের পাচ্ছে না যে ওর একটি অঙ্গ শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেছে। এই ধরণের চুরিতে ওর এত নাম হওয়ার বিশেষ কারণ হল একবারও ধরা না পরা। শেষে চোদ্দ বছর বয়েসে যখন প্রথম ধরা পড়ল ততদিনে ও দরজার ওপরের কাঁচ ভেঙে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে ছিটকিনি খোলায় পারঙ্গম হয়েছে। বাংলোবাড়িতে চুরি করতে স্কাইলাইট দিয়ে না ঢুকে নিজস্ব কায়দায় দরজা খুলে ঢোকে এবং কাজটি সেরে ভালোমানুষের মত সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসে।

এই ছেলেটির গুণগান চলছিল, এমন সময় কেউ তুলে দিল ‘বহরাম চোট্টা’র প্রসংগ।ও নাকি একসময় এই এলাকার ইতিহাস অনুযায়ী বেশ নামকরা চোর ছিল। কিন্তু নামটা শোনামাত্র এক ছোকরা চেঁচিয়ে আপত্তি করল। ঠিক যেমন বিধানসভায় কোন যুক্তি ছাড়াই সির্ফ চিৎকার করে ‘স্পীচ’এর বিরোধ করা হয়। ওর কথা হচ্ছে-বহরাম চোট্টা আবার কোন চোর নাকি? রামস্বরূপ চোর বারো বছর বয়সেই যা মাল সরিয়েছিল বহরাম ব্যাটা জনম ভর চেষ্টা করেও সেটা গুণে শেষ করতে পারবে না।

রঙ্গনাথ এই বিতর্কে যেন দুই প্রজন্মের লড়াইয়ের আঁচ পেল।শনিচরকে বলল, ‘কী ব্যাপার? আজকালকার চোরেরা কি সবাই ভারি সেয়ানা? আগেকার দিনেও তো একের পর এক ভয়ংকর সব চোট্টা জন্মেছিল’।

শনিচরের বয়েসটা এমন যে ওকে নতুনেরা ভাবে বুড়োদের দলে আর বুড়োরা ভাবে ছোঁড়াদের দলে। এবং প্রজন্মের ভাগাভাগি তো বয়সের মাপকাঠি দিয়ে কোন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হয়নি, ফলে দুটো দলই ওকে দুধভাত করে রেখেছে। তাই ওকে কেউ কোন দলকে সমর্থন করতে মাথার দিব্যি দেয়নি। শিল্প-সাহিত্যের দুনিয়ায় যেমন কয়েক’শ আধবুড়ো সমালোচক এমনভাবে মাথা নাড়ে যাতে তার স্পষ্ট কোন মত বোঝা যায়না, শনিচরও ঠিক সেই ভাবে এড়িয়ে গিয়ে বলল, ‘ভাই রঙ্গনাথ, পুরনো দিনের ওস্তাদদের কথা আর বোল না। ছিলেন বটে ঠাকুর দূরবীন সিং। আমি সেসব দিনও দেখেছি। কিন্তু আজকালকার চ্যাংড়াদের কথা না বলাই ভাল।

‘ আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে, যখন আজকের ছেলেছোকরারা জন্মায়নি, বা জন্মে কিছু বৃন্দগান গাইতঃ



“ হে গোবিন্দ, হে গোপাল!

আমার রাজা-রানীকে দেখো ঠাকুর, হে দীনদয়াল”।

অথবা,

“ হে আমার রাজরাজেশ্বর,

জর্জ পঞ্চমকে রক্ষা কর গো, রক্ষা কর”!

সেই সময় শিবপালগঞ্জের সবচেয়ে বড় ‘গঞ্জহা’ ছিলেন ঠাকুর দূরবীণ সিং। বাপ-মা হয়ত ভেবেছিলেন যে নাম যখন দূরবীন রেখেছি, ছেলে সব কাজ বৈজ্ঞানিক ঢংয়ে করবে।বড় হয়ে উনি তাই করলেন। যে জিনিসে একবার হাত দিয়েছেন, তো সোজা তার বুনিয়াদে গিয়ে ঘা’ দিয়েছেন।ইংরেজের আইন-কানুন ওনার ভালো লাগেনি।তাই মহাত্মা গান্ধী যখন শুধু লবণ আইন অমান্য করতে ডান্ডি গেলেন, দূরবীন সিং ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের সমস্ত ধারা ভাঙতে উঠে পড়ে লাগলেন।

স্বভাবে উনি পরোপকারী বটেন। এখন পরোপকার হল একটা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী রোগ, আর এ নিয়ে সবার আলাদা আলাদা মত। কেউ পিঁপড়েকে আটা খাওয়ায়, অন্য কেউ অবিবাহিত বয়স্ক মহিলাদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক করার লক্ষ্যে নিজের চেহারায় ‘প্রেম করতে এক পায়ে খাড়া’ গোছের প্ল্যাকার্ড লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কাউকে যেন খোলাখুলি ঘুষ চাইতে না হয়, তাই এক পরোপকারী যত ঘুষ দেনেওয়ালা তাদের সঙ্গে দিনরাত দরদাম করে মধ্যস্থতার কাজ করে বেড়ায়। এসব হল পরোপকার কাকে বলে তা’ নিয়ে কিছু ব্যক্তিগত ধারণা মাত্র। দূরবীন সিংয়েরও পরোপকার কাকে বলে তা’ নিয়ে নিজস্ব ধারণা ছিল। উনি দুর্বলের রক্ষার জন্যে সদাই আতুর হতেন। এই জন্যে কোথাও মারপিট হচ্ছে শুনতে পেলেই উনি বিনা নেমন্তনে পৌঁছে যেতেন এবং সবসময় দুর্বলের পক্ষ নিয়ে লাঠি ভাঁজতেন। সেসব শান্তিপূর্ণ দিনে এ’সব ব্যাপারের জন্যে রেট বাঁধা থাকত। সবাই জানত যে বাবু জয়রামপ্রসাদ উকিল যেমন মারপিটের কেসে আদালতে দাঁড়াতে প্রত্যেকবার পঞ্চাশ টাকা নিতেন তেমনই দূরবীন সিং ও মামলাটা আদালতে গড়ানোর আগে প্রথম যে দরকারি মারপিটটা হত তার জন্যে পঞ্চাশ টাকা করে নিতেন। বড়সড় পেটাপেটির সময়, মানে যখন বেশ কিছু লোক জমায়েতের দরকার, তখন মাথাপিছু হিসেবে রেট ঠিক হত, টাকাটা বেড়ে যেত। কিন্তু তারও রেট আগে থেকে ঠিক করা থাকত,ফলে কেউ ধোঁকা খেত না। ওনার লোকজনকে মদ ও মাংস খাওয়াতে হত। কিন্তু উনি নিজে সেই পরিস্থিতিতে মদ বা মাংস কিছুই ছুঁতেন না।ফলে ওঁর পেট হালকা এবং মস্তিষ্ক সক্রিয় থাকত যা যুদ্ধের ময়দানে বড়ই দরকারি। ‘মাংস’ ও ‘মদিরা’ দেখেও যে সোজা ‘না’ বলতে পারে তাকে সদাচারী সাত্ত্বিক মানুষ ধরা হয়, তাই ওনাকেও সাত্ত্বিক বলতে কোন বাধা নেই।

দূরবীন সিংযের একটি বৈশিষ্ট্য হল উনি কখনও কারও ঘরে সিঁদ দিতেন না, সোজা পাঁচিল টপকে ঢুকতেন। উনি সুযোগ পেলে যেকোন রাজ্যে পোলভল্ট চ্যাম্পিয়ন হতে পারতেন। গোড়ার দিকে টাকাপয়সার টানাটানি হলে কালেভদ্রে পাঁচিল টপকাতে যেতেন। পরের দিকে এ’ধরণের কাজকম্মো কখনো সখনো শুধু নতুন চ্যালাদের প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিং দেবার জন্যে করতেন। সে যুগে চোর শুধু চোরই হত, আর ডাকাতেরা ডাকাত। চোরেরা শুধু চুরি করতেই ঢুকত আর একটা পাঁচ বছরের বাচ্চাও যদি হাত-পা নাড়ত তাহলে যে পথে সিঁদ কেটে ঢুকেছিল সে পথেই ভদ্রভাবে বেরিয়ে যেত। ডাকাতের দল মালপত্তর লুঠে নেয়ার চাইতে মারপিট করতে বেশি উৎসাহী হত। এই ট্র্যাডিশনে দূরবীন সিং যোগ করলেন চুরি করার সময় যে জেগে উঠবে তাকে ঠ্যাঙাও। এই দাওয়াইটি সমসাময়িক চোরদের মধ্যে ভারি লোকপ্রিয় হল। এভাবে দূরবীন সিং চোর এবং ডাকাতের মধ্যের ফারাকটা প্রায় মিটিয়ে দিলেন এবং চুরির মেথডলজিতেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এলেন।

কিন্তু কালের কুটিল গতি!

শিবপালগঞ্জে যা কিছু কালধর্মের সঙ্গে বেখাপ্পা, তাই ‘কালের কুটিল গতি’ হয়ে যায়।অমন যে ঠাকুর দূরবীন সিং , তিনিও বুড়োবয়েসে একবার নেশাড়ু ভাইপোর এক তামাচা খেয়ে কুয়োর পাড় থেকে গড়িয়ে পড়লেন। শিরদাঁড়ার হাড় ভেঙে গেল। কিছু দিন ঘরের কোণায় দাঁড় করিয়ে রাখা লাঠিগাছটির দিকে তাকিয়ে ওটা ওই ভাইপোর মুখে ঠুঁসে দেবার কল্পনা করে দিন কাটাতে লাগলেন। শেষে একদিন লাঠি এবং ভাইপোর মুখশ্রীকে যেমন ছিল তেমনই রেখে উনি শিবপালগঞ্জের ধরাকে বীরশূন্য করে বীরগতি প্রাপ্ত হলেন; অর্থাৎ টেঁসে গেলেন।

শনিচর এবার দূরবীন সিংকে নিয়ে ওর নিজস্ব স্মৃতিচারণে ডুবে গেলঃ

“ভাইয়া রঙ্গনাথ, এক কৃষ্ণপক্ষের রাতে আমি ভোলুপুরের তিওয়ারিদের বাগানের ভেতর দিয়ে আসছিলাম।তখন আমারও ছেলেমানুষির সীমা ছিল না, বাঘ ও ছাগলকে সমদৃষ্টিতে দেখতাম। শরীরে এমণ তেজ যে হাওয়ায় লাঠি ঘোরাই এবং শুকনো পাতায় একটু খরখরানি টের পেলেই তক্ষুণি মা তুলে গাল দিই। তো, এক নিকষকালো রাতে আমি একটা ডান্ডা হাতে নিয়ে সটাসট চলে আসছি। তক্ষুণি গাছের আড়াল থেকে কে যেন হাঁক পাড়ল—খবরদার!

“ ভাবলাম নিশ্চয়ই কোন ভূত প্রেত, কিন্তু ওদের তো এই ডান্ডায় কিছু হবে না। আমি তাই লাল ল্যাঙ্গোটধারীর ধ্যান করলাম, তবে তাঁর ধ্যান কখন কাজে দেয়? যদি ভূত-প্রেত-মামদো এসে ধরে তবে না? কিন্তু গাছের আড়াল থেকে এগিয়ে এল এক কেলেকুষ্টি হাট্টাকাট্টা সাজোয়ান। বলল, যা কিছু আছে চুপচাপ বের করে দাও। ধুতি-পিরেন সব খুলে নামিয়ে রাখো!

মারার জন্যে লাঠি তুলতেই দেখি চারদিক দিয়ে পাঁচ-ছ’জন আমাকে ঘিরে ফেলেছে। সবার হাতে বড় বড় লাঠি ও ভল্ল।আমি ভাবলাম—নাও শনিচর, আজ তোমার জমাখরচ হিসেব-নিকেশ সব হল বলে । উঁচিয়ে ধরা ডান্ডা হাতেই রয়ে গেল, চালানোর হিম্মত হলনা।

একজন বলল, লাঠি তুলেছিলে, চালালে না কেন? যদি এক বাপের ব্যাটা হোস, তো চালা লাঠি!

বড্ড রাগ হল। কিন্তু ভাই, যেই রাগের চোটে মুখ খুললাম কান্না পেয়ে গেল। আমার মুখ দিয়ে বেরোল—'জান নিওনা, মাল নিয়ে যাও’।

আরেকজন বলল-শালার আট আনার জান, তার জন্যে শেয়ালের মত ফেউ ফেউ করছে। এ’ব্যাটা তো মাল ছেড়ে দেবে বলছে, ঠিক আছে। দিয়ে দে সব মাল।‘

ব্যস ভাইয়া, একটা ঝোলা। তার মধ্যে খানিকটা ছাতু ছিল, আর একটা চমৎকার মোরাদাবাদী লোটা।মামাবাড়ি থেকে পাওয়া। ফাস্ট কিলাস সুতোর বুনুনি। সে কী লোটা, বালতি বললেই হয়। কুয়ো থেকে দুই সের জল তোলা যেত।আসল ঘিয়ে ভাজা একতাড়া পুরি। তখন শালার ডালডা বনস্পতির চল ছিলনা। ব্যাটারা সব গুনে গুনে নিয়ে নিল। তারপর ধুতি খুলতে বলল, গেঁজেতে একটা টাকা ছিল, তাও ছাড়েনি। যখন খালি ল্যাঙোট পরে কুর্তা গায়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, এক ব্যাটা বলল, ‘এবার মুখে কুলুপ এঁটে সোজা বাড়ির দিকে হাঁটা দাও।চুঁ-চাঁ করেছ কি এই বাগানে পুঁতে রেখে দেব’।

আমি রওনা দিচ্ছি তো একজন হেঁকে উঠল,’ বাড়ি কোথায়’?

বললাম--আমি একজন গঞ্জহা(শিবপালগঞ্জ নিবাসী)।

তারপর ভাই, কি আর বলব, সবক’টা লুটেরে এ ওর মুখের দিকে তাকায়। কেউ আমাকে শুধোয় -শিবপালগঞ্জের মুখিয়ার নাম বল।

আরেকজন আমার পরিবারের কর্তার নাম জানতে চায়। তিননম্বর বলে- দুরবীন সিং? ওনাকে চেন?

আমি বললাম,’সেবার দূরবীন সিং এর দলের হয়ে লাঠিও চালিয়েছি।ওই যখন রঙপুরে দু’পক্ষেই বড় জমায়েত হয়েছিল। সকালে সূয্যি না উঠলে ওখানে অন্ততঃ হাজার লোকের লাশ পড়ত।উনি আমার গ্রামসম্পর্কে কাকা’।

ওরে ব্বাবা! রাম-রাম সীতারাম! যেন কালো মানুষের ভিড়ে কোন গোরা মিলিটারি সাহাব ঢুকে পড়েছে। হুটোপুটি শুরু হয়ে গেল। কেউ আমার ধুতি ফিরিয়ে দিচ্ছে, তো কেউ জামাজুতো। একজন ঝোলা ফেরত দিয়ে গেল। আর একজন হাত জোড় করল,” তোমার দুটো পুরি খেয়ে ফেলেছি, এর পয়সা নিয়ে নাও।কিন্তু দূরবীন সিং যেন জানতে না পারেন যে আমরা তোমাকে ঘেরাও করেছিলাম। চাইলে আরও ক’টা টাকা নাও। বল তো পেট চিরে পুরি বের করে দিচ্ছি।আমরা কি জানতাম যে তুমি একজন ‘গঞ্জহা’?

তারপর ওরা আমাকে আমাদের গাঁয়ের পুকুরপাড় অব্দি এগিয়ে দিল। অনেক কাকুতি-মিনতি করল। আমিও ওদের বুঝিয়ে সুজিয়ে চোখের জল মুছিয়ে বললাম- আরে তুমি হলে আমার ঘরের লোক। দুটো পুরি খেয়েছ তো কী হয়েছে? আরও দুটো খাও।

লোকটা পালিয়ে গেল। বলে গেল,’ ঢের হয়েছে দাদা! আর না। কী করে জানব যে তুমি ‘গঞ্জহা’? ব্যস, দাদা! দূরবীন সিং যেন জানতে না পারেন’।

আমি বললাম—বাড়ি চলো। জল-টল খাবে। খিদে পেলে দুটি ডাল-ভাত খেয়ে নেবে। কিন্তু ও শুনল না। বলল,’দাদা, এবার ভাইকে যেতে দাও। তুমিও বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়, আর কাল সকাল নাগাদ সব ভুলে যেও, কেমন? তবে কাউকে কিছু বোলনা যেন।‘

তো ভাইয়া, আমি ঘরে গিয়ে বিছানায় লম্বা হলাম। ভোরের আলো ফুটতেই দূরবীন সিংয়ের বাড়ি গিয়ে ওনার পা’ জড়িয়ে ধরলাম। কাকা, কাল রাত্তিরে তোমার নাম নেওয়ায় লাল-ল্যাঙোটধারী দেবতার আশীর্বাদ পেয়েছিলাম। তোমার নাম নিয়েই প্রাণে বেঁচে ফিরেছি।

উনি পা’ সরিয়ে নিয়ে বললেন- ‘যা ব্যাটা শনিচরা! কোন চিন্তা করিসনা। যতদিন আমি আছি, আলো-অন্ধকারে দিন-রাত্তিরে যেখানে ইচ্ছে ঘুরে বেড়াস, কোন কিছুতেই ভয় পাস না। সাপ-বিচ্ছু তো তুই সামলে নিবি, বাকিদের সামলানো আমার উপর ছেড়ে দিস’।

এবার শনিচর একটা বড় করে শ্বাস টানল, তারপর চুপ মেরে গেল। রঙ্গনাথ বুঝল যে শনিচর এখন বটতলা-মার্কা নভেলের লেখকদের মত আসল কথায় আসার আগে সাসপেন্স তৈরি করছে। ও ভালোমানুষের মত বলল,’তাহলে তো যতদিন দূরবীন সিং বেঁচে ছিলেন ততদিন ‘গঞ্জহা’ লোকজনের খুব পায়াভারি’?

রূপ্পনবাবু মুখ খুললেন, এবং রঙ্গনাথের সামনে প্রথমবার কোন সাহিত্যিক পংক্তি ঝাড়লেন। উনি শ্বাস টেনে গম্ভীর হয়ে আওড়ালেনঃ

“কি পুরুষ বলী নহিঁ হোত হ্যায়, কি সময় হোত বলবান।

কি ভিল্লন লুটী গোপিকা, কি ওহি অর্জুন ওহি বাণ”।।

‘পুরুষকার নয়, পাল্লাতে মহাকাল পড়ে যায় ভারী,

অর্জুনের হাতে সেই গাণ্ডীব, তবু লুঠ হয়ে যায় গোপীনারী”।।

রঙ্গনাথ ফুট কাটে,’ কী হোল রূপ্পনবাবু, শিবপালগঞ্জ থেকে তোমার গোপিকা কেউ হরণ করেছে নাকি’?

রূপ্পনবাবুর হুকুমঃ ‘শনিচর, তোমার অন্য গল্পটাও শুনিয়ে দাও’।

শনিচরের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হল।

“ ভাইয়া, লেঠেলের কাজ তো এসেম্বলীর মত হতে পারেনা। এসেম্বলীতে তুমি যত বুড়ো হবে, যত তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি যত লোপ পাবে—ততই তুমি উপরে উঠতে থাকবে। এই এম এল এ হরমন সিংকে দেখ।উঠে দাঁড়ালে ভয় হয় -মুখ থুবড়ে পড়লো বুঝি! কিন্তু না, রাজনীতিতে দিনের পর দিন ওনার ওজন বাড়ছে। কিন্তু লেঠেলদের ব্যাপারটা সেরেফ কলজের জোরের ব্যাপার। যতদিন চলছে ততদিন ঠিক। যেদিন চলবে না , সেদিন সোজা হালাল হয়ে যাবে।

এই পাঁচ-ছ’বছর আগের কথা। কার্তিক-স্নানের জন্যে গঙ্গার ঘাটে গেছলাম। ফেরার সময় ভোলুপুরের কাছে রাত হয়ে গেল।ফুটফুটে চাঁদনী রাত। বাগানের মধ্যে দিয়ে আসার সময় গুনগুনিয়ে একটা চৌপদী গাইতে শুরু করেছি কি পেছন থেকে পিঠের ডানদিকে একটা লাঠির বাড়ি পড়ল। কোন কথাবার্তা নয়, কোন রাম-রাম নমস্কার-চমৎকার নয়, সোজা লাঠির বাড়ি! ভাইয়া, চৌপদী যে কোথায় পালাল কে জানে, কিন্তু আমার কাঁধের ঝোলাটি ছিটকে পড়ল বিশ হাত দূরে। হাতের লাঠিও পড়ে গেছে। চেঁচাতে গেছি তো তিনটে লোক আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। একজন মুখটা চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বলল,’ চুপ সালে! ঘাড় মটকে দেব’। ভাবলাম লাফিয়ে উঠি, কিন্তু ভাব যদি কেউ পেছন থেকে লাঠি মারে তো স্বয়ং গামা পালোয়ানও কাত হবেন, আমি কোন ছার! খানিকক্ষণ মুখ বুঁজে পড়ে থেকে হাতে পায়ে ধরে মিনতি করলাম-মুখ খুলে দাও, চেঁচাব না কথা দিচ্ছি। তখন মুখের কাপড় খুলে দিয়ে একজন বলল- টাকাকড়ি কোথায় রেখেছ?

আমি বললাম, ‘বাপু, যা কিছু আছে সব এই ঝোলায়’।

ঝোলায় দেড় টাকা খুচরো ছিল। এক ডাকাত সেগুলো হাতে ঠুন ঠুন করে বলল—ল্যাঙ্গোট খুলে দেখাও।

বললাম, ‘ওটা খুলিও না। ওর নীচে কিস্যু নেই। একেবারে ন্যাংটো হয়ে যাব’।

আর যায় কোথা! ব্যাটাদের মেজাজ বিগড়ে গেল। ভাবল আমি বোধহয় ঠাট্টা করছি । তারপর তো শরীরের সবকিছু খুলিয়ে এমন তল্লাসি চালাল যে গাঁজা-ভাঙের খোঁজে পুলিশের তল্লাসিও হার মানবে। যখন কিছুই পেল না তখন এক ব্যাটা আমার পেছনে এক লাথি মেরে বলল—চুপচাপ মুখ বন্ধ রেখে নাক বরাবর চলে যা, গিয়ে সোজা নিজের খোঁয়াড়ে ঢুকে পড়।

ততক্ষণে আমার জিভের সাড় ফিরে এসেছে। বললাম,” দেখ বাপু, তোমরা যে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ, ভাল করেছ। মালপত্তর নিয়ে নিলে, তাও কিছু বলব না। কিন্তু একটা কথা জেনে রাখ, তোমরা কিন্তু নুন থেকে নুন কেড়ে খাচ্ছ। তোমরা যদি সরকারের, তো আমিও দরবারের লোক”।

ওরা এবার আমার কাছ ঘেঁষে এসে নানান প্রশ্ন করতে লাগল। যেমন, আমি কে বটি? কোথায় থাকি? কার শাকরেদ এই সব।

আমি বুক ফুলিয়ে বললাম—আমি একজন গঞ্জহা, ঠাকুর দূরবীন সিংয়ের চ্যালা।

আর বোল না রঙ্গনাথ ভাই। শোনা মাত্র ওরা খ্যাক-খ্যাক করে হেসে উঠল। একজন আমার হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান মারল। আমি খালি ভাবছিলাম যে এবার কী হবে, তো ব্যাটা আমাকে ল্যাং মেরে চিৎ করে ফেলল।

আমি শরীরের ধূলো ঝেড়ে টেরে দাঁড়ালাম। এক ব্যাটা কমবয়েসি সাজোয়ান ডাকাত বলে কি—এই দূরবীন সিং আবার কোথাকার কে?

অমনি সবাই খি-খি করতে লাগল।

এবার আমার পালা।

“সেকী, দূরবীন সিং কে জাননা? বাইরে থেকে এসেছ বুঝি? এদিকে দশ কোশের আশেপাশে কেউ গঞ্জহাদের সঙ্গে লাগতে আসেনা। দূরবীন সিং এর গাঁয়ের লোকজনকে সবাই সমঝে চলে। কিন্তু বাপু, তুমি যখন ওনার নামই শোননি, তো কী আর বলব, নিয়ে যাও আমার ঝোলা”।

“ ডাকাতগুলো ফের খিক-খিক শুরু করল। তবে একজন বলল যে নাম শুনেছে।কিন্তু এখন আর দূরবীন সিংয়ের সেদিন নেই। বুড়োগুলো সব একটু-আধটু লাঠিবাজি দেখিয়ে ্নিজেদের ভারি ওস্তাদ মনে করত।এদের ওই দূরবীন সিংও লাঠি চালিয়ে দু’চারটে বাড়ির পাঁচিল টপকে মস্ত বাহাদূর হয়ে গেছল। এখন গেঁড়িতে চড়ে দেয়াল টপকানো তো বাচ্চারা স্কুলেই শিখে নেয়।

এক ডাকাত বলল, লাঠি চালানোর বিদ্যেটাও আজকাল স্কুলেই শেখা যায়। আমিও ওভাবেই শিখেছি।

আগের নওজোয়ান বলল,’তো ওই দূরবীন সিং হলেন তোমাদের গুরুঠাকুর? শালার কাছে একটা দেশি পিস্তলও নেই, এদিকে এলাকা আগলে রাখার শখ’!

এক ব্যাটার হাতে ছিল চোরবাতি(টর্চ)। ও পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করে বলল,” দেখে নে ব্যাটা। এই হল ছ’ঘরা। দেশি পিস্তল নয়, আসল বিলায়তি মাল’। বলতে বলতে ও পিস্তলের নল আমার বুকে ঠেকিয়ে দিল। তারপর বলল,’যা, গিয়ে তোর বাপকে বল গে’--অন্ধের দেশে কাণা রাজা হওয়ার দিন শেষ। এখন ওর খাটিয়ায় পড়ে থেকে কাঁদার দিন। যদি দিনে রাতে কখনও চোখে পড়ে তো মাথার খুলি উড়ে যাবে। বুঝলি ব্যাটা ফকীরেদাস’?

এরপর ভাইয়া,আমার শরীরে এমন তেজ এসে গেল যে নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। হাতের লাঠি ওখানেই ফেলে হরিণের বেগে ছুট লাগালাম। পেছনে ওদের হাসির খ্যা খ্যা আওয়াজ আমায় যেন তাড়া করছিল। একজন বলল,’মার শালার দূরবীন সিংকে।এই, দাঁড়া বলছি, দেখ তোকে যদি মেরে মেরে দূরবীন না বানাই’।

কিন্তু ভাই, এ তল্লাটে কেউ আমায় দৌড়ে হারাতে পারেনি। আজকাল স্কুল-কলেজের ছেলে-ছোকরাদের সিটি বাজিয়ে বাজিয়ে দৌড়ুতে শেখায়। আমি কোথাও না শিখেই এমন দৌড় লাগাই যে খরগোশ বেচারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকোয়। ভাই, ওরা খুব খারাপ খারাপ গাল পাড়ল , কিন্তু দৌড়ে আমার নাগাল পেলনা। কোনরকমে ঘরে পৌঁছলাম। দূরবীন সিংযের তখন সত্যিই দিন শেষ। পুলিসও ভেতরে ভেতরে ওঁনার বিরুদ্ধে চলে গেছল। পরের দিন আমার পেট গুড়গুড় করল, কিন্তু আমি ওই ঘটনাটি আর ওনাকে জানাইনি। বললে হয়ত দূরবীন কাকা শক লেগে তক্ষুনি টেঁসে যেত’।

রূপ্পনবাবু এতক্ষণ ওনার দুঃখী দূঃখী চেহারাটা একটা ভারি ঝোলার মতন শরীরে টাঙিয়ে রেখেছিলেন। একটা বড় নিঃশ্বাস টেনে বললেন—হলে ভালই হত। তখনই টেঁসে গেলে পরে আর ভাইপোর হাতে মরতে হতনা।

0 comments:

0

গল্প - কুমকুম বৈদ্য

Posted in








একটা ঝিরঝিরি বৃষ্টির অপেক্ষা করে উপল, একটা ভাঙ্গা ছাতা সম্বল করে বেরিয়ে পড়ে ফুটো পকেটে| উপল মানে আমাদের উপলের অবস্থা বেশ সঙ্গীন, বি.এসি. সি পাশ করার পর এদিক সেদিক দু চার খানা অফিসে কোনটাতে সাড়ে তেরো দিনের বেশি টিকতে পারে নি , প্রত্যেকটাতেই ১৪ দিনের লাঞ্চ টাইম পার করে সে দাসত্ব শৃঙ্গল ঘুচিয়ে পালিয়ে এসেছে| পাড়ায় দুটো বাড়িতে পালা করে সাড়ে তিন জন ছাত্র পড়ায় সে, আসলে দুজনের জন্য পয়সা পায় বাকি দেড়খান সে ফ্রিতে নিজ উদ্যোগে পড়ায়| হাফ ছাত্র হল চঞ্চল, কারণ সে এতটাই চঞ্চল যে মুখে মুখে পড়া ছাড়া, লেখালিখির খাতার সাথে ভাব করানো যায় নি এখনো| এই দেড়া ছাত্রদের আসলে উপলের মত মা বাপের পাট মিটে গেছে, একান্নবর্তী পরিবারে খিদমত খাটে| স্কুলে যাচ্ছে কিনা , খাচ্ছে কিনা খোঁজ নেবার কেউ নেই| এদের জন্যই উপলকে পাড়ায় ফিরতে হয় রোজ রাতে| হ্যাঁ যা বলছিলাম উপলের ভাঙ্গা ছাতা, সেটা তাকে মা কিনে দিয়েছিল ক্লাস সেভেনে, হাতল ভেঙ্গেচুরে খুলে পড়ে গেছে, কাপড়েও বিস্তর ফুটো| যদিও এতদিনে উপল পাখিদের মত ভিজতে অভ্যস্ত , ছাতার প্রয়োজন বিশেষ নেই, খোলাখুলির ঝামেলা বিশেষ করে না, যদি আরো একটা শিক ভেঙ্গে পড়ে| জামা প্যান্টও বেশ পুরোনো| সেও বছর সাতেক আগে লাস্ট কেনা হয়েছিল| এ বিষয়ে উপল বেশ যত্নশীল, জামা যাতে ফিট করে মেপে মেপে খায়, সারা দিনে খাই খরচ সাড়ে তেইশ টাকা|

আপনারা এতক্ষনে ভাবছেন এর সব কিছুতেই আধা. আসলে পুরো হতে গেলে যা যা লাগে তার কোন কিছুতেই উপলের বিশেষ উৎসাহ নাই| তবে বৃষ্টি পড়লে ছাতাটা সে সাথে রাখে, ঝড় বাদলে একটা সঙ্গী নিয়ে বেরোনো ভালো| কত লোকে কত কারণে ঘরছাড়া হয়, উপলের কারণটা বৃষ্টি, বেশ আদেখলে ইচ্ছে বটে| তবে উপন বলে তার বৃষ্টি নেশা, বৃষ্টির জলে ভিজে ন্যাতানো বিড়ি খেতে খেতে সে শহরের দৃশ্য জমায় মাথার মধ্যে আর বিশ্লেষণ করে পরে সময় মত| ও বলে গরু খায় কেন? তুমি আমি বলি খিদে পায় বলে| উপল বলবে উহুঁ হল না গরু খাবার খায় পরে মনের সুখে জাবর কাটবে বলে| জাবর কাটা খুব স্বাস্থ্যকর, চুপচাপ বসে না থেকে তবু একটা কাজ করা তো হয়| তেমনি উপলও জাবর কাটে|

আজ তেমনি একটা নেশা করার দিন| রাত দুটোর সময় যখন তার সাড়ে ছয় নম্বর গার্লফ্রেন্ডের দেওয়া চতুর মুঠোফোন সে দেখেছিল ১ এ.এম এ বৃষ্টি হতে পারে, তখনই তার ঘুমটা আনচান করছিল| সেই ঘুমের বেড়া ডিঙিয়ে ভোর পাঁচটার সময় পিঁচুটি সুদ্ধ চোখে বগলে ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে |বাইরে বেরিয়েই তার গায়ে শীত শীত করলো , একটা হাফ হাতা হাওয়াই শার্ট পরে বেরিয়েছে সে, যার পকেটের একপাশ ছিঁড়ে গেছে| গলির মুখে গোষালদের ভাড়া বাড়ির একটা জানলা খোলা, সে উঁকি মেরে দেখল একটা আধ ল্যাংটা লোক তার সোয়া ল্যাংটা বৌ জড়াজড়ি করে ঘুমোচ্ছে | বউটা সে অ্যাসিউম করল কারণ এইবাড়িতে যারা ভাড়া থাকে তারা বেশ্যা বাড়ি যেতে পারে, কল গার্ল বাড়িতে ডাকার পয়সা নেই| আচ্ছা ওরা কি ফ্যামিলি প্ল্যানিং কিছু করে? তারই মতো আরো একজন উঁকি দেবার চেষ্টায় আছে ওদের জানলায়, উপলকে দেখে কেমন সুট করে পাতলা হয়ে গেল| উপল এদিক ওদিক তাকিয়ে উল্টোদিকের বাড়ির বারান্দা পেরিয়ে সামনে পড়ল লোকটা, তাকে দেখেই হলুদ দাঁত গুলো বের করে চত্রিশপার্টির হাসি দিল| উপল চোখ নাচিয়ে শুধোলো কি মতলব? বলল ,তেমন কিচু নয়, মদন কাল দুটি লুপুর লে এসেচে দাসের দোকান থেয়ে , তাই ভাবলুম আঁকশি গইলে বৌটার পা দিয়ে খুলে নি, বর জড়িয়ে শুয়ে আচে মালুম হবে নি| তা পেলে? কি? নুপূর? ধূস মাগীর পা খালি| মদন কার জন্য নেচে কে জানে, তাও ওর মার নোয়া বেচে নিচে| যাক এ নিতান্ত ছোটলোকি কান্ড কারখানা, বউটার পায়ে লোম আচে কি ? মাথার মধ্যে একটা ফটো উঠে গেল একটা বৌ , তার উরু অবধি কাপড় তুলে বরকে বুকে জড়িয়ে বিড়ি খাচ্ছে আর তার লোমশ একটা পা উপরের দিকে উঠে আচে , তাতে একটা নুপূর|বাহ বেশ একটা জব্বর ওয়েল পেন্টিং আর্ট ধরা পড়েছে| হো হো করে হাসি এল উপলের, তার হাসি দেখে চোরটা আবাক হয়ে পাগল নাকি বলতে বলতে চলে গেল|

তারপর এক্কা দোক্কা খেলতে খেলতে ভোরের জাল বাতাস গায়ে মেখে মেখে উপল এসে দাঁড়ালো ময়দানের কাছে, ভিক্টোরিয়ার পরী আজ ঘুরবে , ওর মন বলছে, ঝোড়ো হাওয়া তেমন নয়, তবে ও জানে ২০ কিলোমিটারের বেশি জোরে হাওয়া হলেই পরী ঘোরে, এ ওর বহু দিনের রিসার্চ, যারা বলে ভিক্টোরিয়ার পরী ঘোরে না তারা শালা আসল খবরটাই রাখে না, বড় বড় বাড়ি তুলে দিয়ে হাওয়া আটকে পরীকে ঘুরতে বললে পরি ঘুরবে না, পরীর ডানায় হাওয়া লাগাতে হয়| ওই একটু ঘুরলো যেন, উপলের চোখদুটো বুজে আসছে, পিঁচুটি আর জল , আগের রাতের আধভাঙ্গা ঘুম সব আষ্টপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে উপলকে|পার্কের যে বেঞ্চিটা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দিকে মুখ করে আছে বলে উপল জানে, সেইখানে শুয়ে পড়ল| বৃষ্টির জোরটা বাড়ছে, ছাতাটা বুকে জড়িয়ে , জামার হাতা দুটো পরির মতো দুদিকে ছড়িয়ে| বৃষ্টিতে খোলা বেঞ্চ ঘুম কি সুখ! হুড়ো হুড়ি নেই, সারা শরীর ভিজে শিরশির করে|


ঘন্টা দুই ঘুমিয়ে যখন উঠল বৃষ্টির বেগ তখন অনেক কম, সারা হাত পায়ে জল হাজা উঠেচে, বুপসে গেচে হাত পার চামড়া এইবার চায়ের দোকান খোঁজা দরকার| উপলের পয়সাকড়ি এক্কেবারে যে নেই তা নয় তবে বর্ষার দিনে ও পয়সার ধার ধারে না এটাও একটা নেশা | চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়াতেই দোকানি গরম গরম এককাপ আদা দেওয়া চা হাতে ধরিয়ে দিল, বৃষ্টি বাদলে খদ্দের কম, এখন আর উনুন জ্বালায় না , গ্যাসে জ্বলে| আর চা করে ফ্লাস্কে রেখে দেয়| সকালের দিকে এলে তবেই গরম চা মেলে চায়ের দোকানগুলোতে| নির্দিধায় হাত বাড়িয়ে চা নিয়ে আয়েশ করে খায় উপল, আহ কি দারুণ শান্তি গলার নদীর মতো ঠান্ডা একটা জায়গায় সাবমেরিনের মধ্যেকার ওম উপভোগ করে সে| আর তার পরের ঘটনাটা ভেবে মনে মনে ভুসভুসিয়ে হাসতে থাকে| খেতে খেতে চট করে চায়ের কাগজের কাপ হাতে নিয়ে বৃষ্টির জল ধরতে ধরতে ছুট লাগায়| অমন জোয়ান ছেলের এই কির্তী দেখে দোকানী কিছুটা হতবমম্ভ তারপরে আরে ও ভাই আমার চায়ের দাম, চায়ের দাম বলে চেঁচাতে লাগল , বৃষ্টিতে ভিজে যাবার ভয়ে ধাওয়া করল না|এই যে খুচরো চুরি এতে উপলের একটুও অনুশোচনা নেই| এই যে জল , গ্যাস, চা পাতা সবই প্রকৃতির দান| বিনিময় প্রথার সুবিধার জন্য যে টাকা মানুষে চালু করেছিল তা পৃথিবী শুদ্ধু মানুষের অসুবিধার কারণ| সারা পৃথিবীর কোথায় কি আছে জেনে নিয়ে যে পেরেছে তার দখল নিয়েছে , তারপরে ছবি এঁকে ভাগা ভাগি করে দেশ রাজ্য কিসব বলে ডাকা ডাকি করে মানুষের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে, পাখিদের মধ্য়ে এইরকম অসভ্যতা নেই|

বৃষ্টিটা এইবার ধরে এসেছে কিন্তু আকাশে কালো মেঘ, দুর্যোগ বলতে যা বলে তাই, রাস্তাঘাটে বিশেষ লোকজন নেই, শহরের ছেলেমেয়েরা জলকাদায় রাস্তায় নামে না নাক সিঁটকোয়| বৃষ্টিতে কলকাতা শহরের একটা জিনিস উপলের জব্বর লাগে বৃষ্টির জল, ড্রেনের জল, মুত সব একাকার , তার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে ম্যানহোল খোলা থাকলে তলিয়ে যাবে, বেশ মজার ব্যাপার বলে মনে হয়, তবে উপলের সে সৌভাগ্য হয় নি, একবার লেক মার্কেট চত্তরে প্রায় গলা অবধি ডুবে গেছল তবে তাই কিচ্ছু হয় নি| শুধু পরের দু দিন গা চুলকেছিল বেশ লাগে চুলকে চুলকে ছিলে গেলে জ্বালা জ্বালা করে| উপল তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছিল| খুব জোরে বাজ পড়ল, খুব কাছেই মনে হয়, বাইপাশের ধারে কতগুলো নারকেল গাছের মাথা নেড়া| বাজ পড়লে আর সে গাছে নতুন পাতা গজায় না| নারকেল গাছ দিয়ে যদি খাট বানানো যেত , তাহলে মানুষগুলো ডেকে ডেকে বাজ ফেলত| গাছ কাটা বারণ তো সরকার থেকে| বাজ পড়া নারকেল গাছ একটা জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে, কেমন নাকের উপর কাঁচকলা দেখাচ্ছে|

হাঁটতে হাঁটতে উপলের জামা শুকাচ্ছে গায়ে, তবে ভালোভাবে শুকাতে পারছে না, বাতাসে জলীয় বাষ্প এত বেশি টানছে না| উপলের গলার কাছটা খুশ খুশ করছে আর হাঁচি আসছে| আহা কদিন আগে পর্যন্ত কেউ হাঁচলে এলাকা ফাঁকা হয়ে যেত|

সামনের মন্দিরে ভোগ বিতরণ করছে, উপল জানে যত বড় বড় মন্দির আছে দক্ষিনেশ্বর থেকে পুরীর মন্দির, ছেলেবেলার মা বাবার সাথে গেছিল সব জায়গায় ভোগ বিক্রি করে, কিনে নিতে হয় পয়সা দিয়ে| দানের পয়সায় হয় না ওদের ভোগ ও বোক্রি করে পুরো দোকান শালা, ভগবানের দোকান| মসজিদের সামনেও দেখেছে জড়ুবুটির দোকান, চার্চের ব্যবস্থা কিছু ভাল ওরা প্রসাদের ধার ধারে না ২৫শে ডিসেম্বর কেক দেয় আর জারা খ্রীষ্টান হয় তাদের অনেক কিছু দেয় চার্চ থেকে|এরা আবার ভক্ত কিনছে|ধর্ম মানেই শালা বেচা কেনার হাট| তবে যে সব মন্দিরে লোক খাওয়ায় তাদের উপল ভালোবাসে, আজ যেমন খিচুড়ি লাবড়া চেটেপুটে খাচ্ছে| মন্দিরের চাতাল ভিজে যাচ্ছে তার জামা প্যান্টের জলে| যাক যদি কিছু ধূলোবালি মরে যায় কাদা হয়ে যায়|

ছোটবেলা মা সকালে বাতাসা আর বিকালে নকুলদানা দিত ঠাকুর কে, দেবার পর পাক্কা ৩ মিনিট উপল পাহারায় থাকত, যদি টিকটিকি চলে যায় সেই ভয়ে, তারপর সেই প্রসাদ উপল পেতো| খাবে যখন উপলই ওর হাতে দিলেই হত, মানুষের শরীরেই তো ভগবান, তাও মা ঠাকুরের সামনে দিত, ঠাকুরের এঁটো হলে প্রসাদ হবে| উপল মাঝে মধ্যে ভাবে প্রায় সে ঈশ্বরের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে, তার কোন পিছুটান নেই শুধু মনের ক্যানভাসে এঁকে চলেছে| এই যে মন্দির , একটা কুকুর , পেচ্ছাপ করে দেবে তুলসি তলায়| শুধু এই ছবি তার মন্দির ঘিরে| কুকুরদের ভগবান লাগে না, আর কারোর লাগে না শুধু অসভ্য মানুষের লাগে কেলাকেলি করবার জন্য, হাসি পায় উপলের| রাস্তায় রাস্তায় যারা ফ্যা ফ্যা করে, এরকম বর্ষার দিনে তারা কোথায় যেন সব চলে যায় ছাউনির তলায়|ইলেকট্রিকের তার গুলো শুধু একনাগাড়ে বৃষ্টিতে ভেজে , উপলের ইচ্ছা করে ইলেকট্রিকের তার গলায় জড়িয়ে মরে যায়, কলকাতা শহরটাও তো ওই ভাবে ফাঁসে ঝুলে আছে কতদিন, প্রাণখানি বেরোবো বেরোব করেও বেরাচ্ছে না , উপলেরও যদি ওরকম হয়, গা টা শিরশির করে ওঠে, বেদম জ্বর আসছে মনে হয়, টলমল পায়ে উপল তার পলেস্তরা খসা পুরোনো ঘরে ফরে আসে, আসতেই হয়| আলমারির মাথায় গুঁজে রাখা বাঁশিটিতে ফুঁ পড়ে তার| ঘরের মধ্যে সে বাজিয়েই চলে সন্ধ্যে ছাপিরে রাত , গভীর রাত বাজতেই থাকা, গলিতে তখন সুরের বন্যা ভেসে যাচ্ছে মোড়ের মাথা পর্যন্ত আশ্চর্য সেই সুর| বাঁশি আর বৃষ্টির ঝুগলবন্দিতে ঝিঁ ঝিঁ পোকা যোগাড় দেয়| উপলের পাশে এসে বসে তার মা, গলায় দড়ি দিয়েছিল |আর সেই প্রথম প্রেমিকা, কার ভুলে বিষ খেয়েছিল| ঘুমিয়ে পড়ে উপল, আপাতত মনের সব দরজা বন্ধকরে ঘুম দেবে সে আগামী কদিন , পারলে আর একটা বৃষ্টির আগ অব্ধি

0 comments: