0

প্রবন্ধ - সব্যসাচী মজুমদার





















১.


অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তী ভূমিকা লিখতে গিয়ে জানাচ্ছেন,


“কোনও নির্দিষ্ট সারস্বত লক্ষ ছিল না বলেই তাঁর রবীন্দ্রবিচার জাতীয় জীবনের উদ্বোধনের নামান্তর।হয়তো সেইজন্যেই তিনি একসঙ্গে রবীন্দ্রবাণীর মধ্যে আবিষ্কার করেন ইবসেন, হুইটম্যান ও ব্রাউনিং-এর মতো পরস্পর বিরোধী মানস-সংযোগ,যা খুব স্হিতধী ও বিবেচক সাহিত্য চিন্তায় টেঁকে না।“(আঠেরো/ভূমিকা)


এবং এই প্রসঙ্গে নিজের যুক্তির স্বপক্ষে সুধীর বাবু তুলে ধরছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠিকে,


“হুইটম্যানের সঙ্গে তুলনা করলে রবীন্দ্রনাথের মর্যাদা হানি হয় কিনা সে প্রশ্ন উঠতে পারে।এ প্রসঙ্গে বিজয়লালকে লেখা রবীন্দ্রনাথের এক অপ্রকাশিত চিঠি বেশ কৌতূহলপ্রদ,যেখানে তিনি হুইটম্যান সম্পর্কে খুব প্রসন্ন মন্তব্য করেননি। রবীন্দ্রনাথ ৩০আষাঢ় ১৩৪৪ তারিখে লিখছেন,

তোমাদের হুইটম্যানের কাব্যালোচনার প্রচেষ্টা জয়যুক্ত হোক,এই ইচ্ছা করি। প্রকাণ্ড একটা খনি,ওর মধ্যে নানান কিছুর নির্বিচারে মিশেল আছে, এরকম সর্বগ্রাসী বিমিশ্রণে প্রচুর শক্তি ও সাহসের প্রয়োজন-আদিমকালের বসুন্ধরার সেটা ছিল-তার কারণ তখন তার মধ্যে আগুন ছিল প্রচণ্ড-এই আগুনে নানা মূল্যের জিনিস গলে মিশে যায়।হুইটম্যানের চিত্তে সেই আগুন যা তার কাণ্ড করে বসেচে। জাগতিক সৃষ্টিতে যেরকম নির্বাচন নেই ,সংঘটন আছে,এ সেইরকম -ছন্দোবদ্ধ সব লণ্ডভণ্ড-মাঝে মাঝে এক -একটা সুসংলগ্ন রূপ ফুটে ওঠে আবার যায়, মিলিয়ে।যেখানে কোনও যাচাই নেই, সেখানে আবর্জনাও নেই, সেখানে সকলের সব স্হানই স্বস্হান।এক দৌড়ে সাহিত্যকে লঙ্ঘন করে গিয়েছে এইজন্য সাহিত্যে এর জুড়ি নেই -মুখরতা অপরিমেয় -তারমধ্যে সাহিত্য অসাহিত্য দুই সঞ্চরণ করচে আদিম যুগের মহাকায় জন্তুদের মতো।এই অরণ্যে ভ্রমণ করতে হলে মরিয়া হওয়ার দরকার।


রবীন্দ্রনাথ সুকৌশলে হুইটম্যানের কাব্যধর্ম সম্বন্ধে যা বলেছেন বিজয়লালের রবীন্দ্রবিচার বিষয়ে হয়তো কারও সেই একই কথা মনে আসতে পারে।“(আঠারো/উনিশ/ভূমিকা)


এই আলোচনার পর হয়তো,বিষয়টিকে নিয়ে আর কিছু বলার থাকতো না,যদি না, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এর সম্পূর্ণ বিপরীত মত পোষণ করতেন।বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় প্রণীত রবীন্দ্র বিষয়ক চারটি গ্রন্হ-বিদ্রোহী রবীন্দ্রনাথ, রিয়লিস্ট রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্র সাহিত্যে পল্লি-চিত্র,রবিতীর্থে এবং অগ্রন্থিত আলোচনা’কবিগুরুর কৈফিয়ৎ’ সম্পাদনা করে একত্রে এনেছিলেন সত্যজিৎ চৌধুরী আর সুধীর চক্রবর্তী। সঙ্গে বিজয়লালকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলিকে গ্রন্হভুক্ত করে নাম দিলেন,’রবীন্দ্রনাথ’।মে, উনিশশো একানব্বই সনে প্রকাশিত গ্রন্থের ভূমিকা রচনার ভার নিয়েছিলেন সুধীর বাবু স্বয়ং।সেখানেই বিজয়লালের গদ্য এবং তার স্বরূপ সন্ধানে সুধীর বাবু উদ্ধৃত মন্তব্যগুলি প্রাসঙ্গিক বলে মনে করলেন।


বিজয়লালের রচনায় কী ছিল,আর কোন প্রসঙ্গে কবি এবং সম্পাদকের আপত্তি-ঘটনাটিতে প্রবিষ্ট হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে,অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত প্রণীত ‘সুন্দরের অভ্যর্থনা’গ্রন্হের কিছু অংশ মনে করে নেওয়া আশু প্রয়োজন। বিদগ্ধ রবীন্দ্রবিক্ষক ও .সি.গাঙ্গুলীর একটি ধারণার সঙ্গে তর্কের অবকাশে অলোকরঞ্জন লিখছেন,


“... কিন্তু মোডে বর্ণিত এই অনুচ্ছেদে রবীন্দ্রসমগ্রেরই একটি অনিবারণীয় অভিক্ষেপ হিসেবে চিত্রকলাকে দেখবার যে আয়োজন আছে,সেটি আমাদের কাছে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সমগ্রের মধ্যেই তো আছে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,’আত্মপ্রতিবাদের ঐক্য ‘,হুইটম্যানের সেই উন্মোচন যে,

Do I contradict myself?

Very well,then I contradict myself,

I am large, I contain multitude


ফলতঃ রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে ‘his pictorial experiments reveal a new personality which contradicts his political genius,his highly developed intellectual talents,”ও.সি-র এই অসহায় গোঁড়ামির প্রতিপাদ্য চূর্ণ হয়ে যায়।“(সুন্দরের অভ্যর্থনা:অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ,৩৯)


অলোকরঞ্জনের এই অভিজ্ঞান যেন যুগপৎ তছনছ করে দিতে চায় রবীন্দ্রনাথের অভিযোগ এবং সুধীর চক্রবর্তীর প্রণিধান।এই একই গ্রন্হে,এর পূর্ববর্তী প্রহরেই অলোক বাবু আরও এক কদম এগিয়ে রবীন্দ্রনাথ, প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং জীবনানন্দের ‘অন্তরঙ্গ ‘ হিসেবে হুইটম্যানকে উল্লেখ করে লিখছেন,


“তখনই রবীন্দ্রনাথ-প্রেমেন্দ্র-জীবনানন্দের অন্তরঙ্গ হুইটম্যানের ‘ভারতবর্ষের দিকে ‘কবিতাটিকে কেন্দ্র করে আমাদের মানসে কৌতুহল থাকে।পর-পর তিনটি বিস্ময়বোধক চিহ্ন প্রণয়ন করে তৎক্ষণাৎ তাদের পরিশিষ্টে তিনটি অমীমাংসিত প্রশ্নচিহ্ন বুনে দিয়েছিলেন:

আমরা কি গাছের মতো প্রোথিত হয়ে থাকিনি দীর্ঘ দিন?

লাঞ্ছনায় কাটেনি বুঝি নিছক জন্তুর মতো ক্ষুধা আর তৃষ্ণার তৃপ্তায়নে আমাদের কাল?

পুঁথি পড়ে যুগ যুগ আমরা কি হতবুদ্ধি আর তিমিরাচ্ছন্ন হয়ে থাকিনি?”...


আরও প্রতিবাদের মুখে পড়ে সুধীর চক্রবর্তী কৃত ভূমিকাটি।এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের হুইটম্যান ভাবনাও।বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়ের স্বপক্ষেই যেন নিজের চিন্তা স্বস্হ করলেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত।একই সঙ্গে দেখিয়ে দিতে চাইলেন,রবীন্দ্রনাথ যে অভিযোগ হুইটম্যানের কাব্য সম্পর্কে স্হাপন করেছেন,তার অনেকটাই সত্য হয়ে যায়,তাঁর সামগ্রিকে।


‘সুন্দরের অভ্যর্থনা’গ্রন্হের প্রণেতা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হুইটম্যানকে খুঁজে পাচ্ছেন তাঁদের, রবীন্দ্র কথিত,’আত্মপ্রতিবাদের ঐক্যে’। এই সূত্র ধরেই তবে বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়ের ধারণাকে, হুইটম্যান ও রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে, দেখে নেওয়া জরুরি বলেই বোধকরি। লিখছেন বিজয়লাল,


“আমেরিকার সাহিত্যে হুইটম্যান যে নূতন সুরটিকে জাগালেন,বাংলার সাহিত্যে সেই সুর জাগিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।হুইটম্যানের কবিতায় আমেরিকা যেমন তার পর্বত এবং সমুদ্র, অরণ্য এবং প্রান্তর,নদী এবং উপত্যকার পটভূমিতে সাধারণ মানুষকে নিয়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যেও বাংলাদেশ তেমনি তার পল্লবঘন আম্রকানন,দীগন্তব্যাপী উদার প্রান্তর নদীতীরের ছায়াময় নীলবনরেখা, জনহীন ভগ্নমন্দির...চখাচখির কাকলি-কল্লোলের পটভূমিতে সাধারণ বাঙালিকে নিয়ে জীবন্ত হয়ে দেখা দিয়েছে।“(রবীন্দ্র সাহিত্যে পল্লি-চিত্র; পৃঃ ১৫৯)।

হ্যাঁ,এ ভাষাকে ‘নন-একাডেমিক’বলতে দ্বিধা হয় না,যেমন বলেছেন ভূমিকা লেখক। আবার অতি উপমাময়,কাব্যিক বলেও আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। বিশ্লেষণাত্মক আলোচনাও নয়। অনেকাংশেই রবীন্দ্র সম্পর্কিত আলোচনার প্রাক্-পর্বের সংকটে আপন্ন হয়েছে এই ভাষা সঞ্চার,দর্শনও,সেটি একান্তই মুগ্ধতার সংকট। মনে পড়তে পারে, এক্ষেত্রে, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্র জীবনীর কথা। অপীচ,একই সঙ্গে একটি অতিদুরূহ সমস্যার সম্মুখীন করে দেয় উদ্ধৃত অংশের মূলপাঠখানি ,অর্থাৎ ‘রবীন্দ্র সাহিত্যে পল্লি-চিত্র’।


ভূমিকাতেই, অর্থাৎ সুধীর চক্রবর্তীর লিখনেই জানতে পারা যায়,

“রবীন্দ্র সাহিত্যে পল্লি-চিত্র ‘পড়ে তিনি(রবীন্দ্রনাথ) লিখেছেন,

...তোমাকে এই চিঠিতে আশীর্বাদ না করে থাকতে পারলুম না। আমার পল্লিচিত্র সম্বন্ধে তোমার বইখানি পড়ে বিশেষ খুশি হয়েছি তার কারণ এ নয় যে তুমি আমাকে প্রশংসা করেছ।“(বার/ভূমিকা)


অথচ,এই বইয়েই আগাগোড়া, প্রাবন্ধিক, আলোচনা করেছেন হুইটম্যানকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাযুজ্যে,সামীপ্যে। হ্যাঁ,এটাও একই সঙ্গে মনে পড়ছে যে,সেই রবীন্দ্র অসূয়ার যুগে,যিনিই রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা করেছেন,তাঁকেই কবি জানিয়েছেন সাধুবাদ এবং অনেক সময় শুধরেও দিয়েছেন। সুধীর বাবুর দীর্ঘ ভূমিকা সেই ইঙ্গিতও দেয়। কিন্তু, সমস্যাটা তৈরি হয় স্বতন্ত্র অবকাশে।হুইটম্যানের সঙ্গে তুলনা সত্ত্বেও ,আপত্তির পরেও রবীন্দ্রনাথকেও হয়তো একটি আত্মপ্রতিবাদের ঐক্যে আসতে হলো প্রশংসা বাক্যে! তাহলে, কি রবীন্দ্রনাথ ধরতে পারেননি হুইটম্যানের কবিতার মূল সুরকে এবং সেই ভ্রান্তির অনুগমন করলেন, ভূমিকা লেখকও?নাকী বিজয়লালের ভাবনা,অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের প্রণিধান তবে ‘স্হিতধী ও বিবেচক ‘সাহিত্য ভাবুক নন!


আরও বেশ কয়েকটি পরিসরে তৈরি হয় দ্বন্দ্ব।পল্লিচিত্র তো বটেই এমনকি উনিশশো বাষট্টিতে প্রকাশিত ‘রবিতীর্থে’ও মিলিয়ে দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ও হুইটম্যানকে।যার অনেকগুলো প্রবন্ধই যেমন,পলাতকা,জ্যাঠামশায় রবীন্দ্রপ্রশংসিত।গ্রন্হের শেষে ‘সংযোজন’ অংশে ব্যবহৃত রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি পত্র থেকে জানা যায়,কবি বিশেষ প্রীতিবোধ করতেন ১৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দে ‘দেশ ‘পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসেবে কর্মরত বিজয়লালের রবীন্দ্রবিচারের ওপর।


‘দেশ’পত্রিকার সহ-সম্পাদনাকালীন সময়ে বারংবার কবির সঙ্গে তাঁর পত্র আদান-প্রদানের বিশেষ পরিচয় রয়েছে সুসম্পাদিত গ্রন্হটিতে।এই কার্যকাল সম্পর্কে জানাচ্ছেন অন্যতম সম্পাদক সুধীর চক্রবর্তী,


“সম্পাদনার পাশাপাশি ‘দেশ’পত্রিকায় বেশ কয়েক সংখ্যা ধরে তাঁর রবীন্দ্র সাহিত্য সমালোচনা প্রকাশিত হতে থাকে।‘দেশ’পত্রিকায় প্রকাশিত বিজয়লালের রবীন্দ্রবিষয়ক রচনার সবকটি রবীন্দ্র -তোষণ নয়।, বরং অনেক ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্যের বিরোধিতাবহুল।তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ১৯৩৫ সালের ১১মে সংখ্যা ‘দেশ’পত্রিকায় প্রকাশিত বিজয়লালের রচনা ‘কবিগুরুর কৈফিয়ৎ ‘।“(ভূমিকা/৫)


এবং লক্ষ্যনীয় বিষয়,এই প্রবন্ধেও উপস্থিত হচ্ছেন হুইটম্যান।যদিও এই অবকাশে ‘দেশ’পত্রিকার সহ-সম্পাদক তথা ‘আনন্দবাজার’-এর সাংবাদিক বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় ‘জন ক্রিস্টোফার’কে সামনে রেখে ‘চার অধ্যায়’সম্পর্কে স্পষ্টতঃই জানাচ্ছেন,


“তিনি চারিদিকের লোকজনের অস্তিত্ব সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ হইয়া উক্ত উপন্যাসখানি সৃষ্টি করিয়াছেন।“(সংযোজন:৪২১)


সে স্বতন্ত্র প্রসঙ্গে প্রবেশ না করে,অলোকরঞ্জন -বিজয়লালের সহমত্যের আরেকটি জোরদার সাযুজ্য দেখে নেওয়া যাক। মনে রাখতে হবে অলোকরঞ্জন বাবু রবীন্দ্রনাথের ‘আত্মপ্রতিবাদের ঐক্যে’-র প্রসঙ্গে যে কবিতাটির অনুষঙ্গ ব্যবহার করলেন তা হুইটম্যানের ‘songs of myself ‘,অব্যবহিত পূর্বেই বিজয়লাল এই একই কবিতার সঙ্গে,অর্থাৎ উনিশশো বাষট্টিতে প্রকাশিত ‘রবিতীর্থে’, মিলিয়ে দিচ্ছেন,

রবীন্দ্রনাথের “জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ।

ধন্য হল ধন্য হল মানব জীবন”কে।উদ্ধার করছেন হুইটম্যান রচিত

‘swiftly arose and spread around me the peace and knowledge that pass all the argument of the earth,...”কে।


অর্থাৎ হুইটম্যান অনুরক্ত বিজয়লাল একটি বিতর্কের অবকাশ আজও জারি রাখছেন। হুইটম্যান ও রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে তাঁর ও অলোকরঞ্জনের প্রণিধানের সঙ্গে মধুর বিরোধ তৈরি হচ্ছে সুধীর চক্রবর্তীর বিজয় বাবুর এই চিন্তা সম্পর্কে ঈষৎ অবজ্ঞার। এবং যথারীতি ‘আত্ম-প্রতিবাদ’ সমেত হলেও সুধীর বাবু পাশে পেয়ে যাচ্ছেন স্বয়ং কবিকে।


২.

‘চারণকবি’ হিসেবে খ্যাত হয়েছিলেন আজন্ম রাজনৈতিক কর্মী বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়। জীবনানন্দের সমবয়সী কবি আঠেরোশো নিরানব্বইএর সেপ্টেম্বর মাসে কৃষ্ণনগরে। মূলত তিরিশের দশকে কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ।‘সবহারাদের গান ‘,’কালের ভেরী’ও ‘ডমরু ‘প্রকাশিত হয়,তখন তিনি ‘বঙ্গবাণী’পত্রিকার সহ-সম্পাদকের পদে কার্যরত।

এরপর উনিশশো তিরিশে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হলে বিজয়লাল সাংবাদিকতা ছেড়ে নদীয়াতেই আবার ফেরেন কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে। এইসময় অর্থাৎ উনিশশো একত্রিশে ‘বিদ্রোহী রবীন্দ্রনাথ ‘প্রকাশিত হয়। সুধীর চক্রবর্তী ভূমিকা থেকে জানা যাচ্ছে,


“বইটি ১৯৩২সালের ১৫ এপ্রিল বাজেয়াপ্ত হয় [section 19 of the Indian press (emergency power) ordinance act XXIII of 1931]”(চার/ভূমিকা)


উনিশশো বত্রিশে স্বগৃহে অন্তরীণ থাকার সময় গোপনে কৃষ্ণনগর পরিত্যাগ করে গ্রামান্তরে চারণের দায়িত্ব পালন করার সময় কারারুদ্ধ হন। অবশেষে ছয় জানুয়ারি, উনিশশো চৌত্রিশ থেকে ‘দেশ’পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। উনিশশো চল্লিশ পর্যন্ত আনন্দবাজার,প্রবাসী ও ভারতবর্ষের সঙ্গে সাংবাদিক হিসেবেও সংযোগ রেখেছিলেন বিজয়লাল। কিন্তু অদ্ভুতভাবে একটি বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে, তাঁর চারণ স্বভাব ছিল মূলগত।ভারভারা রাওয়ের মৃত্যুর এই অন্তর্বর্তী প্রহরে মনে করতে ভালো লাগে,বিজয়লাল চল্লিশের সেই আগলভাঙা টানে নিরাপত্তা অস্বীকার করে আবার রাস্তাতেই বিশ্বাস বাসলেন। নদীয়ার হাঁসখালী অঞ্চলে কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে শুরু করলেন চারণ আন্দোলন।তার জন্য সংগঠন গড়ে তোলা কিংবা চারণগান রচনা -সমস্ত ভারই ন্যস্ত করেছিলেন স্বস্কন্ধে। মনে রাখতে হবে ইতিপূর্বে তাঁর রচিত প্রতিটি কাব্যই কিন্তু বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। বিশেষ করে ‘সবহারাদের গান ‘তো পরবর্তী কালে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে,



গলায় জড়ায়ে ফাঁসীর রশিটি, অধরে করুণ হাসি, তরুণ পথিকা ব’লে যাও মোরে কারে এত ভালবাসি’। এমন করিয়া বিবাগী হইয়া ফাঁসীরে করিয়া নিলে, যৌবন-তরী মরণ-সাগরে হেলায় ভাসায়ে দিলে। তরুণ বয়স, রূপ-রস-ভরা এই ধরণীর গেহ, ধন জন মান, পরিচিত কত আপন জনার স্নেহ, তোমারে বাঁধিতে পারিল না কেহ, বীর সন্ন্যাসী, তুমি গাহিতে গাহিতে চ’লে গেলে “মোর জননী জন্মভূমি। স্বরগের চেয়ে গরীয়সী তুমি, পরাণ-শীতল করা, সকল সুখের বড় সুখ মাগো। তোমার লাগিয়া মরা।” ফাঁসীর মঞ্চে আজিকে তোমারে হেরি অপরূপ বেশে;(বিপ্লবীর প্রতি/সবহারাদের গান)


সমকালের রসিক পাঠকের কাছে এ কবিতা বিশেষ স্ফুর্তির কারণ হয়তো হতে পারবে না। রবীন্দ্রনাথ -নজরুলের অনুপ্রাণিত একটি ভাষা পাঠকের রুচিতে সাব্যস্ত হবে, সেইসাথে কবিতার কাব্যিক মূল্যও অনেকাংশে মিশে যাবে রবীন্দ্র অনুসরণের অভিধায়। এমনকি ১১/৩/৪১ তারিখে ১০/১/বি,আর.জি.কর রোড থেকে প্রেরিত একটি পত্রে রবীন্দ্রনাথের প্রতি একটি সনেট লিপিবদ্ধ করেন বিজয়লাল।‘রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্হে সংকলিত সে সনেটের পাঠ নিলেও অনেকটা একই অভিজ্ঞতা হয়

“দুর্গম পথের যাত্রী করিলে তাহারে

মৃত্যুর বন্দনা তব সংগীত -ঝংকারে।

নব্য ভারতের বুকে তব শঙ্খ রব

আনিল যুগান্তকারী বিপুল বিপ্লব।“


এ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলার অবকাশ অবশ্যই থেকে যায়। আমাদের পাঠপ্রক্রিয়া বহুরৈখিক।বহুবিধ সাপেক্ষ সূচকে একটা টেক্সটকে বিচার করতে হয় আমাদের।কোনও কোনও টেক্সট তাই ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে সার্থক হয়ে যায়।মনে রাখতে হবে,বিজয়লাল ছিলেন বিশেষ হুইটম্যান অনুরক্ত। তাঁর রচিত ‘বিদ্রোহী হুইটম্যান ‘সেই সাক্ষ্যই দেয়। ফলতঃ বিজয়লাল সমকালীন আন্তর্জাতিক কবিতা ও সাহিত্য সম্পর্কে বিশেষ অবগত ছিলেন,এ কথা অস্বীকার করা যায় না। বিশেষতঃ ‘রবীন্দ্রনাথ’গ্রন্হের ইতিউতি যখন ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর পাণ্ডিত্য ।এজরা পাউন্ড,রোমা রলা, ইবসেন,ব্রাউনিঙের নিবিড় প্রসঙ্গ,আরও অস্বীকার করা যায় না বিজয়লালের পাঠের ব্যাপ্তীকে।হ্যাভেলক এলিসের যৌন বিজ্ঞানও তাঁর পরিধির আওতায় ছিল। ফলতঃ এহেন,পাঠক,যখন কবির ভূমিকা পালন করছেন , এবং লিখছেন তাঁরই বহুপাঠপ্রাণিত,কিছুটা অনুসৃত লেখা,ধরে নেওয়াটা খুব অন্যায় হবে না,এটা ইচ্ছাকৃত।


আসলে কবিতার নান্দনিক বিনির্মাণে নিয়োজিত হওয়ার চাইতেও কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় অধিক আগ্রহী ছিলেন চারণধর্ম পালনে -বিশ্বাস করতে ভালো লাগে। রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরের রচনা সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন,

“কর্মজীবনের প্রলেপের মতো।“সেই টিপ্পনী যেন আরও প্রাসঙ্গিকতা পায় বিজয়লালের কবিতার পরিসরে। একান্তই টপিক্যাল করে তুলেছিলেন কবিতাগুলিকে। নজরুলের আত্মস্ফূরণ ও রোমান্টিকতার দ্বিরালাপকেও অনুপস্থিত দেখা যায়। প্রবন্ধ রচনা, সংগঠন,চারণ আন্দোলন ও রাজনীতিতে অধিক সক্রিয়তার কারণেই হয়তো কবিতার প্রতি তাঁর মনোযোগের অভাব টের পাওয়া যায়। কিন্তু ‘অভাব’বলাও কী যায়!টপিক্যাল কবিতা যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তা তো মাননীয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা বাংলা একাডেমি প্রাপ্তি বুঝিয়ে দেয়।


বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় উনিশশো বাহান্ন আর ষাটের নির্বাচনে কংগ্রেসের বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হন। উনিশশো ষাটে যক্ষারোগাক্রান্ত হন। উনিশশো চুয়াত্তরের আঠেরো ফেব্রুয়ারি পরলোক গমন করেন।

বিজয়লালের জীবন সম্পর্কে সুধীর চক্রবর্তীর একটি মন্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন,


“বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রসাহিত্য নিয়ে যাঁরা আলোচনা করেছেন এবং রবিকর-রেখা যাঁদের জীবনের পথ -নির্দেশ করেছে, তাঁদের মধ্যে বিজয়লালের জীবন সম্ভবতঃ সবচেয়ে ঘটনাবহুল,সক্রিয়, বিতর্কিত, বিচিত্র কর্মে উত্তাল এবং পরস্পরবিরোধী ভাবাদর্শে উদ্বেল।“(ছয়/ভূমিকা) আর এই কারণেই হয়তো বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় সমস্ত রবীন্দ্র আলোচকদের চাইতে স্বতন্ত্র হিসেবে মনে করছেন অনুজ কৃষ্ণনাগরিক সুধীর চক্রবর্তী।


এই আলোচকের আরও একটা নাম মনে পড়ছে, হরিনাথ মজুমদার। অবশ্য একই পঙক্তিভুক্ত হতে পারেন, ইতোপূর্বের হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ও। তিনজনের কাছেই সাংবাদিকতা আর সাহিত্য ছিল আক্ষরিক অর্থেই তলোয়ার। অনিঃশেষ লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন,এখানে ‘ইংরেজ’ বলে শাসক বা শাসনকে সীমাবদ্ধ করতে চাইছি না,শাসকের বিরুদ্ধে। হরিশ্চন্দ্র -হরিনাথ-বিজয়লাল,তিনজনেই এই একটি ক্ষেত্রে সামীপ্য তৈরি করলেও কবি-ধর্মে অবশ্য বিজয়লাল -হরিনাথের সম্পর্ক অধিক নিকট।


৩.

হয়তো বা যুগের প্রয়োজনে বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় কবি হিসেবে চিহ্নিত হবেন। কিন্তু তাঁর সারাজীবনের সাহিত্য -চিন্তার মূল প্রেক্ষণটি ছিল কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে লক্ষ করেই। এবং এ কথা বলা, বিশেষ অসংগত হবে না যে, রবীন্দ্রনাথের প্রয়োজন ছিল বিজয়লালকে। এখানে ব্যাক্তি সার্থের প্রসঙ্গ আসছে না। বোধহয় এভাবে বললে সার্থকতা আসতে পারে, রবীন্দ্র সাহিত্যের প্রয়োজন ছিল বিজয়লালের দেখার চোখ।


একটি তথ্য দিলে, বক্তব্যটি বিশদ করতে সুবিধা হবে।বিজয়লালের ‘বিদ্রোহী রবীন্দ্রনাথ ‘(১৯৩১)

প্রকাশের আগে, মুষ্টিমেয় রবীন্দ্রবিষয়ক গ্রন্হের সন্ধান পাওয়া যায়।তার মধ্যে অবশ্যই অজিত কুমার চক্রবর্তীর রবীন্দ্রনাথ (১৯১২) উল্লেখযোগ্য।এ প্রসঙ্গে আবারও সুধীর চক্রবর্তী সমীপে গেলে, তিনি জোরের সঙ্গেই জানান,


“যাঁদের আমরা প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্রসাহিত্য সমালোচক বা রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ বলে জানি তাঁদের মধ্যে কেউই বিজয়লালের আগে উল্লেখযোগ্য রবীন্দ্রবিষয়ক গ্রন্হ লেখেননি।এই তালিকায় চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়,নীহাররঞ্জন রায়,প্রমথনাথ বিশী,প্রবোধচন্দ্র সেন প্রভৃতি আরও আছেন।“(আট/ভূমিকা)


এবং আরও এক পা এগিয়ে বিজয়লালের রবীন্দ্র আলোচনার তিনটি উল্লেখযোগ্য বিশেষত্ব আরোপের পর, তৃতীয় বিশেষত্বটির ওপর জোর দিয়ে জানান,যখন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য পাঠকের কাছে, সমালোচকের কাছে সংশয়-স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের মোহন ফাঁদে হাবুডুবু খাচ্ছে আলোচনা,বিজয়লাল আন্তরিক মৌলিকতায় ও দ্বিধাহীন দৃঢ়তায় রবীন্দ্র সাহিত্যের বহুব্যাপ্তিকে ফুটিয়ে তুলেছেন।


সেইসাথে এইটুকুও যোগ করা যায়, তাঁর আপাত –‘নন-একাডেমিক’ চিন্তাগুলিও প্রবলভাবে আচ্ছন্ন করে পরবর্তী আলোচকদেরও।অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের প্রণিধান এই সংযুক্তিকে সমর্থন করবে।


সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা উল্লেখযোগ্য সংযোজন প্রয়োজন। সম্ভবতঃ ‘রিয়লিস্ট রবীন্দ্রনাথ ‘রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্যের আলোচনার পূর্ণাঙ্গ গ্রন্হ।ইতিপূর্বের আলোচনাগুলি প্রধানত রবীন্দ্রনাথের কবিতাকেই লক্ষে রেখে রচিত হয়েছে।ফ্রয়েডের সূত্রানুযায়ী বিশ্লেষণে সম্ভবত প্রীত রবীন্দ্রনাথ লেখককে একটি চিঠিতে লেখেন,

“তোমার ‘মনের খেলা ‘বইয়ে সরল ভাষায় সরসভাবে মনস্তস্ত্ব আলোচনা করেছ –‘রিয়লিস্ট রবীন্দ্রনাথ ‘গ্রন্হে সেই তত্ত্ব বিচারকে যেন রান্নাঘর থেকে এনে ভোজের সভায় সাজিয়েছ।“(শান্তিনিকেতন:৭/১০/৩৬)।


এই গ্রন্হের ‘দুই বোন ‘, ‘মালঞ্চ ‘,’বাঁশরী’,’চার অধ্যায়’,’শেষের কবিতা ‘সম্পর্কে আলোচনা রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিকতার দিকে বাঙালির পাঠষ্ক্রিয়াকে এগিয়ে দিয়েছিলো। রবীন্দ্রনাথ কেবল কবি নন,নাটককার,সংগঠক, ছোটোগল্পকার,প্রাইমার রচয়িতা, ছোটগল্প লেখক,ঔপন্যাসিক,চিত্র শিল্পী, প্রাবন্ধিক -এই সমস্তটা মিলিয়েই তবে রবীন্দ্রনাথ।একটি পুঞ্জ পুঞ্জ রঙের সামগ্রিক সমাহার।সর্বজনীনতায় তাঁকে না পড়লে,অধিত করতে পারার বিশেষ সম্ভাবনা নেই বলেই বিশ্বাস। আবার এই প্রসঙ্গে ‘রবিতীর্থে’-র ‘জ্যাঠামশায়’নামক নিবন্ধটিকে বিশেষভাবে স্মরণ করা যায় ‌‌‌‌,


“জ্যাঠামশায়ের ভাষায়”আমাদের নাস্তিকের ধর্মশাস্ত্রে ভালো কাজের জন্য নিন্দার নরকভোগ বিধান।“যারাই সমাজের পুরাতন আদর্শকে বর্জন করে নূতন আদর্শকে সৃষ্টি করবে তাদের ভাগ্যেই নিন্দা আর লাঞ্ছনা অনিবার্য।এই সত্যকে নীটসে অনেক দিন আগেই ঘোষণা করেছেন।“the good must crusify him that inventeth for himself his own virtue! That is truth.”।(জ্যাঠামশায় /রবিতীর্থে/২৫৮-৫৯)


সত্যের এই সূত্রে নাস্তিক্য ধর্মের উদগাতা,ধর্মের স্বরূপে আঘাত হানা জ্যাঠাশায়কে নীটশের সঙ্গে একীভূত করে দেন কেবল তাই নয়, ভাঙনের প্রবণতায় তিনি জ্যাঠামশায়ের মধ্যে পেয়েছিলেন নীটশের এই আহ্বানবাণীকে,


“Break,break the good and righteous!o my brethren, have ye understood this word?”(জ্যাঠামশায়/ রবিতীর্থে/২৫৯)


এই বজ্রঘোষণাকে রবীন্দ্রনাথ মূর্ত করেছিলেন তুমুল নাস্তিক্য ধর্মের প্রেরণায়। বস্তুত সজীবের প্রতি প্রীতিমানসে জ্যাঠামশায় যে বিবর্তিত কালের ধ্রুব স্বরূপ তা বুঝতে পেরেছিলেন লোকজ্ঞান সম্পন্ন বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়। মানুষের,লোক মানুষের দৃষ্টি যেদিকে ফিরছে এবং যেদিকে ফিরবে,তা, বুঝতে দ্বিধা করেননি বলেই জ্যাঠামশায়কে অদূরযুগচরিত্র হিসেবে, চিহ্নিত করে, রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিপন্ন করতে পেরেছিলেন। আবার লক্ষ করা যায়, এরপরের আলোচনা ‘চতুরঙ্গের রবীন্দ্রনাথ ‘-এ অনাসক্তির আদর্শে শচীশ আর ঔপন্যাসিককে এক করে দিচ্ছেন।শচীশ আত্মোপলব্ধির গভীর রাতে যে কথাগুলো শ্রীবিলাস আর দামিনীকে বলেছিল,তারই প্রতিধ্বনি শুনতে পান ‘religion of man’-এ,

“The abinding cause of all misery is not so much in the lack of the life’s furniture as in the obscurity of life’s significance.”(রবিতীর্থে/২৬৭)


আসলে, একটা টেক্সট অজস্র সাবটেক্সটের দাবি করে। এবং তার পাঠপ্রক্রিয়ার সময় সেই টেক্সটগুলো তুলনাত্মকতা তৈরি করলে পাঠের সামগ্রিক নির্মীত হতে পারে। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি তো অত্যন্ত জরুরি। অন্ততঃ এই গ্রন্হের পাতায় পাতায় অজস্র রেফারেন্সে তাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন।এই গ্রন্থ পাঠের সঙ্গে সঙ্গে পাঠককেও শিক্ষিত হয়ে উঠতে হয়।


এই সূত্রেই ‘বিদ্রোহী রবীন্দ্রনাথ ‘আলোচিত হওয়া প্রয়োজন। অন্ততঃ এই কৌতুহলের তাগিদে তো বটেই -গ্রন্হের নিষিদ্ধকরণ দুর্লভ না হলেও গ্রন্হের আলোচনার বই বাজেয়াপ্ত হয়েছে,এ সচরাচর জানা যায় না। হয়তো এ কারণেই বাজেয়াপ্ত হয়েছিল -বিজয়লাল ‘ফাল্গুনী’র রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ‘songs of the open road -এর রবীন্দ্রনাথকে মিলিয়ে দিয়ে লেখেন,


“বাংলার যৌবনের কানে বিদ্রোহের বাণী দিয়াছেন রবীন্দ্রনাথ।যেখানে পুথির শাসন ছিল সেখানে তিনি প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন প্রাণের রাজত্ব...”।(বিদ্রোহী রবীন্দ্রনাথ/৪৫)

হয়তো বা রবীন্দ্রসাহিত্যের স্বরূপ প্রতিষ্ঠানের সার্থগুলির সঙ্গে একমত হচ্ছিল না। কিন্তু এই আলোচককের আগ্রহ এই গ্রন্হেরই অন্যত্র।


চতুর্থ প্রস্তাবে গ্রন্হকার রবীন্দ্রনাথের তত্ত্ব নাটক গুলির অন্যতম ‘মুক্তধারা’এবং ‘রক্তকরবী’ সম্পর্কে প্রসঙ্গক্রমে আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন। ‘মুক্তধারা’র বিভূতির স্বরূপ নির্ণয় করতে গিয়ে বলছেন,


“বিভূতি কলকারখানাবহুল শক্তিমদমত্ত পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতীক”(বিদ্রোহী রবীন্দ্রনাথ/৩১)

ঠিক একইভাবে বিভূতিকে নির্ণয় করছেন পরবর্তীর রবীন্দ্র আলোচকেরা, এবং বিভূতি যে একটি প্রতীক চরিত্র,তারও নিশ্চয়াত্মক আলোচনা দুর্লভ নয়,যার সূত্র লেখা পাওয়া যায় বিজয়লালের চকিত আলোচনা গুলিতে।আরও একটি বিষয় এক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়,যে প্রতীক প্রবণতা হেতু রবীন্দ্র তত্ত্ব নাটকগুলোর সাংকেতিকতা এবং রূপক ধর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।যে শ্রেণির নাটককে প্রমথনাথ বিশী ‘তত্ত্বনাট্য’বলে নির্দিষ্টিকৃত করতে চেয়েছেন, তার উল্লেখ সেই রবীন্দ্র আলোচনার প্রথম প্রহরেই তুলে ধরছেন বিজয়লাল এবং একই সঙ্গে বিস্মিত হই , ‘মুক্তধারা’আর অভিজিতের সম্পর্কের আভ্যন্তরীন ব্যপ্তীকে স্পর্শ করেন বিজয়লাল কোনও রকম তাত্ত্বিক আভাস ব্যতিরেকেই। সহজাতভাবে বলে দেন রবীন্দ্রনাথের তত্ত্ব নিরপেক্ষ ব্যখ্যা,


“অভিজিৎ যন্ত্রাসুরকে আঘাত করিলেন,যন্ত্রাসুরও তাঁহাকে সেই আঘাত ফিরাইয়া দিল।তখন মুক্তধারা সেই আহত দেহকে মায়ের মতো কোলে তুলিয়া লইয়া চলিয়া গেল।“(বিদ্রোহী রবীন্দ্রনাথ/৩১)


এই ভাষ্যেই কথা বলে ওঠেন যেন পরবর্তীর রবীন্দ্র গবেষকও,


“ইহাতে কি (অভিজিতের) মৃত্যু হইল ?আহা তো মৃত্যু নয়,আহা যে মায়ের কোলে প্রত্যাবর্তন। সন্তানের এত বড় মুক্তি -সাধনার পর মা তাহাকে আর দূরে রাখিতে পারিল না, নিজের স্নেহশীতল বুকের মধ্যে টানিয়া নইল।(বাংলা নাটকের ইতিহাস: রবীন্দ্রনাথ: পৃঃ ৩০৮:ড.অজিতকুমার ঘোষ,১৯৪৬)।


আনন্দের এখানেই বিজয়লালের তথাকথিত ‘নন-একাডেমিক’আলোচনাও কিন্তু একাডেমিক তাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণের অনুপ্রেরণা বলছি না,পূর্বসূত্র হয়ে যেতে পারে। আবার দেখুন,আমরা,নাটকটিকে যাঁরা দেখছি,বা,পড়ছি, তাঁদের কাছে, অভিজিতের মুক্তধারায় ঝাঁপিয়ে পড়াটা মৃত্যুর দ্যোতনা এনে একটি পরিশুদ্ধি ঘটায়। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, দেখুন,এই দুই রবীন্দ্র -চাক্ষিকই কিন্তু অভিজিতের আত্ম’বলিদান’স্বীকার করছেন না। একধরনের রেজারেকশন দিতে চাইছেন। অভিজিৎ -কে প্রতীকে ভাবতে গেলে এই দৃষ্টি ব্যতীত গত্যন্তর ছিল না হয়তো।


৪.

রবীন্দ্রনাথকে তাঁর সম্পূর্ণতায় পড়ার চেষ্টা করেছিলেন বিজয়লাল। বুদ্ধদেব বসু আমাদের রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পের সঙ্গে ‘ছিন্নপত্র’কে মিলিয়ে পড়তে শিখিয়েছিলেন ‘ রবীন্দ্রনাথ : কথাসাহিত্য’(১৯৫৫)-তে। তাঁরই সমকালীন আলোচক বিজয়লালের ‘রবিতীর্থে’(১৯৬২) সংকলিত ,পূর্বে রচিত ,’ছিন্নপত্রের রবীন্দ্রনাথ ‘ শীর্ষক নিবন্ধে আমরা সেই চিন্তারই আভাস পেয়ে থাকি।‘ছিন্নপত্র’-এর সঙ্গে ‘সোনার তরী’,’বলাকা’-কে মিলিয়ে নেওয়ার পর ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে কালীগ্রাম থেকে লেখা সেই বিখ্যাত চিঠির,


“এই-যে মস্ত পৃথিবীটা চুপ করে পড়ে রয়েছে, ওটাকে এমন ভালোবাসি...(ছিন্নপত্রাবলী। ) অনুরাগের সঙ্গে মিল পেয়ে যাচ্ছেন ‘কাবুলিওয়ালা’-র রহমতের । আবার ১৮৮৮ খ্রীষ্টাব্দে শিলাইদহ থেকে লেখা চিঠির বর্ণনার সঙ্গে মিল পাচ্ছেন ‘চতুরঙ্গ’-এ বর্ণিত সেই বালুচরের বর্ণনাটির।যেখানে অভুক্ত দামিনী হাঁটু জল ভেঙে খাবারের থালা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে শচীশের কাছে।


বুদ্ধদেব বসুর মতোই বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়ও রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য অনুভবের জন্য ‘ছিন্নপত্র’কে অত্যন্ত জরুরি পাঠ বলে মনে করিয়ে দিয়ে বলছেন,

“ছিন্নপত্রে-র মধ্যে”ছায়াময় নদীস্নেহবেষ্টিত প্রচ্ছন্ন”বাংলার পল্লি-প্রকৃতির যে বিচিত্র বর্ণনার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে,সেই বর্ণনাগুলিই রবীন্দ্রনাথের নানা উপন্যাসে ,নানা কবিতায়,নানা সংগীতে নব নব ভঙ্গিতে প্রকাশ পেয়েছে।তফাত কেবল ভাষায়,বর্ণণার বিষয়বস্তু একই‌।এই faculty of absorption প্রতিভার একটি বৈশিষ্ট্য।“( রবিতীর্থে/৩৫২/ছিন্নপত্রের রবীন্দ্রনাথ)।


রবীন্দ্র-সাহিত্যে এই faculty of absorption টি ভীষণ ভালোভাবে নির্ণয় করতে পেরেছিলেন বিজয়লাল। আগাগোড়া প্রাবন্ধিক বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় এই নির্ণয়টিকে স্হির রেখে এগিয়েছেন। ফলতঃ রবীন্দ্র আলোচনার প্রাক -পর্বে রবীন্দ্রনাথের ব্যাপ্তীকে নির্ণয়-ঋত্বিক হিসেবে বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়কে চিহ্নিত করাই যায়।




৫.

কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় বিশদ পাঠ্য নন এখন। এমনকি তাঁর প্রবন্ধের বইগুলোও আর পাওয়া যায় না।সবেধন নীলমণি এই ‘রবীন্দ্রনাথ’সংকলনটি। অত্যন্ত সুসম্পাদিত,প্রত্যেকটি রচনার সালতামামি সহ পরিচয় নিখুঁত। সঙ্গে বাড়তি পাওনা রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলি। কিন্তু এই বইও এখন সহজপ্রাপ্য নয়।অথচ রবীন্দ্রআলোচনার প্রাক পর্বের চিন্তা হিসেবে এ গ্রন্হের ভূমিকা যেমন অপরিসীম, তেমনই ভারতীয় স্বাধীনতা পর্বের ইতিহাসে বাড়তি তথ্য -রবীন্দ্রনাথের কাব্য আলোচনাকেও নিষিদ্ধ করতে হয়েছিল। রবীন্দ্র সাহিত্য কেবল নয় সাহিত্য আলোচনাও তখন এতটাই স্পর্শকাতর হয়ে পড়েছিল! রবীন্দ্র কথাসাহিত্য আলোচনার সূত্রপাত হয় সম্ভবতঃ যে গ্রন্হে ,তার নিবিড় পাঠ এই জরুরি বোধহয়। কেননা, রবীন্দ্রনাথ আসলে সামগ্রিক এক বিশ্ব,যার নির্মাণ -বিনির্মাণ এবং প্রতিনির্মাণ সঞ্চিত রয়েছে তারই অভ্যন্তরে, রবীন্দ্রনাথ পাঠ কেবল রবীন্দ্রনাথেই সীমাবদ্ধ থাকে না,এই চিন্তা আরও বিকল্পের দিকে নিয়ে যায়-এই বক্তব্য বাঙালির পাঠপ্রক্রিয়ায় ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন প্রাবন্ধিক বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়ের অধুনালুপ্ত বইটি ফিরে আসুক নতুন করে। রবীন্দ্র চর্চায় তৈরি হোক নতুন তর্ক।



গ্রন্থপঞ্জী:


রবীন্দ্রনাথ:বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়: সম্পাদনা -,সত্যজিৎ চৌধুরী সুধীর চক্রবর্তী: পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ মে ১৯৯১
সুন্দরের অভ্যর্থনা:অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত: রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়: কলকাতা:১৯৯৭
বাংলা নাটকের ইতিহাস:ড.অজিতকুমার ঘোষ: চতুর্থ দে’জ সংষ্করণ: সেপ্টেম্বর ২০১৪
রবীন্দ্র রচনাবলী:১২৫ তম রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ:পৌষ ১৪১৫
রবীন্দ্রনাথ: কথাসাহিত্য: বুদ্ধদেব বসু:নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড:২০০২

0 comments: