0

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়



এবং যেন আবার জড়ো এক পুরনো কলধ্বনি
শুনতে যে পাই, কইছে কথা কিংবা কথার ফিসফিসানি
সন্দেহ, কি, জিহ্বা বাকি - তার বাদে সব উড়ন্ত ছাই
শ্রুতির মধ্যে জন্ম নিচ্ছে, শব্দ তোমার সম্প্রীতি চাই। 

(ওমর খৈয়ামের রুবাই, অনুবাদ : শক্তি চট্টোপাধ্যায়।) 


ঋতবাকের চতুর্থ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, নতুন। আবার, পুরনোও। ৩০শে অগাস্ট, ২০১৪তে যখন প্রথম আত্মপ্রকাশ করে আমাদের পত্রিকা, নিজেদের কাছে নিজেরা ক'টা কথা দিয়েছিলাম। যে দিকেই চলি না কেন, সত্যের পথ থেকে সরব না, নীতির ক্ষেত্রে আপোস করব না - এটা স্থির করে নিয়েছিলাম। যদি দরকার হয়, বদলে নেব নিজেদের। কিন্তু শব্দ, শ্রুতি আর বাকের সঙ্গে কোনও বেইমানি করব না কখনও : এই কথা বলে পথ চলা শুরু করেছিলাম। দেখলাম, বদলাতে হলো। ঋতবাক যা ছিল, যা হবে ভেবেছিলাম আর আজ যা হয়েছে তার মধ্যে ফারাক আছে বেশ। তবে, আমাদের পথ একই আছে কিন্তু। ছেড়ে দিলাম পথটা, বদলে গেল মতটা : এই মন্ত্রে বিশ্বাস করিনি আর করবও না। একদিকে বলার ইচ্ছে আর অন্যদিকে বোঝবার। এই দুইয়ে মিলে লেখা-পড়া চলে। লেখক লেখেন। পাঠক পড়েন। মাধ্যম হয় শব্দ। আমরা বরাবর চেয়েছি, শব্দের ধোঁয়ায় যেন বুঝ ঢাকা না পড়ে যায়। ঋতবাকের আঙিনায় সহজভাবে গভীর কথার আদান প্রদান চলে যেন। সরস কথা, আঁতের কথা, প্রাণের কথা। কথায় ভেজে চিঁড়ে, মুড়ি, খই, বাতাসা। সেইটুকুনই দেখতে আসা। বাণীর ধারা নেমে প্রাণের গভীর থেকে যেন উঠে আসেন বোধির জননী বাক্, যেন বিশ্বসৃষ্টির অলঙ্ঘ্য নিয়ম ঋতকে অক্ষর-অবয়বে প্রকাশের চেষ্টা নিয়ত করে চলেন আমাদের সমধর্মী ঋতব্রতীরা - এটাই চেয়ে আসছি শুরুর ক্ষণটি থেকে আজ পর্যন্ত। এই চাওয়াকে আড় চোখে দেখেছেন কেউ কেউ। খোলাবাজারে পণ্য করতে চেয়েছেন ঋতবাকের অস্তিত্ব। ঘাম আর রক্ত ঝরিয়ে চড়া নিয়ন আলোর প্রলোভনের সঙ্গে যুঝতে হয়েছে। আমরা জানি, টিঁকতে গেলে বাজারের সঙ্গে দুশমনি করা চলে না। তবে, বাজারকে শেষ কথা বলতে দিতেও আমরা নারাজ। আমরা ব্র্যন্ড ঋতবাক গড়তে চাই। বুদ্ধিদীপ্ত প্রবন্ধ, সরস কাহিনী, হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে চিত্ত ঝলমলিয়ে দেওয়া কবিতা, হাতে গড়া বইয়ের ফ্যাকসিমিলি - এসব নিয়ে এখনও অবধি প্রায় ত্রিশটি গ্রন্থ নির্মাণ করে উঠতে পেরেছি : প্রতিটি তার স্বকীয়তায় ভাস্বর। এই কাজটা করেই যাব। কথা দিচ্ছি, ঋতবাকের বই বলতে বাজার বুঝবে আলাদা কিছু, নতুন রকম কিছু। চারটে বই আগামী সাতাশে অগাস্ট, রবিবার, বিকেল পাঁচটায় শোভাবাজার রাজবাড়ির গোপীনাথ জীউ-এর নাটমন্দিরে প্রকাশ পেতে চলেছে। এই সংখ্যার 'বইয়ের খবর'-এ তাদের সম্বন্ধে পড়লেই বুঝবেন, আমরা চোখ ঝলসাতে চাইনে। মন আলো করতে চাই। সফরের গোড়ার দিকে যাঁরা হামরাহী ছিলেন, তাঁরা অন্য পথ ধরেছেন একসময়। অগণন ধারালো শর হেনেছে অন্ধকার। হানছে এখনও। তবু চলব। সঙ্গে আপনারা আছেন। কোথায় চলেছি, সেটা আসল কথা নয়। চলাটাই আসল কথা। 

এই সংখ্যায় শুরু হলো নতুন বিভাগ, কৈশোরনামা। কিশোর-কিশোরীদের জন্য লেখা। তাদের নিয়ে লেখা। ঋতবাক রুচি গড়তে চায়। পাঠকের হাতে তুলে দিতে চায় বাংলার কৃষ্টি-সংস্কৃতির রত্নভাণ্ডারের চাবি। এই গড়ার জন্যেই কাঁচা মনে পাকা ছাপ ফেলার দায়িত্বটা নিতেই হলো। 

আর কী? ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। সৃজনে থাকুন। 

শুভ কামনা নিরন্তর।

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - শিবাংশু দে

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


মৃত্যুরাখাল ও সদানন্দ
শিবাংশু দে



মৃত্যুরাখালের তো গর্বের শেষ নেই। যে জীবন নিয়ে মানুষের এত অহমিকা, স্বজন-পরিজন সংসারের তৃপ্ত আবহ, অর্থ-কীর্তি-সচ্ছলতার উত্তুঙ্গ মিনার, তা'কে এক ফুঁয়ে সে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে। তার সামনে নত হয়ে থাকে রাজার রাজা, ভিখারির ভিখারি, সম্মান-অসম্মানের ভিতে গড়া অনন্ত নক্ষত্রবীথি, পাবকের পবিত্র অগ্নি থেকে মৃত্যুরাখাল কাউকে রেহাই দেয়না। সে তো ভাবতেই পারেনা একটা রক্তমাংসের মানুষ সদানন্দ হয়ে নিজেকে ঘিরে রেখেছে আনন্দের সমুদ্রে। রাখাল তার নাগাল কখনও পাবেনা। তার কিন্তু চেষ্টার কমতি নেই। সদানন্দের আশি বছরের দীর্ঘ জীবন জুড়ে বারম্বার হননপ্রয়াস চালিয়ে গেছে সে। কিন্তু ঐ সমুদ্রটা কখনও পেরোতে পারেনি। সে হেরে যায় সদানন্দের কাছে। জগৎসংসার জানে সে হলো জীবনের শেষ কথা । সদানন্দ বলে সে হলো অনন্ত সম্ভাবনার দ্বার। 

''....বস্তু জগৎ যদি অটল কঠিন প্রাচীরে আমাদের ঘিরে রেখে দিতো এবং মৃত্যু যদি তার মধ্যে মধ্যে বাতায়ন খুলে না রেখে দিতো, তাহলে আমরা যা আছে তারই দ্বারা সম্পূর্ণ বেষ্টিত হয়ে থাকতুম। এ ছাড়া যে আর কিছু হতে পারে তা আমরা কল্পনাও করতে পারতুম না। মৃত্যু আমাদের কাছে অনন্ত সম্ভাবনার দ্বার খুলে রেখে দিয়েছে।'' 

( ২০শে জুলাই ১৮৯৩ সালে ইন্দিরা দেবী'কে লেখা চিঠি)


এই চিন্তাটি আরও সন্নিবদ্ধ হয়েছিলো পরবর্তীকালে। 

'' জীবন যেমন সত্য, মৃত্যুও তেমনি সত্য। কষ্ট হয় মানি। কিন্তু মৃত্যু না থাকলে জীবনেরও কোনো মূল্য থাকেনা। যেমন বিরহ না থাকলে মিলনের কোনো মানে নেই। তাই শোককে বাড়িয়ে দেখা ঠিক নয়। অনেক সময় আমরা শোকটাকে ঘটা করে জাগিয়ে রাখি পাছে যাকে হারিয়েছি তার প্রতি কর্তব্যের ত্রুটি ঘটে। কিন্তু এটাই অপরাধ, কারণ এটা মিথ্যে। মৃত্যু চেয়ে জীবনের দাবি বড়ো।''

মৃত্যু সম্পর্কে কবি'র এই মানসিকতাটি তৈরি হওয়ার পিছনে কিছু আশৈশব প্রস্তুতি লক্ষ্য করা যায়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ কোনও মৃত ব্যক্তির স্মৃতিচিণ্হ রক্ষায় অনিচ্ছুক ছিলেন। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে তিন তলার যে ঘরে তিনি থাকতেন, মৃত্যুর পরে সেই ঘরে তাঁর কোনও প্রতিকৃতি বা অন্য স্মৃতিফলক রাখতে তিনি মানা করেছিলেন। 

এই নিয়ে কবিকে যখন এক ঘনিষ্টজন প্রশ্ন করেন, তখন কবি বলেন, ''সদর স্ট্রিটের বাড়িতে বাবামশায়ের তখন খুব অসুখ। কেউ ভাবেনি তিনি আবার সেরে উঠবেন। সেইসময় একদিন আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি কাছে যেতেই বললেন- আমি তোমাকে ডেকেছি, আমার একটা বিশেষ কথা তোমাকে বলবার আছে। শান্তিনিকেতনে আমার কোনো মূর্তি বা ছবি বা এইরকম কিছু থাকে আমার তা ইচ্ছা নয়। তুমি নিজে রাখবে না, আর কাউকে রাখতেও দেবেনা। আমি তোমাকে বলে যাচ্ছি এর যেন কোনো অন্যথা না হয়।'' তার পর কবি আরো বলেছিলেন, রামমোহন রায় বিদেশে মারা গিয়ে খুব বুদ্ধির কাজ করেছিলেন। আমাদের দেশকে কোনো বিশ্বাস নেই। হয়তো মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়েও একটা কান্ড আরম্ভ হতো। কবির নিজেরও মনে হতো যদি তিনি বিদেশে প্রয়াত হ'ন তবেই ভালো। ভবিষ্যতদ্রষ্টা মানুষ হয়তো মনশ্চক্ষে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিলেন দেশের লোকের হাতে তাঁর শেষ অমর্যাদা।

মীরাদেবী ও রথীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোয় মহর্ষির ছবি রাখতে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু কবি কখনও অনুমতি দেননি। তিনি নিজে কোনও পরলোকগত মানুষের ছবি নিজের কাছে রাখতেন না। অবশ্য অন্য কেউ যদি তাঁর ছবি নিজের কাছে রাখতে চাইতো, তিনি বাধাও দিতেন না। ছবিতে সইও করে দিতেন নির্বাধ। তিনি তো বৈরাগী ছিলেন না। কিন্তু চলে যাওয়া প্রিয়জনদের যে ছবি তাঁর মনের মধ্যে আঁকা থাকতো, তাই ছিলো চূড়ান্ত। কাগজকলমের রেখায় তাঁদের খুঁজতে যেতেন না তিনি। 

এই 'ছবি' দেখা নিয়ে একটা ঘটনা আজ ইতিহাসের অংশ। ১৩২১ সালের কার্তিক মাসে কবি বেড়াতে গিয়েছিলেন এলাহাবাদ, ভাগ্নে সত্যপ্রসাদ গাঙ্গুলির বাড়িতে। সেখানে পুরোনো অ্যালবাম দেখতে দেখতে নতুন বৌঠানের একটা পুরোনো ছবি তাঁকে ট্রিগার করে। এভাবেই জন্ম হয় বলাকা কাব্যের সেই অতিখ্যাত কবিতা 'ছবি'। ''.... হায় ছবি, তুমি শুধু ছবি... ।'' এই স্মৃতিঘনঘোর প্রেরণা থেকে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি লেখেন আর একটি বিশ্রুত কবিতা, 'শাজাহান'। 

''ইতিপূর্বে মৃত্যুকে আমি কোনোদিন প্রত্যক্ষ করি নাই। ... কিন্তু আমার চব্বিশ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হইল তাহা স্থায়ী পরিচয়। তাহা তাহার পরবর্তী বিচ্ছেদশোকের সঙ্গে মিলিয়া অশ্রুর মালা দীর্ঘ করিয়া গাঁথিয়া চলিয়াছে। শিশুবয়সের লঘু জীবন বড়ো বড়ো মৃত্যুকেও অনায়াসেই পাশ কাটাইয়া ছুটিয়া যায়- কিন্তু অধিক বয়সে মৃত্যুকে অত সহজে ফাঁকি দিয়া এড়াইয়া চলিবার পথ নাই। তাই সেদিনকার সমস্ত দুঃসহ আঘাত বুক পাতিয়া লইতে হইয়াছিলো।'' ( জীবনস্মৃতি)

দ্বারকানাথের আশ্রিত ঠাকুর পরিবারের 'সন্দেশ পরীক্ষকে'র পৌত্রী যখন মোকাম কলকাতার সম্ভবত সব চেয়ে উপযুক্ত অভিজাত বিবাহসম্ভব পুরুষের পরিণীতা হিসেবে স্বীকৃত হতে চায়, তখন তার জন্য যে চ্যালেঞ্জটি অপেক্ষা করে থাকে তা এককথায় হিমালয়প্রতিম। ভাসুর সত্যেন্দ্রনাথ একেবারে চান'নি এতো অনভিজাত সাধারণ পরিবারের কন্যাকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মতো একজন যেকোনো শিক্ষিত, সাধিত, মার্জিত অভিজাত নারীর স্বপ্নপ্রতিম পুরুষের ভার্যা হিসেবে স্বীকার করে নিতে। কিন্তু বিবাহের পর মাতঙ্গিনী রাশনামের এই নারীটি নাম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে জ্যোতিরিন্দ্রের উপযুক্ত 'সহধর্মিনী' করে তুলতে সফল হয়েছিলেন। 'রবীন্দ্রনাথ' নামের যে বোধিবৃক্ষটি পরবর্তীকালে একটি সভ্যতাকে নিজের ছায়ায় লালনপালন করে বাঁচিয়ে রেখেছিলো, সেই বৃক্ষের অংকুরোদ্গম থেকে নিজস্ব শরীর খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত কাদম্বরী জল-মাটি-অক্সিজেন দিয়ে তাকে পোষণ করে গেছেন। কবির জীবনে নতুনবৌঠানের ভূমিকা নিয়ে এতো চর্চা হয়েছে যে তাই নিয়ে পুনরাবৃত্তি নিরর্থক। তবু কবি তাঁর বিকশিত হবার প্রথম স্তরে যা কিছু সৃষ্টি করেছেন, তার সব কিছুই এই নারীটিকে মুগ্ধ করার কৃত্য। উত্তরসূরি কবির ভাষ্য, '' আমার সকল গান, তবুও তোমারে লক্ষ্য করে'' এইভাবে প্রযোজ্য হওয়া খুব কম ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। কাদম্বরীর মৃত্যুর দিন দশেক পরে প্রকাশিত কবির 'প্রকৃতির পরিশোধ' 'নাট্যকাব্য'টির উৎসর্গপত্রে লেখা আছে, 'উৎসর্গ-/ তোমাকে দিলাম।' মাসখানেক পর প্রকাশিত 'শৈশবসঙ্গীত' কাব্যসংকলনের উৎসর্গপত্রে কবি লিখেছিলেন, ''....উপহার/ এ কবিতাগুলিও তোমাকে দিলাম। বহুকাল হইল, তোমার কাছে বসিয়াই লিখিতাম, তোমাকেই শুনাইতাম। সেই সমস্ত স্নেহের স্মৃতি ইহাদের মধ্যে বিরাজ করিতেছে। তাই মনে হইতেছে তুমি যেখানেই থাক না কেন, এ লিখাগুলি তোমার চোখে পড়িবেই।'' তারও মাসখানেক পরে প্রকাশিত 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী'র উৎসর্গপত্রে একই আকূতি, ''ভানুসিংহের কবিতাগুলি ছাপাইতে তুমি আমাকে অনেকবার অনুরোধ করিয়াছিলে। তখন সে অনুরোধ পালন করি নাই। আজ ছাপাইয়াছি, আজ তুমি আর দেখিতে পাইলে না।'' সেই অসামান্যা নারীর মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে বেদনাতুর অকালমৃত্যুর শোক সম্ভবত কবির মধ্যে বাকি জীবন ধরে ক্রমাগত মৃত্যুআঘাতের তীক্ষ্ণতাকে প্রত্যাখ্যান করে যাওয়ার শক্তি সঞ্চারিত করে দিয়েছিলো। পরবর্তী মৃত্যুর মিছিল হয়তো তাঁকে ভিতর থেকে বিদীর্ণ করেছে, কিন্তু মৃত্যুরাখালের কাছে নত করতে পারেনি। শুধু ইন্দিরা দেবীর লেখা থেকে পাই, ''...নতুনকাকিমার মৃত্যু আমাদের যোড়াসাঁকোর বাল্যজীবনে প্রথম শোকের ছায়া ফেলে বলে মনে হয়। তখন আমরা ত বিশেষ কিছু বুঝতুম না। তবে রবিকাকাকে খুব বিমর্ষ হয়ে বসে থাকতে দেখতুম....''। 

''হে জগতের বিস্মৃত, আমার চিরস্মৃত,...এ সব লেখা যে আমি তোমার জন্য লিখিতেছি। পাছে তুমি আমার কণ্ঠস্বর ভুলিয়া যাও, অনন্তের পথে চলিতে চলিতে যখন দৈবাৎ তোমাতে আমাতে দেখা হইবে তখন পাছে তুমি আমাকে চিনিতে না পার, তাই প্রতিদিন তোমাকে স্মরণ করিয়া আমার এই কথাগুলি তোমাকে বলিতেছি, তুমি কি শুনিতেছ না।'' (পুষ্পাঞ্জলি)

এই লেখাটি কবির চব্বিশ বছর বয়সে লেখা। কিন্তু তার পরেও দীর্ঘ আশি বছরের যাত্রাপথে কবির বোধ হয় এই 'প্রতিদিন তোমাকে স্মরণ করিয়া' কৃত্যে কখনও ছেদ পড়েনি। এই নারীর স্মৃতি কবিকে দিয়ে এত বিপুল পরিমাণ সার্থক সৃষ্টি করিয়ে নিয়েছিলো যে আমাদের মতো ইতর রসগ্রাহিরা কাদম্বরী দেবীর প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকি। তাঁর স্বল্পকালীন জীবন আর অনন্ত লোকোত্তর অস্তিত্ত্ব কবিকে সারা জীবন সৃজনশীলতার শ্রেয়ত্বে গরিমাময় করে রেখেছিলো।

একেবারে শেষ জীবনে এক স্নেহধন্যাকে কৌতুক করে কবি বলেছিলেন, ''নতুন বৌঠান চলে গিয়েছিলেন বলেই তাঁকে নিয়ে আজও গান বাঁধি। বেঁচে থাকলে হয়তো বিষয় নিয়ে মামলা করতুম''।

''দেখিলাম খান কয় পুরাতন চিঠি
স্নেহমুগ্ধ জীবনের চিণ্হ দু-চারিটি
স্মৃতির খেলেনা-কটি বহু যত্নভরে
গোপনে সঞ্চয় করি রেখেছিলে ঘরে । (স্মরণ)

কবিপত্নী মৃণালিনীর যে ঠিক কী ব্যাধি হয়েছিলো সে বিষয়ে কোনও নিশ্চিত তথ্য নেই। হরিচরণ বন্দোপাধ্যায় লিখেছেন, ''.... বিদ্যালয়ের শিক্ষাপদ্ধতি অক্ষুণ্ণভাবে রক্ষা করার নিমিত্ত মৃণালিনী দেবী কঠোর পরিশ্রম করিয়াছিলেন। ইহার তীব্র আঘাত তাঁহার অনভ্যস্ত শরীর সহ্য করিতে পারিল না। ফলে স্বাস্থ্যভঙ্গ দেখা দিল এবং ক্রমে সাংঘাতিক রোগে পরিণত হইল।'' রথীন্দ্রনাথের লেখায় পাই, ''... শান্তিনিকেতনে কয়েকমাস থাকার পর মায়ের শরীর খারাপ হতে থাকল। ... আমার এখন সন্দেহ হয় তাঁর অ্যাপেন্ডিসাইটিস হয়েছিল। তখন এ বিষয়ে বিশেষ জানা ছিলনা, অপারেশনের প্রণালীও আবিষ্কৃত হয়নি।'' প্রভাতকুমার হেমলতা ঠাকুরের কাছে শুনেছিলেন, ''...মৃণালিনী দেবী বোলপুরের মুন্সেফবাবুর বাড়িতে বর্ষাকালে কোনো নিমন্ত্রণ রক্ষায় গিয়াছিলেন। সেখানে পড়িয়া যান ও আঘাত পান, তখন তিনি অন্তঃস্বত্ত্বা।'' ১৯০২ সালের অক্টোবর মাসের শেষদিকে তাঁর অসুস্থতা খুব বেড়ে যায়। অ্যালোপ্যাথ ডাক্তারেরা অসুখ ধরতে না পারায় কবি বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক প্রতাপ মজুমদার, ডি এন রায় প্রমুখের শরণ নিলেন, কিন্তু কোনো সুরাহা হলোনা। ইন্দিরা দেবী তো এমনও লিখেছেন, ''...কাকিমার শেষ অসুখে (রবিকা) এক হোমিওপ্যাথি ধরে রইলেন ও কোনো চিকিৎসা বদল করলেন না বলে কোনো কোনো বিশিষ্ট বন্ধুকে আক্ষেপ করতে শুনেছি।''

মীরা দেবীর স্মৃতিচারণে পড়েছি, মৃণালিনী দেবীকে রাখা হয়েছিলো কবির নিজস্ব লালবাড়ির দোতলায়। ''...সেবাড়িতে তখন বৈদ্যুতিক পাখা ছিল না, তাই একমাত্র তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করা ছাড়া গতি ছিল না। ঐ বাতাসহীন ঘরে অসুস্থ শরীরে মা না জানি কত কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু বড়ো বৌঠান হেমলতা দেবীর কাছে শুনেছি যে বাবা মার পাশে বসে সারা রাত তালপাখা নিয়ে বাতাস করতেন।''

তার পরে অবস্থার ক্রম-অবনতি হতে থাকে। রথীন্দ্রনাথের স্মৃতি কথনে , ''...মৃত্যুর আগের দিন বাবা আমাকে মায়ের ঘরে নিয়ে গিয়ে শয্যাপার্শ্বে তাঁর কাছে বসতে বললেন। তখন তাঁর বাকরোধ হয়েছে। আমাকে দেখে চোখ দিয়ে কেবল নীরবে অশ্রুধারা বইতে লাগল। মায়ের সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা। আমাদের ভাইবোনদের সকলকে সে রাত্রে বাবা পুরোনো বাড়ির তেতলায় শুতে পাঠিয়ে দিলেন। একটি অনির্দিষ্ট আশঙ্কায় আমাদের সারা রাত জেগে কাটল। ভোরবেলা অন্ধকার থাকতে বারান্দায় গিয়ে লালবাড়ির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলুম। সমস্ত বাড়িটা অন্ধকারে ঢাকা, নিস্তব্ধ, নিঝুম; কোনো সাড়াশব্দ নেই সেখানে। আমরা তখনি বুঝতে পারলুম আমাদের মা আর নেই, তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।'' 

তারপর কবির কাছে সমবেদনা জানাতে দীর্ঘ মানুষের সারি। সকলের সঙ্গে অসম্ভব ধৈর্য নিয়ে কথা বলে গেলেন। শেষে রথীন্দ্রকে ডেকে তাঁর হাতে মৃণালিনী দেবীর নিত্যব্যবহার্য চটিজুতোটি দিয়ে বললেন, '' এটা তোর কাছে রেখে দিস, তোকে দিলুম।'' এই কথা বলে তিনি নিজের ঘরে চলে গেলেন। 

হেমলতা দেবীর স্মৃতিকথায় আমরা পাই ,''রাত্রে আমার স্বামী (দ্বিপেন্দ্রনাথ) এসে বললেন, ''খুড়ির মৃত্যু হয়েছে, কাকামশাই একলা ছাদে চলে গেছেন, বারণ করেছেন কাউকে কাছে যেতে।'' প্রায় সারারাত কবি ছাদে পায়চারি করে কাটিয়েছেন শোনা গেল। কবির পিতা মহর্ষিদেব তখন জীবিত। পুত্রের পত্নীবিয়োগের সংবাদে তিনি বলেন, ''রবির জন্য আমি চিন্তা করিনা, লেখাপড়া নিজের রচনা নিয়ে সে দিন কাটাতে পারবে। ছোট ছেলেমেয়েগুলির জন্যই দুঃখ হয়।'' 

মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়স, উনিশ বছর দাম্পত্য জীবন, পাঁচটি সন্তান, কবির 'ভাই ছুটি' চলে গেলেন। সেই সময় ঘনিষ্ঠ লোকজন বারম্বার কবিকে মহাভারতের শান্তি পর্বের তাঁর এই প্রিয় শ্লোকটি পুনরাবৃত্তি করতে শুনেছে। ''সুখং বা যদি বা দুঃখং প্রিয়ং বা যদি ব্যপ্রিয়ম।/ প্রাপ্তং প্রাপ্তমুপাসীত হৃদয়েনাপরাজিতা''। 

মৃত্যু সম্বন্ধে তাঁর লিপিবদ্ধ ধারণার যে সব কথা উল্লেখিত হয়েছে, তার উৎস ব্যক্তিজীবনে তিনি কীভাবে বারম্বার মৃত্যুর হননঋতুকে সদানন্দ নিরাসক্তিতে গ্রহণ করেছিলেন, তার মধ্যেই ওতোপ্রোত রয়েছে। তার মধ্যে কিছু ইতিকথা তো আজ নব উপনিষদের মর্যাদায় গরীয়ান। 

১৯১৮ সালের গ্রীষ্মকালে তাঁর বড়ো মেয়ে বেলা ছিলেন রোগশয্যায়। থাকতেন তাঁর স্বামীগৃহ জোড়া গির্জার কাছে শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীর বাড়িতে। কবি তখন জোড়াসাঁকোয়। মেয়ে'কে দেখতে প্রতিদিন সকালে সেই বাড়ির দোতলায় যা'ন। একদিন বাড়িতে ঢুকেই বেরিয়ে এলেন। সহযাত্রী প্রশ্ন করলেন, কী হলো? তিনি বললেন, ''নাহ, আর দোতলায় উঠলাম না। সে আর নেই, আমি পৌঁছোবার আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে।''

জোড়াসাঁকোয় ফিরে কিছুক্ষণ তিনতলার ঘরে চুপ করে বসে রইলেন। তারপর বললেন, ''কিছুই তো করতে পারতুম না। অনেকদিন ধরেই জানি ও চলে যাবে। তবু রোজ সকালে গিয়ে ওর হাতখানি ধরে বসে থাকতুম। ছেলেবেলায় যেমন বলতো বাবা গল্প বলো, অসুখের সময়ও অনেক সময় তাই বলতো। যা মনে আসে কিছু বলে যেতুম। আজ তাও শেষ হয়ে গেলো।'' এতটুকু বলেই আবার শান্ত সমাহিত হয়ে বসে রইলেন।

সেদিন বিকেলে তাঁর নানা সামাজিক কাজ ছিলো। ঘনিষ্টজনেরা চাইলেন সে সব থেকে তাঁকে অব্যাহতি দিতে। কিন্তু কবি নিষেধ করলেন। বললেন, এরকম তো আগেও হয়েছে। তাঁর মেজো মেয়ে রানি'র চলে যাওয়ার গল্পটা জানতো কেউ কেউ। সেই সময়টাতে স্বদেশী আন্দোলন চলছিলো পুরো দমে। রাণী খুব অসুস্থ। আলমোড়া থেকে কবি তাঁকে নিয়ে ফিরে এসেছেন। নিজের হাতে অক্লান্ত শুশ্রূষা করতেন। পিতা নোহসি মন্ত্র শোনাতেন। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী মশায় রোজ সন্ধেবেলা আসেন জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে। যাবার সময় মেয়ের কুশলসংবাদ নিয়ে যান। সেদিনও যাবার সময় জানতে চাইলেন রাণী কেমন আছেন? কবি শুধু বললেন, ''সে মারা গিয়েছে''। রামেন্দ্রসুন্দর কিছুক্ষণ কবির মুখের দিকে চেয়ে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন। 

কবি দুই কন্যাকেই হারিয়েছিলেন যক্ষ্মারোগে। 

'' হে রুদ্র, তোমার দুঃখরূপ, তোমার মৃত্যুরূপ দেখিলে আমরা দুঃখ ও মৃত্যুর মোহ হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া তোমাকেই লাভ করি।... তোমার সেই ভীষণ আবির্ভাবের সম্মুখে দাঁড়াইয়া যেন বলিতে পারি , আবিরাবীর্ম এধি, রুদ্র বত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যম।''

(মাঘ উৎসবের ভাষণ থেকে, ১৩১৪ সাল)

কবির ছোটো ছেলে শমীন্দ্র বেড়াতে গিয়েছিলেন মুঙ্গেরে, কবির এক বন্ধুর বাড়িতে। এগারো বছরের বালক, লোকে বলতো কনিষ্ঠ সন্তানটি কবির প্রিয়তম আত্মজ, সেখানে কলেরায় আক্রান্ত হন। কবির কাছে খবর এল শমীন্দ্র খুব অসুস্থ। তিনি পৌঁছে দেখলেন সে চলে গিয়েছে। তিনি তখন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন গৃহকর্তা বন্ধুটির শোকসন্তাপ নিবারণ করতে। লোকে বুঝতেই পারলো না কার সন্তান গত হয়েছে। কবি ফিরে এলেন শান্তিনিকেতনে, একা। রেলস্টেশনে তাঁকে আনতে গিয়েছিলেন জগদানন্দ রায়। গোরুর গাড়ি করে তাঁরা ফেরার সময়ও জানতে পারেননি শমীন্দ্র কেন আসেননি। পরে জানতে পারলেন সে আর নেই। কবির বাহ্যিক ব্যবহারে কোনো বিচলন ছিলোনা। শান্তিনিকেতনে ফিরে কর্মব্যস্ততার মধ্যে তাঁর এক মুহূর্তও কোনও ছেদ পড়েনি। 

শমী গত হবার পর তাঁকে কেউ কখনও প্রকাশ্যে শোক করতে দেখেননি। কিন্তু অনেক বছর পরেও শমীর প্রসঙ্গ উঠলে তাঁর চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠতো। তাঁর তখন ষাট বছর বয়স পেরিয়ে গিয়েছে। একদিন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ জোড়াসাঁকো বাড়িতে গিয়ে শোনেন কবি রীতিমতো সরবে কবিতা আবৃত্তি করে চলেছেন। তিনি একটু অবাক হলেন তিনি। কবি'কে একথা জানাতে তিনি একটু অপ্রতিভ হলেন। তার পর বললেন, ''একটু জ্বর হয়েছে কিনা, তাই মাথাটা একটু উত্তেজিত হয়েছে। শমীরও এরকম হতো। ওর মা যখন মারা যায় তখন ও খুব ছোটো। তখন থেকে ওকে আমি নিজের হাতে মানুষ করেছিলেম। ওর স্বভাবও ছিলো ঠিক আমার মতো। আমার মতই গান করতে পারতো আর কবিতা ভালোবাসতো। এক এক সময় দেখতুম চঞ্চল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিংবা চেঁচিয়ে কবিতা আবৃত্তি করছে। এই রকম দেখলেই বুঝতুম ওর জ্বর এসেছে। ...শমী বলতো বাবা গল্প বলো। আমি এক একটা কবিতা লিখতুম আর ও মুখস্থ করে ফেলতো। সমস্ত শরীর মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে আবৃত্তি করত। ঠিক আমার নিজের ছেলেবেলার মতো। ছাতের কোণে কোণে ঘুরে বেড়াত। নিজের মনে কত রকম ছিল ওর খেলা। দেখতেও ছিল ঠিক আমার মতো।'' 

প্রশান্তচন্দ্র লক্ষ্য করলেন শমীর কথা বলতে বলতে কবির চোখ জলে ভরে এসেছে। ঊদ্ধৃত মাঘ উৎসবের ভাষণটি শমীর মৃত্যুর ঠিক দু'মাস পরের লেখা। 

''...ভোরবেলা উঠে এই জানালা দিয়ে তোমার গাছপালা বাগান দেখছি আর নিজেকে ওদের সঙ্গে মেলাবার চেষ্টা করছি। বর্ষায় ওদের চেহারা কেমন খুশি হয়ে উঠেছে। ওদের মনে কোথাও ভয় নেই। ওরা বেঁচে আছে এই ওদের আনন্দ। নিজেকে যখন বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখি তখন সে কী আরাম। আর কোনো ভয়ভাবনা মনকে পীড়া দেয়না। এই গাছপালার মতো-ই মন আনন্দে ভরে ওঠে,''

( রাণী মহলানবীশ'কে কবিঃ ১৯৩২ সালের অগস্ট মাস)

কবির তিন মেয়ের মধ্যে কনিষ্ঠা মীরাদেবীই শেষ পর্যন্ত তাঁর কাছে থাকতেন। পাঁচ সন্তানের মধ্যে তাঁর জীবনকালে তিনজনের দেহাবসান হয়েছিলো। মীরাদেবীর দাম্পত্যজীবন পরিপূর্ণতা পায়নি। কবি তাঁর এই কন্যাটির দুঃখযন্ত্রণার একান্ত শরিক ছিলেন চিরকাল। মীরাদেবীর একমাত্র ছেলে নীতিন্দ্রনাথ বা নীতু। বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়েছিলেন। কবির পৌত্র বা দৌহিত্র বলতে তিনিই ছিলেন একমাত্র উত্তরপুরুষ। দুঃখী মা'য়ের সন্তান এবং কবির প্রাণপ্রিয় এই মেধাবী, সুদর্শন যুবকটি ছিলেন সবার কাছে প্রেয়, স্নেহিত একটি মানুষ। বিলেতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন গুরুতরভাবে। এন্ড্রুজ সাহেবের সঙ্গে মীরাদেবী যাত্রা করলেন সেদেশ থেকে ছেলেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে। একদিন ভোরবেলা কবি রানী মহলানবিশকে বললেন, যদিও এন্ড্রুজ সাহেব লিখেছেন নীতু ভালো আছেন কিন্তু তবু মন ভারাক্রান্ত রয়েছে। তারপর অনেকক্ষণ ধরে রাণীর সঙ্গে মৃত্যু প্রসঙ্গে তাঁর অনুভূতির কথা বর্ণনা করলেন। 

এইদিন সকালের সংবাদপত্রেই রয়টারের খবর, নীতু মারা গিয়েছেন। কিছুক্ষণ পরে রথীন্দ্রনাথ এলেন বরানগরের বাড়িতে। কবির কাছে গিয়ে বললেন, ''নীতুর খবর এসেছে।'' কবি প্রথমে ঠিক বুঝতে পারেননি। প্রশ্ন করলেন, ''কী, একটু ভালো?'' রথীন্দ্রনাথ বললেন, না, ভালো নয়। রথীকে মৌন থাকতে দেখে কবি বুঝতে পারলেন। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলেন, চোখ থেকে কয়েকফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। আর কিছু নয়। 

তখন তিনি পুনশ্চের কবিতাগুলি লিখছিলেন। একটু পরে সম্বিত ফিরে পেলে 'পুকুরধারে' নামে কবিতাটি লেখা হলো। পরদিন শান্তিনিকেতন ফিরে গেলেন। তখন সেখানে বর্ষামঙ্গল উৎসবের আয়োজন চলেছে। কবির এই শোকসংবাদে বিচলিত আশ্রমিকেরা উৎসব বন্ধ রাখার প্রস্তাব করলেন। কিন্তু কবি রাজি হলেন না। নিজেও উৎসবে পূর্ণতঃ অংশগ্রহণ করলেন। মীরাদেবীকে লিখলেন, '' ...নীতুকে খুব ভালোবাসতুম, তাছাড়া তোর কথা ভেবে প্রকাণ্ড দুঃখ চেপে বসেছিলো বুকের মধ্যে। কিন্তু সর্বলোকের সামনে নিজের গভীরতম দুঃখকে ক্ষুদ্র করতে লজ্জা করে। ক্ষুদ্র হয় যখন সেই শোক, সহজ জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ...অনেকে বললে এবারে বর্ষামঙ্গল বন্ধ থাক আমার শোকের খাতিরে। আমি বললুম সে হতেই পারেনা। আমার শোকের দায় আমিই নেবো। ...আমার সব কাজকর্মই আমি সহজভাবে করে গেছি।...''

মীরাদেবীকে লেখা এই চিঠিতেই বাংলাভাষার অতিচর্চিত শ্রেষ্ঠ মৃত্যুসাহিত্যের স্তবকটি সংলগ্ন ছিলো। 

''...যে রাত্রে শমী গিয়েছিলো সেরাত্রে সমস্ত মন দিয়ে বলেছিলুম বিরাট বিশ্বসত্তার মধ্যে তার অবাধ গতি হোক, আমার শোক যেন তাকে একটুও পিছনে না টানে। তেমনি নীতুর চলে যাওয়ার কথা যখন শুনলুম তখন অনেকক্ষণ ধরে বারবার ক'রে বলেছি, আর তো আমার কোনো কর্তব্য নেই, কেবল কামনা করতে পারি এর পরে যে বিরাটের মধ্যে তার গতি সেখানে তার কল্যাণ হোক। ....শমী যেরাত্রে গেলো, তার পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়ছে তার লক্ষণ নেই। মন বললে, কম পড়েনি- সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে, আমিও তার মধ্যে। সমস্তের জন্যে আমার কাজও বাকি রইলো। যতদিন আছি সেই কাজের ধারা চলতে থাকবে। সাহস যেন থাকে, অবসাদ যেন না আসে, কোনওখানে কোনওসূত্র যেন ছিন্ন হয়ে না যায়। যা ঘটেছে, তা'কে যেন সহজে স্বীকার করি, যা কিছু রয়ে গেলো তাকেও যেন সম্পূর্ণ সহজ মনে স্বীকার করতে ত্রুটি না ঘটে। ( ২৮শে অগস্ট,১৯৩২) 

''দুঃসহ দুঃখের দিনে
অক্ষত অপরাজিত আত্মারে নিয়েছি আমি চিনে
আসন্ন মৃত্যুর ছায়া যেদিন করেছি অনুভব
সেদিন ভয়ের হাতে হয়নি দুর্বল পরাভব।
...আমি মৃত্যু চেয়ে বড়ো এই শেষ কথা বলে
যাবো আমি চলে।''

উনচল্লিশ সালের শেষ দিকে নাৎসি বাহিনী যখন নরওয়ে আক্রমণ করলো, কবি বললেন, ''অসুররা আবার নরওয়ের ঘাড়ে পড়লো। ওরা কাউকে বাদ দেবেনা। নরওয়ের লোকজনদের কথা মনে পড়ছে আর আমার অসহ্য লাগছে। তাঁদের যে কী হচ্ছে কে জানে।'' 

১৯৪০শের বর্ষার পর তিনি গিয়েছিলেন মংপু, মৈত্রেয়ী দেবীর কাছে। কিন্তু অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেপ্টেম্বর মাসে তাঁকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় কালিম্পঙ থেকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হয়। বেশ কিছুদিন চিকিৎসার পর একটু সামলে ওঠেন, কিন্তু অতীব দুর্বল হয়ে পড়েন। এ রকম একটা সময়ে প্রশান্তচন্দ্র খবর পেলেন কবি তাঁকে বারবার ডেকে পাঠিয়েছেন, জরুরি কথা আছে। নানা কাজে ব্যস্ত থাকায় প্রশান্তচন্দ্রের পৌঁছোতে একটু বিলম্ব হ'লো। তিনি কবির কাছে যাবার পর দেখলেন কবি বিশেষ উত্তেজিত এবং ঐরকম দুর্বল শরীর এতো উত্তেজনার ভার নিতে পারছে না। প্রশান্তচন্দ্রকে দেখেই কবি বললেন, ''অনেকক্ষণ ধরে তোমাকে ডাকছি, চীনদেশের লোকেরা যে যুদ্ধ করছে...'' বলতে বলতে কথা জড়িয়ে এল। একটু থেমে সম্বিত ফিরে পেয়ে আবার বললেন, '' এত দেরি করলে কেন? যা বলতে চাইছি বলতে পারছিনে। একটু আগে কথাটা স্পষ্ট ছিলো, এখন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে...'' প্রশান্তচন্দ্র নীরবে অপেক্ষা করতে লাগলেন। খানিকটা পরে থেমে থেমে দম নিয়ে তিনি বলতে লাগলেন, ''চীনদেশের লোকেরা চিরকাল যুদ্ধ করাকে বর্বরতা মনে করেছে। কিন্তু আজ বাধ্য হয়েছে লড়াই করতে, দানবরা ওকে আক্রমণ করেছে বলে। এতেই ওদের গৌরব। ওরা যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়েছে এই হলো বড়ো কথা। ওরা যুদ্ধে হেরে গেলেও ওদের লজ্জা নেই। ওরা যে অত্যাচার সহ্য করেনি, তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, এতেই ওরা অমর হয়ে থাকবে।'' আশি বছর বয়সে, বিছানায় উঠে বসার ক্ষমতা নেই, সেই অবস্থায় অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে তিনি আকুল হয়ে পড়েন। 

রাশিয়া'কে নিয়ে তাঁর মনে ছিলো বিপুল আশ্বাস। তাঁদের দেশ ঘুরে এসে কবির মনে গভীর আস্থা জন্মেছিলো। জার্মানি যখন রাশিয়া আক্রমণ করলো তখন তিনি প্রায় শেষ শয্যায়। প্রতিদিন যুদ্ধের খবর নিতেন। বারবার বলতেন, এই যুদ্ধে যদি রাশিয়া জেতে, তবে তিনি খুব খুশি হবেন। সকালবেলা খবর কাগজ এলে সবার আগে দেখতেন ফ্রন্টের খবর কী। রাশিয়ার জন্য কোনও খারাপ খবর থাকলে বিষণ্ণ হয়ে যেতেন, কাগজ ছুঁড়ে ফেলে দিতেন। 

যেদিন তাঁর অপারেশন হবে সেদিন সকালে বললেন, ''রাশিয়ার খবর বলো''। উত্তর এল, ''একটু ভালো মনে হচ্ছে। হয়তো একটু ঠেকিয়েছে।'' কবির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, ''হবেনা? ওদেরই তো হবে। পারবে। ওরাই পারবে।'' রোগকষ্টের ব্যক্তিগত সংলাপের বাইরে সম্ভবত এই ছিলো তাঁর শেষ কথা। 

এর তিন মাস আগেই তিনি লিখেছেন, '' ...আজ পারের দিকে যাত্রা করেছি--পিছনের ঘাটে কী দেখে এলুম, কী রেখে এলুম, ইতিহাসের কী অকিঞ্চিৎকর উচ্ছিষ্ট সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ। কিন্তু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করবো। আশা করবো মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে।'' 

মৃত্যুরাখাল আবার ফিরে গেলো। সদানন্দের চ্যালেঞ্জ ছিলো সে মৃত্যু চেয়ে বড়ো। আনন্দসমুদ্র পেরিয়ে সদানন্দের মাটির রাজপ্রাসাদ।রাখালের পক্ষে সমুদ্র পেরোনো আর সম্ভব হলোনা। মাঝে মাঝে এই সব পরাভব তার ভালো-ই লাগে। তারও তো কখনও, কোনও দুর্লভ মূহুর্তে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। 

(পূর্বপ্রকাশিত)

0 comments:

0

প্রবন্ধ - অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী

Posted in


প্রবন্ধ



বাঙলায় বোমার আবির্ভাব : তিলক ও রবীন্দ্রনাথের চোখে
অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী 


[২] 

বাঙলার বোমা প্রসঙ্গে লোকমান্য তিলকের পরেই মারাঠী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যাঁর প্রতিক্রিয়া উল্লেখযোগ্য, তিনি হলেন ‘কাল’ পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক শিবরাম মহাদেব পরাঞ্জপে। ক্ষুদিরামের বোমার সূত্রে কলকাতায় গুপ্তসমিতির জনা চল্লিশেক সদস্যের গ্রেপ্তারের পরেও ভারতের নানা স্থানে ব্যাপক ধরপাকড় চলছিল। এই সব গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ কর্মচারীদের পুরস্কৃত করার সরকারি সিদ্ধান্ত সম্পর্কে ‘কাল’ পত্রিকার একটি প্রবন্ধে ১৫ই মে অধ্যাপক পরাঞ্জপে মন্তব্য করেন। তিনি এ-প্রসঙ্গে মাল্টা বিষয়ক গোপন দস্তাবেজ বিক্রি করার দায়ে এক ব্রিটিশ অফিসারের প্রেপ্তার ও তাকে চরমতম দণ্ডদানের জন্য পার্লামেন্টে আইন প্রণয়নের কথা উল্লেখ করেন। ‘ফাঁসিই দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকের যোগ্য শাস্তি’ – একটি ব্রিটিশ কাগজের এই মন্তব্য উল্লেখ করে অধ্যাপক পরাঞ্জপে শ্লেষভরে লেখেন, “যদিও এ-ক্ষেত্রে ভারতীয় পুলিশ অফিসারদের আর ব্রিটিশ অফিসারটির মধ্যে লক্ষণীয় সাদৃশ্য রয়েছে, তবু প্রথম ক্ষেত্রে পুরস্কার বরাদ্দ হয়েছে আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে শাস্তি!” অর্থাৎ ঘুরিয়ে ক্ষুদিরাম প্রমুখ বিপ্লবীদের গ্রেপ্তারে যারা সাহায্য করেছে, তাদের দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতক বলা হলো আর সেই সূত্রে ক্ষুদিরামদের দেশপ্রেমকে বন্দনা করা হয়।

অবশ্য এই নির্ভীক অধ্যাপক- সম্পাদক যে শুধু ইঙ্গিতেই তাঁর প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেন এমন নয়, তিলকের মতোই তিনিও প্রত্যক্ষ ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখলেন যে, বোমা ছোঁড়াটা বাঞ্ছণীয় কিনা, সেই তর্ক দূরে সরিয়ে রাখলেও একটা ব্যাপার সুনিশ্চিত যে, যে-সব ভারতীয় এ-সব কাজ করছে, তারা নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্য এটা করছে না, স্বাধীনতা অর্জনের জন্যই করছে। এই নির্ভীকতার মূল্য অবশ্য পরাঞ্জপেকে অচিরেই চোকাতে হয়েছিল তিলকের মতোই। ১১ই জুন তাঁকে রাজদ্রোহের দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়। রাজদ্রোহের অভিযোগে শিবরাম পরাঞ্জপের উনিশ মাসের কারাদন্ড হয়েছিল। তাঁর মামলার তদারক করতে তিলক যখন বোম্বাই যান, তখন তাঁকেও গ্রেপ্তার করা হয় [২৫শে জুন], যার পরিণতি ছিল দীর্ঘ ছ’ বছরের জন্য সুদূর মান্দালয়ের জেলে নির্বাসন।

বাংলার বুদ্ধিজীবীদের বিশ্লেষণ

বাংলাদেশ তথা কলকাতার অগ্রগণ্য সংবাদপত্র রামানন্দ চট্যোপাধ্যায়ের ‘মডার্ন রিভিউ’-এ এই বোমাকাণ্ড নিয়ে কয়েকটি সম্পাদকীয় প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় [জুন, ১৯০৮]। এগুলির কয়েকটির বিষয় ছিলঃ- (১) রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ও পাশ্চাত্য ভাবাবেগ,(২) বাঙলায় সন্ত্রাসবাদের উৎপত্তি,(৩) বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে রাজনৈতিক হত্যা,(৪) হত্যার মাধ্যমে রাজনৈতিক মতাধিকার, (৫) কী ভাবে সাহস করতে হয় ও মরতে হয়, (৬) পথের সমস্যা, (৭) গীতা ও বোমানিক্ষেপ ইত্যাদি। 

এর মধ্যে ২ সংখ্যক রচনাটির কিছু অংশের মর্মার্থ এরকমঃ- “বাংলার সন্ত্রাসবাদের চরম কারণ খুঁজতে হবে সরকারের একান্ত স্বার্থপর, উদ্ধত ও উৎপীড়নমূলক নীতির মধ্যে আর অধিকাংশ সরকারি ও বেসরকারি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানেরা যে-রকম ঘৃণাপূর্ণ ও অপমানজনক ভাবে বাঙালিদের সঙ্গে কথা বলে আর ব্যবহার করে, তার ভেতরে। চরিত্রে আর পদ্ধতিতে প্রশাসনের যেভাবে রুশীকরণ করা হয়েছে, তার ফলেই জনগণের এক ক্ষুদ্র অংশ রুশ সন্ত্রাসবাদী পদ্ধতির অবলম্বনকারীতে পরিণত হয়েছে। এটা শুধুই ক্রিয়া আর প্রতিক্রিয়ার প্রশ্ন – ‘উত্তেজনা’ আর তার ‘সাড়া’র ব্যাপার।...... এর ফল দাঁড়াল একটা ভুল, যার পরিণতি ভয়াবহ। যে লোকটিকে তারা মারতে চেয়েছিল, তার পরিবর্তে হত্যা করে বসল দু’ জন নিরপরাধা স্ত্রীলোককে, যাদের মৃত্যুতে গভীর শোকপ্রকাশ করা হচ্ছে।”

উদ্ধৃত মন্তব্যে মূলত ভারতে ইংরেজের শাসনপ্রক্রিয়া ও ব্যবহারকে বোমার রাজনীতির জন্য দায়ী করা হলেও এর ঠিক পরেই ‘বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে রাজনৈতিক হত্যা’ শিরোনামে মন্তব্য করা হয়েছিল, “এটা হচ্ছে অবধারিত ভাবে বোমা ছুঁড়ে রাজনৈতিক হত্যাসাধন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এতে মরে নিরীহ মানুষেরা, যাদের বোমা নিক্ষেপকারীরা দোষী মনে করছে, তারা নয়। এমন কি, যখন দ্বিতীয়োক্ত মানুষেরা মরে, তখনও তাদের সঙ্গে কিছু নিরীহ মানুষেরও প্রাণ যায়। তাই এই পদ্ধতি নিশ্চিতভাবেই বেপরোয়া, খারাপ এবং এর সঙ্গে আমরা যোগ করতে পারি- কাপুরুষোচিত। কারণ একজন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার মধ্যে কোনো বীরত্ব তো নেই-ই, সর্বোপরি তার সামনাসামনি আসার সাহস ও হত্যাকারীর নেই।” একই রকম ভাবে পুর্বোক্ত ৪ ও ৫ সংখ্যক প্রবন্ধগুলোতেও বোমার কারবারীদের যথেষ্ট নিন্দা করা হয়েছে।

এর পাশাপাশি বাংলার পুরানো পত্রিকা ‘হিতবাদী’ -র যুক্তি ছিল সোজা ও তীক্ষ্ণঃ- “বলা হচ্ছে যে, ক্ষুদিরাম হত্যা, কাপুরুষোচিত কাজ ও নারকীয় অস্ত্র ব্যবহারের জন্য অপরাধী। জবাবে বিপ্লবীরাও বলতে পারে যে, প্রত্যেক শাসক, যে মানুষকে নিষ্পেষিত করে ও তাদের ফাঁসিকাঠে ঝোলায়, একই অপরাধে দোষী।” [২৮ মে, ১৯০৮] 

বাংলার এই কয়েকটি সংবাদপত্রের নামী সম্পাদকদের মন্তব্যকে বাদ দিলে একজন ছাড়া এখানকার আর কোনও লেখক বুদ্ধিজীবীই বাংলার এই বোমার আবির্ভাবে মতপ্রকাশে তিলক বা পরাঞ্জপের মতো তেমন ভাবে এগিয়ে আসেননি! মহারাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবীদের এইসব মন্তব্য প্রকাশের সমকালে ওই বোমার রাজনীতির রঙ্গভূমি বাঙলাদেশে ওই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় যিনি প্রকাশ্যে মন্তব্য করার কর্তব্যবোধ ও সৎসাহস দেখিয়েছিলেন, তিনি অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের স্পষ্ট ও প্রথম প্রতিক্রিয়া দেখা যায় মজঃফরপুর বিস্ফোরণের দু’ দিন পর কালীমোহন ঘোষকে লেখা তাঁর চিঠির এই মন্তব্যেঃ- “মজঃফরপুরে বম্ব ফেলিয়া দুইটি ইংরেজ স্ত্রীলোককে হত্যা করা হইয়াছে শুনিয়া আমার চিত্ত অত্যন্ত পীড়িত হইয়া আছে। এইরূপ অধর্ম ও কাপুরুষতার সাহায্যে দেশকে যাহারা বড় করিতে চায় তাহাদের কিসে চৈতন্য হইবে জানিনা, কিন্তু তাহারা সমস্ত দেশকে বিষম দুঃখে ফেলিবে। ধর্মের মুখ চাহিয়া দুঃখ সহা যায় কিন্তু এমন পাপের বোঝা দেশ কি করিয়া বহন করিবে?” [ ১৯ বৈশাখ, ১৩১৫]

এর কাছাকাছি সময়েই [৬ই মে] নির্ঝরিনী সরকারকে লেখা এক চিঠিতে গুপ্তবিপ্লববাদ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের অকপটে লেখেন, যে-উদ্দেশ্যেই গুপ্তহত্যার রাজনীতি প্রয়োগ করা হোক, তা পাপ এবং তার শাস্তি বিধাতার বিধান বলে অবশ্যস্বীকার্য:- “নিজের বা পরিবারের বা দেশের কাজে ধর্মকে লঙ্ঘণ করিলে ঈশ্বর ক্ষমা করেন না। যদি মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যও পাপকে আশ্রয় করি, তবে তাহার প্রায়শ্চিত্ত করিতেই হইবে...... দেশের যে দুর্গতি আমরা আজ পর্যন্ত ভোগ করিয়া আসিতেছি তাহার গভীর কারণ আমাদের জাতির অভ্যন্তরে নিহিত হইয়া রহিয়াছে – গুপ্ত চক্রান্তের দ্বারা নরনারী নরহত্যা করিয়া আমরা সে কারণ দূর করিতে পারিব না আমাদের পাপের বোঝা কেবল বাড়িয়াই চলিবে।”

বোমার বিপ্লবীদের গ্রেপ্তারের সপ্তাহ তিনেক পরেই ২৫শে মে কলকাতায় এক জনসভায় তিনি তাঁর সুদীর্ঘ প্রবন্ধ ‘পথ ও পাথেয়’ পাঠ করেন। এতে তিনি স্পষ্টতই ধৃত বিপ্লবীদের প্রতি কিছুটা নরম মনোভাব প্রকাশ করলেন তাদের নিন্দায় আর পাঁচজনের সঙ্গে গলা মেলাতে অস্বীকার করে। এটা লক্ষ্য করার মতো ব্যাপার যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাষাভঙ্গীতে এ কথা প্রচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করেননি, এই স্বদেশী যুবকদের ভাগ্যে যে দোর্দন্ড রাজশক্তির খাঁড়া ঝুলছে, এ কারণেও তাদের সমবেদনা প্রাপ্য। তাঁর ভাষায় :-“ যাহারা অপরাধ করিয়াছে, ধরা পড়িয়াছে, নির্মম রাজদন্ড যাহাদের ’পরে উদ্যত হইয়া উঠিয়াছে, আর কিছু বিচার বিবেচনা না করিয়া কেবলমাত্র বিপদ ঘটাইয়াছে বলিয়াই তাহাদের প্রতি তীব্রতা প্রকাশ করাও কাপুরুষতা। তাহাদের বিচারের ভার এমন হাতে আছে যে, অনুগ্রহ বা মমত্ব সেই হাতকে লেশমাত্র দন্ডলাঘবের দিকে বিচলিত করিবে না। অতএব ইহার উপরেও আমরা যেটুকু অগ্রসর হইয়া যোগ করিতে যাইব তাহাতে ভীরু স্বভাবের নির্দয়তা প্রকাশ পাইবে।” আমরা এর আগে লক্ষ্য করেছি, যেসব ভারতীয়রা বিদেশী প্রভুকে তুষ্ট করতে স্বদেশী বিপ্লবীদের প্রাণ খুলে নিন্দা ও কঠোর ভাবে দমনের সুপারিশ করেছিলেন, তিলক তাঁর ‘কেশরী’ পত্রিকার প্রবন্ধে তাদের কেমন ধিক্কার দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথও যেন এই শ্রেণীর লোকদের স্মরণ করিয়ে দিলেন এ-রকম সমালোচনার অমর্যাদাকর কাপুরুষতা ।

রবীন্দ্রনাথ প্রথমেই স্বীকার করলেন যে বাংলাদেশের ‘মনের জ্বালা’ দেখতে দেখতে ক্রমশই যেমন অগ্নিমূর্তি ধরে প্রকাশ পাচ্ছে, আমাদের জ্ঞানী দূরদর্শী ব্যক্তিরাও এটা কল্পনা করতে পারেননি কিন্তু কোন পক্ষের বিরুদ্ধে এই গোলমালের দিনে নালিশ তোলা তাঁর উদ্দেশ্য নয়, এর কার্যকারণ ও ফলাফল নিরপেক্ষভাবে বিচার করে পথ খোঁজাই তাঁর অভিপ্রায়। স্পষ্টতই এই প্রবন্ধে সশস্ত্র বিপ্লববাদকে তিনি মন থেকে সমর্থন করতে পারেননি। তাই তিনি বললেন, যে-চিত্তদাহের উত্তেজনা “আমরা প্রত্যেকে নানাপ্রকারে অনুভব ও প্রকাশ করিয়াছি, তাহারই একটি কেন্দ্রক্ষিপ্ত পরিণাম যদি এই প্রকার গুপ্তবিপ্লবের অদ্ভুত আয়োজন হয়, তবে ইহার দায় ও দুঃখ বাঙালিমাত্রকেই স্বীকার করিতে হইবে।......”

‘কেশরী’তে তিলকের প্রবন্ধগুলিতে আমরা দেখেছি যে, বোমাকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও বিপ্লবীদের বোমাবাজি যে সমর্থনযোগ্য নয়, সেকথাও [হয়তো বা আইন বাঁচাবার জন্যই] উল্লেখ করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু গুপ্তবিপ্লবকে আন্তরিক ভাবেই পছন্দ করেন না, যদিও এর কার্যকারণ সম্পর্কে তাঁর অনেক বিশ্লেষণই কিন্তু তিলকের সঙ্গে মিলে যায়। কিছু সাদৃশ্যের দিকে আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

বোমার আবির্ভাব যে কাপুরুষ বাঙালির রূপান্তর ঘটিয়েছে, ‘মারাঠা’ পত্রিকার এই মতের প্রতিধ্বনি করে রবীন্দ্রনাথও বলেন, “বহুদিন হইতে বাঙালিজাতি ভীরু অপবাদের দুঃসহ ভার বহন করিয়া নতশির হইয়াছে বলিয়াই বর্তমান ঘটনা সম্বন্ধে ন্যায়-অন্যায় ইষ্ট-অনিষ্ট বিচার অতিক্রম করিয়াও অপমান-মোচন উপলক্ষে বাঙালির মনে একটা আনন্দ না জন্মিয়া পারে নাই।” দ্বিতীয়ত মজঃফরপুরের বিস্ফোরণের মতো ঘটনার পেছনে মূল কারণ যে শাসকদের বৈষম্য ও দমননীতি আর দেশের লোকের আহত আত্মসম্মান – এই রোগনির্ণয় তিলকের মতো রবীন্দ্রনাথেরও :- “একদিকে প্রজার বেদনাকে উপেক্ষা করিয়া বলপ্রকাশ প্রবল মূর্তি ধরিতেছে, অন্যদিকে দুর্বলের নিরাশ মনোরথ সফলতার কোন পথ না পাইয়া প্রতিদিন মরিয়া হইয়া উঠিতেছে। এ অবস্থায় সমস্যাটি ছোট নহে।”

বিপ্লবীদের অধীর অসহিষ্ণু এবং বুদ্ধিভ্রষ্ট বলে রবীন্দ্রনাথ যে ভাবে ভর্ৎসনা করলেন, তিলক ততটা না করলেও তাঁদের কাজের জন্য তিলকের মতো নেতাদের দায়ী করাকে তিনিও সমর্থন করেন না, এটাই তিলকের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের তৃতীয় সাদৃশ্য। চতুর্থত রবীন্দ্রনাথও তিলকের মতো মনে করেছিলেন যে, নিছক বলপ্রয়োগ করে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় :- “বিরোধবুদ্ধি এতই গভীর ও সুদূরবিস্তৃত ভাবে পরিব্যাপ্ত যে, কর্তৃপক্ষ ইহাকে বলপূর্বক কেবল স্থানে স্থানে উৎপাটিত করিতে চেষ্টা করিয়া কখনোই নিঃশেষ করিতে পারিবন না, বরঞ্চ ইহাকে আরও প্রবল ও প্রকাণ্ড করিয়া তুলিবেন।”

রবীন্দ্রনাথ একথা বলে রাজশক্তিকে যেমন হুঁশিয়ারি দিতে চাইলেন, তেমনি আবার তাদের স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, ‘শক্তস্য ভূষণং ক্ষমা’ – যদিও তাঁর এই ‘সাত্ত্বিক উপদেশ’ রাজপুরুষেরা শ্রদ্ধা সহকারে শুনবেন, এমন ভরসা যে তাঁর নেই, সে কথাও স্বীকার করলেন। কিন্তু এদের মধ্যে যে সব লোক গুপ্ত পন্থাকেই রাষ্ট্রহিতসাধনের একমাত্র পথ বলে স্থির করেছে, তাদের গালি দিয়েও কোন ফল হবেনা, আবার ধর্মোপদেশ দিতে গেলেও তারা হেসে উড়িয়ে দেবে। অত্যাচারী কর্তৃপক্ষ আর চরমপন্থী দেশবাসী- এদের কারও সমর্থনই রবীন্দ্রনাথ করেননি। তাই এই দুই পক্ষের সংঘর্ষ তাঁর কাছে অধর্ম সংঘর্ষ, যার অগ্নিদাহ তাঁর মতে সহ্য করতে হবে নিরীহ তৃতীয় পক্ষকেও, যারা প্রত্যক্ষ ভাবে এ সব কাজে লিপ্ত নয়। তাঁর মূল বক্তব্য তাই নিছক উপদেশের খাতিরে নয়, বাস্তব প্রয়োজনের দিক থেকেই এবং সেই বাণী হলো এই যে, প্রয়োজন অত্যন্ত গুরুতর হলেও প্রশস্ত পথ দিয়েই তা মেটাতে হয় – সংকীর্ণ রাস্তা ধরে কাজ সংক্ষেপ করতে গেলে একদিন দিক ভুল হয়ে পথও হারাতে হবে, কাজও নষ্ট হবে।

এই ‘পথ ও পাথেয়’ প্রবন্ধটির বক্তব্যে বাংলাদেশে কিছু প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, সে কথা রবীন্দ্রনাথ নিজেই উল্লেখ করেছেন। তাঁর কাছে এটা শুধু ‘নির্বিচার নিষ্ঠুরতা’ই নয়, এই পথের পথিকেরা তাঁর চোখে নিছকই ‘ক্ষুদ্র স্বার্থের’ পূজারী। বিপ্লববাদীদের সম্পর্কে অনুকম্পা প্রকাশ করে‎‎ও তাঁদের আদর্শ সম্বন্ধে এই সব কঠোর মন্তব্যই এই ভাষণটি সম্পর্কে জনমনে প্রতিকূলতা সৃষ্টির সম্ভাব্য কারণ বলে মনে করলে হয়তো অসঙ্গত হবেনা, কারণ এই বিপ্লবীরা ক্ষুদিরামের বোমা-কাণ্ডের পর থেকেই জনতার বীরপূজা পেতে শুরু করেছিলেন। তাই এই প্রতিকূলতার কারণেই নিজের অভিমত খোলসা করতে রবীন্দ্রনাথকে পুনশ্চ কলম ধরতে হয়, লিখতে হয় ‘সমস্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি।

এই রচনাটিতে তিনি ভারতবাসীর প্রতি শাসক ইংরেজের অমানবিক ব্যবহার, তাদের তল্পিবাহক মুখপাত্রদের দ্বারা স্পর্ধিত দোষারোপ ও স্বদেশী দাবিকে অবদমিত করার ফতোয়ার কথা স্পষ্ট করেই উল্লেখ করলেন এবং এগুলোকেই ভারতবর্ষের চরম হিত যে কী, তা বোঝার পথে সর্বপ্রধান বাধা বলে উল্লেখ করলেন। তাঁর মতে ইংরেজ কোনোমতেই ভারতীয়দের মানবপ্রকৃতি বলে গণ্য করতে চায়না। জনমনের আলোচ্য ক্ষোভের পেছনে যে ইংরেজ শাসকের দুঃশাসন- নীতিই দায়ী, আর এর উপশম যে আরও উৎকট পীড়ন দিয়ে করা যাবেনা, এ-কথা শাসকদের তীব্র ভাষায় স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, যে-সব ইংরেজশাসক বলেন, ‘কাগজগুলোকে উচ্ছেদ করো, সুরেন্দ্রবাঁড়ুয্যে বিপিনপালকে দমন করিয়া দাও’, দেশকে ঠাণ্ডা করার এই একমাত্র উপায় যারা অনায়াসে কল্পনা করতে পারে আর অসঙ্কোচে প্রচার করতে পারে, তারা যে দেশের শাসকপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, এটাই কি দেশের রক্ত গরম করে তোলার পক্ষে প্রধান কারণ নয়! বাংলাদেশের এক ভূতপূর্ব হর্তাকর্তা [ইলিয়ট] বলেছিলেন যে, ভারতবর্ষে যারা ইংরেজের গায়ে হাত তোলে, তারা যেন কোনওমতেই নিষ্কৃতি না পায়, সে- বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এ কথা উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন করেন – “আর যে সকল ইংরেজ ভারতবর্ষীয়কে হত্যা করিয়া কেবলই দন্ড হইতে অব্যাহতি পাইয়া ব্রিটিশ বিচার সম্বন্ধে চিরস্থায়ী কলঙ্কের রেখা আগুন দিয়া ভারতবর্ষের চিত্তে দাগিয়া দিতেছে তাহাদের সম্বন্ধেও সতর্ক হইবার কোনো প্রয়োজন নাই?”

দেখা যাচ্ছে, ‘বলদর্পে অন্ধ ধর্মবুদ্ধিহীন’ ইংরেজ শাসনের এই স্পর্ধাকে ধিক্কার দিতে রবীন্দ্রনাথ কোনরকম দ্বিধা প্রকাশ করলেন না এবং দেশের লোকের যে- অসন্তোষ তাদের ইংরেজের গায়ে হাত তোলায় প্ররোচিত করেছে, তার জন্য ইংরেজ শাসনের ঐ চরিত্রকেই নিঃসঙ্কোচে দায়ী করলেন। শুধু তা-ই নয়, আত্মপ্রসাদস্ফীত বিদেশী শাসককে মহাকালের কন্ঠে শুনিয়ে দিলেন, তারা জেলে দিতে পারে, ফাঁসি দিতে পারে, কিন্তু নিজের রাজদন্ডকে যদি বিশ্ববিধানের চেয়ে বড় বলে জ্ঞান করে, তবে তার স্তূপীকৃত সেই পাপের বোঝার ঘোরতর অসামঞ্জস্য একদিন নিদারুণ বিপ্লবে পরিণত না হয়ে পারেনা। অর্থাৎ তিনি যদিও তিলকের মতো বোমার রাজনীতিকে নামমাত্র নিন্দা করে বোমার পক্ষে যুক্তির কথা জোর গলায় বললেন না, বরং আরও অগ্রসর হয়ে ক্ষুদিরামের মতো বিপ্লবীদের অনভিজ্ঞ, ক্ষুদ্র স্বার্থের অনুসারী ও নির্বুদ্ধিতার শিকার ইত্যাদি [‘পথ ও পাথেয়’ প্রবন্ধে] বলতেও দ্বিধা করলেন না বটে, কিন্তু এই বোমার রাজনীতির উদ্ভবকে তিনি ইংরেজের ঘৃণ্য নীতির প্রত্যাশিত পরিণতি বলে তিলক, বিপিনচন্দ্র ও অন্যান্য নেতাদের মতোই স্পষ্টভাষায় নির্দেশ করলেন, যা তিনি বাংলায় প্রাথমিক বিপ্লবকাণ্ডগুলির সূত্রে কিছুদিন আগেও উপলব্ধি করতে পারেননি [বিগত সংখ্যায় বর্তমান প্রবন্ধের পর্ব-১ দ্রষ্টব্য] -এটি অবশ্যই একটি লক্ষ্য করবার মতো ব্যাপার।

কোনও রাষ্ট্রনেতার ভাষণে বা রচনায় যে ঋজুতা সম্ভব ছিলনা, সেই স্পষ্টতর ভাষায় শাসকদের উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথ বললেন, “যদি কেবল আমাদের দিকে তাকাইয়া এই কথাই বল যে, অকৃতার্থের অসন্তোষ ভারতের পক্ষে অকারণ অপরাধ এবং অপমানের দুঃখদাহ ভারতের পক্ষে নিরবচ্ছিন্ন অকৃতজ্ঞতা – তবে সেই মিথ্যাবাক্যকে রাজতক্তে বসিয়া বলিলেও তাহা ব্যর্থ হইবে এবং তোমাদের টাইমসের পত্রলেখক, ডেলি মেলের সংবাদ রচয়িতা এবং পায়োনীয়র-ইংলিশম্যানের সম্পাদকে মিলিয়া তাহাকে ব্রিটিশ পশুরাজের ভীমগর্জনে পরিণত করিলেও সেই অসত্যের দ্বারা তোমরা কোনো শুভফল পাইবেনা। তোমার গায়ে জোর আছে বটে, তবু সত্যের বিরুদ্ধেও তুমি চক্ষু রক্তবর্ণ করিবে এত জোর নাই। নূতন আইনের দ্বারা নূতন লোহার শিকল গড়িয়া তুমি বিধাতার হাত বাঁধিতে পারিবে না।”

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের এ-সব নির্ভীক বক্তব্য যে-কারণেই হোক, রাজদ্রোহের দায়ে অভিযুক্ত না হলেও তিনি ব্রিটিশ শাসকদের কিছুই প্রায় বলতে বাকি রাখলেন না। ইলিয়টের মতো প্রাক্তন শাসকের দম্ভোক্তিকে তিনি সোজাসুজি মিথ্যাভাষণ বললেন, বিলেতি কাগজগুলোকে এক হাত নিতে ছাড়লেন না এবং লক্ষ করার বিষয়, ‘ব্রিটিশসিংহ’ না বলে ‘ব্রিটিশ পশুরাজ’ বললেন, যাতে তার পাশবিকতার প্রতি ‎ইঙ্গিতটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্মরণীয় যে, প্রায় একই সতর্কবাণীকে রবীন্দ্রনাথ কয়েক বছর আগেই গানে বেঁধেছিলেন –“বিধির বাঁধন কাটবে তুমি, এতই শক্তিমান/ আমাদের ভাঙাগড়া তোমার হাতে এমনি অভিমান!/ শাসনে যতই ঘেরো, আছে বল দুর্বলেরও/ বোঝা তোর ভারী হলেই ডুববে তরী খান।” কিংবা – “ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে, ততই বাঁধন টউটবে/ ওদের আঁখি যতই রক্ত হবে, ততই আঁখি ফুটবে!...” , তখনও বাংলায় বোমার যুগ শুরু না হলেও ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে তাঁর যে-ধারণা অনেকটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল, মজঃফরপুর-বিস্ফোরণের কার্যকারণ বিশ্লেষণে রবীন্দ্রনাথ যেন সে-ধারণারই যৌক্তিকতা খুঁজে পেলেন।

শুধু শাসকপক্ষকে ধিক্কার দিয়েই যে রবীন্দ্রনাথ ক্ষান্ত হলেন না, যে-কাজকে তিনি ‘অধর্ম’ ও ‘পাপ’ বলে মনে করেন, তাতে লিপ্ত হবার জন্য নিজের দেশের মানুষকে তিরস্কার করতেও ছাড়লেন না। ‘দেশহিত’ নামে তাঁর একটি প্রবন্ধেও [বঙ্গদর্শন, আশ্বিন, ১৩১৫] তিনি বিশেষ ভাবে অভিযোগের তর্জনী তুললেন গুপ্তবিপ্লবের হোতাদের দিকে :- “রাজার সন্দেহ জাগ্রত হইয়া আমাদের চারিদিকে যে শাসনজাল বিস্তার করিতেছে তাহার বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগ আমরা সর্বদা উচ্চকন্ঠেই প্রচার করিতেছি, কিন্তু যেখানে আমাদের স্বদেশের লোক আমাদের যজ্ঞের পবিত্র হুতাশনে পাপ-পদার্থ নিক্ষেপ করিয়া আমাদের হোমকে নষ্ট করিতেছে, তাহাদিগকে আমরা কেন সমস্ত মনের সহিত ভর্ৎসনা করিবার, তিরস্কৃত করিবার শক্তি অনুভব করিতেছি না। তাহারাই কি আমাদের সকলের চেয়ে ভয়ংকর শত্রু নহে।......”

গুপ্তবিপ্লবরূপী শক্তিসাধনায় যারা মেতে উঠেছেন, বিশেষ ভাবে সেই বিপ্লবী দলগুলোকেই তিনি যেন মনে করিয়ে দিতে চাইলেন যা আসলে শক্তি নয়, শান্তির বিড়ম্বনা, শক্তিধর্মসাধনায় সেই উচ্ছৃঙ্খলতার মতো সর্বনেশে বিঘ্ন আর কিছুই নেই। তিনি লক্ষ্য করলেন, “আজ দস্যুবৃত্তি, তস্করতা, অন্যায় পীড়ন দেশহিতের নাম ধরিয়া চারিদিকে সঞ্চরণ করিতেছে।” তাই দেশবসীকে সতর্ক করে দিলেন যে, কেবলমাত্র বীর, ত্যাগী ও তপস্বীরাই আত্মহিত, দেশহিত ও লোকহিতের যথার্থ সাধক আর ধর্মই হচ্ছে প্রকৃত শক্তি। তাই “জাতির চরিত্রকে নষ্ট করিয়া আমরা জাতিকে গড়িয়া তুলিব”, এমনটা ভাবা ‘ভয়ংকর ভুল’।

এটা বুঝতে অসুবিধা হয়না যে, সমকালীন পরিস্থিতির মূল্যায়নে দুটি পরস্পর সংঘর্ষশীল পক্ষের মধ্যে যে কোনও একটির দিকে ঝুঁকে না পড়ে নিষ্কম্প কন্ঠে নিজের বিবেকের রায় উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন বলেই রবীন্দ্রনাথ এক অনন্য ও স্বতন্ত্র স্তম্ভপ্রতিম উচ্চতায় অধিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন, যা বেশ কিছুটা অপ্রিয়তা ও লোকনিন্দার মূল্য চুকিয়ে তাঁকে ক্রয় করতে হয়েছিল ।




আকর-পঞ্জীঃ-

১। তিলকের পত্রিকায় স্বদেশী ‎আন্দোলন/ শঙ্করীপ্রসাদ বসু [চার] – শিলাদিত্য,
১-১৫ মার্চ, ১৯৮৪।

২। নির্ঝরিনী সরকারকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি- চিঠিপত্র সপ্তম খণ্ড 
[বিশ্বভারতী] 

৩। আত্মশক্তি ও সমূহ / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- রবীন্দ্ররচনাবলী [জন্মশতবার্ষিক
সংস্করণ], দ্বাদশ খণ্ড। 

৪। রাজাপ্রজা/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- ঐ , ঐ, ঐ ।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - শবনম দত্ত

Posted in


প্রবন্ধ


অ্যান ওড টু ওয়াটার অব লাইফ
শবনম দত্ত



আইলে মল্টের সাথে পারিবারিক প্রেমটা সবে জমে উঠছে সেই মার্কেটে, ইয়োরোপ থেকে ফেরার পথে, ডিউটি-ফ্রিতে দেখি প্রায় ২০% ডিসকাউন্টে ওবান ১৪ বছর পাওয়া যাচ্ছে। দেখেই বরকে ফোন লাগালাম। সে সটান উত্তর দিল, "নেকি, অউর পুছ পুছ!"। সুতরাং ওবানকে কোলে নিয়ে বেরোলাম। বেরিয়ে বরের মুখের হাসি দেখে, প্রচণ্ড সন্দেহ হলো যে দুদিন পরে আমায় দেখে বেশী খুশী, না কি ওবানকে দেখে বেশী খুশী। তা সেই উইকেন্ডেই ওবান দেবতার আরাধনায় বসা গেল। এখানে আরেকটা কথা বলা খুব জরুরী। সেই সময়ই আমরা খুবই মহার্ঘ্য চারটি টাম্বলার গ্লাস কিনেছিলাম। সেগুলোরও উদ্বোধন করা হলো। মহার্ঘ্য মানে আমাদের কাছে মহার্ঘ্য আর কি। আমরা বেসিকালি যাযাবর - জল খাই বোতল থেকে, জুস খাই প্লাস্টিক গ্লাসে। সেই আমরা, ভারতীয় টাকায় প্রায় আড়াই হাজার টাকা দিয়ে, চারটে টাম্বলার কিনে ফেলেছিলাম। দাদারা, দিদিরা, হাসবেন না, মোট্টে হাসবেন না। প্রেমে পড়লে মানুষ কত কি করে? এ আর এমন কি?

তা ওবান গ্লাসে ঢেলে একটু চমকালাম। কেমন যেন সর্ষের তেলের রং। গ্লাসটা নেড়ে দেখি সর্ষের তেলের মতই চলন। তখন নতুন নতুন কাস্কের ফান্ডা শিখছি। বার্বন তৈরী হয়েছিল যে কাস্কে, সেই কাস্ক স্কচ ম্যাচিয়োর করতে ইউজ করলে স্কচের রং হাল্কা হয়। আর এক্স শেরি কাস্ক ইউজ হলে স্কচের রং হয় গাঢ় (পাকা রং আর কি)। দৃঢ়বিশ্বাস জন্মাল ওবান নির্ঘাত শেরি কাস্কে ম্যাচিয়োর করা মাল। বেশ কিছুদিন পরে জেনে ছিলাম যে ওবানের গাড়রংয়ের রাz হলো পাতি ক্যারামেল। আরও বুঝেছিলাম শুধু রং দেখে কাস্ক আন্দাজ করার চেষ্টা হলো অল্পবিদ্যাভয়ংকরীর টিপিকাল লক্ষণ। আসলে ওবান মোটেই এক্স শেরি কাস্কে ম্যাচিয়োর করানো হয় না। আগে হুইস্কি ম্যাচিয়োর করেছে যে কাস্কে, সেই কাস্কই ওবান ম্যাচিয়োর করতে আবার ব্যবহার হয়। সেই দোজবরে কাস্ক সব রং আগের হুইস্কিকে দিয়ে অলরেডি প্রায় নিঃস্ব। ফলে ওবানের ভাগে প্রায় কিছুই জোটে না। অগত্যা ক্যারামেল। আমার অবশ্য একটা গুপ্ত ইচ্ছে আছে এ ব্যাপারে। ওবান ডিস্টিলারিতে একবার "রং দে তু মোহে গেরুয়া" বাজিয়ে দেখতে চাই ওবান রঙীন হয় কিনা। বলা যায় না, হয়তো আর ক্যারামেল মেশাতেই হলো না? 

ক্যারামেলের কথা যখন উঠলোই, একটু খোলসা করে বলা যাক। আমার ধারনা ছিল ক্যারামেল জিনিষটা ব্রাউন এবং মিষ্টি। মনে সন্দেহ হলো যে স্কচে এমন একটা জিনিষ মেশানো হলে তো তার স্বাদ, গন্ধ সব বদলে যাবে। স্কচরসিকরা কি সেটা মেনে নেবেন? আবার রিসার্চ। দেখা গেল E150a বলে একটি ক্যারামেল হয় যেটা স্কচে মেশালে শুধু রংটুকুই বদলায়। স্বাদ বা গন্ধ বদলায় না। স্কচরসিকরা সেটুকু মেনে নিয়েছেন। তাও সব স্কচে E150a মেশানো হয় না। বার্বন বা রাই হুইস্কির ক্ষেত্রে আরো অন্যরকম কি সব ফান্ডা আছে। হঠাৎ মনে হল, আচ্ছা দেশে যে হুইস্কি পাওয়া যায় তাতে কি ক্যারামেল থাকে? খুঁজতে গিয়ে পুরো এক গাল মাছি হয়ে গেল। আমাগো দ্যাশে হুইস্কিতে ক্যারামেল থাকে কিনা সে প্রশ্নটাই অবান্তর, কেন কি সে হুইস্কিতে হুইস্কিই প্রায় থাকে না। যাকে বলে কেস পুরো জন্ডিস! হুইস্কি হলো অ্যালকোহলিক বেভারেজ যা গ্রেন থেকে তৈরী হয়। আর আমাদের দেশে, বেশীর ভাগ হুইস্কি মোলাসেস থেকে তৈরী অ্যালকোহলের সাথে নাম মাত্র পরিমাণে হুইস্কি মিশিয়ে তাতে রং, স্বাদ, গন্ধ অ্যাডকরে বিক্রি হয়। মোলাসেস হলো গিয়ে আখ থেকে চিনি তৈরীর সময় সাইড এফেক্ট হিসেবে তৈরী হওয়া ডার্ক ব্রাউনঘন লিকুইড বস্তু একটি। এটা থেকেই রাম তৈরী হয়। আরও একটু গভীরে গিয়ে দেখা গেল, রয়াল চ্যালেঞ্জে নাকি ১২% হুইস্কি আর বাকিটা মোলাসেস থেকে তৈরী নিউট্রাল স্পিরিট। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল অ্যান্টিকুইটি ব্লু কিন্তু রাম নয়। ইন্ডিয়ান গ্রেন হুইস্কি, ইন্ডিয়ান মল্ট হুইস্কি আর স্কচ মল্ট হুইস্কির ব্লেন্ড। এর মধ্যে স্কচ মল্ট হুইস্কি কতটা, তা জিজ্ঞাসা করিয়া লজ্জা দিবেন না।

যাই হোক ওবানে ফেরা যাক। দর্শন শেষে স্বাদগ্রহণ। একটু জল মিশিয়ে সিপ নিয়ে দেখি বেশ ফল পাকড়ের গন্ধ, মিষ্টি মিষ্টি। ফিনিশ লঅঅম্বা। আর লাস্টে একটুকখানি নোনতা। খবরে প্রকাশ ওবান নাকি অল্প স্মোকিও। তা আমার আনাড়ি নাককে ধোঁয়া বিলকুল ফাঁকি দিল। পরের কয়েক মাসে ওবান ছাড়াও আরও কটা হাইল্যান্ড স্কচ খাওয়া হলো। গ্লেনমোরাঞ্জি (Glenmorangie), ডালহুইনি (Dalwhinnie) ইত্যাদি, প্রভৃতি। এরই মাঝে একদিন দেখি একটা আকাশ নীল রঙের প্যাকেট সুপারমার্কেটে স্কচের সারিতে। এঁকে তো আগে দেখি নাই? চশমা না পরামাইনাস পাওয়ারওলা চোখ দুটো প্রায় প্যাকেটে লাগিয়ে ফেলে দেখলাম এঁর নাম তালিস্কার স্কাই (Talisker Skye)। তালিস্কারের অন্য একটা প্যাকেট আগে দেখেছিলাম। সেটা প্রায় নেভি ব্লু রংয়ের ছিল। গুগল করতেই দেখলাম ইনি সেই বছরই জন্মলাভ করেছেন। তালিস্কার জায়গায় জায়গায় বলে বেড়াচ্ছে, "আনিলাম অপরিচিতের নাম ধরণীতে, পরিচিত স্কচেদের সরণীতে"। নিজেকে জনগনেশ কনসিডার করে, ইনি কৌতুক কিনা, তা পরীক্ষা করার গুরুদায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিয়ে ফেললাম। পরীক্ষায় বোঝা গেল উনি কৌতুক একেবারেই নন। বরং হাইলি ইন্টারেস্টিং যাকে বলে। শুরুতে একটা লেবু লেবু গন্ধ আর সাথে ধোঁয়ার গন্ধ। জিভে একটু মিষ্টি, আর একটু যেন নোনতা ভাবও আছে। যতক্ষণ জিভে থাকে ধোঁয়ার গন্ধ ভরপুর। ফিনিশটা মাঝারি। প্যাকেটের গায়ে কি লেখা আছে তা পড়তে গিয়ে মেগা হোঁচট খেলাম। স্কচটার বয়েসই লেখা নেই! যাহ্ বাবা। ইনি কি তবে মহিলা? আরও কিঞ্চিৎ গবেষণা করার পর রহস্য উদ্ধার হলো। তালিস্কার এবং আরও ক'টা ডিস্টিলারি কিছু কিছু স্কচের বয়েস লেখে না। সুতরাং ধরে নিতে হবে যে, এই স্কচের বয়েস তিন বছরের উর্দ্ধে (পুরা ভাড়া মানে পুরো দাম অবশ্যই লাগে)। কিন্তু তিন কেন? দুই বা চার কেন নয়? আসলে স্কচ অন্তত তিন বছর ম্যাচিয়োর করতে হয়। আর যে কোনও হুইস্কিতেই সবচেয়ে নবীন যে হুইস্কিটা ব্লেন্ড করা হয় সেটাই হুইস্কিটার বয়েস হয় (আহা এমন সুবিধা যদি মানুষের থাকত! ভাবুন খালি। হাঁটু বদলে আনলেন আর আপনি শিশুটি হয়ে গেলেন!)। পাঠক মনে রাখবেন, সিঙ্গল মল্ট স্কচ মানে যে স্কচ হুইস্কিতে একটিমাত্র ডিস্টিলারিতে তৈরী স্কচ থাকে। কাজেই একটি ডিস্টিলারিতে তৈরী হওয়া ৩ বছর ও তার চেয়ে বেশীবয়সের মাল্টিপল স্কচ মিক্স করলেই সিঙ্গল মল্ট স্কচ রেডি। তার বয়েস ৩ বা তার বেশী। 

ততদিনে ক্রিসমাস প্রায় দোরগোড়ায়। এ দেশে ক্রিসমাস আমাদের দুর্গাপুজো। জামাকাপড়, জুতো ছাড়ুন, ইয়ারবাড আর মোমবাতিতেও ছুট দেয়। বেশ কিছু স্কচেও ভাল মতন ছুট দিচ্ছে দেখা গেল। আর এখানে দাম বাড়িয়ে ছুট দেবার প্রহসনটা নেই। ছুট মানে সত্যিই ছুট। সুতরাং ব্যাকপ্যাক বোঝাই করে ল্যাফ্রয়েগ সিলেক্ট, কুল্যাইলা ১২, লাগাভুলিন ১৬ ইত্যাদি ইত্যাদি কেনা হলো। ভাবছেন তো কেন সবগুলো আইলে মল্ট কিনলাম? এ দেশে স্কচপ্রেমীরা সাধারণত দু'তিন রকম স্কচ পর পর খেয়ে তারপরে মতামত দেন। আমাদেরও তেমনই ইচ্ছা ছিল প্রাণে। পরপর নাহোক, ছুটির দু সপ্তাহে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খাব বলে আনা। এইবারে খেয়াল করে দেখলাম ল্যাফ্রয়েগ সিলেক্টেরও বয়স লেখা নেই। পড়ে দেখলাম ইনি যেসব স্কচ মিশিয়ে তৈরী হয়েছেন তারা কেউ এক্স শেরি কাস্কে বড় হয়েছেন, কেউ অ্যামেরিকান ওক ব্যারেলে বড় (বুড়ো?) হয়েছেন, কেউ বা আরও অন্যকিছুতে। ভাল কথা, সে যাত্রায় হুইস্কিস্টোনও কেনা হলো। 

হুইস্কি স্টোন বস্তুটা কি সেটা একটু খোলসা করে বলা যাক। হুইস্কি স্টোন হলো লুডোর ছক্কার থেকে একটু বড় আকারের স্টোন। কয়েক ঘন্টা ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখলে, বার করার পরে অনেকক্ষণ ঠাণ্ডা থাকে। এই স্টোনগুলো হুইস্কিতে দিয়ে খেলে হুইস্কি ঠাণ্ডা থাকে। স্কচ অন দ্য রক্স ইন রিয়েল সেন্স আর কি। সিঙ্গল মল্ট বরফ দিয়ে খাবার কথা বললে, স্কটল্যান্ডের খানদানী দোকানীরা আপনাকে স্কচ বেচতে সেরেফ ইনকার করে দিতে পারে। স্কচ খাবার কায়দা হলো অল্প পরিমাণে সামান্য ঠাণ্ডা জল মিশিয়ে অথবা তাও না মিশিয়ে। ঠাণ্ডায় ভদ্রলোকেরা খুবই জুবুথুবু হয়ে পড়েন । গন্ধ টন্ধ কিছুই রিলিজ করেন না। বরফ মিশিয়ে খাবার আরও একটা মেজর সাইড এফেক্ট হলো যে অত ঠাণ্ডায় জিভের টেস্ট বাডগুলো নাম্ব হয়ে যায় অনেকটাই। ফলে স্কচের এত রকমের টেস্টিং নোটস অধরামাধুরী হয়েই থেকে যায়। তাই বরফ নৈব নৈব চ। কিন্তু হাতে গ্লাস ধরে রাখলে তো হাতের গরমেই গ্লাস গরম হবে আর সেই থেকে হুইস্কি গরম হয়ে যাবে। অগত্যা হুইস্কি স্টোনই মুশকিল আসান উড়ে মালী।

হুইস্কি ঠাণ্ডা রাখা নিয়ে এত চর্চার পরে কি হুইস্কির গ্লাসের কথা না এসে পারে? হুইস্কির গ্লাসের ব্যাপারটা কিন্তু ফর  আ চেঞ্জ জলবৎ তরলং, হুইস্কিবৎ কমপ্লেক্সং নয়। মোটের উপরে দু' রকম গ্লাসে হুইস্কি খাবার চল। টাম্বলার আর গ্লেনকেয়ার্ন। টাম্বলার হলো থিক বটম, বেঁটে গ্লাসগুলো। এগুলোর সুবিধা হলো সহজে উল্টায় না, আর যদি কোননভিস অথবা অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী আত্মা হুইস্কিতে কিছু মেশাতে চান তিনি সহজে মেশাতে পারেন গ্লাসের মুখটা বড় বলে। অন্যদিকে গ্লেনকেয়ার্ন গ্লাস হলো অনেকটা লেজ কাটা ওয়াইন গ্লাসের মতন। মানে বেসিকালি গ্লাসের নিচের ডাণ্ডাটা খুব ছোট। এতে সুবিধা সেই একই - উল্টাবার চান্স কম। মানে আপনি যাতে উল্টান তার পাকা ব্যবস্থা আর কি! ওই দেখুন কথায় কথায় সেই পেঁচো মাতালটা আবার উঁকি মারতে লেগেছে। হুইস্কি কি আর উল্টাবার জন্য খায় কেউ? হুইস্কি খায় মনটাকে এক জায়গায় জড় করতে। তা হচ্ছিল গ্লেনকেয়ার্ন গ্লাসের কথা। এ গ্লাস ধরার সময় হুইস্কি যে পার্টে আছে গ্লাসের, গ্লাসের সেই পার্টটাই ধরতে হয়। কাজেই হাতের গরমে হুইস্কি একটু গরম হয়। ইভাপোরেট করে। এটা হলো ঘ্রানেণ অর্ধভোজনং করার যোগাড়। ইভাপোরেট করার ফলে তৈরী ভেপারগুলো গ্লাসের সরু মুখটা দিয়ে পালাবার জন্য আকুলিবিকুলি করে কিন্তু পথ পায় না (অনেকটা বিশেষ বিশেষ শহরের বিশ্বখ্যাত ট্র্যাফিক জ্যামে ফেঁসে যাওয়া বাইকচালকের মতো)। হুইস্কি রসিকরা সেই অবস্থারই সুবিধা নিয়ে, গ্লাসের মুখের কাছে নাক নিয়ে গিয়ে - গন্ধের সুনামি উপভোগ করে। 

যাই হোক আবার ক্রিসমাস মার্কেটে ফিরি। এইখানে আরও কিছু হুইস্কির দেখা পেয়েছিলাম যার প্যাকেটের গায়ে দুর্বোধ্য ভাষায় কিসব লেখা। দেখে মনে পড়ল আরে এমন অক্ষর তো চায়না টাউনে দেখেছি। চীনা হুইস্কিও বেরিয়ে গেছে? তারপরে মনে পড়ল আরে এটা তো কোলকাতা নয়, লন্ডন! সাহস করে একটা প্যাকেট তুলে ইংরেজীতে কিছু লেখা আছে কিনা খুঁজতে লাগলাম। মিনিট তিনেকের চেষ্টায় বুঝলাম এঁকে চীনে বলে চিনে ভুল করেছিলাম। ইনি জাপানী। আরও বেকুব হয়ে ভাবছি, "সা রে গা মা পা ধা নি/বোম ফেলেছে জাপানী" গাইবো কিনা, স্টোরের একজন এসে বললেন, "দিস ইজ জাপানীজ হুইস্কি। ইট ইজ ব্রিলিয়ান্ট। ইফ ইউ হ্যাভ নট ট্রায়েড দিস অলরেডি, ইউ শুড গিভ ইট আ ট্রাই"। না দাদারা/দিদিরা আমরা মোট্টে ট্রাই দিই নাই। খালি পরে রিসার্চ করে দেখেছিলাম জাপানী হুইস্কি একদম ট্র্যাডিশনাল স্কচ বানানোর প্রসেস ফলো করেই বানানো হয়। এমনকি ওরা ওস্কটিশদের মতন whisky লেখে। অ্যামেরিকান বা আইরিশদের মতন whiskey লেখে না। খালি একটা জিনিস দেখলাম অনেক জায়গতেই বলেছে যে কিছু জাপানী হুইস্কি কফে (Coffey) স্টিলে ডিস্টিল করা হয়। 

কফে স্টিল নিয়ে রিসার্চের আগে আমরা কি রকম স্টিল, কি ডিস্টিলেশন নিজেরা দেখেছি সে গপ্পোটা করেনিই, কেমন? স্কটল্যান্ডের ডিস্টিলারি ট্যুরে যে ডিস্টিলেশনের বন্দোবস্ত আমাদের দেখায় সেগুলোতে সব জায়গায় থাকে পট স্টিল। অ্যাস্টোরিক্সের গল্পে গেটাফিক্স (এটাসেটামিক্স) যে বড় হাঁড়ি টাইপ জিনিসে ম্যাজিক পোশন বানায়, সেটার মাথায় একটা লম্বা পাইপ জুড়ে দিলেই পট স্টিল রেডি। এই স্টিলগুলো কপারে তৈরী। কেন শুধু কপার দিয়েই বানায়, স্টীল বা অন্য কিছু দিয়ে নয়, তার সদুত্তর উইকিও দেয় নাই, ডিস্টিলারির লোকেরাও দেয় নাই। তাই এও হলো "ধরা সে যে দেয় নাই" ব্র্যাকেটে পড়া আরও একটি স্কচ রহস্য। তবে বলা হয় যে স্টিলের কপারের টাচে এসে ওয়াশের মধ্যে থেকে বেরোনো সালফার বেসড কম্পাউন্ডগুলো নিউট্রালাইজড হয়ে যায়। সত্য মিথ্যা জানে শ্যামলাল! বেশির ভাগ ডিস্টিলারিতে দু' রকমের স্টিল থাকে। ওয়াশ স্টিল আর স্পিরিট স্টিল। ইস্ট যখন ফারমেন্ট করে ম্যাশের সুগারকে অ্যালকোহলে কনভার্ট করে তখন তৈরী হয় ওয়াশ। এতে অ্যালকোহল থাকে 10-20%। এই ওয়াশকে ওয়াশ স্টিলে গরম করা হয়। ওয়াশ স্টিলের পুরাকালে গরম করা হতো ডাইরেক্ট ফ্লেমে, মানে সরাসরি পেছনে আগুন দিয়ে আর কি। কিন্তু এখন মানুষ সভ্য হয়েছে। কোনও কিছুই সোজাসুজি করে না। তাই এখন স্টিলের নীচে হট স্টিম দেওয়া হয়। কিন্তু গোটা কয়েক ডিস্টিলারিতে, যেমন গ্লেনফিডিচ, ম্যাকানান এগুলোতে, এখনও স্টিলের পেছনে সরাসরি আগুন দেবার প্রথা রয়েছে। এই ডিস্টিলারির মালিকের বাড়ির লোকজন খুব সরলমনা কিনা সে বিষয়ে আমি কোনও গ্যারান্টি দিচ্ছি না কিন্তু। যাই হোক, গরমে যখন ওয়াশ ফুটতে আরম্ভ করে, ওয়াশের মধ্যে থাকা অ্যালকোহল আর বাকি যেসব জিনিস জলের আগে ফোটে তারা জলদি জলদি ভেপোরাইজ করতে শুরু করে। এই ভেপার পাইপ বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করে। পাইপের শেষটা নীচের দিকে নামানো মতন হয়।সেই মুড়ো দিয়ে এই ভেপারটা বেরিয়ে আসে। এবার ভেপারটা আবার ঠাণ্ডা করে লিকুইড করা হয়। এই লিকুইডেরনাম লো ওয়াইন। এর সাথে ওয়াইনের কোন সম্পর্ক নেই যদিও। তাতে অবশ্য কি বা যায় আসে! গোলাপ আর গোলামজাম, আম আর আমতা, কে কার কি হয় শুনি? তা এই পাইপের হাইটের উপরে হুইস্কির স্বাদ গন্ধ অনেকটা ডিপেন্ড করে। যত উঁচু পাইপ তত বেশী জিনিস পিছনে ফেলে অ্যালকোহল উপরে উঠে যায়। অ্যালকোহল যে খুবই অ্যাম্বিশাস, তাতে কি আর সন্দেহ আছে? লাগাভুলিনের বেঁটে পাইপওলা পট স্টিলের জন্যই লাগাভুলিনের লোওয়াইন অনেক বেশী পিটি হয়। আবার গ্লেনমোরাঞ্জির লম্বা পাইপওলা পট স্টিল খুব কম জিনিসকেই লো ওয়াইনঅবধি যাবার পাসপোর্ট দেয়। তাই সে হুইস্কি খুবই মোলায়েম। লম্বা পাইপ ছাড়াও আরও কিছু ব্যবস্থা আছে যাতে অ্যালকোহল একাই উপরে যেতে পারে, যেমন ধরুন পাইপের শুরুটায় একটা টায়ারের মতন ফোলা অংশ যোগ করে দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।

এই লো ওয়াইনকে নিয়ে আরও একটা স্টিলে আবার ডিস্টিল করা হয়। এই স্টিলের নাম স্পিরিট স্টিল। সাধারণত এই স্টিলটা ওয়াশ স্টিলের থেকে ছোট হয়। লো ওয়াইনে থাকে 20-30% অ্যালকোহল আর স্পিরিট স্টিল থেকে যে স্পিরিটটা বেরোয় তাতে থাকে 60-75% অ্যালকোহল। এইখানে স্টিলম্যানের কথাটা বলতে হবে। স্পিরিট স্টিল থেকে যখন অ্যালকোহলের ভেপার বেরোতে শুরু করে প্রথমে খুব বেশী অ্যালকোহল পার্সেন্টেজওলা ভেপারবেরোয়। এটাকে বলে হেড। তারপর আসে ওই 60-75% অ্যালকোহলওলা ভেপার। তাকে বলে হার্ট। আর শেষে আসে টেল। সামান্য অ্যালকোহল থাকে তাতে। স্টিলম্যানের কাজ হলো হেডটাকে ছেড়ে দিয়ে হার্টটাকে ধরা আর তাকে কাস্কের দিকে পাঠিয়ে দেওয়া। এরপরও কি বলতে হবে কেন কেবল সিংহহৃদয়ের মানুষরাই স্কচের কদর করতে পারেন? ভাল কথা, হেড আর টেলকে কিন্তু আবার ডিস্টিল করতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় লো ওয়াইন রিসিভারে। এইখানে বলে রাখা উচিত, আইরিশ হুইস্কি কিন্তু তিনবার ডিস্টিল করা হয়।

কফে স্টিলের কেসটা বেশ আলাদা। এখানে স্টিলটা জাস্ট একটা কলামের মতন আর মাঝে মাঝে হরাইজন্টাল প্লেট দেওয়া থাকে। গরম সেই নীচেই দেওয়া হয়, কিন্তু ওয়াশটা উপর থেকে ঢালা হয়। এবার ওয়াশ যত নীচেরদিকে নামছে তত বেশি গরম পাচ্ছে, তার মধ্যের অ্যালকোহল ভেপোরাইজ করছে। সেই অ্যালকোহল ভেপার আবার উপরে উঠে যাচ্ছে। উপরে আরেকটা পাইপ থাকে যেটা দিয়ে এই অ্যালকোহল ভেপারটা বেরিয়ে যায়। কি ভাবছেন? জীবনের পাঠশালা? আমিও ঠিক তাই ভেবেছিলাম। জীবনের তাতে সেঁকে, পুড়েই তো মানুষের মধ্যে থেকে সব ইমপিয়োরিটিগুলো বেরিয়ে যায়, মানুষ হয়ে ওঠে সৃস্টিকর্তার মনোমত! যাক্ গে যাক। গল্পে ফিরি। তা এই স্টিল থেকে যে অ্যালকোহল ভেপার বেরোয় সেটা কিন্তু চাইলে 95% বা তারও বেশি পিয়োর অ্যালকোহল হতে পারে। পট স্টিল থেকে কিন্তু এত পিয়োর অ্যালকোহল বেরোয় না। স্কচ পট স্টিলেই বানানো হলেও অন্যান্য হুইস্কিযেমন বার্বন, রাই, বেশ কিছু জাপানিজ হুইস্কি, ভদকা, জিন সব এই কফে স্টিলে বানানো হয়। 

সেই ক্রিসমাসের ছুটি কেমন গেছিল, কি কি শিখিছিলাম, সে কথা লিখতে বসলে আরও একটা স্কচ-ভারত হয়ে যাবে। এরপর গত দু-আড়াই বছরে আরও অনেক সিঙ্গল মল্টের সাথে জানা শোনা হয়েছে, আরও কয়েকটা ডিস্টিলারি ট্যুরে গেছি, অ্যালকোহল নয়, স্কচের নেশায় বুঁদ হয়েছি। গেলিক ভাষায় (স্কটল্যান্ডের ভাষা) স্কচের নাম উষ্কা বেহ হা, যার মানে ওয়াটার অফ লাইফ। আজ অবধি যা প্রমাণ পাওয়া গেছে তাতে মনে হয় প্রথম স্কচ তৈরী হয়েছিল 1494 সালে। তারপর থেমস দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। মঙ্কদের হাত ধরে ক্রমশ স্কচ তৈরীতে পার্ফেকশন এসেছে, ট্যাক্সের চক্করে শ'য়ে শ'য়ে ডিস্টিলারি বন্ধ হয়ে গেছে, ফরাসি বিপ্লবের সুযোগ নিয়ে ব্র্যান্ডিকে ব্রাত্য করে জেন্টলম্যানস ড্রিংক হয়ে উঠেছে স্কচ। আজ দু'শোর বেশী দেশের মানুষ স্কচের ভক্ত। স্কচ রফতানি করে বছরে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার রোজগার করে ইউ কে। 

কিন্তু এহ বাহ্য। আসলে স্কচ হলো মানুষের পার্ফেকশনিষ্ট হতে চাওয়ার আরেকটা গল্প। এক একটা স্কচের বোতলে যতটা অঙ্ক, ততটাই প্যাশন। স্কচের রহস্য ভেদ করতে হলে তার সাথে একান্ত হতে হয়, জনতার মাঝে তার রহস্য রহস্যই থেকে যায়। তাই বন্ধুদের সাথে আনন্দ করার জন্য তোলা থাক বীয়ার, টেকিলা, জি, দুনিয়া থেকে ছুটি নেবার জন্য থাক ভদকা কিম্বা রাম, আর একলার সাথে বাস করার জন্য থাক স্কচ। 

0 comments:

0

বইঘর - চয়ন

Posted in


বইঘর


ভাবনা -আড্ডা -গল্পে : অমর ধ্রুবপুত্র
চয়ন



অনাবৃষ্টিতে, খরায় কাতর উজ্জয়িনী। রোদে পুড়ে ছারখার সোনার দেশ। রক্তবর্ণ সবুজ পাতারা, নরম মাটি পাথর, নদী সরোবর জলহীন। ধ্রুবপুত্র নির্বাসিত তাই মানুষের অন্তঃকরণ প্রেম-প্রীতি-করুণা শূন্য। ভয়ঙ্কর অজন্মা এক ভীষণতর বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি করতে চলেছে। এরপর নারীপুরুষের মিলনে প্রাণসৃষ্টি হবে না আর। এই অবস্থায় নবরূপে প্রত্যাবর্তন ধ্রুবপুত্রের। তিনি চান বৃষ্টি আসুক, ফসল ফলুক, মানুষ জন্মাক। কিন্তু, এই অনাবৃষ্টিতে সব নারী আজ প্রোষিতভর্তৃকা। সব পুরুষই কোনও না কোনও ভাবে নির্বাসিত : যুদ্ধক্ষেত্রে, বন্দীশালায়, জনশূন্য প্রান্তরে। তাঁর নির্বাসন কালে ধ্রুবপুত্র রচনা করেছিলেন উমা মহেশ্বরের মিলন গাথা। রচনা করেছিলেন এক অনুপম কাব্য। তিনি কবি, তাই তিনি দ্রষ্টা। তিনি জানেন বৃষ্টির মেঘ পারে পুরুষের নির্বাসন কালের অন্ত ঘটাতে। তিনি জানেন নির্দয় প্রকৃতির বিপক্ষে দাঁড়াতে পারে তাঁর কাব্য। তিনি রচনা করতে পারেন বৃষ্টির মন্ত্র -- অন্ততপক্ষে রচনার চেষ্টা করতে পারেন। কবি মন্ত্রোচ্চারণ করতে থাকেন : 

কশ্চিতকান্তা বিরহগুরুণা স্বাধিকারপ্রমত্তঃ
শাপেনস্তংগমিতমহিমা বর্ষভোগ্যেণ ভর্তুঃ। 

নিষাদদের ঢাকে মেঘের গর্জনধ্বনি জেগে ওঠে। বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ পাওয়া যায়। খোলা আকাশের নীচে মৈথুনরত নরনারী মিলনসুখের তুঙ্গমুহূর্তে দেখতে পায় ঘন মেঘে আকাশ ছেয়েছে। বৃষ্টি আসছে; বৃষ্টি এল। 

সমস্ত ইওরোপ এক পোড়োজমিতে রূপান্তরিত হয়েছে। মানুষের নির্বোধ হিংসা নির্বাসিত করেছে কৃষ্টি-সংস্কৃতির অন্তরাত্মাকে। বৃষ্টি নেই, ছায়া নেই। 

And the dead tree gives no shelter, the cricket no relief.
And the dry stone no sound of water. Only
There is shadow under this red rock. 

বন্ধ্যা নারী পুরুষের সম্পর্ক। দেহ আছে, প্রেম নেই। মৈথুন যান্ত্রিক। 

She turns and looks a moment in the glass,
Hardly aware of her departed lover; 
Her brain allows one half- formed thought to pass: 
'Well now that's done: and I'm glad it's over.'

এই অবস্থার মধ্যে এক কবি জলের খোঁজে চলেছেন। তিনি তার সন্ধান করছেন নর নারীর মিলনজাত উর্বরতা নিয়ে রচিত লোকাচার ( fertility cult এর) মধ্যে; হৃতসুষমা সংস্কৃতির মধ্যে : 

The river's tent is broken; the last fingers of leaf 
Clutch and sink into the wet bank. The wind
Crosses the brown land, unheard. The nymphs are departed.
Sweet Thames, run softly, till I end my song. 

বহুপথ অতিক্রম ক'রে ভারতীয় দর্শনের জগতে এসে আশ্বাস লাভ করেন কবি। ভেজা বাতাস বয়ে আনে বৃষ্টির আশ্বাস। বৃহদারণ্যক উপনিষদের অনুপ্রেরণায় মেঘগর্জনের মধ্যে কবি শোনেন দম্যত, দত্ত, দয়ধ্যম্। কবি চেষ্টা করেন তাঁর কাব্যের শক্তিতে পোড়ো জমিতে বৃষ্টি নামানোর : 

In a flash of lightning. Then a dump gust
Bringing rain

Ganga was sunken, and the limp leaves
Waited for rain, while the black clouds
Gathered far distant, over Himavant.
The jungle crouched, humped in silence.
Then spoke the thunder. 

দুটি গ্রন্থ: উপন্যাস আর কাব্য। দুটি সন : ২০০২ এবং ১৯২২। দুটি নাম : ধ্রুবপুত্র ও The Waste Land। দু'জন স্রষ্টা : অমর মিত্র আর T.S. Eliot। কী সাদৃশ্য দুটি রচনার মধ্যে! ঔপন্যাসিক নিশ্চিতভাবে কাব্যগ্রন্থটির দ্বারা প্রভাবিত? 

অমর মিত্র হাসলেন। তারপর বললেন, " জীবনে ওয়েস্টল্যাণ্ড পড়ি নি আমি।" তাহলে এই অনাবৃষ্টি ও বৃষ্টির দ্বান্দ্বিকতা? যার দেখা তাঁর রচিত অশ্বচরিত উপন্যাসেও পাওয়া যায়? শরতকালে যে ঘোড়া খুঁটি উপড়ে পালায় চরের বুকের সবুজ ঘাসের টানে, সে হঠাৎ বৈশাখ মাসে পালাতে যায় কেন? কারণ, এই বৈশাখী পূর্ণিমারাতে আচমকা বৃষ্টি নামে। বৃষ্টি থামলে দেখা যায় বালির গর্তের মধ্যে জল জমেছে। সোনার থালার মত চাঁদ উঠেছে আকাশে। ঠাণ্ডা বাতাস শুঁকে শরতের গন্ধ পায় ঘোড়াটা। দৌড় শুরু করে। দৌড়তে দৌড়তে রাত ফুরোয়। সূর্য ওঠে। বৈশাখী দাবদাহ প্রবল সমারোহে জানান দেয় নিজের অস্তিত্ব। ঘোড়াটার মৃত্যু ঘটে। সেই এক বিষয় বস্তু নয় কি? খানিক মিথ্যে আশা আর নিষ্করুণ জীবনের বৈপরীত্য? সাহিত্যিক আবার হাসেন। 

-- " কী জানেন? ছোট থেকে আমি কোনওদিন জলের অভাব দেখি নি। এখানে টালাট্যাঙ্কের জল সব সময় পাওয়া যায় কিনা! মনে হ'ত উল্টোদিকটা ভাবলে কেমন দাঁড়ায় ব্যাপারটা!" পুরোপুরি আড্ডার মেজাজে বলেন অমর মিত্র। 
তারপর তাঁর চোখে ভাবনা ঘনিয়ে আসে। নিজের মনে বলতে শুরু করেন তাঁর উজ্জয়নী আবিষ্কারের গল্প। আমরা শুনতে থাকি কেমন ভাবে আত্মীয়ভবনে গিয়ে তিনি উজ্জয়িনী দেখেন প্রথমবার। দেখেন মহাকাল মন্দির। চলোর্মি বেত্রবতীর সাক্ষাত না পেয়ে ক্ষুব্ধ হন। আমরা শুনি, দ্বিতীয়বার কেমন ক'রে গোয়ালিয়রের এক সাহিত্য সভা থেকে ফেরার পথে তিনি আবার উজ্জয়িনীতে আসেন। এক গাছের নীচে বসে থাকতে থাকতে তাঁর মনে হয়েছিল যেখানে এখন মাত্র চোদ্দ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয় সেখানেই কি একদিন শিপ্রার জলছোঁয়া বাতাস সারসদের কলতান বহুদূর বয়ে নিয়ে যেত? তখনই তাঁর মনে খরা ও বৃষ্টির বিপ্রতীপতাময় এক কাহিনী দানা বাঁধতে থাকে। " আসলে, বাঁকুড়ার খরা নিজের চোখে না দেখলে খরার রূপ ফোটাতে পারতাম না আমি। বলা যেতে পারে বাঁকুড়া আর উজ্জয়িনী এখানে এক হয়ে গেছে।" লেখক বলে চলেন তাঁর প্রস্তুতি পর্বের কথা : গ্রন্থ পাঠ, কালিদাসের নাটক দেখা আর সবশেষে এপিফেনি। "উদয়গিরি গেলাম একদিন। এই উদয়গিরিই হ'ল মেঘদূতের নীচৈঃ পর্বত। এখানেই পাথর দিয়ে গাঁথা নির্জন খালি ঘরে প্রেমিক প্রেমিকারা প্রেম করত। দেওয়ালের গায়ে নিজেদের নাম লিখত। এখান থেকে নীচের দিকে চেয়ে বনযুথিকার গাছ দেখলাম কি না ঠিক বুঝলাম না। তবে, জঙ্গল দেখলাম। দেখলাম সাদা ফিতের মত নীচে পড়ে আছে নদীটা। আর তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি সেই মেঘ হয়ে উঠলাম। মেঘের চোখ দিয়ে দেখলাম সবটা।" আমাদের গায়ে কাঁটা দিল। আমরা মনে মনে আবৃত্তি করতে লাগলাম : নীচৈরাখ্যং গিরিমধিবসেস্তত্র বিশ্রামহেতো...( বিশ্রামের জন্য তুমি নীচৈঃ নামক পর্বতে বাস করবে)। 

" লিখতে শুরু করার পর পঁচাত্তর পাতা লিখে ফেলে রেখেছিলাম। মাঝখানে একবার মনে হয়েছিল এভাবে হবে না। পুরো ফর্মটা বদলাতে হবে। তারপর আবার মনে হ'ল না ঠিকই আছে। লিখতে শুরু করলাম। লেখাটা নিজেই নিজেকে চালিয়ে নিয়ে গেল। পুরোটাই আমার কল্পনা। ওয়েস্টল্যাণ্ড কী আমি জানি না।" 

দ্বিধাগ্রস্ত মন নিয়ে ঘরে ফিরে উপন্যাস এবং কবিতা আবার একবার পড়লাম। আর, আবিষ্কার করলাম যে দুটির মৌলিক চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। অমর মিত্রের উপন্যাসে ছত্রে ছত্রে স্পন্দিত জাগ্রত জনজীবন। ভারতাত্মা মূর্ত এ কাহিনীতে। দেবদাসী, গণিকা, রাজ্ঞী, সামান্য গৃহবধূ, শূদ্রাণী, শূদ্র, নিষাদ, রাজা, কবি নিয়ে লেখক গড়ে তুলেছেন তাঁর কথনবাস্তব। কুমারসম্ভব ও মেঘদূতের মিলনে তিনি স্পষ্ট ভাবে বলেছেন যে সমাজ যখন বন্ধ্যত্বের দিকে এগোয় তখন সমাজশরীর থেকেই জেগে ওঠে নূতন প্রাণ। কবি তখন জয়গান করেন সেই চিরজীবিতের। 

অপরদিকে, এই উত্তরণ অন্তত The Waste Land এ সম্ভব হয়নি Eliot এর পক্ষে। তাঁর সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার বা ঔপনিষদিক দর্শন কোথাওই কোনও বহমান জীবন স্রোতের দেখা পান নি তিনি। এক ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্য থেকে তিনি বর্ষার মেঘের অভিজ্ঞতার স্মৃতিরেশই অনুভব করতে পেরেছেন কেবল। কথককন্ঠস্বর তাই অবহ একাকীত্বের যন্ত্রণা নিয়ে আর্তনাদ ক'রে ওঠে : "Shall I at least set my lands in order?" এই সংশয়দীর্ণ উচ্চারণ ধ্রুবপুত্রের মধ্যে আমরা পাই না।

পঠন শেষে আমরা নিঃসংশয় হই অমলধ্রুবকে অমৃতের পুত্রদের মধ্যে দেখতে পান যে ঔপন্যাসিক পাঠকচিত্তে তিনি অমর হয়ে রইবেন চিরদিন।।

0 comments:

1

বইঘর - গ্রন্থকীট

Posted in


বইঘর


বইয়ের খবর
গ্রন্থকীট



বইয়ের নাম : মহারাজকাহিনী - ইতিহাসের অন্য আলোয় শোভাবাজার রাজবাড়ি।
লেখক : চয়ন সমাদ্দার
গ্রন্থনির্মাণ : ঋতবাক
বিনিময়মূল্য : ২৫০ টাকা।


কলকাতার প্রথম মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুর আর তাঁর বংশের ইতিহাস বলে ‘মহারাজকাহিনী’।এই বই নিরপেক্ষ যুক্তিনিষ্ঠ দৃষ্টিতে দেখে এক সময়, আর তার সন্তান এক মানুষকে। বোঝার চেষ্টাকরে ইতিহাসের চলনকে। চ্যালেঞ্জ করে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বহু ধারণাকে। ‘মহারাজকাহিনী’ লেখক আর ইতিহাসের মধ্যে চলা এক সংলাপের নাম। এই বই বুঝতে চায় বহুদিন ধরে চলে আসা একটা মিথ কী কারণে সৃষ্টি হয়। বয়ানের উওরে প্রতিবায়ান রচনার চেষ্টা করে। যুক্তি সাজিয়ে ইতিহাসের ওপর অন্য আলো ফেলে ‘কলকাতা কালচার’-এর অন্যতম আঁতুরঘর শোভাবাজার রাজবাড়িকে নতুন চোখে দেখতে চায়। 



বইয়ের নাম : শোভাবাজার রাজবাড়ির রান্নাবান্না
লেখক : নন্দিনী দেব বউরাণী, আলাপচারিতায় সুস্মিতা বসু সিং
গ্রন্থনির্মাণ : ঋতবাক
বিনিময়মূল্য : ১৫০ টাকা


এই বই এক কথোপকথন। কথা গড়িয়ে গেছে কথায়, আর তার থেকে উঠে এসেছে শোভাবাজার রাজপরিবারে প্রচলিত মোট পঁয়তাল্লিশটি রান্নার রন্ধনপ্রণালী। এ বই নিছক এক রান্নার বই নয়। এইআলাপচারিতার মধ্য দিয়ে দেখা দেয় সময়ের জলছবি, অনেক নাম না জানা রন্ধনশিল্পীর হাতের ছাপ। পাওয়া যায়,হেঁশেলের অন্তরঙ্গ স্বাদ-গন্ধ। এই বই বহু ভিন্ন স্বরের সংলাপ। ক্ষমতার বিন্যাসের স্বর, বাঙালি কৃষ্টি-সংস্কৃতির কন্ঠ, বহু মেয়ে-বউয়ের নিজেকে প্রকাশ করতে চাওয়ার চেষ্টার ধ্বনি। 



বইয়ের নাম : অবলোকন ১
লেখক : চয়ন
গ্রন্থনির্মাণ : ঋতবাক
বিনিময়মূল্য : ১৬৫ টাকা।


‘অবলোকন ১’ বারোটি গল্পের সংকলন। ইতিহাস আর ফ্যানটাসির মিলন ঘটেছে কাহিনীগুলিতে।অবলোকন কালপথিক, সে ইতিহাসের প্রহরী। পথভোলা ইতিহাসকে সঠিক পথের দিশা দেখায় সে।শেক্সপীয়ার, বিবেবাকনন্দ, রামপ্রসাদ, থেকে কলকাতার প্রথম সিরিয়াল কিলার ত্রৈলোক্য পর্যন্ত সবারজীবনেই ছায়া ফেলে দাঁড়ায় অবলোকন। এই বইয়ের এক ডজন গল্পে মহাভারতের কাল থেকে উনিশশতকের আটের দশক অবধি ঘোরাফেরা অবলোকনের। এই গল্প গুলো ইতিহাসের সম্ভাবনা, ব্যক্তিমনের ইচ্ছেপূরণ, আর ইতিহাসের প্রতি ভীর প্রেম : এই সব কিছু দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে।



বইয়ের নাম : কালাপানি
লেখক : সরিৎ চট্টোপাধ্যায়
গ্রন্থনির্মাণ : ঋতবাক
বিনিময়মূল্য : ২০০ টাকা


‘কালাপানি’ মানুষের সম্পর্কের ওঠাপড়া নিয়ে লেখা উপন্যাস। এই বইয়ে কালাপানি আন্দামাননিকোবর দ্বীপপুঞ্জ বুকে ধরে রাখা সমুদ্রও বটে আবার মানবসম্পর্কের মাঝে বিছিয়ে থাকা অথই অপার সমুদ্রের প্রতিরূপও বটে। নির্জন দ্বীপের মতো নিঃসঙ্গ এক একজন মানুষের মধ্যে বিস্তৃতঅগাধ সাগরের নাম কালাপানি। এই উপন্যাসে লেখক এই জলধি পেরিয়ে পরিযায়ী প্রেমের ঘরপাওয়ার গল্প বলেছেন। দুটি প্রেমের গল্প আছে এই বইয়ে। প্রথমটিতে প্রেম আর ক্ষমতা এক সঙ্গে মিশে ভালোবাসাকে পথভোলা করে। আর, দ্বিতীয়টিতে প্রেম, মনুষ্যত্ব এবং উজাড় করে দেওয়ার কাহিনী। দুইয়ে মিলে সার্থক প্রণয়। মানুষের মানব হয়ে ওঠা। 

1 comments:

4

স্মৃতির সরণী - বিভাস রায় চৌধুরী

Posted in


স্মৃতির সরণী


অগ্নি বাণ
বিভাস রায় চৌধুরী 



সন্ধ্যে নাগাদ ব্যারাকপুরের পরিত্যক্ত রানওয়ের এক কোণে চুপচাপ আমাদের হেলিকপ্টারপার্ক করে দিয়ে আমরা যে যার মেস এ চলে গেলাম। ক্যাপ্টেন শুধু জানিয়ে দিলেন পরদিন ভোর চারটেতে রিপোর্টিং। সেই সাত সকালে আমরা কুম্ভীগ্রাম এয়ার ফোর্স ইউনিট (শিলচর এয়ারপোর্ট) থেকে উড়ে, শিলং, গৌহাটি, বাগডোগড়া (শিলিগুড়ি) হয়ে ব্যারাকপুর পৌঁছতে সূর্য্য ডুবে গেল। অন্ধকারে একটা শক্তিমান ট্রাক আমাদের পাঁচজনকে টিমটিমে আলো আঁধারী মেসের সামনে নামিয়ে দিয়ে ড্রাইভার বলে গেল কাল ভোরে ও নিজেই এসে এখান থেকেই পিক আপ করে নিয়ে যাবে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সিনেমার মতো এয়ার ফোর্স স্টেশন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ফলে এই সেক্টরে আমাদের আর্মি, এয়ার ফোর্স একটু বেশি রকমের শান্ত।

পরদিন ভোরবেলা এসে হেলিকপ্টার রেডি করে টেক অফ করতে পূর্ব আকাশে লালি ধরে গেল। পশ্চিম দিগন্তের রেখা তবুও কালচে।

ব্যারাকপুর থেকে সোজা গঙ্গার উপড় দিয়ে উড়ে এসে, হাওড়া ব্রিজের কাছে বাঁয়ে পাক খেয়ে ইডেনের লাইট পোস্টের কান ঘেঁষে ল্যান্ড করলো রেস কোর্সে। হাওড়া ব্রীজ আসলে ‘নো ফ্লাইং জোন’। আকাশ থেকে সেই প্রথম হাওড়া ব্রীজ, ইডেন, ধর্মতলা দেখা। একটা তিরিশ মিটার এলাকা ঘাস কেটে হেলিপ্যাড বানানো। স্মোক জেনারেটর জ্বলছে। সেদিন সাত সকালে রেস কোর্সে কোনও ঘোড়া ঢুকতে পারেনি। এক কোণে একটা অলিভ গ্রীন জিপসি আর কয়েকজন আর্মি অফিসার দাঁড়িয়ে। হেলিকপ্টার ল্যান্ড করতেই পাইলট ইঞ্জিন বন্ধ না করে, আমাদের একজনকে ইশারা’তে বললেন নীচে গিয়ে দাঁড়াতে। 

শীতের সকালে হেলিকপ্টারের ব্লেডের হাওয়া কানের পাস দিয়ে গুলির মতো ঘষে গেল। একটা পাতলা স্যুট কম্বিনেশন গায়ে। 

মিনিট দুয়েকের মধ্যে আরেকটা জিপসি এসে একদম ঘুরন্ত টেল ব্লেডের কাছে থামল। হেলিকপ্টারের পেছনে যে পাখা থাকে, ভীষণ জোরে ঘোরে বলে অনেকের চোখে পরে না। হাত দিয়ে ড্রাইভারকে ইশারা করে পেছতে বললাম। চারজন সায়েন্টিস্ট নামলেন। হাতে একটা করে নোট প্যাড আর একজনের কাছে একটা এস এল আর ক্যামেরা। 

পৌনে ঘন্টা পরে আমরা সমুদ্রের ধারে একটা কংক্রিটের হেলিপ্যাডে নামলাম। ডিফেন্স সিকিউরিটি কোর এর গার্ড জানালো জায়গাটার নাম চাঁদিপুর। দূরে কতগুলো গ্রাম দেখা যাচ্ছে। আর বাকিটা DRDO র বাউন্ডারী। 

কিছুদিন আগেই এখান থেকে অগ্নি মিসাইলের টেস্ট লঞ্চ হয়েছিল। সেই টেস্ট নিয়ে হৈ চৈ কম হয়নি। তবে প্রথম টেস্টের মিসাইল ছিল হাজার কিমি রেঞ্জের, সাথে হাজার কেজির নিউক্লিয়ার বোম নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা। তখনই বলা হয়েছিল, এর পরের টার্গেট দুই হাজার কিমি দূরত্বে মারতে পারে এমন মিসাইল বানানো। সাথে মাথায় লাগানো থাকবে হাজার কেজির নিউক্লিয়ার বোম। 

চারিদিকে বেশ সাজ সাজ রব। DRDO থেকে একজন অফিসার এসে ঐ চারজনকে নিয়ে গেলেন। একটা গাড়ী আমাদের নিয়ে পৌঁছে দিল ওদের ক্যান্টিনে। সমুদ্রের ধারে মেস। সামনে ধুধু বালির সমুদ্র সৈকত, জল তখন প্রায় দুই কিমি দূরে। সকাল থেকে এক কাপ গরম জলও জোটেনি, চা তো স্বপ্ন। ক্যান্টিনে গরম গরম পুরী আর আলুর তরকারী, সঙ্গে এক গ্লাস করে চা। আহা!

দুপুর দশটা নাগাদ আবার ‘টেক অফ’, মিনিট দুয়েকের মধ্যে নীচে শুধু জল আর জল। তার মধ্যে প্রচুর কচ্ছপ ভেসে আছে। এগুলো সব অলিভ রিডলে, সামুদ্রিক কচ্ছপ। এই কচ্ছপেরা প্রতি বছর অস্ট্রেলিয়া থেকে ওড়িশা’তে দলে দলে ডিম পাড়তে আসে। সেক্সুয়ালি ডিমরফিক এই কচ্ছপের পুরুষ প্রজাতির ওজন প্রায় ৪০ কেজি, আর মহিলাদের ওজন ৩৫ কেজির কাছাকাছি। মেক্সিকো আর কোস্টারিকাতেও ডিম পাড়তে যায়, কিন্তু এই অলিভ রিডলের ডিম পাড়া উৎসব ওড়িশা’র গাহিরমাথা এলাকাতেই সব চেয়ে বেশি। 

হেলিকপ্টার যখন খুব নীচু দিয়ে ফ্লাই করে, মানে ১০০ বা ২০০ মিটারের উচ্চতায়, সেই উড়ন্ত হেলি থেকে সমুদ্রের নীল জল আর তার মধ্যে জলজ উদ্ভিদ বা এই সব কচ্ছপের ভেসে থাকা দেখতে দেখতে মনেই থাকেনা সময় কোথা দিয়ে চলে গেল। 

একটা আইল্যান্ড দেখা যাচ্ছে। এর নাম তখন ছিল হুইলার্স আইল্যান্ড। আপাত দৃষ্টিতে এই আইল্যান্ড, অলিভ রিডলের ব্রিডিং গ্রাউন্ড বা প্রজনন ক্ষেত্র। আসলে এই দ্বীপকেই সেই সময় তৈরি করা হচ্ছিল ইন্ডিয়ার মিসাইল টেস্ট লঞ্চ প্যাড হিসেবে। ওড়িশা সরকার ১৯৯৩ সালে এই দ্বীপ Defence Research and Development Organisation (DRDO) দিয়ে দেয়। 

আইল্যান্ডে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম। রিডলে ছাড়াও দেখতে পেলাম অসংখ্য লাল কাঁকড়া। আর কি কি দেখলাম সেগুলো লেখা যাবেনা। তবে বুঝলাম কিছু একটা হতে চলেছে।

সেবারের মতো বিকেলে সেই চার মূর্তীকে দমদম এয়ার পোর্টে নামিয়ে পরদিন কুম্ভীগ্রামে ফিরে এলাম। 

ওদিকে দেশের পশ্চিম সীমান্তে তখন অন্য কিছু চলছিল। ৫৮ নং ইঞ্জিনিয়ার রেজিমেন্টের এক দল সেনা তখন ব্যাস্ত মরুভূমিতে কিছু করতে। কিভাবে করতে হবে জানে, কিন্তু কেন করছে জানেনা। এক জন দু’জন করে নতুন লোক আসেন। আর্মির ড্রেস পরেই আসেন, কিন্তু হাঁটা চলা দেখেই সন্দেহ হয়। 

খাবার আসে প্যাকেটে। জল আসে প্লাস্টিকের পাউচে। খাওয়া হয়ে গেলে কিছু ফেলে রাখলে হবে না। সব প্যাকেট বানিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিতে হবে। এক জায়গার কাজ শেষ হলে সরে এসে অন্যত্র আবার সেই ভাবেই কাজ চলে। কাজ হয়ে গেলে তাঁবু ওঠাও আর চলো অন্য সাইটে। 

আমরা ফিরে আসতেই, আবার একটা হেলিকপ্টার আরেক দিন চাঁদিপুর গেল। ফিরে এল দিন তিনেক বাদে। আবার একদিন গেল, ফিরেও এলো। শীত কমে গেল। বেশ কয়েক বার চাঁদিপুর ট্রিপ মেরে আমরা এটাকে প্রায় জল ভাত ভেবে নিয়েছি।

এর মধ্যেই একদিন আবার আমার টার্ন এলো চাঁদিপুরের। তবে এবারে অন্য রুটে। কলকাতা বাই পাস করে সোজা কলাইকুন্ডা। সেখান থেকে ভুবনেশ্বর। পুরনো এয়ারপোর্টের একটা হ্যাঙ্গারে হেলিকপ্টার রেখে আমাদের আস্তানা DRDO র গেস্ট হাউস। পরদিন সকালে দেখি গেস্ট হাউসে একটু বেশি রকমের চাপা উত্তেজনা। 

সকালে এয়ারপোর্টে গিয়ে সব কিছু রেডি করতে করতে, সিডিউল টাইমের আগেই কনভয় এসে গেল। খান তিনেক গাড়ী। যাত্রী দু’জন। একজন প্রধান মন্ত্রীর সাইন্টিফিক অ্যাডভাইজার, অন্যজন তার সাগরেদ। সোজা হুইলার্স আইল্যান্ড। গ্রীষ্মের প্রখর রোদে, হেলিপ্যাড তেতে আছে। সেখানেই হেলিকপ্টারের নীচে দাঁড়িয়ে একটা ডাবের জল খেলেন অ্যাডভাইজার সাহেব। একটা চার্ট পেপার সাইজের সার্কিট ডায়াগ্রাম নিয়ে সেখানেই মিনিট দশেকের মিটিং করে তারপর গেলেন লঞ্চ প্যাডের কাছে। সেখানেও প্রচুর ভিড়। মানুষের থেকেও বেশি যন্ত্রপাতি। আর তার প্যাকিং কেস। একটা কুড়ি মিটার লম্বা অগ্নি-২, মিসাইল, ঘাড় কাত করে শুয়ে আছে। দুই হাজার কিমি দূরত্বে অ্যাটম বোমা মারতে পারার মতো মিসাইল তখন আমাদের হাতে ছিল না। সবার মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা। 

গরম বাড়ছে, ১৯৯৮ সালের ১১ মে মাস। সন্ধ্যেবেলা আসামের জঙ্গল আর চা বাগান ঘেরা সেই ইউনিট থেকে ফিরে টায়ার্ড শরীর ঠাণ্ডা মেঝেতে এলিয়ে দিয়ে টিভি খুলতেই শুনলাম পোখরানে অপারেশন শক্তি সাকসেসফুল। ভারত, দ্বিতীয়বার পারমাণবিক পরীক্ষা সফল ভাবে করে ফেলেছে। প্রায় ৪৫ কিলো টন ‘টি এন টি’র বিস্ফোট, আর সেটা করেছে সবার অজান্তে। পাকিস্তানী গুপ্তচর আর আমেরিকান স্যাটেলাইটকে ধোঁকা দিতে অগ্নি -২ এর টেস্ট প্রিপারেশনের জন্য আমাদের গত চার পাঁচ মাস ধরে চাঁদিপুর আর হুইলার্স আইল্যান্ডে চক্কর কেটেছি। যাতে আমেরিকান স্যাটেলাইটের চোখ ভারতের পূর্ব প্রান্তে ফোকাস হয়ে থাকে। সেই সুযোগে পোখরানে আর্মির ছত্রছায়ায় আমাদের নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্ট এর দল সমস্ত প্রস্তুতি ঠিক ভাবে করে ফেলতে পেরেছিলেন। কারোর সন্দেহ হয়নি। 

আর হ্যাঁ, ঐ প্রাইম মিনিস্টারের অ্যাডভাইজার ছিলেন, মিসাইল ম্যান, কালাম সাহেব। পরে রাষ্ট্রপতি হলে, তখনও একবার সুযোগ হয়েছিল ওঁকে নিয়ে এক দুর্গম পাহাড়ে যাওয়ার। সে গল্প অন্য কোথাও শোনাবো। আর ওই হুইলার্স আইল্যান্ডের নাম পালটে দেওয়া হয়েছে। কালাম আইল্যান্ড। 



রাম চন্দ্রের সেতু বানাতে কাঠবেড়ালি’র একটা ছোট্ট রোল ছিল। পুণ্যভূমি পোখরানে আমেরিকান সি আই এ আর পাকিস্তানী আই এস আই ইন্টেলিজেন্সিকে ধোঁকা দিতে আমরা দেশের পূর্ব প্রান্তে সেই রোলটাই প্লে করেছিলাম।

4 comments: