প্রবন্ধ - শবনম দত্ত
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
শবনম দত্ত
২
আইলে মল্টের সাথে পারিবারিক প্রেমটা সবে জমে উঠছে সেই মার্কেটে, ইয়োরোপ থেকে ফেরার পথে, ডিউটি-ফ্রিতে দেখি প্রায় ২০% ডিসকাউন্টে ওবান ১৪ বছর পাওয়া যাচ্ছে। দেখেই বরকে ফোন লাগালাম। সে সটান উত্তর দিল, "নেকি, অউর পুছ পুছ!"। সুতরাং ওবানকে কোলে নিয়ে বেরোলাম। বেরিয়ে বরের মুখের হাসি দেখে, প্রচণ্ড সন্দেহ হলো যে দুদিন পরে আমায় দেখে বেশী খুশী, না কি ওবানকে দেখে বেশী খুশী। তা সেই উইকেন্ডেই ওবান দেবতার আরাধনায় বসা গেল। এখানে আরেকটা কথা বলা খুব জরুরী। সেই সময়ই আমরা খুবই মহার্ঘ্য চারটি টাম্বলার গ্লাস কিনেছিলাম। সেগুলোরও উদ্বোধন করা হলো। মহার্ঘ্য মানে আমাদের কাছে মহার্ঘ্য আর কি। আমরা বেসিকালি যাযাবর - জল খাই বোতল থেকে, জুস খাই প্লাস্টিক গ্লাসে। সেই আমরা, ভারতীয় টাকায় প্রায় আড়াই হাজার টাকা দিয়ে, চারটে টাম্বলার কিনে ফেলেছিলাম। দাদারা, দিদিরা, হাসবেন না, মোট্টে হাসবেন না। প্রেমে পড়লে মানুষ কত কি করে? এ আর এমন কি?
তা ওবান গ্লাসে ঢেলে একটু চমকালাম। কেমন যেন সর্ষের তেলের রং। গ্লাসটা নেড়ে দেখি সর্ষের তেলের মতই চলন। তখন নতুন নতুন কাস্কের ফান্ডা শিখছি। বার্বন তৈরী হয়েছিল যে কাস্কে, সেই কাস্ক স্কচ ম্যাচিয়োর করতে ইউজ করলে স্কচের রং হাল্কা হয়। আর এক্স শেরি কাস্ক ইউজ হলে স্কচের রং হয় গাঢ় (পাকা রং আর কি)। দৃঢ়বিশ্বাস জন্মাল ওবান নির্ঘাত শেরি কাস্কে ম্যাচিয়োর করা মাল। বেশ কিছুদিন পরে জেনে ছিলাম যে ওবানের গাড়রংয়ের রাz হলো পাতি ক্যারামেল। আরও বুঝেছিলাম শুধু রং দেখে কাস্ক আন্দাজ করার চেষ্টা হলো অল্পবিদ্যাভয়ংকরীর টিপিকাল লক্ষণ। আসলে ওবান মোটেই এক্স শেরি কাস্কে ম্যাচিয়োর করানো হয় না। আগে হুইস্কি ম্যাচিয়োর করেছে যে কাস্কে, সেই কাস্কই ওবান ম্যাচিয়োর করতে আবার ব্যবহার হয়। সেই দোজবরে কাস্ক সব রং আগের হুইস্কিকে দিয়ে অলরেডি প্রায় নিঃস্ব। ফলে ওবানের ভাগে প্রায় কিছুই জোটে না। অগত্যা ক্যারামেল। আমার অবশ্য একটা গুপ্ত ইচ্ছে আছে এ ব্যাপারে। ওবান ডিস্টিলারিতে একবার "রং দে তু মোহে গেরুয়া" বাজিয়ে দেখতে চাই ওবান রঙীন হয় কিনা। বলা যায় না, হয়তো আর ক্যারামেল মেশাতেই হলো না?
ক্যারামেলের কথা যখন উঠলোই, একটু খোলসা করে বলা যাক। আমার ধারনা ছিল ক্যারামেল জিনিষটা ব্রাউন এবং মিষ্টি। মনে সন্দেহ হলো যে স্কচে এমন একটা জিনিষ মেশানো হলে তো তার স্বাদ, গন্ধ সব বদলে যাবে। স্কচরসিকরা কি সেটা মেনে নেবেন? আবার রিসার্চ। দেখা গেল E150a বলে একটি ক্যারামেল হয় যেটা স্কচে মেশালে শুধু রংটুকুই বদলায়। স্বাদ বা গন্ধ বদলায় না। স্কচরসিকরা সেটুকু মেনে নিয়েছেন। তাও সব স্কচে E150a মেশানো হয় না। বার্বন বা রাই হুইস্কির ক্ষেত্রে আরো অন্যরকম কি সব ফান্ডা আছে। হঠাৎ মনে হল, আচ্ছা দেশে যে হুইস্কি পাওয়া যায় তাতে কি ক্যারামেল থাকে? খুঁজতে গিয়ে পুরো এক গাল মাছি হয়ে গেল। আমাগো দ্যাশে হুইস্কিতে ক্যারামেল থাকে কিনা সে প্রশ্নটাই অবান্তর, কেন কি সে হুইস্কিতে হুইস্কিই প্রায় থাকে না। যাকে বলে কেস পুরো জন্ডিস! হুইস্কি হলো অ্যালকোহলিক বেভারেজ যা গ্রেন থেকে তৈরী হয়। আর আমাদের দেশে, বেশীর ভাগ হুইস্কি মোলাসেস থেকে তৈরী অ্যালকোহলের সাথে নাম মাত্র পরিমাণে হুইস্কি মিশিয়ে তাতে রং, স্বাদ, গন্ধ অ্যাডকরে বিক্রি হয়। মোলাসেস হলো গিয়ে আখ থেকে চিনি তৈরীর সময় সাইড এফেক্ট হিসেবে তৈরী হওয়া ডার্ক ব্রাউনঘন লিকুইড বস্তু একটি। এটা থেকেই রাম তৈরী হয়। আরও একটু গভীরে গিয়ে দেখা গেল, রয়াল চ্যালেঞ্জে নাকি ১২% হুইস্কি আর বাকিটা মোলাসেস থেকে তৈরী নিউট্রাল স্পিরিট। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল অ্যান্টিকুইটি ব্লু কিন্তু রাম নয়। ইন্ডিয়ান গ্রেন হুইস্কি, ইন্ডিয়ান মল্ট হুইস্কি আর স্কচ মল্ট হুইস্কির ব্লেন্ড। এর মধ্যে স্কচ মল্ট হুইস্কি কতটা, তা জিজ্ঞাসা করিয়া লজ্জা দিবেন না।
যাই হোক ওবানে ফেরা যাক। দর্শন শেষে স্বাদগ্রহণ। একটু জল মিশিয়ে সিপ নিয়ে দেখি বেশ ফল পাকড়ের গন্ধ, মিষ্টি মিষ্টি। ফিনিশ লঅঅম্বা। আর লাস্টে একটুকখানি নোনতা। খবরে প্রকাশ ওবান নাকি অল্প স্মোকিও। তা আমার আনাড়ি নাককে ধোঁয়া বিলকুল ফাঁকি দিল। পরের কয়েক মাসে ওবান ছাড়াও আরও কটা হাইল্যান্ড স্কচ খাওয়া হলো। গ্লেনমোরাঞ্জি (Glenmorangie), ডালহুইনি (Dalwhinnie) ইত্যাদি, প্রভৃতি। এরই মাঝে একদিন দেখি একটা আকাশ নীল রঙের প্যাকেট সুপারমার্কেটে স্কচের সারিতে। এঁকে তো আগে দেখি নাই? চশমা না পরামাইনাস পাওয়ারওলা চোখ দুটো প্রায় প্যাকেটে লাগিয়ে ফেলে দেখলাম এঁর নাম তালিস্কার স্কাই (Talisker Skye)। তালিস্কারের অন্য একটা প্যাকেট আগে দেখেছিলাম। সেটা প্রায় নেভি ব্লু রংয়ের ছিল। গুগল করতেই দেখলাম ইনি সেই বছরই জন্মলাভ করেছেন। তালিস্কার জায়গায় জায়গায় বলে বেড়াচ্ছে, "আনিলাম অপরিচিতের নাম ধরণীতে, পরিচিত স্কচেদের সরণীতে"। নিজেকে জনগনেশ কনসিডার করে, ইনি কৌতুক কিনা, তা পরীক্ষা করার গুরুদায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিয়ে ফেললাম। পরীক্ষায় বোঝা গেল উনি কৌতুক একেবারেই নন। বরং হাইলি ইন্টারেস্টিং যাকে বলে। শুরুতে একটা লেবু লেবু গন্ধ আর সাথে ধোঁয়ার গন্ধ। জিভে একটু মিষ্টি, আর একটু যেন নোনতা ভাবও আছে। যতক্ষণ জিভে থাকে ধোঁয়ার গন্ধ ভরপুর। ফিনিশটা মাঝারি। প্যাকেটের গায়ে কি লেখা আছে তা পড়তে গিয়ে মেগা হোঁচট খেলাম। স্কচটার বয়েসই লেখা নেই! যাহ্ বাবা। ইনি কি তবে মহিলা? আরও কিঞ্চিৎ গবেষণা করার পর রহস্য উদ্ধার হলো। তালিস্কার এবং আরও ক'টা ডিস্টিলারি কিছু কিছু স্কচের বয়েস লেখে না। সুতরাং ধরে নিতে হবে যে, এই স্কচের বয়েস তিন বছরের উর্দ্ধে (পুরা ভাড়া মানে পুরো দাম অবশ্যই লাগে)। কিন্তু তিন কেন? দুই বা চার কেন নয়? আসলে স্কচ অন্তত তিন বছর ম্যাচিয়োর করতে হয়। আর যে কোনও হুইস্কিতেই সবচেয়ে নবীন যে হুইস্কিটা ব্লেন্ড করা হয় সেটাই হুইস্কিটার বয়েস হয় (আহা এমন সুবিধা যদি মানুষের থাকত! ভাবুন খালি। হাঁটু বদলে আনলেন আর আপনি শিশুটি হয়ে গেলেন!)। পাঠক মনে রাখবেন, সিঙ্গল মল্ট স্কচ মানে যে স্কচ হুইস্কিতে একটিমাত্র ডিস্টিলারিতে তৈরী স্কচ থাকে। কাজেই একটি ডিস্টিলারিতে তৈরী হওয়া ৩ বছর ও তার চেয়ে বেশীবয়সের মাল্টিপল স্কচ মিক্স করলেই সিঙ্গল মল্ট স্কচ রেডি। তার বয়েস ৩ বা তার বেশী।
ততদিনে ক্রিসমাস প্রায় দোরগোড়ায়। এ দেশে ক্রিসমাস আমাদের দুর্গাপুজো। জামাকাপড়, জুতো ছাড়ুন, ইয়ারবাড আর মোমবাতিতেও ছুট দেয়। বেশ কিছু স্কচেও ভাল মতন ছুট দিচ্ছে দেখা গেল। আর এখানে দাম বাড়িয়ে ছুট দেবার প্রহসনটা নেই। ছুট মানে সত্যিই ছুট। সুতরাং ব্যাকপ্যাক বোঝাই করে ল্যাফ্রয়েগ সিলেক্ট, কুল্যাইলা ১২, লাগাভুলিন ১৬ ইত্যাদি ইত্যাদি কেনা হলো। ভাবছেন তো কেন সবগুলো আইলে মল্ট কিনলাম? এ দেশে স্কচপ্রেমীরা সাধারণত দু'তিন রকম স্কচ পর পর খেয়ে তারপরে মতামত দেন। আমাদেরও তেমনই ইচ্ছা ছিল প্রাণে। পরপর নাহোক, ছুটির দু সপ্তাহে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খাব বলে আনা। এইবারে খেয়াল করে দেখলাম ল্যাফ্রয়েগ সিলেক্টেরও বয়স লেখা নেই। পড়ে দেখলাম ইনি যেসব স্কচ মিশিয়ে তৈরী হয়েছেন তারা কেউ এক্স শেরি কাস্কে বড় হয়েছেন, কেউ অ্যামেরিকান ওক ব্যারেলে বড় (বুড়ো?) হয়েছেন, কেউ বা আরও অন্যকিছুতে। ভাল কথা, সে যাত্রায় হুইস্কিস্টোনও কেনা হলো।
হুইস্কি স্টোন বস্তুটা কি সেটা একটু খোলসা করে বলা যাক। হুইস্কি স্টোন হলো লুডোর ছক্কার থেকে একটু বড় আকারের স্টোন। কয়েক ঘন্টা ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখলে, বার করার পরে অনেকক্ষণ ঠাণ্ডা থাকে। এই স্টোনগুলো হুইস্কিতে দিয়ে খেলে হুইস্কি ঠাণ্ডা থাকে। স্কচ অন দ্য রক্স ইন রিয়েল সেন্স আর কি। সিঙ্গল মল্ট বরফ দিয়ে খাবার কথা বললে, স্কটল্যান্ডের খানদানী দোকানীরা আপনাকে স্কচ বেচতে সেরেফ ইনকার করে দিতে পারে। স্কচ খাবার কায়দা হলো অল্প পরিমাণে সামান্য ঠাণ্ডা জল মিশিয়ে অথবা তাও না মিশিয়ে। ঠাণ্ডায় ভদ্রলোকেরা খুবই জুবুথুবু হয়ে পড়েন । গন্ধ টন্ধ কিছুই রিলিজ করেন না। বরফ মিশিয়ে খাবার আরও একটা মেজর সাইড এফেক্ট হলো যে অত ঠাণ্ডায় জিভের টেস্ট বাডগুলো নাম্ব হয়ে যায় অনেকটাই। ফলে স্কচের এত রকমের টেস্টিং নোটস অধরামাধুরী হয়েই থেকে যায়। তাই বরফ নৈব নৈব চ। কিন্তু হাতে গ্লাস ধরে রাখলে তো হাতের গরমেই গ্লাস গরম হবে আর সেই থেকে হুইস্কি গরম হয়ে যাবে। অগত্যা হুইস্কি স্টোনই মুশকিল আসান উড়ে মালী।
হুইস্কি ঠাণ্ডা রাখা নিয়ে এত চর্চার পরে কি হুইস্কির গ্লাসের কথা না এসে পারে? হুইস্কির গ্লাসের ব্যাপারটা কিন্তু ফর আ চেঞ্জ জলবৎ তরলং, হুইস্কিবৎ কমপ্লেক্সং নয়। মোটের উপরে দু' রকম গ্লাসে হুইস্কি খাবার চল। টাম্বলার আর গ্লেনকেয়ার্ন। টাম্বলার হলো থিক বটম, বেঁটে গ্লাসগুলো। এগুলোর সুবিধা হলো সহজে উল্টায় না, আর যদি কোননভিস অথবা অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী আত্মা হুইস্কিতে কিছু মেশাতে চান তিনি সহজে মেশাতে পারেন গ্লাসের মুখটা বড় বলে। অন্যদিকে গ্লেনকেয়ার্ন গ্লাস হলো অনেকটা লেজ কাটা ওয়াইন গ্লাসের মতন। মানে বেসিকালি গ্লাসের নিচের ডাণ্ডাটা খুব ছোট। এতে সুবিধা সেই একই - উল্টাবার চান্স কম। মানে আপনি যাতে উল্টান তার পাকা ব্যবস্থা আর কি! ওই দেখুন কথায় কথায় সেই পেঁচো মাতালটা আবার উঁকি মারতে লেগেছে। হুইস্কি কি আর উল্টাবার জন্য খায় কেউ? হুইস্কি খায় মনটাকে এক জায়গায় জড় করতে। তা হচ্ছিল গ্লেনকেয়ার্ন গ্লাসের কথা। এ গ্লাস ধরার সময় হুইস্কি যে পার্টে আছে গ্লাসের, গ্লাসের সেই পার্টটাই ধরতে হয়। কাজেই হাতের গরমে হুইস্কি একটু গরম হয়। ইভাপোরেট করে। এটা হলো ঘ্রানেণ অর্ধভোজনং করার যোগাড়। ইভাপোরেট করার ফলে তৈরী ভেপারগুলো গ্লাসের সরু মুখটা দিয়ে পালাবার জন্য আকুলিবিকুলি করে কিন্তু পথ পায় না (অনেকটা বিশেষ বিশেষ শহরের বিশ্বখ্যাত ট্র্যাফিক জ্যামে ফেঁসে যাওয়া বাইকচালকের মতো)। হুইস্কি রসিকরা সেই অবস্থারই সুবিধা নিয়ে, গ্লাসের মুখের কাছে নাক নিয়ে গিয়ে - গন্ধের সুনামি উপভোগ করে।
যাই হোক আবার ক্রিসমাস মার্কেটে ফিরি। এইখানে আরও কিছু হুইস্কির দেখা পেয়েছিলাম যার প্যাকেটের গায়ে দুর্বোধ্য ভাষায় কিসব লেখা। দেখে মনে পড়ল আরে এমন অক্ষর তো চায়না টাউনে দেখেছি। চীনা হুইস্কিও বেরিয়ে গেছে? তারপরে মনে পড়ল আরে এটা তো কোলকাতা নয়, লন্ডন! সাহস করে একটা প্যাকেট তুলে ইংরেজীতে কিছু লেখা আছে কিনা খুঁজতে লাগলাম। মিনিট তিনেকের চেষ্টায় বুঝলাম এঁকে চীনে বলে চিনে ভুল করেছিলাম। ইনি জাপানী। আরও বেকুব হয়ে ভাবছি, "সা রে গা মা পা ধা নি/বোম ফেলেছে জাপানী" গাইবো কিনা, স্টোরের একজন এসে বললেন, "দিস ইজ জাপানীজ হুইস্কি। ইট ইজ ব্রিলিয়ান্ট। ইফ ইউ হ্যাভ নট ট্রায়েড দিস অলরেডি, ইউ শুড গিভ ইট আ ট্রাই"। না দাদারা/দিদিরা আমরা মোট্টে ট্রাই দিই নাই। খালি পরে রিসার্চ করে দেখেছিলাম জাপানী হুইস্কি একদম ট্র্যাডিশনাল স্কচ বানানোর প্রসেস ফলো করেই বানানো হয়। এমনকি ওরা ওস্কটিশদের মতন whisky লেখে। অ্যামেরিকান বা আইরিশদের মতন whiskey লেখে না। খালি একটা জিনিস দেখলাম অনেক জায়গতেই বলেছে যে কিছু জাপানী হুইস্কি কফে (Coffey) স্টিলে ডিস্টিল করা হয়।
কফে স্টিল নিয়ে রিসার্চের আগে আমরা কি রকম স্টিল, কি ডিস্টিলেশন নিজেরা দেখেছি সে গপ্পোটা করেনিই, কেমন? স্কটল্যান্ডের ডিস্টিলারি ট্যুরে যে ডিস্টিলেশনের বন্দোবস্ত আমাদের দেখায় সেগুলোতে সব জায়গায় থাকে পট স্টিল। অ্যাস্টোরিক্সের গল্পে গেটাফিক্স (এটাসেটামিক্স) যে বড় হাঁড়ি টাইপ জিনিসে ম্যাজিক পোশন বানায়, সেটার মাথায় একটা লম্বা পাইপ জুড়ে দিলেই পট স্টিল রেডি। এই স্টিলগুলো কপারে তৈরী। কেন শুধু কপার দিয়েই বানায়, স্টীল বা অন্য কিছু দিয়ে নয়, তার সদুত্তর উইকিও দেয় নাই, ডিস্টিলারির লোকেরাও দেয় নাই। তাই এও হলো "ধরা সে যে দেয় নাই" ব্র্যাকেটে পড়া আরও একটি স্কচ রহস্য। তবে বলা হয় যে স্টিলের কপারের টাচে এসে ওয়াশের মধ্যে থেকে বেরোনো সালফার বেসড কম্পাউন্ডগুলো নিউট্রালাইজড হয়ে যায়। সত্য মিথ্যা জানে শ্যামলাল! বেশির ভাগ ডিস্টিলারিতে দু' রকমের স্টিল থাকে। ওয়াশ স্টিল আর স্পিরিট স্টিল। ইস্ট যখন ফারমেন্ট করে ম্যাশের সুগারকে অ্যালকোহলে কনভার্ট করে তখন তৈরী হয় ওয়াশ। এতে অ্যালকোহল থাকে 10-20%। এই ওয়াশকে ওয়াশ স্টিলে গরম করা হয়। ওয়াশ স্টিলের পুরাকালে গরম করা হতো ডাইরেক্ট ফ্লেমে, মানে সরাসরি পেছনে আগুন দিয়ে আর কি। কিন্তু এখন মানুষ সভ্য হয়েছে। কোনও কিছুই সোজাসুজি করে না। তাই এখন স্টিলের নীচে হট স্টিম দেওয়া হয়। কিন্তু গোটা কয়েক ডিস্টিলারিতে, যেমন গ্লেনফিডিচ, ম্যাকানান এগুলোতে, এখনও স্টিলের পেছনে সরাসরি আগুন দেবার প্রথা রয়েছে। এই ডিস্টিলারির মালিকের বাড়ির লোকজন খুব সরলমনা কিনা সে বিষয়ে আমি কোনও গ্যারান্টি দিচ্ছি না কিন্তু। যাই হোক, গরমে যখন ওয়াশ ফুটতে আরম্ভ করে, ওয়াশের মধ্যে থাকা অ্যালকোহল আর বাকি যেসব জিনিস জলের আগে ফোটে তারা জলদি জলদি ভেপোরাইজ করতে শুরু করে। এই ভেপার পাইপ বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করে। পাইপের শেষটা নীচের দিকে নামানো মতন হয়।সেই মুড়ো দিয়ে এই ভেপারটা বেরিয়ে আসে। এবার ভেপারটা আবার ঠাণ্ডা করে লিকুইড করা হয়। এই লিকুইডেরনাম লো ওয়াইন। এর সাথে ওয়াইনের কোন সম্পর্ক নেই যদিও। তাতে অবশ্য কি বা যায় আসে! গোলাপ আর গোলামজাম, আম আর আমতা, কে কার কি হয় শুনি? তা এই পাইপের হাইটের উপরে হুইস্কির স্বাদ গন্ধ অনেকটা ডিপেন্ড করে। যত উঁচু পাইপ তত বেশী জিনিস পিছনে ফেলে অ্যালকোহল উপরে উঠে যায়। অ্যালকোহল যে খুবই অ্যাম্বিশাস, তাতে কি আর সন্দেহ আছে? লাগাভুলিনের বেঁটে পাইপওলা পট স্টিলের জন্যই লাগাভুলিনের লোওয়াইন অনেক বেশী পিটি হয়। আবার গ্লেনমোরাঞ্জির লম্বা পাইপওলা পট স্টিল খুব কম জিনিসকেই লো ওয়াইনঅবধি যাবার পাসপোর্ট দেয়। তাই সে হুইস্কি খুবই মোলায়েম। লম্বা পাইপ ছাড়াও আরও কিছু ব্যবস্থা আছে যাতে অ্যালকোহল একাই উপরে যেতে পারে, যেমন ধরুন পাইপের শুরুটায় একটা টায়ারের মতন ফোলা অংশ যোগ করে দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই লো ওয়াইনকে নিয়ে আরও একটা স্টিলে আবার ডিস্টিল করা হয়। এই স্টিলের নাম স্পিরিট স্টিল। সাধারণত এই স্টিলটা ওয়াশ স্টিলের থেকে ছোট হয়। লো ওয়াইনে থাকে 20-30% অ্যালকোহল আর স্পিরিট স্টিল থেকে যে স্পিরিটটা বেরোয় তাতে থাকে 60-75% অ্যালকোহল। এইখানে স্টিলম্যানের কথাটা বলতে হবে। স্পিরিট স্টিল থেকে যখন অ্যালকোহলের ভেপার বেরোতে শুরু করে প্রথমে খুব বেশী অ্যালকোহল পার্সেন্টেজওলা ভেপারবেরোয়। এটাকে বলে হেড। তারপর আসে ওই 60-75% অ্যালকোহলওলা ভেপার। তাকে বলে হার্ট। আর শেষে আসে টেল। সামান্য অ্যালকোহল থাকে তাতে। স্টিলম্যানের কাজ হলো হেডটাকে ছেড়ে দিয়ে হার্টটাকে ধরা আর তাকে কাস্কের দিকে পাঠিয়ে দেওয়া। এরপরও কি বলতে হবে কেন কেবল সিংহহৃদয়ের মানুষরাই স্কচের কদর করতে পারেন? ভাল কথা, হেড আর টেলকে কিন্তু আবার ডিস্টিল করতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় লো ওয়াইন রিসিভারে। এইখানে বলে রাখা উচিত, আইরিশ হুইস্কি কিন্তু তিনবার ডিস্টিল করা হয়।
কফে স্টিলের কেসটা বেশ আলাদা। এখানে স্টিলটা জাস্ট একটা কলামের মতন আর মাঝে মাঝে হরাইজন্টাল প্লেট দেওয়া থাকে। গরম সেই নীচেই দেওয়া হয়, কিন্তু ওয়াশটা উপর থেকে ঢালা হয়। এবার ওয়াশ যত নীচেরদিকে নামছে তত বেশি গরম পাচ্ছে, তার মধ্যের অ্যালকোহল ভেপোরাইজ করছে। সেই অ্যালকোহল ভেপার আবার উপরে উঠে যাচ্ছে। উপরে আরেকটা পাইপ থাকে যেটা দিয়ে এই অ্যালকোহল ভেপারটা বেরিয়ে যায়। কি ভাবছেন? জীবনের পাঠশালা? আমিও ঠিক তাই ভেবেছিলাম। জীবনের তাতে সেঁকে, পুড়েই তো মানুষের মধ্যে থেকে সব ইমপিয়োরিটিগুলো বেরিয়ে যায়, মানুষ হয়ে ওঠে সৃস্টিকর্তার মনোমত! যাক্ গে যাক। গল্পে ফিরি। তা এই স্টিল থেকে যে অ্যালকোহল ভেপার বেরোয় সেটা কিন্তু চাইলে 95% বা তারও বেশি পিয়োর অ্যালকোহল হতে পারে। পট স্টিল থেকে কিন্তু এত পিয়োর অ্যালকোহল বেরোয় না। স্কচ পট স্টিলেই বানানো হলেও অন্যান্য হুইস্কিযেমন বার্বন, রাই, বেশ কিছু জাপানিজ হুইস্কি, ভদকা, জিন সব এই কফে স্টিলে বানানো হয়।
সেই ক্রিসমাসের ছুটি কেমন গেছিল, কি কি শিখিছিলাম, সে কথা লিখতে বসলে আরও একটা স্কচ-ভারত হয়ে যাবে। এরপর গত দু-আড়াই বছরে আরও অনেক সিঙ্গল মল্টের সাথে জানা শোনা হয়েছে, আরও কয়েকটা ডিস্টিলারি ট্যুরে গেছি, অ্যালকোহল নয়, স্কচের নেশায় বুঁদ হয়েছি। গেলিক ভাষায় (স্কটল্যান্ডের ভাষা) স্কচের নাম উষ্কা বেহ হা, যার মানে ওয়াটার অফ লাইফ। আজ অবধি যা প্রমাণ পাওয়া গেছে তাতে মনে হয় প্রথম স্কচ তৈরী হয়েছিল 1494 সালে। তারপর থেমস দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। মঙ্কদের হাত ধরে ক্রমশ স্কচ তৈরীতে পার্ফেকশন এসেছে, ট্যাক্সের চক্করে শ'য়ে শ'য়ে ডিস্টিলারি বন্ধ হয়ে গেছে, ফরাসি বিপ্লবের সুযোগ নিয়ে ব্র্যান্ডিকে ব্রাত্য করে জেন্টলম্যানস ড্রিংক হয়ে উঠেছে স্কচ। আজ দু'শোর বেশী দেশের মানুষ স্কচের ভক্ত। স্কচ রফতানি করে বছরে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার রোজগার করে ইউ কে।
কিন্তু এহ বাহ্য। আসলে স্কচ হলো মানুষের পার্ফেকশনিষ্ট হতে চাওয়ার আরেকটা গল্প। এক একটা স্কচের বোতলে যতটা অঙ্ক, ততটাই প্যাশন। স্কচের রহস্য ভেদ করতে হলে তার সাথে একান্ত হতে হয়, জনতার মাঝে তার রহস্য রহস্যই থেকে যায়। তাই বন্ধুদের সাথে আনন্দ করার জন্য তোলা থাক বীয়ার, টেকিলা, জি, দুনিয়া থেকে ছুটি নেবার জন্য থাক ভদকা কিম্বা রাম, আর একলার সাথে বাস করার জন্য থাক স্কচ।
0 comments: