0

ছোটগল্প - স্বর্ণেন্দু সাহা

Posted in


ছোটগল্প


সাইকেলটা পড়ে যাচ্ছে
স্বর্ণেন্দু সাহা




চাকা টলে উঠল। ভারসাম্য হারিয়ে লাগিয়ে রাখা স্ট্যান্ডের উলটো দিকে হেলে গেলাম। হেলে যাওয়া দিকে রয়েছে কাদামেশানো নোংরা জমা জল। পুরনো ফুটপাথের কিছুটা অংশ ভাঙা। সেই ভাঙা অগভীর গর্ত সুলভ জায়গায় এসে আশ্রয় নিয়েছে গতকালের বৃষ্টি। রাস্তার ময়লা আর পিচ ফেটে বেরোনো মাটি ধুইয়ে নিয়ে আসা বৃষ্টির জল এখানে হাজির হয়েছে। আমি এমন একটা পরিচয়হীন জলের মধ্যে পড়তে চলেছি। হ্যাঁ, নিশ্চিতভাবেই আমি পড়ে যাচ্ছি। কেমন লাগবে পড়তে? আসলে, আগে কোনওদিন পড়িনি। বিতস্তা খুব সাবধানে, যত্নে আমায় সামলে রাখে। শ্যেন দৃষ্টি রাখে আমার কলকব্জার সুস্থতার দিকে। দুই চাকার স্পোকস, জয়েন্টস নিয়ম মেনে তেল ঘষে পরিষ্কার করে। তৈরী হওয়ার চারবছর পরেও তাই আমি নতুনের মতো ঝকঝকে। গড়িয়ে চলার সময়ে কোনও পার্টস থেকে বয়সজনিত অক্ষমতার শব্দ বেরোয় না। আমার জেল্লা আর পারফরম্যান্স দেখে হালফ্যাশনের সাইকেলগুলো মুখ আড়াল করে।

মেয়েটা বড্ড আদরে রাখে আমাকে। কখনও পড়ে যেতে দেয়নি। অথচ, এখন পড়ে যাওয়া স্রেফ কয়েকটা মুহূর্তের অপেক্ষা। আমায় দাঁড় করিয়ে রেখে বিতস্তা ফুটপাথের অন্যদিকে বসা দোকানীর থেকে কী যেন কিনতে গেছে। ওকে দেখতে পাচ্ছি। ওর পিছন ঘোরা শরীরের অবয়বটা দেখতে দেখতে আমি পড়ে যাচ্ছি।



দ্যাখ্ লোকটার অবস্থা! কোথায় কী আছে খেয়াল নেই। হুড়ুমদুড়ুম করে নিজের জায়গায় পৌঁছতে পারলেই হলো। হাঁটছে দিগবিদিগজ্ঞানশূন্য হয়ে। দেখলও না যে, ওর দোলাতে থাকা হাতটা স্ট্যান্ড করিয়ে রাখা সাইকেলটায় ধাক্কা মারল! কোনও হেলদোল নেই। সোজা এগিয়ে যাচ্ছে।

অবশ্য বেভুল লোকজন পেলে অরিন্দমের সুবিধাই হয়। মুখ্য কাজ ছাড়া বাকি অন্যান্য ক্ষেত্রে এরা তালকানা। এই জাতীয় মানুষকে ঠকানো, পকেট মারা ইত্যাদি বেজায় সহজ। বিপদের অথবা ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় থাকে না। বিপদের সম্ভাবনার হিসেব কষে চাল ফেলতে হয় অরিন্দমকে, কারণ তার পেশাই লোকঠকানো। অন্যদের ঠকিয়ে উপার্জিত ধন সে ব্যবহার করে নিজের পেট ও জীবন চালায়।

মিনিট দশেক আগে লোকটাকে সে নিজের ‘শিকার’ হিসেবে টার্গেট করেছে। ঢোলাঢালা পাঞ্জাবী পরা। ঢোলা জিনস। থলথলে, ভোগী চেহারা। সাদা পাঞ্জাবীর তলা থেকে উপচে আসা মেদের স্তর আরামে থাকার পরিচয় দিচ্ছে। চাপানো আভিজাত্যের পরত চুলের কায়দায়, মুখের শেভ করা চামড়ায়। বাজার অভিযানে নাম লেখানো পথচলতি লোকেদের মধ্যে থেকে একে সে দক্ষ চোখে আলাদা করে বেছে নিয়েছিল। বেছে নেওয়ার নির্ভুলতার প্রমাণ পেশ করেছিল খানিক পরেই খাসির মাংসের দাম দেওয়ার উদ্দেশ্যে খুলে যাওয়া মানিব্যাগ। অরিন্দম দেখে নিয়েছিল, পচে ফুলে যাওয়া মোটা কোলাব্যাঙের আকৃতির মানিব্যাগের খোপে অবহেলায় রাখা গোছা গোছা লালচে নোট। দরকার না থাকা সত্বেও কিছু বড়লোক নিজের হাতে বাজার করতে ভালবাসে। অর্থ ছাড়াও পরিবারের সদস্যদের পেটে যা ঢুকছে তাতে নিজের অবদানের প্রভাব জিভে জারিয়ে হয়ত বেশী স্বাদ পায়।

ছোটোবেলায় ‘বাজার’ শব্দটা তার স্মৃতিতে রয়েছে আতঙ্কের পরিবেশ গড়ে তোলার একটা কারণ হয়ে। বাবা পারতপক্ষে বাজার যেতে চাইত না। মা’ও অপেক্ষা করত ভাঁড়ারের শেষ খুদকুঁড়োটুকু শেষ হওয়া অবধি। তারপর চাপা স্বরে অপরাধী মুখে শাড়ির আঁচলের কোনা তর্জনীতে পেঁচাতে পেঁচাতে বলত, “ঘরে চাল বাড়ন্ত। কিছু না আনলে...”

মায়ের অসমাপ্ত বাক্য পূরণ করে দিত বাবার লাফিয়ে ওঠা গলার চিৎকার। দু’ কামরা বাড়ির সারা প্রান্ত সরগরম হয়ে উঠত বাবার হিংস্র হা-হুতাশে। বাবার অচেনা রূপ দেখে ছোট্ট অরিন্দম সিঁটিয়ে যেত।

চিৎকার করাটা বাবার অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেলেও বাজার যেতেই হতো। অক্ষমতাকে রাগ দেখিয়ে ঢেকে ফেললেও পেটের ইঁদুরদের চলাফেরায় কোনও বিকার ঘটানো যায় না। অরিন্দম সঙ্গ নিত মায়ের ইশারায়। সে দেখত, বাবা কুন্ঠিত মুখ নিয়ে বাজারের রাস্তায় ঢুকছে। মাছ, মাংস, মরশুমি সবজির দিকে আড়চোখে তাকাতো বাবা। বাবার চোখ দিয়ে তাকানো বাজারকে তার চিড়িয়াখানা মনে হতো; দেখতে পারো, নেওয়া বারণ। এককেজি চাল কেনার আগে বাবা চালের গুনমান যাচাই করত সোনা পরখের ভঙ্গীতে। বিরক্ত হতো বিক্রেতা। অরিন্দমের ধারনা, আড়ালে বাবা অকথ্য বিশেষণে ভূষিত হতো। সে বিশ্বাস করে, পৃথিবীতে দু’ ধরণের মানুষ আছে। একদল দাম শুনে জিনিস কেনে। আরেকদল জিনিস কিনে দাম দেয়। প্রথমদলের মানুষের সন্তানরূপে জন্ম নিয়ে, দিনের পর দিন লজ্জিত হয়ে বেঁচে থাকতে থাকতে তার মধ্যে প্রতিজ্ঞা জন্ম নিয়েছিল, মাঝের পরিখাটা টপকে দ্বিতীয় দলের ‘টিকিট’ পাওয়ার। টিকিট মানে, গান্ধীজীর ছবি ছাপা অগুনতি টাকার বান্ডিল। 

টার্গেট করা লোকটাকে কথার জালে ফাঁসিয়ে ঠকানোর প্রয়োজন নেই। অন্যমনস্ক হয়ে চলছে। সদ্য কেনা খাসির মাংসের থলে হাতে ঝুলিয়ে দ্বিপ্রাহরিক ভোজনের স্বপ্নে বিভোর মধ্যবয়সীর পকেট থেকে মানিব্যাগ ঝেঁপে দেওয়া অরিন্দমের কাছে মাখন গেলার মতোই সহজ। অর্থ খোলামকুচি হয়ে পড়লে ব্যয়ের থেকে অপব্যয় বেশী হয়। অরিন্দম সেই অপব্যয় হতে চলা অর্থের খানিকটা নিয়ে ব্যয় করবে। এতে অন্যায় কোথায়? অন্যায় থাকলেও অরিন্দম পরোয়া করে না। দৈনন্দিন সাধারণ প্রয়োজনের কথা জানাতে গিয়ে মাকে যে চিৎকার সহ্য করতে হতো—অন্যায় নয়? পরিস্থিত তাকে কমবয়সে অনেক বড় করে দিয়েছে—অন্যায় নয়? হাতুড়ে চিকিৎসায় মরে যাওয়া মায়ের দাহকার্যের খরচ জোগাতে হয়েছে একপ্রকার ভিক্ষা করে—অন্যায় নয়?

মেসবাড়ির স্যাঁতস্যাঁতে খুপড়ির দেওয়াল ঘেঁষা খাটে শরীর এলিয়ে অরিন্দম ফুঁপিয়ে কাঁদে। রোজ রাতে চোখের জল ঢাকনা হয়ে থাকে তার বন্ধ হওয়া চোখের পাতার উপর। তার মাথায় আজব চিন্তা ঘুরপাক খায়। রং কী অন্যায়ের? কালো? তাহলে কী সে একদিন কালোয় ঢাকা পড়ে যাবে। কালো মানুষেরা তার চারদিকে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে কালো পতাকায় মোড়া সাম্রাজ্যের চাবি তুলে দেবে তার হাতে? কালো মানেই খারাপ! ভাবতে ভাবতেই পুরনো দিনের ছবি নড়াচড়া করে তার বন্ধ চোখের চারপাশে। সবার দেখাদেখি আবদার করে বাবাকে নিয়ে পূজোর সপ্তাহখানেক আগে শপিং এর দিনটা ফিরে আসে।

উল্টোডাঙা হয়ে শ্যামবাজারের দিকে বাবার হাত ধরে হাঁটছিল সে। অবাক হয়ে দেখছিল, সাতসকালে মানুষের থমকে যাওয়া, ইতস্তত স্রোত দখল করে নিয়েছে রাস্তা। হকারদের খরিদ্দার ধরা চিৎকার, আর খরিদ্দারদের দরদামের প্রচেষ্টায় পরিবেশ মুখর। পকেটের সাধ্যের সাথে সাধ মিলিয়ে পছন্দসই পোষাক হস্তগত করার পদ্ধতিতে নিমগ্ন থাকা লোকেরা কমিয়ে দিয়েছিল যানবাহন চলাচলের পরিসর। শ্লথ গতিবেগে এগোচ্ছিল বাস, ট্যাক্সি, অটো।

সেদিন বাবা তাকে একটা টিশার্ট কিনে দিয়েছিল। জিনিসটা হাতে নিয়ে, গন্ধ শুঁকে নতুন উদ্দীপনা পেয়েছিল সে। বাড়িতে গিয়ে মাকে, বন্ধুদের দেখাবে। ওরা নিশ্চয়ই প্রশংসা করবে দেখে। এসব ভেবে খুশীতে উদ্বেল অরিন্দমের উজ্জ্বল চোখে সুরভিত হয়ে উঠেছিল ঘেমো হট্টগোল। রকমারি পসরা, দোকানপাট, বিভিন্ন রকম মানুষের পাশ কাটিয়ে হেঁটে চলছিল সে। মায়ের শাড়ি কেনার জায়গায় তারা যাচ্ছিল।

বাগবাজার স্ট্রিটের কাছের একটা ছোট্ট কিন্তু মালপত্রে ডাঁই হওয়া দোকান থেকে কেনা হয়েছিল শাড়ি। প্যাকেট হাতে বেরিয়ে এসেই তার চোখ আটকে গেছিল ঝকঝকে একটা দোকানের দিকে। আলো ঝলমলে, কাঁচের দরজাওয়ালা দোকানটা তাকে যেন টানছিল। তাই দেখে বাবা বলেছিল।

“দোকানের নাম দেখেছিস? বড় বড় করে কালো রঙের মোটা অক্ষরে লেখা ‘সাকসেস’। কার সাকসেস বলত? আমরা ওখানে ঢুকে জামাকাপড় কিনব আর ওরা চড়া দাম হাতিয়ে আমাদের গলা কাটবে। গলা কাটাতেই ওদের সাকসেস।” 

একপলক বাবার দিকে তাকিয়ে সে দেখেছিল ব্যঙ্গে চোবানো রাগের ভাঙাচোরা প্রতিচ্ছবি। কালো সাকসেসের কথা সে আর ভুলতে পারেনি। বুঝতেও পারেনি ওই দিন, বাবা ঠিক কী বলতে চেয়েছিল! বহু বছর পরে বুঝেছে, খারাপ কাজ করে পাওয়া সাফল্যের রঙ কালোই হয়। যে মানুষদের সাথে খারাপটা ঘটে, তাদের ঘৃণা আর অভিশাপে কালিমালিপ্ত হয় ‘কর্মবীর’এর সাফল্য।

টাকা থাকলে কালো সাদা হয়ে যায়। টাকা না থাকলে সাদা বিবর্ণ হয়ে যায়। তাই অরিন্দম সাফল্যের অন্ধকার রঙ নিয়ে মাথা ঘামায় না। ন্যায়, অন্যায় বিচার করার কলকব্জা তার বিকল। বেশী ভাবার পরতা পোষায় না।। পকেট ভারী থাকাই হলো আসল।

লোকটার পকেট আর চেহারা, দুটোই ভারী। ফোলা ব্যাঙের মতো পকেট থুড়ি মানিব্যাগ আর বিয়েবাড়ি খেয়ে অ্যান্টাসিড গোলা মোষের মতো চেহারা। তা না হয় হোক। তাই বলে চলার সময় একটু দেখবে না! কাঁধ থেকে ঝোলা ডানহাতটা মালটার নিজেরই তো? জন্মসূত্রে পাওয়া যন্ত্রপাতি সামলে রাখতে হয়। মর্কটের মতন দিল এক ধাক্কা। খেয়াল করেনি, এদিকে সাইকেলটা পড়ে যাবার উপক্রম। 

ঝকঝকে নতুন সাইকেল। সামনে বাস্কেট দেখে লেডিজ সাইকেল বলেই আন্দাজ করল অরিন্দম। মালকিন নির্ঘাত আশেপাশেই আছে। উঁহু, সাইকেলটাকে এভাবে পড়ে যেতে দেওয়া তো যায় না। অরিন্দমের স্বভাবই এমন। চোখের সামনে কোনও অঘটন, খারাপ কিছু সে ঘটতে দেয় না। 

অরিন্দম চটজলদি মাঝের দূরত্বটা পেরিয়ে সামনে ঝুঁকে অর্ধেক হেলে যাওয়া সাইকেলটাকে মাঝপথে ধরে ফেলল। স্ট্যান্ডে আগের জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিতেই ভেসে এল কয়েকজনের আলগা মন্তব্য।

“ইস্, এক্ষুনি পড়ত!”

“বেজায় ভাল রিফ্লেক্স মশাই আপনার। তড়াক্ করে ধরে ফেললেন!”

“ময়লা লেগে একাকার হতো পরিষ্কার...ইয়েটা। বাঁচালেন যাহোক।”

অরিন্দম দেখল একটা মেয়েকে ভুরু কুঁচকে এদিকে তাকাতে। এবং সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে ত্রস্তমুখে ছুটে এল প্রায়।

“এই ভদ্রলোক বোধহয় ধরাধরির ব্যাপারে ওস্তাদ। হা হা...”

শেষোক্ত টিপ্পনীতে আমল না দিয়ে মেয়েটাকে জরিপ করল সে। ছিমছাম, সুগঠিত দেহবল্লরী। শ্যামলা, পরিচ্ছন্ন ত্বক। ডাকসাইটে সুন্দরী না হলেও লাবন্যমাখা চোখমুখ। পাতলা বিষাদের ছাপও অরিন্দমের চোখ এড়ালো না।

“থ্যাঙ্কস।” মেয়েটা বলল।

মনভোলানো হাসিটা মুখে ছড়িয়ে সে অনুভব করল মেয়েটার উপস্থিতি তার শরীরকে শক্ত করছে। জিভে লালারসের সঞ্চার টের পেয়েও সে চোখ সরাতে পারল না। কোনওমতে সাইকেলের হ্যান্ডলটা মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে সে মনকে শাসন করল। কেমনতর কথা ভাবছে সে? না, ঠিক নয়। সে শরীরকে সমকোণে ঘুরিয়ে সোজা তাকাল। ওই তো লোকটা। জোরে পা চালালে এখনও ধরা যাবে। কাছাকাছি গিয়েই ঝেড়ে দিতে হবে নিপুণ কায়দায়। মেয়েটার সাথে কথা বলতে চাওয়ার বেয়াদপ ইচ্ছাকে লালিত হতে না দিয়ে মাথা নীচু করে সে এগোতে শুরু করল। দূরত্বটা কী বেড়ে গেছে? না। আচমকা তীরে গজানো কামনার ঢেউ চেনা রাস্তাকে দুর্গম করেছে। তবে সে জানে, কালোকে কেউ রঙিন করে দিতে পারে না।



“ভগবান আর মানুষ আলাদা চিজ । মানুষ কখনও ভগবান হয় না। খুব ভাল, মহান মানুষেরও পা পিছলোয় অকস্মাৎ। অনেক সময় কী হয় জানো? ছোটো ছোটো লোভে বড় বড় মানুষ পড়ে একেবারে তলিয়ে গিয়ে হাবুডুবু খায়। সারাজীবনব নিঃশঙ্ক ব্রম্ভচারীত্ব পালন করে বুড়ো বয়সে কাজের মাসির শ্লীলতাহানির খবর তো শোনাই যায়। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণের ব্যাপারটা প্রকৃতি ঠুসে দিয়েছে জীবকুলে। কামাবেগ তাই দোষের কিছু নয় একদম। তবু, সেটাকে দোষ ঠাউরে ঘটানো হয় কত কাণ্ড। মানুষই পারে এমন। ভগবান পারতেই চায় না।”

নীলাচলের বকবক শুনে বিতস্তা ক্যাবলার মতো হেসে সায় দিত। অধিকাংশই ট্যান্ করে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যেত। না বুঝলেও, কেমন করে কথাগুলো যেন তার মনে থেকে গেছে। অল্প অল্প এখন বোঝে। বোঝে, নীলাচল অনেক কিছু অনেক বেশী বুঝত।

সুদর্শন চেহারার পরিপাটি বেশবাসের লোকটা ওর সাইকেল পড়ে যেতে দিল না। কি দায় ছিল ওঁর? কিচ্ছু না। তবু করলেন। আর তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে স্বতঃস্ফূর্ত ধন্যবাদ ওঁর প্রাপ্য ছিল। কিন্তু ওকে দেখেই কেন সদ্য ভাল কাজ করা লোকটার চাহনি বদলে গেল! বিতস্তার মনে হচ্ছিল, চোখদুটো থেকে ঠাণ্ডা, পিচ্ছিল, লোভী একটা জিভ বেরিয়ে এসে ওর সর্বাঙ্গ চাটছে।

এই ধরণের চাহনির সঙ্গে পরিচয় প্রথম নয়। তবু ঘেন্নাভাবটা চট করে কাটে না।

বিতস্তা ছোট্ট শ্বাস ফেলে সাইকেলে প্যাডল শুরু করল। বাড়ি ফিরেই টিউশনিতে বেরোতে হবে। যদিও, বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করে না। কেউ ছিটেফোঁটা স্নেহের স্বরে কথা বলে না ওর সাথে। মায়ের মুখে সবসময় ঠেস দেওয়া খোঁটা আর কাজের হুকুম। অবাধ্য হলে অশ্রাব্য গালাগালি। বিতস্তা অবাক হয়, এই মা’ই কী তাকে ছোটোবেলায় ‘রাণী’ বলে ডাকত!

বয়স বাড়ার সাথে তাল রেখে পোষাক ছোটো হয়, রক্তের সম্পর্কের অচ্ছেদ্য বন্ধনের সুতোটাও পলকা হতে থাকে। মুখ বুজে থাকা, নির্লিপ্ততা হয়ত মানুষগুলোকে কাছে রাখে, কিন্তু বিদ্রোহের সামান্য চেষ্টায় সুতোর প্রান্ত ছিঁড়ে জট পাকায়। 

মেয়ে কারও সাথে প্রেম করছে, এই সত্যিটা মা মেনে নিতে পারবে না জেনেই বিতস্তা নীলাচলের কথা বাড়িতে জানায়নি। ছোট ছোট মিথ্যে বলেছে, দুজনের দেখা হওয়ার সময়টুকু বের করে আনতে। মিথ্যে বলতে ও পটু নয়। তাই ধরা পড়তেও দেরী হয়নি। আর তারপর থেকেই ওর প্রতি মায়ের আচরণের ধাঁচ অদ্ভুতভাবে ভীষণ বড় বাঁক নিয়েছে। মাকে বোঝাতে যাওয়ার সমস্ত চেষ্টা প্রতিহত হয়েছে জন্ম নেওয়া অবিশ্বাসের স্তম্ভে। 

অসহ্য, দমচাপা কষ্ট হয় মাঝেমধ্যে বিতস্তার। খোলা মাঠের ঘাসের উপর ছোট্ট বাক্সে কেউ যেন ওকে বন্দী করে রেখেছে। বাক্স খুলতে পারলেও মুক্তি নেই। রিপু আক্রান্ত হায়নার দল পায়চারি করে বেড়াচ্ছে চারপাশে। বাক্স ভাঙার চিন্তা করলেই অধৈর্য শানিত নখরের শব্দ ওর বুকে ঠাণ্ডা জল ঢেলে দেয়। ভয়ে কুঁকড়ে যায় ও।

ঠিক কতদিন এভাবে থাকতে পারবে ও জানে না। কোনওমতে কলেজের বেড়া ডিঙনোর পর রুদ্ধ হয়ে গেছিল উচ্চশিক্ষার সুযোগ। ঘরে বসে দিন কাটত। জীবনে আর কিছু হবে না, এই চিন্তায় ও হতাশ হয়ে পড়েছিল। তারপরেই আলাপ নীলাচলের সাথে। নীলাচল, বিতস্তার ভ্যাপসা পৃথিবীতে সবুজের ঝলক নিয়ে এসছিল। ওর ভয়ানক উৎসাহে মাসখানেক চাকরী পাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে সে পড়াশোনা শুরু করেছিল। মায়ের কটুবাক্য অগ্রাহ্য করার কৌশল সে শিখেছিল নীলাচলের থেকেই। ঘরের রান্না, বাজার, নিজের টিউশনি সমেত সমস্ত কাজ সেরে দিনের বাকি সময়টা সে পাগলের মতো পড়ত। আর্থিক দিক থেকে স্বনির্ভর হতে পারলে মরুভূমি মরূদ্যান হতে সময় নেয় না। নীলাচল ওকে সেই মরূদ্যানের ঠিকানায় যাওয়ার পথ বাতলেছিল। রক্তজল করা খাটনির বেড়াজালে ডুবে গেছিল বিতস্তা। শান্তিতে ছিল সে। সামনের লক্ষ্যটা তুমুল পরিশ্রমের অবসরে তাকে বর্ষার আমেজ উপহার দিত।

নীলাচল বলত, “দাঁতে দাঁত চাপা লড়াই বোঝো? একচিমটে কান্না বাইরে যাবে না। একচিলতে মজা ভিতরে ঢুকবে না। শরীর যেখানেই যাক, যেতে বাধ্য হোক, মন চুপটি করে বসে থাকবে আবেগশূন্য বাতাসে ভরা ছোট্ট কুঠুরিতে। অনেকে দেখবে হাসাহাসি করছে। গুরুত্ব দেবে না। জবাব দেবে না। যখন তুমি দাঁত খুলবে, তখন বাকীদের হাসি শুষে নেবে তোমার উর্ধারোহনের ভীষণ ঝলমলে একটা পরিচয়। লড়াই হোক সেই পরিচয় তৈরীর লক্ষ্যে। দাঁতে দাঁত চেপে।”

মাটি থেকে পাথর হওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে লড়াইয়ে নেমেছিল বিতস্তা। অনন্য কিছু করে দেখাবার তাগিদ ফুঁসে উঠছিল ঝরা পাতার সার থেকে। একদিন হঠাৎ সব থেমে গেল।

থেমে গেল । কারণ, দাঁত ভেঙে যাওয়ার পর লড়াইয়ের কায়দা তার অজ্ঞাত ছিল। বর্তমানে তার সামনে কোনও গন্তব্য নেই। জীবনটাকে লজঝড়ে গোরুর গাড়ির মতো চলতে দিচ্ছে।

বাড়ি ঢুকতেই আওয়াজ পেয়ে মা বেরিয়ে এসে বলল, “বিয়ে ঠিক করলাম তোর।”

বিতস্তার মনে হহো, মা হিব্রুতে কিছু বলছে। মানে কী বিয়ের? সাবালক একজোড়া নারী পুরুষের একসাথে, এক বিছানায় শোয়ার আইনসম্মত ব্যবস্থা? অগ্নিসাক্ষী করে সাতপাক, সিঁদুর অথবা ছাপা কাগজে কলমের আঁচড়? মনের শহরে অবলুপ্ত হওয়া কৌতুকজনক এই প্রথা নিয়ে কী আওড়াচ্ছে মা? বিয়ে ঠিক করেছে! বিয়ে তো সেই কবেই হয়ে গেছে তার। মহাবিশ্বের যাবতীয় বিয়ে সম্পর্কিত প্রক্রিয়া মেনে মনে মনে নীলাচলের সাথে বিয়ে হয়েছে বিতস্তার। সে ভাবলেশহীন চোখে মায়ের দিকে একপলক চেয়ে সাইকেলটা নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে বাজার থেকে আনা মালপত্রের থলিটা হাতে নিল। রান্নাঘরের দিকে তাকে এগোতে দেখে মা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “এই দামড়ি! শুনতে পেলি কি বললাম? রজতবাবু আসছেন কাল। কালকেই যাব রেজিস্ট্রি অফিস। শুভকাজে দেরী করতে নেই। রেডি থাকিস।”

“কিসব বলছ আবোলতাবোল!” রান্নাঘরের মেঝেতে ব্যাগ নামিয়ে রেখে ক্লান্ত গলায় বলল সে, “থামো তো।”

“রজতবাবু তোকে বিয়ে করতে চান। সেই প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন আজ। আমি, তোর বাবা রাজী। চুপচাপ কাল যাবি আমাদের সাথে।”

রজতবাবু! মানে, ওপাড়ার বউ মরা চামড়ার ব্যাবসায়ী ওই লোকটা! মাথাটা কী গেল মায়ের? বিতস্তা বুঝতে পারছিল না কি বলবে!

মা তাকাল কড়া চোখে, “কোনও প্যাকনা তুলিস না। তোর ভালর জন্যই। উনি পণ নেবেন না। কত বড় মন--”

“মা তুমি জানো-”বিতস্তা নিস্তেজ গলায় বলল, “তুমি জানো আমি বিয়ে করব না। কেন বলছ এসব-”

“ও সারাজীবন আমার ঘরে বসে খাবি। বাইরে ছেলে নিয়ে ফুর্তি করবি। এই মতলব তোর বল্? আর আমি মরি জোয়াল টেনে!”

বুকে রক্তক্ষরণ করা কষ্টটা বিতস্তা গিলে ফেলল। আপনজন খারাপ কথা বললে বেশ জোরেই লাগে। অভ্যাস হয়ে গেলেও লাগে। বলল, “ভাবো যা খুশি-”

মা গলা তুলল, “ভাববো আবার কী? ভাবিস তো তুই। চারদিকে নোংরামো করে বেড়াস। ছেলেটাকে মারলি তাও শান্তি পাসনি?”

পৃথিবীটা যেন ছোট হয় এল বিতস্তার কাছে। বারান্দায় জাঁকিয়ে বসা রোদ তাড়িয়ে দিল টুকরো টুকরো ভেজা কুয়াশা। ভীষণ কান্না পেল তার। কাকে মেরেছে সে? নীলাচলকে? কেন মা বলছে ওর কথা? তার জীবনের শক্তি, ভরসা নীলাচলের মৃত্যুর সাথেই হারিয়ে গেছে। আচমকা বেদম জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার চার দিনের মধ্যে মারা যায় ও। ওকে ছাড়া বেঁচে থাকাটাই অর্থহীন, বিস্বাদ হয়ে গেছে। তবু ওর কথা মনে রেখেই গত একমাস যাবৎ সে নিজেকে সামলে রেখেছে। শক্ত হতে চাইছে।

“মরতে চাইলে প্রবলেম কী? ইজি। জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা খুব সহজ। দম থাকলে বেঁচে দেখাও। ক্ষমতা থাকলে অন্যকে বাঁচিয়ে দেখাও। নিজেকে মেরে কিচ্ছু প্রমাণ করা যায় না।” নীলাচল উদাস মুখে বলত।

“ঘেটি ধরে নিয়ে যাবো।” মা চেঁচাচ্ছিল, “বিয়ে না করে ছাড়া গরু হয়ে থাকবি? দায়িত্ব ছাড়া অতই পাল খাবার শখ থাকলে কাগজে বিজ্ঞাপন দে। মোটা টাকা পাবি। কোনও ওজর শুনবো না। কাল তোকে যেতেই হবে।”

যখন কেউ কোথাও যাওয়ার রাস্তা দেখতে পায় না, ঘরটাই তার দুনিয়া হয়ে ওঠে। সেই দুনিয়াতে একটুও আলোড়ন না তুলে একদিন বিনা আড়ম্বরে মরে যায়। যখন, কোথাও যাওয়ার রাস্তা ঠাহর না পাওয়া মানুষকে তার ঘর থেকে হিঁচড়ে টেনে বের করার আয়োজন করা হয়, সেই মানুষটা হয় দৈবের হাতে নিজেকে ছেড়ে দেয়, নতুবা, স্বাধীনভাবে বলিষ্ঠভাবে শেষ একটা কাজ করে; নিজের মৃত্যুদিবস নিজেই ঠিক করে জীবনের দিকে চেয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে।

বিতস্তা মাথা নীচু করে ছিল। জানান না দিয়ে আবির্ভূত হওয়া সমস্যাটার মোকাবিলা করার পথ খুঁজে পেতে চাইছিল । পেল না। অবশেষে চোখ তুলল। ক্লিষ্ট হেসে বলল, “হ্যাঁ, মা । যেতে তো হবেই।”

নীলাচলকে সে জিজ্ঞেস করেছিল, “কোনওদিনই কী কোনওকিছুতেই তুমি কম্প্রোমাইজ করোনি? করবে না?”

নীলাচল আনমনা হয়ে জবাব দিয়েছিল, “করিনি। করবও না। নীতি আগে, আদর্শ আগে। আদর্শ বিসর্জন দিয়ে সমঝোতা করা মানে নিজের আত্মাকে ঠকানো। ওতে ভাল হতে পারে না।”



লোকটা বারবার এদিকে তাকাচ্ছে । অরিন্দম অস্বস্তি বোধ করল। চিনতে পেরেছে নাকি! উঁহু! চেনার কথা তো নয়! সেই অরিন্দমের বড় চুল ছিল, মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি। এখন ক্লিন শেভন্ ফিটফাট লুক। চেনা মুশকীল।

খচখচানি সমেত অরিন্দম খাওয়ায় মন দিল। মাছের ঝোলটা দারুণ রেঁধেছে। পাতলা ঝোল, মশলা বিহীন, কিন্তু জবর টেস্ট। ভাতের হোটেলে এমন খেতে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কাল থেকে সে এখানেই রয়েছে। পাঞ্জাবী পরা মোটকুর পকেট না মেরে স্বভাবসিদ্ধ কায়দার তার সাথে আলাপ জমিয়ে নিয়েছে সুন্দর কিছু মিথ্যে বলে। প্রশস্ত হয়ে এসছে বড় একটা দাঁও মারার পথ। কয়েকদিন থাকতে হবে।

ঝটপট খাওয়া শেষ করল অরিন্দম। চেয়ার ছাড়তেই আড়চোখে খেয়াল করল, কোণের টেবিল থেকে লোকটাকেও উঠতে। নজর তার দিকে। কেসটা কী হলো? চিনে ফেলল? ত্রিকালসিদ্ধ জ্যোতিষী আর কর্পোরেট চেহারার পার্থক্য সরিয়ে চিনে ফেলা তো দুরূহ কাজ! চিনে থাকলে জলদি পিঠটান দিতে হবে এই তল্লাট ছেড়ে।

বিল মিটিয়ে বেরোনোর মুখেই ডাক পড়ল, “এই যে মশাই, শুনছেন!”

আর কে শুনছে! পরিস্থিতি শ্রোতা হবার উপযুক্ত নয় মোটেই। তাড়াহুড়োর ভঙ্গীতে বেরিয়ে গেল সে। চলন্ত যেকোনও একটা বাসে উঠে পড়তে হবে এক্ষুনি। 

জগিং এর থেকে একটু কম বেগে হাঁটতে হাঁটতে মাথা ঘোরাল অরিন্দম। লোকটা পিছু নিয়েছে। অনুসরণের ধান্দায় নেই, পাকড়ে ফেলতে একপ্রকার ছুটে আসছে।

মুহূর্তখানিক সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগল সে। এইরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি প্রথমবার। ‘আপনি ভুল করছেন’ জাতীয় কথা বলে সপ্রতিভতার সাথে বিপদটা এড়ানো যাবে কী? ঘুলিয়ে উঠবে নাতো আরও!

তীব্র ফাঁকা গহ্বরের মতো একটা ভয় জাপটে ধরল তাকে। পালোয়ানের কঠোর বজ্রমুষ্টিতে চাপা পড়ল তার জোরালো মনের তাকত। দৌড় দিল অরিন্দম।

পিছনে চিৎকার, “ধর্ লোকটাকে, ধর্...”

একজনকে কনুইয়ের গুঁতো মেরে, আরেকজনের কাঁধে ঠেলা মেরে প্রাণপণ ছুটে জনবহুল শাখা রাস্তা পেরিয়ে মেন রোডে এসে দাঁড়ালো সে। দড়াম করে শক্ত কিছু একটা তার গায়ের উপর এসে পড়ল। পা আর কোমরে অসম্ভব ব্যাথা অনুভব করে টাল হারিয়ে পিচরাস্তায় লুটিয়ে পড়ল। দেখল ধাক্কা মারা অপরাধী সাইকেলটাও পড়ে যাচ্ছে। বেকায়দায় পড়ে যাচ্ছে আরোহিণীও। সে দেখল, ওই লোকটা ছুটে আসছে।





বিতস্তার মায়ের হাতে ছোট্ট একটা চিরকুট। স্থবিরের মতো খাটের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছিল। চিরকুটে লেখা অক্ষরগুলো তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। চাইছিল না বিশ্বাস করতে। অথচ কষ্ট হচ্ছিল নিদারুণ। যে কষ্ট মা ছাড়া কেউ অনুধাবনের ক্ষমতা রাখে না।

“সরি মা। আমাকে মরতে হবে। নীলাচল চলে যাওয়ার পর আমি ছিলাম সেটাই যথেষ্ট অবাক কাণ্ড। তাও ছিলাম। তুমিও বুঝলে না যে, ওকে ছাড়া আর কাউকে আমি আমার শরীর ও মনের দখলদারি দিতে পারব না। কিছুতেই পারব না। আদর্শে আটকাচ্ছে। আর কোথাও আমার যাওয়ার পথ নেই মা। সাইকেলটা প্রিয় আমার। ওকে নিয়েই যাচ্ছি। ট্রেনের নীচে সাইকেল আর আমি একসাথে ঝুপ করে শুয়ে পড়ব। সবাই ট্রেনে চেপে ঘুরতে যায়। আমাদের উপর নাহয় ট্রেন চাপল...

ইতি

তোমার নোংরা মেয়ে”




পড়ে যাচ্ছি আমি। অদ্ভুত, কী অদ্ভুত! যে মানুষটা কাল আমাকে পড়তে রুখল, আজ তার সাথেই সংঘর্ষে আমি পড়ে যাচ্ছি। ইস্, খুব লেগেছে লোকটার। বিতস্তা! মেয়েটাও তো পড়ে যাচ্ছে আমার সাথে। ওর মাথাটা ঝুঁকে গেছে নীচের দিকে। মাথা ফেটে যাবে নির্ঘাৎ! কি করব? আমি নিজেও যে পড়ে যাচ্ছি।

কে, কখন, কিভাবে পড়ে যায় কেউ জানে না। রাস্তা থেকে, জীবন থেকে, অহংকার থেকে, ভালবাসা থেকে পড়ার সময়, হঠাৎ করেই ঘনিষ্ঠ হয়ে যেতে পারে। সেই ঘনিষ্ঠতায় আটকে গেলে পতন হয়ে ওঠে চিরটাকালব্যাপী। ব্যর্থতা হয় শোবার ঘর আর সাফল্য হয় ছুঁতে না পারা মহাকাশ। মাঝের পাঁচিলের প্রতিটা ইঁটে লেগে থাকে পতনের কাহিনী। অতিক্রম করা কঠিন।

পড়ে গিয়েও যে উঠে দাঁড়ায়, সে আর পড়তে ডরায় না। জীবন তাকে যতবারই ফেলে দিক না কেন, হার না মানা লড়াইয়ের চাড় তাকে ঠেলে দাঁড় করিয়ে পিঠে হাত রাখে। আশ্বাসের তপ্ত দেওয়াল তার মনকে ন্যুব্জ হতে আটকায়। তেতো খেয়ে পুষ্টিসাধনের অনুরূপে তিক্ত স্মৃতিকে অভিজ্ঞতার ভাঁড়ে জমিয়ে সে নিজেকে সমৃদ্ধ করে। আর তাই যুঝতে পারে চারপাশে ঘটে চলা একে অপরকে ফেলে দেওয়ার চক্রান্তের বিরুদ্ধে শান্ত হয়ে যুঝতে।

জানি, পড়ে যাওয়া অস্তিত্বকে টেনে তোলার মানুষ খুব কম। কিংবা, হয়ত তারাই শুধুমাত্র মানুষ। বাকীরা একটা খোলস মুড়ে জন্ম নেয়। কর্তব্যকে ভয় ও পাগলামির চোখে দেখার খোলস।

আমি পড়তে ভয় পাচ্ছি। ভয় পাচ্ছি অনভ্যস্ত ঘটনার অংশীদার হওয়ার সূত্রপাতকে।

ভাবছি, একদমই কি কিছু করার নেই?

0 comments: