ছোটগল্প - সরিতা আহমেদ
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
অজাত কথা
সরিতা আহমেদ
মা,
সত্যি বলতে কি, তোমায় যে চিঠি লিখব কোনওদিন ভাবিনি। কিন্তু এই কথাগুলো যে তোমায় না বললেই নয়, মা। এদিকে আমার কাছে সময়ও কম, তাই...
আমায় তোমার মনে নেই, সে আমি জানি। কিন্তু তোমায় ভুলি কি করে বল! তোমায়, তোমার রিনরিনে কন্ঠস্বর, হাতের চুড়ির টুংটাং আর ঘামের সাথে লেপ্টে থাকা মা-মা গন্ধটা – ভোলা যায়! খুব ভোর ভোর দিম্মার ঘর থেকে রেডিওতে যখন রবি ঠাকুর ভেসে আসত, তখনই তোমার আর বাবার ফিসফিসানিতে আমার ঘুম ভেঙ্গে যেত। রবি ঠাকুর – নামটা বেশ! পিকু যখন তোমার কোলে মাথা রেখে নতুন নতুন ছড়া আবৃত্তি করত, আমি সেইসময় এই নামটা শুনেছিলাম, আর দারুণ ভাল লেগেছিল। মা, পিকু কি এখনও তোমার কোলে মাথা রেখে ছড়া বলে? সেবারের পুজোয় যখন পিকু শিউলি রঙের জামাটা পরে নাক কুঁচকালো, আর তোমরা তক্ষুনি ফেরত দিতে ছুটলে – আমার খুব কষ্ট হয়েছিল তোমার জন্য। অতটা শরীর খারাপ নিয়ে এত শখ করে বেছে বেছে কিনলে ছেলের জন্য! সেদিন খুব বলার চেষ্টা করেছিলাম আমার জন্য তো রেখে দিতে পারতে। এখন ভাবি, ভাগ্যিস বলতে পারিনি। নইলে কি সিদ্ধান্তটা নিতে পারতে! তোমার মনে আছে মা, শপিং মলে বাবা আর দিম্মা যখন খেলনা গাড়ি, টিশার্ট জিন্সের প্যান্ট, আর জন্য ক্রিকেট ব্যাটের দাম পরখ করছিল, আমার খুব লোভ হচ্ছিল গোলাপী টেডির জন্য, লাল হলদে ফ্রকের জন্য। তুমিও তো তাকাচ্ছিলে ওইদিকেই, বুঝি টের পেয়েছিলে আমি কি চাই! রাতে বাবার গম্ভীর গলায় চাপা ফিসফিসানির জবাবে তুমি মুখে যদিও কিছু বলতে না, তবু আমি তো জানতাম তুমি বোঝ আমায়। তবু... এখন ভাবি, ভাগ্যিস সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলে তোমরা।
জানো মা, প্রথম প্রথম পিকুকে আমি হিংসে করতাম। ও কেমন তোমার গন্ধ নিতে নিতে ঘুমাতে পারে। আমিও পারতাম হয়ত যদি না শরীরের নিচে ওই গর্তটা থাকত!
গর্ত জিনিসটা সত্যিই খুব খারাপ হয়, তাই না মা? ওখানে খোক্ষসের বাস নিশ্চয়, নইলে ওখানটায় এত অন্ধকার কেন? কেনই বা সবাই ঐ অন্ধকারকে ছিঁড়ে খুঁড়ে দেখতে চায়? পিকুর শরীরে ওরকম গর্ত নেই, তাই ও আলোয় থাকতে পেরেছে। আচ্ছা মা, যদি আমি তোমার কাছে থাকতাম তবে কি পিকু, বাবা আমার গর্তটার অন্ধকারকেও ছিঁড়ে ছিঁড়ে দেখতে চাইত, যেমনটা মুন্নির হয়েছে?
যখন আমার চোখে মুখে পিঁপড়ে ঢুকে খাবলাচ্ছিল, খুব ব্যথা পেয়েছিলাম। তবু ধানীর থেকে হয়তো কমই ছিল সে যন্ত্রণা। ধানীও পড়ে ছিল আমার পাশে, তবে গায়ে অনেকগুলো কাটা ছেঁড়া ছিল ওর। সাতখানা সূঁচ শরীরে বয়ে চলা তো কম কথা নয়, বল!
ও বাড়ির যমজ দুই বোন রতি আর নিধি যখন বেনী দুলিয়ে সুন্দরলাল বালিকা বিদ্যালয়ে পড়তে যেত, আমার খুব হিংসে হতো, আমার মতো দশা হয়নি ওদের। বাপ-মা ওদের কত যত্ন করে! তোমার মনে আছে কদম গাছের তলায় পিকুকে অঙ্ক শেখাচ্ছিলে যেদিন, একটা একটা ফুল হাতে নিতে যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ! ও ভুল উত্তর দিচ্ছিল, আমি হলে ঠিক পারতাম। এতবার শুনেছি তোমার কাছে, আমার তো মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। এই যাহ! রতিদের কথা বলতে গিয়ে কিসব বলছি! তো সেই কদম গাছের নিচে দেখি একদিন নিধি পড়ে আছে- একদম লাল হয়ে। রতিটা নাকি বেপাত্তা! সবাই বলছিল ‘বেচে দিয়েছে’। আচ্ছা মা, বেচে দেওয়া মানে কি! বেচে দিলে কি কেউ আর ফেরে না মায়ের কাছে? ওরা বলল কচি মাল বেচে দিলে ভাল দাম মেলে। সবই ওই গর্তটার জন্য, জানো! সেদিন আমার একটুও হিংসে হয়নি। ভাগ্যিস আমি আলোর দুনিয়ায় আসিনি, নইলে জগাই দাদু আমায় নিয়েও অমন খেলা খেলত, নইলে কেউ বেচে দিত রতির মতো। আচ্ছা, বাপিও কি আমায় বেচে দিয়ে অনেক দাম পেত, মা? কিন্তু বাপির তো অনেক টাকা, হণ্ডা গাড়িও আছে –সেই যেটার ভ্রুম ভ্রুম শব্দ শেষবার পেয়েছিলাম, তখনও পিঁপড়েরা খবর পায়নি আমার। তোমরা বোধহয় আমায় বেচতে না,বল! তাহলে হয়ত কেউ ধানীর মতো আমার গর্তটায় সূঁচ বেঁধাত যাতে পরের বার আরেকটা পিকু আসে তোমার কোলে, তাই না মা! সেইজন্য কি সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলে?
আমার দিব্যি মনে আছে মা, তোমার তখন হাঁটতে বেশ কষ্ট হতো, তারই মধ্যে পিকুর টিউশান স্যারের কাছে যেদিন গিয়েছিলে, আর শিব মন্দিরের ধারে হারান দাদুর সাথে দেখা হয়েছিল। ‘এবারে শুধু মিস্টি মুখ নয় বৌমা, পাত পেড়ে মাংস ভাত খাব’ –বলেছিল দাদু। আচ্ছা, ক্লিনিক থেকে আসার পরে খাইয়েছিলে দাদুকে? না খাওয়ালে একদিন খাইয়ে দিও। কারণ আমি যদি নিধিদের মতো তোমাদের কাছে থাকতাম চারবছর ধরে, তবে কোনওদিন কদম তলায় আমায় এমন চেহারায় দেখলে তোমাদের মাংস-ভাত খাওয়া উঠে যেত। যেমন রতির মায়ের উঠে গেছে। এখন খালি কান্না গিলেই থাকে মিনতি মাসি। কদমতলায় লাল হয়ে পড়ে থাকার চেয়ে বোধহয় ডাস্টবিনটা ভাল জায়গা, তাই না মা!
নাহ, তোমায় এমন কান্না গিলে থাকতে হবে না বলেই তো আমি বাড়ি আসিনি মা। প্রথম প্রথম খুব জানতে ইচ্ছে হতো, আমায় ভুলে তোমরা ভাল আছ কি করে! কিন্তু মালতিদির পোড়া শরীরটা আরও ভাল করে পোড়াবে বলে যেদিন ওরা শ্মশানে নিয়ে গেল, সেদিন মনে হয়েছিল পিঙ্কিটা না জন্মালেই ভাল করত। মেয়েকে হারিয়ে মা বাঁচলেও, মাকে হারিয়ে মেয়ে বাঁচবে কি করে! পিঙ্কিটার জন্য খুব ভয় করে, মা। ওরও তো আমার মতো গর্ত আছে নিচেটায়। ওকেও যে মুন্নির মতো বাবা-দাদারা বেঁধে রেখে খুবলে খাবে কিনা, জগাইদাদুর মতো কেউ নোংরা আদরের দাগ দেবে কিনা, রতিটার মতো হাত বদলে পাচার হয়ে যাবে কিনা, কিম্বা গর্তে সাতটা সুঁচ বা লোহার শিক বেঁধানো অবস্থায় কেউ নালায় ফেলে দেবে কিনা, কেই বা জানে!
তোমাদের প্রতি এখন আমার আর অভিমান নেই, পিকুর প্রতিও কোনও হিংসে নেই, জানো। শুধু ভয় হয়, এভাবেই আমরা সব যদি ডাস্টবিনে ঠাঁই পাই, তবে পিকুর বা পিকুর বন্ধুদের জীবনে কোনও পিঙ্কি, নিধি বা ধানী আসবে কি করে! আর যদি নাই আসে তবে পিকুরা জন্মাবে কিভাবে?
এই দেখ, কত কথা বলে ফেললাম। তোমার ভেতর থেকে এত কথা শুনেছিলাম, ভেবেছিলাম তোমার কোলে ছড়া শিখতে শিখতে সব বলব। কিন্তু... আর বেশিক্ষণ বলতে পারব না মা, পিঁপড়েগুলো আমার জিভে আটকে আছে। পিকুকে নিয়ে, বাপিকে নিয়ে তুমি ভাল থেক মা। শুধু একটাই দুঃখ জানো, হণ্ডা গাড়ির খালি শব্দ আর পেট্রোলের গন্ধটাই পেলাম, বাপিকে দেখতে পেলাম না। ‘বাপের মুখই পেত বোধহয়’- পচা গন্ধওয়ালা নোংরার স্তুপে পড়ার আগে দিম্মার গলায় এটা শুনেছিলাম মনে আছে। আচ্ছা, বাপের মতো মুখ পাওয়া মেয়েদের বুঝি বাপের মুখ দেখা, বাপের কোলে চড়া মানা, তাই না মা। যাক গে, এবার আমি আসি। শরীরের ভেতর অন্ধকার নিয়ে জন্মালে অন্ধকারেই তো ফিরতে হবে, সে আমি জানি। তুমি ভেব না মা, মুন্নি, নিধি বা ধানীদের চেয়ে আমি অনেক লাকি। তোমাদের কন্যাদায় থেকে মুক্ত করে দিতে পেরেছি – একি কম বড় কথা!
- তোমাদের অবাঞ্ছিতা
0 comments: