0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক


জলরেখা 
নন্দিনী সেনগুপ্ত



২২ 

‘সকলকে ফাঁকি দিয়ে স্বর্গে পৌঁছুবে
সকলের আগে সকলেই তাই’... 

কলকাতার রাস্তায় উর্ধশ্বাসে ছোটা প্রচণ্ড গতিময় মানুষজন, গাড়িঘোড়া দেখে হঠাৎ নিরূপের এই লাইনদুটো মনে পড়ল। জীবনানন্দ দাশ। তার একসময় কবিতা পড়ার খুব নেশা ছিল। যখন জনবহুল শহরের মধ্যে বাস করত, তখন সে প্রচুর কবিতা পড়ত। এখন সে প্রকৃতির কোলে পাণ্ডববর্জিত পরিবেশে প্রায় একা বসবাস করে, অথচ সেভাবে কবিতা পড়ার ইচ্ছে হয় না তার। এখন যেন সে ভাবুক, কাব্যিক আবেশের থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে। অদ্ভুত লাগল এই কথা ভেবে তার। যখন আইয়মের সাথে... হ্যাঁ, মেঘ নিয়ে, প্রেম নিয়ে অনেক কাব্য করত সে। আবার সেগুলো ইংরেজি করে করে আইয়মকে বোঝাত তার মর্মার্থ। এমনকি আইয়মকে সে বাংলা লিখতে পড়তে শেখার জন্য রাজি করিয়ে ফেলেছিল শুধু যাতে আইয়ম রবীন্দ্রনাথ অন্তত নিজে পড়তে পারে। কিন্তু সে নিজে এখন কী করছে? মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও কদ্দিন ছুঁয়ে দেখেনি রবীন্দ্রনাথ। রচনাবলীগুলো কি মা হুগলীর বাড়িতে নিয়ে গিয়েছে? হ্যাঁ, তেমনটিই হওয়া সম্ভব। মা গয়নাগাঁটি কলকাতার বাড়িতে ফেলে চলে যেতে পারে, কিন্তু বইগুলো নির্ঘাত সব গুছিয়ে নিয়ে গেছে। মায়ের এই রবীন্দ্রপ্রীতি মনে আসতেই নিরূপের মুখে একটা চাপা হাসির আভাস খেলে গেলো। সে তো যাবেই দুদিন পরে হুগলী। দেখবে বইগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা! অনেক পুরনো, হলদে পাতাগুলোর খুব বেহাল দশা; দেখা যাক যদি এক দুটো বেছে সুটকেসে ঢুকিয়ে নেওয়া যায়। 

গতকাল বিকেলে সে হুগলীতে একবার ফোন করেছিল। ফোনে মায়ের গলাটা ভালো ঠেকল না নিরূপের। কোনও চিন্তায় আছে? নাকি মা তার উপরে খুব রেগে আছে? অদ্ভুত একটা শীতলতা ছিল মায়ের কণ্ঠস্বরে। ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই নিরূপের ভ্রু কুঁচকে যায়। নীরদাকে নিয়ে কি মায়ের কোনও বিশেষ সমস্যা হলো ওখানে? সবকিছুর জন্য নিজেকে দায়ী মনে হয় তার। বুড়ো বয়সে বড় বেশি চাপে ফেলে দিয়েছে সে মা-বাবাকে এবং নিজে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। মা-বাবাকে অরূপের অবর্তমানে তারই দেখে রাখার কথা ছিল, উল্টে নিজের মেয়ের দায়িত্ব দিয়ে কেটে পড়েছে। ‘না, নিরূপ, কাজটা তুমি ভালো করলে না!’ নিজেই নিজেকে বলে সে। 

‘কাজটা তুমি ভালো করলে না, নিরূপ!’ এই বাক্যটা সে আগেও শুনেছে। দাসদার সঙ্গে বছর দশেক আগেই দেখা হয়েছিল হায়দ্রাবাদে একটা কনফারেন্সে। দাসদা তাকে এক কোণে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে এই কথাটা বলে গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। নিরূপ মাথা নিচু করে শুনেছিল। ‘মেয়েটাকে কেড়ে নিয়ে আসা মায়ের কাছ থেকে, না নিরূপ! এটা উচিত হয়নি তোমার! তোমাদের বনিবনা হচ্ছিল না, পরিষ্কার করে বলতে পারতে। কথা বলতে পারতে ওর সাথে বা আমাদের কারও পরামর্শ নিতে পারতে। ওদের মধ্যে ডিভোর্স আকছার হয়। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ওদের। কিছু সমস্যা হতো না তোমার!’ দাসদা এক নিঃশ্বাসে বলেছিল, ‘জানো তুমি? তোমার নামে হুলিয়া বেরিয়ে গিয়েছিল। গ্রামের লোকেরা তোমাকে পেলে জ্যান্ত পুঁতে দিত মাটিতে। পারেনি, সেটা কেবল আইয়মের জন্য।’ বোসদা চুপ করে গিয়েছিলেন। নিরূপের গলা কেঁপেছিল একটু। সেটা উৎকণ্ঠায় না কনফারেন্সের সন্ধ্যায় ব্যাংকয়েটের তরল সোনালী পানীয়ের প্রভাবে সেটা আর তার এখন মনে নেই। সে প্রশ্ন করেছিল, ‘কী? কী করেছিল আইয়ম?’ দাসদা অনেকক্ষণ গুম হয়ে বসেছিল। তারপর আরও একটা করে ড্রিংক নিয়ে ওরা দুজনেই এসে বসেছিল ব্যাঙ্কয়েট হলের বাইরের লনে। খোলা বাতাসে শ্বাস টেনে দাসদা জানিয়েছিল যে আইয়ম মিথ্যে কথা বলে সামলেছিল ওর গ্রামের লোকেদের। বলেছিল যে নিরূপ ওর সম্মতি নিয়েই বাচ্চাকে নিয়ে গেছে দাদু-ঠাকুমাকে দেখাবার জন্য। শীগগির ফিরে আসবে। হঠাৎ করে চলে যায়নি বা পালিয়ে যায়নি। আইয়ম নাকি পরে দাসদার সাথে দেখা করতে এসেছিল। জানিয়েছিল যে ও দূরে কোথাও চলে যেতে চায়। যদি নিরূপ কোনওদিন ফিরে এসে দেখে যে আইয়ম নিজের গ্রামে নেই, তাহলে ও যেন একবার গ্রামে এসে ওর ছোটবেলার বান্ধবী রিলাংএর সাথে দেখা করে। নিরূপের আর কিচ্ছু জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি। শুধু মনে আছে দাসদার কাঁধে মাথা রেখে অনেকটা কেঁদেছিল সে; হয়তো সত্যিই পানীয়ের প্রভাবে সে সেদিন ভেঙে পড়েছিল। নাহলে ভেতরে ভেতরে চুরচুর হয়ে গেলেও বাইরে থেকে দেখে কেউ তাকে এতটুকু বুঝতে পারেনা যে ভিতরে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে সে হাসিমুখে ঘুরছে, ফিরছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে। দাসদা ওকে গেস্ট হাউসের ঘর অবধি পৌঁছে দিয়েছিল রাতে। বলেছিল, ‘বুঝতে পারছি তুমি আইয়মকে এখনও ভালবাসো। কিন্তু এভাবে পালিয়ে যেও না। ভুল করেছ, সেটা ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্বীকার করো। যাও একবার, ফিরে যাও। কে বলতে পারে, হয়ত এখনও ও তোমার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে। তাছাড়া, বাচ্চাটার প্রতিও তুমি অবিচার করছো। তার মা বেঁচে আছে। অথচ তাকে বলেছো যে তার মা নেই!’ 

ভেবেছে নিরূপ, অনেকবার ভেবেছে যে একবার গিয়ে দাঁড়াবে আইয়মের সামনে। কিন্তু সাহস হয়নি। পিছনে ফিরে তাকালে দেখতে পায় যে অনেক জায়গায় সে ভুলভাল আচরণ করেছিল। সে ওভার রিঅ্যাক্‌ট করেছিল যেদিন আইয়ম বাচ্চাটাকে নিয়ে ওদের গ্রামের পুরোহিতের কাছে গিয়েছিল। কেন সে ওরকম করল তা নিজেও জানে না। আদিবাসীদের পূজার পদ্ধতি আর তাদের সনাতন হিন্দু পূজার পদ্ধতি তো   একরকম হবে না, এটা তার বোঝা উচিত ছিল। তাদের বাড়িতে, হ্যাঁ, তাদের বংশ কৃষ্ণভক্ত বলে চিরকাল কৃষ্ণ বা নারায়ণপূজা ছাড়া অন্য কোনও পূজা হয় না; কিন্তু ছোটবেলা থেকে অনেক বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে তো সে দেখেছে কথায় কথায় বাড়িতে বা মন্দিরে বিভিন্ন রকমের পূজা; কলকাতা শহরে বসেই শিব, দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্ত্তিক, গণেশ, মনসা, শনি, শীতলা এতরকম ঠাকুরদেবতার পূজার কথা কি সে শোনেনি? আদিবাসী পূজার ব্যাপারে তার হঠাৎ খেপে যাওয়া কি উচিত হয়েছিল? ছোট বাচ্চার মঙ্গলকামনায় পূজা দেওয়া তো খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ! আইয়ম তো সেটাই করেছিল। কেন যে তার হঠাৎ সেদিন মাথা গরম হয়ে গেলো সে আজো ঠিক মনে করে আনতে পারে না। আবার সেই পুরোহিতের ছেলের সঙ্গেই আইয়মের বিয়ে হবার কথা ছিল একসময়। সব মিলিয়ে তার মাথার ভিতরে বিস্ফোরণ ঘটেছিল। সে চিৎকার করে বলেছিল যে বাচ্চাকে নিয়ে কোনও পূজা আচ্চা তার পছন্দ নয়। আইয়ম ঠাণ্ডা মাথায় তাকে অনেকক্ষণ ধরে বুঝিয়েছিল সব কিছু এবং সে বুঝেও গিয়েছিল। তার পর... হ্যাঁ, তার পর তো কিছুদিন সব ঠিকঠাক চলছিল। সমস্যাটা আবার শুরু হলো আইয়মের বাবা তাদের বাড়ি থাকতে আসার পর থেকে। 

0 comments: