ধারাবাহিক - সুবল দত্ত
Posted in ধারাবাহিকধারাবাহিক
প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত
॥১৪॥
‘আজ যাহা ক্লান্ত ক্ষীণ আজ যাহা নগ্ন চূর্ণ –অন্ধ মৃত হিম/একদিন নক্ষত্রের দেশে তারা হয়ে রবে গোলাপের মতন রক্তিম’
--জীবনানন্দ দাশ
গোরাচাঁদ
পায়ে পায়ে জেরেকার বেডের কাছে এগিয়ে এলেন গোরাচাঁদ। মুখ নিচু। খুব অপরাধী লাগছে নিজেকে। জেরেকার এই অবস্থার জন্যে পুরোপুরি নিজেকে দায়ী করছেন তিনি। ক্যাথিটার খোলা হয়ে গেছে। বড় প্লাস্টার কেটে এখন শরীরের কয়েক জায়গায় স্টিকার দেওয়া। জেরেকাকে অনেক ফ্রেশ লাগছে। জেরেকার একটা খুব বড় গুণ, ট্রমা ওকে কোনওদিনই কাবু করতে পারেনি। খুব তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি সামলে নেয়। অবশ্য এই রাশিয়ান আর্মীদের মেডিক্যাল ট্রিটমেন্ট সিষ্টেম অনেক বেশি এডভান্সড। স্ক্যানিং মেশিন এক্সরে আলট্রাসোনো সমস্ত ওরা বয়ে নিয়ে এসেছে। তার ওপর মানসিক আতংক থেকে যাতে দ্রুত সুস্থ হয়ে বেরিয়ে আসে তার নানান সেবা।
জেরেকার কাছে আসতেই সে দু' হাত বাড়িয়ে বৃদ্ধের হাত জড়িয়ে ধরল। জেরেকার মুঠিবদ্ধ হাতে গোরাচাঁদের চোখ বেয়ে চোখের জল টপ টপ করে পড়তে লাগল। গোরাচাঁদ আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না। জেরেকা চোখ বন্ধ করে সেই শিহরণ অনুভব গ্রহণ করল। গোরাচাঁদ বিড়বিড় করে কাঁপা গলায় আবৃতি করলেন জীবনানন্দের এক টুকরো কবিতা, ‘...রাত্রি দিন আমাদের মন/বর্তমান অতীতের গুহা ধরে একা একা ফিরিছে এমন!’ একটু থেমে গোরাচাঁদ বললেন, দীর্ঘ তিরিশ বছর তোমার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তোমাদের উপজাতিদের হকের লড়াই লড়ছি, কিন্তু আঘাতের পর আঘাত পাচ্ছি, প্রত্যাঘাত সফল হচ্ছেনা জেরেকা। অসফলতার ছোটো ছোটো গর্তে পড়তে পড়তে ক্রমশ আরও আরও নিরাশার অতলে নেমে যাচ্ছি। এখন নিশ্চিত তোমাদের সবাইকে নিয়ে আমি এবার চিহ্নহীন হয়ে যাব। এই পাপের ভাগী কেবল আমিই জেরেকা। কারণ? কারণ তো আমিই, আর আমারই অংশজ? আমারই নিজের রক্ত এই ধ্বংসলীলার হোতা?
একটু চুপ করে জেরেকার চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার বললেন, ছুরিতে চিরে ফেলা তুমি তোমার ভাঙা হাত দিয়েই বুকে ক্রশ এঁকে যাকে তোমার এই অসহায় সময়টিকে সমর্পণ করে দিলে এখন, তুমি বলতে পারো সে কে? সে আদৌ কিছু কি? সে কি নেচার না অটো? যদি প্রকৃতি হয় তবে কেউ কি বলতে পারবে প্রকৃতি নিজের সুবিচার কবে করবে? আদৌ করবে কি না? নাকি এমনিই ধীরেধীরে ধংসের দিকে নিজেকে ঠেলে দেওয়ার প্রকৃতির এক অবাধ ষড়যন্ত্র?
গোরাচাঁদ একটানা কথাগুলি বলে হাঁফাতে লাগলেন। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে আমার পুঁজিবাদীদের আগ্রাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই। কিন্তু কিছুই করতে পারলাম না জেরেকা। দেশের সাধারণ মানুষকে বোঝানো গেলনা এই তোমাদের মতন উপজাতিদের উপর অত্যাচারের আসল কারণ মাত্র কিছু লোভী মানুষ,যারা কিজানি কি কারণে জনতার প্রতিনিধির কাছ থেকে সাপোর্ট পেয়ে যায়। সাধারণ মানুষ ও সরকারের প্রতিনিধিদের ভুল এক ঘুমপাড়ানি জুজুর গান শুনিয়ে তার আড়ালে বনজ ভেষজ খনিজ সব সব লুঠ হয়ে যাচ্ছে। শালা এদেশে সোস্যালিজম কম্যুনিজম কোনও ইজমই চলবেনা। শুধু নানা ডিজাইনের শোষণবাদ। বড় ছোটো মাঝারী ধনী দরিদ্র সব সব...।
জেরেকা বুদ্ধিমতী। বাধা না দিয়ে সারাটা সময় চুপ করে রইল। বাধা দিলনা। অবশ্য বাধা আর কি দেবে সে? এই হতাশা যুক্তিযুক্ত। গোরাচাঁদ চুপ করলেন। জেরেকার হাত তখনো নিজের হাতে। অনেকক্ষণ নীরবতার পর জেরেকা ক্লান্ত গলায় বলল,-পেরো কোথায়? পেরোকে খুব দেখতে মন করছে। গোরাচাঁদ চারপাশে এদিকওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিলেন গোপন কিছু সাউন্ড রিসিভার আছে কিনা। তারপর সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, -পেরো কোথাও আত্মগোপন করে রয়েছে। আমি সেটা জানিনা। যদিও আমাদের দেশের ওই কুলাঙ্গার মেজর জেনারেল আর ওই কপার মাইনসের ভাড়াটে গুণ্ডা ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, কিন্তু আমি জানি ও ঠিক থাকবে ওকে কেউ খুঁজে পাবেনা। জেরেকা খুব করুণগলায় বলল, -ওর সাথে আমার কখনও সাক্ষাত হয়না। আমি টের পাই ও ছায়ার মতো আমার কাছাকাছি ঘুরে বেড়ায়। ওকে বহুদিন দেখিনি। ও কেমন দেখতে হয়েছে, মোটা কি পাতলা বেঁটে কি লম্বা, ও কি খুব কালো? আমি জানিনা। ও আমাকে ঘৃণা করে? ওর কি খুব অভিমান?
জেরেকার চোখ বেয়ে দরদর করে জল পড়তে লাগল। গোরাচাঁদ ওর চোখের জল মুছিয়ে দিলেন আর নিজেরও চোখ মুছলেন। খুব শান্ত গলায় ধীরে ধীরে জেরেকাকে ভেষজ মধু খাওয়ানো সারা গায়ে প্রলেপ দেওয়া আর এখানে নিয়ে আসার কথা বললেন তিনি। সুযোগ বুঝে কখন যে সে সেখান থেকে সটকে পড়েছে সেটা তিনিও বুঝতে পারেননি। রাশিয়ান সৈন্যদের ওকে খুঁজে আনার কোনও গরজও নেই এইকথাও বললেন। হঠাত্ মনে পড়তে গোরাচাঁদ বললেন,-আচ্ছা জেরেকা? তোমার সাথে ঠিক কি কি ঘটনা হয়েছিল, তোমার মনে আছে?
জেরেকার মুখ যন্ত্রণায় কুঁচকে গেল,- ওই যে ঘন মহুলবনের মাঝবরাবর দুধ ঝর্ণা বইছে, তারপাশে খুব বড় একটা ময়দানে আমাদের জমায়েত হয়। একথাটা আপনি পেরো আর আমরা ছাড়া আর তো কেউ জানেনা। আমার খেড়িয়া শবর ভাই দুধ খেড়িয়া ঢেলকি খেড়িয়া গোলগো ভুনিয়া সান্ডি গিদি নাগো কুড়ুখ জঙ্গলী ভাইয়েরা আরও নানান বনাঞ্চলের ভাইয়েরা সবাই সেখানে জমায়েত হয়েছিল সেদিন বিকেলে। অন্যসব দিনের মতোই পেরোর দেখা পাইনি। সেদিন জানতে পারলাম আমাদেরই এক মুখিয়া গ্রামে গ্রামে ঘুরে আমার ও আপনার নাম নিয়ে একটা রেজিস্টারে সব আদিবাসী গ্রামের ভাইদের আঙ্গুলের ছাপ ও সহি নিয়েছে। ওতে কি লেখা রয়েছে জানিনা কিন্তু আমি বুঝে গেছি এটা মাইন্স ওনারদের চক্রান্ত। সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রাণপণে দৌড়েছি সেই মুখিয়ার গ্রামে। কিন্তু মাঝপথে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে রয়েছিল পুরো সেনাবাহিনী নিয়ে মেজর জেনারেল সৌমজিত্।
জেরেকার গলা কেঁপে গেল। নীরবে চোখ বেয়ে অশ্রু বইতে লাগলো আবার। গোরাচাঁদ হাতবাড়িয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আবার নীরবতা। কিছুক্ষন পর ঢোক গিলে আবার বলতে লাগলো সে।
-আমার নিজের ছেলে পেরো। তাকে আমার বুকের দুধ পান করাতে পারিনি। সমুকে তার জীবনের শুরু থেকে আমি মায়ের অভাব বুঝতে দিইনি। আমার স্তনপান করিয়ে কোলেপিঠে পাঁচবছর ধরে মানুষ করিয়েছি। সে কিনা?
আবার জেরেকার গলা রুদ্ধ হয়ে আসে। একটু সময় নিয়ে থেমে গোরাচাঁদ জিজ্ঞেস করলেন, -ও আসলে কি করেছে তোমাকে? জেরেকা চোখমুছে বলল, -ও আমাকে কিছুই করেনি। আমি রাস্তা থেকে নেমে সৈন্যবাহিনী থেকে একটু সরে গিয়ে আবার হাঁটতে থাকলাম কিন্তু কয়েকজন শহুরে গুণ্ডা মতন লোক আমাকে ঘিরে ফেলেছিল। ওরা হঠাত্ করে ছোরা চালাতে শুরু করে দিল। আমি চিৎকার করে সমুকে ডাকলাম। ও মুখ ফিরিয়ে নিল। তারপর যেন কিছুই হচ্ছেনা এমনিই ভান করে মিলিটারি জিপে চেপে চলে গেল। আমি পড়ে যাওয়ার পরও ওরা আমাকে আরো আরও জখম করতে লাগলো ছুরি দিয়ে। আমাকে ঘষটে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। তারপর তারপর আমার মনে নেই।
-ওই লোকগুলোর কিছু কথা শুনতে পেয়েছিলে কি?
-না সেরকম কিছু নয়, তবে ওরা যখন টেনে হিঁচড়ে আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন হাসাহাসি করে হিন্দিতে বলছিল মেজর সাহাব বলছিল এই আদিবাসী বুড়ির ছেলেটা নাকি মৌগা, আর ওই গোরা বুড়োটার পিরিতের লোক।
-তুমি কি বল, জেরেকা?
-ছিঃ। আমি জানি পেরো আপনার উত্তরসূরী। আপনার মানসপুত্র। যদি আপনার আন্দোলনের শুভসমাধান কেউ আনতে পারে তবে সেই পারবে। কেননা সে আদিম হোক আর হিংস্র হোক তার বিদ্যা আর বুদ্ধিমত্তা আপনারই দেওয়া। ও আমার সাথে কথা নাই বলুক, সে আমার গর্ব।
গোরাচাঁদ হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাড়াতেই জেরেকা হাত ধরে নিল আবার।
-যাবেন না স্যার। আরো কিছু জরুরী কথা আছে। রাশিয়ান মেজর জেনারেল এসেছিলেন আমার কাছে।
0 comments: