0

বইঘর - চয়ন

Posted in


বইঘর


ভাবনা -আড্ডা -গল্পে : অমর ধ্রুবপুত্র
চয়ন



অনাবৃষ্টিতে, খরায় কাতর উজ্জয়িনী। রোদে পুড়ে ছারখার সোনার দেশ। রক্তবর্ণ সবুজ পাতারা, নরম মাটি পাথর, নদী সরোবর জলহীন। ধ্রুবপুত্র নির্বাসিত তাই মানুষের অন্তঃকরণ প্রেম-প্রীতি-করুণা শূন্য। ভয়ঙ্কর অজন্মা এক ভীষণতর বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি করতে চলেছে। এরপর নারীপুরুষের মিলনে প্রাণসৃষ্টি হবে না আর। এই অবস্থায় নবরূপে প্রত্যাবর্তন ধ্রুবপুত্রের। তিনি চান বৃষ্টি আসুক, ফসল ফলুক, মানুষ জন্মাক। কিন্তু, এই অনাবৃষ্টিতে সব নারী আজ প্রোষিতভর্তৃকা। সব পুরুষই কোনও না কোনও ভাবে নির্বাসিত : যুদ্ধক্ষেত্রে, বন্দীশালায়, জনশূন্য প্রান্তরে। তাঁর নির্বাসন কালে ধ্রুবপুত্র রচনা করেছিলেন উমা মহেশ্বরের মিলন গাথা। রচনা করেছিলেন এক অনুপম কাব্য। তিনি কবি, তাই তিনি দ্রষ্টা। তিনি জানেন বৃষ্টির মেঘ পারে পুরুষের নির্বাসন কালের অন্ত ঘটাতে। তিনি জানেন নির্দয় প্রকৃতির বিপক্ষে দাঁড়াতে পারে তাঁর কাব্য। তিনি রচনা করতে পারেন বৃষ্টির মন্ত্র -- অন্ততপক্ষে রচনার চেষ্টা করতে পারেন। কবি মন্ত্রোচ্চারণ করতে থাকেন : 

কশ্চিতকান্তা বিরহগুরুণা স্বাধিকারপ্রমত্তঃ
শাপেনস্তংগমিতমহিমা বর্ষভোগ্যেণ ভর্তুঃ। 

নিষাদদের ঢাকে মেঘের গর্জনধ্বনি জেগে ওঠে। বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ পাওয়া যায়। খোলা আকাশের নীচে মৈথুনরত নরনারী মিলনসুখের তুঙ্গমুহূর্তে দেখতে পায় ঘন মেঘে আকাশ ছেয়েছে। বৃষ্টি আসছে; বৃষ্টি এল। 

সমস্ত ইওরোপ এক পোড়োজমিতে রূপান্তরিত হয়েছে। মানুষের নির্বোধ হিংসা নির্বাসিত করেছে কৃষ্টি-সংস্কৃতির অন্তরাত্মাকে। বৃষ্টি নেই, ছায়া নেই। 

And the dead tree gives no shelter, the cricket no relief.
And the dry stone no sound of water. Only
There is shadow under this red rock. 

বন্ধ্যা নারী পুরুষের সম্পর্ক। দেহ আছে, প্রেম নেই। মৈথুন যান্ত্রিক। 

She turns and looks a moment in the glass,
Hardly aware of her departed lover; 
Her brain allows one half- formed thought to pass: 
'Well now that's done: and I'm glad it's over.'

এই অবস্থার মধ্যে এক কবি জলের খোঁজে চলেছেন। তিনি তার সন্ধান করছেন নর নারীর মিলনজাত উর্বরতা নিয়ে রচিত লোকাচার ( fertility cult এর) মধ্যে; হৃতসুষমা সংস্কৃতির মধ্যে : 

The river's tent is broken; the last fingers of leaf 
Clutch and sink into the wet bank. The wind
Crosses the brown land, unheard. The nymphs are departed.
Sweet Thames, run softly, till I end my song. 

বহুপথ অতিক্রম ক'রে ভারতীয় দর্শনের জগতে এসে আশ্বাস লাভ করেন কবি। ভেজা বাতাস বয়ে আনে বৃষ্টির আশ্বাস। বৃহদারণ্যক উপনিষদের অনুপ্রেরণায় মেঘগর্জনের মধ্যে কবি শোনেন দম্যত, দত্ত, দয়ধ্যম্। কবি চেষ্টা করেন তাঁর কাব্যের শক্তিতে পোড়ো জমিতে বৃষ্টি নামানোর : 

In a flash of lightning. Then a dump gust
Bringing rain

Ganga was sunken, and the limp leaves
Waited for rain, while the black clouds
Gathered far distant, over Himavant.
The jungle crouched, humped in silence.
Then spoke the thunder. 

দুটি গ্রন্থ: উপন্যাস আর কাব্য। দুটি সন : ২০০২ এবং ১৯২২। দুটি নাম : ধ্রুবপুত্র ও The Waste Land। দু'জন স্রষ্টা : অমর মিত্র আর T.S. Eliot। কী সাদৃশ্য দুটি রচনার মধ্যে! ঔপন্যাসিক নিশ্চিতভাবে কাব্যগ্রন্থটির দ্বারা প্রভাবিত? 

অমর মিত্র হাসলেন। তারপর বললেন, " জীবনে ওয়েস্টল্যাণ্ড পড়ি নি আমি।" তাহলে এই অনাবৃষ্টি ও বৃষ্টির দ্বান্দ্বিকতা? যার দেখা তাঁর রচিত অশ্বচরিত উপন্যাসেও পাওয়া যায়? শরতকালে যে ঘোড়া খুঁটি উপড়ে পালায় চরের বুকের সবুজ ঘাসের টানে, সে হঠাৎ বৈশাখ মাসে পালাতে যায় কেন? কারণ, এই বৈশাখী পূর্ণিমারাতে আচমকা বৃষ্টি নামে। বৃষ্টি থামলে দেখা যায় বালির গর্তের মধ্যে জল জমেছে। সোনার থালার মত চাঁদ উঠেছে আকাশে। ঠাণ্ডা বাতাস শুঁকে শরতের গন্ধ পায় ঘোড়াটা। দৌড় শুরু করে। দৌড়তে দৌড়তে রাত ফুরোয়। সূর্য ওঠে। বৈশাখী দাবদাহ প্রবল সমারোহে জানান দেয় নিজের অস্তিত্ব। ঘোড়াটার মৃত্যু ঘটে। সেই এক বিষয় বস্তু নয় কি? খানিক মিথ্যে আশা আর নিষ্করুণ জীবনের বৈপরীত্য? সাহিত্যিক আবার হাসেন। 

-- " কী জানেন? ছোট থেকে আমি কোনওদিন জলের অভাব দেখি নি। এখানে টালাট্যাঙ্কের জল সব সময় পাওয়া যায় কিনা! মনে হ'ত উল্টোদিকটা ভাবলে কেমন দাঁড়ায় ব্যাপারটা!" পুরোপুরি আড্ডার মেজাজে বলেন অমর মিত্র। 
তারপর তাঁর চোখে ভাবনা ঘনিয়ে আসে। নিজের মনে বলতে শুরু করেন তাঁর উজ্জয়নী আবিষ্কারের গল্প। আমরা শুনতে থাকি কেমন ভাবে আত্মীয়ভবনে গিয়ে তিনি উজ্জয়িনী দেখেন প্রথমবার। দেখেন মহাকাল মন্দির। চলোর্মি বেত্রবতীর সাক্ষাত না পেয়ে ক্ষুব্ধ হন। আমরা শুনি, দ্বিতীয়বার কেমন ক'রে গোয়ালিয়রের এক সাহিত্য সভা থেকে ফেরার পথে তিনি আবার উজ্জয়িনীতে আসেন। এক গাছের নীচে বসে থাকতে থাকতে তাঁর মনে হয়েছিল যেখানে এখন মাত্র চোদ্দ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয় সেখানেই কি একদিন শিপ্রার জলছোঁয়া বাতাস সারসদের কলতান বহুদূর বয়ে নিয়ে যেত? তখনই তাঁর মনে খরা ও বৃষ্টির বিপ্রতীপতাময় এক কাহিনী দানা বাঁধতে থাকে। " আসলে, বাঁকুড়ার খরা নিজের চোখে না দেখলে খরার রূপ ফোটাতে পারতাম না আমি। বলা যেতে পারে বাঁকুড়া আর উজ্জয়িনী এখানে এক হয়ে গেছে।" লেখক বলে চলেন তাঁর প্রস্তুতি পর্বের কথা : গ্রন্থ পাঠ, কালিদাসের নাটক দেখা আর সবশেষে এপিফেনি। "উদয়গিরি গেলাম একদিন। এই উদয়গিরিই হ'ল মেঘদূতের নীচৈঃ পর্বত। এখানেই পাথর দিয়ে গাঁথা নির্জন খালি ঘরে প্রেমিক প্রেমিকারা প্রেম করত। দেওয়ালের গায়ে নিজেদের নাম লিখত। এখান থেকে নীচের দিকে চেয়ে বনযুথিকার গাছ দেখলাম কি না ঠিক বুঝলাম না। তবে, জঙ্গল দেখলাম। দেখলাম সাদা ফিতের মত নীচে পড়ে আছে নদীটা। আর তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি সেই মেঘ হয়ে উঠলাম। মেঘের চোখ দিয়ে দেখলাম সবটা।" আমাদের গায়ে কাঁটা দিল। আমরা মনে মনে আবৃত্তি করতে লাগলাম : নীচৈরাখ্যং গিরিমধিবসেস্তত্র বিশ্রামহেতো...( বিশ্রামের জন্য তুমি নীচৈঃ নামক পর্বতে বাস করবে)। 

" লিখতে শুরু করার পর পঁচাত্তর পাতা লিখে ফেলে রেখেছিলাম। মাঝখানে একবার মনে হয়েছিল এভাবে হবে না। পুরো ফর্মটা বদলাতে হবে। তারপর আবার মনে হ'ল না ঠিকই আছে। লিখতে শুরু করলাম। লেখাটা নিজেই নিজেকে চালিয়ে নিয়ে গেল। পুরোটাই আমার কল্পনা। ওয়েস্টল্যাণ্ড কী আমি জানি না।" 

দ্বিধাগ্রস্ত মন নিয়ে ঘরে ফিরে উপন্যাস এবং কবিতা আবার একবার পড়লাম। আর, আবিষ্কার করলাম যে দুটির মৌলিক চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। অমর মিত্রের উপন্যাসে ছত্রে ছত্রে স্পন্দিত জাগ্রত জনজীবন। ভারতাত্মা মূর্ত এ কাহিনীতে। দেবদাসী, গণিকা, রাজ্ঞী, সামান্য গৃহবধূ, শূদ্রাণী, শূদ্র, নিষাদ, রাজা, কবি নিয়ে লেখক গড়ে তুলেছেন তাঁর কথনবাস্তব। কুমারসম্ভব ও মেঘদূতের মিলনে তিনি স্পষ্ট ভাবে বলেছেন যে সমাজ যখন বন্ধ্যত্বের দিকে এগোয় তখন সমাজশরীর থেকেই জেগে ওঠে নূতন প্রাণ। কবি তখন জয়গান করেন সেই চিরজীবিতের। 

অপরদিকে, এই উত্তরণ অন্তত The Waste Land এ সম্ভব হয়নি Eliot এর পক্ষে। তাঁর সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার বা ঔপনিষদিক দর্শন কোথাওই কোনও বহমান জীবন স্রোতের দেখা পান নি তিনি। এক ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্য থেকে তিনি বর্ষার মেঘের অভিজ্ঞতার স্মৃতিরেশই অনুভব করতে পেরেছেন কেবল। কথককন্ঠস্বর তাই অবহ একাকীত্বের যন্ত্রণা নিয়ে আর্তনাদ ক'রে ওঠে : "Shall I at least set my lands in order?" এই সংশয়দীর্ণ উচ্চারণ ধ্রুবপুত্রের মধ্যে আমরা পাই না।

পঠন শেষে আমরা নিঃসংশয় হই অমলধ্রুবকে অমৃতের পুত্রদের মধ্যে দেখতে পান যে ঔপন্যাসিক পাঠকচিত্তে তিনি অমর হয়ে রইবেন চিরদিন।।

0 comments: