প্রাচীনকথা - মিথিল ভট্টাচার্য
Posted in প্রাচীন কথা
প্রাচীনকথা
পরাহত ভাগ্যনায়ক
মিথিল ভট্টাচার্য
অন্তিম পর্ব
একদৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন মথুরা তথা সমগ্র আর্যাবর্তের ভবিষ্যৎ ভাগ্যনায়ক।
নব সূর্যের লালিমা একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ছে মথুরার শুভ্র প্রাসাদের উপরে। বহু যুগ পর আসা এক নতুন যুগকে যেন অধীর আগ্রহে স্বাগত জানাচ্ছে এই প্রাচীন অট্টালিকা। এত বছর তারই অপেক্ষায় ছিল কি এই প্রাচীন নগরী?
একটি গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে প্রাসাদের সীমানা অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে এলেন কিশোর বাসুদেব।
ভোর হতে অল্প দেরী। নগরী যেন এখনও নিদ্রার জাল কেটে মুক্ত করে উঠতে পারেনি নিজেকে। একটা স্বল্প হাসির রেখা ফুটে উঠলো কৃষ্ণ বর্ণের রাজকুমারের মুখে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলেন রাজপ্রাসাদের বাইরের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা মুখ্য অশ্বশালার দিকে। আলো আঁধারিতে যেন এখনও স্তব্ধ হয়ে আছে এই বিরাট অশ্বশালা , শুধু একজন বৃদ্ধ মানুষ এককোণে একটি অশ্বের পায়ে লোহার নাল পড়াচ্ছেন। দৃঢ় পায়ে মানুষটির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন সেই কিশোর।
চমকে উঠে বলে উঠলেন মানুষটি, ‘রাজকুমার কৃষ্ণ, আপনি এখানে? এত ভোরে? কোনও প্রয়োজন ছিল আমাকে?’
একটু হেসে, মধুর স্বরে উত্তর দিলেন কৃষ্ণ, ‘একই প্রশ্ন আমারও, মহাশয় সুধর্মা, গত কাল আপনিই আমাদের সারথি হয়ে মহাসামন্তের রথে করে নিয়ে এসেছেন। আর এত ভোরে আপনি এখানে? কোনও বিশেষ প্রয়োজন?’
কুন্ঠিত স্বরে বলে উঠলেন মহাসামন্তের সারথি, ‘না কুমার। সেরকম কোনও প্রয়োজন নয়। কিন্তু, গতকালের দুর্ঘটনার পর ঘোড়া দুটো ভীত হয়ে পড়েছিল। অল্প বিস্তর আঘাতও পেয়েছিলো। তাইওদের তত্ত্বাবধান করতেই আসা।’
সস্নেহে অশ্বের কেশরে হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন কৃষ্ণ। মৃদু স্বরে সে বলে ওঠেন, ‘খুব ভালো লাগলো দেখে মহাশয় সুধর্মা, আপনি শুধু অশ্বের সারথিই নন, তাদের সঙ্গে ভালোবাসার বন্ধনেও জুড়েছেন নিজেদের। এই অসহায় প্রাণীগুলো ভালোবাসার কাঙাল, একবার এদের নিজের অন্তরে স্থান দিয়ে দেখুন, জীবনের কোনও মুহূর্তেই কখনও এরা আপনাকে একা ছেড়ে যাবেনা।’
অল্প হেসে সম্মতি দিলেন বৃদ্ধ সারথি।
নিজের কালো গভীর চোখ দুটি দিয়ে বৃদ্ধ মানুষটির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলে উঠলেন কৃষ্ণ, ‘আপনার কাছ থেকে এই অশ্ব বিদ্যা শেখার ইচ্ছা রইলো মহাশয় সুধর্মা, শেখাবেন তো আমাকে?’
দুই হাত জড়ো করে, কুন্ঠা ভরা স্বরে বলে উঠলেন মানুষটি, ‘এই ভাবে আমাকে লজ্জায় ফেলবেন না রাজকুমার। আপনার মতন একজন ক্ষত্রিয় রাজকুমারের এই তুচ্ছ বিদ্যা শেখার প্রয়োজন কেনপড়বে ? এই সামান্য বিদ্যা যে আমাদের মতন দরিদ্র মানুষদের জন্য কুমার।’
নিজের হাত দুটি বাড়িয়ে, সরল মানুষটির জড়ো করা হাত দুটিকে আঁকড়ে ধরে, মধুর স্বরে বলে উঠলেন শ্যামল বর্ণের সেই কিশোর, ‘কোনও বিদ্যাকে তুচ্ছ বলে তাকে অপমান করবেন নামহাশয় সুধর্মা। ভবিষ্যতের গর্ভে কী লুকিয়ে আছে, তা কার পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব বলুন? বলা যায়না, হয়তো সুদূর ভবিষ্যতে এই বিদ্যাই হয়ে উঠবে আমার প্রধান অবলম্বন। আর, যদি তাঅধ্যয়নের সুযোগ আপনার মতন একজন প্রাজ্ঞ মানুষের কাছ থেকে পাই তবে তা আমার পরম সৌভাগ্য হবে মহাশয়।’
শ্রদ্ধায় নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই অল্প বয়সী কিশোরের সামনে মাথা নত করে তাঁকে প্রণাম জানান বৃদ্ধ সারথি। এই প্রণাম কোনও রাজবংশকে নয়, কোনও উচ্চ বর্ণের ক্ষত্রিয় কুমারকেনয়; এই প্রণাম আর্যাবর্তের এক ভবিষ্যৎ ভাগ্যনায়ককে।
অল্প হেসে বলে ওঠেন সেই মানুষটি, ‘আরেকটি প্রশ্ন আপনাকে করার ছিল মহাশয় সুধর্মা।’
শশব্যস্ত হয়ে বলে ওঠেন মানুষটি, ‘হ্যাঁ কুমার বলুন।’
গভীর স্বরে বলে উঠলেন কৃষ্ণ, ‘মহাশয় সুধর্মা, আপনি একজন প্রাজ্ঞ সারথি। আপনার কি মনে হয় কাল যে দুর্ঘটনা ঘটনা ঘটল, তা নিতান্তই কাকতালীয়? নাকি সবটাই পূর্ব পরিকল্পিত? আপনার এত বছরের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান আপনাকে কিসের আভাস দেয় ?’
কুণ্ঠার সঙ্গে বলে ওঠেন প্রবীণ সারথি, ‘কুমার, আমি এক তুচ্ছ অশ্ব সারথি। এই বিষয়ে কিছু বলা কি আমার সাজে ?’
একটু হেসে, দৃঢ় স্বরে বলে ওঠেন কৃষ্ণ, ‘বরং এই বিষয়ে সব থেকে বেশি আপনার মতামত গুরুত্বপূর্ণ, মহাশয় সুধর্মা। অশ্ব এবং রথবিদ্যার বিষয়ে আপনার মতন জ্ঞানী একজন মানুষেরমতামত যদি গুরুত্বপূর্ণ না হয়, তবে কার মতামত হবে তা আমি বুঝতে অসমর্থ মহাশয়। আর, আপনি যদি ভীত হয়ে কিছু বলতে না চান, তবে আমি আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আজ আপনি আমাকে যা বলবেন, তা আমি এবং আপনি ভিন্ন আর কেউ কোনও দিন জানবে না। আপনার বলা প্রতিটি শব্দ শুধু আমার অন্তরের গণ্ডীতেই সীমাবদ্ধ রয়ে যাবে। আপনি যদি কিছু বলতে চান, তবে তা নির্ভয়ে বলতে পারেন।’
তাঁর মুখের দিকে একমুহূর্তের জন্য তাকিয়ে রইলেন বৃদ্ধ সারথি সুধর্মা। তারপর, সব কুন্ঠা, ভয়ের প্রাচীর ভেঙে, দৃঢ় স্বরে বলে উঠলেন মানুষটি, ‘কুমার, কাল যে ঘটনা ঘটেছে, আমার জ্ঞান ওবুদ্ধি অনুযায়ী তা কোনও ভাবেই স্বাভাবিক হতে পারে না। ওই ভাবে, আচমকা, পথের মাঝখানে, বাইরে থেকে অদৃশ্য গর্তের উপস্থিতি; আর ঠিক সেই সময়েই ক্ষিপ্ত গজরাজের ছুটে আসা, এস্বাভাবিক হতে পারেনা কুমার। আর শুধু তাই নয়, সব থেকে বড় প্রশ্ন ওই গহব্বর। ওই গহ্বর কোনও স্বাভাবিক গহব্বর ছিলনা কুমার। এই গহব্বরকে আমরা অশ্ব বিদ্যায় শিক্ষিতরা বলে থাকিঅশ্ব ত্রাস গহব্বর। একবার এই ধরণের বিশেষ গহব্বরে কোনও রথের চাকা পড়লে, তা বার করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। আর বিশেষ করে এই গহব্বরে রথের চাকা একবার বসে গেলে অশ্ব এতআতংকিত হয়ে পড়ে যে, তাকে শান্ত করে দুষ্কর হয়ে ওঠেযতাকে শান্ত না করতে পারলে রথকে এই গহব্বর থেকে তোলা অসম্ভব। তাই...’
তাঁর অসম্পূর্ণ কথাকে সম্পূর্ণ করে একটু হেসে বলে ওঠেন কৃষ্ণ, ‘আর তাই, কালকের এই ঘটনা আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে আমাদের সামনে এসে ধরা দেয়; তাইতো মহাশয় সুধর্মা? কালকে অশ্বকে শান্ত করা আরও অসম্ভব হয়ে উঠেছিল ক্ষিপ্ত গজরাজের উপস্থিতিতে, অশ্ব শান্ত না হলে রথের চাকা গহব্বর থেকে বার করা অসম্ভব। অর্থাৎ, গজরাজের পায়ের তলায় আমাদের সমাধিনেওয়া একপ্রকার নিশ্চিত ছিল, তাইতো? সুতরাং, ঘটনার পরম্পরাকে সাজালে এই সত্যই প্রতিভাত হয়ে ওঠে যে, কাল আমাদের জন্য মরণপাশই অপেক্ষা করছিলো প্রবল আগ্রহে। ধন্যবাদমহাশয় সুধর্মা, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। সমস্ত সংশয়কে মুছে দিয়ে আপনি আমাকে সত্যের কাছে পৌঁছে যাওয়ার পথে দেখিয়ে দিলেন আজ।’
পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় মাথা নত করে আবার প্রণাম জানান বৃদ্ধ সারথি।
একটু হেসে বললেন কৃষ্ণ, ‘ভোরের আলো ফুটে উঠছে মহাশয় সুধর্মা। এতক্ষণে বোধ হয় মাতুল প্রবল চিন্তায় আমার খোঁজ শুরু করে দিয়েছেন। এবার আমাকে প্রাসাদে ফিরতে হবে, কিন্তু খুবদ্রুত আপনার সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে। আপনার কাছ থেকে অশ্ব বিদ্যার শিক্ষা নিতে খুব শীঘ্রই আবার আসবো আমি, প্রস্তুত থাকবেন।’
উজ্জ্বল হাসি ভরা মুখে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন বৃদ্ধ মানুষটি। আর, দ্রুত পায়ে পিছন ফিরে মথুরার রাজপ্রাসাদের দিকে রওনা দিলেন মথুরার রাজকুমার।
সুর্যোদয় হয়েছে অল্প সময় আগেই। আজকের নতুন সূর্য যেন নিজের পূর্ণ শক্তি নিয়ে আলোক রশ্মি বিকিরণ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
শুভ্র প্রাসাদ যেন চির উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে আজ এই নব অরুণের পরশ পেয়ে।
দৃঢ় পায়ে রাজপ্রাসাদের প্রাঙ্গণে এসে পৌঁছন কৃষ্ণ। কিন্তু, প্রাসাদের দিকে এগোনোর আগেই একটি অদ্ভুত দৃশ্যে তাঁর গতি স্তব্ধ হয়ে যায়। রাজপ্রাসাদের রক্ষীদের সঙ্গে প্রবল তর্কে লিপ্ত হয়েছেতাঁরই বয়সী এক কিশোর। বয়স কিছু অল্প হওয়াও অসম্ভব নয়। কিন্তু, অবিশ্বাস্য তেজ ও সাহসের সঙ্গে সে বিবাদে লিপ্ত হয়েছে তার প্রায় দ্বিগুণের আকারের দুই যমরূপী রক্ষীর সঙ্গে। প্রবল কৌতূহলে কিশোরটির দিকে এগিয়ে গেলেন কৃষ্ণ। তাদের বিবাদের কয়েকটি টুকরো টুকরো কথা ভেসে এলো তাঁর কানে,
- সম্মান বস্তুটা পদমর্যাদার মুখাপেক্ষী নয়। যখন, এই অসহায়া বৃদ্ধাকে আপনারা অপমান করেছেন তখন ক্ষমা প্রার্থনা তো আপনাদের করতেই হবে, নচেৎ ...
ক্রোধে প্রায় রক্তিমবর্ণ ধারণ করে, অসি বার করে,বজ্রধ্বনির শব্দে বলে উঠলো দুই প্রহরী, ‘নচেৎ কী? এখনও কৈশোরে পা রাখোনি, এতো দুঃসাহস কোথা থেকে আসে তোমার? কে তুমি?পরিচয় দাও নিজের।’
কিশোরের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মধ্যবয়সী মানুষ ভীত স্বরে বলে উঠলেন, ‘কুমার, দয়া করে অনুমতি দিন। আপনার পরিচয় এদের জানাই। না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে যেতে পারে। আমার অনুরোধ কুমার। বলতে দিন আমাকে।’
মধ্যবয়সী মানুষটির দিকে ফিরে, দৃঢ় স্বরে বলে উঠলো সেই কিশোর, ‘না অনুমিত্র, এক বীরের পরিচয় শুধু তার শস্ত্র হতে পারে। আর কিছু না। আর একটু আগেই আমি নিজের মুখে বলেছি -সম্মান বস্তুটি পদমর্যাদার মুখাপেক্ষী নয়। নিজের সম্মান রক্ষার্থে তার ব্যবহার কীরূপে করতে পারি আমি? আমার পরিচয় আমার এই অসি।’
সদর্পে নিজের অসি বন্ধন মুক্ত করে দুই প্রহরীর দিকে এগিয়ে যায় বীর কিশোর।
অন্যদিকে উন্মুক্ত তরবারি নিয়ে তার দিকে ক্ষিপ্ত বৃষের মতো এগিয়ে আসছে দুই কালান্তক প্রহরী। আর শুধু কয়েকটি মুহূর্তের ব্যবধান। তার পরেই শুরু হবে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। অনুমিত্র নামের মানুষটি ভয়ে নিজের চোখ বন্ধ করে ফেলেছেন। কিন্তু হঠৎ করে একটি মধুর অথচ দৃঢ় স্বর দুই পক্ষকেই বিরত করে এই সংগ্রামে অংশ নেওয়ার থেকে। সভয়ে চোখ খুলে অনুমিত্র দেখেন,তাঁর কুমারেরই প্রায় সমবয়সী, কৃষ্ণ বর্ণের এক অদ্ভুত সুদর্শন কিশোর একটি বিচিত্র হাসি মুখে নিয়ে তাকিয়ে রয়েছেন তাঁদের দিকে।
দুই পক্ষই কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল।
দৃঢ় পদক্ষেপে দুই পক্ষের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ান কৃষ্ণ। একটু হেসে, মধুর স্বরে বলে ওঠেন, ‘ক্ষমা করবেন আমায়, কিন্তু আপনাদের বিতর্ক শুনে সমস্ত জানার লোভ থেকে বিরত হয়ে থাকতেপারলাম না। কৌতূহল বড় প্রবল হয়ে উঠলো। যদি জানতে পারি কী ঘটনা থেকে এই দ্বন্দ্ব যুদ্ধের সূত্রপাত হতে চলেছে তবে কৌতূহল নিবৃত্ত হতো। যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে তবে আমি কিজানতে পারি কী কারণ এই বিতর্কের ?’
রক্ষদ্বয় গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো, ‘সব কিছুর মুলে এই অকালপক্ক কিশোরের জেদ, আর কিছুই না। সামান্য বিষয়কে বিষম আকার দিয়েছে সে। না হলে এসবের প্রয়োজনই থাকেনা।’
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ফুঁসে উঠলো সেই কিশোর : ‘সামান্য বিষয়? একজন পিতামহীর বয়সী নারীকে উৎকোচের জন্য পীড়ন করা, আর শেষ অবধি সে দিতে অসমর্থ হওয়ায় তাকে ঠেলে ফেলে দেওয়া, এটা সামান্য বিষয়? তাহলে বলুন, এটাই মথুরার স্বাভাবিক চিত্র। অবশ্য যে নগরী এখন কংসের অধীনে, তার চিত্র আর কী ভিন্ন হতে পারে?’
গর্জন করে উঠলো দুই প্রহরী ‘সাবধান মুর্খ কিশোর, এত সময় অবধি তোমার অসংখ্য প্রগলভতা সহ্য করেছি, কিন্তু আর নয়। মহারাজের বিরুদ্ধে আর একটি কথা বললে তোমার মস্তক আরস্কন্ধের উপর থাকবে না।’
অসি দৃঢ় হাতে তুলে ধরে শাণিত স্বরে বলে উঠলো সেই কিশোর, ‘কার মস্তক স্কন্ধের উপর থাকে তার বিচার যুদ্ধের আগে করা অনুচিত বীর। যদি এতই সাহস থাকে তবে এগিয়ে আসুন যুদ্ধে।’
সংগ্রামের আবার সূচনা হওয়ার আগেই দুই পক্ষের ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়ান কৃষ্ণ।
একটু হেসে সে ওই কিশোরের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘যুদ্ধ তো যেকোন মুহূর্তে শুরু করা যায় মিত্র। কিন্তু, বিষয়টিকে যদি আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করা যায় তবে তাতে সমস্যা কোথায় বলতে পারো ?’
দুই প্রহরীর দিকে ফিরে মৃদু পরিহাসলঘু স্বরে তিনি বলে ওঠেন, ‘ভুল কিছু তো করেননি আপনারা। মথুরা নগরীতে এসেছেন ওই বৃদ্ধা, তার সম্মানীয় রক্ষীদের জন্য কিছু সামান্য দক্ষিণাও আনবেন না? একি আচরণ! তার বদলে যদি আপনারা কিছু রূঢ় বাক্য বলেন বা তাঁকে ঠেলে দিয়েই থাকেন, তাতে অন্যায় কোথায়?’
দুই রক্ষীর ঠোঁটের কিনারায় ফুটে ওঠে একটি বিজয় গর্ব মাখানো হাসির রেখা। তীব্র স্বরে প্রতিবাদ করে উঠতে যায় সেই কিশোর, কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে কৃষ্ণ বলেন, ‘কিন্তু, বিষয়টা কী জানেন? এই অতিতুচ্ছ বিষয়টাকেই আবার কিছুলোকের বড় করে দেখার খারাপ স্বভাব থাকে। এই যেমন দেখুননা, মহারাজ কংস না হয় উদার মনের বিচক্ষণ নৃপতি; তিনি এই সামান্য বিষয় চিন্তাতেও আনবেননা। কিন্তু শুনছি, তিনি নাকি তার ভাগিনেয়দের হাতে রাজ্য তুলে দিয়ে এবার অবসর নিতে চান। বলা যায়না,তারা অপরিণত মস্তিষ্কে এই সামান্য ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেয়। শুনেছি তো তারা বড় হয়েছে ছোট গ্রামের পরিবেশে, এই সব বড় বড় নগরীর রীতি কি তারা বুঝবে ?
তারপর ধরুন, মহারাজের অবসরের পর যদি যাদব গোষ্ঠী নতুন করে শাসন ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে, তখন? যদি তারা এই সমস্ত তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় অধিক গুরুত্ব দিয়ে বিচার শুরু করে,তবে? জানেন তো, যাদব গোষ্ঠীর বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশে নারীর সম্মান নিয়ে কত সব পুরনো রীতি নীতি প্রচলিত আছে। এই তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় যদি অতিরঞ্জিত হয়ে তাদের কানে যায়? কর্ম বজায় রাখা তো দুরস্ত, এদের তো আবার শিরশ্ছেদের বাড়াবাড়ি করার স্বভাবও রয়েছে। কী পুরাতন ধ্যানধারণা বলুন তো? তবে, এই সব অহেতুক বিষয় নিয়ে আপনাদের অতো ভাবার প্রয়োজন নেই। ভুল কিছু তো করেননি আপনারা! যা হবে দেখা যাবে।
নিজের কর্মে অবিচল থাকতে যদি মস্তকও হারাতে হয় তবে তাতে ভয় বা লাজ কিসের?’
একটু হেসে দুই রক্ষীর মুখের দিকে ফিরে তাকান কৃষ্ণ।
তাঁর সামনে ভয়ে, আশংকায় দুটি প্রায় রক্তশূন্য মুখ। একজন প্রায় বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল।
অন্য জন একটু গলা খাঁকরে, মধুর স্বরে, বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘আইমা, তুমি আহত নও নিশ্চয়ই? তুমি যে কিভাবে পা ফস্কে পড়ে গেলে, আমরা তো বুঝতেই পারলাম না। তোমাকে ধরতে গেলাম, তার আগেই তুমি পড়ে গেলে। তুমি বিশ্রাম নাও, হ্যাঁ? আমরা অন্য দিকে একটু টহল দিয়ে আসি। আর কোনও দরকার হলে বিনা দ্বিধায় বোলো। আমরা তোতোমার সন্তান তুল্য। তোমার যে কোনও আদেশ আমাদের শিরোধার্য।’
তারপর কৃষ্ণের দিকে চেয়ে আরও মধুর স্বরে বলল, - ‘ভ্রাতা আপনিই তাহলে আপাতত আইমার একটু খেয়াল রাখুন। আমরা নগরীর অন্য প্রান্তে টহল দিয়ে এক্ষুনি আসছি। আর দেখুননা, একটা সামান্য বিষয় নিয়ে কি ভুল বোঝাবুঝি হলো। আইমার পা ফস্কালো, এবং এই নবীন বন্ধু মনে করলেন আমরা বোধ হয় তাকে ঠেলা দিয়েছি। অবশ্য, আমাদেরই ওঁকে অবলম্বন দেওয়া উচিত ছিল। এই সামান্য বিষয় আর বাড়িয়ে কি লাভ বলুন? এইবিষয়টি না হয় শেষ করা যাক।’
ততোধিক মধুর স্বরে উত্তর দিয়ে উঠলেন কৃষ্ণ, ‘অবশ্যই মান্যবর। কিন্তু আইমা মনে হয় পড়ে গিয়ে সামান্য আঘাত পেয়েছেন। আমরা তো এখানে বৈদ্য খুব ভালো চিনি না। আপনারা যদি তাকে একটু অবলম্বন দিয়ে নিয়ে যেতেন। সর্বোপরি আপনারা তাঁর সন্তান তুল্য।’
শশব্যস্ত হয়ে, মাথা নেড়ে, বৃদ্ধাকে দুই দিক থেকে অবলম্বন দিয়ে, তাঁকে বৈদ্যের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য এগোয় দুই প্রহরী। আর স্তব্ধ হয়ে তাঁর মুখের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সেই নবীন কিশোর।
তার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলে ওঠেন কৃষ্ণ, ‘কী দেখছো মিত্র?’
হতবাক স্বরে বলে ওঠে সেই বীর কিশোর, ‘দেখছি আপনাকে, মহাশয়। কত সহজে বিনা কোনও রক্তপাতে এদেরকে সঠিক পথে নিয়ে এলেন আপনি। শুধু কয়েকটি বাক্যের প্রয়োগে! কীভাবে করলেন আপনি এই কাজ?’
একটু হেসে বলেন কৃষ্ণ, ‘তোমার সাহস ও ন্যায় অন্যায় বোধে আমিও মুগ্ধ হলাম মিত্র। কিন্তু যেখানে শুধু বাক্যের প্রয়োগের দ্বারাই কৌশলে সমস্যার সমাধান হতে পারে, অন্যায়ের বিনাশ ঘটে,সেখানে বল প্রয়োগের কীই বা প্রয়োজন? হ্যাঁ, কোনও কোনও সময় বল প্রয়োগ ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না। সেই সমস্ত সময়ের জন্যই নিজের শক্তিকে প্রস্তুত রাখাটাই কি বুদ্ধিমানের কাজ নয় ?’
একটা প্রাণখোলা হাসিতে নিজের উজ্জ্বল মুখটি ভরিয়ে বলে উঠলো সেই কিশোর, ‘আপনার সমস্ত কথার রহস্য ভেদ করা আমার পক্ষে অসম্ভব মহাশয়। কিন্তু, এইটুকু বুঝতে পারলাম, অনেক গভীর আপনার চিন্তার ক্ষমতা। আমি নিজেকে সম্মানিত বোধ করছি আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পেরে, আপনার কাছ থেকে মিত্র সম্বোধন পেয়ে। তা নিজের এই মিত্রকে নিজের পরিচয় দেবেন না? আমি। ...’
কিশোর আর কিছু বলার আগেই পিছন থেকে এগিয়ে আসে একজন ব্যক্তি। শশব্যস্ত হয়ে সে বলে ওঠে, ‘কুমার আপনার পিতামহের দূত এসেছে, আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য সে উদগ্রীব।আপনি শীঘ্র একবার আসুন।’
কিশোর তার দিকে ফিরে ব্যস্ত স্বরে বলে ওঠে, ‘আপনি একটু অপেক্ষা করুন মিত্র। আমি দূতের সঙ্গে দেখা করে এক্ষুনি আসছি।’
দ্রুত পায়ে প্রাসাদের অন্যদিকে এগিয়ে যায় সেই বীর কিশোর। একটু হেসে তার ফেলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকেন কৃষ্ণ। যতটা অভিভূত এই কিশোর তাঁকে দেখে হয়েছে ঠিক ততটাই তিনি আপ্লুত অনুভব করেছেন এর সঙ্গে পরিচিত হয়ে। এতটা প্রাণশক্তি, ন্যায় অন্যায় বোধ এবং সর্বোপরি সাহস তিনি তার এই স্বল্প জীবনে এখনও পর্যন্ত খুব কম দেখেছেন। যেই হয়ে থাক এই কিশোর, খুব সামান্য কেউ এ নয়। কোনও বিরাট ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠাই যেন শাশ্বত অক্ষরে লেখা আছে এর ভাগ্যে!
একটা ব্যস্ত স্বর তাঁকে তাঁর চিন্তার জগৎ থেকে একমুহূর্তে বাস্তবের মাটিতে নামিয়ে নিয়ে আসে, ‘কুমার আপনি এখানে? আপনার মাতুল সেই কখন থেকে অধীর আগ্রহে আপনার জন্য অপেক্ষাকরে চলেছেন! শীঘ্র প্রাসাদে চলুন, মহারাজ কংস দুশ্চিন্তায় এবার আপনার সন্ধানে প্রাসাদের চারদিকে সৈন্যদলের তল্লাশি না শুরু করিয়ে দেন!’
অল্প হেসে বলে উঠলেন কৃষ্ণ, ‘চলুন মহাসামন্ত। মাতুলকে আর বেশি অপেক্ষা করানো সঠিক হবে না।’
একটিবার ওই কিশোরের ফেলে আসা পথের দিকে ফিরে তাকিয়ে নিজের মনে বলে ওঠেন তিনি, ‘যদি আমাদের মিত্রতা ভাগ্যে লেখা থাকে, তবে তা নিশ্চয়ই সত্য হয়ে দেখা দেবে বন্ধু। আজ তোমার পরিচয় আমি জানি না; আর আমার পরিচয় তুমিও। কিন্তু, আমার অন্তর বলছে, ভবিষ্যতে সুদীর্ঘকাল ধরে অক্ষয় হয়ে থাকবে আমাদের মিত্রতা। খুব শীঘ্রই আবার দেখা হবে আমাদের। প্রস্তুত থেকো বন্ধু।’
মহাসামন্ত অক্রূরের সঙ্গে দ্রুত পা ফেলে মথুরার শুভ্র প্রাসাদের দিকে এগিয়ে যান কৃষ্ণ।
মুখোমুখি প্রথমবারের জন্য দাঁড়িয়েছেন প্রায় একযুগ ধরে একে অপরের জীবনের দিশা বদলে দেওয়া দুই মানুষ। এই প্রথমবার একে অপরকে নিজের চোখে দেখছেন। কিন্তু, মনে হয় যেন তাঁরা দুজনেই পরস্পরকে চেনেন কয়েক জন্ম ধরে। একে অপরকে না চিনেও, চেনার এক প্রয়াস করে গেছেন তাঁরা গত পনের বছর।
কিছুসময়ের জন্য নির্বাক হয়ে শুধু একে অপরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তাঁরা। যেন পরস্পরের দৃষ্টির মধ্যে দিয়ে একজন চিনে নিতে চাইছেন অন্যজনের শক্তি ও দুর্বলতাকে।
মাতুলের দৃঢ় ব্যক্তিত্বের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভয়, লোভ ও আশংকার বিকৃত রূপটাকে যেন নিজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চিনে নিতে চান কৃষ্ণ! আর অন্যদিকে, ভাগিনেয়র মায়াবী কালো দুই চোখের দৃষ্টিতেযেন হারিয়ে যান মথুরাধিপতি মহারাজ কংস! আজ অবধি বহু মানুষের দুই চোখের দিকে তাকিয়ে তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে বুঝে নিতে সক্ষম হয়েছেন তিনি, কিন্তু এইরকম অদ্ভুত দৃষ্টির মুখোমুখি হবার অভিজ্ঞতা আজ পর্যন্ত হয়নি তার! একি দৃষ্টি ! এ কোন রহস্য লেগে আছে ওই দুটি কালো চোখের তারায়? কেন তাঁর বারবার মনে হচ্ছে, অপরিমিত ক্ষমতা লুকিয়ে আছে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই কিশোরের মধ্যে। ভালো এবং মন্দ উভয় শক্তিকেই চরম পর্যায়ে পৌঁছে দেবার, সৃষ্টি ও বিনাশ দুই করারই যেন অপরিসীম সামর্থ্য লুকিয়ে আছে এই নবীন প্রাণের অন্তরে।
একমুহূর্তের জন্য নিজেকে নিজে শাসন করে ওঠেন মথুরাধিপতি। এইসব কি ভাবছেন তিনি? এক সামান্য কিশোরকে কেন এত গুরুত্ব দিচ্ছেন? না না, এই সব আর কিছু নয়। এসব শুধু ওইবিশ্বাসঘাতক কালীয় সর্দারের অভিশপ্ত পত্রের ফল। ওই পত্রের কথাগুলোই তাঁর মস্তিষ্কে ভ্রান্ত চিন্তার প্রবেশ ঘটাচ্ছে!
জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলেন তিনি, ‘আমি তোমারই অপেক্ষায় ছিলাম ভাগিনেয়। তুমি নগর ভ্রমণ করতে গিয়েছিলে, জানাতে পারতে তো আমাকে। আমি তো নিজেই আজ তোমাকে নিয়ে মথুরা নগরী পরিভ্রমণে বেরোবো আশা করেছিলাম’।
মধুর হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলে উঠলেন কৃষ্ণ, ‘অপরাধ নেবেন না মাতুল। এই অদ্ভুত সুন্দর নগরীকে নিজের চোখে একবার দর্শন করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারলামনা। ভবিষ্যতে এইসুন্দর নগরীকেই যে শাসন করতে হবে আমাকে তাইনা? তাই তো আপনার মনোকামনা, তাই না মাতুল?’
একটু হেসে নত হয়ে মহারাজ কংসের পদধুলি গ্রহণ করেন কৃষ্ণ।
অন্তরের মধ্যে জমে ওঠে প্রচণ্ড ক্রোধকে আপ্রাণ চেষ্টায় স্তিমিত করে, একটু হেসে বলে ওঠেন কংস, ‘যশস্বী হও ভাগিনেয়। হ্যাঁ এই নগরী যে তোমারই। তোমার হাতে তোমার অধিকার তুলে দিয়ে তোমার এই ক্লান্ত মাতুল অবশেষে নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়।’
ঠোঁটের কিনারায় মধুর হাসিটি নিয়ে বলে ওঠেন কৃষ্ণ, ‘চিন্তা করবেন না মাতুল। যখন যার প্রায়শ্চিত্তের সময় হয়, তখন সেই সুযোগ নিজে থেকেই তার হাতের কাছে তুলে দেন বিধাতা। আপনি যখন এত আন্তরিক ভাবে, সব ভুলে, নিজের অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইছেন তখন নিশ্চয়ই সেই সুযোগ আপনিও পাবেন।’
একটা শুকনো হাসি হেসে বলে ওঠেন কংস, ‘সে তো অবশ্যই। তবে চলো তার আগে তোমাদের দেখিয়ে নিয়ে আসি এই নগরী। তারপর, তোমাকে যুবরাজ পদে অভিষিক্ত করব। প্রিয় ভগিনী এবংভগ্নীপতি দেবকী এবং বসুদেব এবং তোমার মাতামহ, আমার পিতা মহারাজ উগ্রসেনকেও সসম্মানে মুক্ত করতে হবে। আর কোনও বিলম্ব রাখতে চাইনা আমি। চলো ভাগিনেয়, তোমার ভবিষ্যৎ রাজধানী পরিভ্রমণে।’
মহারাজ কংসের সঙ্গে মথুরা নগরীর বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ করে অবশেষে কৃষ্ণ ও বলরাম এসে পৌঁছন কুস্তি প্রতিযোগিতার প্রাঙ্গণে।
মহারাজ কংসের মুখে একটি হাসির রেখা অবশেষে ফুটে ওঠে।
- এই কুস্তি প্রতিযোগিতা মথুরার বহুবছরের ইতিহাস ভাগিনেয়। এই প্রতিযোগিতায় যারা বিজয়ী হয় তাদের মন চাওয়া পুরষ্কার বহু বছর ধরে বিতরণ করা এই প্রাচীন নগরীর ঐতিহ্য হয়েরয়েছে কৃষ্ণ। আবার রয়েছে অদ্ভুত নিয়মের বেড়াজাল। বিজয়ী প্রতিযোগী চাইলেই এই প্রাঙ্গণের যেকোনও মানুষকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আহ্বান জানাতে পারে, যদি সে সেই আহ্বান অস্বীকার করে তবে সমস্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ত্যাগ করে তাকে পরিত্যাগ করতে হয় এই নগরী। আর একবার এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলে দুই প্রতিযোগীর উভয়ই এই প্রতিযোগিতা সমাপ্ত করতে চাইলেও মৃত্যু পর্যন্ত চলবে এই দ্বন্দ্ব যুদ্ধ। তাকে আটকানোর ক্ষমতা কারোর নেই। এমনকি আমার ভাগিনেয়েরও।
তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত হাসি হেসে বলে ওঠেন কৃষ্ণ, ‘চলুন মাতুল, আপনার আপত্তি না থাকলে একবার দেখে আসি এই বিচিত্র প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের।’
গভীর হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলে ওঠেন কংস, ‘যেমন তোমার ইচ্ছা ভাগিনেয়। চল।’...
কিছু সময় পরের ঘটনা।
মল্লভূমিতে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছেন চারজন প্রতিদ্বন্দ্বী। মথুরার দুই কুখ্যাত মল্লযোদ্ধা, রক্তপিপাসু, মানুষরূপী দানব : চাণু্র ও মুষ্টিক। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে প্রথমবার এই মল্লভূমিতে নেমে এসেছেন মথুরার দুই রাজকুমার কৃষ্ণ ও বলরাম।
কংসের বহু যত্নে নির্মিত চক্রান্ত অবশেষে বাস্তবায়িত হতে চলেছে। তাঁর ইশারাতে, কৃষ্ণ ও বলরাম মল্লভূমিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই, তাঁদের বল এবং সামর্থ্যকে তীব্র ব্যঙ্গ করে মল্লযুদ্ধের আহ্বান জানায় তার এই দুই রক্তপ্রেমী মহাযোদ্ধা। অবশ্যই এর সঙ্গে সঙ্গেই বহু মানুষ, বিশেষ করে মহাসামন্ত অক্রুর এর তীব্র প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন। কিন্তু তাঁদের শান্ত করে নিজে থেকে এগিয়ে যান কৃষ্ণও বলরাম। একটা বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে কংসের ঠোঁটের এক কিনারায়। অবশেষে, তিনি নিষ্কৃতি পেতে চলেছেন তাঁর সব থেকে বড় শত্রুর হাত থেকে। ...
অর্ধ প্রহর পরের ঘটনা। ...
হতবাক হয়ে মল্লুভূমির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন মথুরাধিপতি।
তাঁর এতো সাধের চক্রান্ত কোনও এক অদৃশ্য শক্তির অঙ্গুলিহেলনে ভস্ম হয়ে পড়ে রয়েছে চাণুর ও মুষ্টিকের মৃতদেহের রূপে।
তিনি এখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারছেননা যে তাঁর সামনে এই মাত্র কি ঘটনা ঘটল।
তাঁর নগরীর শ্রেষ্ঠ মল্লদ্বয়ের মৃত্যু হলো দুই কিশোরের হাতে!
বলরামের সঙ্গে মুষ্টিকের যুদ্ধের ফলাফল তাও তিনি কিছুটা হলেও বুঝতে পারেন। রোহিনীপুত্র সত্যিই অসীম বলশালী এবং মল্লবিদ্যায় সুপণ্ডিত। কিন্তু তাঁর জীবনের কুগ্রহ এই কৃষ্ণ? না সে বলরামের সমান বলশালী আর না এই বিদ্যায় তার গভীর জ্ঞান আছে বলে একবারও মনে হলো। তাহলে কোন মন্ত্রে সে প্রাণ কেড়ে নিল ওই মানুষরূপী দানবের? কি অদ্ভুত কৌশলে লড়াই করলো সে ওই দানবের সঙ্গে! চাণুর শত চেষ্টাতে একবারও ছুঁতে পারল না তার এই বিচিত্র প্রতিদ্বন্দ্বীকে। আর কোন এক অজানা কৌশলে একের পর এক আঘাতে এই রক্তপিপাসু দানব প্রথমবার পেলোনিজের রক্তের স্বাদ!
আর শেষ পর্যন্ত মথুরাধিপতির সমস্ত প্রয়াসকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে তাকে আশ্রয় নিতে হলো ধুলোতেই!
ক্লান্ত শরীরে একমুখ হাসি মুখে নিয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে আসে তাঁর জীবনের অভিশাপ। মধুর স্বরে বলে ওঠে সে, ‘মাতুল মল্লযুদ্ধে বিজয়ী হয়েছি। পুরষ্কার দেবেন না প্রিয় ভাগিনেয়কে?’
কৃত্রিম হাসিতে মুখ ভরিয়ে তুলে বলে ওঠেন মথুরাধিপতি, ‘অবশ্যই কৃষ্ণ।, তোমরা দুই ভাই আজ শুধু আমার নয়, গোটা মথুরার গর্ব। বল কি পুরস্কার চাও ? যা চাইবে তাই আজ তোমায় আমি দেব।’
একটু হেসে কৃষ্ণ বলেন, ‘আপনি নিশ্চিত তো মাতুল, যে পুরস্কার আমি আজ চাইবো আপনি আমাকে দেবেন? দেখুন, পরে মথুরাধিপতি গোটা মথুরার সামনে প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজের দেওয়া কথা অগ্রাহ্য করবেন না তো?’
একটু ইতস্তত করে বলেন কংস, ‘যদি সেই পুরস্কার আমার সাধ্যের মধ্যে থাকে তাহলে অবশ্যই তুমি তা পাবে কৃষ্ণ।’
মিষ্টি হাসেন কৃষ্ণ।
-সাধ্যের মধ্যে তো আপনার অবশ্যই মাতুল। আমি একবার আপনার সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করতে চাই। এই মুহূর্তে, এই প্রাঙ্গণেই।
স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন কংস। একী আকাঙ্খা জানাচ্ছে কৃষ্ণ? ভাঙা স্বরে, ইতস্তত করে বলেন, ‘সবে একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে বিজয়ী হয়ে উঠলে কৃষ্ণ, এত তাড়াতাড়ি আবার সংগ্রামের কি প্রয়োজন বল? তুমি আছো, আমিও মথুরাতেই আছি। এই ক্রীড়া তো পরেও করা যেতে পারে।’
কৃষ্ণ কিছু বলে ওঠার আগেই ভীড়ের মধ্যে থেকে বলে একটি অল্পবয়সী কিশোর, ‘ভুল করছেন মহারাজ। আপনি নিজে একটু আগে বলেছেন যে পুরস্কার বিজয়ী চায় তাই তাকে দেওয়া হয় এই প্রাঙ্গণে। আর শুধু তাই নয়, আপনি এটাও বলেছেন যে, এই প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে থাকা যেকোনও ব্যক্তিকে কোনও বিজয়ী মল্লযোদ্ধা প্রতিস্পর্ধা জানালে তা অস্বীকারের ক্ষমতা থাকেনা অন্য মানুষটির।করলে, ক্ষত্রিয় ধর্ম অনুযায়ী রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্ত অধিকার ত্যাগ করে বনবাস। আপনি নিজেও এই মুহূর্তে মল্লযুদ্ধের প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে রয়েছেন মথুরাধিপতি। কিভাবে রাজকুমার কৃষ্ণের আহ্বান ফিরিয়ে দেবেন আপনি ?’
অসম্ভব ক্রোধে একটা অগ্নি প্রবাহ যেন নেমে যায় মেরুদণ্ড বেয়ে। কিন্তু কোনও উত্তর দেবার আগেই কাছে এসে মৃদু স্বরে বলে ওঠে অমাত্য চন্দ্রক, ‘মহারাজ ভুল করেও কিছু আপত্তিকর বলে বা করে বসবেন না ওই কিশোরের সঙ্গে। এ কোনও সাধারণ কিশোর নয়। আমি আপনাকে যার কথা বলেছিলাম, এ সেই। রাজকুমার যুযুধান, মহারাজ শিনির পৌত্র।’
স্তব্ধ হয়ে যান কংস। মহারাজ শিনির পৌত্র! একে যে বন্দী করাও অসম্ভব। আর, এর বলা প্রতিটি বাক্যকে তিনি অস্বীকারও বা করবেন কিভাবে ?
তিনি কিছু বলে ওঠার আগেই আবার বলেন অমাত্য চন্দ্রক, ‘মহারাজ, যা করার অতিশীঘ্র করুন। দূত মারফত সংবাদ এসেছে যে মহারাজ শিনি এবং মহারাজ শূরসেন মথুরার মুখ্য দ্বারের কাছে পৌঁছেছেন। একবার তাঁরা প্রবেশ করতে পারলে আপনার সব পরিকল্পনা চিরকালের মতন ধ্বংস হয়ে যাবে। যা সিদ্ধান্ত নেবার এখনই নিন।’
কংস কিছু ভেবে ওঠার আগেই মধুর স্বরে হেসে বলে ওঠেন কৃষ্ণ ’মাতুল বোধ হয় ভয় পাচ্ছেন। স্বাভাবিক। বয়সও হয়েছে যথেষ্ট তারপরে আর রাজ্যশাসনের ইচ্ছেও অবশিষ্ট নেই। এই অবস্থায় তাঁকে জোর না করে মথুরার কি নীতি অনুযায়ী বনবাসে যাওয়ার অনুমতি দিলেই বরং ভালো হয়। এমনিতেই তো মাতুলের অন্তরে সেই ইচ্ছেরই জন্ম হয়েছে গত কয়েক বছরে। তবে, সেই ব্যবস্থাই করা হোক ? কি বলেন মাতুল ?’
নিজের অমানুষিক ক্রোধকে সংযত করে কংস বলেন, -অবশ্যই বনবাসে আমার অন্তর অবশেষে শান্তি পাবে বৎস কৃষ্ণ। কিন্তু প্রথমবার তুমি আমার কাছে কোনও অনুরোধ করেছো। তা অপূর্ণই বা রাখি কি করে বল? তোমার ইচ্ছা পূরণ আজ আমি অবশ্যই করব। আমি মল্লভূমিতে প্রবেশ করছি।
পূর্ণ চক্ষু মেলে তাকান কৃষ্ণ। হাত বাড়িয়ে দেন।
এক অদ্ভুত সংগ্রামের দর্শক হয়ে ওঠে মথুরানগরী। অসামান্য বলশালী এবং নিপুণ মল্লযোদ্ধা কংসের একের পর এক আক্রমণকে শুধুই অদ্ভুত কৌশলে প্রতিহত করে যাচ্ছে এই রহস্যময় বীর কিশোর।
যত সময় যাচ্ছে তত বেশি অধৈর্য্য হয়ে উঠছেন মথুরাধিপতি। আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীকে গুরুতর আহত না করে উঠতে পারার আক্ষেপে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছেন। আরকত সময় ধরে তিনি ব্যর্থ চেষ্টা করে যাবেন তার এই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীকে ধ্বংস করার? সেই কত বছর আগে প্রথম পুতনাকে গুপ্তঘাতিকা রূপে পাঠিয়ে তিনি হত্যা করতে চেয়েছিলেন এই অভিশাপকে। কিন্তু আজকের মতো সেদিনও ব্যর্থতা ছাড়া আর কোনও কিছুর সম্মুখীন হতে হয়নি। এতগুলো বছর ধরে শুধু চেষ্টা আর ব্যর্থতা। আর না! এবার তিনি সামনে পেয়েছেন তাঁর জীবেনর এই সবথেকে বড় কণ্টককে। আর কারোর উপর নির্ভর না করে নিজের হাতে তিনি একে শিকড় সমতে উপড়ে ফেলবেন।
প্রচণ্ড ক্রোধে তিনি ছুটে গেলেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই অদ্ভুত কিশোরের দিকে। কিন্তু পরের মুহূর্তেই বিদ্যুতের বেগে যেন সেই স্থান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন তাঁর সব থেকে বড় এই শত্রু। তিনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই কেউ যেন তার পায়ের অস্থিতে সজোরে আঘাত করলো। তার ডান পা এই আঘাতে এক নিমেষে সম্পূর্ণ অবশ হয়ে গেল। তিনি কিছু বলে ওঠার আগেই দেখলেন তাঁর বাম পাও অবশ হয়ে আসছে। বিপুল শরীরের ভার যেন আর বইতে পারছে না দুর্বল পা জোড়া। মুহূর্তের মধ্যে মাটির উপর আছড়ে পড়লো তাঁর বিশাল দেহ।
আর, বিদ্যুতের বেগে তাঁর শরীরের উপর নিজের হাঁটু গেড়ে উপবিষ্ট হলো তাঁর পরম শত্রু।
কোনওমতে হেসে বলে উঠলেন তিনি, ‘দ্বন্দ্ব তাহলে এখানেই সমাপ্ত হোক ভাগিনেয়। তুমি বিজয়ী হলে এই যুদ্ধে।’
আগের মতোই মধুর হেসে বলে উঠলো সেই নবীন কিশোর, ‘না মাতুল দ্বন্দ্ব তো এখনও শেষ হয়নি। আপনিই তো বললেন একজনের মৃত্যুর আগে অবধিশেষ হয়না এই দ্বন্দ্ব। আর আপনি মথুরাধিপতি, যত পাপই করে থাকুননা কেন, আপনি একজন নৃপতি। এইভাবে আপনার সম্মানহানি হতে কিভাবে দিতে পারে আপনারই ভাগিনেয়? মাতুল, আপনি প্রায়শ্চিত্তের কথা বলছিলেন,দেখুন অবশেষে এসেছে তার সময়। স্বয়ং ঈশ্বর আপনাকে সেই সুযোগ দিচ্ছেন। নিজের প্রাণ দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করার।’
প্রচণ্ড আতঙ্কে একটাই তীব্র স্বর বেরিয়ে আসে মথুরাধিপতি মহারাজ কংসের কণ্ঠ চিরে, - নাআআআ…
আর, তার বুকের উপর বসে থাকা পনেরো বছরের সেই কিশোর সকল দণ্ডায়মান মথুরাবাসীর শ্রবণযোগ্য গম্ভীরস্বরে বলে ওঠে, ‘আমি মথুরার রাজসিংহাসনের প্রকৃত উত্তরাধিকারী, রাজকুমার বসুদেব এবং রাজকুমারী দেবকীর অষ্টম পুত্র রাজকুমার কৃষ্ণ, আজ মথুরার সব থেকে বড় অপরাধী মহারাজ কংসকে তাঁর পিতা, ভগিনী এবং ভগিনীপতিকে বন্দী করার অপরাধে, নিজের ছয়ছয়টি নিষ্পাপ ভাগিনেয় এবং পিতা নন্দ ও মাতা যশোদার কন্যাকে হত্যা করার মহাপাপের জন্য, যাদব গোষ্ঠীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার অপরাধে এবং সর্বোপরি মথুরার জন সাধারণের ওপর এত বছর ধরে অত্যাচার করার শাস্তি রূপে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করলাম।’
একটা প্রচন্ড তীক্ষ্ণ আঘাত এসে স্পর্শ করে হৃদপিণ্ডের ঠিক উপরে। শরীরের সমস্ত অঙ্গ একটু একটু করে অবশ হয়ে যেতে থাকে। দৃষ্টির সামনে ক্রমশ নেমে আসতে থাকে একটি কালো পর্দা।সামনে কে বসে আছে? কে এই ছেলেটি? কেন স্বয়ং সৃষ্টি পালনকর্তার ভঙ্গিমায় বসে রয়েছে সে কংসের বুকের উপরে? সে নিজে কে?
আর কিছু ভাবার শক্তি আর অবশিষ্ট থাকে না। একটু একটু করে সমস্ত চেতনা হারিয়ে, চির তমসার রাজ্যে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায় মথুরাধিপতি মহারাজ কংসের অস্তিত্ব।
রক্তমাখা বিধ্বস্ত শরীরে প্রাক্তন মথুরাধিপতির শরীরের উপর থেকে উঠে দাঁড়ান আর্যাবর্তের ভবিষ্যৎ ভাগ্যনায়ক।
আজ বাস্তবায়িত হলো এতদিনের অসম্পূর্ণ কর্তব্য। না এ হত্যা নয়, মথুরাবাসীর ন্যায়। তাই তো নিজে থেকেই মাতুল তাঁদের নিয়ে এসেছিলেন এই মল্লযুদ্ধের প্রাঙ্গণে। অলক্ষ্য থেকে এক অদৃশ্যশক্তি যেন আজ তাঁকে নিয়ে এসেছিলো এই প্রাঙ্গণে প্রায়শ্চিত্তের জন্য।
ক্লান্ত, রক্তাক্ত শরীরে আকাশের দিকে তাকান কৃষ্ণ। মথুরার আকাশে নব সূর্য শেষ পর্যন্ত সকল বাধা অতিক্রম করে পৌঁছে গেছে ঠিক মধ্যভাগে। সকল কালো মেঘ অবশেষে অপসারিত হয়েছে। মধ্যগগনের বুকে জেগে থাকা দিবাকরের দিকে তাকিয়ে প্রাণ ভরে এক সুগভীর নিশ্বাস নিলেন কৃষ্ণ।
প্রথম খণ্ড সমাপ্ত
অসাধারণ বললেও কম হবে, একটা পৌরাণিক কাহিনীর এমন যুক্তিপূর্ণ বাস্তবায়ন আগে কখনো পড়িনি.. দারুণ.. :)
ReplyDelete