1

অণুগল্প - সরিৎ চট্টোপাধ্যায়

Posted in


অণুগল্প


তন্দুরি
সরিৎ চট্টোপাধ্যায় 



মাজুলির কাসিম আলি বক্সিং করত। শিবা থাপার সঙ্গে শ্যাডো করার জন্য ডাক পড়ত ওর। 

আকাশে একটা শকুন ঘুরছে। ওর নজরে উন্মত্ত জলরাশির মাঝে একখণ্ড জমি। তার ওপর তিনটে একচালা। আর কয়েকটা মানুষ।

আজ চোদ্দদিন ওরা এই দ্বীপটায় আটক হয়ে আছে। ওরা বাইশজন। বেশিরভাগই অক্ষম, জরাগ্রস্ত। আসামের এই জায়গাটা আগেও একটা দ্বীপ ছিল। এখনও তাই আছে। শুধু আয়তনে এখন সেটা আগের মাত্র এক শতাংশ। বাকিটা ব্রহ্মপুত্র ফি-বছরের মতো আত্মসাৎ করেছে। একটা নিমগাছ শুধু ফাঁকা প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে আছে। যথার্থ বুদ্ধিজীবির মতো এতকিছুর মধ্যেও তার কোনও হেলদোল নেই।

কাসিম পালাতে পারত। কিন্তু মণিআপা আর আব্দুলদাদানকে ছেড়ে ও যায়নি। 

আজকের রাতটা যেন অশুভ। তার নিঃশ্বাসে বিষ! পাঁচটা ছায়াশরীর অন্ধকারে প্রেতাত্মার মতো কী যেন মন্ত্রণায় ব্যস্ত। বারোদিনের অনাহারক্লিষ্ট পাঁচজোড়া চোখ আজ উন্মাদ, উন্মত্ত।

নিভে আসছে আব্দুলের জীবনপ্রদীপ। কাসিম পাশে বসে বুকে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বৃদ্ধ প্রবল শ্বাসকষ্টের মধ্যেও বলছে, যা কইসি তাই করিস কিন্তু দাদুভাই! ... তুদের ... যে করেই হউক ... বাঁচতেই হবে!

চতুর্দিকে দুর্নিবার ফেনিল জলরাশি! সদ্যবিবাহিতা জিয়া নিজের চোখে দেখেছে ওর স্বামীকে ভেসে যেতে। আজ মাঝরাতে অন্ধকারে একলা শুয়ে কাঁদছিল ও। কাসিম ধূমায়িত মাংসের আধপোড়া টুকরোটা নিয়ে পাশে এসে বসল। মৃদু স্বরে বলল, খাই লও! 

রাক্ষুসীর মতো টুকরোটা ছিনিয়ে নিল জিয়া। আজ দশদিন পর মুখে প্রথম কোনও খাবার পড়ল ওর। কিন্তু তিনকামড়েই শেষ হয়ে গেল। দ্বিধামেশানো চোখে ও কাসিমকে জিজ্ঞাসা করল, আর নাই?
: না। 
: কুথায় পেলি?
: ইখানে কুন গরু বা শুয়োর দ্যাখছিস?
: না। 
: ফের সওয়াল করিস নে। শুয়া পড়। 

আরও দু'দিন পর মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত্ বিসওয়াল হেলিকপ্টারে রাজ্যের ক্ষয়ক্ষতি জরিপ করতে বেরিয়েছিলেন। সঙ্গে দুই দেহরক্ষীর পাশে গুয়াহাটি দূরদর্শনের দু'জন সংবাদ কর্মী। ছোট্ট দ্বীপটায় ওরা হাত নাড়ছিল। হেমন্ত্ একজনকে মনে হলো যেন চিনতে পারলেন। ঠিক, ছেলেটা পুরস্কার নিয়েছিল ওঁর হাত থেকে। 
: একবার নামা যাবে?
: এক বস্তা আলুও তো নেই স্যার। রিস্ক হয়ে যাবে!
: হোক! ভাবো ন'টার নিউজে যখন দেখাবে তখন কী রেসপন্স হবে। পাইলটকে বলো, আমি নামব। 

ওরা নামতেই এগিয়ে এল উনিশজন। 
হাতজোড় করে মুখে অনাবিল হাসি নিয়ে এগিয়ে গেলেন হেমন্ত বিসওয়াল। ডিজিটাল ক্যামেরায় ফটাফট ছবি উঠছে। কাসিমের প্রথম ঘুঁসিটা পড়ল ঠিক ওঁর চোয়ালের ডগায়। প্রথমবারেই নকআউট পাঞ্চ। প্রথম দেহরক্ষী রাইফেলটা উঁচু করারও সময় পেল না। জিয়াসমেত চারজন ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপর। দ্বিতীয়জন বেগতিক দেখে একলাফে উঠে পড়ল হেলিকপ্টারে। পাইলট বিপদ বুঝে টেক-অফ করার পূর্ব মুহূর্তে রিপোর্টার দু'জনও কোনওমতে ঢুকে পড়ল। চিৎকার করতে করতে উড়ে গেল ওটা। 

সেদিন রাতে পেট ভরে খেয়েছিল ওরা। মন্ত্রীর মাংস যে এত সুস্বাদু কে বা জানত। ভোরের আলো যখন ফুটছে তখন নরম মাটিতে পঞ্চম কবরটাতে মাটি চাপা দিচ্ছে ওরা। 

কাসিম জিয়াকে বলল, এবার আসবে ওরা। 
জিয়া পূবের আকাশের দিকে চোখ তুলে বলল, হ, জানি। 

দূরে দেখা যাচ্ছিল ওদের। চারটে গানশিপ। একটার পেটের তলায় দুটো মিসাইল বাঁধা। রক্তে রাঙানো আকাশে ধীরে ধীরে এদিকেই আসছিল ওরা। 

কাসিম জিয়ার মুখের দিকে তাকাল একবার। পেছনে ভয়াবহ ব্রহ্মপুত্র তার দূর্বার গতিতে বয়ে চলেছে। 
: আমার হাতটা ধর জিয়া!
: কেন?
: এতসহজে হার মানব নি। মণিআপার কসম! আব্দুলদাদানের কসম!
: ই জলের তোড়! মরি যাব তো!
: রইলেও মরবি! চল্!

জোড়া মিসাইলদুটো যখন তাদের লক্ষ্যে এসে ফাটল তখন মোট সতেরোজন ছিল ওই মাজুলি দ্বীপটায়।

1 comment:

  1. শিবরাম চক্রবর্তী র লেখা গল্পের সাথে প্রবল মিল| আর আসামে মানুষ মারতে মিসাইল !!!

    ReplyDelete