0

ব্যক্তিগত গদ্য - সঞ্চয়িতা বিশ্বাস

Posted in


ব্যক্তিগত গদ্য


শুধু যাওয়া-আসা
সঞ্চয়িতা বিশ্বাস


গতকাল বাবু চলে গেলেন।বাবু মানে আমার শ্বশুরমশাই…শিবাজীর বাবা। নিজের বাবার বাইরে কাউকে 'বাবা' সম্বোধন করতে অস্বস্তিবোধ করি বলে বিয়ের পর নিজেই ঠিক করে নিয়েছিলাম 'বাবু' সম্বোধনটুকু। বাবু কখনও আপত্তি করেননি। বেশ কিছুদিন ধরেই উনি অসুস্থ ছিলেন। বার্ধক্যের শক্তির সাথে ডাক্তাররাও যুঝতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল ওঁকে।ঘর থেকে উঠোন অবধি কোনওরকমে নেমেছিলেন নিজের পায়ে।তারপর ড্রাইভার ছেলেটি কোলে করে গাড়িতে উঠিয়েছিল। পিছনে ঠাম্মার কোল থেকে মোহর তখনও চেঁচিয়ে যাচ্ছে "দাদানকে নিয়ে যেও না…"

সব 'চলে যাওয়া'র কারণ এক না হলেও কোথায় যেন চলে যাওয়াগুলোর মধ্যে খুব মিল। প্রতিটা মৃত্যুর অভিজ্ঞতা তার পূর্ববর্তী মৃত্যুগুলোর স্মৃতি টাটকা করে দেয়…সেই নব গণিত মুকুলের 'পূর্বপাঠের পুনরালোচনা' চ্যাপ্টারটার মতো। বাবুর পার্থিব অবয়বটুকু চারটে মানুষের ওপর ভর করে আসলো…বারান্দায় থাকলো…কিছু পাশবিক সামাজিকতা চললো…। আমি এসব কিছুই দেখলাম না। আমি টের পেলাম, মৃত্যুর গন্ধ সবসময় একরকম…হিম হিম আঁশটে একটা বাস…ধূপ-ফুল কিছুতেই ঢাকে না সেটা…এই গন্ধটুকুই লেগেছিল বাবার শরীরে…কিংবা ভীমের মুখের মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে যখন ওর শ্বাসপ্রশ্বাস চালু করবার চেষ্টা করছিলাম, তখন…। বাবুর পায়ে তেল-হলুদ লাগানোর লম্বা লাইন পড়ে গেল।আমার ঠাকুরদার চলে যাওয়ার দিনও এরকমই হয়েছিল মনে পড়লো। তিরানব্বুই সালে ঠাকুরদা চলে যাওয়ার পর আজ অবধি এই স্মৃতিটুকু কখনও মনে আসেনি। কি আশ্চর্য!

আমার ঠাকুরদা মারা গিয়েছিলেন সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের একটা দুপুরে। সেবারই প্রথম এবং শেষবার গিয়েছিলাম ঠাকুরদার বাড়িতে। নদীর ধারে উঁচু মাটির দালান…ইংরেজী 'L' অক্ষরের মতো। উঠোনের একপাশে রান্নাঘর। তার গায়ে বিশাল এক তেঁতুল গাছ। এক বাড়ি ভর্তি লোকজন, বাচ্চাকাচ্চা। গোয়ালঘর…চালকলের একটানা যান্ত্রিক আওয়াজ…পোষা রাজহাঁস…মা মুরগীর পিছনে একগাদা ছানা। সেদিন আমি বোধহয় একটা মুরগীর সাথে খেলছিলাম। হঠাৎ কোনও একজন জেঠি আমাকে টেনে নিয়ে গেল ঠাকুরদার ঘরে। ঠাকুরদা ভাঙাচোরা শয্যাশায়ী একজন মানুষ যার সাহচর্য আমি কখনওই পাইনি। বার্ধক্য তাঁর শরীরকে বিকৃত করে দিয়েছে। আর ছয় বছর বয়সী আমার কাছে সেই শরীর নিতান্তই আতঙ্কের বিষয়। ফলে পারতপক্ষে সে ঘরে আমি ঢুকতাম না।আমাকে সেদিন জেঠি টেনেহিঁচড়ে ভিড় ঠেলে ঠাকুরদার পাশে নিয়ে গিয়েছিল। এই বয়সে এসে আমার মনে নেই ঠাকুরদা তখনও জীবিত কিনা কিংবা ওঁর কোটরগত চোখ খোলা ছিল না বন্ধ।আমার স্মৃতি জুড়ে আছে একটা হাঁ করা মুখ যার মধ্যে পৃথিবীর সমস্ত অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। কে যেন জলভর্তি ঘটি না গ্লাস নাকি চামচ আমার হাতে ধরিয়ে ওই ভয়াবহ অন্ধকারে জলটুকু ঢেলে দিলো…

মুসলিমপাড়ার সুন্দরীদি আত্মীয়দের ভিড় ঠেলে আমার কাছে এগিয়ে এসে খুব সংকুচিতভাবে জিগ্যেস করলো, "অ বৌমা, আমি একটু বাবার পায়ে তেল-হলুদ দেবো?" সুন্দরীদি এ বাড়িতে দীর্ঘদিন কাজ করেছে। বাবুর নির্দেশে বাড়ির সবার জন্মদিনের আগে সুন্দরীদির গাইগরুর দুধ আনা হয় পায়েসের জন্য। বাবু হাঁক দেয়, "ও মেয়ে!" সুন্দরীদি 'বাবা' ডাকে ওঁকে…মানেও খুব। কি সহজ সাবলীল একটা সম্পর্ক…রক্তের সম্পর্কের জটিলতা থেকে মুক্ত একটা সম্পর্ক!

মোহরকে আমি উপরের ঘরে মায়ের কাছে বসিয়ে রেখেছিলাম খেলনা দিয়ে। বাবুকে যখন নিয়ে চলে যাচ্ছে সবাই, জানলা দিয়ে মা ওকে দেখালো বাবুকে। মোহর জানে, দাদান ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে।শুধু অভ্যেসবশে ও মাকে বললো, "দাদান আমাকে বলে গেল না!" আমি জানি, ওর সচেতন স্মৃতিতে এই অধ্যায়টুকু ধরা থাকবে না…কিন্তু কোথাও তো থাকবে…!

সারা বাড়ি শুনশান।বাড়ির ছেলেরা গ্রামের লোকের সাথে শ্মশানে গেছে ঠাকুরদাকে দাহ করতে। মা কিংবা জেঠিরা সবাই কোথায় কি জানি! মাটির টানা বারান্দা দিয়ে হাঁটছি। ধলা জেঠুর ঘর আর মেজো জেঠুর ঘরের মাঝের ঘরটা ঠাকুরদার। প্লাবণ বলেছে, ও ঘরে ঠাকুরদার ভূত আছে। আমি ধলা জেঠুর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। মেজো জেঠুর ঘরে যেতে পারছি না। সন্ধ্যা নামছে। কেউ আলো জ্বালেনি আজকে। আমার সামনে ঠাকুরদার মুখের মতো আঁধার নামছে। আমি দেয়ালে সেঁটে অপেক্ষা করছি…আমার পা ভারী…গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না…কেউ এসে আমার হাত ধরুক…

0 comments: