6

কৈশোরনামা - ধূপছায়া মজুমদার

Posted in


কৈশোরনামা


মিশকুন আর বন্ধু-রা
ধূপছায়া মজুমদার


এক যে আছে ছোট্ট ছানা হাতি, নাম তার মিশকুন। তার কাছে আছে লম্বা একখানা শুঁড়,দুটো ক্ষুদে ক্ষুদে চোখ, মাথার দু’পাশে দুখানা লতপতে কান, সেগুলো আবার ফটাফট নাড়ানো যায়। আর আছে চারটে গোবদা পা, আর একখানা পুঁচকে লেজ। ওহো, আসল কথাটাই ভুলে গিয়েছি বলতে, শুঁড়ের দু’পাশ দিয়ে উঁকি মারছে ছোট্ট দুটো সাদা দাঁত। এইসব জিনিসপত্তর নিয়ে সে তার মায়ের পায়ের ফাঁকে ফাঁকে হেঁটে-চলে বেড়ায়। এখনো অতটা বড় হয়নি কিনা, তাই মা-কে জিজ্ঞেস না করে এদিক-সেদিক যাওয়া বারণ। হ্যাঁ, জঙ্গলের চেনা রাস্তায় যেতে মানা নেই, সেখানকার জীবজন্তুরা সবাই মিশকুনকে চেনে, দেখতে পেলে আগলে রাখবে, কিন্তু অচেনা রাস্তায় যাওয়া বারণ। তবে মিশকুন তো লক্ষ্মীছানা, তাই সে মায়ের কথার অবাধ্য হয় না। 

একদিন সকালবেলায়, মায়ের সঙ্গে মিশকুন নদীতে নামলো চান করতে। শুধু কি চান, চানের আগে বালিতে গা ঘষা, নদীতে নেমে মায়ের দেখাদেখি শুঁড়ে করে জল নিয়ে ফোয়ারার মতো করেচারপাশে জল ছড়ানো, জলে গা ডুবিয়ে চুপটি করে বসে বসে ঢেউয়ের দোল খাওয়া, চানের সময় এমন কত্ত খেলা করা যায়! সেসময় মা-ও ভারি খুশি থাকেন, তাই বকুনি খাওয়ার ভয়ও মিশকুনের থাকে না। 

তা, নদীতে হুটোপাটি করে চানপর্ব চলছে। মিশকুন, মা, আর বাবা তো আছেনই, আরও কত মামা-মাসি-কাকু-পিসি-রা আর তাদের ছানাপোনারা রয়েছে। মিশকুনের চান হয়ে গেছে, ওর আর জলে থাকতে ইচ্ছে করছিলো না, মাকে জিজ্ঞেস করলো, 

“মা, মা, চান তো অনেক হলো, এবার ডাঙ্গায় উঠি?”

মা বললেন, “আচ্ছা, উঠে পড়, কিন্তু এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াবি না”।

সে “ঠিক আছে মা” বলে গুটিগুটি পায়ে জল থেকে উঠে এলো।পাড়ে এসে কিছুক্ষণ রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে গা-মাথা শুকিয়ে, জল ঝেড়ে ফেলে হাঁটা লাগালো জঙ্গলের পথে। মায়েরা তখনও জলের ফোয়ারা নিয়ে খেলা করছে। 

জঙ্গলের এই রাস্তা মিশকুনের চেনা, তাই এখানে আসতে মোটেই বারণ নেই। সে দিব্যি হেলেদুলে এ-গাছ, ও-গাছ দেখতে দেখতে এগিয়ে চললো। বুনো গাছ আর ফলফুলুরির গন্ধ তার খুব ভালো লাগে। 

একটা উঁচু গাছের দিকে চোখ পড়তেই সে দেখলো, ও মা, বাবুইদিদি ঠোঁটে করে দুটো খড়কুটো নিয়ে কি যেন সাজাচ্ছে। ভালো করে নজর করতেই দ্যাখে, কেমন সুন্দর উল্টোনো কুঁজোর মতো দেখতে একটা জিনিস গাছের পাতার আড়ালে ঝুলছে, আর বাবুইদিদি ঠোঁটে করে খড়কুটো নিয়ে সেটার ভেতর একবার ঢুকছে, একবার বেরোচ্ছে। মিশকুন ভারি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,

“বাবুইদিদি বাবুইদিদি, করছো তুমি কী?”

বাবুই হেসে বললো,

“এই দ্যাখো না কেমন মজার বাসা বেঁধেছি!”

মিশকুন ভাবে এ তো আজব কাণ্ড। ঠোঁটে করে কুটো বয়ে এনে গাছের ডালে কেমন বাসা বেঁধেছে দ্যাখো! আচ্ছা, মিশকুন পারবে অমনটা, যদি চেষ্টা করে? মা-কে জিজ্ঞেস করতে হবে, ভাবতে ভাবতে মিশকুন এগিয়ে চলে। 

একটু দূরে গিয়ে একটা কাঠবাদাম গাছের দিকে নজর পড়লো। একটা কাঠবেড়ালি গাছের ডালে বসে দু’হাতে করে কি যেন ধ’রে আছে, আর মাঝেমাঝে সেটায় কুটকুট করে কামড় বসাচ্ছে। তার ঝাঁকড়া লেজটা মাঝেমাঝে তিরতির করে কেঁপে উঠছে। 

মিশকুন তাকে শুধোলো, 

“কাঠবেড়ালি কাঠবেড়ালি খাচ্ছো তুমি কী?”

কাঠবেড়ালি ‘কিচ-কিচ’ করে বলল, 

“এই দ্যাখো না আমি কেমন বাদাম চিবোচ্ছি!”

মিশকুন ভাবলো, বাঃ, বেড়ে মজা তো! গাছের ডালে বসে তারিয়ে তারিয়ে কেমন বাদাম খাচ্ছে দ্যাখো! কই, তার মা-মাসিরা তো কক্ষনও অমন গাছে উঠে খাওয়া-দাওয়া সারে না? আজকেই মা’কে বলতে হবে, মিশকুনও এবার থেকে গাছের ডালে বসেই জলখাবার খাবে।

এই কথা মনে ক’রে বেজায় খুশি হয়ে সে এগিয়ে চললো। একটু পরেই দেখতে পেলো একটা গাছের ডালে হাত-পা এলিয়ে দিয়ে বাঁদরদাদা দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুম দিচ্ছে। মিশকুন শুঁড় উঁচিয়ে হাঁক দিলো,

“বাঁদরদাদা বাঁদরদাদা করছো তুমি কী?”

অমনি ধড়মড়িয়ে ঘুম ভেঙ্গে লজ্জায় একহাত জিভ কেটে বাঁদরদাদা বলল, 

“এঃ! দ্যাখো দেখি কেমন ঘুমিয়ে পড়েছি!”

মিশকুনের মনটা ভারি খারাপ হয়ে গেল। বাবুইদিদি, কাঠবেড়ালি, বাঁদরদাদা—এরা সব কেমন গাছে বাসা বেঁধে থাকে, গাছেই ঘুমোয়, খাওয়া-দাওয়া সেখানে বসেই সারে! মিশকুনও যদি ওদের মতো তরতরিয়ে গাছ বাইতে পারতো! ওরাযে কেন শুধু মাটিতেই হাঁটাচলা করে, সে বোঝে না। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে সে ধীর পায়ে নদীর ধারে মায়ের কাছে ফিরে আসে। মা কত খুঁজে খুঁজে জিভে জল আনা লতাপাতা জোগাড় করেছেন মিশকুন খেতে ভালবাসে ব’লে, কিন্তু খেতে বসে সে এক গ্রাসও মুখে তুলতে পারে না। গায়ে-মাথায় শুঁড় বুলিয়ে মা জিজ্ঞেস করতেই তার চোখ দিয়ে জল ঝ’রে পড়ে টুপটুপ।

“কি হয়েছে মিশকুনসোনা? মা’কে বলো বাবু। মা শুনলে তোমার সব কষ্ট মুছিয়ে দেবে।একবার বল্‌ সোনা কাঁদছিস কেন?”

মায়ের কাকুতি-মিনতিতে মিশকুন আর পারলো না, ফোঁপাতে ফোঁপাতে সব বলে ফেললো। 

মা বুঝলেন গাছে উঠতে পারে না ব’লে তার ছানার মন বেজায় খারাপ হয়ে রয়েছে। তিনি তখন মিশকুনকে বললেন,

“খেয়ে নিয়ে জঙ্গলে ঢোক্‌ আবার, বাবুই, কাঠবেড়ালি আর বাঁদরকে বলে আয় আজ বিকেলে আমাদের বাড়িতে ওদের সবার নেমন্তন্ন। যে যার বাবা-মায়ের হাত ধ’রে যেন তাড়াতাড়ি চলে আসে”।

মিশকুন তো আহ্লাদে আটখানা। তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে জঙ্গলে ঢুকে নেমন্তন্ন-পর্ব চুকিয়ে এলো।

বিকেল একটু গড়াতে মা-বাবার হাত ধ’রে অতিথি-রা সবাই এসে হাজির। মিশকুনরা তো খশিতে ডগমগ একেবারে। 

মিশকুনের মা সবাইকে বললেন, 

“চলো বন্ধুরা আর ছানাপোনা-রা, আমরা নদীর ধারে গিয়ে বসি। ঠাণ্ডা হাওয়ায় প্রাণ জুড়োবে, আর নদীর জলে আমরা বেশ নিজেদের ছায়া দেখতে দেখতে গল্প-সল্প করব। 

বাবুই-বাঁদরদের মায়েরাও সমস্বরে বলে উঠলেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, সে-ই ভালো, চলো চলো”।

দল বেঁধে নদীর পাড়ে গিয়ে বসা হলো। ব’সে এ-গল্প, সে-গল্প, দু’চারটে গানের কলি গেয়ে ওঠা, এইসব চলছিল, এমন সময় মিশকুনের চোখ পড়ল নদীর জলে। সেখানে দেখা যাচ্ছে মিশকুন, বাবুইদিদি, কাঠবেড়ালি আর বাঁদরদাদার আয়না-ছবি, শক্ত কথায় যাকে বলে প্রতিবিম্ব। 

চারজনে মিলে খেলাধুলো হয় মাঝেমাঝে, কিন্তু এমন করে আয়নার সামনে বসে এ-ওকে তো দেখা হয়নি কখনও, তাই মিশকুন অবাক হয়ে জলের দিকে তাকিয়ে থাকে। দ্যাখে কি, তার মাথাটা ইয়াব্বড়, তাতে আবার দুলছে একখানা লম্বা শুঁড়, শুঁড় আর মুখের মাঝে বেরিয়ে আছে দুটো কচি সাদা দাঁত। তারপরে দ্যাখো, মস্ত বড় পিঠ, তাতে বাবুই-কাঠাবেড়ালির বাড়ির সব্বাই বেশ আরাম ক’রে বসতে পারবে, ওদের বইতে তার কষ্টও হবে না বিশেষ। মিশকুনের পিঠের নিচে আবার আছে গাছের গুঁড়ির মতো চারটে পা, সব মিলিয়ে চেহারাখানাকে দশাসই বলাই যায়। সেখানে বাবুইদিদির চেহারাটা দ্যাখো! মিশকুন মন দিয়ে জল-আয়নাটা দেখতে থাকে। 

বাবুইদিদির ছোট্ট মাথা, ছোট্ট ঠোঁট, এইটুকুনি পেট, আর তার নিচে কাঠির মতো সরু সরু দু’খানি পা। দুটো ডানা আছে বটে তার, যেটা মিশকুন, কাঠবেড়ালি বা বাঁদরদাদা --- কারোরই নেই, তবে সে ডানাদুটোও বড্ড ছোট। সব মিলিয়ে বাবুইদিদি এতটাই হাল্কা, সে যদি মিশকুনের পিঠে উঠে বসে, তবে ও টেরও পাবে না। অমন হাল্কা চেহারা ব’লেই কি বাবুইদিদি গাছের ডালে ঝুলে ঝুলে বাসা বানাতে পারে?

“আমি হলে তো এতবড় চেহারা নিয়ে গাছের ঐ পলকা ডালে উঠতেই পারতাম না”, মনে মনে ভাবতে ভাবতে মিশকুন কখন যেন মুখ ফুটে কথাটা ব’লে ফেলেছে। 

“ঠিক বলেছ মিশকুনভাই”, বাঁদরদাদা যে পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে, বুঝতেই পারেনি সে।

“তোমার মনে বুঝি দুঃখ হয়েছে তুমি গাছে চড়তে পারো না ব’লে?”দাদার প্রশ্নের উত্তরে ঘাড় নাড়ে মিশকুন।

“একটা কথা বলো, তুমি যেমন নদীতে নেমে শুঁড়ে ক’রে জল নিয়ে ফোয়ারা-ফোয়ারা খেলতে পারো, অমনটা কি আমরা পারি? আমাদেরও মনে হয় একটা শুঁড় থাকলে কত্তো মজা হতো, কিন্তু কি আর করা যাবে!” কাঠবেড়ালির মনটাও ভারী হয়ে আসে শুঁড় না থাকার দুঃখে।

“আহাহা, তুমি কেমন কিচ্‌-কিচ্‌ করে এডাল-ওডাল ঘুরে ফলপাকুড় পেড়ে নিয়ে খেতে পারো সেটা বলো! হাতিরা তো তা পারে না। আবার বড় বড় পাথর, গাছের গুঁড়ি পায়ের এক ঠেলায় গড়গড়িয়ে নদীতে নামিয়ে দিতে পারে মিশকুন, তুমি-আমি কেউ অমন পারবোই না”।

“তাহলে? কি বোঝা গেল বন্ধুরা? মিশকুন পারে না, এমন অনেক কাজ তুমি বা আমি বা বাবুই খুব ভালোভাবে করতে পারি, আবার ও যেসব কাজে তুখোড়, সেগুলোর বেশিরভাগই আমরা করতে পারি না, তাই না?”

গা-ভর্তি বাদামী লোম, লম্বা ল্যাজ আর চারটে পা সামলে ভারি তড়বড়ে বক্তৃতা দিলো বাঁদরদাদা।

ওদিকে মিশকুন তখন মন দিয়ে কাঠবেড়ালির লেজ নিরীক্ষণ করছে। আহা,কেমন ঝাঁকড়া বাহারি লেজখানা! তারপরে দ্যাখো গায়ে কেমন ডোরাকাটা দাগও আছে। সেই এক বাঘমামা ছাড়া আর কারও গায়ে এমনটা দেখাই যায় না। ইস্‌, তার যদি এমনটা থাকত! এটা ভেবেই মনে মনে জিভ কাটে মিশকুন। নাহ্‌, আর সে এসব ভাববে না। তারও তো লম্বা শুঁড় আছে, দুধ-সাদা দাঁত আছে, তবে? আসলে তারা সবাই সুন্দর, একেকজনের রূপ একেকরকম। তারা সবাই কত্ত রকমারি কাজ করতে পারে। খামোখা “আমার লেজ ঝাঁকড়া নয়”, “ও কেমন ডালে ডালে লাফিয়ে বেড়ায়”, এসব ভেবে মন খারাপ করা কেন বাপু? তার চেয়ে বরং বাবুইদিদিদের সঙ্গে একটা শলা করা যাক। এই না ভেবে মিশকুন তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের নিয়ে বৈঠকে বসলো। 

কি কথাবার্তা হলো সে তো জানা গেল না, তবে খানিকক্ষণ পরে ওরা চারমূর্তিতে বেড়াতে বেরোলো। বাবা-মায়েরা দূর থেকে দেখলেন, মিশকুন দুলকি চালে হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গলে ঢুকছে, তার পিঠে বসে আছে বাবুই, কাঠবেড়ালি আর বাঁদর। উঁচু কোনও গাছের মগডালে ফলপাকুড় ঝুলছে দেখলেই মিশকুন শুঁড় বাড়িয়ে সেগুলো পেড়ে আনছে, সে যেখানে নাগাল পাচ্ছে না, বাঁদর ‘হুপ হুপ’ ব’লে লাফ দিয়ে সেসব ডালে উঠে ফল পেড়ে আনছে, আর চারমূর্তিতে মিলে চলছে মহানন্দে মহাভোজ।।

6 comments:

  1. ঋতবাক খুলে প্রথমেই পড়লাম 'মিশকুন আর বন্ধুরা' লেখাটি ।ছোটদের জন্য লেখা । খুব ভালো লাগলো ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ।

      Delete
    2. This comment has been removed by the author.

      Delete
  2. খুব সুন্দর হয়েছে

    ReplyDelete
  3. এইরকম লেখা বর্তমান যুগে ছোটদের, আর শুধু ছোটদের কেন, তাদের মা বাবাদেরও খুব পড়ার দরকার বলে মনে হয়। কত মিশকুনকে যে গাছে চড়ানোর চেষ্টা চলছে আশেপাশে, আর সেটা না পারলে ফেলিওর বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে তার ঠিক নেই!

    ReplyDelete