0

প্রবন্ধ - অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী

Posted in


প্রবন্ধ



বাঙলায় বোমার আবির্ভাব : তিলক ও রবীন্দ্রনাথের চোখে
অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী 


[২] 

বাঙলার বোমা প্রসঙ্গে লোকমান্য তিলকের পরেই মারাঠী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যাঁর প্রতিক্রিয়া উল্লেখযোগ্য, তিনি হলেন ‘কাল’ পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক শিবরাম মহাদেব পরাঞ্জপে। ক্ষুদিরামের বোমার সূত্রে কলকাতায় গুপ্তসমিতির জনা চল্লিশেক সদস্যের গ্রেপ্তারের পরেও ভারতের নানা স্থানে ব্যাপক ধরপাকড় চলছিল। এই সব গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ কর্মচারীদের পুরস্কৃত করার সরকারি সিদ্ধান্ত সম্পর্কে ‘কাল’ পত্রিকার একটি প্রবন্ধে ১৫ই মে অধ্যাপক পরাঞ্জপে মন্তব্য করেন। তিনি এ-প্রসঙ্গে মাল্টা বিষয়ক গোপন দস্তাবেজ বিক্রি করার দায়ে এক ব্রিটিশ অফিসারের প্রেপ্তার ও তাকে চরমতম দণ্ডদানের জন্য পার্লামেন্টে আইন প্রণয়নের কথা উল্লেখ করেন। ‘ফাঁসিই দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকের যোগ্য শাস্তি’ – একটি ব্রিটিশ কাগজের এই মন্তব্য উল্লেখ করে অধ্যাপক পরাঞ্জপে শ্লেষভরে লেখেন, “যদিও এ-ক্ষেত্রে ভারতীয় পুলিশ অফিসারদের আর ব্রিটিশ অফিসারটির মধ্যে লক্ষণীয় সাদৃশ্য রয়েছে, তবু প্রথম ক্ষেত্রে পুরস্কার বরাদ্দ হয়েছে আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে শাস্তি!” অর্থাৎ ঘুরিয়ে ক্ষুদিরাম প্রমুখ বিপ্লবীদের গ্রেপ্তারে যারা সাহায্য করেছে, তাদের দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতক বলা হলো আর সেই সূত্রে ক্ষুদিরামদের দেশপ্রেমকে বন্দনা করা হয়।

অবশ্য এই নির্ভীক অধ্যাপক- সম্পাদক যে শুধু ইঙ্গিতেই তাঁর প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেন এমন নয়, তিলকের মতোই তিনিও প্রত্যক্ষ ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখলেন যে, বোমা ছোঁড়াটা বাঞ্ছণীয় কিনা, সেই তর্ক দূরে সরিয়ে রাখলেও একটা ব্যাপার সুনিশ্চিত যে, যে-সব ভারতীয় এ-সব কাজ করছে, তারা নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্য এটা করছে না, স্বাধীনতা অর্জনের জন্যই করছে। এই নির্ভীকতার মূল্য অবশ্য পরাঞ্জপেকে অচিরেই চোকাতে হয়েছিল তিলকের মতোই। ১১ই জুন তাঁকে রাজদ্রোহের দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়। রাজদ্রোহের অভিযোগে শিবরাম পরাঞ্জপের উনিশ মাসের কারাদন্ড হয়েছিল। তাঁর মামলার তদারক করতে তিলক যখন বোম্বাই যান, তখন তাঁকেও গ্রেপ্তার করা হয় [২৫শে জুন], যার পরিণতি ছিল দীর্ঘ ছ’ বছরের জন্য সুদূর মান্দালয়ের জেলে নির্বাসন।

বাংলার বুদ্ধিজীবীদের বিশ্লেষণ

বাংলাদেশ তথা কলকাতার অগ্রগণ্য সংবাদপত্র রামানন্দ চট্যোপাধ্যায়ের ‘মডার্ন রিভিউ’-এ এই বোমাকাণ্ড নিয়ে কয়েকটি সম্পাদকীয় প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় [জুন, ১৯০৮]। এগুলির কয়েকটির বিষয় ছিলঃ- (১) রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ও পাশ্চাত্য ভাবাবেগ,(২) বাঙলায় সন্ত্রাসবাদের উৎপত্তি,(৩) বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে রাজনৈতিক হত্যা,(৪) হত্যার মাধ্যমে রাজনৈতিক মতাধিকার, (৫) কী ভাবে সাহস করতে হয় ও মরতে হয়, (৬) পথের সমস্যা, (৭) গীতা ও বোমানিক্ষেপ ইত্যাদি। 

এর মধ্যে ২ সংখ্যক রচনাটির কিছু অংশের মর্মার্থ এরকমঃ- “বাংলার সন্ত্রাসবাদের চরম কারণ খুঁজতে হবে সরকারের একান্ত স্বার্থপর, উদ্ধত ও উৎপীড়নমূলক নীতির মধ্যে আর অধিকাংশ সরকারি ও বেসরকারি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানেরা যে-রকম ঘৃণাপূর্ণ ও অপমানজনক ভাবে বাঙালিদের সঙ্গে কথা বলে আর ব্যবহার করে, তার ভেতরে। চরিত্রে আর পদ্ধতিতে প্রশাসনের যেভাবে রুশীকরণ করা হয়েছে, তার ফলেই জনগণের এক ক্ষুদ্র অংশ রুশ সন্ত্রাসবাদী পদ্ধতির অবলম্বনকারীতে পরিণত হয়েছে। এটা শুধুই ক্রিয়া আর প্রতিক্রিয়ার প্রশ্ন – ‘উত্তেজনা’ আর তার ‘সাড়া’র ব্যাপার।...... এর ফল দাঁড়াল একটা ভুল, যার পরিণতি ভয়াবহ। যে লোকটিকে তারা মারতে চেয়েছিল, তার পরিবর্তে হত্যা করে বসল দু’ জন নিরপরাধা স্ত্রীলোককে, যাদের মৃত্যুতে গভীর শোকপ্রকাশ করা হচ্ছে।”

উদ্ধৃত মন্তব্যে মূলত ভারতে ইংরেজের শাসনপ্রক্রিয়া ও ব্যবহারকে বোমার রাজনীতির জন্য দায়ী করা হলেও এর ঠিক পরেই ‘বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে রাজনৈতিক হত্যা’ শিরোনামে মন্তব্য করা হয়েছিল, “এটা হচ্ছে অবধারিত ভাবে বোমা ছুঁড়ে রাজনৈতিক হত্যাসাধন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এতে মরে নিরীহ মানুষেরা, যাদের বোমা নিক্ষেপকারীরা দোষী মনে করছে, তারা নয়। এমন কি, যখন দ্বিতীয়োক্ত মানুষেরা মরে, তখনও তাদের সঙ্গে কিছু নিরীহ মানুষেরও প্রাণ যায়। তাই এই পদ্ধতি নিশ্চিতভাবেই বেপরোয়া, খারাপ এবং এর সঙ্গে আমরা যোগ করতে পারি- কাপুরুষোচিত। কারণ একজন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার মধ্যে কোনো বীরত্ব তো নেই-ই, সর্বোপরি তার সামনাসামনি আসার সাহস ও হত্যাকারীর নেই।” একই রকম ভাবে পুর্বোক্ত ৪ ও ৫ সংখ্যক প্রবন্ধগুলোতেও বোমার কারবারীদের যথেষ্ট নিন্দা করা হয়েছে।

এর পাশাপাশি বাংলার পুরানো পত্রিকা ‘হিতবাদী’ -র যুক্তি ছিল সোজা ও তীক্ষ্ণঃ- “বলা হচ্ছে যে, ক্ষুদিরাম হত্যা, কাপুরুষোচিত কাজ ও নারকীয় অস্ত্র ব্যবহারের জন্য অপরাধী। জবাবে বিপ্লবীরাও বলতে পারে যে, প্রত্যেক শাসক, যে মানুষকে নিষ্পেষিত করে ও তাদের ফাঁসিকাঠে ঝোলায়, একই অপরাধে দোষী।” [২৮ মে, ১৯০৮] 

বাংলার এই কয়েকটি সংবাদপত্রের নামী সম্পাদকদের মন্তব্যকে বাদ দিলে একজন ছাড়া এখানকার আর কোনও লেখক বুদ্ধিজীবীই বাংলার এই বোমার আবির্ভাবে মতপ্রকাশে তিলক বা পরাঞ্জপের মতো তেমন ভাবে এগিয়ে আসেননি! মহারাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবীদের এইসব মন্তব্য প্রকাশের সমকালে ওই বোমার রাজনীতির রঙ্গভূমি বাঙলাদেশে ওই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় যিনি প্রকাশ্যে মন্তব্য করার কর্তব্যবোধ ও সৎসাহস দেখিয়েছিলেন, তিনি অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের স্পষ্ট ও প্রথম প্রতিক্রিয়া দেখা যায় মজঃফরপুর বিস্ফোরণের দু’ দিন পর কালীমোহন ঘোষকে লেখা তাঁর চিঠির এই মন্তব্যেঃ- “মজঃফরপুরে বম্ব ফেলিয়া দুইটি ইংরেজ স্ত্রীলোককে হত্যা করা হইয়াছে শুনিয়া আমার চিত্ত অত্যন্ত পীড়িত হইয়া আছে। এইরূপ অধর্ম ও কাপুরুষতার সাহায্যে দেশকে যাহারা বড় করিতে চায় তাহাদের কিসে চৈতন্য হইবে জানিনা, কিন্তু তাহারা সমস্ত দেশকে বিষম দুঃখে ফেলিবে। ধর্মের মুখ চাহিয়া দুঃখ সহা যায় কিন্তু এমন পাপের বোঝা দেশ কি করিয়া বহন করিবে?” [ ১৯ বৈশাখ, ১৩১৫]

এর কাছাকাছি সময়েই [৬ই মে] নির্ঝরিনী সরকারকে লেখা এক চিঠিতে গুপ্তবিপ্লববাদ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের অকপটে লেখেন, যে-উদ্দেশ্যেই গুপ্তহত্যার রাজনীতি প্রয়োগ করা হোক, তা পাপ এবং তার শাস্তি বিধাতার বিধান বলে অবশ্যস্বীকার্য:- “নিজের বা পরিবারের বা দেশের কাজে ধর্মকে লঙ্ঘণ করিলে ঈশ্বর ক্ষমা করেন না। যদি মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যও পাপকে আশ্রয় করি, তবে তাহার প্রায়শ্চিত্ত করিতেই হইবে...... দেশের যে দুর্গতি আমরা আজ পর্যন্ত ভোগ করিয়া আসিতেছি তাহার গভীর কারণ আমাদের জাতির অভ্যন্তরে নিহিত হইয়া রহিয়াছে – গুপ্ত চক্রান্তের দ্বারা নরনারী নরহত্যা করিয়া আমরা সে কারণ দূর করিতে পারিব না আমাদের পাপের বোঝা কেবল বাড়িয়াই চলিবে।”

বোমার বিপ্লবীদের গ্রেপ্তারের সপ্তাহ তিনেক পরেই ২৫শে মে কলকাতায় এক জনসভায় তিনি তাঁর সুদীর্ঘ প্রবন্ধ ‘পথ ও পাথেয়’ পাঠ করেন। এতে তিনি স্পষ্টতই ধৃত বিপ্লবীদের প্রতি কিছুটা নরম মনোভাব প্রকাশ করলেন তাদের নিন্দায় আর পাঁচজনের সঙ্গে গলা মেলাতে অস্বীকার করে। এটা লক্ষ্য করার মতো ব্যাপার যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাষাভঙ্গীতে এ কথা প্রচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করেননি, এই স্বদেশী যুবকদের ভাগ্যে যে দোর্দন্ড রাজশক্তির খাঁড়া ঝুলছে, এ কারণেও তাদের সমবেদনা প্রাপ্য। তাঁর ভাষায় :-“ যাহারা অপরাধ করিয়াছে, ধরা পড়িয়াছে, নির্মম রাজদন্ড যাহাদের ’পরে উদ্যত হইয়া উঠিয়াছে, আর কিছু বিচার বিবেচনা না করিয়া কেবলমাত্র বিপদ ঘটাইয়াছে বলিয়াই তাহাদের প্রতি তীব্রতা প্রকাশ করাও কাপুরুষতা। তাহাদের বিচারের ভার এমন হাতে আছে যে, অনুগ্রহ বা মমত্ব সেই হাতকে লেশমাত্র দন্ডলাঘবের দিকে বিচলিত করিবে না। অতএব ইহার উপরেও আমরা যেটুকু অগ্রসর হইয়া যোগ করিতে যাইব তাহাতে ভীরু স্বভাবের নির্দয়তা প্রকাশ পাইবে।” আমরা এর আগে লক্ষ্য করেছি, যেসব ভারতীয়রা বিদেশী প্রভুকে তুষ্ট করতে স্বদেশী বিপ্লবীদের প্রাণ খুলে নিন্দা ও কঠোর ভাবে দমনের সুপারিশ করেছিলেন, তিলক তাঁর ‘কেশরী’ পত্রিকার প্রবন্ধে তাদের কেমন ধিক্কার দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথও যেন এই শ্রেণীর লোকদের স্মরণ করিয়ে দিলেন এ-রকম সমালোচনার অমর্যাদাকর কাপুরুষতা ।

রবীন্দ্রনাথ প্রথমেই স্বীকার করলেন যে বাংলাদেশের ‘মনের জ্বালা’ দেখতে দেখতে ক্রমশই যেমন অগ্নিমূর্তি ধরে প্রকাশ পাচ্ছে, আমাদের জ্ঞানী দূরদর্শী ব্যক্তিরাও এটা কল্পনা করতে পারেননি কিন্তু কোন পক্ষের বিরুদ্ধে এই গোলমালের দিনে নালিশ তোলা তাঁর উদ্দেশ্য নয়, এর কার্যকারণ ও ফলাফল নিরপেক্ষভাবে বিচার করে পথ খোঁজাই তাঁর অভিপ্রায়। স্পষ্টতই এই প্রবন্ধে সশস্ত্র বিপ্লববাদকে তিনি মন থেকে সমর্থন করতে পারেননি। তাই তিনি বললেন, যে-চিত্তদাহের উত্তেজনা “আমরা প্রত্যেকে নানাপ্রকারে অনুভব ও প্রকাশ করিয়াছি, তাহারই একটি কেন্দ্রক্ষিপ্ত পরিণাম যদি এই প্রকার গুপ্তবিপ্লবের অদ্ভুত আয়োজন হয়, তবে ইহার দায় ও দুঃখ বাঙালিমাত্রকেই স্বীকার করিতে হইবে।......”

‘কেশরী’তে তিলকের প্রবন্ধগুলিতে আমরা দেখেছি যে, বোমাকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও বিপ্লবীদের বোমাবাজি যে সমর্থনযোগ্য নয়, সেকথাও [হয়তো বা আইন বাঁচাবার জন্যই] উল্লেখ করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু গুপ্তবিপ্লবকে আন্তরিক ভাবেই পছন্দ করেন না, যদিও এর কার্যকারণ সম্পর্কে তাঁর অনেক বিশ্লেষণই কিন্তু তিলকের সঙ্গে মিলে যায়। কিছু সাদৃশ্যের দিকে আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

বোমার আবির্ভাব যে কাপুরুষ বাঙালির রূপান্তর ঘটিয়েছে, ‘মারাঠা’ পত্রিকার এই মতের প্রতিধ্বনি করে রবীন্দ্রনাথও বলেন, “বহুদিন হইতে বাঙালিজাতি ভীরু অপবাদের দুঃসহ ভার বহন করিয়া নতশির হইয়াছে বলিয়াই বর্তমান ঘটনা সম্বন্ধে ন্যায়-অন্যায় ইষ্ট-অনিষ্ট বিচার অতিক্রম করিয়াও অপমান-মোচন উপলক্ষে বাঙালির মনে একটা আনন্দ না জন্মিয়া পারে নাই।” দ্বিতীয়ত মজঃফরপুরের বিস্ফোরণের মতো ঘটনার পেছনে মূল কারণ যে শাসকদের বৈষম্য ও দমননীতি আর দেশের লোকের আহত আত্মসম্মান – এই রোগনির্ণয় তিলকের মতো রবীন্দ্রনাথেরও :- “একদিকে প্রজার বেদনাকে উপেক্ষা করিয়া বলপ্রকাশ প্রবল মূর্তি ধরিতেছে, অন্যদিকে দুর্বলের নিরাশ মনোরথ সফলতার কোন পথ না পাইয়া প্রতিদিন মরিয়া হইয়া উঠিতেছে। এ অবস্থায় সমস্যাটি ছোট নহে।”

বিপ্লবীদের অধীর অসহিষ্ণু এবং বুদ্ধিভ্রষ্ট বলে রবীন্দ্রনাথ যে ভাবে ভর্ৎসনা করলেন, তিলক ততটা না করলেও তাঁদের কাজের জন্য তিলকের মতো নেতাদের দায়ী করাকে তিনিও সমর্থন করেন না, এটাই তিলকের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের তৃতীয় সাদৃশ্য। চতুর্থত রবীন্দ্রনাথও তিলকের মতো মনে করেছিলেন যে, নিছক বলপ্রয়োগ করে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় :- “বিরোধবুদ্ধি এতই গভীর ও সুদূরবিস্তৃত ভাবে পরিব্যাপ্ত যে, কর্তৃপক্ষ ইহাকে বলপূর্বক কেবল স্থানে স্থানে উৎপাটিত করিতে চেষ্টা করিয়া কখনোই নিঃশেষ করিতে পারিবন না, বরঞ্চ ইহাকে আরও প্রবল ও প্রকাণ্ড করিয়া তুলিবেন।”

রবীন্দ্রনাথ একথা বলে রাজশক্তিকে যেমন হুঁশিয়ারি দিতে চাইলেন, তেমনি আবার তাদের স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, ‘শক্তস্য ভূষণং ক্ষমা’ – যদিও তাঁর এই ‘সাত্ত্বিক উপদেশ’ রাজপুরুষেরা শ্রদ্ধা সহকারে শুনবেন, এমন ভরসা যে তাঁর নেই, সে কথাও স্বীকার করলেন। কিন্তু এদের মধ্যে যে সব লোক গুপ্ত পন্থাকেই রাষ্ট্রহিতসাধনের একমাত্র পথ বলে স্থির করেছে, তাদের গালি দিয়েও কোন ফল হবেনা, আবার ধর্মোপদেশ দিতে গেলেও তারা হেসে উড়িয়ে দেবে। অত্যাচারী কর্তৃপক্ষ আর চরমপন্থী দেশবাসী- এদের কারও সমর্থনই রবীন্দ্রনাথ করেননি। তাই এই দুই পক্ষের সংঘর্ষ তাঁর কাছে অধর্ম সংঘর্ষ, যার অগ্নিদাহ তাঁর মতে সহ্য করতে হবে নিরীহ তৃতীয় পক্ষকেও, যারা প্রত্যক্ষ ভাবে এ সব কাজে লিপ্ত নয়। তাঁর মূল বক্তব্য তাই নিছক উপদেশের খাতিরে নয়, বাস্তব প্রয়োজনের দিক থেকেই এবং সেই বাণী হলো এই যে, প্রয়োজন অত্যন্ত গুরুতর হলেও প্রশস্ত পথ দিয়েই তা মেটাতে হয় – সংকীর্ণ রাস্তা ধরে কাজ সংক্ষেপ করতে গেলে একদিন দিক ভুল হয়ে পথও হারাতে হবে, কাজও নষ্ট হবে।

এই ‘পথ ও পাথেয়’ প্রবন্ধটির বক্তব্যে বাংলাদেশে কিছু প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, সে কথা রবীন্দ্রনাথ নিজেই উল্লেখ করেছেন। তাঁর কাছে এটা শুধু ‘নির্বিচার নিষ্ঠুরতা’ই নয়, এই পথের পথিকেরা তাঁর চোখে নিছকই ‘ক্ষুদ্র স্বার্থের’ পূজারী। বিপ্লববাদীদের সম্পর্কে অনুকম্পা প্রকাশ করে‎‎ও তাঁদের আদর্শ সম্বন্ধে এই সব কঠোর মন্তব্যই এই ভাষণটি সম্পর্কে জনমনে প্রতিকূলতা সৃষ্টির সম্ভাব্য কারণ বলে মনে করলে হয়তো অসঙ্গত হবেনা, কারণ এই বিপ্লবীরা ক্ষুদিরামের বোমা-কাণ্ডের পর থেকেই জনতার বীরপূজা পেতে শুরু করেছিলেন। তাই এই প্রতিকূলতার কারণেই নিজের অভিমত খোলসা করতে রবীন্দ্রনাথকে পুনশ্চ কলম ধরতে হয়, লিখতে হয় ‘সমস্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি।

এই রচনাটিতে তিনি ভারতবাসীর প্রতি শাসক ইংরেজের অমানবিক ব্যবহার, তাদের তল্পিবাহক মুখপাত্রদের দ্বারা স্পর্ধিত দোষারোপ ও স্বদেশী দাবিকে অবদমিত করার ফতোয়ার কথা স্পষ্ট করেই উল্লেখ করলেন এবং এগুলোকেই ভারতবর্ষের চরম হিত যে কী, তা বোঝার পথে সর্বপ্রধান বাধা বলে উল্লেখ করলেন। তাঁর মতে ইংরেজ কোনোমতেই ভারতীয়দের মানবপ্রকৃতি বলে গণ্য করতে চায়না। জনমনের আলোচ্য ক্ষোভের পেছনে যে ইংরেজ শাসকের দুঃশাসন- নীতিই দায়ী, আর এর উপশম যে আরও উৎকট পীড়ন দিয়ে করা যাবেনা, এ-কথা শাসকদের তীব্র ভাষায় স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, যে-সব ইংরেজশাসক বলেন, ‘কাগজগুলোকে উচ্ছেদ করো, সুরেন্দ্রবাঁড়ুয্যে বিপিনপালকে দমন করিয়া দাও’, দেশকে ঠাণ্ডা করার এই একমাত্র উপায় যারা অনায়াসে কল্পনা করতে পারে আর অসঙ্কোচে প্রচার করতে পারে, তারা যে দেশের শাসকপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, এটাই কি দেশের রক্ত গরম করে তোলার পক্ষে প্রধান কারণ নয়! বাংলাদেশের এক ভূতপূর্ব হর্তাকর্তা [ইলিয়ট] বলেছিলেন যে, ভারতবর্ষে যারা ইংরেজের গায়ে হাত তোলে, তারা যেন কোনওমতেই নিষ্কৃতি না পায়, সে- বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এ কথা উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন করেন – “আর যে সকল ইংরেজ ভারতবর্ষীয়কে হত্যা করিয়া কেবলই দন্ড হইতে অব্যাহতি পাইয়া ব্রিটিশ বিচার সম্বন্ধে চিরস্থায়ী কলঙ্কের রেখা আগুন দিয়া ভারতবর্ষের চিত্তে দাগিয়া দিতেছে তাহাদের সম্বন্ধেও সতর্ক হইবার কোনো প্রয়োজন নাই?”

দেখা যাচ্ছে, ‘বলদর্পে অন্ধ ধর্মবুদ্ধিহীন’ ইংরেজ শাসনের এই স্পর্ধাকে ধিক্কার দিতে রবীন্দ্রনাথ কোনরকম দ্বিধা প্রকাশ করলেন না এবং দেশের লোকের যে- অসন্তোষ তাদের ইংরেজের গায়ে হাত তোলায় প্ররোচিত করেছে, তার জন্য ইংরেজ শাসনের ঐ চরিত্রকেই নিঃসঙ্কোচে দায়ী করলেন। শুধু তা-ই নয়, আত্মপ্রসাদস্ফীত বিদেশী শাসককে মহাকালের কন্ঠে শুনিয়ে দিলেন, তারা জেলে দিতে পারে, ফাঁসি দিতে পারে, কিন্তু নিজের রাজদন্ডকে যদি বিশ্ববিধানের চেয়ে বড় বলে জ্ঞান করে, তবে তার স্তূপীকৃত সেই পাপের বোঝার ঘোরতর অসামঞ্জস্য একদিন নিদারুণ বিপ্লবে পরিণত না হয়ে পারেনা। অর্থাৎ তিনি যদিও তিলকের মতো বোমার রাজনীতিকে নামমাত্র নিন্দা করে বোমার পক্ষে যুক্তির কথা জোর গলায় বললেন না, বরং আরও অগ্রসর হয়ে ক্ষুদিরামের মতো বিপ্লবীদের অনভিজ্ঞ, ক্ষুদ্র স্বার্থের অনুসারী ও নির্বুদ্ধিতার শিকার ইত্যাদি [‘পথ ও পাথেয়’ প্রবন্ধে] বলতেও দ্বিধা করলেন না বটে, কিন্তু এই বোমার রাজনীতির উদ্ভবকে তিনি ইংরেজের ঘৃণ্য নীতির প্রত্যাশিত পরিণতি বলে তিলক, বিপিনচন্দ্র ও অন্যান্য নেতাদের মতোই স্পষ্টভাষায় নির্দেশ করলেন, যা তিনি বাংলায় প্রাথমিক বিপ্লবকাণ্ডগুলির সূত্রে কিছুদিন আগেও উপলব্ধি করতে পারেননি [বিগত সংখ্যায় বর্তমান প্রবন্ধের পর্ব-১ দ্রষ্টব্য] -এটি অবশ্যই একটি লক্ষ্য করবার মতো ব্যাপার।

কোনও রাষ্ট্রনেতার ভাষণে বা রচনায় যে ঋজুতা সম্ভব ছিলনা, সেই স্পষ্টতর ভাষায় শাসকদের উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথ বললেন, “যদি কেবল আমাদের দিকে তাকাইয়া এই কথাই বল যে, অকৃতার্থের অসন্তোষ ভারতের পক্ষে অকারণ অপরাধ এবং অপমানের দুঃখদাহ ভারতের পক্ষে নিরবচ্ছিন্ন অকৃতজ্ঞতা – তবে সেই মিথ্যাবাক্যকে রাজতক্তে বসিয়া বলিলেও তাহা ব্যর্থ হইবে এবং তোমাদের টাইমসের পত্রলেখক, ডেলি মেলের সংবাদ রচয়িতা এবং পায়োনীয়র-ইংলিশম্যানের সম্পাদকে মিলিয়া তাহাকে ব্রিটিশ পশুরাজের ভীমগর্জনে পরিণত করিলেও সেই অসত্যের দ্বারা তোমরা কোনো শুভফল পাইবেনা। তোমার গায়ে জোর আছে বটে, তবু সত্যের বিরুদ্ধেও তুমি চক্ষু রক্তবর্ণ করিবে এত জোর নাই। নূতন আইনের দ্বারা নূতন লোহার শিকল গড়িয়া তুমি বিধাতার হাত বাঁধিতে পারিবে না।”

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের এ-সব নির্ভীক বক্তব্য যে-কারণেই হোক, রাজদ্রোহের দায়ে অভিযুক্ত না হলেও তিনি ব্রিটিশ শাসকদের কিছুই প্রায় বলতে বাকি রাখলেন না। ইলিয়টের মতো প্রাক্তন শাসকের দম্ভোক্তিকে তিনি সোজাসুজি মিথ্যাভাষণ বললেন, বিলেতি কাগজগুলোকে এক হাত নিতে ছাড়লেন না এবং লক্ষ করার বিষয়, ‘ব্রিটিশসিংহ’ না বলে ‘ব্রিটিশ পশুরাজ’ বললেন, যাতে তার পাশবিকতার প্রতি ‎ইঙ্গিতটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্মরণীয় যে, প্রায় একই সতর্কবাণীকে রবীন্দ্রনাথ কয়েক বছর আগেই গানে বেঁধেছিলেন –“বিধির বাঁধন কাটবে তুমি, এতই শক্তিমান/ আমাদের ভাঙাগড়া তোমার হাতে এমনি অভিমান!/ শাসনে যতই ঘেরো, আছে বল দুর্বলেরও/ বোঝা তোর ভারী হলেই ডুববে তরী খান।” কিংবা – “ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে, ততই বাঁধন টউটবে/ ওদের আঁখি যতই রক্ত হবে, ততই আঁখি ফুটবে!...” , তখনও বাংলায় বোমার যুগ শুরু না হলেও ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে তাঁর যে-ধারণা অনেকটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল, মজঃফরপুর-বিস্ফোরণের কার্যকারণ বিশ্লেষণে রবীন্দ্রনাথ যেন সে-ধারণারই যৌক্তিকতা খুঁজে পেলেন।

শুধু শাসকপক্ষকে ধিক্কার দিয়েই যে রবীন্দ্রনাথ ক্ষান্ত হলেন না, যে-কাজকে তিনি ‘অধর্ম’ ও ‘পাপ’ বলে মনে করেন, তাতে লিপ্ত হবার জন্য নিজের দেশের মানুষকে তিরস্কার করতেও ছাড়লেন না। ‘দেশহিত’ নামে তাঁর একটি প্রবন্ধেও [বঙ্গদর্শন, আশ্বিন, ১৩১৫] তিনি বিশেষ ভাবে অভিযোগের তর্জনী তুললেন গুপ্তবিপ্লবের হোতাদের দিকে :- “রাজার সন্দেহ জাগ্রত হইয়া আমাদের চারিদিকে যে শাসনজাল বিস্তার করিতেছে তাহার বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগ আমরা সর্বদা উচ্চকন্ঠেই প্রচার করিতেছি, কিন্তু যেখানে আমাদের স্বদেশের লোক আমাদের যজ্ঞের পবিত্র হুতাশনে পাপ-পদার্থ নিক্ষেপ করিয়া আমাদের হোমকে নষ্ট করিতেছে, তাহাদিগকে আমরা কেন সমস্ত মনের সহিত ভর্ৎসনা করিবার, তিরস্কৃত করিবার শক্তি অনুভব করিতেছি না। তাহারাই কি আমাদের সকলের চেয়ে ভয়ংকর শত্রু নহে।......”

গুপ্তবিপ্লবরূপী শক্তিসাধনায় যারা মেতে উঠেছেন, বিশেষ ভাবে সেই বিপ্লবী দলগুলোকেই তিনি যেন মনে করিয়ে দিতে চাইলেন যা আসলে শক্তি নয়, শান্তির বিড়ম্বনা, শক্তিধর্মসাধনায় সেই উচ্ছৃঙ্খলতার মতো সর্বনেশে বিঘ্ন আর কিছুই নেই। তিনি লক্ষ্য করলেন, “আজ দস্যুবৃত্তি, তস্করতা, অন্যায় পীড়ন দেশহিতের নাম ধরিয়া চারিদিকে সঞ্চরণ করিতেছে।” তাই দেশবসীকে সতর্ক করে দিলেন যে, কেবলমাত্র বীর, ত্যাগী ও তপস্বীরাই আত্মহিত, দেশহিত ও লোকহিতের যথার্থ সাধক আর ধর্মই হচ্ছে প্রকৃত শক্তি। তাই “জাতির চরিত্রকে নষ্ট করিয়া আমরা জাতিকে গড়িয়া তুলিব”, এমনটা ভাবা ‘ভয়ংকর ভুল’।

এটা বুঝতে অসুবিধা হয়না যে, সমকালীন পরিস্থিতির মূল্যায়নে দুটি পরস্পর সংঘর্ষশীল পক্ষের মধ্যে যে কোনও একটির দিকে ঝুঁকে না পড়ে নিষ্কম্প কন্ঠে নিজের বিবেকের রায় উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন বলেই রবীন্দ্রনাথ এক অনন্য ও স্বতন্ত্র স্তম্ভপ্রতিম উচ্চতায় অধিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন, যা বেশ কিছুটা অপ্রিয়তা ও লোকনিন্দার মূল্য চুকিয়ে তাঁকে ক্রয় করতে হয়েছিল ।




আকর-পঞ্জীঃ-

১। তিলকের পত্রিকায় স্বদেশী ‎আন্দোলন/ শঙ্করীপ্রসাদ বসু [চার] – শিলাদিত্য,
১-১৫ মার্চ, ১৯৮৪।

২। নির্ঝরিনী সরকারকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি- চিঠিপত্র সপ্তম খণ্ড 
[বিশ্বভারতী] 

৩। আত্মশক্তি ও সমূহ / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- রবীন্দ্ররচনাবলী [জন্মশতবার্ষিক
সংস্করণ], দ্বাদশ খণ্ড। 

৪। রাজাপ্রজা/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- ঐ , ঐ, ঐ ।

0 comments: