0

সম্পাদকীয়: সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


অতিথি  সম্পাদকের কলমে 
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

এরকম একটা সময় পৃথিবীতে আসবে কি, যখন আর কাগজের বইয়ের কোনও অস্তিত্ব থাকবে না? বা থাকলেও সেটা সীমাবদ্ধ থাকবে শুধু সংগ্রহশালার আলমারির ভিতর? কিরকম হবে সেই সময়টা? খুব দুঃখজনক? Depressing?

আপাতচিন্তায় সেই রকমই তো মনে হয়। বসার ঘরের bookrack ভরা রঙ-বেরঙের বই, পড়ার টেবিলের উপর স্তূপীকৃত বইয়ের রাশি, তার মধ্যে থেকে টুক করে একখানা তুলে নিয়ে পাশের বিছানায় গড়িয়ে পড়ার আরামই যদি না থাকে, তাহলে আমাদের মতন পাঠপিপাসু মানুষের জীবনে আর থাকে কি? তাই বই নেই – এইরকম একটা পরিস্থিতির কথা ভাবতেই আমাদের শরীর, মন, অন্তরাত্মা অবধি কিকরম যেন করে ওঠে!

বিশেষ করে বছরের এই সময়টায়। সামনেই বইমেলা। বাঙালির প্রায় তিন প্রজন্মের বোহেমিয়ান রোম্যান্টিকতার স্থানীয় লীলাভূমি, মননের শিল্পক্ষেত্র, জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান ভারতবর্ষের একমেবদ্বিতীয়ম পুস্তকোৎসব। ঠাঁইনাড়া হওয়া সত্ত্বেও সে এখনও স্বমহিমায় ভাস্বর। কয়েক লক্ষ বাঙালির সম্বৎসর প্রতীক্ষার মাঠজোড়া ফসল। স্কুল-কলেজ-অফিস ফেরতা সান্ধ্যভ্রমণ বা সপ্তাহান্তে সপরিবার একটা ছোটখাটো পিকনিক... বইমেলা ছাড়া কলকাতা ও তার আশপাশের অঞ্চলবাসী শিক্ষিত বাঙালির শীতকালটাই সম্পূর্ণ হয় না। কিন্তু বই না থাকলে যে বইমেলাও থাকবে না, সে কথা স্বতঃসিদ্ধ। এবং সে যে ভারি দুঃখের বিষয় হবে, সে কথা বাঙালিকে আর আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই।

কিন্তু মুশকিল হলো, বিশ্বব্যাপী পরিসংখ্যান বলছে, গত কয়েক দশকে প্রকাশনা ও পাঠকের সংখ্যা হু হু করে বেড়েছে। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ শিক্ষার প্রসার যে বেড়েছে পৃথিবীতে, তাতে বিশেষ সন্দেহ নেই। হ্যাঁ, যাঁদের রসবোধে অম্লরসের একটু আধিক্য, সেই চিরকালের প্রতিষ্ঠানবিরোধীরা জিজ্ঞেস করতেই পারেন, চারপাশের এই ধর্মধ্বজরা কি সেই প্রসারিত শিক্ষার নিদর্শন? সে প্রশ্নের সদুত্তর দেওয়ার মতন বিদ্যেবুদ্ধি আমার নেই। তবে পরিসংখ্যানকে যেহেতু ফেলে দেওয়া যায় না, সেই কারণে একথা মেনে নিতেই হবে, যে সারা পৃথিবীর নিরিখে মানুষের পাঠাগ্রহ বেড়েছে, এবং সেই সঙ্গে বেড়েছে বইয়ের সংখ্যা – সেটা যে রূপ বা format-এই হোক না কেন।

আসলে বই বা book কথাটা এখন আর শুধুমাত্র কাগজে ছাপা পৃষ্ঠার সংকলন বোঝায় না। সে কথা অবশ্যই এই web magazine-এর পাঠক-পাঠিকাদের আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই। আমি নিশ্চিত, আপনারা প্রায় সবাই e-book বা kindle জাতীয় জিনিস পড়তে অভ্যস্ত। কাগজের বইয়ের মতন সর্বার্থে সুখপাঠ্য সেগুলো যে নয়, সে কথা অনস্বীকার্য। টানা অতক্ষণ আলোর উৎসের দিকে তাকিয়ে থাকা যে চোখের জন্যও খুব স্বাস্থ্যকর নয়, সেও সত্যি। কিন্তু তার থেকেও বড় একটা সত্যি এই কাগজের বইয়ের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার পিছনে লুকিয়ে আছে।

সেই সত্যিটা হলো, শুধু বই নয়, কাগজ বস্তুটার যে কোনও ব্যবহার আমাদের এই গ্রহটার প্রায় অপূরণীয় ক্ষতি করে দিচ্ছে। কাগজ তৈরি হতে কাঠ লাগে, এবং সেই কাঠের জোগান দিতে দিতে প্রকৃতির এখন নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম। কৃত্রিম কাগজ তৈরি করার কিছু উপায় patented হয়েছে বটে, কিন্তু যা দিয়ে সে কাগজ তৈরি হয়, সেই polyolefin বা styrene polymer জাতীয় রাসায়নিক বস্তুগুলোর সম্পূর্ণ জৈববিনাশ বা biodegradation হয় না। তাই পৃথিবীর স্বাস্থ্যের খাতিরে সম্ভবত মানুষের খানিকটা স্বাস্থ্য আর বেশ কিছুটা আনন্দ পরিত্যাগ করার সময় ঘনিয়ে আসছে। পুস্তকপ্রেমী মানুষদের যে দুর্দিন আসছে, সে কথা বলা বাহুল্য।

তবে পরিস্থিতিটা আপাতদৃষ্টিতে যতখানি নৈরাশ্যব্যঞ্জক মনে হয়, ততখানি বোধহয় নয়। আসলে ওই পুস্তকপ্রেম এবং পাঠপ্রেমের মধ্যেকার তফাৎটাকে ধীরে ধীরে বাড়িয়ে তুলতে হবে, এই যা। ব্যবসা-বানিজ্য-প্রশাসনের কাজে কাগজের ব্যবহার চট করে কমিয়ে ফেলা কঠিন। তার জন্য নানারকম আইন বদলানোর প্রয়োজন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রেও তাই। শুধু কাগজের যে ব্যবহারটিকে এই পর্যায়ে কমানো সম্ভব, সেটি হলো পাঠক্রমবহির্ভূত বইয়ের উৎপাদন। বই-পত্রিকা-সংবাদপত্র পড়ার অন্যান্য পদ্ধতিগুলি, অর্থাৎ তাদের digital সংস্করণগুলি যত তাড়াতাড়ি জনপ্রিয়তর হবে, তত তাড়াতাড়ি বোধহয় কাগজের বই ছাপার প্রয়োজন কমে আসবে।

আমি অনেককে বলতে শুনেছি, digital সংস্করণের গ্রহস্বত্বাপহরণ বা piracy নাকি খুব সহজ। কিন্তু একটু খেয়াল করে দেখবেন, যে সমস্ত pirated e-book গুলি আমরা download করে পড়ি, সেগুলি বেশির ভাগই কিন্তু মুদ্রিত বইয়ের scanned copy। একবার বই হাতে পেলে তাকে scan করে upload করে ফেলা অত্যন্ত সহজ কাজ, এবং সে কাজ আটকানোরও কোনও উপায় নেই। কিন্তু যদি সে বই ছাপাই না হয়, শুধুমাত্র digital সংস্করণেই সীমিত থাকে, তাহলে তাকে download‌‌‌‌‌-সুরক্ষিত রাখলেই কিন্তু গ্রহস্বত্বাপহরণের সম্ভাবনা অনেকখানি কমে যায়। 

তবে বই, পত্রিকা বা সংবাদপত্র ছাপা বন্ধ হয়ে গেলে যে অনেক সংস্থা এবং ব্যক্তির বানিজ্যিক স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটবে, সে কথাও ঠিক। বিক্রির হার এক ধাক্কায় অনেকখানি কমে যাবে। বিজ্ঞাপনের ব্যবসায়িক মুনাফাও হ্রাস পাবে। তবে সে সবই সাময়িক। যে কোনও সামাজিক বা প্রযুক্তিগত বিবর্তনেই অভ্যস্ত হতে আমাদের সময় লাগে। কিন্তু সেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যখন মানুষের সমাজচেতনায় সে বিবর্তনের সুফল স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তখন আর অসুবিধা হয় না। সমাজবিবর্তনের ইতিহাস তা-ই বলে, এবং সেটাই rationality-র নিয়ম।

তাই মুদ্রিত বই বা তার দোকানের সংখ্যা কমে গেলেই যে সেটা খুব আতঙ্কিত হওয়ার মতন বিষয় হবে, তা মনে হয় না। বরং যেটা বেশ দুশ্চিন্তার বিষয়, সেটা হলো সাহিত্যের মানগত অবনমন বা অবমূল্যায়ন। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে সেটা ঘটছে কি না, এবং সেই কারণে বাঙালির পাঠাগ্রহ কমে যাচ্ছে কি না, সেটা সম্পূর্ণ অন্য বিষয়। তার বিশ্লেষণ করার জন্য আমার থেকে অনেক বেশি ধীসম্পন্ন বিচক্ষণ আলোচকের প্রয়োজন। অদূর ভবিষ্যতে ঋতবাকের e-পৃষ্ঠায় সে বিষয়ে লেখা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।


0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ: স্বপন দেব

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ

ফিরে দেখা বই-মেলা
স্বপন দেব



১৯৭৪ সালের ৫ ই ডিসেম্বর, বৃহস্পতি বার, বিকেল পাঁচটা। কলেজ ষ্ট্রীট কফি হাউসের তিনতলায় তিনটি টেবিল এক সাথে জুড়ে শীতের পড়ন্ত বিকেলে জোর আড্ডা চলছে কিছু তরুণ এবং নবীন প্রকাশক দের। এটা ওটা নিয়ে আলোচনা চলতে চলতে একজন বলে উঠলেন, আচ্ছা, বই নিয়ে একটা মেলা করা যায় না ? বই প্রেমীরা দলে দলে আসবেন আর আমাদের ব্যবসাও বেশ ফুলে-ফেঁপে উঠবে ? উপস্থিত সকলের ই মনে ধরল কথাটা। 

এর পর আলোচনা শুরু হল এটা নিয়েই। কথায় কথায় ফ্র্যাঙ্কফুর্ট বই মেলার কথাও বললেন কেউ কেউ। সবাই এক কথায় রাজী ! চলো সকলের সঙ্গে আলোচনা করে দেখা যাক ! বই-মেলার স্বপ্ন বুকে নিয়ে যে যার বাড়ী ফিরে গেলেন। মাস দুয়েক পরে সমস্ত প্রকাশক দের নিয়ে একটা সভা ডাকা হোল ৩ নং সূর্য সেন ষ্ট্রীটের ত্রিপুরা হিতসাধিনী সভা গৃহে। সেখানে বিমল ধর মহাশয় বই-মেলার কথা তুলতেই ছ্যা ছ্যা করে ঊঠলেন প্রবীণ প্রকাশকেরা ! তাঁদের বক্তব্য, বই কি একটা পণ্য ? মেলায় বই বিক্রি করায় তাঁদের ঘোরতর আপত্তি আছে। এদিকে তরুণ প্রকাশকরাও নাছোড়বান্দা ! তাদের বক্তব্য বই তো প্রকাশ ই হয় বিক্রির জন্যে। আর যে কোন জিনিষের মত বিক্রির জন্যে বই এরও একটা বাজার দরকার। ঠিক আছে, পরীক্ষামূলক ভাবে বছর তিনেক চালিয়েই দেখা যাক না ! না, সেই সভায় কোন সিদ্ধান্তই নেওয়া গেলনা। কিন্তু, প্রবীণ দের রাজী করানোর জন্যে বিমল ধর, অশোক বারিক, সুপ্রকাশ বসু, অরুণ বাগচি রা কথাবার্তা চালাতে লাগলেন এবং আস্তে আস্তে এক এক করে রূপার এন ডি মেহতা, অক্সফোর্ড এর নিল ও-ব্রায়েন, সাহিত্য সংসদের মহেন্দ্রনাথ দত্ত, এম সি সরকারের সুপ্রিয় সরকার, আলায়েড পাবলিশার্স এর জয়ন্ত মাকনতলা, মিনার্ভা অ্যাসোসিয়েটস এর সুশীল মুখার্জী যাঁরা সেইসময়ে প্রকাশক মহলে বেশ নামকরা ছিলেন তাঁরাও দলে এলেন। 

এইসবেরই পরিণতিতে ১৯৭৫ সালের ১৮ ই সেপ্টেবর পাবলিশার্স & বুকসেলার্স গিল্ড জন্ম নিল। এর পরেই শুরু হয় কলকাতা বইমেলার চিন্তাভাবনা। সর্বভারতীয় প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতাদের কথা মাথায় রেখে কলকাতা বইমেলার পোষাকি নাম হয় কলিকাতা পুস্তকমেলা বা ইংরাজিতে ক্যালক্যাটা বুক ফেয়ার। প্রথমে ঠিক হয়েছিল যে প্রতি বছর নয় বরং একবছর অন্তর এই বই মেলার আয়োজন করা হবে। নেহাৎ ই পরীক্ষামূলক ভাবে ১৯৭৬ সালের ৫ ই মার্চ সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল-বিড়লা তারা মণ্ডলের উল্টোদিকের ছোট মাঠে যেটা এখন মোহরকুঞ্জ নামে পরিচিত সেখানেই প্রথম কলকাতা বইমেলার আয়োজন হয়েছিল। মাত্র ৩৪ জন প্রকাশক এবং ৫৬ টা স্টল নিয়ে এই মেলা শুরু হয়। মেলার সাফল্য সম্পর্কে সন্দেহ থাকায় অনেক প্রকাশক ই যোগ দেন নি এই প্রথম মেলায়। 

কিন্তু এই বই মেলায় যথেষ্ট জনসমাগম হওয়ায় পরের বছর আবার বইমেলা করার সিদ্ধান্ত হয় এবং পরের বছর থেকে বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশকের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। আর এই প্রথম বইমেলার সুবাদেই সেই বছর নয়াদিল্লিতে বিশ্ব বইমেলায় অংশ গ্রহণ করার সুযোগ পায় গিল্ড এবং জিতে নেয় মাঝারী স্টলের শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার টি। এই প্রথম বছরেই গিল্ড ফ্রাঙ্কফুর্ট বুক ফেয়ারেও অংশ নেয়। তবে বইমেলার যে বিপুল জনপ্রিয়তা আজ চোখে পড়ে তার সূচনা হয়েছিল ১৯৭৮ সালে আয়োজিত তৃতীয় বইমেলা থেকে। সে বছর মোট ১১২ টি প্রকাশন সংস্থা বইমেলায় অংশ নিয়েছিলেন আর মেলা আয়োজিত হয়েছিল রবীন্দ্রসদনের বিপরীতে ভিক্টোরিয়া সংলগ্ন অপেক্ষাকৃত বড় মাঠটিতে। ১৯৮৩ সালে মেলায় যোগ দিয়েছিলেন ২৮৫ টি প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতা সংস্থা। সেবার বিড়লা তারামণ্ডল থেকে রবীন্দ্রসদনের বিপরীতে অবস্থিত অধুনা মোহরকুঞ্জ উদ্যানের সবটাই মেলার জন্যে পেয়ে যায় গিল্ড এবং প্রায় এই সময় থেকেই বইমেলা হয়ে ওঠে বাঙালীর চতুর্দশ পার্বণ। 

এই বছরেই একটি গ্রন্থ প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসে অকস্মাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মেলা-প্রাঙ্গনেই প্রয়াত হন আনন্দবাজার পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক অশোক কুমার সরকার। ১৯৮৪ সালে মেলা আয়োজিত হয়েছিল ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউণ্ডে। সে বছরেই জেনেভার ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হয়ে বইমেলার আন্তর্জাতিক ক্যালেণ্ডারের স্থান করে নেয় কলকাতা বইমেলা। মেলার চতুর্থ বছর থেকেই গিল্ড সিদ্ধান্ত নেয় যে কলকাতা বইমেলার একটা নির্দিষ্ট সময়সূচী থাকা উচিৎ। সেইমত ঠিক হয় যে প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের শেষ বুধবার থেকে ফেব্রুয়ারীর দ্বিতীয় রবিবার অবধি মেলা চলবে। ক্রমশ কলকাতা বইমেলা একটা আন্তর্জাতিক রূপ পেতে থাকে। ১৯৮৩ সালে সারা বিশ্বের সাহিত্য ও প্রকাশনার সাথে যুক্ত বিখ্যাত ব্যক্তিরা কলকাতা বইমেলায় আসা শুরু করেন। সে বছর ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশার্স অ্যাসোশিয়েশনের সভাপতি জেনেভা থেকে কলকাতা বইমেলায় যোগ দিতে আসেন। আগের বছর এসেছিলেন ফ্রাঙ্কফুর্ট বুক ফেয়ারের ডিরেক্টর। ভীড় বাড়ছে, ক্রমশ আরো বেশি বেশি করে প্রকাশক রা আসছেন বইমেলায় স্টল পেতে। স্থান সঙ্কুলান হচ্ছেনা আর পুরানো জায়গায়। 

১৯৯১ সালে কলকাতা বইমেলা উঠে এল মাদার তেরেসা সরণি-আউটরাম রোড- জহরলাল নেহরু রোডের সংযোগস্থলের ময়দানে। কলকাতা বইমেলার ইতিহাসে ১৯৯৭ সালটা কোনদিন ই ভোলার নয়। তখন কলকাতা বইমেলা পুরোপুরি আন্তর্জাতিক। এর আগে ভারতীয় রাজ্যগুলিকে ফোকাল থিম করা হলেও এই ৯৭ সালেই প্রথম একটি বিদেশী রাষ্ট্র ফ্রান্স কে ফোকাল থিম করা হয় আর একটা নতুন আকর্ষণ যোগ হয় বইমেলায়। সেটা হল মঁমার্তে। বিশিষ্ট এবং উঠতি নামী শিল্পী রা এসে প্রতিদিন ছবি আঁকতেন। থিম প্যাভিলিয়নটি সাজানো হয়েছিল প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামের আদলে। বইমেলার উদবোধন করেছিলেন স্বনামধন্য ফরাসী সাহিত্যিক জাঁক দেরিদা। 

আর এই ১৯৯৭ সালেই ঘটল সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা। মেলার ষষ্ঠ দিনে বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে গেল বইমেলা। প্রচুর ক্ষতি এবং হতাশায় ভগ্নোদ্যম গিল্ডের পাশে এসে দাঁড়ালেন তৎকালীন সংস্কৃতি ও স্বরাষ্ট্র দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। মাত্র তিন দিনেই আবার নতুন করে গড়ে তুললেন মেলা-প্রাঙ্গন। সে বছরে মেলা চলেছিল ২০ দিন। ১৯৯৮ থেকে ২০০৬ সাল অবধি ময়দানে বইমেলা নিরুপদ্রবেই চলেছে কোন ঘটনা বা দুর্ঘটনা ছাড়াই। প্রতি বছরে খালি ফোকাল থিম পাল্টেছে। ১৯৯৯ তে বাংলাদেশ ছিল ফোকাল থিম। বিখ্যাত কবি সামসুর রহমান মেলার উদবোধন করেন এবং তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনাও বইমেলা ঘুরে যান। 

বইমেলার ভবিষ্যৎ আকাশ গাঢ় কালো মেঘে ছেয়ে গেল ২০০৭ সালে। ময়দানে বইমেলা অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে একটি জনস্বার্থের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে মেলা উদবোধনের আগের দিন মহামান্য হাইকোর্ট নির্দেশ দিলেন যে অবিলম্বে ময়দানে বইমেলা বন্ধ করে দিতে হবে। গিল্ডের তো মাথায় হাত ! সেবার ফোকাল থিম ছিল অষ্ট্রেলিয়া আর অতিথি রাষ্ট্র ছিল ইউ এস এ। ইতিমধ্যেই ইউ এস এ আর অষ্ট্রেলিয়া থেকে বহু অতিথি এসে গেছেন। ময়দানের ২৩ একর জায়গার বদলে মাত্র ১০ একর জায়গা পেল গিল্ড যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে। মেলা শুরুর দিন আবার নতুন করে ঠিক করতে হল। ওদিকে সল্ট লেক স্টেডিয়ামে নতুন করে মেলা শুরু করার কর্মকাণ্ড চলতে লাগলো। সেবার প্রকৃতিও ছিল গিল্ডের প্রতি বিরুপ। আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টিতে ব্যহত হচ্ছিল পুননির্মাণের কাজ। 

মঁমার্তে, চিলড্রেন প্যাভিলিয়ন এবং আরো অনেক কিছু নিয়মিত অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে অবশেষে ১০ ই ফেব্রুয়ারী আবার শুরু হল বইমেলা। মেলা চলেছিল ১৫ দিন। কিন্তু, যাতায়াতের অসুবিধা, যানবাহনের অভাব ইত্যাদির জন্যে সেবারের মেলা তেমন জমে ওঠেনি। ২০০৬ এর ২৫ লাখ দর্শকের তুলনায় সেবার মেলায় লোকসমাগম ছিল মাত্র ৮ লাখ। ছোটো ও মাঝারী প্রকাশকেদের বিপুল ক্ষতি হওয়ায় গিল্ড স্থির করলো সল্টলেক স্টেডিয়ামের বদলে তাদের পরের বছরের মেলার জন্যে অন্য জায়গা খুঁজতে হবে। এর মধ্যেই এতদিন বন্ধু সেজে থাকা কিছু লোক তাদের আস্তিন থেকে ঈর্ষার অস্ত্র বের করে গিল্ডের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নেমে পড়ল। যাই হোক, রাজ্য সরকারের প্রস্তাব মত মিলনমেলা অথবা পার্ক সার্কাস ময়দানের মধ্যে ২০০৮ এর বইমেলার জন্যে গিল্ড পার্ক সার্কাস ময়দানকেই বেছে নিল। ৩০শে জানুয়ারী থেকে ৯ ই ফেব্রুয়ারী বইমেলার দিন ঠিক হয়ে গেল। উদবোধন ২৯শে জানুয়ারী। 

কিন্তু আবার জনস্বার্থ মামলা এবং তার পরিণতিতে মেলার উদবোধনের ঠিক আগের দিন মাননীয় ক্যালক্যাটা হাই-কোর্ট নির্দেশ দিলেন পার্ক সার্কাস ময়দানে বইমেলা করা যাবেনা ! কি সর্বনাশ ! সেবারের ফোক্যাল থিম ছিল ইউ এস এ এবং ইতিমধ্যেই ৬৭ জন প্রতিনিধি ইউ এস এ এবং ল্যাটিন অ্যামেরিকার বিভিন্ন দেশ থেকে কলকাতায় হাজির হয়ে গেছেন ! এই পরিস্থিতিতে গিল্ডের বেশীরভাগ সদস্যই মত দিলেন সেবারের বই মেলা স্থগিত ঘোষণা করার। মেলা বন্ধ হয়ে গেল। এই সময়েই যারা গিল্ডের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নেমেছিলেন তারা বইমেলা ২০০৮ নাম দিয়ে মার্চের প্রথম সপ্তাহে ঐ সল্টলেক স্টেডিয়ামে একটি বইমেলার আয়োজন করেন এবং সেটি চূড়ান্ত ফ্লপ করে। মেরেকেটে লাখ পাঁচেক দর্শক গিয়েছিলেন সেখানে। 

যাইহোক বহু বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে ২০০৯ সালের কলকাতা পুস্তক মেলা স্থানান্তরিত হল সায়েন্স সিটির বিপরীতে সেই বহুপ্রস্তাবিত মিলন মেলা নামক অত্যাধুনিক মেলাপ্রাঙ্গনে। এ বছর থেকেই কলকাতা পুস্তক মেলার নাম বদলে হয় আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা। এই বছর থেকেই চালু হয় বইমেলার থিম সং “ওই ডাকছে বই……বই এর সাথে পথ চলা”। সুরকার বিক্রম ঘোষ। গীতিকার সুগত গুহ আর গলা মিলিয়েছিলেন শ্রীকান্ত আচার্য, লোপামুদ্রা, শুভমিতা, রুপঙ্কর, রুপম ইসলাম এবং রূপরেখা । স্কটল্যান্ড ছিল সে বছরের ফোকাল থিম। সিটি অফ জয় এর লেখক ডোমিনিক ল্যাপিয়ার উপস্থিত ছিলেন এই বই মেলায়। ২৭শে জানুয়ারী, ২০০৯ এ এই নতুন স্থানে মেলা শুরু হয়। ১৫ লাখ দর্শক আর ১৭ কোটি টাকার বই বিক্রি গিল্ড কতৃপক্ষের মুখে হাঁসি ফোটালো আবার। 

২০০৯ থেকে এই মিলনমেলাই হয়ে গেল বইমেলা বা আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তক মেলার স্থায়ী ঠিকানা। ২০১০ সালে বইমেলা চলাকালীন এক সন্ধ্যায় ভয়াবহ লোডশেডিং ছাড়া আর কোন বিরূপতার মুখে পড়তে হয়নি গিল্ড কে। আর ২০১৪ তে ৩৮ তম বইমেলা পুরোপুরি টেকস্যাভি, বাণিজ্যমুখী। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার ওয়েবসাইট ও এখন ঝাঁ চকচকে, আগের থেকে অনেক বেশী দৃষ্টিনন্দন এবং সপ্রতিভ। 

গতবছরের বইমেলায় ১৮ একর মানে আটলক্ষ বর্গফুট এলাকায় ছড়িয়ে ছিল মোট ৭৭০ টি স্টল ! বিশ্বের ২৯ টি দেশের প্রকাশনা সংস্থা যোগ দিয়েছিল এই মেলায়। কলকাতা আন্তর্জাতি পুস্তকমেলা এখন দর্শক সংখ্যার নিরিখে বিশ্বের সব চেয়ে বড় বইমেলা। গত কয়েক বছর ধরেই কলকাতা বইমেলার মঞ্চ ভাগ করে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল কে এল এফ বা কলকাতা লিটারারি ফেস্টিভাল। কিন্তু ২০১৪ থেকেই কে এল এফ আলাদা হয়ে গেছে। তাতে অবশ্য কলকাতা বইমেলার সেলেব্রিটি কোশেন্ট খুব একটা কমেনি। কারণ উদ্যোক্তারা গত বছর থেকেই শুরু করেছেন তিন দিনের কলকাতা ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাণ্ড লিটারারি ফেস্টিভাল। ৩৯ তম আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলা শুরু হতে চলেছে ২৮ শে জানুয়ারী থেকে। ফোকাল থিম গ্রেট ব্রিটেন। শেষ করছি ওমর খৈয়ামের একটি কবিতা দিয়েঃ-

“ রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে
প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে
কিন্তু একটি বই অনন্ত যৌবনা
যদি তা তেমন বই হয়”

0 comments:

0

বিশেষ প্রতিবেদন: পিয়ালী বসু

Posted in


বিশেষ প্রতিবেদন

বইমেলা : একটি তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা 
পিয়ালী বসু



বইমেলা, Book Fair বইপ্রেমী মানুষের কাছে এই উদ্দীপনার নাম । কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হতে চলেছে কলকাতা বইমেলা আর তার ঠিক প্রাক্কালে আমরা বরং একবার চোখ বুলিয়ে নিই বইমেলা র উৎস ও নানাবিধ বইমেলা র ওপর ।


ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা 

পৃথিবীর বৃহত্তম বইমেলা বলে খ্যাত এই বইমেলা। Frankfurt Trade Fair Ground এ মাত্র পাঁচ দিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় এই বইমেলা। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা প্রায় ৫০০ বছর পুরনো , জানা যায় Johaness Gutenberg ফ্রাঙ্কফুর্ট এর কাছে Mainz একটি ছাপাখানা স্থাপন করেন , এবং স্থানীয় পুস্তক বিক্রেতাদের উদ্যোগে সেইসময়ে শুরু হয় ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা এখনও পর্যন্ত ইউরোপের শ্রেষ্ঠ বইমেলা!


লন্ডন বইমেলা 

London International Antiquarian Book Fair কে আমরা সবাই লন্ডন বইমেলা বলেই জানি। ১৯৫৭ সালে স্কুল কলেজে যখন গরমের ছুটি চলছে তখন বেশ আশ্চর্য ভাবেই উদ্ভাবিত হল এই বইমেলা। লন্ডনের Bond Street এ নামকরা এক Auction এর দোকান ছিল , সেখানেই এই বইমেলার প্রথম সূচনা। মাত্র ৫ পাউনডে বিক্রী হত সব বই , মুল উদ্দ্যেশ্য ছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে বই এর নেশা ধরানোর এবং তাতে পূর্ণমাত্রায় সফল হয়েছিলো লন্ডন বইমেলা। ১৯৬৬-১৯৭০ সালে এই বইমেলা পরিচিত হয় The Book Collectors Fair নামে এবং চলতে থাকে টানা ১৬ দিন। ক্রমে বাড়তে থাকে এই বইমেলার পরিচিতি স্বাভাবিক ভাবে পরিধিও , ১৯৯৮ সাল থেকে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা লন্ডন বইমেলা অনুষ্ঠিত হতে থাকে অলিম্পিয়া তে ।



মায়ামি বইমেলা 

১৯৮৪ সালে Books By The Bay দিয়ে সূচনা হয় মায়ামি বইমেলার। দুদিন ব্যাপী এই বইমেলার কোন ভেনু না থাকায় রাস্তাতেই শুরু হয় এই বইমেলা , দু বছরের মধ্যে পাল্টায় চিত্রকল্প , পাল্টায় ছবি ! ১৯৮৬ সাল থেকেই মায়ামি বইমেলার নতুন নামকরণ হয় Miami International Book Fair , দু দিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত বইমেলা বাড়তে থাকে আট দিন, শেষে দশ দিনে। প্রতি বছরের নভেম্বর মাসে হাজার হাজার বইপ্রেমী মানুষ সমস্ত প্রতিকূলতা জয় করে এসে উপস্থিত হন Miami Downtown এ । এই বইমেলার অন্যতম বিশেষত্ব হল এখানে লেখক লেখিকাদের জন্য বিশেষ প্রদর্শনীর ব্যাবস্থা থাকে, Festivals of Authors নামে এই প্রদর্শনী টি শুরু হয় লেখালিখি সম্পর্কিত নানাবিধ বিতর্ক নিয়ে এবং শেষও হয় বই সম্পর্কিত তথ্যাবলী দিয়ে। রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে এবং পরে ব্যারাক ওবামা এই বইমেলার অন্যতম আকর্ষণ ।


আয়ারল্যান্ড বইমেলা 

Dublin Art Book Fair নামে খ্যাত আয়ারল্যান্ডের বইমেলা টি অপেক্ষাকৃত ভাবে নতুন , মাত্র পাঁচ বছর আগে জেমস জয়েসের শহর আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিনে শুরু হয় এই বইমেলা। ৬ই নভেম্বর – ১০ই নভেম্বর Temple Bar গ্যালারী তে অনুষ্ঠিত হয় এই বইমেলা। শিল্প সাহিত্যের দেশে এই বইমেলা একটা বিশেষ আকর্ষণ। মাত্র ৫ ইউরো তে বই পাওয়া যায় এই মেলায় যা বই প্রেমিক মানুষদের কাছে এক পরম পাওনা।


শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি সমৃদ্ধ দেশ আয়ারল্যান্ডে আরও অনেক ইতস্তত বইমেলা দেখা যায় , যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য Dublin City Book Fair , Dublin Book Festival, Westmeath town Of Books Festival, Delvin Book Fair ও Celtic Book Fair 


আবু ধাবি বইমেলা 

Abu Dhabi International Book Fair নামে খ্যাত এই বইমেলার সৌন্দর্য যে কোন পশ্চিমের দেশকেও হার মানায়, ৫০ টি দেশ থেকে প্রায় ১০২৫ জন প্রকাশক ও পাঠকের সমাবেশে সরগরম থাকে এই বইমেলা। 


শারজাহ বইমেলা 

Sharjah International Book Fair নামে খ্যাত এই বইমেলাটি প্রতিবছরের ৪ঠা -১৪ই নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয় । বিশ্বের অন্যতম প্রধান বইমেলা হিসেবে এই বইমেলাটির নাম করা হয়। ১৯৮২ সালে স্থাপিত এই বইমেলার প্রধান বিশেষত্ব হল নব্য জেনেরেশন এর কাছে বই কে পৌঁছে দেওয়া , নানা রকম মেলা এবং সেমিনারের মাধ্যমে সমৃদ্ধ এই বইমেলা ।


কায়রো বইমেলা 

নতুন বছরের শুরুতে জানুয়ারি মাসেই অনুষ্ঠিত হয় এই বইমেলা যা শেষ হয় ফেব্রুয়ারির শেষদিকে। ১৯৬৯ সালে স্থাপিত এই বইমেলার অন্যতম বিশেষ আকর্ষণ ইজিপ্সিয় বইপত্র এবং ম্যাপ। 


কলকাতা বইমেলা

International Kolkata Book Fair বা আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা নামে খ্যাত এই বইমেলা এশিয়ার বৃহত্তম বইমেলা হিসেবে আজও স্বীকৃত। প্রতি বছরের জানুয়ারি মাসে এই বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় মিলন মেলা প্রাঙ্গনে। Publishers & Book Sellers Guild এর মেলার উদ্যোক্তা। ১৯৭৬ সালে স্থাপিত এই বইমেলা প্রথমে অনুষ্ঠিত হত কলকাতা ময়দানে , কিন্তু দুর্ভাগ্য জনক এই অগ্নি কাণ্ডে ক্ষতি হয় প্রচুর প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতার , তার পরেই এই মেলা স্থানান্তরিত হয় সল্টলেকে এবং পরে মিলন মেলা প্রাঙ্গনে ।


সবশেষে এটুকুই বলার ... A Reader Lives A Thousand Times Before He/ She Dies.. তাই বই পড়ুন , ভালবাসুন বই কে আর প্রতিমুহূর্তে বেঁচে থাকুন আনন্দে।







0 comments:

0

বিশেষ প্রবন্ধ: ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in



বিশেষ প্রবন্ধ

বই কথা-মেলার কথা
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



বাঙালীর এখন বারো মাসে তেরো নয় চোদ্দ পার্বন । আর বাংলার এই চতুর্দশ পার্বন হ’ল ‘কলকাতা বইমেলা’ । দেখতে দেখতে কলকাতা বইমেলা আটত্রিশ বছর পার করে উনচল্লিশে পা দিল । পোষাকি নাম ‘কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তক মেলা’- বিশ্বের বৃহত্তম অ-বানিজ্যিক বইমেলা । অ-বানিজ্যিক – কারণ, বিশ্বখ্যাত ফ্রাঙ্কফুর্ট কিংবা লন্ডন বইমেলায় পাঠকের কাছে বই বিক্রি হয়না, বইএর স্বত্ত বিক্রি হয় প্রকাশকদের কাছে, ওগুলো পুস্তক প্রকাশকদের মেলা । কলকাতা বইমেলার আকর্ষণ অন্যরকম । বইএর সঙ্গে পাঠকের মিলন মেলা । আর সেই কারণেই কলকাতা বইমেলা এশিয়ার মধ্যে সর্ববৃহৎ তো বটেই, বইপ্রেমীদের উপস্থিতির বিচারেও কলকাতা বইমেলা বিশ্বের সর্ববৃহৎ । বই বিক্রির হিসাব কোটি ছাড়িয়েছে বইমেলার দ্বিতীয় বছরেই ।

শুধু কলকাতা বইমেলাকেই বা বাঙালীর চতুর্দশ পার্বন বলি কেন ? আজ বাংলার এমন কোন জেলা নেই যেখানে বইমেলার আয়োজন হয়না । প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বইমেলার আয়োজন বাঙালির বড় আদরের বিষয় হয়ে উঠেছে । আমাদের এই ‘বইএর সমুদ্র’ অবগাহন, পাঠকের কাছে বইএর পৌঁছে যাওয়া – এসবের সূত্রপাত নিঃসংশয়ে কলকাতা বইমেলার সাফল্যের পথ বেয়েই এসেছে ।

বইকে ঘিরে এই যে উৎসব, যে উৎসবে মাতেন লক্ষ লক্ষ মানুষ, সেই বই প্রকাশের উৎসমুখে ফিরে তাকাতে ইচ্ছা হয় । তখনকি জানা ছিল বইএর কি অমোঘ শক্তি ! পুরাণের গল্প – সমুদ্র মন্থন করে নাকি অমৃত উঠেছিল, আর সেই অমৃত পান করে দেবলোক অমরত্ব লাভ করেছে । মানুষ দেবতা নয়, কিন্তু তার সভ্যতার ইতিহাস, তার পথচলাটাও তার সমাজ ও সভ্যতার পাঁচ হাজার বছরের মহা মন্থনের ফল । সেই মহা মন্থনের কোন এক আদীমতম কালখন্ডে মানুষ তার মেধা ও সৃজন ভাবনায় নিজেই রচনা করেছিল অমৃতের ভান্ডার – বই, পেয়েছিল অমরত্বের অধিকার । সে অন্য প্রসঙ্গ, আমি যেতে চাই ছাপা বইএর উৎসমুখে ।

সেই কবে আঠেরো শতকের শেষ ভাগে, নগর কলকাতার তারুণ্যে, কলকাতার ‘গ্রন্থনগরী’ হয়ে ওঠার সূত্রপাত । ছাপাখানার আবির্ভাব কলকাতার নবীন প্রজন্মের মানসিক বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিল । ইংরেজরা তাদের শাসনের কাজের জন্য কলকাতায় ছাপাখানা এনেছিল, এটা একটা ঘটনা মাত্র কিন্তু ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা ও ব্যবহারে এদেশীয়রা অনেক বেশি আগ্রহী ও তৎপর ছিল । উনিশ শতকে বাংলায় বুদ্ধির জাগরণে মুদ্রণ যন্ত্রের ভূমিকা অবিস্মরণীয় । সে পথে রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুররা অগ্রপথিক, কিন্তু এদের সঙ্গে দুটি নাম নিশ্চিত ভাবেই সমান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় তাঁরা হলেন ত্রিবেণীর এক কর্মকার পঞ্চানন এবং শ্রীরামপুরের বহরা গ্রামের এক বাঙালি ব্রাহ্মণ গঙ্গা কিশোর ভট্টাচার্য । পঞ্চানন কর্মকার প্রথম বাংলা হরফ তৈরি করেন ১৭৮৪ সনে । আর গঙ্গা-কিশোর ভট্টাচার্য প্রথম বাংলা বই ছাপা শুরু করেন । গঙ্গাকিশোর শ্রীরামপুরের ব্যাপ্টিস্ট মিশনের ছাপাখানায় কম্পোজিটর ছিলেন, তারপর কলকাতায় । গঙ্গা কিশোরই কলকাতায় প্রথম বাংলা বই ছাপা শুরু করেন । ১৮১৬তে প্রকাশিত ভরত চন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ ছিল কলকাতায় ছাপা প্রথম সচিত্র বাংলা বই । বইটির কাটতি বাড়ানোর জন্য গঙ্গা কিশোর একটি দোকান খোলেন । সুতরাং গঙ্গা কিশোর ভট্টাচার্যই নগর কলকাতায় প্রথম বইয়ের দোকান খোলার পথ দেখিয়েছিলেন । কলকাতা যে একদিন ‘গ্রন্থ নগরী’তে পরিণত হল, তার আদি কারিগর গ্রামীণ বাংলা থেকে উঠে আসা এই দুজন – পঞ্চানন কর্মকার ও গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য ও আরো কয়েকজন । তখন রেলগাড়ি আসেনি, ডাক ব্যবস্থা শুরু হয়নি, কারখানার ভোঁ বাজতো না । তখন এঁরাই হয়েছিলেন কলকাতার সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রথম নেপথ্য পুরোহিত । ১৮৩০এ কলকাতা তখনও প্রাসাদ নগরী হয়ে ওঠেনি । কিন্তু ‘গ্রন্থনগরী’ হয়ে ওঠার সূত্রপাত হয়ে গিয়েছিল । ‘বটতলার সাহিত্য’ বলে একটা বিদ্রুপবাক্য আমাদের সাংস্কৃতিক মহলে খুব প্রচলিত । এই ‘বটতলা’র কোন ভৌগলিক সীমানা নেই । চিৎপুরের অলিগলি, গরাণহাটা, আহিরিটোলা, শোভাবাজারে ছাপাখানায় বাংলা বইএর মুদ্রণ ও বিপনন ব্যবস্থা প্রথম শুরু হয়েছিল বাংলা বই ছাপার সেই আদিপর্বে ।

অথচ আমাদের পরম বিস্ময়, সেই ‘গ্রন্থনগরী’ কলকাতার নাম বিবেচিত হয় নি, ভারতে যখন ‘জাতীয় বইমেলা’ সংগঠিত করার ভাবনাচিন্তা শুরু করে ন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট ।

ভারতে বইমেলা সংগঠন করার সূত্রপাত ১৯৬০এর দশকে, যখন ন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট বা এন বি টি মুম্বাইএর চার্চ গেট ময়দানে প্রথম জাতীয় বইমেলার আয়োজন করেছিল । এর পর তারা দিল্লী, মুম্বাই ও চেন্নাইতে জাতীয় বইমেলার আয়োজন করেছিল । কিন্তু কলকাতার কথা তারা ভাবেনি । কলকাতাকে তারা জাতীয় বইমেলা করার জন্য উপযুক্ত মনে করে নি । আয়োজকদের মুর্খতাকে ধন্যি ধন্যি করতে হয় ! ১৯৭২এ নতুন দিল্লিতে বিশ্ব বইমেলা আয়োজিত হয় । কলকাতা তখনও বইমেলা সংগঠনের জন্য ব্রাত্য বিবেচিত ছিল । এর পর কলকাতার কয়েকজন উৎসাহী প্রকাশক, কলকাতা যে বইমেলা করার যোগ্য স্থান তা বোঝানোর উদ্যোগ নেয় । তাদের চেষ্টায় অবশেষে সেই চাঁদ সদাগরের বাঁ হাতে মনসাকে ফুল দেবার মত অনিচ্ছুক ন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট ১৯৭৪এর জানুয়ারি মাসে কলকাতার একাডেমি প্রাঙ্গণে নিতান্ত ছোট আকারে একটি বইমেলার আয়োজন করেছিল । এর পরই কলকাতায় বার্ষিক বইমেলা করার চিন্তা ভাবনা শুরু হয় ।

পরের বছর ১৯৭৫এ, কলকাতার ১৪টি প্রকাশক মিলে গঠিত হয় ‘পাবলিশার্স এন্ড বুক সেলার্স গিল্ড’ । এদের উদ্যোগেই শুরু হয়ে গেলো ‘কলকাতাপুস্তক মেলা’ ১৯৭৬এর ৫ই মার্চ । চলেছিল ১৪ই মার্চ পর্যন্ত । এখন যেখানে ‘মোহর কুঞ্জ’, বিড়লা তারামন্ডলের ঠিক উলটো দিকের মাঠে আয়োজিত হয়েছিল কলকাতার প্রথম বইমেলা । মজার কথা, সেই প্রথম বইমেলায় কলকাতার সমস্ত প্রকাশক বইএর পসরা নিয়ে আসেন নি । তারা এর সাফল্য নিয়ে সন্দিহান ছিলেন । ফলে মেলার মাঠ অনেক ফাঁকাই ছিল । কিন্তু বইপ্রেমী মানুষের কাছে বইমেলা তার জন্মলগ্নেই প্রবল আকর্ষণ সৃষ্টি করে, মেলার দিলগুলিতে যথেষ্ঠ জনসমাগম হয় । ফলে পরের বছর থেকে মেলায় পুস্তক বিপণির সংখ্যা ও জন সমাগম বাড়তে থাকে । ১৯৭৭এর দ্বিতীয় বইমেলায় বই বিক্রি হয়েছিল এক কোটি টাকারও বেশি আর মেলায় আসা বইপ্রেমীদের সংখ্যাটি ছিল প্রায় দু লক্ষ ।

কলকাতা বইমেলার উত্তরোত্তর যে বিপুল জনপ্রিয়তা, তার প্রকৃত সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৭৮এ আয়োজিত তৃতীয় বইমেলা থেকে । প্রসঙ্গত, একটি বিষয় মনে রাখতে হবে । ১৯৭৬এর মার্চে প্রথম বইমেলার সময় ছিল জরুরি অবস্থার সামাজিক ও রাজনৈতিক কালো দিন । তামাম সত্তর দশকটা ছিল ‘মৃত্যুর দশক’। রাস্তায় ছড়ানো তরতাজা তরুণদের লাশ, কারান্তরালে হত্যা, সন্ত্রাস, গুপ্ত হত্যা, গণতান্ত্রিক শাসনের অন্তর্জলি যাত্রা, ১৯৭৫এ জরুরি অবস্থার কৃষ্ণপ্রহরে সঙ্কুচিত ব্যক্তি স্বাধীনতা আর মানুষের কন্ঠনালি তাক করা বন্দুকের নল - বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রের সে এক দুঃসহ কালো সময় । ১৯৭৬এর মার্চে প্রথম বইমেলা হয়েছিল এই আবহে । ১৯৭৭এর মার্চে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন, কেন্দ্রে কংগ্রেসের একচেটিয়া শাসনের অবসান, জুনে বাংলায় বামপন্থী সরকারের পত্তন । এই মুক্তির আবহেই আয়োজিত হয়েছিল তৃতীয় কলকাতা বইমেলা ১৯৭৮এ । উদ্বোধন করেছিলেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় । তৃতীয় বইমেলা হয়েছিল আরো প্রসস্ত ময়দানে, অনেক বড় আকারে । ১১২টি প্রকাশক এই মেলায় অংশ নিয়েছিল ।

তারপর কলকাতা বইমেলা শুধু বেড়েছে – আকারে, পাঠক আকর্ষণে, মর্যাদায়; যায়গা করে নিয়েছে আন্তর্জাতিক বইমেলার ক্যালেন্ডারে । বইমেলা বেড়েছে তার পথচলায় নানান ঘটনা-দুর্ঘটনা, বাধা-বিপত্তি, অবিশ্বাস, কোন কোন মহলের বিরোধীতা ও জটিলতাকে সাক্ষ্য রেখে । ১৯৯৭এর ২২তম বইমেলায় মেলা চলাকালীন ঘটে গিয়েছিল ভয়াবহ অগ্নিকান্ড । লক্ষাধিক টাকার বই ভস্মিভূত হয়, হয়েছিল প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি । ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় মেলায় আসা এক দর্শনার্থীর । আবার তিনদিন পরে, গ্রিক পুরাণের ফিনিক্স পাখির মত ভস্মস্তুপ থেকে জেগে উঠেছিল বইমেলা তার পূর্ণ দীপ্তিতে । ঐ বছর বইমেলার থিম ছিল ফ্রান্স আর উদ্বোধক ছিলেন নোবেল জয়ী ফরাসি সাহিত্যিক জাক দারিদা । ১৯৮৩তে ৮ম বইমেলায় একটি গ্রন্থ প্রকাশ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে অকস্মাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মেলাপ্রাঙ্গণেই প্রয়াত হন আনন্দবাজার-দেশ পত্রিকার স্বত্বাধিকারী অশোককুমার সরকার । পরের বছর থেকে কলকাতা বইমেলায় চালু হয় সম্মানজনক ‘অশোককুমার স্মৃতি বক্তৃতা’ । ১৯৮৩তে বইমেলায় অংশগ্রহণ করেছিলেন ২৮৫টি প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতা সংস্থা । ১৯৮৪তে কলকাতা বইমেলা জেনেভার ইন্টারন্যাশানাল পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হয়ে আন্তর্জাতিক বইমেলার ক্যালেন্ডারে যায়গা করে নেয় । ঐ বছর বইমেলায় ৩৬৩টি প্রকাশন সংস্থা অংশগ্রহণ করেছিল ।

১৮৮৪ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা বিভাগ অপেক্ষাকৃত ছোট আকারে ‘পশ্চিমবঙ্গ গ্রন্থমেলা’ নামে আর একটি বইমেলার আয়োজন করে । এই বইমেলার একটি মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী জেলার গ্রন্থাগারগুলির বই কেনায় বিশেষ সুবিধা দান। ১৯৯৪এ এই সরকারী বইমেলা বন্ধ করে দিয়ে সরকারী উদ্যোগে শুরু হয় ‘জেলা বইমেলা’ । উদ্দেশ্য কলকাতার বাইরে প্রত্যন্ত জেলা শহরে বইমেলাকে ছড়িয়ে দেওয়া, মানুষকে আরো বেশি বইএর কাছে নিয়ে আসা । বস্তুত এর পর থেকেই বাংলার জেলাশহরগুলিতে বার্ষিক উৎসবের মত অসংখ্য বইমেলার আয়োজন হতে থাকে ।

১৯৭৬ থেকে ২০০৭ টানা ৩১বছর কলকাতা ময়দানে বইমেলা চলার পর সাময়িক বিপর্যয়েরও মুখোমুখি হয়েছিল বইমেলা । বলা যায় ২০০৭ এবং ২০০৮ - এই দুটো বছর কলকাতা বইমেলার ইতিহাসে সুর-তাল কেটে যাওয়া দুটি বছর । ময়দানে বইমেলা আয়োজনের বিরোধিতায় সক্রিয় হয়ে হয়ে ওঠে ‘ময়দান বাঁচাও কমিটি’ নামে একটি সংগঠন । তাদের দায়ের করা মামলায় মহামান্য কলকাতা হাইকোর্ট কলকাতা ময়দানে বইমেলার আয়োজন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে । অগত্যা সে’বছর যুবভারতী ক্রিড়াঙ্গণ সংলগ্ন মাঠে নিতান্ত ছোট পরিসরে কোন রকমে আয়োজিত হয়েছিল মেলা । পরের বছর মেলা আয়োজিত হবার কথা ছিল পার্কসার্কাস মাঠে । কিন্তু নির্ধারিত মেলা উদবোধনের আগের দিন কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে সেই আয়োজনও নিষিদ্ধ হয়ে যায় । সেবার অবশ্য প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে ‘কলকাতা পুস্তকমেলা আয়োজিত হয় নি । হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যুবকল্যাণ বিভাগের উদ্যোগে ‘বইমেলা ২০০৮’ এই ব্যানারে মার্চ মাসে । একত্রিশ বছর চলার পর আদালতের নির্দেশে বইমেলার ঠিকানা বদল মেনে নিতে পারেননি বাংলার বুদ্ধিজীবিদের একটা বড় অংশ । উচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে তারা কলকাতা ময়দানে এক প্রতীকি বইমেলার আয়োজন করেছিলেন ২০০৭এর ৩১শে জানুয়ারি । পরের বছর অর্থাৎ ২০০৯এ কলকাতা পুস্তকমেলা চলে যায় বিধান নগরের মিলনমেলা প্রাঙ্গণে । সে’বছর থেকেই কলকাতা বইমেলার নাম বদল হয়ে হয় ‘আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলা’ । মিলনমেলা প্রাঙ্গণই এখন বইমেলার স্থায়ী ঠিকানা ।

‘বইমেলা’ মানে তো শুধু বইএর মেলা নয় যেন সংস্কৃতির মহোৎসব । লিটল ম্যাগাজিন বিপণিতে তরুণ প্রজন্মের সাহিত্যপ্রয়াসের সাক্ষর, তাদের নবতম গ্রন্থের প্রকাশ, দেশ-বিদেশের সাহিত্যবিষয়ক আলোচনা । চোখে স্বপ্নমাখা কোন তরুণের উদাস ছবি আঁকা, কিংবা কোন প্রবীণ কবি কাঁধে ব্যাগ ভর্তি বই নিয়ে নিজেই পৌঁছে যাচ্ছেন পাঠকের কাছে – এ যেন বই আর পাঠকের এক মহামিলনমেলা ।

আশ্চর্য হতে হয়, ১৯৭৬এ ১৪জন পুস্তক প্রকাশকের উদ্যোগে মাত্র ৫৬টি বইএর স্টল নিয়ে যে বইমেলার শুরু, সেই ‘কলকাতা বইমেলা’ গতবছর তার ৩৮তম বর্ষে আয়োজিত হয় আট লক্ষ বর্গফুট এলাকা জুড়ে দেশ-বিদেশের ৭৭০টি স্টল নিয়ে, বইএর প্রতি মানুষের ভালোবাসার অনন্য শক্তি !

সেই কবে – ঔপনিবেশিক ভারতে ১৭৮৪ সনে হুগলী জেলার ত্রিবেণীর এক কর্মকার, পঞ্চানন প্রথম বই ছাপার জন্য বাংলা হরফ নির্মাণ করেছিলেন আর তার ত্রিশ বছর পরে শ্রীরামপুরের বহড়া গ্রামের এক ব্রাহ্মণ গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য প্রথম বাংলা বই ছাপা শুরু করেছিলেন, তখন কে জানতো বইএর কি অমোঘ শক্তি !

0 comments:

0

বিশেষ রচনা: শৌনক দত্ত

Posted in


বিশেষ রচনা



সুস্মিতার বইমেলা সুস্মিতার তিনি...
শৌনক দত্ত

সময়ের কলিংবেলে জানুয়ারী বাজচ্ছে।জানুয়ারী মানেই ঘর ময় নতুন বইয়ের গন্ধ আর রোজ বইমেলায় বইয়ের সন্ধান জানুয়ারী শেষ তো চলো বাংলাদেশ একুশে বইমেলায়।এবার সেই পরিকল্পনা নেই। বড়দিন চলে গেলো টাকা পয়সা বইয়ের ক্যাটালগ নিয়ে সুস্মিতা বসেনি। অফিস ক্লান্ত বাসু কোনদিন লিখতে পারেনি যদি পারতো, তবে এক জীবন সুস্মিতা লিখতো। গোমট অনেকটা কেটে গেলেও ফাঁকা, নির্জনা একাকীত্ব এখনো কাটেনি। বাসু ফ্রেশ হয়ে দুই মগ কফি নিয়ে ছবির সামনে বসে সুস্মিতা তাকে বলেছিলো, কলকাতার বইমেলা ১৯৭৬এর ৫ইমার্চ শুরু হলেও বাংলাদেশের এখন যেটা অমর একুশে গ্রন্থ মেলা সেটা আরো বছর খানেক প্রাচীন। সেটা ১৯৭২সনের ৮ই ফেব্রুয়ারী।

মাসখানেক ধরে বাসু সুস্মিতার ছবির সাথে কথা বলে, সুস্মিতা তার উত্তর দেয়, কতকথা বলে বন্ধু ডাঃ শিঞ্চন এটাকে ইলিউশান বলছে কিছু ওষুধ ও দিয়েছে। বাসু এটা ইলিউশান মানতেই চায় না। তবু রুটিন চেক আপ এবং ওষুধ চলছে বাসুর।বুক সেলফ থেকে সুস্মিতার পরশ মাখা মৈত্রেয়ী দেবীর 'ন হন্যতে' বইটা বুকে জড়িয়ে বসতেই সুস্মিতা এলো।
-ন হন্যতে পড়বে বুঝি?
-হ্যাঁ।
-তোমার মির্চা ইলিয়াড পড়া হয়নি। ২০০৮এ উনার জন্মশর্তবর্ষে তোমাকে যে তার কথা বলেছিলাম তোমার মনে আছে বাসু?
বাসু মনে করতে চেষ্টা করে। চলমান সময় অতীত নদীর সভ্যতার মতো জেগে ওঠে।

-কি মনে করতে পারলে না তো?

আজ থেকে ছয়বছর আগের ধুলোময় বইমেলার ধুলো সরিয়ে কফি মগে চুমুক দেয়। মনে পড়ে যায় ২০০৮ ছিলো দিকপাল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু ও মির্চা ইলিয়াডের জন্মশতবর্ষ। কলকাতার পত্রপত্রিকা বাকী দুজনকে যতটা আলোকিত করেছিলো ঠিক ততটাই উপেক্ষার আঁধারে এড়িয়ে গেছে। সুস্মিতা হেসে ওঠে যেন। এতটা বাসু মনে রাখবে তা যেন ভাবতেই পারেনি সুস্মিতা।

ক্যালেন্ডারের পাতায় খসে পড়বে আরেকটি সময়কে লালন করে। বাসু কফি শেষ জানালা গলে ঢুকে পড়া নিয়ন আলো আবছায়ায় তাকে ভাবায়; ঐসময়টায় কি অস্থির সুস্মিতা বারবার বলতো, দ্যাখো বাসু মির্চার জীবন ও কীর্তির কোনও মূল্যায়ন কোথাও নেই অথচ এই শহরের সঙ্গে তার বিশেষ ধরনের একটা সম্পর্ক ছিলো। সেই সম্পর্ক শুধু এই বিদগ্ধ মানুষটির ব্যক্তিত্ব ও বৌদ্ধিক বিকাশেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, সাহিত্যের ইতিহাসেও একটা ছাপ রেখে দিয়েছে।

বিশ শতকের যে সমস্ত শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী তাদের স্বকালের এবং পরবর্তী প্রজন্মের চিন্তা ও অনুভবের পথরেখা নির্মান করেছেন, ইলিয়াড তাঁদের অন্যতম একজন। ভারতীয় দর্শনে তার মতো আত্যন্তিক অনুপ্রাণিত পাশ্চত্য মনীষা সম্ভবত আর মাত্র একজনই ছিলেন। মেক্সিকান কবি ও নিবন্ধকার অক্টাভিও পাজ।


ঠান্ডা হয়ে আসা কফিমগে বন্ধু ডাক্তার শিঞ্চন ভাগ বসালো। সুস্মিতার মগটায় শিঞ্চন চুমুক দিক বাসু মনে মনে চাইছিলো না। শিঞ্চন হয়ত বুঝেছিলো, উঠে গিয়ে অন্য মগে কফিটা ঢেলে এসে বসলো।
তা আজ কি কথা বলছিস তোরা?
বাসু তোরা শুনে খুশি হয়ে বললো, মির্চা ইলিয়াড।
মির্চা মানে সেই মৈত্রেয়ী দেবীর প্রেমিক?
বাসু জানে আজ রুটিন চেক আপের ডেট, তাই শিঞ্চন এসেছে।
মির্চা নিয়ে তুমি কি কি পড়েছো?
তুই তো জানিস সুস্মিতা পড়তো, তারপর আমায় গল্পের ছলে বলতো।
তারমানে মির্চা ইলিয়াড নিয়ে তোর পড়া নেই কোন কিছু?
ঠিক তা না। ২০০৮এ ওনার শতবর্ষে সুস্মিতা আমাকে মির্চার লেখা পড়িয়েছে, শুনিয়েছে।
কলকাতায় মির্চা কেন এসেছিলেন?
বাসু মুচকি হাসে তারপর একটু থেমে গম্ভীর স্বরে বলে, শিঞ্চন বিশ্বাস কর ইলিউশান নয় সুস্মিতা আমার কাছে আসে এখনো তোর পাশেই বসে আছে সুস্মিতা। শিঞ্চন পাশে রাখা ছবিটা দেখে একপলক। তারপর এক গহীন নীরবতা। নীরবতা টুকরো টুকরো করে বাসু বলে ওঠে, কলকাতায় মির্চা ইলিয়াড তার দেশ রোমানিয়া থেকে ১৯২৮সালে এই শহরে পা রাখলেন সংস্কৃত শিখবেন বলে। পুরোদস্তুর গুরুশিষ্যের পরম্পরা মেনে তিনি তালিম নিতে মনস্থ করলেন প্রখ্যাত পন্ডিত অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের কাছে।


শিঞ্চন ফিরে গেছে অনেকক্ষণ। খাবার গরম করে খেতে বসেছে বাসু। তখনি সুস্মিতার আর্বিভাব, কি বাসুবাবু তারপর আর বলতে পারলেন না। আরে বুদ্ধু তারপরের গল্পটা ভুলে গেলে? বাসু মাথাটা দুই তিন বার সামনের দিকে ঝুঁকালো। সুস্মিতা একঝাঁক পাখির উড়ে যাবার মতো হাসলো আর বলতে লাগলো সেই গুরু সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের বাড়িতেই মির্চা থাকতে লাগলেন পেয়িং গেস্ট হয়ে।অনেকটা ঠিক সেই হাম দিল দে চুকে সনম সিনেমার সলমনখান আর ঐশ্বর্যরাই। যাক তেইশ বছর বয়সি এই ছাত্রটি অচিরে অধ্যাপক দাশগুপ্তের ষোড়শী কন্যা ঐশ্বর্য মানে মৈত্রেয়ীর প্রেমে পড়লেন। গুরু যখন টের পেলেন তার এই ইউরোপীয় শিষ্যটির কীর্তি তাকে বাড়ী ছাড়ার আদেশ দিলেন।মির্চা চিরতরে কলকাতা ছেড়ে গেলেন। প্রথমে আশ্রয় নিলেন হিমালয়ে গিয়ে।গবেষণা শুরু করলেন তার যোগ বিষয়ক প্রথম বইটির জন্যে। পরে দেশে ফিরে মৈত্রেয়ীর সঙ্গে তার গভীর সংরাগের বর্ণনা দিয়ে ১৯৩৩সালে একটা উপন্যাস প্রকাশ করলেন রোমানিয়ান ভাষায়। বইটার আদলে উপন্যাসের আবরণ কিন্তু পরিষ্কার তা প্রায় আত্মজীবনী। এমনকী তিনি মৈত্রেয়ী নামটাও পর্যন্ত রেখে দিলেন এবং বইটির শিরোনাম হল ওই নামে।
তীক্ষ্ণধী এই বিদ্বান মানুষটির সাথে কলকাতার আক্ষরিক অর্থেই তিক্তমধুর সম্পর্ক।

মৈত্রেয়ী বইতে মির্চা দাবি করলেন, মৈত্রেয়ীর সঙ্গে তার শুধু রোমান্টিক সম্পর্ক ছিল না, দৈহিক সম্পর্কও ছিল। কোলকাতার অগোচরে রোমানিয়াতে বইটি বেস্ট সেলার হল এবং কথাসাহিত্যিক হিসেবে মির্চা ইলিয়াডের খ্যাতি প্রতিষ্ঠিত হল।
-সুস্মিতা তবে কি খ্যাতির জন্য মির্চা প্রেম কে খাটো করলো? এটা তো প্রতারণা প্রেমকে পন্য করে বড় হয়ে ওঠা সেটা তো প্রেম নয়?
তা হয়ত নয় কিংবা এই প্রেম লিখেছিলেন বলেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্যারিসে তিনি প্রকাশ করলেন বিশ্বের বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে তার 'পবিত্রতার তত্ত্ব'। মহতী এই সার্বজনীন তত্ত্ব তাঁকে এক দিব্যদর্শী মনীষায় বিভাসিত করল। অনেকটা ধরো রাধা ছেড়ে আসা কৃষ্ণের বিরহ। কিংবা চৈতন্যের রাধা ভাব। তাই প্রেম কে খাটো করেছেন বলা ঠিক হবে না হয়ত। তারপরের ঘটনা তো আরো রোমহর্ষক। ইলিয়াড যখন১৯৫৭সনে চিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিলেন তার ও বছর দুই তিন পর তার উপন্যাসের নায়িকা মৈত্রেয়ী দেবী জানতে পারলেন যে মির্চা তাদের প্রনয়সখ্য নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন।ইটালিয়ান, জার্মান, ফরাসি এবং স্প্যানিস ভাষায় সে বইয়ের তর্জমা বেরিয়েছে, কিন্তু ইংরেজী অনুবাদ তখনও হয়নি।

গিন কামানি তার 'অন্তর্ভেদী চোটঃ মৈত্রেয়ী দেবীর বইয়ের অকথিত নেপথ্যকথা'(A Terrible Hurt:The Untold Story behind the publishing of Maitreyi Devi)নিবন্ধে যা লিখেছিলেন তা আরো বেশি অবাক করা রহস্য'...১৯৭২সাল পর্যন্ত কিছু হয়নি। এই সময় ইলিয়াডের একজন ঘনিষ্ঠ রোমানিয়ান বন্ধু সেরগুই আল জর্ঘ কলকাতায় এলেন। তার কাছে উক্ত দেবী অবশেষে জানতে পারলেন যে ইলিয়াড তার বইতে তাদের যৌন সম্পর্কের বর্ণনা দিয়েছেন। পরে তার এক বন্ধু উপন্যাসটা ফরাসি থেকে অনুবাদ করে দিলেন এবং তা পড়ে তিনি আঁতকে উঠলেন।''

জীবনানন্দের বনলতা সেন কবিতার শেষ কয়েক পংক্তির মতো ১৯৭৩এ মৈত্রেয়ী দেবী রবীন্দ্রনাথের উপর বক্তৃতা দেয়ার জন্য আমন্ত্রিত হলেন শিকাগোতে। মৈত্রেয়ী দেবী গেলেন নদীর সব লেনদেন শেষ করে মির্চার মুখোমুখি বসতে। কলকাতা ছাড়ার চল্লিশ বছর পর দুটি বিচ্ছিন্ন প্রেমিক চিকাগোর নদী পাশে দেখা করলেন। তখন কি কোথাও বাজচ্ছিলো 'আবার দেখা যদি হলো সখা প্রাণের মাঝে আয়' তা আমাদের জানা হয়না তবে মির্চা কথা দিলেন মৈত্রেয়ী দেবীর জীবদ্দশায় বইটির কোনও ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশিত হবে না।
-বাসু, এটা কি প্রেম নয়? এটা কি প্রেম ও প্রেমিকার প্রতি শ্রদ্ধা নয়। এটা কি বৃন্দাবনের ধুলো আঁকড়ে বাঁচা নয়?

ভাব যেখানে গভীর ভাষা সেখানে মূক। চিকাগো থেকে ফিরেই মৈত্রেয়ী দেবী 'মৈত্রেয়ী'উপন্যাসের জবাবে নিজে ১৯৭৪সনে লিখে ফেললেন তার নিজের দিকের গল্পটা, যে বইটি 'ন হন্যতে' এই উপন্যাসে তিনি তার গল্পটা বললেন ভারতীয় পাঠকের কাছে মৈত্রেয়ী পড়ার সুযোগ আসার আগেই।

মৈত্রেয়ী নিয়ে ফরাসী তরুন চিত্রপরিচালক নিকোলাস ক্লোত্‍স বাংলার রাত(Bengal Night)চলচ্চিত্র তৈরী করেন অনেক বির্তক মামলা মোকদ্দমার মাঝে গিনু কামানির লেখা থেকে জানা যায় ভারতবর্ষে একবারই এই চলচ্চিত্রটি দেখানো হয়েছিলো ১৯৮৯সনে ভারতীয় চলচ্চিত্র উত্‍সবে। ১৯৯০সালে মৈত্রেয়ী দেবী মারা যাওয়ার চার বছর পরে একটি আমেরিকান সংস্করণে শেষ পর্যন্ত মৈত্রেয়ীর ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশিত হয়। সঙ্গে সহযোগী খন্ড হিসেবে থাকল মৈত্রেয়ীদেবীর জবাবী উপন্যাসটিও। মৈত্রেয়ীর কোন ভারতীয় সংস্করণ কখনো হয়নি।

যতদূর শোনা যায় মির্চা আর কখনো ভারতের মাটিতে পা রাখেননি। যদিও তার আত্মজীবনীতে তিনি ভারতবর্ষ এবং ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে গভীর অনুরাগ ব্যক্ত করেছেন, স্পষ্ট বোঝা যায় মানসিকভাবে পরে আর তিনি তার যৌবন অভিযাত্রার দিনগুলোর মুখোমুখি হতে পারেননি। কলকাতার সঙ্গে এইটুকুই তার সম্পর্ক। এইটুকুই সম্ভবত দেবীর মতোই তার মনেও গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। অবশ্য স্রেফ কলকাতা দেখতে আসা, তার মতো উচ্ছল তরুন একজন ইউরোপীয়ের চেয়ে ভারতীয় নারী হিসেবে মৈত্রেয়ী দেবীর ব্যাপারটা অনেক বেশি মর্মস্পর্শী।

এত কিছুর পর মির্চা কে মনে রাখা কেন?
জানালা গলে ঢুকে আসা মৃদ্যু ঠান্ডা বাতাসে যেন বাসুর চুলে সুস্মিতা বিলি কেটে দিলো।
দেখো বাসু প্রেম কার বেশি? অবশ্যই মির্চার!
কেন?
মৈত্রেয়ী দেবী মরমে জ্বলেননি। মির্চার মরমে মরমে দহন অনেকটাই আমাদের প্রচলিত রাধা বিরহী কৃষ্ণ নয় -ধারনার মতো অথচ রাধার চেয়ে শতগুণ বিরহী কৃষ্ণ, সে কথা তোমায় পরে একদিন শোনাবো।

মির্চা কে যেসব সৃষ্টির জন্য কলকাতা কিংবা ভারতবর্ষ শতবর্ষে উপেক্ষিত না রেখে আলোকিত করতে পারতো তার মাঝে 'মহাবিশ্ব এবং ইতিহাসঃ শাশ্বত প্রত্যাবর্তনের কথকতা'(Cosmos and History:The Myth of Etemal Return,1954)'পবিত্র ও পার্থিবঃ ধর্মের প্রকৃতি'(The Sacred and the profane:The Nature of Religion,1959)এবং কল্পকথা ও বাস্তবতা,(১৯৬৩)। মির্চা ইলিয়াডের আর ও ডজনখানেক অন্যান্য উপন্যাস ও গল্প সংগ্রহ আছে। শ্রীরামপুরের রাত, বুড়োটা এবং আমলাটি ছাড়াও তিনি তার ভারতের দিনলিপিও প্রকাশ করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলে রাখা যায় যে, তাতে তিনি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার সাক্ষাত্‍কারের বর্ণনা দিয়েছেন।

এ ছাড়া তার আরও অনেক দিনলিপি ও স্মৃতিকথা আছে। ভারতবর্ষ তার কাছে অনেকখানি। একই সঙ্গে এখানে ফিরতেও আবার ভয় পেয়েছেন তিনি। তার জন্মশতবর্ষে স্পষ্টবক্তা আবেগপ্রবণ এই মানুষটিকে ভারতের স্মরণ করা উচিত ছিলো।

এল্যার্মের শব্দে বাসুর ঘুমটা ভেঙে যায় কোথাও সুস্মিতা নেই, পর্দা গলা আলোয় সুস্মিতার ছবির পাশে মির্চা ইলিয়াডের লা নুই বেঙ্গলী আর তার বুকের উপর মৈত্রেয়ীদেবীর ন হন্যতে ।



0 comments:

3

ধারাবাহিক: সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক 

বানরায়ণ, পর্ব ২
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়



গ্রামের মাঝখানে আঙিনার তিন দিকে জমায়েত হয়েছিলাম আমরা গ্রামবাসীরা। অন্য দিকটায় কয়েকটা গাছের গুঁড়ি জড়ো করে একটা উঁচু মঞ্চের মতন বানানো হয়েছিলো। সেটাকে ঘিরে বর্শা হাতে দাঁড়িয়েছিলো জনা বিশেক কিষ্কিন্ধার যোদ্ধা। পাথরে কোঁদাই শরীর। ভাবলেশহীন পাথুরে মুখ।

বাঘটাকে মাংস দিয়েছিলো ওরা বিষ মিশিয়ে। সেটা খেয়ে আমাদের চোখের সামনে ছটফট করতে করতে মরে গেলো অত বড় হিংস্র পশুটা। তারপর তার শরীর থেকে অসাধারণ নিপুণতার সঙ্গে ছাড়িয়ে নিলো চামড়াটা। বললো, ওটা রাজার জন্য উপহার নিয়ে যাবে। তারপর ওরা আমাদের সঙ্গে চলে এলো আমাদের গ্রামে।

সর্দার প্রথমটা ভয় পেয়েছিলো। এইরকম মানুষ সর্দারও দেখেনি কোনওদিন। কেউ জানতো না যে আমরা কিষ্কিন্ধা বলে কোনও রাজ্যের প্রজা। জানার প্রয়োজনই হয়নি কখনও। সর্দার প্রথমে ভেবেছিলো, এরা আমাদের গ্রাম লুট করতে এসেছে। সঙ্গে নিয়ে আসার জন্য আলাদা করে মোহক, পাহান, চিরুদের নিজের ঘরে ডেকে চাপা গলায় বকতে শুরু করেছিলো। কিন্তু ঠাকুর্দা থামালো তাকে। কি যেন বললো সর্দারের কানে কানে। সর্দার একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তার দিকে কিছুক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে মাথা নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।

সত্যি কথা বলতে, ভয় খানিকটা আমাদেরও করেছিলো। সঙ্গে করে এদের গ্রামে নিয়ে না এসে উপায় ছিলো না। বাঘটার চামড়া ছাড়ানো হয়ে যাওয়ার পর দলপতি তার অলঙ্ঘ্য স্বরে যখন বললো, ‘‘এবার চলো, তোমাদের গ্রামে যাবো।’’ তখন একে অপরের দিকে তাকানো আর তারপর সম্মতিসূচক মাথা নাড়া ছাড়া আমাদের আর কিছু করার কথা মনে হয়নি।

আসার পথে ওদের কয়েকজন একটু গল্প করার চেষ্টা করছিলো আমাদের সঙ্গে। ঠাট্টা-মশকরা করছিলো। জিজ্ঞেস করছিলো, এত লোকের আতিথেয়তা আমরা করতে পারবো কি না। সে বিষয়ে আমাদেরও একটু সন্দেহ ছিলো। একশোজন তাগড়াই জোয়ান লোকের খোরাক প্রায় আমাদের পুরো গাঁয়ের একদিনের খোরাকের সমান। এত তাড়াতাড়ি অত খাবার জোগাড় করা যাবে কি?

কিন্তু গাঁয়ে পৌঁছে বুঝলাম, ওই নিয়ে চিন্তা করার কোনও কারণ ছিলো না। এদের প্রত্যেকের পিঠে ঝোলানো চামড়ার বস্তাগুলোর মধ্যে যার যার নিজের দু’দিনের খাবার রসদ আছে। ছোলা, গুড়, চিঁড়ে থেকে আরম্ভ করে ফল আর শুকনো মাংস অবধি। গ্রামের মাঝের বিস্তীর্ণ উঠোনের উপর সুসংবদ্ধ হয়ে বসে খেতে আরম্ভ করলো ওরা। ততক্ষণে সর্দারের সঙ্গে ওদের দলপতির প্রাথমিক কথাবার্তা হয়ে গেছে। সর্দার আমাদের অভিযানের দলের লোকেদের ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বকা শুরু করেছে। ঠাকুর্দা যে তার কানে কানে কি বলে তাকে থামালো, সেটা আমরা কেউ বুঝলাম না।

ওদের ততক্ষণে খাওয়া হয়ে গেছে। সবাই উঠে সার বেঁধে বর্শা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। যাদের হাতে ওই কুড়ুল আর বড় বড় ভারি অস্ত্রগুলো ছিলো, তাদের কয়েকজন দেখলাম এক কোনে আমাদের জ্বালানির জন্য কেটে রাখা গাছের গুঁড়িগুলোর কয়েকটাকে ধরাধরি করে এনে আঙিনার মাঝখানে উঁচু মতন মঞ্চটা বানিয়ে ফেললো। তারপর পাঁচজন পাঁচজন করে চারপাশ থেকে মঞ্চটা ঘিরে দাঁড়ালো। বাকিরা সার বেঁধে পিছনে। দলপতি ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ালো মঞ্চটার উপর। ধীর গম্ভীর স্বরে কথা বলতে আরম্ভ করলো।

‘‘তাম্বলি গ্রামের অধিবাসীরা, আমি আপনাদের সবাইকে অনুরোধ করছি এখানে আসতে, আমার কথা শুনতে। আমি শপথ করে বলতে পারি, এমন কথা আপনারা কেউ কোনওদিন শোনেননি। শুধু আপনারা নন, সমগ্র বিন্ধ্যপর্বতের কোনও অধিবাসী কোনওদিন শোনেনি এমন কথা।’’

কয়েক মুহুর্তের মধ্যে গ্রামের ছেলে-বুড়ো-মেয়ে-মদ্দ সবাই জড়ো হয়ে গেলো আঙিনায়। এমনিতেই এমন মানুষ কেউ দেখেনি কখনও। তার মধ্যে কিষ্কিন্ধা আর তার রাজা সুগ্রীবের কথাটা ছড়িয়ে পড়েছে গাঁয়ের মুখে মুখে, কানে কানে। আমরা নাকি সেই মহান রাজার প্রজা। আশপাশের আরও যে পাঁচদশটা গ্রামের মানুষের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে, তারা কেউ তো কোনওদিন বলেনি এমন কোনও রাজ্যের কথা, রাজার কথা!

‘‘আমি মহান কিষ্কিন্ধা রাজ্যের মহাশক্তিধর কল্যানময় রাজা পরমভট্টারক সুগ্রীবের একজন সেনাধ্যক্ষ। আমার নাম সম্বর্ত। মহারাজ সুগ্রীব ও তাঁর পরম মিত্র অযোধ্যার যুবরাজ মহাবীর রামচন্দ্রের হয়ে আমি আপনাদের সবাইকে আহ্বান জানাতে এসেছি এক এমন অভিযানে, যাতে অংশগ্রহণ করলে আপনারা প্রত্যেকে লাভ করবেন অসামান্য শৌর্যবীর্য, অফুরন্ত ধনরত্ন এবং চিরঅমরত্ব।’’

সম্বর্তের বাচনভঙ্গী বেশ আকর্ষণীয়। এই অবধি বলে সে খানিকক্ষণ থামলো। কথাগুলো সমবেত জনতার হৃদয়ঙ্গম হতে একটু সময় দিলো। তারপর আবার শুরু করলো...

‘‘আপনারা বোধহয় কেউ অযোধ্যার নাম শোনেননি। এই বিন্ধ্যপর্বতের উত্তরে বহু দূরে সমৃদ্ধ উত্তরকোশল দেশ। সেই দেশের রাজধানী অযোধ্যা। সেখানকার যুবরাজ মহাবীর রামচন্দ্র, যাঁর বীরত্বের গৌরব সমগ্র আর্যাবর্ত তথা দাক্ষিণাত্যে প্রসিদ্ধ, সেই রামচন্দ্র পিতৃসত্য পালনের তাড়নায় যখন স্ত্রী সীতাদেবী ও ভাই লক্ষ্মণের সঙ্গে বনবাস করছিলেন, সেই সময় লঙ্কার অত্যাচারী রাজা রাবণ বলপূর্বক সীতাকে হরণ করেন।’’

আবার কিছুক্ষণের নৈঃশব্দ। লঙ্কা, রাবণ, সবগুলো নামই যে আমাদের কাছে অপরিচিত, সেটা সম্ভবত আমাদের হতভম্ব মুখগুলো দেখেই সম্বর্ত বুঝতে পারছিলো। তার মুখে খানিকটা বিরক্তি আর অনেকখানি অনুকম্পা মেশানো একটা হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেলো। গলাটা পরিস্কার করে নিয়ে সে আবার বলতে শুরু করলো...

‘‘তোমাদের গ্রামের পরে যে জঙ্গল শুরু হচ্ছে, সেই জঙ্গলের পর বহু যোজন পেরিয়ে যেখানে মাটি শেষ, সেইখান থেকে শুরু হয় সমুদ্র... অথৈ জলের পারাবার।’’ সম্বর্তের সম্বোধনে ‘‘আপনি’’টা বেশ সাবলীল ভাবেই ‘‘তুমি’’ হয়ে গেলো। ‘‘সেই পারাবারের মাঝে রাক্ষসরাজ রাবণের সোনার দ্বীপ লঙ্কা। সেখানে পথে ঘাটে সোনা-রূপা-মনি-মুক্তার ছড়াছড়ি। কিন্তু সে দ্বীপের পাপের বোঝা পূর্ণ হয়েছে। আজ বহু বছর যাবত রাবণ তার অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে আর্যাবর্ত ও দাক্ষিণাত্যের দেশগুলির উপর। কত রমণীর সর্বনাশ যে সেই কামুক করেছে, কত নির্দোষ, শান্তিপ্রিয় রাজাকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করেছে, তার সীমা-পরিসীমা নেই। কিন্তু এইবার তার আর নিস্তার নেই। অতিদর্পী রাবণ জানে না, সে যাকে হরণ করেছে, সেই সীতাদেবী স্বয়ং জগজ্জননী স্বরূপা। তিনি ত্রিভুবনের প্রভু শ্রীরামচন্দ্রের স্ত্রী, যাঁর নেতৃত্বে কিষ্কিন্ধার দুর্মদ বাহিনী সমুদ্রের অন্তহীন ঢেউয়ের মতনই গিয়ে আছড়ে পড়বে লঙ্কার উপকূলে। ছারখার করে দেবে রাবণের অতি সাধের স্বর্ণলঙ্কাকে।’’

দম নেওয়ার জন্য একটু থামলো সম্বর্ত। তার সাবলীল বাচনভঙ্গী থেকে বোঝা যাচ্ছিলো যে সে এই বক্তৃতাটা দিতে অভ্যস্ত। কিন্তু ঠিক কি বলতে চাইছিলো, সেটা তখনও অবধি পরিস্কার বোঝা যাচ্ছিলো না। কিছু একটা অভিযানে অংশগ্রহণের কথা বলছিলো। সেটা কি? সম্বর্তের কথার মাঝখানেই আমি একবার সর্দারের আর একবার ঠাকুর্দার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। সর্দারের মুখে স্পষ্ট অস্বস্তি আর দুশ্চিন্তার ছাপ। কিন্তু ঠাকুর্দার মুখে কেমন একটা অদ্ভূত তদ্গত, আবিষ্ট ভাব। যখন স্বপ্ন হয়, তখন এই রকম একটা ভাব হয় ঠাকুর্দার। সেই স্বপ্নের ভিতর ঠাকুর্দা এমন সব ঘটনা দেখতে পায়, যেগুলো...

‘‘কুমারিকার উপকূলে শুরু হয়েছে সেতুবন্ধনের কাজ।’’ সম্বর্তের কন্ঠস্বরে আমার চিন্তার সূত্রটা কেটে গেলো। ‘‘স্বয়ং দেবকারিগর বিশ্বকর্মার দুই যমজ পুত্র নল ও নীলের তত্ত্বাবধানে তৈরি হচ্ছে সেই সেতু, যা সাগর পেরিয়ে সুগম করে দেবে কিষ্কিন্ধাবাহিনীর লঙ্কা আক্রমণের পথ। দাক্ষিণাত্যের সব রাজ্য, সব গ্রাম থেকে হাজারে হাজারে তরুণ, যুবকরা গিয়ে যোগদান করছে সেই সুমহান কর্মযজ্ঞে।’’ 

সমবেত গ্রামবাসীর মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে তাদের মনোভাব বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করলো সম্বর্ত। ‘‘প্রভু শ্রীরামচন্দ্র এবং মহারাজ সুগ্রীবের পক্ষ থেকে আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি... এসো, কিষ্কিন্ধার অপরাজেয় বাহিনীতে যোগদান করে দুর্বিনীত, অহঙ্কারী, অত্যাচারী রাবণ ও তার রাক্ষসসেনাকে ধ্বংস করো... এবং সেই সঙ্গে লাভ করো অমর কীর্তি ও অতুল সম্পদ।’’

একটু বিরতি। তারপর আবার বক্তৃতা। ‘‘আবার বলছি... নিজের নাম ও কীর্তিকে অমর করে রেখে যাওয়ার এমন সুযোগ বারবার আসে না জীবনে। আমি নিশ্চিত, সাহসে বা বীরত্বে তাম্বলি গ্রামের তরুনরা কারও চেয়ে কম নয়। বরং বহুদিনের অভিজ্ঞতায় তোমাদের দেখে আমার মনে হয়েছে, তোমরা এই অঞ্চলের অন্যান্য গ্রামবাসীদের থেকে আলাদা। তোমাদের মধ্যে যাদের সঙ্গে আমাদের ওই পাহাড়ের উপর দেখা হয়েছিলো, তাদের সাহস আর ঠাণ্ডা মাথা রীতিমতন প্রশংসনীয়। তোমাদের মতন সাহসী অথচ স্থিতধী লোকেরই প্রয়োজন যুদ্ধে সব থেকে বেশি।’’

সম্বর্তের শহুরে ভাষা সবটা খুব ভালো না বুঝলেও অন্তত এটুকু বুঝতে পারছিলাম যে লোকটা আমাদের প্রশংসা করছে। ততক্ষণে সে আসল কথায় এসে গেছে। ‘‘এখান থেকে যোজন তিনেক দূরে, ওই যে পাহাড়ের গায়ে তোমরা ফাঁদ পেতেছিলে, সেই পাহাড়ের ওপাশে আমাদের অস্থায়ী শিবির। সেখানে চলছে সৈন্যনিয়োগের কাজ। কিষ্কিন্ধার অন্যতম প্রধান সেনানায়ক গবাক্ষ সেখানে স্বয়ং নিয়োগ করছেন নতুন যোদ্ধাদের, তত্ত্বাবধান করছেন তাদের প্রশিক্ষণের। তোমরা যারা সত্যিকারের সাহসী, বীর, যারা এই ক্ষুদ্র গ্রামের গণ্ডী অতিক্রম করে বাইরের বিশাল বিশ্বটাকে দেখতে চাও, উপভোগ করতে চাও এই বীরভোগ্যা বসুন্ধরাকে, তারা এসো। যোগদান করো কিষ্কিন্ধার রাজকীয় বাহিনীতে। এক অত্যুজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে আছে তোমাদের জন্য।’’

বক্তব্য শেষ করে সম্বর্ত ধীর পদক্ষেপে নেমে গেলো অস্থায়ী মঞ্চটার উপর থেকে। রেখে গেলো উদ্বেগ, উত্তেজনা, চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা আর আকাশচুম্বী উচ্চাশায় উদ্বেল কিছু তরুণকে। সে রাতে তাদের কারও দু’চোখ এক মুহুর্তের জন্যও এক হলোনা। 

গণ্ডগোলটা শুরু হলো পরের দিন সকালে, সম্বর্ত আর তার দল চলে যাওয়ার পর।

3 comments:

1

ধারাবাহিক : নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক 

ছুটি কথা ৫
নন্দিনী সেনগুপ্ত

কলকাতায় বেশ শীত পড়েছে কয়েকদিন হল। শীত পড়লেই মন চলে যায় ছোটবেলায় পাওয়া শীতের ছুটিগুলোয়। মন চলে যায় ক্রিসমাসের কেকে, নতুন গুড়ের গন্ধে, কমলালেবুর কোয়ায়, উলের নকশায়। কিন্তু এইগুলোর সঙ্গে আমাদের ছোটবেলায় একটা জিনিস হত শীতে, সেটা হল নতুন বছরে নতুন ক্লাসে ওঠা, নতুন খাতা, নতুন বই। ঐ যাহ্‌, বই বলতেই মনে পড়ল বইমেলা। হুঁ হুঁ, নতুন বছরে নতুন ক্লাসের বই পড়বার ঠিকঠাক উৎসাহ আসবে কোত্থেকে, যদি বইমেলা থেকে বেশী নয়, নিদেনপক্ষে গুটিচারেক নতুন গপ্পের বই না ঝুলিতে জমা হয়? 

প্রতিবারই আমি বই পাই, বইমেলা থেকে। বাবা যায় তো, কিনে আনে। কিন্তু বাবা আমায় কোনওবার নিয়ে যায়না। যে নাটকে গান নেই, নাচ নেই, খালি কথা, কথা, আর কথা, সেরকম নাটকও বাবা আমায় দেখাতে নিয়ে যায়। সিনেমা দেখাতে নিয়ে যায়, সিনেমার ইংরেজি কথা না বুঝলে ফিসফিস করে হলের মধ্যে মানেও বলে দেয়, একটুও রাগ করে না। কিন্তু বইমেলা যাবার নাম করলেই কেমন গম্ভীর হয়ে বলে, ‘ওরে সব্বোনাশ, তুই হাঁটতে পারবিনা এত, শেষে দু পা গিয়েই বলবি, বাবি, কোলে নাও! তখন আমি বই কিনব না তোকে কোলে নেবো? আর বেজায় ধুলো যে রে! নির্ঘাত সর্দিকাশি বাঁধাবি। একদম না। একদম বায়না ধরবি না বইমেলা যাবার’। এই অবধি বলেই বাবা চশমা পড়ে ফেলে, তারপর চাইনিজ কলম দিয়ে কি যেন লিখতে শুরু করে ডায়রি খুলে। বাবা একবার লিখতে শুরু করলে আর কোনও কথা বলা মানা, দরকারি কাজ করছে, তাই আর বিরক্ত করা চলবেনা। 

কিন্তু আমার খুব ইচ্ছে বইমেলা ব্যাপারটা কি, সেইটা একবার দেখতে চাই। বুবাই প্রতিবার সেই চুঁচুড়া থেকে বইমেলা দেখতে আসে সেজমেসোর সঙ্গে, কিন্তু এই কলকাতায় বসে আমার এখনও বইমেলা দেখা হল না। সামনের বছর আমি ক্লাস ফোরে উঠবো, এখনও বইমেলা দেখা হলনা আমার! নাহ, এবার একটা বিহিত করতেই হবে। ঐ চশমা পড়বার আগেই যা বলবার সেটা বলে ফেলতে হবে বাবাকে। 

যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। সাহস করে একদিন বলে ফেললাম বাবাকে, ‘বাবি, প্লিজ প্লিজ প্লিজ... এবার আমাকে বইমেলা দেখাতে নিয়ে চলো-ও-ও-ও! আমি কথা দিচ্ছি একটুও বায়না করবো না আইসক্রিম খাবার, একবারও কোলে উঠতে চাইবো না, পুরোটা হাঁটতে পারবো। আর হ্যাঁ, এখন থেকে রোজ পড়াশুনা করবো, সমান করে জুতোর ফিতে বাঁধবো আর তুমি বাড়ি না থাকলে তোমার কলম টাচ করবো না। প্লিজ আমায় নিয়ে চলো এইবারটি’। এতগুলো কথা একেবারে একদমে বলে ফেলে বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বাবা কি গোঁফের ফাঁক দিয়ে একটু মুচকি মুচকি হাসছে? বাবা কি এখন আমাকে গলা জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঘষে বলবে, ‘আচ্ছা, আমার মা-মনি!’? —হ্যাঁ, বলেছে, বাবা বলেছে। উফফফ, কি মজা, এবার তাহলে বইমেলা যাচ্ছি। বুবাই তাহলে আর আমায় দুয়ো দিতে পারবে না, আমি একটা কাঁচকলা দেখিয়ে বলব, ‘আম্মো বইমেলা দেখেছি’। 

অবশেষে এলো সেই শুভদিন। শীত একটু আছে বটে, কিন্তু ফুল সোয়েটার পড়বার মত নয়। কিন্তু মা কি শোনে? দিলো সেই ফুলহাতা লাল পুলওভারটা পরিয়ে, সঙ্গে আকাশী রঙের ফুলপ্যান্ট। টুপিটাও পরিয়ে দিতে চাইছিল, আমি চেঁচামেচি জুড়লাম, শেষে বাবা ওটা নিজের ঝোলায় ঢুকিয়ে নিয়েছে। আমি বইমেলা যাচ্ছি। মেলায় ঢুকতে গিয়ে আমার চক্ষু চড়কগাছ। কি সুন্দর তোরণ! আমাদের বাবুবাগানের দুর্গাপুজাতেও এত সুন্দর করে সাজায়না। ভেতরে ঢুকলাম ধীরে ধীরে, বেশ ভিড় হয়েছে; রবিবারের দুপুর তো, তাই। বাবা সব সময় আমার হাত ধরে আছে। দারুণ দারুণ দেখতে সব স্টল হয়েছে। বেশীরভাগ স্টলেই নিচের দিকে বাচ্চাদের বই, যাতে আমাদের বয়সী বাচ্চারা হাতে তুলে নিয়ে দেখতে পারে। 

রাস্তায় আসবার সময় বাবা আমায় পইপই করে বুঝিয়ে এনেছে, বই র‍্যাকের যেখান থেকে তুলবো, ঠিক সেইখানেই যেন আবার রেখে দিই, ওটা আমার বাড়ি নয়, যে যেখান থেকে খুশি বই নিয়ে আরেক জায়গায় রেখে দিলে চলবে, আর বই পছন্দ হলে বাবাকে বলতে, সেইটা বাবা আমায় কিনে দেবে। কিন্তু আমি জানি পছন্দ হলেই তো আর চলবে না, কিছু কিছু বই আমার ভারি পছন্দ হচ্ছে বটে, কিন্তু সেগুলোর দাম বিচ্ছিরি রকমের বেশী; সেগুলো কিনে পড়বার চেয়ে পাড়ার, ইস্কুলের বা রামকৃষ্ণ মিশনের লাইব্রেরী থেকে ধার করে পড়া ঢের ভালো। বই পছন্দ হলেই কিনতে হবে এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি। তাও নয় নয় করে বেশ কিছু বই কেনা হয়ে গেলো। 

একটা স্টল থেকে বেরবো, এমন সময় বাবা হাত ধরে টেনে আমায় ফিসফিস করে বলল, ‘ঐ দ্যাখ মামণি, ঐ যে তুই আনন্দমেলায় গোগোলের গল্প পড়তে ভালবাসিস, ঐ যে ভদ্রলোক যাচ্ছেন, ঐ উনিই ঐ গপ্পোগুলোর লেখক!’ আমি হাঁ করে তাকিয়ে দেখি, ওরেব্বাস, ঐ তো ছোট্টখাট্টো দেখতে একটা মানুষ, সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা, তার উপরে ধূসর জহরকোট, কাঁধে একটা ঝোলা, হেঁটে যাচ্ছেন ছোট অথচ দৃঢ় পদক্ষেপে। উনি ঐ অত্তবড় গপ্পোগুলি লেখেন! শুধু গোগোল কেন উনি তো বড়দের উপন্যাসও লেখেন। ঠাম্মা আর মা হাঁ করে গেলে, আমাকে একটুও টাচ করতে দেয়না সেই বই; উপরে তাকে তুলে রাখে যাতে আমি চেয়ারে উঠেও হাত না পাই। ইনিই সেই সমরেশ বসু! আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকি দূর থেকে ওনার সেই ভারি উজ্জ্বল চোখদুটির দিকে। পরে বড় হয়ে আরও একদুবার ওনাকে দেখেছি সামনাসামনি, প্রণাম করেছি পায়ে হাত দিয়ে, কিন্তু প্রথম সেই দর্শন মনে দাগ কেটে রয়েছে আজও। 

দেব সাহিত্য কুটিরের স্টলের কাছে এসে বাবা বলল, এই খানে বাবার বন্ধু দীপককাকু দাঁড়িয়ে থাকার কথা। বাবা আমাকে বলল, ‘একটু এইখানে দাঁড়া, যা ভিড়, দীপক মনে হয় ভিতরে গেলো, আমি ডেকে নিয়ে আসি, নড়বি না কিন্তু, এইখানে দাঁড়িয়ে থাক’। বাবা তো বলল, কিন্তু ওইরকম দাঁড়িয়ে থাকতে পারে নাকি কেউ মেলা দেখতে এসে? কি বোকা বোকা ব্যাপার! আমি ভাল করে দেখে নিলাম জায়গাটা, একটু চিনে নিলাম, যাতে একটু ঘুরে নিয়ে আবার ফিরে আসতে পারি ঐ জায়গায়। 

তারপর আমি কাছের একটু ফাঁকা স্টলগুলি দেখতে লাগলাম। ওমা, রান্নার বই, সেলাইএর বই, আল্পনার বই, কতরকম বই পাওয়া যায়। আমি তো ভেবেছিলাম শুধু গপ্পের বই আর পড়ার বই পাওয়া যায় এখানে। উফফ, ভারি গরম লাগছে, লাল পুলওভারটা খুলে সেটা বেঁধে নিলাম কোমরে। নিচের সাদা জামাটা একটু পুরনো, হোক গে, গরম থেকে তো বাঁচি একটু। আরেকটা স্টলে ঢুকলাম, ওমা, এটা দেখি একদম একটা মন্দিরের মত সাজানো, ঠাকুরের ছবি, ধূপধূনা জ্বলছে, বিক্রিও হচ্ছে শুধু ঠাকুরের বই। এই দ্যাখো, বাবা তো ঠাকুরদেবতার কথা শুনলেই চটে যায়, তাই এই স্টলে আমায় নিয়ে আসেনি। কিন্তু মা বলেছে, ঠাকুর-দেবতার ছবি দেখলেই নমস্কার করতে। আমি দুহাত জোড় করে চোখ বুজে দাঁড়াই ঠাকুরের ছবির সামনে। 

তারপর বেরিয়ে এসে আবার দাঁড়াই সেই দেব সাহিত্য কুটিরের সামনে। কিন্তু বাবা কোথায়? বাবাকে তো দেখতে পাচ্ছিনা! আমি আর কতক্ষণ এইখানে দাঁড়াবো? বাবি, তুমি কোথায়? আচ্ছা, আমি কি হারিয়ে গেলাম? 

আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করি এক এক করে যে হারিয়ে গেলে কি করতে হয়। আমার পকেটে অল্প একটু পয়সা আছে। বাসের টিকিট কাটতে পারবো। বাসে ওঠবার আগে একটু জেনে নেবো সেই বাস ঢাকুরিয়া যাবে কিনা। তাহলে? খুব সোজা, হারিয়ে তুমি যাওনি নন্দিনী ! আমি নিজেকে নিজে বলি, মনে মনে সাহস দি, এগিয়ে গিয়ে খুঁজবো বের হবার গেট কোনটা, আরেকবার ভাবি, বাসস্ট্যান্ড খুঁজে না পেলে রাস্তায় কোনও পুলিশকে জিজ্ঞাসা করবো। কিন্তু বাবা কোথায় গেলো? এইটা ভেবেই আমার একটু একটু কান্না পেতে থাকে। আমি তো হারাইনি, কিন্তু বাবা কি হারিয়ে গেলো? যাই একটু নাহয় বাবাকে খুঁজি, তারপর মেলা থেকে বেরোবার গেট খুঁজবো। 

আমি ঢুকে যাই আবার দেব সাহিত্য কুটিরের স্টলে। নাহ, কোথাও বাবা নেই, ভিড়টাও ততটা নেই, যে আমি বাবাকে খুঁজে পাবো না। বেরিয়ে আসি, মেলায় সানাই বন্ধ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ; কিন্তু কে একটা হারিয়ে গেছে, তাকে ডাকছে মেলার অফিস থেকে। বলছে একটা বাচ্চা মেয়ে হারিয়ে গেছে, ক্লাস থ্রির বাচ্চা, পরনে লাল পুলওভার, আকাশী প্যান্ট, পায়ে বাটার স্নিকার, নাম নন্দিনী বন্দ্যোপাধ্যায়। 

এই মেরেছে, সবকিছুই তো আমার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, তাহলে কি আমিই হারিয়ে গেছি? আচ্ছা, হারিয়ে গেলে কি করা উচিত? আমি এত ছোট নই যে ডাক ছেড়ে কাঁদবো। আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই একটা স্টলের সামনে দাঁড়ানো একজন মহিলার দিকে। কি সুন্দর দেখতে, কতকটা আমাদের ক্লাসটিচার বীণাদির মত। গিয়ে বলি, ‘এক্সকিউজ মি আন্টি, একটু শুনবেন?’ ভদ্রমহিলা চোখ তুলে তাকান, চশমার ফ্রেমটাও বীণাদির চশমার ফ্রেমের মত। আমি বলে উঠি, ‘ঐ যে মাইকে নাম এনাউন্স করছে না, ওটা না আমার নাম, আসলে আমি না--- আমার বাবাকে খুঁজে পাচ্ছিনা, প্লিজ আমাকে একটু হেল্প করবেন?’ ভদ্রমহিলা কিরকম যেন চমকে উঠলেন, তারপর বললেন ‘ওঃ আচ্ছা, আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি, এই এনাউন্সমেণ্ট গিল্ডের অফিস থেকে করা হচ্ছে, সম্ভবতঃ তোমার বাবা ঐখানেই আছেন’। 

ভদ্রমহিলার সঙ্গে বোধহয় ওনার স্বামী ছিলেন, তিনিও বললেন, ‘হ্যাঁ, তাই হবে, চলো, তোমাকে আমরা গিল্ডের অফিসে নিয়ে যাই’। ওরা দুজন দুদিক থেকে এসে আমার হাত ধরেন, এবার আমি একটু ঘাবড়ে যাই। আচ্ছা এরা আবার ছেলেধরা নয়তো? আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে না তো? আমি বহুদিন রাস্তায় বেরোলে হাত ধরিনা। আজ বাবা বারে বারে হাত ধরে থাকছিল বলে আমার ভারি রাগ হচ্ছিল। এখন আবার এরা আমায় হাত ধরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ভিড় ঠেলে, আর বলছে ‘খুকি, কিচ্ছু চিন্তা করোনা, কোনও ভয় নেই’। দুত্তোর, আমি খুকি হতে যাবো কেন? খুকি তো ঠাম্মার ডাকনাম। মাসিঠাম্মা, মানে ঠাম্মার দিদি যখন আসে আমাদের বাড়ি, তখন ডাকে,---‘ও খুকি, আয়রে রেঙ্গুনের গপ্পো করি, ও খুকি আয়রে তোর মাথায় তেল দিয়া দিই’। মাসিঠাম্মা খালি ‘খুকি, খুকি’ করে আর মা মুখে আঁচল চাপা দেয়। কিন্তু আমি বাবার কথা ভাবছি তাই এদের বলতেও পারিনা যে আমার নাম খুকি নয়, আমার নাম নন্দিনী। 

একটু পরে আমরা মেলায় একটা প্যান্ড্যালে এসে দাঁড়ালাম। ঐ তো, আমি দীপককাকুকে দেখতে পাচ্ছি। দীপককাকু খুব লম্বা, সবাইকে ছাড়িয়ে দীপককাকুকে দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু বাবাকে দেখতে পাচ্ছিনা। বাবা কোথায়? আমি ওনাদের হাত ছাড়িয়ে ছুটে যাই দীপককাকুর দিকে। দীপককাকুও আমাকে দেখতে পেয়ে একটা চীৎকার করে উঠলো, ‘আরে, এই তো, এই তো, পাওয়া গেছে, পাওয়া গেছে’। আমি কিচ্ছু বুঝে উঠতে পারিনা, আমি বলতে থাকি দীপককাকুকে, ‘কিন্তু বাবা কোথায়? তুমি কি বাবাকে দেখেছো?’ এমন সময় বাবা ভিড়ের মধ্যে থেকে ছুটে আসে আমার দিকে, ভীষণ রেগে গিয়েছে বাবা, বুঝতে পারছি আমি। 

বাবা এত রেগে গিয়েছে যে চশমার মধ্য দিয়ে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, কোনও কথা বলছেনা, একটাও কথা বলছেনা আমার সঙ্গে। বাবা শক্ত করে আমার ডানহাতটা ধরে আছে, এবার আমার সত্যি কান্না পাচ্ছে। আমি মনে মনে বলি ‘বাবি, প্লিজ আমার সঙ্গে কথা বল। আমাকে বকা দাও ভুল করে থাকলে, কিন্তু কথা বল’। বাবা কিচ্ছু বলেনা, ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসে আমাকে নিয়ে, আমি যে ভদ্রমহিলা আর ভদ্রলোকের সঙ্গে গিল্ডের অফিস অবধি গিয়েছিলাম তাদের ধন্যবাদ জানায়, তাদের সঙ্গে আর দীপককাকুর সঙ্গে অনেক কথা বলতে থাকে, তাদের ঠিকানাও নেয়, কিন্তু আমার সঙ্গে একটাও কথা বলে না। 

 আমাকে শক্ত করে ধরে নিয়ে বাবা বেরিয়ে আসে মেলা থেকে, পিছনে পড়ে থাকে বইয়ের উৎসব, জ্ঞানের পসরা। দীপককাকু উত্তর কলকাতায় যাবে। আমরা দক্ষিণের বাসে উঠি। আমি বাসের জানালার সিটে বসি, বাবাও বসে আমার পাশে। আমি আস্তে আস্তে বাবার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিই, বাবা কথা বলেনা। শীতের হাওয়ায় বাবার চুল উড়ছে, বাবা বাইরে সন্ধ্যার অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে। বাবা চশমাটা খুলে আমাকে জড়িয়ে ধরে। বাবার ঝোলায় নতুন বইয়ের গন্ধ, বাবার গালের আফটারশেভ লোশনের গন্ধ সব মিলেমিশে যাচ্ছে। আমি কাঁদছি আর বলছি, ‘আয়াম সরি, বাবি, আর কখনও তোমার অবাধ্য হবো না’। 

এখনও এই শীতের সন্ধ্যার অন্ধকার, বইমেলার নতুন বইয়ের গন্ধ, এই সবকিছুর মধ্যেই বোধহয় রয়ে গেছে আমার বাবার আদর, আলিঙ্গন। বাবা চলে গেছেন আজ ঠিক আট বছর হল, এই লেখা শেষ করছি ১০ই জানুয়ারি, ২০১৫ -- আজই বাবার মৃত্যুদিন। ভাল থেকো বাবি, নতুন বইয়ের গন্ধে আমাকে জড়িয়ে ধরে থেকো। 













1 comments:

2

অণুগল্প: উৎসব দত্ত

Posted in


অণুগল্প



মনের কাছাকাছি 
উৎসব দত্ত 



সহেলি আর রাজীব ছমাস হল একসাথে থাকে সামনের বছর বিয়ে করতে পারে, নাও পারে - দুজনেই খামখেয়ালি। কদিন ধরেই ভাবছে শপিংএ যাবে। অফিসের ব্যস্ততায় সারা হচ্ছিলনা। আজ প্ল্যান করা আছে অফিস থেকে আগে বেরোবে। 

সময় মতো ওরা চলে এসেছে। রাজীবের জন্য টি শার্ট পছন্দ করে দিয়েছে সহেলি আর দুটো ডেনিম জিন্স সাথে টুকটাক যা নেবার ছিল। 

সহেলি ওর সেই প্রিয় বুটিকটায় ঢুকেছে। ডানদিকে সেই পরিচিত লোকটা। 

"ম্যাডম, ক্যামন আছেন ? নতুন শাড়িগুলো দেখুন । ব্রান্ডেড। এগুল আমাদের এখানেই তৈরি । কদিন পর বাইরে চলে যাবে।"

বেশ কয়েকটা পছন্দ হল। সহেলি শাড়ি গুলো নিয়ে ট্রায়াল রুমে এ চলে গেল। 

রাজীব চুপচাপ বসে আছে। দু একবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। রাজীবের একটা শাড়ি পছন্দ হয়েছিল একবার ভাবল সহেলি কে বলবে কিন্তু বলা হলনা।

ট্রায়াল রুম থেকে বেরিয়ে এসে সহেলি "অ্যাই ক্যামন লাগছে ?"

রাজীব আর কি বলে "খুব ভালো"। 

কিন্তু সহেলির মনোমতো হচ্ছেনা কিছুতেই। আরও বার পাঁচেক শাড়ি দেখা হল। রাজীবকে যথারীতি ডজ করতে হচ্ছে। প্রতিবার কি ভালো বলা চলে আবার খারাপ লাগছেও বলা যাবেনা। 

ফাইন্যালি পছন্দ হল। কিন্তু সহেলির কপাল খারাপ বুটিকের লোকটা জানালো ওটা Already Sold। কি করা যাবে অন্য শাড়ি নিতে হল। 

ফেরার পথে সহেলি রাজীবের ওপর রাগ দেখাল "তোমার জন্য এতো দেরি করে এলাম কদিন আগে এলে ওই শাড়িটা পেয়ে যেতাম।"

বাড়ি ফিরে এক এক করে সব বের করা হচ্ছে। "একি! সেই শাড়িটা তো ! যেটা আমি পছন্দ করেছিলাম…."

অ্যাই রাজীব আমার পছন্দ করা শাড়িটা আমদের ব্যাগে এল কি করে? "

রাজীবের ছোট্ট জবাব "আমি পছন্দ করে রেখেছিলাম, তোমার ট্রায়াল দেবার আগে"।

2 comments:

2

অণুগল্প: শাহেদ সেলিম

Posted in







অণুগল্প

পুস্তক 
শাহেদ সেলিম



মিথের পেছনে ছুটে ছুটে অবশেষে পৌঁছে গেলাম, রামুর এক জীর্ণ ত্রিতল কেয়াঙ্গে।
বয়বৃদ্ধ ভান্তে এসে দাঁড়ালেন আমার সামনে। সস্নেহে হাত ধরে জিজ্ঞেস করলেন,

-কি চাও তুমি?

আমি প্রশ্ন শুনে বিদগ্ধ শ্রোতার মত চেয়ে রইলাম তার দিকে।
হায়! এই প্রশ্নটি অনাদিকাল ধরে আমার পিছু নিয়েছে! কখনো উত্তর খুঁজে পাই নি।

-কি চাও তুমি? কি চাও তুমি?- আমায় অনুসরণ করছে।

সম্বিত ফিরে পেয়ে বললাম পুস্তকটির কথা,-- আমি এসেছি পুস্তকটির কিছু ছবি নিতে।

এর আগেও সন্ধান করেছি একটি বৃক্ষের। যার সফেদ ক্ষীণ তন্তু থেকে তৈরি হত মসলিন।
যা অঙ্গে ধারন করেছিল সম্রাজ্ঞী ক্লিওপেট্রা, ফারউরা মুড়ি দিয়ে উঠে পড়তেন শেষ নৌকাবিহারে।
খুঁজেছি তাকে ময়মনসিংহ থেকে নরসিংদী, খুঁজেছি সোনারগাঁয়ে।

পাইনি সে অমূল্য বৃক্ষ!

বৃদ্ধ ভান্তে, আমাকে নিয়ে গেলেন তার পুস্তকখানায়।
একটা লালশালু মোড়ানো পুস্তক আমার হাতে তুলে দিলেন। বললেন-- এটা পালিতে লেখা।

তালপাতার পুস্তক ধীরে ধীরে উন্মোচিত করল নিজেকে, আমার সামনে। এর এক বর্ণও আমি পড়তে পারি নি।
আমি ভাষাবিদ নই। আমি সাধারণ এক ফটোগ্রাফার।
কিন্তু তার পাতায় পাতায় ধুসর বর্ণগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলো আমার পূর্বপুরুষগণ।
পরতে পরতে ভেসে উঠল তাদের সহজিয়া জীবন।
আমি আমার শেকড় খুঁজে পেলাম! আমি মৌন হয়ে গেলাম!
ভান্তে দূর পাহাড়ের জাদি দেখিয়ে বললেন-
‘তারও উপারে আমাদের আলোকিত মানুষেরা প্রকৃতির জ্ঞান লাভ করতেন।
নিয়ে আসতেন জীবনের মানে।’

তখন--
আমার ভেতর শুধু অনুরণিত হতে লাগল, 
আমদের সব কিছু নিয়ে গেছে বেদুইনের দল!!!
---------------------------------------------------------------





পাদটীকাঃ 
রামুঃ কক্সবাজারের একটি উপজেলা।
কেয়াঙ্গঃ বৌদ্ধ উপাসনালয়।
ভান্তেঃ বৌদ্ধ ধর্মগুরু।
জাদিঃ পাহাড়ের চুড়ায় অবস্থিত বৌদ্ধদের বিশেষ সৌধ।

2 comments: