0

ছোটগল্প: সুধাংশু চক্রবর্তী

Posted in


ছোটগল্প



একগুচ্ছ বইমেলা
সুধাংশু চক্রবর্তী



।। বইমেলা – ১ ।।

আজই বইমেলা শুরু হয়েছে । ধুতি-পাঞ্জাবীতে বাবু হয়ে, কাঁধে দুধসাদা চাদরখানা ফেলে, হাতে নিত্যসঙ্গী লাঠিটা নিয়ে বইমেলায় চলে এলাম গুটিগুটি পায়ে । অসংখ্য মানুষের পায়ের চাপে ধুলো উড়ছে বইমেলা প্রাঙ্গনের আকশে বাতাসে । বইয়ের স্টলগুলো যেন এক-একটা মৌচাক । মানুষের ভীড়ে ছয়লাপ হয়ে আছে প্রতিটি স্টল । বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে অগুনতি মানুষের সমবেত কলরব । সেইসাথে চলছে মাইকে রকমারি ঘোষণা । 

এদিক সেদিক দেখতে দেখতে হাঁটছি । একটা বিখ্যাত প্রকাশনার স্টলের কাছে যেতেই ভিড়ের ভেতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো একজন যুবাপুরুষ । এসে আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে একটি নতুন বই গুঁজে দিলো হাতে । আমি একদম হা-হয়ে গেছি । কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না ।

যুবাপুরুষটি হেসে বললো, আপনার আশীর্ব্বাদে এই বিখ্যাত প্রকাশনার দপ্তরেই একটি উচ্চপদের অধিকারী হয়েছি মাস্টারমশাই । সেইসাথে লেখালেখিও চালিয়ে যাচ্ছি । আজ আমার লেখা একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে আমাদেরই সংস্থা থেকে । তারই একটা কপি দিলাম গুরুদক্ষিণা হিসেবে । 

আমাকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার বললো, চিনতে পারছেন না ? আমি আপনাদের গ্রামের মদনমুদির সেই বখাটে ছেলে । বোধন । ওই যে আপনি যাকে জোর করে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন । যাকে রোজ ধরে এনে পড়াতেন যতদিন না ........। 

কোনো কথাই আর ঢুকছে না আমার কানে ।



।। বইমেলা – ২ ।।


আজ আবার বইমেলা শুরু হলো । চলবে পাঁচদিন । এই ক’দিন আমার মন খারাপের পালা চলবে । কেন ? তুমি নেই বলে । 

বিগত সাতটি বইমেলায় দুজনে মিলে খুব মজা করেছি । বুক ভরিয়েছি নতুন বইয়ের গন্ধে । খাবারের দোকানে হুল্লোড় করেছি বন্ধুদের সাথে । বন্ধুরা মিলে একটা চটি বই ছেপেছিলাম বছর তিনেক আগে । সেবারের বইমেলায় খুব হাঁকডাক করে বিক্রি করেছিলে সেই চটিবইগুলো । তোমার উৎসাহ দেখে আমরা খুব অবাক হয়ে গেছিলাম । 

আজ সকাল থেকেই তোমার চিরঘুমে শায়িত মুখটা দেখতে পাচ্ছি । গতবছর বইমেলার পরপরই মারণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলে । মাসছয়েকের মধ্যেই একলা করে দিয়ে চলে গেলে চির শান্তির দেশে । 

আজ আবার বইমেলা আবার শুরু হলো । কিন্তু তুমি অপেক্ষা করলে না । যেখানেই আছো সুখে থেকো । আচ্ছা, ওখানেও কি বইমেলা হচ্ছে ? হলে তোমারও নিশ্চয়ই মন খারাপের পালা চলছে ?



।। বইমেলা – ৩ ।। 


হতদরিদ্র জগাই বোস রোজই রকমারি চটিবই নিয়ে ফুটপাথে বসে । টুকটাক বিক্রি হয় । তাতেই কোনোমতে দিনগুজরান হয় । আগে বই ফিরি করতো লোকাল ট্রেনে । এখন পারে না । অভুক্ত – অর্ধভুক্ত শরীরে অত ঝামেলা পোষায় নাকি ? অগত্যা ফুটপাথে শতরঞ্জি বিছিয়ে চটিবই নিয়ে বসে পথচারীদের উদ্দেশ্যে হাঁকতে থাকে, বই নিয়ে যান বাবুরা । মাত্র দশ টাকা – দশ টাকা - দশ টাকা । 

আজও বসেছিলো । দুপুরবেলায় একদল লোক সামনে দিয়ে গাড়ী হাঁকিয়ে মাইক ফুঁকতে ফুঁকতে বলে গেল, বইমেলা – বইমেলা - বইমেলা । আজ শুরু হচ্ছে বিকেল চারটে থেকে । আসুন – দেখুন – আনন্দ করুন – নতুন নতুন বই কিনুন ।  

শুনেই জগাই বোসের চোখ দুটো চক্‌চক্‌ করে উঠলো । 

সন্ধ্যেবেলায় চটি বইয়ের ঝোলাটা কাঁধে ফেলে, শতরঞ্জি বগলদাবা করে এসে হাজির হলো মেলা প্রঙ্গনের গেটের সামনে । দেখেই রে-রে করে তেড়ে এলো ভলেন্টিয়ারেরা । জগাই বোস কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকগুলো তার কাঁধের ঝোলাটা টেনে নিয়ে রাস্তার পাশের হাইড্রেনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেল হাত ঝাড়তে ঝাড়তে । 

আজ সারাদিন পেটে দানাপানি পড়েনি বিক্রিবাট্টা হয়নি বলে । পেটের জ্বালার বড় বালাই । জগাই উপায়ান্তর না দেখে দুর্বল শরীরেই ঝাঁপিয়ে পড়লো হাইড্রেনের গহ্বরে । কোমর ডোবা কাদায় নেমে হাতড়াতে লাগলো তার সাতরাজার ধন সেই চটিবইয়ের ঝোলাটার সন্ধানে । সকাল হলেই আবার ফুটপাথে বসবে অক্ষত বইগুলো নিয়ে ।


।। বইমেলা – ৪ ।।


নৈহাটি বইমেলা থেকে কমিক্সের বইটা কিনতেই দিদি বইটা হাতে নিয়ে দেখতে চাইলো । কিছুতেই হাত দিতে দেবো না দিদিকে । দিদিও ছাড়বে না । সেই নিয়ে বেদম ঝগড়া বেঁধে গেল দিদির সাথে । দিদি রেগে গিয়ে শাসালো, একবার হাতে পাই, তারপর দেখিস । 

বিকেলে খেলতে যাবার সময় দিদির শাসানী ভুলে বইটা রেখে গেলাম পড়ার টেবিলে । ফিরে এসে বইটা আর পেলাম না সেখানে । কোথাও খুঁজে পেলাম না ! 

দিদি দেখে হাসতে হাসতেই বললো, হাজার খুঁজলেও বই পাবি না । লুকিয়ে ফেলেছি যাতে আর হাতে না-পাস ।

আমিও নাছোড় । কান্না জুড়ে দিলাম । মায়ের গঞ্জনা, বাবার ধমক খেয়ে দিদি একসময় কান্নায় ভেঙে পড়ে ঘোষণা করলো, আমি বেঁচে থাকতে বইটা কিছুতেই ওকে ধরতে দেবো না । 

দিন কয়েকের মধ্যে বইয়ের কথা ভুলেও গেলাম । 

এরপর বারো বছর অতিক্রান্ত হয়েছে । সবে গ্রাজুয়েশন করেছি । দিদিরও বিয়ের কথাবার্তা চলছে । এই সময়েই দিদি একদিন ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সবাইকে ছেড়ে চিরকালের জন্য চলে গেল । আমাদের সব চেষ্টা বিফল করে দিয়ে । 

আজ পুরনো একটা কমিক্সের বই খুঁজে পেলাম দিদির বিছানার তলা থেকে । বইয়ের পাতা নেড়েচেড়ে দেখে বুঝলাম,আগে কখনো পড়িনি । 



।। বইমেলা – ৫ ।।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই মা বললেন, আজ আর অফিসে যেতে হবে না তোকে । পাত্রপক্ষ দেখতে আসবেন । ওঁদের পছন্দ হয়ে গেলে সামনের মাসেই তোদের চারহাত এক করে দেবো ঠিক করেছি । 

নমিতা মুখ ভার করে জবাব দিলো, অফিসে যেতেই হবে । আর এক্ষুনি বিয়ে করবো না । যদি করি তাহলে আরও বছর দুয়েক বাদে । তার আগে কোনোমতেই না । সে তোমরা যতই চেষ্টা করো না কেন । 

তারপর আর একটাও কথা না বলে সেজেগুজে অফিসে চলে এলো । কিন্তু কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছে না । অগত্যা হাফ-ডে ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো অফিস থেকে । মনে পড়লো, গতকাল থেকেই বইমেলা শুরু হয়ে গেছে। সেখানেই গেলে হয় । 

রাস্তায় নেমে এদিক সেদিক করতে করতেই সন্ধ্যে হয়ে এলো । সন্ধ্যে হতেই সোজা চলে এলো বইমেলা প্রাঙ্গণে । সেখানে এসে বইয়ের স্টলেগুলো দেখতে দেখতে একটা স্টলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো । অনিন্দ্য না ! অনিন্দ্য তার প্রাণের বন্ধু সেই কলেজ জীবন থেকে । চাকরিবাকরি করে না । শুধু লেখালেখি করে । হয়তো ওরই কোনো নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে এই স্টলে ! 

এগিয়ে গিয়ে অনিন্দ্যর পিঠে হাত রাখলো । অনিন্দ্য তাকে দেখেই উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়লো, নমিতা তুই ? কতকাল পর দেখা হলো বলতো ? কোথায় ছিলি এতদিন ? 

তারপরই কাঁধের ঝোলা থেকে একটা নতুন বই বের করে নমিতার দিকে এগিয়ে ধরলো, আমার এই বইটা আজই প্রকাশিত হলো এঁদের প্রকাশনা থেকে । এই নে, ধর । 

নমিতা হাসিমুখে বইটা নিলো । বইয়ের নাম ‘ফিরে এসো’ । পাতা ওলটাতেই চোখে পড়লো, উৎসর্গ করেছে নমিতাকেই । চমকে উঠে সামনে তাকাতেই অনিন্দ্যর চশমার পুরু কাঁচে লেগে বুকস্টলের তীব্র আলো ছিটকে এসে ভরিয়ে দিলো নমিতার দু’চোখের তারা ।

সে আর সাতপাঁচ না ভেবে অনিন্দ্যকে সরাসরি বল বসলো, আমাকে বিয়ে করবি ? আজকেই ? 


।। বইমেলা - ৬ ।।

মেঝের একপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু পুরোনো বইপত্র । অনিমেষ উঠে গিয়ে সেখান থেকেই একটা গল্পের বই তুলে নিয়ে খুলে বসলো । বইয়ের প্রথম পাতায় চোখ পড়তেই চমকে গেল, বাবুনের নাম লেখা রয়েছে না ! তার মানে এটা বাবুনের বই ! এতদিন কোথায় ছিলো ?

দিদিকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো, পুরনো বইগুলো বের করেছে রোদে দেবে বলে । বাবুনের বই শুনেই দিদির দু’চোখ ছাপিয়ে জলের ধারা নামলো । বাবুন যে অকালেই চলে গেছে সকলের মায়া ত্যাগ করে । মাত্র সতেরো বছর বয়সে । 

অনিমেষ গল্পের বইয়ের ভেতরের একটা পাতায় এসে জোর ঝটকা খেলো । বইয়ের মাঝামাঝি জায়গায় একটা পাতার অর্ধেকটা ছেঁড়া । এই বইটাই তো কিনেছিলো বাবুনের সাথে খড়্গপুর বইমেলায় গিয়ে । খড়্গপুরের প্রথম বইমেলায় । 

আরও মনে পড়লো, বইটা আগে পড়বে বলে বাবুনের সাথে খুব ঝগড়াও করেছিলো সেদিন । ঝগড়াটা শেষমেশ মারামারিতে গিয়ে বর্তেছিলো । আর সেই মারামারির গুঁতোয় বইয়ের এই পাতাটাই তো ছিঁড়ে গেছিলো সেদিন ! 

দিদিও তাকিয়ে আছে খোলাপাতাটার দিকে । অনিমেষ চোখের জল মুছতে মুছতে বইটা এগিয়ে দিলো দিদির দিকে। 



।। বইমেলা - ৭ ।। 


দিব্য কল্যাণী বইমেলা থেকে কিনে নিলো তারই প্রিয় একজন লেখকের লেখা একটি উপন্যাস । পরদিন সকালে জলখাবার খেয়ে বইটা খুলে বসে কখন যেন আটকা পড়ে গেল গল্পের ফাঁদে । কোনোদিকেই আর ভ্রূক্ষেপ নেই তার । 

স্ত্রী প্রমীলা সকাল থেকেই রান্নার কাজে ব্যস্ত । গ্যাস ফুরিয়ে যেতে দিব্যকে ডেকে গলা তুলে বললো, এই যে শুনছো, রান্নার গ্যাস ফুরিয়ে গেছে । ভরা সিলিন্ডারটা লাগিয়ে দিয়ে যাও দিকি । 

দিব্য উপন্যাসের পাতায় মুখ গুঁজে রেখেই জবাব দিলো, এই আসছি । মুখে ‘আসছি’ বললেও, উপন্যাস ছেড়ে উঠে যাবার কোনো ইচ্ছাও দেখালো না । 

প্রমীলা তারপর আরও কতো কি বলে গেলো গলা তুলে । সেসবের একটা কথাও ঢুকলো না দিব্য’র কানে । প্রমীলা একসময় রাগ করে চলে এলো শোবার ঘরে । 

দিব্য উপন্যাসটা পড়ে শেষ করলো দুপুর দুটো নাগাদ । তারপর উপন্যাসটা গুছিয়ে তুলে রেখে দিয়ে স্নান করলো বেশ আয়েশ করে । স্নান করতে করতেই ভেবে নিলো, আজ আবার একটা বই কিনে আনবে বইমেলায় গিয়ে । 

ওদিকে প্রমীলা একদম চুপচাপ হয়ে গেছে । দিব্য স্নান সেরে সোজা খাওয়ার টেবিলে চলে এসেই চমকে উঠলো । খাওয়ার টেবিলটা যে একদম তকতকে পরিষ্কার হয়ে রয়েছে ! কি মনে করে শোবার ঘর উঁকি মেরে দেখলো, প্রমীলা ঘুমিয়ে আছে বিছানায় । মুখ দেখে মনে হচ্ছে, দুপুরের খাওয়ার পাট চুকিয়ে দিয়েছে অনেকক্ষণ আগেই ।


।। বইমেলা – ৮ ।।

ইদানিং বাবুনের পাল্লায় পড়ে টুবাইয়ের খুব সখ হয়েছে প্রেম করার । প্রাণের বন্ধু বাবুনই একটা উপায় বাতলে দিলো, কোনো একটা মেয়ের নাম-ঠিকানা জোগাড় করে তাকে একটা প্রেমপত্র লিখে পাঠিয়ে দে । 

টুবাই আজ বাবুনের সাথে উত্তরপাড়া বইমেলায় গিয়ে পুরোনো বইয়ের স্টল থেকে একটা পুরোনো গল্পের বই কিনলো । বইয়ের প্রথম পাতাটা ওলটাতেই একটি মেয়ের নাম এবং ঠিকানা পেয়ে গেল । ‘মৃন্ময়ী সেন, ৪৭-সাহেবপাড়া, বাগনান’ । 

দেখাতেই বাবুন তাকে উৎসাহ দিয়ে বললো, এই তো পেয়ে গেছিস তোর সেই কাঙ্ক্ষিত ঠিকানা । তাহলে দেরি না করে আজই একটা প্রেমপত্র লিখে পাঠিয়ে দে এই ঠিকানায় । 

টুবাই একটা প্রেমপত্র লিখলো বাসায় ফিরে এসেই । ‘প্রিয়তমা মৃণ্ময়ী......।’ চিঠিটা পরদিনই পোষ্ট করে দিলো সেই ঠিকানায় । 

দিন পঁচিশেকের মাথায় টুবাইয়ের নামে একটা চিঠি এলো মৃন্ময়ী সেনের তরফ থেকে । ‘সুপ্রিয় টুবাইবাবু, আমার মা মৃন্ময়ীদেবী আজ দশবছর হলো ইহলোক ত্যাগ করেছেন । বড্ড দেরী করে ফেলেছেন ভাই । আপনি নাহয় একেবারে ওপাড়ে গিয়েই আমার মায়ের সাথে......।


।। বইমেলা – ৯ ।।

বর্ধমান বইমেলায় এসেছি এক লেখক বন্ধুর আহ্বানে । বন্ধুটি কিছু গল্প লিখে পাঠিয়েছিলেন একটা বড় পত্রিকায় । তারই লেখা গল্পগুলো বইয়ের আকারে প্রকাশ পেয়েছে এবারের বইমেলায় । সংবাদটা পেয়েই আমাকে ডেকেছেন সেখানে । একটা বই উপহার দিতে চান । তবে শর্ত একটাই । আমি যেন বর্ধমান বইমেলার প্রথমদিনই গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করি । 

আমাদের বাড়ীর সকলেই খুব ভালোবাসি বই পড়তে । বিশেষ করে মা’কে একপ্রকার বইয়ের পোকাই বলা যেতো । তাই সুদূর হালিসহর থেকে ছুটে গেলাম শুধুমাত্র বইয়ের টানে ।

বইমেলায় গিয়ে দেখা করলাম বন্ধুটির সাথে । বন্ধু গল্পের বইয়ের একটা কপি আমার হাতে তুলে দিলেন । বই পেয়ে আনন্দে আপ্লুত হয়ে স্টলের অন্য বইগুলো হাতড়াতে শুরু করলাম দু’চোখ দিয়ে । 

হঠাৎ চোখদুটো আটকে গেল একটা বইয়ের ওপর এসে । মা তো এই বইটাই কিনে দিতে বলেছিলেন সেদিন ! কিন্তু অনেক খুঁজেও পাইনি কোথাও । আজ পেলাম । অথচ মা যে দু’মাস আগেই ইহলোক ত্যাগ করেছেন ।


।। বইমেলা - ১০ ।। 

এবারও জমিয়ে শীত পড়তে না পড়তেই বইমেলার আসর বসেছে কাঁকিনাড়ায় । বছর তিনেক আগেও আমি আর বিদিশা এসে জমিয়ে আড্ডা দিতাম এই বইমেলা প্রাঙ্গণে । তারপর ঘরে ফিরতাম শীতের কালো আকাশে ধূলোর ঝড় উড়িয়ে । বিদিশা আমাকে না জানিয়ে হঠাৎ করে কোথায় যেন চলে গেছে চাকরী নিয়ে । সেই যে চলে গেল, তারপর আর কোনো খোঁজই পাইনি তার । আমিও আর আসিনি বিগত তিনটি বইমেলায় । কার জন্যে আসবো ? যার জন্যে আসতাম, সে যে হারিয়ে গেছে জনারণ্যে । 

এবছর পায়ে পায়ে চলে এলাম বইমেলায় । আসলে অনেকদিন ধরেই একটা বই খুঁজছিলাম । কোথাও পাইনি । কাঁকিনাড়া বইমেলা শুরু হতেই কেন জানি না মনে হলো, বইটা এখানে পেলেও পেয়ে যেতে পারি । 

যাই হোক, কাঁকিনাড়া বইমেলায় এসে ঘুরতে ঘুরতে একটা স্টলে ঢুকে কাঙ্খিত বইটা চোখে পড়লো । খুব আনন্দ হলো দেখে । ভাগ্যিস এসেছিলাম । নইলে এই জীবনে বইটা হয়তো আর পাওয়াই হতো না । এসব ভাবতে ভাবতে স্টলে এসে বইটার দিকে হাত বাড়ালাম । কিন্তু একজন মহিলা ঝপ্‌ করে বইটা তুলে নিলেন আমার আগেই ! খুব রাগ হলো । সেই কবে থেকে খুঁজছি ! অথচ হাতে পাবার আগেই বেহাত হয়ে যাচ্ছে ! কিছুতেই মানতে পারছি না । 

রাগ চাপতে না পেরে মহিলাটিকে পাকড়াও করলাম, আচ্ছা মহিলা তো আপনি ! নেবো বলে হাত বাড়াতেই বইটা তুলে নিলেন ? 

মহিলা মুখ নিচু করে বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিলেন । শুনে চোখ তুলে তাকালেন । তাঁর মুখ দেখে বিস্ময় চেপে রাখতে পারলাম না, আরে ! বিদিশা না ?

বিদিশাও চমকে গেছে হঠাৎ করে আমাকে দেখে । সেও উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়লো, বিপুল তুমি ! তুমিও এসেছো বইমেলায় ! অবাক কাণ্ড । এতবছর পর এলাম আর তোমার সাথে দেখা হয়ে গেল ! 

- আমিও তো তাই । তোমার সাথে সেই যে এসেছিলাম, তারপর আর আসিনি । এবারই এলাম এই বইটার খোঁজে । 

- ছাড়ো ওসব কথা । এটা তুমিই কিনে নাও । তুমি নিলেই আমার কেনা হয়ে যাবে । হা হা হা । 

একটু থেমে দম নিয়ে বললো, এখনো কি সেই অফিসেই আছো ? নাকি অন্য কোথাও ? বিয়ে করেছো নিশ্চয়ই ? 

-এখানে দাঁড়িয়ে কথা না বলে চলো না কোনো খাবারের স্টলে গিয়ে বসি । বইয়ের দাম মিটিয়ে দিতে দিতেই বললাম । 

খাবারের স্টলে বসে বিদিশা জানালো, এখনো বিয়ে করে উঠতে পারেনি । আমারও সেই একই দশা । শুনেই বিদিশার চোখদুটো জ্বলে উঠতে দেখলাম । তাই দেখে সাহস করে বললাম, তোমার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে চলো না দুজনে মিলে বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়ি দিনক্ষণ দেখে । 

বিদিশা হাসতে হাসতেই বললো, ভারী মজা তো ! কাঁকিনাড়া বইমেলায় এসে তোমার তো লাভই হলো দেখছি । কাঙ্খিত বইয়ের সাথে কাঙ্খিত বউটিকেও পেয়ে যেতে চাইছো ?

0 comments: