3

ধারাবাহিক: সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক 

বানরায়ণ, পর্ব ২
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়



গ্রামের মাঝখানে আঙিনার তিন দিকে জমায়েত হয়েছিলাম আমরা গ্রামবাসীরা। অন্য দিকটায় কয়েকটা গাছের গুঁড়ি জড়ো করে একটা উঁচু মঞ্চের মতন বানানো হয়েছিলো। সেটাকে ঘিরে বর্শা হাতে দাঁড়িয়েছিলো জনা বিশেক কিষ্কিন্ধার যোদ্ধা। পাথরে কোঁদাই শরীর। ভাবলেশহীন পাথুরে মুখ।

বাঘটাকে মাংস দিয়েছিলো ওরা বিষ মিশিয়ে। সেটা খেয়ে আমাদের চোখের সামনে ছটফট করতে করতে মরে গেলো অত বড় হিংস্র পশুটা। তারপর তার শরীর থেকে অসাধারণ নিপুণতার সঙ্গে ছাড়িয়ে নিলো চামড়াটা। বললো, ওটা রাজার জন্য উপহার নিয়ে যাবে। তারপর ওরা আমাদের সঙ্গে চলে এলো আমাদের গ্রামে।

সর্দার প্রথমটা ভয় পেয়েছিলো। এইরকম মানুষ সর্দারও দেখেনি কোনওদিন। কেউ জানতো না যে আমরা কিষ্কিন্ধা বলে কোনও রাজ্যের প্রজা। জানার প্রয়োজনই হয়নি কখনও। সর্দার প্রথমে ভেবেছিলো, এরা আমাদের গ্রাম লুট করতে এসেছে। সঙ্গে নিয়ে আসার জন্য আলাদা করে মোহক, পাহান, চিরুদের নিজের ঘরে ডেকে চাপা গলায় বকতে শুরু করেছিলো। কিন্তু ঠাকুর্দা থামালো তাকে। কি যেন বললো সর্দারের কানে কানে। সর্দার একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তার দিকে কিছুক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে মাথা নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।

সত্যি কথা বলতে, ভয় খানিকটা আমাদেরও করেছিলো। সঙ্গে করে এদের গ্রামে নিয়ে না এসে উপায় ছিলো না। বাঘটার চামড়া ছাড়ানো হয়ে যাওয়ার পর দলপতি তার অলঙ্ঘ্য স্বরে যখন বললো, ‘‘এবার চলো, তোমাদের গ্রামে যাবো।’’ তখন একে অপরের দিকে তাকানো আর তারপর সম্মতিসূচক মাথা নাড়া ছাড়া আমাদের আর কিছু করার কথা মনে হয়নি।

আসার পথে ওদের কয়েকজন একটু গল্প করার চেষ্টা করছিলো আমাদের সঙ্গে। ঠাট্টা-মশকরা করছিলো। জিজ্ঞেস করছিলো, এত লোকের আতিথেয়তা আমরা করতে পারবো কি না। সে বিষয়ে আমাদেরও একটু সন্দেহ ছিলো। একশোজন তাগড়াই জোয়ান লোকের খোরাক প্রায় আমাদের পুরো গাঁয়ের একদিনের খোরাকের সমান। এত তাড়াতাড়ি অত খাবার জোগাড় করা যাবে কি?

কিন্তু গাঁয়ে পৌঁছে বুঝলাম, ওই নিয়ে চিন্তা করার কোনও কারণ ছিলো না। এদের প্রত্যেকের পিঠে ঝোলানো চামড়ার বস্তাগুলোর মধ্যে যার যার নিজের দু’দিনের খাবার রসদ আছে। ছোলা, গুড়, চিঁড়ে থেকে আরম্ভ করে ফল আর শুকনো মাংস অবধি। গ্রামের মাঝের বিস্তীর্ণ উঠোনের উপর সুসংবদ্ধ হয়ে বসে খেতে আরম্ভ করলো ওরা। ততক্ষণে সর্দারের সঙ্গে ওদের দলপতির প্রাথমিক কথাবার্তা হয়ে গেছে। সর্দার আমাদের অভিযানের দলের লোকেদের ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বকা শুরু করেছে। ঠাকুর্দা যে তার কানে কানে কি বলে তাকে থামালো, সেটা আমরা কেউ বুঝলাম না।

ওদের ততক্ষণে খাওয়া হয়ে গেছে। সবাই উঠে সার বেঁধে বর্শা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। যাদের হাতে ওই কুড়ুল আর বড় বড় ভারি অস্ত্রগুলো ছিলো, তাদের কয়েকজন দেখলাম এক কোনে আমাদের জ্বালানির জন্য কেটে রাখা গাছের গুঁড়িগুলোর কয়েকটাকে ধরাধরি করে এনে আঙিনার মাঝখানে উঁচু মতন মঞ্চটা বানিয়ে ফেললো। তারপর পাঁচজন পাঁচজন করে চারপাশ থেকে মঞ্চটা ঘিরে দাঁড়ালো। বাকিরা সার বেঁধে পিছনে। দলপতি ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ালো মঞ্চটার উপর। ধীর গম্ভীর স্বরে কথা বলতে আরম্ভ করলো।

‘‘তাম্বলি গ্রামের অধিবাসীরা, আমি আপনাদের সবাইকে অনুরোধ করছি এখানে আসতে, আমার কথা শুনতে। আমি শপথ করে বলতে পারি, এমন কথা আপনারা কেউ কোনওদিন শোনেননি। শুধু আপনারা নন, সমগ্র বিন্ধ্যপর্বতের কোনও অধিবাসী কোনওদিন শোনেনি এমন কথা।’’

কয়েক মুহুর্তের মধ্যে গ্রামের ছেলে-বুড়ো-মেয়ে-মদ্দ সবাই জড়ো হয়ে গেলো আঙিনায়। এমনিতেই এমন মানুষ কেউ দেখেনি কখনও। তার মধ্যে কিষ্কিন্ধা আর তার রাজা সুগ্রীবের কথাটা ছড়িয়ে পড়েছে গাঁয়ের মুখে মুখে, কানে কানে। আমরা নাকি সেই মহান রাজার প্রজা। আশপাশের আরও যে পাঁচদশটা গ্রামের মানুষের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে, তারা কেউ তো কোনওদিন বলেনি এমন কোনও রাজ্যের কথা, রাজার কথা!

‘‘আমি মহান কিষ্কিন্ধা রাজ্যের মহাশক্তিধর কল্যানময় রাজা পরমভট্টারক সুগ্রীবের একজন সেনাধ্যক্ষ। আমার নাম সম্বর্ত। মহারাজ সুগ্রীব ও তাঁর পরম মিত্র অযোধ্যার যুবরাজ মহাবীর রামচন্দ্রের হয়ে আমি আপনাদের সবাইকে আহ্বান জানাতে এসেছি এক এমন অভিযানে, যাতে অংশগ্রহণ করলে আপনারা প্রত্যেকে লাভ করবেন অসামান্য শৌর্যবীর্য, অফুরন্ত ধনরত্ন এবং চিরঅমরত্ব।’’

সম্বর্তের বাচনভঙ্গী বেশ আকর্ষণীয়। এই অবধি বলে সে খানিকক্ষণ থামলো। কথাগুলো সমবেত জনতার হৃদয়ঙ্গম হতে একটু সময় দিলো। তারপর আবার শুরু করলো...

‘‘আপনারা বোধহয় কেউ অযোধ্যার নাম শোনেননি। এই বিন্ধ্যপর্বতের উত্তরে বহু দূরে সমৃদ্ধ উত্তরকোশল দেশ। সেই দেশের রাজধানী অযোধ্যা। সেখানকার যুবরাজ মহাবীর রামচন্দ্র, যাঁর বীরত্বের গৌরব সমগ্র আর্যাবর্ত তথা দাক্ষিণাত্যে প্রসিদ্ধ, সেই রামচন্দ্র পিতৃসত্য পালনের তাড়নায় যখন স্ত্রী সীতাদেবী ও ভাই লক্ষ্মণের সঙ্গে বনবাস করছিলেন, সেই সময় লঙ্কার অত্যাচারী রাজা রাবণ বলপূর্বক সীতাকে হরণ করেন।’’

আবার কিছুক্ষণের নৈঃশব্দ। লঙ্কা, রাবণ, সবগুলো নামই যে আমাদের কাছে অপরিচিত, সেটা সম্ভবত আমাদের হতভম্ব মুখগুলো দেখেই সম্বর্ত বুঝতে পারছিলো। তার মুখে খানিকটা বিরক্তি আর অনেকখানি অনুকম্পা মেশানো একটা হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেলো। গলাটা পরিস্কার করে নিয়ে সে আবার বলতে শুরু করলো...

‘‘তোমাদের গ্রামের পরে যে জঙ্গল শুরু হচ্ছে, সেই জঙ্গলের পর বহু যোজন পেরিয়ে যেখানে মাটি শেষ, সেইখান থেকে শুরু হয় সমুদ্র... অথৈ জলের পারাবার।’’ সম্বর্তের সম্বোধনে ‘‘আপনি’’টা বেশ সাবলীল ভাবেই ‘‘তুমি’’ হয়ে গেলো। ‘‘সেই পারাবারের মাঝে রাক্ষসরাজ রাবণের সোনার দ্বীপ লঙ্কা। সেখানে পথে ঘাটে সোনা-রূপা-মনি-মুক্তার ছড়াছড়ি। কিন্তু সে দ্বীপের পাপের বোঝা পূর্ণ হয়েছে। আজ বহু বছর যাবত রাবণ তার অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে আর্যাবর্ত ও দাক্ষিণাত্যের দেশগুলির উপর। কত রমণীর সর্বনাশ যে সেই কামুক করেছে, কত নির্দোষ, শান্তিপ্রিয় রাজাকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করেছে, তার সীমা-পরিসীমা নেই। কিন্তু এইবার তার আর নিস্তার নেই। অতিদর্পী রাবণ জানে না, সে যাকে হরণ করেছে, সেই সীতাদেবী স্বয়ং জগজ্জননী স্বরূপা। তিনি ত্রিভুবনের প্রভু শ্রীরামচন্দ্রের স্ত্রী, যাঁর নেতৃত্বে কিষ্কিন্ধার দুর্মদ বাহিনী সমুদ্রের অন্তহীন ঢেউয়ের মতনই গিয়ে আছড়ে পড়বে লঙ্কার উপকূলে। ছারখার করে দেবে রাবণের অতি সাধের স্বর্ণলঙ্কাকে।’’

দম নেওয়ার জন্য একটু থামলো সম্বর্ত। তার সাবলীল বাচনভঙ্গী থেকে বোঝা যাচ্ছিলো যে সে এই বক্তৃতাটা দিতে অভ্যস্ত। কিন্তু ঠিক কি বলতে চাইছিলো, সেটা তখনও অবধি পরিস্কার বোঝা যাচ্ছিলো না। কিছু একটা অভিযানে অংশগ্রহণের কথা বলছিলো। সেটা কি? সম্বর্তের কথার মাঝখানেই আমি একবার সর্দারের আর একবার ঠাকুর্দার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। সর্দারের মুখে স্পষ্ট অস্বস্তি আর দুশ্চিন্তার ছাপ। কিন্তু ঠাকুর্দার মুখে কেমন একটা অদ্ভূত তদ্গত, আবিষ্ট ভাব। যখন স্বপ্ন হয়, তখন এই রকম একটা ভাব হয় ঠাকুর্দার। সেই স্বপ্নের ভিতর ঠাকুর্দা এমন সব ঘটনা দেখতে পায়, যেগুলো...

‘‘কুমারিকার উপকূলে শুরু হয়েছে সেতুবন্ধনের কাজ।’’ সম্বর্তের কন্ঠস্বরে আমার চিন্তার সূত্রটা কেটে গেলো। ‘‘স্বয়ং দেবকারিগর বিশ্বকর্মার দুই যমজ পুত্র নল ও নীলের তত্ত্বাবধানে তৈরি হচ্ছে সেই সেতু, যা সাগর পেরিয়ে সুগম করে দেবে কিষ্কিন্ধাবাহিনীর লঙ্কা আক্রমণের পথ। দাক্ষিণাত্যের সব রাজ্য, সব গ্রাম থেকে হাজারে হাজারে তরুণ, যুবকরা গিয়ে যোগদান করছে সেই সুমহান কর্মযজ্ঞে।’’ 

সমবেত গ্রামবাসীর মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে তাদের মনোভাব বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করলো সম্বর্ত। ‘‘প্রভু শ্রীরামচন্দ্র এবং মহারাজ সুগ্রীবের পক্ষ থেকে আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি... এসো, কিষ্কিন্ধার অপরাজেয় বাহিনীতে যোগদান করে দুর্বিনীত, অহঙ্কারী, অত্যাচারী রাবণ ও তার রাক্ষসসেনাকে ধ্বংস করো... এবং সেই সঙ্গে লাভ করো অমর কীর্তি ও অতুল সম্পদ।’’

একটু বিরতি। তারপর আবার বক্তৃতা। ‘‘আবার বলছি... নিজের নাম ও কীর্তিকে অমর করে রেখে যাওয়ার এমন সুযোগ বারবার আসে না জীবনে। আমি নিশ্চিত, সাহসে বা বীরত্বে তাম্বলি গ্রামের তরুনরা কারও চেয়ে কম নয়। বরং বহুদিনের অভিজ্ঞতায় তোমাদের দেখে আমার মনে হয়েছে, তোমরা এই অঞ্চলের অন্যান্য গ্রামবাসীদের থেকে আলাদা। তোমাদের মধ্যে যাদের সঙ্গে আমাদের ওই পাহাড়ের উপর দেখা হয়েছিলো, তাদের সাহস আর ঠাণ্ডা মাথা রীতিমতন প্রশংসনীয়। তোমাদের মতন সাহসী অথচ স্থিতধী লোকেরই প্রয়োজন যুদ্ধে সব থেকে বেশি।’’

সম্বর্তের শহুরে ভাষা সবটা খুব ভালো না বুঝলেও অন্তত এটুকু বুঝতে পারছিলাম যে লোকটা আমাদের প্রশংসা করছে। ততক্ষণে সে আসল কথায় এসে গেছে। ‘‘এখান থেকে যোজন তিনেক দূরে, ওই যে পাহাড়ের গায়ে তোমরা ফাঁদ পেতেছিলে, সেই পাহাড়ের ওপাশে আমাদের অস্থায়ী শিবির। সেখানে চলছে সৈন্যনিয়োগের কাজ। কিষ্কিন্ধার অন্যতম প্রধান সেনানায়ক গবাক্ষ সেখানে স্বয়ং নিয়োগ করছেন নতুন যোদ্ধাদের, তত্ত্বাবধান করছেন তাদের প্রশিক্ষণের। তোমরা যারা সত্যিকারের সাহসী, বীর, যারা এই ক্ষুদ্র গ্রামের গণ্ডী অতিক্রম করে বাইরের বিশাল বিশ্বটাকে দেখতে চাও, উপভোগ করতে চাও এই বীরভোগ্যা বসুন্ধরাকে, তারা এসো। যোগদান করো কিষ্কিন্ধার রাজকীয় বাহিনীতে। এক অত্যুজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে আছে তোমাদের জন্য।’’

বক্তব্য শেষ করে সম্বর্ত ধীর পদক্ষেপে নেমে গেলো অস্থায়ী মঞ্চটার উপর থেকে। রেখে গেলো উদ্বেগ, উত্তেজনা, চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা আর আকাশচুম্বী উচ্চাশায় উদ্বেল কিছু তরুণকে। সে রাতে তাদের কারও দু’চোখ এক মুহুর্তের জন্যও এক হলোনা। 

গণ্ডগোলটা শুরু হলো পরের দিন সকালে, সম্বর্ত আর তার দল চলে যাওয়ার পর।

3 comments:

  1. golpo dana badhcjey....uttyejona barchey.....khub shundor

    ReplyDelete
  2. জমে উঠেছে বেশ !! আর সেই সঙ্গে বাড়ছে পরের কিস্তি পড়ার আগ্রহ !!

    ReplyDelete