ব্যক্তিগত গদ্য: বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
Posted in ব্যক্তিগত গদ্য
ব্যক্তিগত গদ্য
বই-রাগী বৃত্তান্ত
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
ঋতবাক-এর মাননীয়া সম্পাদিকা পইপই করে বলে দিয়েছেন, বই নিয়ে কিছু লিখতে। কারণ সামনে বইমেলা, বই নিয়ে হৈচৈ উন্মাদনা। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। কিন্তু আমার নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে একটাই আশঙ্কা কি যে লিখি, কিছুই তো কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছিনা। ভুল মানুষকে ওঁরা দায়িত্ব দিয়েছেন, এসব নিয়ে গুল মারার। বই আর আমি – অহি নকুল সম্পর্ক আমাদের।
পুরোপুরি বই-রাগী মানুষ আমি। বই নিয়ে কি লিখি বলুন তো ? বন্ধু সুস্মিতার কথা শুনে তখন থেকে মাথায় চেপে আছে একবস্তা রাগ। এত সস্তা নয় সে রাগ জল ঢেলে নেভানো যাবে। দুঃসাধ্য জেনেও বাধ্য হয়ে কলম আর কাগজের শ্রাদ্ধ করার জন্য বসেছি। বুঝতে পারছি হাজার চেষ্টা করেও আজ আর কিছু হবে না। মগজ তো অচল। স্থিতিজাড্য নিয়ে বসে আছে। আজ বলতেই হবে, আর পারলাম না বই নিয়ে ওইসব খই বাছতে, শিবের গান গাইতে। চিরকাল মিতবাক আমি । ঋতবাক-এর জন্য কি আর লিখব ।
হ্যাঁ, বই। বই এর সাথে আমার বরাবরের বিবাদ। এই বৈরিতার সুত্রপাত তো সেই ছোটবেলায়। মা একটার পর একটা বর্ণপরিচয় কিনে আনতেন। আর আমি কত অবলীলায় সেগুলো ফরফর করে ছিঁড়ে ফেলতাম। হাওয়ায় উড়ত বই-এর পাতা। ঠিক যেন ঘুড়ি উড়ছে আকাশে। সেই নীল আকাশের কাগজ দিগন্তে মনও উড়ে যেত – কি মজা কি মজা আর পড়তে হবে না। ভাবতাম – মা একদিন বলবেনই, আর তোকে বই কিনে দিতে পারবনি বাপু, তা তোর সাতজন্মে লেখাপড়া হোক বা না হোক। না, মা কোনদিন সেকথা বলেননি। বরং ধৈর্য হারিয়ে একদিন মা কে বলেছিলাম – আমার জন্য বই কিনতে কিনতে একদিন তো সব পয়সাই শেষ হয়ে যাবে ।
বই কিনে কেউ কোনদিন দেওলিয়া হয়না ... কথাটা মিলিয়ে নিস বড় হয়ে।
পড়া মানেই তখন ছিল দাদুর কাছে কানমলা। পড়া মানেই এক বন্দিশালা। সেই বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিত আকাশ। স্বপ্ন দেখাত চিল আর চড়ুইয়ের ডানা। নামতার খাতা নৌকো হয়ে নেমে আসত বর্ষার রাস্তায়। পড়ার বইখাতাগুলো এভাবেই ভালবাসার মানচিত্র হয়ে যেত।
বাবার বৈঠকখানায় ঢুকে দেখতাম বইএর পাহাড়। বুঝতাম নিস্তার নেই এই জগত থেকে। বই আর পত্রিকার পাতা গুলো কাঁচি দিয়ে কুচি কুচি করে কেটে ফেলতাম। যেন প্রতিজ্ঞাই করে ফেলেছিলাম পৃথিবী থেকে সব বই নিশ্চিহ্ন করে দেব। তাহলে কেউ আর আমায় পড়তে বলবে না। উইপোকাদের বন্ধু হয়ে উঠতে চাইতাম মনেপ্রাণে ।
ভুখা মানুষ বই ধরো ওটা তোমার হাতিয়ার – কথাটা খুব শুনতাম। কিন্তু বুঝতে পারতাম না, বই নিয়ে কীভাবে যুদ্ধ হয় ? কীভাবে সংগ্রামের অস্ত্রাগার হয়ে উঠতে পারে কালির বর্ণমালা । অক্ষরের ভেতর কি বারুদ থাকে ? কীভাবেই বা সেই বারুদ থেকে একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গের সূচনা বিন্দু তৈরি হয় ? প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে উঠত মন। এত প্রশ্নের উত্তর কোথায় থাকে ? – বই। বইকে বাদ দিলে সমাজ আর জঙ্গলের মধ্যে কোন দূরত্ব থাকেনা। এসব জেনেছি অনেক পরে। তার আগে অনুভব করে নিয়েছি দেশ আর জাতি সীমান্তের বেড়া টপকে নিজেদের অনুভব বিনিময়ের সেরা মাধ্যম এই অক্ষরদুনিয়া। যা বিচ্ছিন্নভাবনা বা বিবাদমানতায় খণ্ডিত নয়। চারপাশের এই অস্থিরতা, ব্যক্তিগত অহংকারের আস্ফালন থেকে মুক্তির আশ্রয়। সাদা পাতার মাঝে লাইনে লাইনে বাক্যের ভাঁজে যে ইশারা যা সৃজনতৃষায় সক্রিয় করে তোলে অনুভবী মন। এই আনন্দ শিহরণ কোন ভাষা মাটি দিয়ে নির্মাণসফলতা লাভ করবে ?
বইমেলা দেখি। বইসয়িক মানুষের বই ভাবনা। বই চিত্রের আনন্দনিকেতন। শিশুরাও আসে। কত বাচ্চা তাদের মায়ের হাত ধরে বইমেলায় আসে। মুখে নির্মল হাসি। এই ছবিগুলোর মধ্যে নিজেকে খুঁজে চলি অবিরাম। দেখতে পাইনা। আমার মা আমাকে কখনও হাত ধরে বইমেলায় নিয়ে যাননি। কিন্তু বইএর যে মেলা, তার প্রবেশদ্বারের চাবিটি আমার হাতে তুলে দিয়েছিল কোনদিন। আমি সযত্নে তা রেখেছি।
বইএর গন্ধ আজও আমাকে তাড়া করে। যেখানে যা বই পাই কিনি। সংগ্রহ করি। ঐতিহ্যবিচ্যুত নতুন ভাবনার কোন গ্রন্থ পেলেই অস্থিরতা তৈরি হয়। মনে হয় এখনই হাতের মাঝে তুলে নিই তাকে। অনেক সময় তা সম্ভব হয়েও ওঠে না। তখন ভীষণ বিরক্ত লাগে। বুঝতে পারি রাগটা এখনও তীব্র। অনুরাগ।
0 comments: