0

ছোটগল্প: তাপসকিরণ রায়

Posted in


ছোটগল্প


রমাকান্ত নামা-চুম্বকীয় কথা 
তাপসকিরণ রায়



একলা থাকলে এই হয়। চিন্তা জগৎ বিস্তৃত হতে থাকে। রমাকান্তরও তাই হয়েছে। চিন্তা ভাবনার রাজ্য তাঁকে ঘিরে থাকে। তিনি ভাবছিলেন পৃথিবীর আকর্ষণের কথা। নিউটন আবিষ্কার করলেন পৃথিবীর গুরুত্ব আকর্ষণের কথা। আপেল বোঁটা ছিঁড়ে আকাশের দিকে উঠে যায় নি--মাটিতে এসে পড়েছে। মাটি বড় খাঁটি গো ! কথাটা কে না জানে ? এখান থেকেই বীজের উদ্ভাবন, এখান থেকেই অংকুর উদ্গম, এখান থেকেই জীবনের শুরু। 

এবার শুরুর পরের কথা। শৈশবের কথা, এ কাল তো তখনও মাটি ও মাকে ছুঁয়ে থাকে। পৃথিবীর সব কিছুই তখন তার কাছে নতুন। এই অপার আকাশ, বন-বনানী, নদী-সাগর, বৃষ্টি ঝরার দিন, ফুলের সমারোহ, আপন জনের স্নেহ ভালবাসা, এ সব নিয়েই কেটে যায় শৈশব। আর সম বয়সের বন্ধুদের নিয়ে খেলে বেড়ানোর দিনগুলি তো কোন দিনও ভোলার নয়। 

রমাকান্ত যখন কৈশোরে পা দিয়েছন, হুল্লোড় বাজী তখন অনেকটা কমে গেছে। সুন্দরের দিকে তাকিয়ে থাকা বুঝি তার কাজ। সুন্দর, সুন্দর, চারদিক কত না সুন্দর ! বয়সটাই যে এমনি ! রমাকান্ত আর সবার মত কৈশোরের রঙ্গিন চশমায় ঘুরে বেড়ান, আর ঠিক জীবনের এই সময়টাতেই দেখা হয়ে গিয়েছিল পাখিদির সাথে। বস্তুত এই পাখিদিটাই তাঁকে পাকিয়ে দিয়েছিল। কৈশোরের ডাঁসা রমাকান্ত কৈশোরেই পেকে গিয়ে ছিলেন। কারণ ওই পাখিদির পাল্লায় পড়েই রমাকান্তর স্বাভাবিক জীবনের ব্যাঘাত ঘটেছিল। যৌবনের দৃষ্টি তাড়াতাড়ি পাল্টে গিয়েছিল। যেমনটা সবার হয়, তার চাইতে একটু বেশী। পাখিদি ধরা ছোঁয়ার আনন্দটুকু আগে ভাগেই জানিয়ে দিয়ে ছিল। রমাকান্তর মাঝে আকর্ষণ জন্ম নিচ্ছিল, পাখিদির প্রতি, অন্য মেয়েদের প্রতি। এই আকর্ষণই তো জীবনকে টেনে নেয়--সামনের দিকে বেড়ে যাবার, অভিজ্ঞতার দিকে এগিয়ে যাবার। ফুল তাকে টানে, আকাশ তাকে ডাকে, মেঘ পাহাড়ের ইশারায় তাকে ছুটে যেতে হয়, সুদূরের সীমানায় !

এক তো প্রকৃতির মোহ, মানুষকে মুগ্ধ করে, তারপর নারী, সে তো জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। নারী ছাড়া জীবন ভাবা যায় না। আবার পুরুষ ছাড়া নারীর অবস্থানের কথাও চিন্তা করা যায় না। শুধু নারী বা শুধু পুরুষ, অপূর্ণ সমষ্টি মাত্র, যাকে বলে অর্ধাঙ্গ। পৃথিবীর সেই কেন্দ্রীভূত টানের মতই যেন এ টান--উভয়ে উভয়কে জানতে অজান্তে আকর্ষণ করেই চলেছে। বেঁচে থাকার মর্ম ব্যথাও তো এখানেই আটকে আছে গো ! যতদিন বেঁচে থাকা ততদিন তুমি আকাশের সঙ্গে মিশে যেতে পার না--মাটির শিকড়টানে তোমায় পড়ে থাকতে হয়। পৃথিবীর সমস্ত বস্তুই নাকি পরস্পর পরস্পরের প্রতি আকর্ষিত থাকে। এ ব্যাপাটা কিন্তু নারী পুরুষের মাঝে আরও বেশী। 

শুরুতে ফুল খুব ভালো লাগত রমাকান্তর। তারপর কল্পনাকে--কল্পনা ছিল তাঁর ছোট বেলার সাথী। বুঝ হবার পর থেকেই পাশের বাড়ির ওর সঙ্গে তাঁর ভাব। বন্ধু যাকে বলে। আকাশ দেখা, ফুল দেখা, ক্রমশ কমে যাচ্ছিল রমাকান্তর। তার বদলে মেয়েদের চোখে পড়ত বেশী। তাদের সাথে কথা বলতে, খেলা করতে ভালো লাগত তাঁর। কল্পনা একদিন বলে ছিল, রমাকান্ত দা, তুমি অনেক বড় হয়ে গেছ !

-কি করে জানলি ? রমাকান্ত প্রশ্ন করেছিল। 

-এই যে তুমি কত বড় আর লম্বা হয়ে গেছ ! তোমার গোঁফ দাড়ি গজিয়ে গেছে, কল্পনা বলেছিল। 

হেসে ছিলেন রমাকান্ত, তা ঠিক শরীর লমলম করে তার বেড়ে উঠেছে ঠিক ! আর কল্পনা ? রমাকান্ত বলেছিলেন, তোরও তো চেহারা কেমন লাল টুকটুকে হয়ে উঠেছে ! 

-ধ্যাত--তুমি না আজকাল যাতা কথা বল--কল্পনা ঈষৎ হেসে বলেছিল। 

ওই সময় থেকেই রমাকান্ত ঠোঁট কাটা হয়ে গিয়েছিলেন--হরবোলার মত তার মুখে কথা ফুটে ছিল। তবে সে সব সেয়ানা কথা। তিনি বুঝতে পারতেন যে এ জন্যে ওই পাখিদিই দায়ী। সেই তাঁকে পাকিয়ে দিয়েছিল। 

-ঠিক বলছি রে কল্পনা, শাড়ি পরা শুরু কর তুই ! শাড়িতে তোকে কিন্তু খুব মানাবে। 

-সত্যি বলছ ? তোমার ভালো লাগবে ? আগ্রহ নিয়ে বলে উঠেছিল কল্পনা। 

রমাকান্ত বলেছিলেন, আমার কেন ? সত্যর ভালো লাগবে--ও তো তোর পিছনে ঘুর ঘুর করে-

-আমার ভালো লাগে না, ওকে তুমি মানা করে দিও--

-কেন--ওকে ভালো লাগে না তোর ?

-না, বলে সে দিন চুপ করে গিয়েছিল কল্পনা। রমাকান্ত আরও একটু বাজাতে চাইছিলেন কল্পনাকে, কে বল, তবে বল কাকে তোর ভালো লাগে ?

কল্পনা চুপ করে গিয়েছিল, খানিক পরে বলে ছিল, আমি যাকে চাই জানি না সে আমায় চায় কি না ! কথাকটি বলে সেদিন কল্পনা আর সেখানে দাঁড়ায় নি। 

ভালবাসা কাকে বলে ? প্রশ্নটা মনে ওঠে, কিন্তু এ নিয়ে তোলপাড় করার সময় কোথায় রমাকান্তর ? পাখিদি, কালো, ধ্যাবড়া, বয়সে রমাকান্তর চে চোদ্দ পনের বছর বয়সের বড়। তবু তার চেহারায় কোথাও যেন লাবণ্য ছিল, শরীরে তেলতেলে একটা ভাব ছিল, হাসির মাঝে সুন্দর চোখ ফেড়ে তাকানোর ধার ছিল, অন্তত রমাকান্তর তাই মনে হত।

এটাই বড় কথা ছিল যে রমাকান্ত চরিত্র হারান নি। চরিত্র হারাবার সময় সুযোগ অঢেল থাকা সত্ত্বেও পাখিদির হাত থেকে তিনি বাঁচতে পেরেছেন। অবশ্য বলতে গেলে বলতে হয়, পুরুষের চরিত্র বলে কিছু নেই। নারী সঙ্গ না হলেই কি চরিত্রবান বলা যাবে পুরুষকে ? তবে চরিত্রবান আর চরিত্রহীনের মাঝে কিন্তু এক পা রাস্তাই বাকি থেকে যায়। আবার একটা মেয়ে অনায়াসে তার ছলা কলায় একটা ছেলেকে চরিত্রহীন বানিয়ে দিতে পারে। এ ভাবে নাকি জীবন ভরের ধরে রাখা চরিত্রের বাঁধও যখন তখন ভেঙে যেতে পারে। রমাকান্ত ব্যাপারটাকে অমূলক বলে মনে করেন না। 

ওই পাখিদির আদর সোহাগ রমাকান্ত অনেক পেয়েছেন। সেই যাকে বলে স্ত্রী আর পুরুষের খেলা। তবে রমাকান্ত দেখেছেন, পাখিদির মাঝেও নিজেকে বাঁচাবার একটা তাড়না ভেতরে ভেতরে কাজ করে যেত। রমাকান্ত তাই হয় তো পাখিদির অসৎ সঙ্গত পান নি। 

তখন একাধিক নায়িকার আনাগোনা ঘরে। ঘন ঘন পাখিদি আর কল্পনা ঘরে আসত। কল্পনা পাখিদির ওপরে রাগ করে রমাকান্তকে বলত, পাখি দিকে তুমি এতটা প্রশ্রয় দেও কেন ?

হাসতেন রমাকান্ত, কেমন দাঁত খোলা হাসি। তাঁর প্রগলভ ভাব কল্পনার ভাল লাগত না, বলত, পাখিদি তোমার ঘরে এত আসে কেন বল তো ?

-বাবা: ! তুই আমার ওপর--

-হ্যাঁ, করতে পারি না কি আমি ? অভিমানিনী কল্পনা বলে ছিল। 

রমাকান্ত অবাক হয়ে ছিলেন কল্পনার কথায়। তবে কি কল্পনা তাঁকে—তিনি বলে উঠেছিলেন, তুই তো আমার বন্ধু রে ! তুই--

কল্পনা উতলা হয়েছিল, হ্যাঁ, শুরুতে বন্ধুত্বই হয়, ভাল লাগা আসে তারপর--

রমাকান্ত মাঝখানে বলে উঠে ছিলেন, তারপর--?

-তারপর ভালবাসা আসে—কল্পনা বলেছিল। 

থমকে গিয়েছিলেন রমাকান্ত। কল্পনাকে অন্য ভাবে কখনো তিনি দেখেন নি। ছোট বেলা থেকে সে তাঁর সাথী, খেলার সুখ-দুঃখের ঝগড়ার--সে ছিল জীবনের একমাত্র সাথী। কিন্তু ভালবাসার কথা তো কখনো রমাকান্তর মনে আসে নি !

-রমাকান্ত দা চুপ থেকো না তুমি, কিছু তো বল, ব্যগ্র হয়ে বলে ছিল কল্পনা। 

-তুই তো আমার বন্ধু রে--তোকে--

-না আমি তোমায় ভালোবাসি--তুমি কি আমায়—আহত হয়ে বলে উঠেছিল কল্পনা। 

--তুই আমার বন্ধু রে--ভালবাসার কথা তোকে নিয়ে কখনো ভাবি নি—রমাকান্ত নিজের কথা প্রকাশ করতে চেয়ে ছিলেন। 

কল্পনা চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, ওর চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসছিল। ও দ্রুতপদে সে দিন রমাকান্তর ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে ছিল।

রমাকান্ত অনেক ভেবেছেন কল্পনাকে নিয়ে। বন্ধুত্বকে এগিয়ে নিয়ে প্রেমিকা করে নেওয়া কোন বড় ব্যাপার নয়। বিশেষ করে পুরুষেরা এমনটা করতেই পারে। তিনি ভেবে দেখে ছিলেন, কল্পনার কথা মেনে নিয়ে, কল্পনা, আমিও তোকে ভালোবাসি রে ! বললে কিছু ক্ষতি নেই। 

সেদিন রাত নটা বেজে গেছে। পাখিদি এসে ছিল রমাকান্তর ঘরে। কল্পনা ও তাঁর ভালবাসার কথা তার কানেও পৌঁছেছিল হবে। সে রমাকান্তকে কিছু বলতে এসেছিল। 

-কি বলবে ? রমাকান্ত জিজ্ঞেস করেছিল। 

-রমা, তুই নাকি কল্পনাকে ভালবাসিস ?

-তুমি কি করে জানলে গো ? 

পাখিদি এগিয়ে এসে ছিল রমার দিকে। রমাকে আদর করে চুমু খেয়ে বলে উঠেছিল, দেখ, কল্পনা ভালো মেয়ে, তবে তোর এখন বিয়ের বয়েস হয় নি। এখনি বিয়ে করবি না কিন্তু!

রমাকান্ত চুপ করে ছিলেন। পাখিদি তাঁকে আদর দিয়ে ভরিয়ে দিচ্ছিল। তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল, চেহারা ছবি বয়সের বাঁধ ভেঙে জাগতিক এক চুম্বকটান উভয়ে অনুভব করে যাচ্ছিল। ওদের দুজনের ঠোঁট পরস্পরের ঠোঁটে লেপটে ছিল। 



0 comments: