2

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়



সদ্য শেষ হলো আন্তর্জাতিক কলিকাতা পুস্তক মেলা, ২০১৬। ঋতবাক-এর প্রথম বইমেলা। প্রথম আত্মপ্রকাশেই চরম সাফল্য। ঋতবাক-এর এই জয়যাত্রা শুরু হয়েছে সেই ৩০শে আগষ্ট, ২০১৪তেই, যেদিন থেকে আপনারা স্বতঃস্ফূর্ত আন্তরিকতায় পাশে এসে দাঁড়িয়ছেন, সহযাত্রী হয়েছেন। প্রথম মুদ্রিত সংস্করণ মুদ্রণের আগেই তিনশ’রও বেশী কপি অগ্রিম বুকিং হয়ে যাওয়া, শোভাবাজার রাজবাড়িতে অসম্ভব সফল একটা উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, মেলার মাঠে প্রায় একশ’ ত্রিশ কপি বিক্রি হয়ে যাওয়া তারই প্রত্যক্ষ ফলশ্রুতি, নিঃসন্দেহে। ইতিমধ্যেই ঋতবাক পাড়ি দিয়েছে ত্রিপুরা ও বাংলাদেশ। স্থান করে নিয়েছে ন্যাশানাল লাইব্রেরী ও লিটিল ম্যাগাজিন লাইব্রেরীতেও। কিন্তু এত সমস্ত সাফল্যের কথা মাথায় রেখেও বলতেই হবে ঋতবাক-এর চূড়ান্ত প্রাপ্তি অন্য জায়গায়। ঋতবাক, তার এই ক্ষুদ্র, অনভিজ্ঞ যাত্রাপথে সমৃদ্ধ হয়েছে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী, বিশ্বনাথ রায়, সুজিত আচার্য-র মতন বিশাল মাপের গবেষক-সাহিত্যিকদের নিঃশর্ত, স্বতঃস্ফূর্ত অবদানে। এই প্রাপ্তি তর্কাতীতভাবেই সমস্ত মূল্যায়নের উর্দ্ধে। যার অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতি ঋতবাক-এর এবারের বিশেষ ভাষা সংখ্যা। 

বাংলা ব্লগ ম্যাগাজিনের ইতিহাসে প্রথমবার এবারের ঋতবাক বিশেষ ভাষা সংখ্যায় প্রকাশিত হলো রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী ও বিশ্বনাথ রায়-এর লেখা। রামকৃষ্ণবাবু লিখে দিলেন এবারের প্রচ্ছদ নিবন্ধ। নৃসিংহবাবুর লেখাটি তো একেবারেই ভিন্ন স্বাদের, প্রকৃত অর্থেই এ এক অচেনা নৃসিংহ। এই সংখ্যা থেকেই শুরু হলো বিশ্বনাথবাবুর নতুন ধারাবাহিক - ‘যাবনী মিশাল ভাষা’র সন্ধানে। এই সংখ্যাতেই প্রকাশিত হলো "পশ্চিমবঙ্গ ভাষা শহীদ স্মারক সমিতির" কর্ণধার রতন বসু মজুমদার-এর লেখা – বাংলা ব্লগে এই প্রথম। এর এক অন্য তাৎপর্য, এ এক অভাবনীয় প্রাপ্তি, আমরা আপ্লুত। 

ঋতবাক-এর নিয়মিত বিভাগগুলিও পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে অজস্র ভালো লেখায়, দিন দিন প্রত্যেকের লেখার গুণগত মান হচ্ছে উন্নত থেকে উন্নততর, আর দিন দিন সমৃদ্ধতর হচ্ছে ঋতবাক। এও এক পরম প্রাপ্তি। আপনাদের সকলের আন্তরিক সহযোগিতায় ঋতবাক-এর এই যাত্রা পথ আরও মসৃণ ও সুগম হোক। 

শুভেচ্ছা নিরন্তর...
সুস্মিতা বসু সিং

2 comments:

10

প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ

২১শে ফেব্রুয়ারির চিন্তা
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য



হেনরিক সিয়েন্‌কিয়েভিচ্‌ (১৮৪৬ – ১৯১৬) – কে অনেকেই জানেন ‘কুয়োভাদিস’ (কোথায় চলেছেন)–এর লেখক বলে। পোল্যান্ডের এই লেখকটি ছিলেন বহু গুণের আধার।তাঁর অন্যতম কীর্তি  ‘অ্যাসপিনওয়ালের আলোকস্তম্ভ-রক্ষী’ নামে একটি বড়গল্প।কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদে (মূল পোল ভাষা থেকে নয়, তার ইংরিজি অনুবাদের পুনরনুবাদ) গল্পটি হয়তো অনেকেরই পড়া। 

নানা দেশ ঘুরে স্কাতিন্স্‌কি নামে এক পোল দক্ষিণ আমেরিকার পানামা-য় এসে পৌঁছেছেন। তাঁর বয়েস হয়েছে অনেক। এখন তিনি থিতু হতে চান। তাই তিনি কাজ নিলেন আলোকস্তম্ভ-রক্ষীর। কাজ বলতে আলোকস্তম্ভের লন্ঠন জ্বালা। ছ’দিন কাটে একা; রোববার শহর থেকে নৌকোয় করে আসে খাবার আর পানীয় জল, তার সঙ্গে আসে স্পেনীয় ও ইংরিজি ভাষার খবরের কাগজ। একদিন দেখা গেল একটি বাড়তি মোড়ক এসেছে। তার গায়ে মার্কিন ডাকটিকিট সাঁটা আর লেখা প্রাপকের নাম। সিয়েন্‌কিয়েভিচ্‌ লিখেছেন : 

কৌতূহলী হয়ে [মোড়কের] কাপড়টা কেটে সে দেখলো, বই রয়েছে। একটা বই তুলে একবার চোখ বুলিয়ে সে রেখে দিল। থরথর ক’রে তার হাত দুটো কাঁপতে আরম্ভ করেছে। দু-হাতে চোখ সে ঢেকে ফেলল, যেন যা দেখছে সেটা অবিশ্বাস্য। তার মনে হল সে বুঝি স্বপ্ন দেখছে। 

বইগুলো পোল ভাষায় লেখা - এর মানে কী? কে তাকে বই পাঠাতে পারে? তার মনেই নেই, চাকরির প্রথমে মার্কিন প্রতিনিধির কাছ থেকে ধার করে আনা [নিউ ইয়র্ক] হেরল্ডে, নিউ ইয়র্কে পোলিশ সমিতি প্রবর্তনের কথা পড়ে তৎক্ষণাৎ চাঁদা হিসেবে সে নিজের মাইনের অর্ধেক তাদের পাঠিয়ে দিয়েছিল। এখানে তার টাকা-পয়সার কোনও প্রয়োজন নেই। সেই সমিতি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বইগুলো পাঠিয়েছে। অতএব বইগুলো নিতান্ত স্বভাবিক উপায়ে এসেছে।

একা থাকতে থাকতে এই বৃদ্ধ পৃথিবী সম্বন্ধেই আস্তে আস্তে নিরুৎসাহ হয়ে পড়েছিলেন। নিজের দেশের জন্যেও কোনও ব্যাকুলতা আর ছিলনা। এই বইগুলি এসে পড়ল হঠাৎ, তাঁর মাথা ঘুরে গেল। মোড়কের ভেতরে ছিল একটি কবিতার বই। লিথুয়ানিয়া-র এক বিখ্যাত কবির কবিতা। পড়তে পড়তে ‘ফুঁপিয়ে উঠে বৃদ্ধ মাটিতে আছড়ে পড়লো। সমুদ্রে বালির সঙ্গে এসে মিশল তার তুষার-ধবল চুল। তার দেশকে শেষ দেখবার পর চল্লিশটি বছর কেটে গেছে। ঈশ্বর জানেন, আরও কত বছর আগে মাতৃভাষা সে শুনেছে। ...হঠাৎ যেন এক আশ্চর্য ঘটনার ভিতর দিয়ে তার স্বদেশ প্রেম ফিরে এলো। তাই আনন্দে নেচে উঠল তার মন।’

তার পর? না, আলোকস্তম্ভ-রক্ষীর গল্পটি বলার জন্যে এখানে কলম ধরিনি। কামাক্ষীপ্রসাদের অনুবাদে গল্পটি প্রথম পড়েছিলুম। হালে তাঁর ‘কিশোর রচনা সম্ভার ৩’ (দে’জ পাবলিশিং, ১৪০১ ব.)-এ আবার সেটি পড়লুম। প্রথম পড়ার যে আনন্দ বেদনা,  সেটিই আবার অনুভব করলুম নতুন করে।

জন্মভূমি আর মাতৃভাষা – যে কোনো মানুষের এই দুটি পরিচয় তার জীবনের সঙ্গে শক্ত গাঁটে বাঁধা, কোনো ভাবেই সে গাঁট খোলা যায় না। মানুষ ধর্ম পাল্টাতে পারে, নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশের নাগরিক হতে পারে, পোশাক-আশাক, হাঁটাচলার ধরণধারণ সব বদলে ফেলতে পারে, এমনকি আদালতে গিয়ে নাম-পদবিও পালটাতে পারে। আগের মানুষটিকে তার ফলে আর চেনাই যাবে না। কিন্তু বদলানো যায় না ঐ দুটি ব্যাপার : জন্মভূমি আর মাতৃভাষা।

রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাতে মানচিত্র বদলে যায়; এক দেশ ভেঙে হয় দুই বা আরও বেশি দেশ। কখনওবা দু-দেশ জুড়ে এক দেশ হয়। কোথাও আবার পর্ব চলতেই থাকে, যেমন হয়েছে এই উপমহাদেশে। প্রথমে ভারত ভেঙে ভারত আর পাকিস্তান। সেই পকিস্তান আবার দু-টুকরো হলো : আগেকার পূর্ব পাকিস্তান হলো স্বাধীন বাংলাদেশ। কিন্তু এত ভাগাভাগির মধ্যেও যাঁর জন্মভূমি ছিল লাহোর বা কুমিল্লা, মাতৃভাষা ছিল উর্দু বা বাংলা, তাঁর জন্মভূমি আর মাতৃভাষা একই থাকবে। এমনকি জন্মভূমির নাম যদি পালটে যায়, তাতেও কিছু যায় আসেনা। যদি ধ্বংসও হয়ে যায়, পরিণত হয় ভাঙাচোরা এক স্তূপে, তাতেই বা কী? মনের মধ্যে সেই জন্মভূমি থেকেই যায়। কোনো আলোড়ন, কোনো বিস্ফোরণ সেখানে একটা আঁচড়ও কাটতে পারেনা।

একই কথা মাতৃভাষা সম্পর্কে। খুব ছোটো বেলায় মা-এর কোলে বসে যে ভাষা শেখা হয়, তারই নাম মাতৃভাষা। ঘটনা চক্রে জন্মভূমি ছেড়ে অন্যদেশে, এমনকি সাত সমুদ্র পেরিয়ে কেউ অন্য মহাদেশে গেলেও তার মাতৃভাষা মাতৃভাষাই থাকে। ভিন্‌ দেশে অন্য ভাষী মানুষদের সঙ্গে থাকতে থাকতে কেউ কেউ আর মাতৃভাষায় কথা বলার সুযোগ পান না, হয়তো ভুলেই যান। কিন্তু সত্যিই কি ভোলেন?  মৃত্যুর আগে তাঁর মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে আসে বহু দশক আগে শুনে শেখা সেই মাতৃভাষা, এমন উদাহরণ অনেক আছে। আলোকস্তম্ভ-রক্ষীর গল্পটি নিছক গল্প নয়।






10 comments:

2

বিশেষ নিবন্ধঃ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

Posted in


বিশেষ নিবন্ধ

বাঁশী
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী



কেউ এটা সঠিকভাবে জানেই না। জানেই না যে, বাঁশী যারা বাজায়, তাদের কোনও কাজ নেই এ-সংসারে। আর কাজ যদি বা থাকেও, সে কাজটা তার কাজ নয়। তার বাঁশী বাজানোরই কথা ছিল, নেহাৎ কোনও প্রয়োজনে তাকে কাজটা করতে হচ্ছে। আমার মনে আছে, আমি যখন ওপাড়ায় থাকতাম – আমাদের ভাড়াবাড়ির সঙ্গেও বাড়িওয়ালার বিরাট মাঠ ছিল একটা, আর পিছনদিকটায় ছিল এক পরিত্যক্ত ভিটে, যেখানে অনর্থক একটা জঙ্গল ছিল, সেখানে ঘু-ঘু চরে বেড়াত। সেই বাড়ির সামনে দিয়ে যে রাস্তা গেছে, সেই রাস্তায় অলস দুপুরে মাঝে মাঝে এক বাঁশীওয়ালার দেখা পেতাম। সে আপন মনে বাঁশী বাজিয়ে যেত, কারও কাছে সে বাঁশী থামিয়ে পয়সাও চাইত না, কেউ তাকে পয়সা দেবার আগ্রহও দেখাত না। বস্তুত, বাঁশীওয়ালাকে পয়সা দিয়ে যেন অপমানও করা যায় না। ‘বাঁশী বাজায়’ মানেই সে এক উদাসী, সে মানুষকে ঔদাসীন্যের সঙ্গীত শোনায়। এই ঔদাসীন্যের মধ্যে আবার চরম এক ‘রোম্যান্টিসিজম্’ আছে, আছে চরম এক উপভোগ্যতা, যেখানে নিজেকেই বুঝি নিজে সবচেয়ে উপভোগ করে মানুষ।

গাঁয়ের বাড়িতে কমলিনী-দিদিকে দেখেছিলাম। তাঁর পিতা সম্পন্ন গৃহস্থ ছিলেন, কিন্তু পুত্রী কমলিনীর বিয়ে দিতে পারেননি। আমি সজ্ঞানে যখন তাঁকে দেখেছি, তখন তাঁর সাতচল্লিশ-আটচল্লিশ বছর বয়স। দেখতে তখনও বেশ সুন্দরী– সেটা অবশ্য এখন বুঝি। কেননা আমি যখন তাঁকে দেখেছি, তখন স্ত্রীলোকের যৌবন কিম্বা সৌন্দর্য বিচারের জ্ঞান হয়নি আমার। কিন্তু এখন বুঝি, সেই প্রথম-প্রৌঢ়তাতেও কী অসামান্যা সুন্দরী ছিলেন তিনি। অথচ যৌবন-বয়সেই তাঁর যে কী হল, কেউ আমরা বুঝলাম না। তিনি নাকি স্বপ্নে এমন দেখেছেন – শ্যামসুন্দর কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছে। তাঁর আর বিয়ে করার উপায় নেই। এরই মধ্যে কমলিনী-দিদির ঠাকুমার গুরু এসেছিলেন বাড়িতে। তিনি ভারী রসিক ভক্ত বৈষ্ণব মানুষ – মনোহর দাস বাবাজি, বৃন্দাবনে তাঁর বাস। তিনি যেখানেই যান, সেখানেই তাঁর সঙ্গে থাকে কৃষ্ণের সাক্ষাৎ স্বরূপ গোবর্ধন শিলা। বাবাজি তাঁর মালার থলিতে গোবর্ধন শিলা নিয়ে গলায় ঝোলান, আর শিষ্যবাড়িতে এসে ঠাকুরের চৌদলে সেই মূর্তি বসিয়ে ঝোলা থেকে সোনার চূড়া-বাঁশী বার করে শ্রীমূর্তির পাশে বাঁকা করে রাখেন, শিলার মাথায় পরিয়ে দেন নকল চুল, তার উপর শিখিপুচ্ছ গোঁজা।

বাবাজি-মশায়ের সেবার মাধুর্য দেখে কমলিনী-দিদি তাঁর কাছেই দীক্ষা চাইলেন। বাবাজি চমকে উঠলেন একেবারে। তারপর কমলিনীর পিতা সবিস্তারে জানালেন সব। এমনও বললেন – বাবা! মেয়ে আমার বিয়ে করবে না। বলে নাকি তার বিয়ে হয়ে গেছে শ্যামসুন্দরের সঙ্গে। তাকে অনেক বুঝিয়েছি আমি, সে শুনবে না। তা বাবা, টাকা-পয়সার অভাব আমার নেই। একটা মেয়ের ভাত, সবার পাত কুড়িয়েও হয়ে যাবে। কিন্তু আমি ওর জীবন চালাবার পাথেয় নিয়ে চিন্তা করছি, বাবা! ও জীবন কাটাবে কী করে? কাজেই ওকে দীক্ষা দিন বাবা, ও কৃষ্ণের সেবা করুক, অন্ন ভোগ দিক, ঠাকুরের শিঙার করুক, সন্ধ্যাবেলায় পদাবলী কীর্তন শুনবো আমরা।

মনোহর দাস বাবাজি দু’দিন ধ্যানমগ্ন বসে থেকে পরের দিন বৈষ্ণবমতে দীক্ষা দিলেন কমলিনী-দিদিকে। দীক্ষার শেষে তাঁর গিরিরাজ গোবর্ধনকে সামনে বসিয়ে বাবাজিমশাই গিরিধারীর সোনার বাঁশীখানি কমলিনীর মাথায় ঠেকিয়ে বললেন – এই বাঁশী আমার শ্যামল সুন্দরের প্রতিমূর্তি। তুমি তোমার প্রাণের স্বামী ভেবে এই বাঁশীর উপর কৃষ্ণের পূজা-অর্চনা-শিঙার করবে। এই বাঁশীই তোমার বংশীধারী শ্যামসুন্দর কৃষ্ণ।

আমি কমলিনী-দিদির ঠাকুরের সিংহাসন দেখেছি ছোটবেলায়। তাঁর ঠাকুরের ঘরে দু’টি সিংহাসন। একটিতে অদ্ভুত একটি পাথরের উপর ‘মাউন্ট’ করা সেই গুরুদেবের দেওয়া কৃষ্ণ-প্রতিরূপিনী বাঁশীটি। অপর একটি সিংহাসনে রাধা-কৃষ্ণের পৃথক দু’টি যুগলমূর্তি। শুনেছি, বৃন্দাবনের গোবর্ধন-পাহাড় থেকে কমলিনী-দিদি একটি বড়ো ধরনের গিরিধারী শিলা আনিয়েছিলেন। কৃষ্ণের ভাব আনার জন্য তাতে খচিত হয়েছিল মিনে করা আঠায় লাগানো চোখ-মুখ-নাক, আর বাঁশীটি সযত্নে সন্নিবেশ করা হত সেই গিরিধারী গোপালের মুখের কাছে। তার সঙ্গে সারা সিংহাসন জুড়ে বন্য ফুলের সাজ। সেই বাঁশীখানিকে তখন সজীব মনে হত। যেন এখনই তান উঠবে বংশীধারীর ‘কুঞ্চিতাধরপুটে’। কমলিনী বিকেল হলেই বলতেন – আমার ঠাকুরের শিঙার করার সময়। এখন তাঁকে শৃঙ্গার-বেশে সাজাতে হবে; আর সেই সময়টাতেই বিগ্রহের অবস্থানে একটা পরিবর্তন ঘটাতেন কমলিনী-দিদি। পাশের সিংহাসন থেকে কৃষ্ণের অবয়বী মূর্তিখানি নিয়ে আসা হত গোবর্ধন-শিলার সামনে এবং সেই মূর্তির হাতের ফুটোর মধ্যে দিয়ে বাঁশীখানি গলিয়ে দিতেন কমলিনী-দিদি। ‘ত্রিভঙ্গ-ভঙ্গিম-ঠামে’ দাঁড়ানো এই কৃষ্ণমূর্তিটিকে একটু ব্যাঁকা-ত্যারচা করে অবস্থিত করার পর দিদি বলতেন – এই বাঁশী ছাড়া সারাটা দিন কেমন আভরণহীন মলিন লাগে মানুষটাকে, দেখেছো তো! আবার দ্যাখো, সেই শৃঙ্গারোজ্জ্বল বেশ, ‘অখিলরসামৃত মূর্তি’ – বাঁশী ছাড়া আমার কৃষ্ণকে মানায়ই না। বাঁশীটাই ওর সব, এই বাঁশীই তিনি।

জিজ্ঞাসা করেছিলাম – তাহলে সারা দিনই বাঁশীটা দিয়ে রাখো না কেন ওই হাতের কুণ্ডলীতে? কমলিনী বলেছিলেন, সকাল সাড়ে দশটা-এগারোটায় একবার দিই বটে। তখন ওর গোষ্ঠে যাবার সময়, গোরু চরাতে গেলে ওর বাঁশী লাগে। বলে কিনা – দাদা বলরামের শিঙা শুনলে গোরুগুলি বড্ড লাফালাফি করে, তাঁকে বলাও যায় না কিছু। কিন্তু বাঁশীর তানে ওরা একটু ঠাণ্ডা থাকে, বিকেল হলে গোরুগুলোকে এক জায়গায় আনতেও কাজে লাগে। আমি বলেছিলাম – কিন্তু তুমি তো আর সারাদিন বাঁশীটা দাও না তাঁর হাতে। কমলিনী বলেছিলেন, না দিই না। আমরা রাধারানীর সখীকুলের দাসী। মেয়ে বলে মেয়েদের কষ্টটুকু বুঝি শুধু। জননী যশোমতীর কত কষ্ট বলো! ছেলে গোরু চরাতে যাবে রাখালের বেশে, তার সঙ্গে গোপজনের আরও কত রাখাল, তবু তাঁর চিন্তা এই বুঝি কোনও গোরু তার পিছনের পায়ের লাথি মারল তাঁর ছেলের পায়ে, এই বুঝিকংসের লোক এসে ধরল তাঁর ছেলেকে, রাস্তা-ঘাট মোটেই ভালো নয়, হয়তো তুলেই নিয়ে গেল তাঁর ছেলেকে!

কমলিনী-দিদি বলতে বলতে একটু থামলেন এবার। আমি বললাম – তুমি সকালবেলায় তোমার ঠাকুরের হাতে একবার বাঁশী তুলে দাও, সেই সূত্রেই তুমি গোরু থেকে আরম্ভ করে কংসের কথা শোনাতে আরম্ভ করলে। কমলিনী বললেন – শোনাতে তো হবেই, ভাই! আমি ভাবছিলাম, ব্যক্তিগত ভালোবাসা কি ভীষণ স্বার্থপর হয়! এমনকি আমিও তাই। এই দ্যাখো না, জননী যশোমতী রীতিমতো নির্দেশ দিয়ে বলেছেন – অতগুলি গোরু নিয়ে যাবার সময় তোমার দাদা বলাই বলরাম সামনে-সামনে যাবে, ‘আর শিশু বাম ভাগে’, আর তুমি যাবে তাদের মাঝখান দিয়ে। অর্থাৎ গোরুর লাথির ছাট অন্য বাচ্চাদের গায়ে লাগে লাগুক, আমার ছেলেটির গায়ে যেন না লাগে – কমলিনী-দিদি মিহিসুরে গাইলেন – কংসের লোক অন্য ছেলে নেয় নিক, কিন্তু আমারটি যেন না নেয় –

বলাই ধাইবে আগে          আর শিশু বাম ভাগে
শ্রীদাম সুদম সব পাছে।
তুমি তার মাঝে যাইও        সঙ্গ ছাড়া না হইও
মাঠে বড় রিপুভয় আছে।।

কিন্তু এই যে বিরাট গোষ্ঠে যাবার প্রক্রিয়া, এখানে কত নির্দেশ, আদেশ, পরামর্শ – এখানে সবচেয়ে বড়ো কাজটা কিন্তু বাঁশীর – কমলিনী আসল রহস্য জানালেন এবার। এই বাঁশী মানে মায়ের হৃদয় নিশ্চিন্দি হল, তখন তো দূরভাষ ছিল না যেখবর নেবেন মা। তাই পদাবলী আরম্ভেই মার নির্দেশ হল – তুমি গোরুগুলির সামনে-সামনে যাবে না এবং খুব দূরেও যাবে না গোরু চরাতে, এমন দূরত্বে থাকবে যেখান থেকে তোমার বাঁশীর শব্দ শুনতে পাই আমি –

নিকটে রাখিও ধেনু               পুরিও মোহন বেণু
ঘরে বসি আমি যেন শুনি
কমলিনী-দিদি আবারও গেয়ে ফেললেন যাদবেন্দ্র দাসের পদকলি। সেই গ্রাম্য পরিবেশে এই বাঁশীর পদটি যে কি আর্তি বয়ে এনেছিল আমার কাছে, তা আমি পর্যন্ত জননী যশোমতীর সহমর্মিতায় বুঝেছিলাম যেন। কমলিনী-দিদি বলেছিলেন – এক অতিস্নেহময়ী জননীর কাছেই যেখানে বাঁশীর এত আবেদন, সেখানে আমার রাইকিশোরীর হৃদয়ে যে বাঁশী শতেক ঢেউ তুলে তরঙ্গিনী হয়ে ওঠে, ভাই! আমি প্রতিদিন বিকেলে আমার প্রাণের ঠাকুরকে নিয়ে আসি বাঁশীর সিংহাসনে। দাঁড় করিয়ে দিই গিরিরাজ গোবর্ধনের পাশে আর হাতে তুলে দিই সেই মোহন বাঁশীটি। আমার রাধারানী থাকেন অপর সিংহাসনে, অভিসারিকার বেশে। কৃষ্ণের বাঁশী বাজবে আর আমার বিনোদিনী রাইকিশোরী গাইতে গাইতে যাবেন –
ভালে ভালে বনি আওয়ে মদন মোহনিয়া
অধর-সুধা ঝরু মুরলী-তরঙ্গিনী
বিগলিত রঙ্গিনী-হৃদয়-দুকূল।

সে বাঁশী শুনলে আর ঘরে মন বসে না, ভাই! আমরা সকলে অভিসারিনী হয়ে পড়ি, রাধার সখীদের সঙ্গে খুঁজতে থাকি তাঁকে।




বাঁশী মানে এই অন্বেষণ। বাঁশী মানে সেই সুদূরের সুর, যা অনুক্ষণ পাগল করে আমাদের। অথবা বাঁশী মানে সেই অলৌকিক সুদূর, যার অপেক্ষায় এক অলৌকিক বিরহ-বিলাসের সুখের মতো এক ব্যথা অনুভব করি অহরহ। অথবা বাঁশী মানে সেই মধুর অতিক্রম, যেখানে সমস্ত নিয়ম ভেঙে পড়ে কেজো লোকের মর্মে শেল বিঁধিয়ে দিয়ে। কমলিনী-দিদি বলেছিলেন – সেদিন শারদী পূর্ণিমার রাত্রি ছিল। আকাশ-ভরা চাঁদচুয়ানো জ্যোৎস্নার মধ্যে দাঁড়িয়েছিলেন কৃষ্ণ। সেই কোন হেমন্তকালে তিনি কথা দিয়েছিলেন গোপিনী-সখীদের – তোমাদের সঙ্গে মিলন হবে আমার। তোমরা অপেক্ষা কোরো প্রতিদিন। সেই সব নিশিদিন চলতে চলতে আজ শারদী রাত্রি এসেছে। গগনের চাঁদ সারা দিনের প্রতীক্ষায় থাকা পূর্বদিকবধূর গাল ছুঁয়ে দিল তার কিরণকরের স্পর্শে। দিকবধূর গালের লজ্জার লালিমাতে মেটে-লাল হয়ে উঠল পূর্বাকাশ – তদড়ুরাজঃ ককুভ-করৈর্মুখং / প্রাচী আবিলিম্পন্ অরুণেন শন্তমৈঃ। এমন মধুরতা দেখে কৃষ্ণ আর সইতে পারলেন না। তিনি বাঁশী বাজিয়ে দিলেন অশেষ ব্রজযুবতীদের উদ্দেশ্যে – জগৌ কলং বামদৃশাং মনোহরম্।

আর যেই না সেই বাঁশীর সুর হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে এল বৃন্দাবনের কুলযুবতীদের কানে – তখন রাত্রি আঁধার হচ্ছে কেবল, তখন এই বাঁশী শোনার প্রথম প্রতিক্রিয়া হল – যে যে অবস্তায় ছিল, সেই অবস্থায় সমস্ত কাজ রেখে দৌড়তে আরম্ভ করল সেই বাঁশীর সুর লক্ষ্য করে – যে বাঁশী বাজল বনমাঝে কি মনোমাঝে। দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া, একজন খেয়াল করল না যে অন্যজন কী করছে। এ যেন একান্ত ব্যক্তিগত এক সুরের আহ্বান, যাতে মনে হয় এ সংকেত শুধু আমরই জন্য, অথচ আমারই মতো অন্য আর একজনও সেই সুর-সংকেত শুনতে পায়, কেননা সে আমারই মতো আর একজন, কিন্তু কৃষ্ণের বাঁশী শুনলে সেই অন্য আর একজনকে খেয়াল থাকে না – সমস্ত আমিগুলো একসঙ্গে দৌড়োয়, সেই গতিতে দুলতে থাকে শুধু কানের দুল – অসঙ্গ সাক্ষীর মতো, বাঁশী শোনার পর অখিল যুবতীকুলের গতির শীঘ্রতার পরিমাপ করে যেন – আজগ্মুরন্যোন্যলক্ষিতোদ্যমাঃ / স যত্র কান্তো জবলোলকুণ্ডলাঃ।

কমলিনী-দিদিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম – এমন হয় কেন? এ কেমন পাগলপারা স্বভাব তৈরি হয় বাঁশীর সুরে যেখানে এতগুলো যুবতী মেয়ে, তারা যে যে-কাজ করছিল, সব ফেলে দৌড়োল – কেউ এক চোখে কাজল পরে, কেউ পায়ের নূপুর গললায় পরে, কারও ‘খসন বসন রসন চেলী / গলিত বেণী লোলনী। এ কেমন করে হয়? কমলিনী-দিদি গল্প শুনিয়ে বলেছিলেন – এটা আমার গুরুর মুখে শোনা কথা। সেই আমার হাতে গিরিধারীর বাঁশী দিয়ে তিনি বলেছিলেন – বাঁশী হল সেই সুরের বঁড়শি, একবার সুরের সুতোয় তোর গলায় এসে বিঁধল, তো তুই যতই জলের মধ্যে ঘোরাফেরা কর, তোকে যেতে হবে তাঁর কাছেই। আমি এই আমার বাপের সংসারে আছি, তবু ধন্যি বাপ আমার! তিনি আমাকে হাতা-খুন্তি আর সন্তান জন্ম দেওয়ার দায় থেকে মুক্তি দিয়েছেন, আমাকে শুনতে দিয়েছেন বাঁশীর সুর। আমার বাবাজিমশায় বাঁশীর জন্মকাহিনী শুনিয়েছিলেন একদিন – বলেছিলেন – যেদিন এই দেহ হবে বাঁশীর মতো, সেদিন সেই সুরের গুরু সুর সাধবেন এই বাঁশীতে।

কথাটা ভাল করে বুঝলাম না বলে কমলিনী বললেন – কৃষ্ণ ব্রজভূমির নায়ক, শতপুষ্পের কুঞ্জবনে তাঁর চলাফেরা, বৃন্দাতুলসী তাঁর সখী, গলায় বনফুলের মালা, এমন মানুষের কাছে প্রকৃতি হল সব চাইতে ভালোবাসার জিনিস। কৃষ্ণ প্রতিদিন বনভূমিতে আসেন, প্রতিটি গাছের কাছে যান, তাদের সুখদুঃখের কথা শোনেন, তাদের পরিচর্যা করেন। আর গাছেরাও তাঁকে ভীষণ ভালোবাসে। গভীর পারস্পরিকতায় প্রতিদিন তাঁদের কুশল বিনিময় হয়। কিন্তু এই গভীর আন্তরিকতার মধ্যেই একদিন সেই বিপর্যয় ঘটে গেল। কৃষ্ণ সেদিন বনভূমিতে প্রবেশ করে কাউকে ভালোবাসা জানালেন না, কোনও পত্রপুষ্পে অঙ্কন করলেন না তাঁর করাঙ্গুলির স্পর্শ। তিনি এসে উপস্থিত হলেন বংশমণ্ডপে বাঁশবনর ছায়ায় এবং তাকিয়ে রইলেন একটি বাঁশগাছের দিকে। বাঁশ গাছ বলল – হ্যাঁগো, এমন করে তাকিয়ে আছ কেন আমার পানে? কৃষ্ণ বললেন দুঃখ-স্বরে – একট জিনিস চাই তোমার কাছে, কিন্তু বড়ো কষ্টের সেই চাওয়া। বাঁশ বলল – বলো কী চাই তোমা, তোমাকে অদেয় নেই কিছু। কৃষ্ণ বললেন – আমি তোমার প্রাণ চাই। তোমাকে কাটতে হবে আমায়। বাঁশ খানিকক্ষণ ভাবল। তারপর বলল – তোমার কাছে সব সমর্পণ করে বসে আছি আমরা। এ দেহ কাটবে কী রাখবে, সব তোমার ই্চ্ছে।

কৃষ্ণ সেই বাঁশ গাছ কেটে খণ্ড খণ্ড করলেন। তারপর উপযুক্ত বংশখণ্ডটি নিয়ে তাতে ফুটো করতে আরম্ভ করলেন। কৃষ্ণ এক-একটিফুটো করেন আর বাঁশী যন্ত্রণায় কাঁদতে থাকে। অবশেষে তৈরি হল বাঁশী, কৃষ্ণ ফুঁ দিলেন বাঁশীতে – তাতে থেমে গেল ব্রজভূমিতে গোরুর বিচরণ, ময়ূরের নৃত্য, পক্ষীকুলের কলকাকলি। ব্রজগোপীরা বললেন – মুখরিত এই বংশীধ্বনি শুনে মৃগ-পক্ষীদের মধ্যেই এমন আকুল অবস্থা, সেখানে আমরা ঘরে থাকি কী করে – কা স্ত্রাঈ তে কল-পদায়াত-বেণুগীতম্। আর সেই বাঁশ, যে নিজের জীবন দিয়ে বাঁশীর জীবন পেয়েছিল, সে অঝোরে কাঁদছিল এই ভেবে যে, কতট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সে কৃষ্ণের কাছে, কৃষ্ণ বাঁশী ছাড়া এক মুহূর্তও থাকেন না। কৃষ্ণ বংশদণ্ডের জীবন নিয়ে বংশখণ্ডকে আপন জীবনে সর্বক্ষণের জন্য স্থান দিয়েছেন। এর জন্য একদিন কৃষ্ণের প্রিয়তমা সখীরাও ঈর্ষালু হয়ে উঠলেন বাঁশীর উপর, সর্বক্ষণ কৃষ্ণের হাতে থাকা বাঁশীর উপর – মুখরিত মোহন-বংশ।

একদিন গোপিনীরা জিজ্ঞাসা করলেন বাঁশীকে – কী রহস্যটা বলো তো। আমরাও তো সারা জীবনের তপস্যায় তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গিনী হতে পারলাম না, অথচ তোমার এত সৌভাগ্য হয় কি করে? বাঁশী বলল – আমাকে তাঁর পছন্দ হওয়ার কারণ শোন – আমার ভিতরটা পুরো ফাঁপা, আমার ইচ্ছে-অনিচ্ছে নেই, চাওয়া-পাওয়া নেই, আমি একেবারে জীবন-মুক্ত। তিনি যেমন চালান তেমনি চলি, যেমন বলান তেমনি বলি, আমি সব সমর্পণ করেছি তাঁর কাছে – ‘আমার লাজ ভয়, আমার মান-অপমান সুখ-দুঃখ-ভাবনা’। ভিতরটা এমন নির্গুণ হলে তবেই তিনি সর্বাংশে গ্রহণ করেন। গোপীকুল বুঝি শিক্ষা নিলেন বাঁশীর কাছে – লজ্জা-ভয়, আর্যজনের সমস্ত বিহিত পথ ত্যাগ করে তাঁরা যে এখন কৃষ্ণের কাছে উপস্থিত হন – সেটা শুধুই বাঁশীর শব্দ শুনে।

কমলিনী-দিদির বংশীকাহিনটা ভালই লাগল, অন্তত সেটা আমাকে ভাবিয়ে তুলল আরও। বাঁশীর প্রতীকটুকু কমলিনী-দিদি কৃষ্ণের একা্ত্মতায় ধরেছেন বলেই তাঁর সিংহাসনে সোনার বাঁশীখানি কৃষ্ণ হয়েই বসে আছে। আমি ভাবি, প্রতীক তো শুধু এখানেই নয়, আমার মহাকবিও তো বাঁশীকে ব্যবহার করেছেন কালের রাখালের হাত দিয়ে। আমি যেদিন এই গানখানা শুনেছিলাম – সেই যে মধ্যদিনে যখন পাখিরা গান বন্ধ করে দেয়, তখন কলের রাখাল যে বেণু বাজায়, সে গান শোনে রুদ্র – প্রান্ত-প্রান্তরের কোণে বসে – এ গান শুনে এক অলৌকিক ভয় যেন আকৃষ্ট করে মন; তবু এই ভয়ের মধ্যেও – হে রাখাল! বেণু তব বাজাও একাকী – সেই রাখালের কথা শুনি যেই, অমনই আমদের কৃষ্ণাবেশ ঘটে, কেননা তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে রাখাল ভাবাই যায় না কখনও। তাঁকেই শুধু ভাবা যায় যেন – কেউ যেখানে নেই, সেখানেও তাঁর বাঁশীর আবেদন ভেসে আসে তাঁর কাছে যাবার জন্য। কিন্তু এর চাইতেও বেশি অবাক হয়েছিলুম কালের রাখালকে পৃথিবীর অনন্ত উপরে সেই চিদাকাশের মাঝে ধেনু চরাতে দেখে। সেখানে সেই কোন সুদূরে জগৎসৃষ্টির আদিকেন্দ্রে সূর্য-চন্দ্র-গ্রহ-তারা আর অফুরান নক্ষত্রের ধেনু চরে বেড়াচ্ছে সেই বাঁশীর সুরে – তিনি বাঁশী বাজাচ্ছেন –আর দিগন্তেউচ্চকিত গ্রহ-তারা-নক্ষত্রের দল মহাজাগতিক শৃঙ্খলায় চরে বেড়াচ্ছে – উপনিষদের ঋষি মঙ্গল উচ্চারণ করছেন –

এতস্য বা অক্ষরস্য প্রশাসনে গার্গি সূর্যাচন্দ্রমগৌ বিধৃতৌ তিষ্ঠতঃ।

আমার কবি লিখলেন –

এই তো তোমার আলোক ধেনু সূর্য তারা দলে দলে –
কোথায় বসে বাজাও বেণু, চরাও মহাগগনতলে।

আবারও মনে হল সেই কমলিনী-দিদির কথাই – ওই বাঁশী আমার ঠাকুর। সেই কোন সুদূরে বসে আমার শ্যামল-কিশোর বাঁশী বাজাচ্ছেন, আর আমরা ছুটে বেড়াচ্ছি পাগলের মতো – সুদূর বিপুল সুদূর, তুমি যে বাজাও ব্যাকুল বাঁশরী! আমি বলেছিলাম – জানো তো দিদি, তুমি তো বাঁশী নিয়ে এক ‘রোম্যান্টিক’ জগৎ তৈরি করে ফেলেছ। তাতে আমিও ভাবি – বাঁশীর একটা নিজস্ব জগৎ আছে সত্যি, সেখানে কেজো জগতের সমস্ত বাস্তব, সমস্ত শৃঙ্খলা শেন তুচ্ছ হয়ে যায়। সে বাঁশী যে শুনতে পায়, সে এক বিশৃঙ্খল মধুরতার টানে গা ভাসিয়ে দেয় এই পৃথিবীতে। তার সাথের সাথী হয় উদসী হাওয়া, নদীর জল। আর বিকীর্ণ পৃথিবীর প্রান্তর। তাকে যদি কাজের জগতে ফিরিয়ে আনতে হয়, তাহলে শঙ্খের নিনাদ না হলে চলে না। আমার কবি লিখে গেছেন –

সংসারে সবাই যবে সারাক্ষণ শত কর্মে রত
তুই শুধু ছিন্নবাধা পলাতক বালকের মত
মধ্যাহ্ণে মাঠের মাঝেএকাকী বিষণ্ণ তরুচ্ছায়ে
দূরবনগন্ধবহ মন্দগতি ক্লান্ত তপ্ত বায়ে
সারাদিন বাজাইলি বাঁশী। ওরে তুই ওঠ্ আজি।
আগুন লেগেছে কোথা। কার শঙ্খ উঠিয়াছে বাজি
জাগাতে জগৎ-জনে।

কবিতা শুনে কমলিনীর মুখ ভার হল একটু। তারপর খানিক ভেবে বলল – তোমার যিনি কবি তিনি তো আমারও কবি। তবে কিনা আমার কবির স্বভাবের মধ্যে বাঁশীটাই সব, অন্যের জন্য তাঁকে শঙ্খ বাজাতে হয়, অন্যের জন্য তিনি বজ্রের মধ্যে বাঁশী রাখেন, পৃথিবীর হাজার অন্যতর কাজের প্রয়োজন আছে বলেই বাঁশীতে অন্য তান তুলতে হয়। কিন্তু সে আমার কবির স্বাভাবিক জগৎ নয়। তিনি নিজে সেই ছন্নছাড়া পাগলের দলে আছেন বলেই বাঁশী ছেড়ে শঙ্খ বাজাতে গেলে তাঁকে হাহাকার করতে হয়। তা নইলে ওই একই কবিতার মধ্যে তিনি লিখতেন না –

-- যেদিন জগতে চলে আসি,
কোন্ মা আমারে দিলি শুধু এই খেলাবার বাঁশি।
বাজাতে বাজাতে তাই মুগ্ধ হয়ে আপনার সুরে
দীর্ঘ দিন দীর্ঘ রাত্রি চলে গেনু একান্ত সুদূরে
ছাড়ায়ে সংসারসীমা।

কবি ইচ্ছে কিন্তু এই বাঁশীতেই তিনি সেই সুরধ্বনি জাগিয়ে তুলতে চান যাতে গীতশূন্য অবসাদ-পুর জাগ্রত হয়ে ওঠে। কিন্তু এই সুর বাঁশীতে তৈরি হলেও বাঁশীর মধ্যে যেহেতু উদাসীন এক ছন্নছাড়া পাগলপারা ব্যাপার আছে, তাই বাঁশী দিয়ে শঙ্খনাদ হয় না, কবিও তা পারেন না। আমা কবির হাহাকার আছে এখানে। বলেছেন তো –

যে বাঁশীতে শিখেছি যে সুর
তাহারই উল্লাসে যদি গীতশূন্য অবসাদপুর
ধ্বনিয়া তুলিতে পারি মৃত্যুঞ্জয়ী আশার সঙ্গীতে
কর্মহীন জীবনের এক প্রান্ত পারি তরঙ্গিতে
শুধু মুহূর্তের তরে – দুঃখ যদি পায় তার ভাষা...

দেখেছো তো ভাই, ‘যদি’ – কমলিনী-দিদি বললেন – ‘যদি’। আমি জানি বাঁশী দিয়ে বিপ্লব-বিদ্রোহ হয় না। বাঁশীর মধ্যে মোহিনী আছে গো, মোহিনী আছে! সে আকর্ষণ করে, পাগল করে, ঘরছাড়া করে – আমার ঠাকুরের মতো। কমলিনী-দিদি চৈতন্য-চরিতামৃতের কবির সুরে গান ধরলেন –

নীবি খসায় পতি আগে,      গৃহধর্ম্ম করায় ত্যাগে
বলে ধরি’ আনে কৃষ্ণস্থানে।
লোকধর্ম্ম, লজ্জা, ভয়,        সব জ্ঞান লুপ্ত হয়,
ঐছে নাচায় সব নারীগণে।।
কানের ভিতর বাসা করে,     আপনে তাঁহা সদা স্ফুরে
অন্য শব্দ না দেয় প্রবেশিতে।
আন কথা না শুনে কান,           আন বলিতে বোলয় আন,
এই কৃষ্ণের বংশীর চরিতে।।

আমার সামনে কমলিনী-দিদির এই গান গাইতে একটুও লজ্জা হল না। বুঝলাম, বাঁশীতে মজে আছেন কমলিনী। তবে এর চেয়েও বেশি আছে কিছু। এ তো যুবতীজনের কাছে কৃষ্ণের বাঁশীর আবেদন। এমনকি এই সূত্রে নদীয়া-বিনোদিয়া ঠাকুর চৈতন্যের কথাও বুঝি। কেননা তাঁরই গানের কলি গাইলেন তো কমলিনী-দিদি। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কথা হল ওই মহাপণ্ডিত বুড়োদের নিয়ে। তাঁরা কেউ অদ্বৈতবাদী দার্শনিক, কেউ ধুরন্ধর নৈয়ায়িক, কেউ বা বাঁশীর জন্য নিরাকার নির্গুন ব্রহ্মবাদিতা মাথায় রেখেও কৃষ্ণের বাঁশী না শুনে পারেন না। আমি কমলিনী-দিদিকে সেই অসামান্য শ্লোকরাশি শোনালাম, শুধু বললাম – বাঁশীর সুর নয় শুধু, আমার কৃষ্ণের বাঁশীর সুর – সেখানে তোমার মতো বাঁশী-সোহাগিনীর সঙ্গে নৈয়ায়িক মথুরানাথ তর্কবাগীশ, প্রতাপরুদ্রীয় বাসুদেব সার্বভৌম অথবা মধুসূদন সরস্বতীর কোনও তফাৎ নেই। মোহিনী বাঁশী সকলের মন একত্তর করে দিয়েছে; তুমি তাঁদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠা বংশীসাধিকা কমলিনী-দিদি।



2 comments:

0

প্রবন্ধঃ রতন বসু মজুমদার

Posted in


প্রবন্ধ


বাঙালি জাতিসত্তার সঙ্কট
রতন বসু মজুমদার



বাংলার বর্ষপঞ্জি ইতিহাসের নিরিখে মাত্র পাঁচটি শতক পেরিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন বর্ষপঞ্জি কোনও না কোনও ধর্মীয় অনুষঙ্গে যুক্ত। বঙ্গাব্দ শুরু হয়েছিল মোগল বাদশা আকবরের আমলে। শুরু হয়েছিল চোদ্দশ বছর আগের ঘটনাকে যাত্রাবিন্দু হিসেবে গণ্য করে। ভারতবর্ষ, বিশেষত বাংলার ইতিহাসে মিলন-মিশ্রণ-সমন্বয়কারী বিবিধ উপাদানের মতো বাংলা বর্ষ ধারণ করেছিল হিন্দু-মুসলিম ও বিভিন্ন লৌকিক উপাদনের স্মারক। পাঁচশ বছর আগে সুবে বাংলায় ফসল উৎপাদনের চক্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য সম্রাট আকবর এই বর্ষপঞ্জির প্রবর্তন করেছিলেন। বর্ষপঞ্জির মাস গণনার ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়েছে লৌকিক ও হিন্দু দেবতাশ্রিত রীতিনীতি। বিভিন্ন নক্ষত্র স্মারক হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে বিভিন্ন মাসের এবং বর্ষসূচক হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে মক্কা থেকে মদিনায় হজরত মহম্মদের হিজরতের ঘটনা তথা হিজরি সাল। এই বর্ষপঞ্জি অচিরেই সমগ্র বাংলার মানুষের কাছে আদৃত হয়ে ওঠে। এই বর্ষপঞ্জির গ্রহণযোগ্যতার আর একটি কারণ হল সেই সময় প্রথমবারের মতো মোগল কর্তৃত্ব শিথিল হয়ে এসেছিল। এক পূর্ণাঙ্গ জাতিরাষ্ট্রের আকার নিতে শুরু করেছিল বাংলা। সমতট, পুণ্ড্র, বরেন্দ্র, বাঙাল, হরিকেল, ইত্যাদি অঞ্চল তার ভাষাগত সাযুজ্য সত্বেও কখনোই রাজনৈতিক অখণ্ডতা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি। মোগল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা সেই রাজনৈতিক ঐক্যের একটি বাতাবরণ গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। সেই সময় থেকেই সমগ্র অঞ্চল ‘বাঙাল’ অভিধায় চিহ্নিত হতে শুরু করে। ফসলি সাল হিসেবে রাজস্ব আদায়ের সময়সূচি চিহ্নিত বঙ্গাব্দের প্রচলন প্রকৃত অর্থেই সমগ্র ভূখণ্ডে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন জনপদের মানুষ। বাঙালির সমন্বয়বাদী জীবনচেতনা এবং হিন্দু-মুসলিম লৌকিক বিভিন্ন ধারার মিশ্রণে উদ্ভূত এই পঞ্জিকা বাঙালির জাতিগত বিকাশের পথ প্রশস্ত করেছিল। ইতিহাসের নানা চড়াই উতরাই পেরিয়ে এই বর্ষপঞ্জি আজ বাঙালির চেতনায় এক নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে চলেছে।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঋতুভিত্তিক যে উৎসবগুলির সূচনা করেছিলেন, তারও ভিত্তি ছিল এই বর্ষপঞ্জি। বর্ষামঙ্গল, শারদ উৎসব, পৌষমেলা, বসন্ত উৎসব, নববর্ষ উৎসব, বৃক্ষরোপণ, হলকর্ষণ, নবান্ন – এইসব উৎসবই ছিল বাঙালির সপ্রাণ সাংস্কৃতিক উৎসব। আর এই সব উৎসবের মধ্য দিয়েই ধর্ম, শ্রেণী নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক চেতনার প্রকাশ ঘটত। কোনও ধর্মীয় অনুষঙ্গ না থাকায় উৎসবগুলি সমগ্র বাঙালি জাতির মহামিলন ক্ষেত্র হিসেবে পূর্ণ প্রকাশিত হত। নানা লৌকিক উপাচার নানাভাবে বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনার আকর হয়ে উঠত। একাত্ম হয়ে উঠতে পারত বাঙালি জাতির সব অংশের মানুষ। পিরের দরগা, চণ্ডীমণ্ডপ, দরবেশের চামর, সবই ছিল হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব বাঙালির একান্ত আপন। বাঙালি কখন নিজের অজান্তেই হিন্দুদের সত্যনারায়ণ আর গাজিপিরের সম্মিলনে গড়ে তুলেছে সত্যপিরের আখড়া। সাঁওতাল গ্রামের যে শালগাছটি বিশেষ ভাবে পূজিত হয় সব গ্রামবাসীদের দ্বারা, সেই শালগাছের তলায় নুড়ি পাথরের বৃত্ত গড়ে তোলেন গ্রামবাসীরা। সেই বৃত্তাকার পাথরের স্তূপ থেকে পাথর সংগ্রহ করে কখন কোন এক ব্রাহ্মণ শালগ্রাম শিলা সংগ্রহ করেছিলেন, জানা নেই। অথচ অতি পবিত্র সেই শালগ্রামশিলার সঙ্গে হাজার হাজার বছরের আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের নিবিড় সম্পৃক্ততার খবর আমরা ক’জনই বা জানি? বাঙালি হিন্দু রমণীদের মাথার সিঁদুর বা ধান-দুর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করার রীতি সেই সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর কাছ থেকেই গৃহীত হয়েছে। ফলে বাঙালির আত্মচেতনায় সমন্বয়বাদী চেতনার প্রকাশ ঘটেছে বহুযুগ আগে থেকে। গ্রামীণ সমাজ চোখের মণির মতো রক্ষা করে চলেছে সেই বিপুল ব্যাপ্ত বৈচিত্র্য ও বৈভবকে। আজও প্রথাগত ধর্মকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই বাউল ফকিররা মানব ধর্মের প্রচার করে চলেছেন, যা বিপুল সংখ্যক বাঙালির কাছে এক পরম সম্পদ। ‘মানব সত্য’ – এই বার্তাই সৃষ্টি করেছে সেই অমোঘ সত্যের আহ্বান, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’।

ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা বাঙালির এই বিশাল ব্যাপ্ত ঐক্য চেতনায় বারবার আঘাত করেছে। পৈতে-টিকি, টুপি-দাড়ির ধর্মীয় বিভেদের বীজ বারবার চেষ্টা করেছে সমাজের গভীরে আঘাত করার। ধর্মীয় গোঁড়ামি বারবার চেষ্টা করেছে বাঙালির এই স্বতঃসলিলা ঐক্যবোধকে ভেঙে দিতে। যখনই তারা শক্তি সঞ্চয় করেছে, তখনই সম্প্রদায়গত বিভেদ মাথা চাড়া দিয়েছে। আর এই বিভেদই শেষ পর্যন্ত বঙ্গবিভাজনের মতো এক ভয়ঙ্কর অভিশাপ ডেকে এনেছে বাঙালির হাজার বছরের সমন্বয়বাদী সমাজকে দু’টুকরো করে। একসময় বিভাজিত বাংলা পরিচিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব পাকিস্তান নামে। পরবর্তীকালে বাঙালি জাতিচেতনাই পূর্বপাকিস্তান নামক ভূখণ্ড থেকে পাকিস্তান শব্দটি মুছে দিয়ে এক স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। সাতচল্লিশে বঙ্গ বিভাজনের পরের বছর থেকেই দাবি উঠেছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। সেই দাবি দাবানলের মতো আছড়ে পড়লো ১৯৫২ সালে। ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাস রচিত হল শহিদদের আত্মবলিদানের মধ্য দিয়ে। বাংলাভাষার মর্যাদার দাবিতে সেই সংগ্রাম ক্রমশ জাতিসত্তার সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়। শেষ পর্যন্ত দাবি ওঠে ‘বাংলা ভাষার রাষ্ট্র চাই’। ৩০ লক্ষ শহিদের রক্তে রঞ্জিত এই স্বাধীন রাষ্ট্র জন্ম নেয়, যা বাঙালির একান্তই নিজের।

ধর্মের ভিত্ততে ভারত তথা বঙ্গ বিভাজনের ফলে অবিভক্ত বাংলার পশ্চিমাঞ্চল যুক্ত হয় ভারতরাষ্ট্রে। বিভক্ত এই রাজ্যটির নাম হয় ওয়েস্ট বেঙ্গল। ব্রিটিশ ভারতের নর্দার্ন প্রভিন্স বা সেন্ট্রাল প্রভিন্স যথাক্রমে উত্তরপ্রদেশ বা মধ্যপ্রদেশ বলে চিহ্নিত হলেও স্বাধীন ভারতে ওয়েস্ট বেঙ্গল পশ্চিমবঙ্গ হয়ে উঠতে পারেনি আজও। সংবিধানে আজও আমরা ওয়েস্ট বেঙ্গলের অধিবাসী, পশ্চিমবঙ্গের নয়। সাত দশকেও রাজ্যের শাসককুল কখনোই চেষ্টা করেননি এই ভ্রম সংশোধনের। আসলে রাজ্যের নবজন্মের পর থেকেই এই বাংলার শাসন ক্ষমতায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা একটা পর্যায় পর্যন্ত ইন্ডিয়ান বা ভারতীয় হয়ে ওঠার সাধনায় মগ্ন ছিলেন। দ্বিতীয় পর্বে শাসককুল আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠায় চেষ্টিত হলেন। ফলে আমাদের বাঙালিত্ব বিসর্জন দিতে কেউই দ্বিধা করেননি। বিপরীতে আবহমান বাংলার লোকজ সংস্কৃতিকে পণ্য করে অনুদান, পুরষ্কার, ভাতা, ইত্যাদির প্রলোভন দেখিয়ে শাসককুল এক ধরনের দাস সংস্কৃতির পরিমণ্ডল তৈরি করেছেন। রাজ-অনুগ্রহ বিতরণের ঢক্কানিনাদে গ্রামীণ সংস্কৃতির পরম্পরা আজ ধ্বংসের মুখে। আমাদের সারি-জারি, আউল-বাউল, ভাওয়াইয়া, গম্ভীরা, টুসু, ভাদু, ভাটিয়ালি, কবিগান, আলকাপ, সবই আজ পণ্য সংস্কৃতির শিকার।

অন্যদিকে মাতৃভাষার মর্যাদার প্রশ্নটি সম্পূর্ণ অবহেলিত। রবীন্দ্র শতবর্ষে প্রণীত রাজ্য সরকারের ভাষা সংক্রান্ত আইন আজও কার্যকর হয়নি। আজও রাজ্য সরকারের অধিকাংশ কাজে বাংলাভাষা ব্রাত্য। এ বিষয়ে যাঁদের অগ্রগণ্য ভূমিকা থাকার কথা, সেই সব তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা নিজেরাই রাজ-অনুগ্রহের প্রত্যাশায় আত্মমর্যাদাকে বন্ধক রেখেছেন। বাংলার দুখিনী বর্ণমালাও তাই এঁদের কাছে শুধুই স্বর্ণমুদ্রা অর্জনের উপকরণ মাত্র।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় যাঁরা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন, তাঁদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে সূচনা হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের। ১৯৬১ সালের ১৯শে মে শিলচরের ১১ জন বাংলাভাষাপ্রেমী আসাম পুলিশের বুলেট বক্ষে ধারণ করে বরাক উপত্যকায় বাংলাভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী হিন্দি ভাষার, ইংরাজি ভাষার আধিপত্যের কাছে নিজেদের বিকিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিদিন। আসুন না, একবার, অন্তত একবার, সবাই মিলে রুখে দাঁড়াই! মিলিত কন্ঠে গেয়ে উঠি ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক আমি তোমায় ছাড়ব না মা’ ।।

0 comments:

0

প্রনব্ধঃ আফরোজা খাতুন

Posted in


প্রবন্ধ

ভাষা আন্দোলনে মেয়েরা
আফরোজা খাতুন



[লেখক পরিচিতি - প্রাবন্ধিক। নারী অধিকার অর্জন আন্দোলনে নিবেদিত। সম্পাদিকা, ফোরাম ফর এমপাওয়ারমেন্ট অফ উইমেন ইন ইন্ডিয়া। সহযোগী সম্পাদক, ইন্টারন্যাশানাল জার্নাল অফ বেঙ্গল স্টাডিস। অধ্যাপিকা, বাংলা বিভাগ, সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ফর উইমেন]

একুশ ফেব্রুয়ারি মানেই ভাষার জন্য লড়াই। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে লড়াই। পূর্বপাকিস্তানের বাঙালী ছাত্রছাত্রীরা,১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হয়ে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের (বর্তমান জগন্নাথ হল) দিকে মিছিল করে যাচ্ছিলেন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানাতে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৫২ –র ২৭ জানুয়ারি উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা ঘোষণা করলে, বিক্ষুব্ধ বাঙালী লাগাতার আন্দোলন শুরু করে। মিছিল, সমাবেশ, বন্ধের মধ্য দিয়ে প্রদেশব্যাপী একটি নির্দিষ্ট আন্দোলনের কর্মসূচি স্পষ্ট হয়।

রাজনৈতিক চক্রান্তে ভাগ হয়েছে বাংলা। অস্তিত্বের সংকট কাটিয়ে ওঠার আগেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালী আবার হতচকিত হন, রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে জেনে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ পূর্ববঙ্গবাসীর কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ সেই বছরের ১৯ মার্চ মুহম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকায় আসার কথা উর্দুর সপক্ষে ভাষণ দিতে। তাই ১১ মার্চ সমগ্র দেশ জুড়ে আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। বন্ধ, সমাবেশ ও মিছিল করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে জোরদার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এমন গণবিক্ষোভ এর আগে সংগঠিত হয়নি। শাসকের বদল ঘটেছে মাত্র। ইংরেজদের জায়গায় এসেছে পাঞ্জাবী শাসক। পরাধীনতা যে কাটেনি, পূর্বপাকিস্তানের বাঙালিরা টের পেয়েছিলেন। কারণ শুধু রাষ্ট্রভাষা উর্দুই নয়, পাকিস্তানের সমস্ত প্রদেশের স্কুলগুলিতেও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে উর্দুকেই গ্রহণ করার কথা ভাবা হয়েছিল। আর ছিল আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব। অথচ পাকিস্তানের ৬০ শতাংশ মানুষ তখন বাংলা ভাষাভাষী। আসলে প্রথম থেকেই পাকিস্তান সরকার ভেবে নিয়েছিল, আরামপ্রিয় ভীতু বাঙালীর বাসস্থান পূর্ব পাকিস্তান হবে তাদের উপনিবেশ – হবে খাজনা আদায়ের জমিদারি, শুল্ক আদায়ের বন্দর। এই সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থলোভেই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিল। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হলেও এই জাতীয়তাবোধ যে স্থায়ী সংহতি রক্ষা করতে পারবে না, সেটা নেতৃবৃন্দ জানতেন। তাই শোষণ কায়েম রাখার কৌশল হিসেবে বিরাট সংখ্যক বাঙালীর মুখের ভাষা, কাজের ভাষা, সাহিত্যের ভাষার ওপর আঘাত হানার প্রকল্প শুরু হয়। অবাঙালী প্রকাশকরা বাঙালীদের মনে ইসলামী উত্তেজনা জাগিয়ে রেখে স্থায়ী আনুগত্য পেতে চেয়েছিল। একে বঙ্গবিচ্ছেদের ব্যথা, এর পরেই বঙ্গসংস্কৃতি হারানোর আশঙ্কা – প্রচণ্ড নাড়া খেলেন পাকিস্তানের বাঙালীরা।তাই প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন উর্দু রাষ্ট্রভাষা হবে একথা ১৯৫২-র ২৭ জানুয়ারি ঘোষণা করলে, বাঙালী ছাত্রছাত্রীরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সেই বছরের (১৯৫২) ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা প্রাঙ্গণে সভা ও ঢাকার রাস্তায় মিছিল করেন। ১৯৫২ সালের ১১, ১২ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানে পালন করা হয় কালো পতাকা দিবস। বন্ধ, মিছিল ও সমাবেশের মধ্যে দিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন হয়। মাতৃভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন যখন তুঙ্গে,ঠিক সেই সময় আন্দোলনকে দুর্বল করার অভিপ্রায়ে পাকিস্তানের শাসক সম্প্রদায় ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করে। ফলে ২১ ফেব্রুয়ারির পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী, আইন পরিষদের সামনে সামনে মিছিল করে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা আইনত নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তবু সেদিন ভাষাপুত্র ও ভাষাকন্যারা সরকারের আইন অমান্য করেই বেরিয়ে পড়লেন আইন পরিষদের দিকে তাঁদের দাবি নিয়ে। ছাত্রছাত্রীদের সংগঠিত করার অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন গাজিউল হক। মিছিল করার দুঃসাহসিকতার শাস্তিস্বরূপ পাকিস্তান সরকারের পুলিশ বাহিনী কেড়ে নিল কিছু যুবকের প্রাণ। মাতৃভাষা বাংলার জন্য যে সব পুরুষ প্রাণ দিলেন, যুদ্ধ করলেন, আন্দোলনের শরিক হলেন, সেইসব পুরুষের ইতিহাস দৃশ্যমান হল। সমাজ, শিক্ষাক্ষেত্র, হোস্টেল সব জায়গার বাধা অতিক্রম করে যে মেয়েরা আন্দোলনের শরিক হলেন তাঁদের কথা আড়ালেই রইল,ইতিহাসের মূল স্রোতে আজও তেমন স্থান হল না।

আপসহীন প্রগতিশীল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত থেকেই গড়ে উঠেছিল ভাষা আন্দোলনের প্রাণ। তাই ভাষা আন্দোলনে মেয়েদের অংশগ্রহণ মূল ধারার বাইরে নয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে এই আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভূমিকা ছিল প্রধান। তবে পাশাপাশি স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ভূমিকাও কোনও অংশেই কম ছিল না। যদিও ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের অংশগ্রহণ যথেষ্ট কম ছিল। কিন্তু তৎকালীন সমাজব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে মেয়েদের এই অংশগ্রহণও স্বীকৃতির দাবি রাখে। লেখক-সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সার দেশভাগের সময় পূর্ববঙ্গে চলে যান। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর দায়িত্ব ছিল ছাত্রীদের সংগঠিত করে, সচেতন করে,জাগিয়ে তুলে, আন্দোলনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে আন্দোলনকে শক্তিশালী করা। ভাষা-সৈনিক রওশন আরা বাচ্চু বলেন, “বিজ্ঞান ও কলা বিভাগ মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ছাত্রীসংখ্যা ৬০/৭০ এর বেশি হবে না। তখনকার সময়ে ছেলেদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা নিষিদ্ধ ছিল। প্রক্টরের মাধ্যমে কথা বলা হতো। নিয়ম না মানলে দশ টাকা জরিমানার ব্যবস্থা ছিল। শিক্ষক ক্লাসে যাওয়ার সময় ছাত্রীদের কমনরুম থেকে ডেকে নিয়ে যেতেন। ছাত্রীরা মাথায় কাপড় দিয়ে,অনেকে বোরখা পরে ক্লাস করত। ক্লাসে মেয়েরা শিক্ষকের সামনের সারিতে বসত। কিন্তু সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা সামাজিক বাধাবিপত্তি – বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হোস্টেল থেকে বের করে দেবেন অথবা অভিভাবকগণ পড়াশোনা বন্ধ করে দেবেন – সব কিছুকে অগ্রাহ্য করে সংগ্রামী ভাইদের সঙ্গে সমভাবে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল”।১

রওশন আরা বাচ্চু ২১-এর আন্দোলনে আহত হন। সেদিন সকাল থেকেই তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী সংগ্রহ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় নিয়ে আসেন। পাঞ্জাবী শাসক ১৪৪ ধারা জারি করেছে আন্দোলন বন্ধ করতে।ছাত্রছাত্রীরা ১৪৪ ধারা ভেঙে আইন পরিষদের দিকে যাবেন তাঁদের দাবি জানাতে।প্রায় তিনিটি ট্রাক বোঝাই পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট ঘিরে ফেলে। বিপদজনক পরিস্থিতি বুঝে ভাইস চ্যান্সেলার সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন ১৪৪ ধারা ভাঙতে নিষেধ করেন। কিন্তু সেদিন ভাষা সৈনিকদের আটকানো যায়নি। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা, সেদিন মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন ছাত্রীরা। ১০ জন করে ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট দিয়ে বেরিয়ে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে আইন পরিষদের দিকে এগিয়ে যান। এইভাবে মেয়েদের তিনটি দল বেরোয়। রওশন আরা বাচ্চু এই মেয়েদের মিছিল বেরোনোর তত্বাবধান করেন এবং মেয়েদের তৃতীয় দলে অংশ নেন। ছাত্রীদের পিছনে বেরোতে থেকেন ছাত্ররা। অপরদিকে শুরু হয়ে জয়ায় কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া, লাঠিচার্জ, গ্রেফতার। এই দমন পীড়নের মধ্য দিয়েই মিছিল এগোচ্ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য পূর্ব বঙ্গের আইন পরিষদের দিকে, বাংলা ভাষার দাবি নিয়ে। কিন্তু মেডিকেল কলেজের সামনেই পুলিশের এলোপাথাড়ি গুলি শুরু হয়। দিশেহারা হয়ে রওশন আরা বাচ্চু আশ্রয় নেন ভাঙা রিক্সার স্তূপের মধ্যে। সেটাও নিরাপদ নয় বুঝে বহু কষ্টে কাঁটা তারের বেড়া ডিঙিয়ে একটা বাড়ির বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ান। তাঁর মতই আহত ভাষা-সৈনিক সারা তৈফুর, সুফিয়া ইব্রাহিম, বোরখা পরিহিতা শামসুন, প্রমুখরাও সেখানে আত্মগোপন করেছিলেন। এমন আতঙ্কজনক অবস্থায় তাঁদের মনোবল একটুও দুর্বল হয়নি। বরং ন্যায় ও সত্যের লড়াইয়ে অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে আরও কঠিন শপথ গ্রহণ করেন।

২১-এর আন্দোলন শুরু করেছিলেন ছাত্রছাত্রীরা। পুলিশের গুলিবর্ষণে নিহত রফিক, জাব্বার, সালাম, বরকত ও বহুজনের আহত হওয়ার ঘটনায়, এই আন্দোলন গণআন্দোলনের রূপ নেয়। পুলিশের গুলিতে নিহত মৃতদেহগুলি পুলিশ ও সেনাবাহিনী জোর করে ছাত্রদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে য়ায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল গোপনে কবর দিয়ে ভাবাবেগ কিছুটা দমন করা। কবর স্থানের চিহ্ন কাউকে জানতে দিতে চায়নি তারা। তবু কিছু সাহসী যুবকের অনুসন্ধানে কবরগুলি শনাক্ত হয়। আর তাই আজও ২১ ফেব্রুয়ারি আজিমপুর গোরস্থানে প্রভাত ফেরী করে শহীদদের শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো হয়।

১৯৫২-র অভাবনীয় ঘটনায় হতচকিত ছাত্রীরা সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনে দলে দলে ভাগ হয়ে, বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন টাকা তোলার জন্য। আন্দোলন চালাতে গেলে অর্থ দরকার। এই গুরু দায়িত্ব কেউ অস্বীকার করেননি। পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে তাঁরা অর্থ সংগ্রহ করেন। অনেক বাড়ির মহিলা তাঁদের হাত, কান, গলা থেকে সোনার অলঙ্কার খুলে ভাষা আন্দোলনের তহবিলে দান করেন। ২১-র নারকীয় অত্যাচারের অভিজ্ঞতায়, আরও বৃহত্তর আন্দোলনের জন্য তাঁরা প্রস্তুতি নিতে থাকেন। মূলত হোস্টেলের ছাত্রীরা যেমন অর্থ সংগ্রহ করেছেন, সেইসঙ্গে সারারাত জেগে পোস্টার লিখেছেন। রওশন আরা বাচ্চুর মতই মোসলেমা খাতুন, হালিমা খাতুন, কায়সার সিদ্দিকী, সারা তৈমুর, সুফিয়া খান, ডঃ শরিফা খাতুন, গুলে ফেরদৌস, মনোয়ারা ইসলাম, রওশন জাহান ইসলাম, প্রমুখ হোস্টেল-ছাত্রীরা এই ভাষা আন্দোলনের শরিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভষা-সৈনিক সুফিয়া আহমেদ অবশ্য বাড়ি থেকেই আসতেন।আন্দোলনের অগ্রণী ভূমিকায় থেকে, তিনি একেক দিন ঢাকার একেক এলাকায় চাঁদা তুলে নিয়ে আসতেন। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপস্থাপনায় কাজী খালেদা খাতুন, জুলেখা হক বা রওশন আহমেদ দোলনের মত অনেক স্কুল পড়ুয়া ২১-এর ভাষা আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা প্রাঙ্গণের সমাবেশে হাজির হয়েছিলেন। নির্দিষ্ট সময়ে স্কুলের গেটে উপস্থিত হয়ে স্কুলে না ঢুকে তাঁরা সভায় চলে আসেন। বাড়ি ফেরার পথ তাঁরা ঠিকমত চিনতেন না। মিছিল ছত্রভঙ্গ হলে, বহুকষ্টে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে ঐ ছাত্রীরা পথ খুঁজে বাড়ি ফেরেন।যুদ্ধের ভূমিকে মজবুত করতে এই যে মেয়েরা সক্রিয় ছিলেন, মূলস্রোতে তাঁরা জায়গা না পেলে হয়তো বা ইতিহাস খনন করে তাঁদের জন্য আগামীতে আলাদা ইতিহাস রচিত হবে।

২১-এর ভয়াবহ কাণ্ড ঘটার পর ছাত্ররা মেডিকেল কলেজ ও সলিমুল্লাহ হল –এই দুটি জায়গাতে কন্ট্রোল রুম খোলেন। সেখান থেকে বর্তমান পরিস্থিতি ও আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচীর ঘোষণা অবিরাম চলতে থাকে। যাঁরা আন্দোলনের শরিক ছিলেননা, এবার তাঁদের মধ্যেও জেগে ওঠে সংগ্রামী চেতনা, দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়। সলিমুল্লাহ হল পুলিশ ঘিরে রেখেছিল আন্দোলনকে দুর্বল করতে।ছাত্রদের ঠিকমত খাবারও জুটতো না। সেই সময় ইডেন কলেজের ছাত্রী ভাষা-সৈনিক গুলে ফেরদৌস স্মৃতিচারণে বলেছেন – “আমরা হোস্টেলের মেয়েরা কোঁচড় ভরে খাবার নিয়ে জানালা গলিয়ে আন্দোলনরত ছাত্রদের তুলে ধরা শার্টের ভেতর খাবার ঢেলে দিয়েছি। কারণ সলিমুল্লাহ হল পুরোটা পুলিশ দ্বারা প্রহরাবেষ্টিত ছিল। লুকিয়ে লুকিয়ে আবাসিক ছাত্ররা রাতের অন্ধকারে আমাদের কাছ থেকে খাবার নিয়ে খেত। কর্তৃপক্ষ মেয়েদের হোস্টেলের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিল। আমাদের স্টাডিরুম ছিল রাস্তার পাশে। কাজেই সেই ঘরের জানালা দিয়ে আমরা সবকিছু দিতে পারতাম। তখন প্রতিরাতে সলিমুল্লাহ হল থেকে ভেসে আসত – ‘ভাইসব, সালাম, রফিকের রক্তের কথা ভুলে যেও না,শুনতে কি পাওনা তাদের আত্মার দীর্ঘশ্বাস, তাদের কান্না!’ ১৪৪ ধারা তখনও বলবৎ। হঠাৎ একদিন সলিমুল্লাহর কয়েকজন ছাত্র এসে জানাল, আজ রাতে হল সার্চ করা হবে। মাইক কেড়ে নেবে। কি করা যায়? আমরা ওদের আশ্বস্ত করে বললাম, মাইক দিয়ে যান। আমরা লুকিয়ে রাখব। সেদিন রাতের অন্ধকারে ওরা তিনটে মাইক আমাদের কাছে দিয়ে গিয়েছিল। ভেতরে পুকুরপাড়ে একটা বড় গর্ত ছিল। সেটাতে মাইকগুলো রেখে ওপরে বড়ইর কাঁটা দিয়ে ঢেকে রেখেছিলাম।”২ পরিস্থিতির ভয়াবহতায়, ছাত্রীরা হোস্টেল থেকে বেরোনোর
অনুমতি পেতেন না। কিন্তু তাই বলে কি তাঁদের দমানো গিয়েছিল? অনেক সময় হোস্টেলের দেওয়াল টপকিয়ে যাতাযাত করেছেন। ইঁটের পরে ইঁট সাজিয়ে প্রাচীরের ওপর উঠে ঝাঁপ দিয়েছেন। এরজন্য কর্তৃপক্ষ বকাবকি করলেও তাঁরা দমেননি। তাঁরা অভুক্ত ছাত্রদের জন্য খাবার নিয়ে গেছেন। জেলে বন্দী অনশনরত ভাষা-সৈনিকদের কাছে খাবার নিয়ে গিয়ে তাঁদের অনশন ভঙ্গ করিয়েছেন।

ভাষা আন্দোলনের এক কিংবদন্তী চরিত্র নাদেরা বেগম। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে, সেই সময়ের সরকার বিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন নেতৃত্বের ভূমিকায়। ছাত্রীদের নেতৃত্ব দানের জন্য তাঁকে কারাগারে যেতে হয়। কারাগারে তাঁর উপর কঠোর নির্যাতন চলে। তবু তাঁর মনোবলে চিড় ধরাতে পারেনি পাকিস্তান স্বৈরশাসক। কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও তাঁর উপর পুলিশ বিশেষ নজর রাখত। যার ফলে ১৯৫২-র ২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনে তাঁর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ সম্ভব হয়নি। ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকার প্রথম মহিলা সাংবাদিক লাইলা সামাদ, যিনি সাহিত্যিকও ছিলেন, ভাষা আন্দোলনের সংগঠক কর্মী হিসেবে তাঁর একটা বড় ভূমিকাও ছিল। সুফিয়া কামালের দুই মেয়েই (সুলতানা কামাল, সাইদা কামাল) তখন ছোট। তবু দুটি শিশুকে কোলে নিয়েই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় সমাবেশে যোগ দিতেন। কামরুননেসা, আনন্দময়ী, ইলা বক্সী, বেনু ধর, এঁরা সকলেই ছিলেন ভাষা-সৈনিক। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনে প্রথম জেলে যান নারায়ণগঞ্জের শিক্ষিকা মমতাজ বেগম। তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে শুনেই নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পুলিশ মমতাজ বেগমকে নিয়ে ঢাকায় যেন যেতে না পারে তার চেষ্টা করে সেখানকার মানুষ। শত শত গাছ কেটে, কয়েক মাইল জুড়ে রাস্তায় ফেলে ব্যারিকেড তৈরি করে পুলিশের গাড়ি আটকানোর জন্য। স্বৈরাচারী শাসক বন্ড সই করে তাঁকে মুক্তি দিতে চেয়েছিল। কিন্তু মমতাজ বেগম এই বন্ড সই-এর মুক্তি নিতে অস্বীকৃতি জানান।এর ফলে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে বিচ্ছেদ আসে। স্বামী তাঁকে তালাক দেন।সিলেটের ছালেহা বেগম, স্কুলে কালো পতাকা উত্তোলন করেছিলেন বলে সেখানকার ডি সি-র আদেশে তাঁকে তিন বছরের জন্য স্কুল থেকে বার করে দেওয়া হয়। এরপর তাঁর আর পড়া হয়নি। সিলেটের অন্য ভাষা-সৈনিকরা হলেন যোবেদা খাতুন চৌধুরী, শাহেরা বানু, সৈয়দা লুৎফুন্নেছা খাতুন, সৈয়দা নজিবুন্নেছা খাতুন, রাবেয়া খাতুন, প্রমুখ।

১৯৫২ সালে চট্টগ্রাম কলেজের আই এ ক্লাসের ছাত্রী ছিলেন প্রতিভা মুৎসুদ্দি।ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে যে আন্দোলনের জোয়ার শুরু হয়, তাতে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর পুরোপুরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। পরীক্ষার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার ২১-এর মিটিং-এ যাবেননা ঠিক ছিল। কিন্তু হঠাৎ খবর পেলেন কিছু ছাত্রীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছেয়ে গেছে মিলিটারিতে। পরীক্ষার পড়া বন্ধ রেখে,উইমেন্স হোস্টেল থেকে মেয়েদের একটা দল নিয়ে মিলিটারিদের মধ্যে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজির হন। শুরু হয় পুলিশের লাঠি চার্জ। তার ঘা প্রতিভা মুৎসুদ্দির গায়েও পড়ে। তিনি জানাচ্ছেন – “একজন ছাত্র আমাকে কোলে করে বারান্দায় পৌঁছে দিল। আমরা দোতলায় ছাত্রীদের কমনরুমে গেলাম। সেখান থেকে দেখলাম মিলিটারি, মধুর ক্যান্টিন, কমার্স বিল্ডিং ও একতলা থেকে ছাত্রদের ধরছে। কেউ কেউ দেওয়াল টপকে মেডিকেল কলেজ ক্যাপাসে ঢুকে আত্মরক্ষা করছে। আমরা ৭ জন, - আমি, কামরুননাহার লাইলী(প্রয়াত), ফরিদা বারিক মালিক, হোসনে আরা আপা(ইংরেজী), লায়লা নুর(ইংরেজী) ও আরও দুইজন বেশ ক’ঘন্টা পর লাইব্রেরিতে যাই। ...যখন প্রায় সন্ধ্যা হয় আমরা ঠিক করলাম আলাদাভাবে ধরা না দিয়ে একসাথেই ধরা দেবো। আমরা সারিবদ্ধ হয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে পৌঁছই তারা আমাদের ভ্যানে উঠতে নির্দেশ দিল। ঐ সময় যত ছাত্র ক্যাম্পাসে লুকিয়েছিল সবাই এগিয়ে এলো। প্রায় কয়েকশত ছাত্রছাত্রী। প্রথমে আমাদের লালবাগ থানায় নিল – প্রত্যেকের নামে আলাদা ওয়ারেন্ট লিখল। এরপর রাতে কেন্দ্রীয় কারাগারে।”৩

জাতির স্বপ্ন ও আশা আকাঙ্খার মূর্ত প্রতীক এই ছাত্রছাত্রীরা ক্রমাগত কর্মসূচি তৈরী করে আন্দোলনকে জোরদার করে তোলেন। কন্ট্রোলরুম থেকে ক্ষণে ক্ষণে ছাত্ররা পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করে চলে। ১৯৫২-র ২২ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের চূড়ান্ত অভিব্যক্তির দিন। সকালে ‘গায়েবি জানাজা’ পড়া হয়। তারপর ১৪৪ ধারা অমান্য করেই জনসাধারণ শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে শোভাযাত্রা করে বর্বর হত্যা কাণ্ডের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। শোভাযাত্রার মাঝে হঠাৎ পুলিশের লাঠিচার্জ শুরু হয় এবং জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য গুলি চলে। হাইকোর্টের কেরানী শফিউর রহমান এখানে শহীদ হন। এই ভাবে প্রতিদিন ঢাকা শহরে বন্ধ,মিছিল আর পুলিশ–জনতার সংঘর্ষ চলতে থাকে। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে শহীদ বরকতের গুলির জায়গায় ছাত্ররা তৈরি করেন প্রথম শহীদ মিনার। হোস্টেলের মেয়েরা ভোরে উঠে, খালি পায়ে সাদা শাড়ি পরে শহীদ মিনারে যান শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে। তাঁরা ছাড়াও অসংখ্য মেয়ে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে সোনার অলঙ্কার খুলে দেন মিনারের পাদদেশে, আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অভিপ্রায়ে।ভাষা আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন আকস্মিক ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের কাছে নির্দেশ আসে হোস্টেল খালি করার। সরকারের নির্যাতনের মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছয় ২৬ ফেব্রুয়ারি। সলিমুল্লাহ হলের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে ৩০ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারপর মেডিকেল কলেজে ঢুকে শহীদের স্মৃতিস্তম্ভকে ধ্বংস করে ফেলে। তাই সেদিন কবির কন্ঠে ধ্বনিত হয় –

‘ইঁটের মিনার ভেঙেছে, ভাঙুক। একটি মিনার গড়েছি আমরা
                                                    চারকোটি পরিবার
হাজার মুঠির বজ্র শিখরে সূর্যের মতো জ্বলে শুধু এক
                                                              শপথের ভাস্কর’।
                                                      (আলাউদ্দিন আল আজাদ, ‘স্মৃতিস্তম্ভ’)

পাকিস্তানের বাঙালী চেতনার শুদ্ধতার উদ্বোধন এই একুশে। গোটা দেশের বাঙালী ৫২-র একুশে একপ্রকার শপথ নিয়েই ১৯৬৯-এর গণ-আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাওয়া এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে ওঠার পিছনে রয়েছে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২-র অবদান। তাই ভাষা-শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে গড়ে তোলা শহীদ মিনার পাকিস্তান সরকার বারবার ভেঙে ফেলে, দৃঢ় করে তুলেছিল বাঙালীর মানসিক শক্তিকে। সেই শক্তির জোরেই সংগ্রামী অভিযান এবং জয়লাভ – যার শরিক ছেলে ও মেয়েরাও।



তথ্যসূত্র

১। তুষার আব্দুল্লাহ সম্পাদিত ঃ ভাষাকন্যা, নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা, ঢাকা, ১৯৯৭, পৃ – ৪।
২। তুষার আব্দুল্লাহ সম্পাদিত ঃ ঐ, পৃ – ৪৪।
৩। তুষার আব্দুল্লাহ সম্পাদিত ঃ ঐ, পৃ – ৩০।


ঋণ স্বীকার

১। মজহারুল ইসলাম ও ডঃ চিত্ত মণ্ডল সম্পাদিত ঃ মহান একুশে – সুবর্ণ জয়ন্তী সংকলন, নবজাতক প্রকাশন, কলকাতা, ২০০২।
২। তুষার আব্দুল্লাহ সম্পাদিত ঃ ভাষাকন্যা, নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা, ঢাকা, ১৯৯৭।
৩। ‘একদিন’ দৈনিক পত্রিকা, কলকাতা, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১২।

0 comments:

1

প্রবন্ধঃ ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


আমার একুশে পালন
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



১৯৯৯এর ১৭ই নভেম্বর বিশ্ব সংগঠন ইউনেসকো ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটিতে ‘বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস’ পালনের আহ্বান জানানোর পর বিশ্বের নানা প্রান্তের সঙ্গে এ বাংলাতেও ‘ভাষাদিবস’ পালনের রেওয়াজ শুরু হয়। ওপার বাংলাতো বটেই, এ বাংলাতেও দু’একটি ভাষাসংগঠন আরো আগে থেকেই ‘ভাষা শহীদ দিবস’ পালন করে আসছে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিতে। এপারের বরাক উপত্যকার বাংলাভাষীরা বিনম্র শ্রদ্ধায় একষট্টির ভাষা আন্দোলনে হত এগারো শহিদের স্মৃতিতর্পণ করেন প্রতি বছর ১৯শে মে, যারা নিজ মাতৃভাষার মর্যাদার দাবিতে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে শহিদ হয়েছিলেন। এটা ভাষাদিবস পালনের একটি দিক।

একুশে পালনের তাৎপর্য শুধুমাত্র ভাষা শহিদদের স্মৃতিতর্পন নয়, আরো কিছু।একুশে যেমন ভাষাশহিদ দিবস, তেমনই মাতৃভাষা দিবসও। একুশে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা এবং আমাদের জীবনচর্যায় মাতৃভাষাকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দানের প্রত্যয়কে প্রসারিত করার দিন। মাতৃভাষার প্রতি মর্যাদার আবেগ থেকেই কানাডার ভ্যানকুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের  তৎকালীন মহাসচিব কোফি আন্নানের কাছে ১৯৯৮ সালে। কোফি আন্নানতাঁদের জানান যে ব্যক্তি উদ্যোগে এমন প্রস্তাব নেওয়া যায় না। অতঃপর বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে সরকারীভাবে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেওয়া হয়।বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রপুঞ্জের তৎকালীন ডেপুটি মহাসচিব কলিন পাওয়ারের কাছে বিশ্বের নানান জনজাতির মাতৃভাষার বিপন্নতার কথা তুলে ধরেছিল। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা’ দিবস রূপে পালনের আহ্বান জানায়।

এমন নয় যে পঞ্চাশ বছর পরে উন্নত প্রথম বিশ্বের মাতব্বরদের সংগঠন রাষ্ট্রসঙ্ঘ আচমকা ১৯৫২র রক্তক্ষয়ী ভাষা আন্দোলনের প্রতি বা ভাষা শহীদদের প্রতি সহানুভুতিশীল হয়ে উঠেছিল। যদিও এটা ঠিক যে ২১শে ফেব্রুয়ারি ভিন্ন‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালনের অপর কোনও দিন হতে পারে না।কারণ, মাতৃভাষার জন্য জীবন দানের নজির বিশ্বের কোনও প্রান্তেই নেই।১৯৬১র ১৯শে মে ভারতের কাছাড় জিলার শিলচরে ১৯জন তরুণের রক্ত ঝরেছিল মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রামেই। বস্তুত গত শতকের নব্বই-এর দশকের শুরু থেকেই উন্নত বিশ্বের ভাষাবিজ্ঞানীরা লাগাতার গবেষণা শুরু করেছিলেন বিশ্বায়ন বা পণ্যায়ন কিভাবে অনুন্নত জনগোষ্ঠীর ভাষাগত ভারসাম্য এলোমেলো করে দিতে পারে, কিভাবে ভাষাগত বহুত্ববাদকে ধ্বংশ করতে চাইছে সে বিষয়ে। সেইসব গবেষণায় এক ভয়াবহ ছবি উঠে এসেছিল যে এই শতাব্দীর মধ্যে এখন বিশ্বে প্রচলিত সাতহাজার মাতৃভাষার মধ্যে ছয় হাজার ভাষাই লুপ্ত হয়ে যাবে যদি না ভাষা বিলুপ্তির এই প্রবণতাকে ঠেকানো যায়। এই তাগিদ থেকেই তৃতীয় বিশ্বের ভাষাগোষ্ঠীগুলির ভাষা বিলুপ্তি সম্পর্কে সচেতনতা জাগ্রত করার জন্যই ‘বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস’ পালনের আহ্বান। সংশয় নেই যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের দিনটি ২১শে ফেব্রুয়ারি ধার্য করাটা বাংলাভাষী আমাদের এক অভূতপূর্ব অর্জন। আমাদের কাছে ‘একুশে’ শব্দটাই এক অসামান্য প্রতিজ্ঞা এবং সাহসের আগ্নেয়গিরির প্রতীক। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, বছরের এই একটা দিন ভাষাশহীদদের স্মরণ আর বাকি তিনশো চৌষট্টি দিন ভাতঘুম দেওয়া। এপারে ‘ভাষা দিবস’এর চেহারাটা এই রকমই। ঘটা করে ভাষাশহীদ দিবস পালন করি, শহীদবেদীতে ফুলমালা চড়াই, কিন্তু যাদের কাছে ‘ভাষা দিবস’এর তাৎপর্য পৌঁছানো অতি প্রয়োজন, তারা অধরা থেকে যায়। হয়তো কোনও মা তাঁর বালক পুত্রকে শুধোলেন, হ্যাঁরে, স্কুলে আজ ভাষাদিবসে তোর গান কেমন হ’ল? পুত্র উত্তর দিল, ‘ফ্যান্টাসটিক মাম্মি’, ‘সলিড গান গেয়েছি’! মা তাকে ধমক দেবেন না মোটেই। বরং গর্বিত হবেন, এটাই এখনকার বাস্তব ছবি! বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য কিংবা রাষ্ট্র সঙ্ঘ দ্বারা এই ভাষাকে বিশ্বের মধুরতম ভাষা স্বীকৃতিদানে এপারের বাঙালিরাও গর্বিত নিশ্চিতভাবেই, কিন্তু তরুণ প্রজন্মের দৈনন্দিন চর্যায় সেই আবেগের কোন প্রতিফলন দেখা যায় না। বাংলাভাষার সঙ্গে তাদের অনাত্মীয়তাই বেড়ে চলে, এটা নির্মম সত্য।

এপারে বাংলা ভাষাটা অর্থনীতির ভাষা নয়, চাকুরীর ভাষা নয়, বাণিজ্যের ভাষাও নয়। এটা তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে নিজের মাতৃভাষার অনাত্মীয়তা গড়ে ওঠার একটা কারণ বটে। কিন্তু সেটাই সব নয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মাতৃভাষার প্রয়োগে অনীহার এটা কোনও যুক্তিই হতে পারে না। দৈনন্দিন জীবনে মাতৃভাষায় কথা না বলার জন্য কত শব্দ যে লোপ পেয়ে যাচ্ছে তার হিসাব হয়তো এখন করছি না, হয়তো পঞ্চাশ বছর পরের প্রজন্ম দেখবে অনেক বাংলা শব্দই হারিয়ে গেছে, লুপ্ত হয়ে গেছে। ‘সারিবদ্ধ’ – এই বাংলা শব্দটা কি আর বলি কদাচ? বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও ছাত্রদের বলেন ‘লাইন’ দিয়ে দাঁড়াও। ‘চূড়ান্ত’ এমনই আর একটা শব্দ প্রায় হারিয়ে গেছে ‘ফাইনাল’কে জায়গা ছেড়ে দিয়ে। কোনও উজ্জ্বল তরুণের কাছে ‘বিপণি’ শব্দটা অচেনা। সে চিনেছে ‘শপিং মল’।

উন্নত দেশগুলি সৃষ্ট অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন ও পণ্যায়নের লক্ষ্য অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা ও উন্নয়নশীল তৃতীয় বিশ্বের ভাষাগত ভারসাম্য এবং সেইসঙ্গে মাতৃভাষার আবেগ আমাদের যে সাংস্কৃতিক পরিচয়ে বেঁধে রাখে সেটিকেও ধ্বংস করা। আর এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে জনজাতি গোষ্ঠীর ভাষাগুলি। তারা চায় সারা বিশ্ব মাত্র পাঁচ/ছয়টি ভাষায় কথা বলবে। ভাষার নৃতাত্বিক উপযোগিতা তারা স্বীকার করে না। মনে করে ভাষার কাজ শুধুমাত্র সংযোগ সাধন বা কমিউনিকেট করা। পণ্যায়ন ও ভোগবাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক আজকের তরুণ প্রজন্মও তাই মনে করে। মনে করে নিজ মাতৃভাষা উচ্ছন্নে গেলে তার কি? ভোগবাদের অনন্ত পারাবারে সাঁতার দেওয়ার অবাধ স্বাধীনতা তো তার আছে! আর সেই কাজ সুসম্পন্ন করতে তাকে মাতৃভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়ায় সুচতুরভাবে নিরন্তর কাজ করে চলেছে সংবাদপত্র, টেলিভিশন আর বানিজ্যিক বিজ্ঞাপন। বহুজাতিক বানিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলি হিন্দি, ইংরাজি বাংলা মিলিয়ে এক অদ্ভুত জগাখিচুড়ি ভাষা আমদানি করছে আর তরুণ প্রজন্ম অভ্যস্ত হয়ে উঠছে সেই ভাষায়, ‘ইন্ডিয়া কেয়ার করবে, ইন্ডিয়া শেয়ার করবে’।সাম্প্রতিক সময়ের আর এক প্রবণতা – অন্তর্জালের বিভিন্ন সামাজিক পরিসর ও চলভাষ বার্তায় রোমান অক্ষরে মাতৃভাষা লেখার ক্রবর্ধমান প্রবণতা। ফলে অনেক আঞ্চলিক ভাষার বর্ণমালা হারিয়ে যাচ্ছে। তেলেগু ভাষায় কয়েক প্রজন্মের মানুষ জানে না সে ভাষায় এক থেকে নয় সংখ্যাগুলি কেমন লেখা হত। তারা ১ থেকে ৯ সংখ্যাগুলি লেখে ইংরাজিতে। সম্প্রতি অন্তর্জালের সামাজিক পরিসর বা স্যোশাল মিডিয়ায় এক তরুণের লেখা পড়লাম। লিখেছেন মাতৃভাষার বর্ণমালার ব্যবহার বা শুদ্ধতা নিয়ে ভাববেন যারা সাহিত্য লিখছেন তারা, মনের ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে ইংরাজি বর্ণমালার ব্যবহারে ক্ষতি কি? তার মতে সংযোগ সাধন করাটাই মূল কথা। তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশই এমন মনে করে। কোনও ভাষাগোষ্ঠীর নিজের মাতৃভাষা ভিন্ন কোনও বর্ণমালায় লেখার ফলে কি বিপর্যয় ঘটতে পারে তার নজিরও অনেক রয়েছে। ‘বলিভিয়া’র মানুষ অতীতে কথা বলতো ‘আয়মারা’ ও ‘কুয়োছুয়া’ ভাষায়। তেল ও সীসার আকর্ষণে বলিভিয়ায় স্প্যানিশ উপনিবেশ স্থাপন করার পর দেখা দিল ভয়ঙ্কর ভাষা বিপর্যয়।বলিভিয়ার মানুষ তাদের ভাব প্রকাশের জন্য স্প্যানিশ বর্ণমালায় লেখা শুরু করলো। আর কয়েক বছরের মধ্যে বলিভিয়ার স্থানীয় ভাষা ও স্প্যানিশ ভাষার সংমিশ্রণে সৃষ্টি হল এক জগাখিচুড়ি ভাষা। মাত্র দেড় কোটি মানুষের জনসংখ্যার ছোট্ট দেশ বলিভিয়ায় এখন ৮৯% মানুষ কথা বলে স্প্যানিশ ভাষায় আর বাকি ৩৫টি স্বীকৃত আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে মাত্র ১১% মানুষ।

আমরা - এপারের বাংলাভাষীরা একটা আত্মপ্রসাদ লাভ করি যে আমাদের রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র আছে, আর ভাবি, যে ভাষায় এমন কালজয়ী সাহিত্যসম্পদ আছে, সে ভাষা বিপন্ন হতে পারে না কোনওদিন। হ্যাঁ পারে, এমন নজির অনেক আছে। কোনও ভাষার লিখিত রূপ বা সাহিত্য থাকা বা না থাকা সেই ভাষার বেঁচে থাকার একমাত্র শর্ত নয়, জরুরিও নয়। ভাষার লিখিত রূপ বা সাহিত্য এসেছে অনেক পরে। মৌখিক ভাষা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও সম্পদ অনেক বেশি।কোনও জনগোষ্ঠীর ভাষাবিলুপ্তির অর্থ তার পরিবেশেরও ধ্বংস সাধন হওয়া।তার পরিবেশ, আচার-আচরণ, তার অরণ্যসম্পদ ও বণ্যপ্রজাতি সম্পর্কিত জ্ঞানভাণ্ডারেরও বিলুপ্তি, যে জ্ঞানভাণ্ডার সঞ্চিত থাকে জনগোষ্ঠীর মৌখিক ভাষার মধ্যে। একটি জনগোষ্ঠীর ভাষা বিলুপ্তির অর্থ নৃতাত্বিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়া। মানুষের জ্ঞানভাণ্ডারের খুব সামান্য অংশই ভাষার লিখিত রূপ বা সাহিত্যে থাকে, মানুষের মৌখিক জ্ঞানভাণ্ডারের সম্পদ অনেক বেশি, অনেক বৈচিত্রপূর্ণ। এখন সারা বিশ্বে প্রচলিত ৭৩৫৮টি ভাষার মধ্যে ১৭৮টি ভাষায় কথাবলা মানুষের সংখ্যা মাত্র ১০জন, ২০০টি ভাষায় কথা বলে ১০জনেরও কম আর ৫১টি ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা ১ জন মাত্র। তাহলে জন্ম-মৃত্যুর স্বাভাবিক নিয়মে কয়েক বছরের মধ্যেই এই ভাষাগোষ্ঠীগুলির শেষতম মানুষটির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে লুপ্ত হবে ৪২৯টি ভাষাগোষ্ঠীর অতীত, তাদের মৌখিক জ্ঞানভাণ্ডারে সঞ্চিত বিপুল সম্পদ।

প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি আমার সামনে আসে ভাষাবিলুপ্তির এই ভয়ঙ্কর সত্যের ছবি নিয়ে। পীড়িত করে এই আশংকায় যে, আমার মাতৃভাষাও কি তবে এই পরিণতির শিকার হবে কোনও এক দিন? ভাষামৃত্যুর এই প্রবণতাকে রুখে দেওয়া যায় যদি মাতৃভাষায় কথা বলার পরম্পরাকে প্রজন্মের পর প্রজন্মে হস্তান্তর করতে পারি আর শিশুদের মাতৃভাষায় কথা বলার শিক্ষা দিই। আর কোনও বিকল্প নেই। ২১শে পালনের তাৎপর্য আমার কাছে এটাই। আগামী একশো বছর পরে আমার মাতৃভাষাটা বেঁচে থাকবে কি না কিংবা কতখানি বিকলাঙ্গ হয়ে বেঁচে থাকবে তা সময়ই বলবে। আপাতত আমার মাতৃভাষার ক্রম বিকলাঙ্গ হয়ে যাওয়ার দুঃসহ অবস্থা কেটে গিয়ে সোনালি রেখা দেখা দেবে - এমন কোন দূরতম সংকেতও পাওয়া যাচ্ছে না। তথাপি বিশ্বাসের একটা ভিত্তিভূমি থাকে।সেই বিশ্বাসের ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়ে, যে ভাষা আমার গর্বের আধার, যে ভাষায় সৃজনের এত বৈভব, তাকে ঘিরে যদি অসম্ভবের মিনারও নির্মাণ করি, তাতে গ্লানিবোধ থাকে না। সেই বিশ্বাসের ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখে চলি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার পংক্তিতে –
“একটি দুটি মানুষ আজও আঁধারে গান গায়
এতো আলোর মধ্যে আকাশ বাংলা ভাষায় ভরা
বুকের মধ্যে চলছে ছুটে সোনালি হরকরা”

1 comments:

1

প্রবন্ধঃ পল্লববরন পাল

Posted in



প্রবন্ধ


অমানুষের ভাষা 
পল্লববরন পাল



বাকিংহাম থেকে বারাণসী – শ্রীব্যাকরণ সিং, B.A. খাদ্যবিশারদদের গাত্রবর্ণের বিভিন্নতা বা দাড়ি ও লোমের ডিজাইন ও দৈর্ঘ্যপ্রস্থের তারতম্য থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু ভাষা একটাই – যে ভাষায় আবার একটাই মাত্র শব্দ – ব্যা| যদিও‘ছাগলে কী না বলে’ ব’লে একটা কথা অধুনা আমাদের বাংলার রাজনীতিতে প্রচলিত, যার মানে দাঁড়ায় – ছাগল সংস্কৃত ল্যাটিন ফরাসি ইংরেজি…‘অ-য়ে অজগর আসছে তেড়ে’ থেকে ‘রস জমে এই প্রপঞ্চময় বিশ্বতরুর শিকড়ে’…‘সাজানো ঘটনা’ থেকে শেক্সপিয়র গ্যাব্রিয়েল মার্কেজ়… বন্দে মাতরম থেকে ইনকিলাব জিন্দাবাদ - সবই বলতে পারে, কিন্তু দুঃখের কথা হলো - সত্যি সত্যি ছাগলে ‘ব্যা’ ছাড়া কিছুই বলেনা| কিম্বা মনে মনে হয়তো অনেক কিছুই বলে, কিন্তু আমাদের, মানে মানুষের কানে ঐ একটাই মাত্র শব্দ শুনতে পাই–‘ব্যা’|

গুয়াতেমালার গরুদেরও নাকি গুরগাঁওয়ের গরুর মতোই ‘হাম্বা’য় আনন্দ,‘হাম্বা’তেই দুঃখ, ‘হাম্বা’য় প্রেম-ফুর্তি-হৈহৈ আবার ‘হাম্বা’তেই ভয়-ভাবনা-ভির্মি –এমনকি নার্সারি রাইমসের বইয়ে লাফ দিয়ে চাঁদ ডিঙিয়ে যাবার সময়েও সেই একমেবাদ্বিতীয়ম্‌ ‘হাম্বা’|

কায়রো থেকে কামস্কাটকা - পৃথিবীর সর্বত্র কাকেশ্বরদের গলা ভাঙা –কাকেশ্বরীদেরও - এবং অসম্ভব একটা কর্কশ ‘কা’-‘কা’ শব্দেই তারা বাবা-মা-মাসি-পিসি সবাইকেই কাকা বলে সম্বোধন করে, ঐ ‘কা-কা’ই ওদের নিজেদের মধ্যে সবরকম ভাবের আদানপ্রদানের একমাত্র শব্দ| খাদ্য টুকরোর চারপাশে বৃত্তবৈঠক বা ইলেক্ট্রিকের তারে ওদের সরল রৈখিক সারিবদ্ধ পার্টিসম্মেলনে উত্তেজিত ভাষণ বা ‘কা-ষণ’ আমরা প্রায় সকলেই দেখেছি বা শুনেছি|

টিটাগড় থেকে টিউনিশিয়ার ঘরের দেয়ালে বা সিলিঙে টিকটিকিদের গলাতেও একটাই শব্দ, একটাই ভাষা – ‘টিক-টিক’ – পৃথিবীর সর্বত্র ঘড়িদের মতন,যদিও ঘড়ি আদপে একটি যন্ত্র, আর যন্ত্রের ভাষা ঠিক করে দেয় আবিষ্কর্তা মানুষ– যন্ত্রের নিজস্ব কোনও ভাষা হয়না - আচ্ছা, ঘড়ির ভাষা ‘টিক-টিক’ হলো কেন? আবিষ্কারের মুহূর্তে কোনও টিকটিকি ডেকে উঠেছিলো বলে কি? আমাদের সার্বজনীন সিধুজ্যাঠা ওরফে গুগুলদাদুকে পরে একবার জিজ্ঞেস করে দেখতে হবে|

যত হিঁদ-হিঁদ-হিঁদিক্কারী ফ্যাচাং তৈরি করেছে মানুষ – সবচেয়ে নাকি উন্নত প্রাণী,সুতরাং সবচেয়ে জটিল – আচ্ছা, উন্নতির সঙ্গে জটিলতার সম্পর্কটা সমানুপাতিক কেন? এই যে মানুষে মানুষে সম্পর্ক ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে, সে কি এই বিশ্বায়িত উন্নতির জন্য? এমন উন্নতিই কী আমরা চেয়েছি, যা আমাদের শুধু জটিল করে তুলবে? ভাবতে পারেন, পরিসংখ্যান বলছে - মানুষের পৃথিবীতে স্বীকৃত জীবিত ভাষার সংখ্যা - লক্ষ্য করুন, ‘জীবিত ভাষা’ - মানে ভাষারও জীবন-মৃত্যু আছে, তবে কি প্রাণও আছে? ভাষাও কি প্রাণী নাকি? ওরে বাবা,আরো জটিল হয়ে সব গুলিয়ে যাচ্ছে যে! – তো সেই স্বীকৃত জীবিত ভাষার সংখ্যা ২০১৫ সালের হিসেব অনুযায়ী ৭১০২টি, যার মাত্র ৬ শতাংশ ভাষা ব্যবহার করে পৃথিবীর ৯৪ শতাংশ মানুষ, এবং অবশিষ্ট ৯৪ শতাংশ ভাষা ব্যবহার করে বাকি ৬ শতাংশ মানুষ! হাজার হাজার ভাষা, তার মধ্যে কোটি কোটি শব্দ – লক্ষ লক্ষ প্রয়োগের নিয়মাবলী – কী যাচ্ছেতাই ব্যাপার! যত্তোসব!!

এখন প্রশ্ন হল, ভাষা কী? ভাষা কথা বলার একটা সাংকেতিক পদ্ধতি – এক বা একাধিক জীবগোষ্ঠীর সবাই যে সংকেতগুলো জানে এবং পদ্ধতি সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল| এককথায় –ভাষা হলো মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম| মনের ভাব প্রকাশ করা যায় কথার মাধ্যমে, লেখার মাধ্যমে, অথবা চোখের দৃষ্টি বা শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বিভিন্ন ইঙ্গিত বা ভঙ্গি দিয়ে| সেই সূত্রে মুখের বা লেখার ভাষা, চোখের ভাষা বা শরীরের ভাষা ইত্যাদি - ভাষার এরকম বিভিন্ন প্রকাশভেদ আছে| তার মানে ভাষা থাকলেই যে লিপি আছে, তা সব ক্ষেত্রে ঠিক নাও হতে পারে, তবে কোনও না কোনওরকমের সংকেত যে কোনও ভাষার ক্ষেত্রে অবশ্যই আছে| এবং যে কোনও ভাষারই প্রয়োগের প্রাথমিক শর্ত হলো – মন থাকতে হবে, সেই মনের আবার ভাব থাকতে হবে, যে ভাব শুধু থাকলেই হবে না, প্রকাশ করতেও হবে, অথবা অন্য স্বজাতি-স্বভাষীদের জানানোর তাগিদ থাকতে হবে|

প্রাণ যার আছে, তারই মন আছে, বোধ আছে – এটা বৈজ্ঞানিক সত্য| আমরা জানি| সুতরাং, যে কোনও প্রাণীরই কবি সুনীলের ভাষায় ‘কথা আছে, ঢের কথা আছে’ - সেই কথা প্রকাশের তাগিদের জন্য কোনও না কোনও পদ্ধতি আছে,অর্থাৎ ভাষা আছে, মানে থাকবার কথা|

ব্যাস, এটুকু লিখেই স্বখাতসলিলে আমার সমাধি হইলো, মানে ঝপ করিয়া ঝামেলা পুকুরে পড়িলাম – প্রিয় পাঠক, এতো কম জ্ঞান নিয়ে প্রবন্ধ লেখা যায়?প্রবন্ধ লেখা কি চাট্টিখানি ব্যাপার? সম্পাদিকা তো তাঁর নিজস্ব আলু-আলু সুরেলা ভাষায় আমাকে তোল্লা মেরে গাছে তুলে দিলেন, আমিও গ্যাস খেয়ে তরতর করে উঠে গেলাম মগডালে – বসে গেলাম ভাষা নিয়ে লিখতে| এখন কে বাঁচাবে আমাকে? ‘না বাঁচাবে আমায় যদি, মারবে কেন তবে?’ এই যে বললাম – যে কোনও প্রাণীরই ভাষা আছে - যে গাছের মগডালে এই মুহূর্তে বসে আছি, সেই গাছেরও তো প্রাণ আছে – তো, তার ভাষাটা কী? এই যে ছিয়ানব্বই কিলোর একটা মানুষ বা কুমড়োপটাশ বলা নেই কওয়া নেই হুড়মুড় করে মগডাল অবধি উঠে গেলো – গাছ তো একবারও ‘উঃ-আঃ-ওরে বাবারে’ মার্কা কোনও মন্তব্য করে উঠলো বলে শুনলাম না! তর্কের খাতিরে নাহয় ধরে নিলাম, আমি গাছ নই, তাই গাছের ভাষা শুনতে পাইনি| কিন্তু বলেছে নিশ্চয়ই পাশের গাছটার উদ্দেশে| তাহলে পাশের গাছটা অবশ্যই ওই ‘উঃ আঃ ওরে বাবারে’ শুনেছে – তো, শুনে উত্তরে সে কী বললো? ‘নাকিকান্না না কেঁদে কাঁধ ঝেড়ে ফেলে দে না হুমদো ব্যাটাকে’ - বললো? মানে নিজেদের ভাষাতেই বললো নিশ্চয়ই? কিন্তু কোথা থেকে বললো? শুনতে না পাই, কথা চালাচালি যে হলো – বুঝতেও পারলাম না তো! গাছের মুখ কোথায়? চোখ কান কোথায়? নাকি শুধুই শরীরী ভাষায় ওয়াইফাই হোয়াট্‌স্‌আপ - সাঙ্কেতিক কথোপকথন?

ছোটোবেলায় ইশকুলে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে লেখা থাকতো – অমুক সম্পর্কে যাহা জান নিজ ভাষায় বর্ণনা কর – এখনও এইরকম লেখা থাকে কিনা অবশ্য জানিনা – কিন্তু ‘নিজ ভাষায়’ কেন? মানে অতীতে আমার থেকেও কয়েক ডিগ্রি বেশি ফাঁকিবাজ ও দুষ্টুবুদ্ধির কোনও ছাত্র কখনও ১৬ নম্বরের প্রশ্নের উত্তরে ছাগলের ভাষায় একটি ‘ব্যা’ লিখে নম্বর দাবি করেছিলো? নাকি এই বাংলা প্রশ্নের উত্তরে কেউ এর আগে ব্রাহ্মী বা পালি ভাষায় উত্তর লিখেছিলো? তারপর থেকেই এই সাবধানতা? ও গুগুলদাদু, আপনি কি এ সম্পর্কে কিছু জানেন? 

গাছেই যখন তুলে দিলেন সম্পাদিকা, তবে ভাষা প্রসঙ্গেও খানিক গেছো হয়েই থাকি না কেন? তবে, তৎসহ শর্ত জুড়ে দিয়েছেন সম্পাদিকা – নিজভাষায় লিখতে হবে – শর্তটা না থাকলে একটা প্রকাণ্ড ‘ব্যা’ লিখে প্রবন্ধটা স্যাটাস্যাট লিখে হাত ধুয়ে ফেলতে পারতাম, কিন্তু সে গুড়ে বালি| শুনেছি, বহুকাল আগে গাছের ছাল দিয়ে নাকি তৈরি হতো লেখার পাতা| তারও আগে নিশ্চয়ই গাছের গায়েই মানুষ লেখালেখির কাজ করতে অভ্যস্ত ছিলো| জলপাই কাঠের এস্রাজ বাজাতে বাজাতে আধুনিক এক কবি কয়েক দশক আগে ছুরি দিয়ে সব শাল গাছে গাছে তাঁর ইচ্ছে লিখেছিলেন – মানুষকবির সেই খোদিত ইচ্ছের আঘাতে শালগাছেদের রক্তক্ষরণ বা মর্মন্তুদ চীৎকার কোন ভাষায় কিভাবে প্রকাশিত হয়েছিলো – মৃদুল দাশগুপ্ত স্বয়ং সম্ভবত জানেন না| মৃদুলের থেকে বয়সে অগ্রজ এক দাশগুপ্ত কবি মঞ্জুষ অবশ্য বলছেন অন্য কথা – 
          ‘গাছের গায়ে কখনো লিখবোনা
          আমি তোমার নাম
          শব্দবিহীন রক্তপাতে গাছ
          দিতেও পারে গান্ধারীর শাপ’
লক্ষ্য করুন পাঠক, কবি মঞ্জুষ কিন্তু গাছেদের ভাষার অস্তিত্ব সম্পর্কে একেবারে নিঃসন্দেহ – তাঁর একমাত্র আশংকা অভিশাপের ভাষা নিয়ে| গাছের গায়ে নাম লিখলে হয়তো তিনি সে শাপের সম্পর্কে বিষদ শুনতে পেতেন, কিন্তু লিখে উঠতে পারেননি, তাই গাছেদের ভাষা সম্পর্কে জানতেও পারেননি|

জানতে পেরেছিলেন একমাত্র বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু – গাছেরা আঘাত পেলে প্রতিক্রিয়ায় কী বলে, তিনি শুনতে পেয়েছিলেন তাঁর নিজের আবিষ্কৃত ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্র দিয়ে| সে সব তিনি প্রাঞ্জল ভাষায় শিশুদের উপযোগী করে লিখেও গেছেন তাঁর ‘আহত উদ্ভিদ’ ‘গাছের কথা’ সহ বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক রচনায়|
‘গাছের লিখনভঙ্গী ব্যাখ্যা অনেক সময় সাপেক্ষ| তবে উত্তেজিত অবস্থায় সাড়া বড় হয়, বিমর্ষ অবস্থায় সাড়া ছোট হয়, মুমূর্ষু অবস্থায় সাড়া লুপ্তপ্রায় হয়| …এই যে সাড়ালিপি সম্মুখে দেখিতেছেন, তাহা লিখিবার সময় আকাশ ভরিয়া পূর্ণ আলো, বৃক্ষ উৎফুল্ল অবস্থায় ছিল, সেইজন্য সাড়াগুলির পরিমাণ কেমন বৃহৎ| দেখিতে দেখিতে সাড়ার মাত্রা হঠাৎ ছোট হইয়া গেল…বাহিরে আসিয়া দেখিলাম সূর্য্যের সম্মুখে একখানা ক্ষুদ্র মেঘখণ্ড বাতাসে উড়িয়া যাইতেছে…গাছ টের পাইয়াছিল, সে ছোট্ট সাড়া দিয়া তাহার বিমর্ষতা জ্ঞাপন করিল|…যে সকল উদাহরণ দেওয়া গেল,তাহা হইতে বুঝিতে পারিবেন যে, বৃক্ষ লিখিত সাড়ালিপি দ্বারা তাহার জীবনের গুপ্ত ইতিহাস উদ্ধার হইতে পারে।’

হে পাঠক, ক্ষমা করবেন, আমার এই এক দোষ – খেই হারিয়ে আমি মাঝেমাঝেই বড্ডো বাজে কথা বলি| ভুলে গেছিলাম - লিপি নয়, আমার অর্বাচীন বকবকের বিষয় ‘ভাষা’| বৃক্ষের সাড়ালিপি বা তাদের গুপ্ত ইতিহাস – সে সব অন্য প্রসঙ্গ, অন্যত্র সে নিয়ে বকবক করবেন জগদীশচন্দ্রের উত্তরাধিকারী কোনও বিজ্ঞানী বা গবেষক পণ্ডিত – এই মূর্খ রচনা লেখকের কম্মো নয়, সে স্পর্ধাও নেই| আপাতত গাছের মগডালে আছি, আরো কিছু সময় সেখানেই থাকা নিরাপদ| নিচে বন্দুক হাতে সম্পাদিকা দাঁড়িয়ে – ট্রিগারে আঙুল|
       ‘গাছের বিষয়েও
        আমরা বিশেষ কিছুই জানিনা –
        এক একটা গাছের সঙ্গে
        সারাজীবন থেকে যেতে ইচ্ছে করে’
কবি ভাস্কর চক্রবর্তী – কিন্তু ভাস্করদা, সারাজীবন কারুর সঙ্গে থাকতে গেলে তো নিদেনপক্ষে তার সঙ্গে কথাবার্তার সেতুবন্ধনটুকু দরকার, নইলে তো উন্মাদ হয়ে যেতে হয় – যদি গাছের ভাষা বোঝা যেতো, তবে হয়তো আপনার ইচ্ছাপূরণ হতো| তা হয়নি| কারণ, পূরণ হলে নিশ্চয়ই আপনি গাছের সঙ্গে সহবাস করতেন, লিখতেন, আমাদের জানাতেনও| আপনি পারেননি, অথচ বৃদ্ধ গাছদাদুর ভাষা বুঝতে পেরেছিলো মাত্র দেড় বছরের এক সামান্য শিশু – কবি জয় গোস্বামী খুব নিবিষ্ট চিত্তে সে সব দেখেছেন ও ধারাবিবরণীর ঢঙে লিখেওছেন- …রাস্তার ওইপাশের ঢালু দিয়ে
            খোয়া ভর্তি ঝুড়ি মাথায় উঠে আসছে মজুর মেয়ে
            পেছন দিকে ঘুরে ঘুরেই তাকাচ্ছে – যেখানে
            পথের পাশের দেবদারুটি বৃদ্ধ মাতামহ
            দেড় বছরের ছেলেকে তার একটা-দুটো পাতা ফেলে ভুলিয়ে রাখছেন
মাটিতে এলোমেলো ফেলে রাখা দেবদারুপাতারা তাদের ফিসফিস কথা দিয়ে, ওড়াউড়ির ভঙ্গী দিয়ে গল্প করছে দেড় বছরের এক অবোধ শিশুর সাথে - যেমন যাবার বেলায় ‘গোলাপফুল’ কবি অমিতাভ দাশগুপ্তকে গভীর গোপন এমন কিছু কথা বলে গেছে ‘সে সব এতই ব্যক্তিগত, এত মধ্যযামিনী-র, যা প্রেমের চেয়ে বেশি, কবিতার চেয়ে আরও বেশি’| একমাত্র রবীন্দ্রনাথ নিজের কানে শুনেছেন গাছের ভাষা – স্পষ্ট - রীতিমতো নিভৃত কথোপকথনও চালিয়ে গেছেন গাছের সঙ্গে -
‘ওগো বনস্পতি, জন্মমাত্র-ই পৃথিবীতে প্রথম প্রাণ যে আনন্দধ্বনি করে উঠেছিলো, সেই ধ্বনি তোমার শাখায় শাখায় – তার মধ্যে কতো রঙ, কতো গন্ধ,কতো রস… তোমার পাতারা বলছে – প্রাণ যতক্ষণ নেই ততক্ষণ সমস্তই কেবল স্তুপ, সমস্তই শুধু ভার|’

উরিস্যাবাস! বুঝুন, শুধু গাছের পাতাদের পরিষ্কার বাংলায় বলা কথা শুনেছেন, তাই নয়| আবার গাছেদের ধ্বনির রঙ ধ্বনির গন্ধ – ধ্বনির আবার রঙ-গন্ধ -ভাবা যায়? ওঁর গঞ্জিকাসক্তির আশঙ্কা করলে বিলক্ষণ গণধোলাই খাবো – তাই চোখ বুঁজেই বিশ্বাস করে নিলাম যে, উনি সে ধ্বনির রঙ সচক্ষে দেখেছেন, গন্ধ শুঁকেছেন ও আহ্লাদিত হয়েছেন, ভাষার রসপানও করেছেন| কিন্তু কিভাবে? কই,আর কেউ তো এমন করে পায় না! ‘গাছের কথা’ প্রবন্ধে জগদীশচন্দ্র বলেছেন – 

‘…আমাদের খোকা অনেক কথা ফুটিয়া বলেনা; চক্ষু, মুখ ও হাত নাড়া, মাথা নাড়া প্রভৃতির দ্বারা আকার ইঙ্গিতে অনেক কথা কয়, আমরা তাহা বুঝিতে পারি,অন্যে বুঝিতে পারে না| একদিন পার্শ্বের বাড়ী হইতে একটি পায়রা উড়িয়া আসিয়া আমাদের বাড়ীতে বসিয়া গলা ফুলাইয়া উচ্চৈঃস্বরে ডাকিতে লাগিল|পায়রার সঙ্গে খোকার নূতন পরিচয়, খোকা তাহার অনুকরণে ডাকিতে লাগিল|…একদিন বাড়ী আসিয়া দেখি, খোকার বড় জ্বর হইয়াছে; মাথার বেদনায় চক্ষু মুদিয়া বিছানায় পড়িয়া আছে|…আমার হাতের স্পর্শে খোকা আমাকে চিনিল…তারপর পায়রার ডাক ডাকিল| ঐ ডাকের ভিতর আমি অনেক কথা শুনিলাম| বুঝিতে পারিলাম, খোকা বলিতেছে, “…খোকা তোমাকে বড় ভালবাসে”| আরও অনেক কথা বুঝিলাম, যাহা আমিও কোন কথার দ্বারা বুঝাইতে পারি না| যদি বল, পায়রার ডাকের ভিতর এত কথা কী করিয়া শুনিলে? তাহার উত্তর এই – খোকাকে ভালবাসি বলিয়া| তোমরা দেখিয়াছ, ছেলের মুখ দেখিয়া মা বুঝিতে পারেন, ছেলে কী চায়? অনেক সময় কথারও আবশ্যক হয় না| ভালবাসিয়া দেখিলেই অনেক গুণ দেখিতে পাওয়া যায়, অনেক কথা শুনিতে পাওয়া যায়|” 

কবিদের এই এক সুবিধে| স্বভাবপ্রেমিক| জয়ের কবিতার দেড় বছরের ঐ শিশুর মতো কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত বা রবিঠাকুরও জানতেন - গাছকে তেমন তেমন করে ভালোবাসলে তার ভাষা অবশ্যই বোঝা যায়, ভাবের আদানপ্রদান করা যায়|শুধু গাছকে? তা কেন? ভালোবাসা কি এরকম কোনও সীমানা শর্ত মানে নাকি? 

সৃষ্টি যার নাগাল পায়না, বিজ্ঞান যেখানে এখনও পৌঁছতে পারেনি, শুধুমাত্র ভালোবেসেই কবিদের সে সব স্টেশনে অবাধ অনায়াস যাতায়াত – বিনা টিকিটের ডেইলি প্যাসেঞ্জারদের মতো| 
      ‘…সে নদীর দু’দিকে দুটো মুখ
      এক মুখে সে আমাকে
      আসছি বলে
      দাঁড় করিয়ে রেখে
      অন্যমুখে ছুটতে ছুটতে চলে গেল

     আর যেতে যেতে বলে গেল –
     আমি অমনি করেই যাই
     অমনি করেই আসি

     বুঝিয়ে গেল –
     আমি থেকেও নেই
     না থেকেও আছি

     আমার কাঁধের ওপর হাত রাখল সময়
     তারপর কানের কাছে ফিসফিস করে বললে –
     দেখলে? কাণ্ডটা দেখলে?
     আমি কিন্তু কক্ষনো তোমায় ছেড়ে থাকি না|’

কবি সুভাষের নদী ও সময় তো কবির একেবারে চায়ের দোকানের আড্ডাবাজ ইয়ার দোস্ত, শালা মাইরি সম্পর্ক, এবং নিতান্তই পাড়াতুতো বাঙালি আর বাংলা ভাষায় তাদের রীতিমতো দার্শনিকের মতো অসম্ভব গভীর ব্যুৎপত্তি| রবিঠাকুর অবশ্য এ ব্যাপারেও অন্য সব কবিদের থেকে অনেক এগিয়ে – তাঁর এইরকম মহাজাগতিক দোস্তি সম্পর্কে সরাসরি নিজেই কবুল করেছেন – 
     আঁধার বাতায়নে
     একলা আমার কানাকানি
     ঐ আকাশের সনে|
     …আজ আকাশের মনের কথা ঝরোঝরো বাজে 

দোস্তি প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেলো – না পাঠক, এবারে আমি সাবধানী, কথার খেই হারাইনি - রবিঠাকুরের এক স্বনামধন্য দোস্তের নাম উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি –যাঁর ‘টুনটুনির বই’য়ের পাতায় পাতায় টুনটুনিপাখি শেয়াল কুমীর বাঘেরা তাদের নিজ ভাষায় নয়, মানুষের ভাষায় রাজা থেকে চাষী জোলা থেকে পণ্ডিতমশাইয়ের সঙ্গে অনর্গল কথা বলেছে| সুকুমার রায়ের ‘হযবরল’-এ তো ছাগল কাক বেড়াল সজারু প্যাঁচা কুমীরসহ আস্ত চিড়িয়াখানাটাই মানুষের ভাষায় কথাবার্তা বলেছে|অথচ, আমরা মানুষ হয়ে ওদের ভাষায় কথা বলতে পারিনা| ছিঃ ছিঃ - ওরা পারে, আমরা পারিনা – ভাষাতেও ‘আমরা ওরা’ - এই অপমানের লজ্জা মানুষ হিসেবে কোথায় লুকোই?

প্রখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ সি এল বার্বের বলেছেন – It is language that distinguishes man from the rest of the animal world. কী সাঙ্ঘাতিক কথাবার্তা! কী বর্বরোচিত বক্তব্য বার্বের সাহেবের? আমার সঙ্গে শুয়োরের বাচ্চার তফাৎ একমাত্র ভাষায়? ব্যাটা পাগল না পাশবালিশ? যদিও চেহারায় আমিও ছাব্বিশ ইঞ্চি ছাব্বিশ ইঞ্চি ছাব্বিশ ইঞ্চি(স্যরি, ছাব্বিশের জায়গায় ছেচল্লিশ পড়তে হবে, নইলে পিছিয়ে পড়তে হবে) – তবে আমার স্ত্রী অবশ্য এ কথা শুনলে বিলক্ষণ আশ্বস্ত ও উৎফুল্ল হবেন, কারণ, তিনি বার্বেরবিরোধী - তাঁর মতে আমিও নাকি রেগে গেলে ঘোঁৎ ঘোৎ শব্দ করি – ওই ইয়ের বাবাদের মতোই| 

কিন্তু বার্বের সাহেবের ওই কথাটা আরও একটু বোঝা দরকার, মানে জটায়ুর ভাষায় ‘কাল্টিভেট’ করা দরকার – নইলে বাকি জানোয়ারদের থেকে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে সংশয় বিতর্ক থেকেই যাবে, শেষ হবেনা| 

পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে মানুষের ভাষা আর অমানুষের ভাষায় আসমান-জমিন ফারাক| মৌমাছি বা বাঁদরের মতো অমানুষদের ভাষায় ভাব প্রকাশের সম্ভাব্য উপায় বড্ডো কম, মানে গুটিকয়েক – সংখ্যাটা ঠিক কতো, দয়া করে আমাকে না জিজ্ঞেস করে কোনো অমানুষ ভাষাতাত্ত্বিককে ধরুন, তিনি বলে দেবেন|

আমি যেটুকু মোদ্দা জানি, সেটা হলো – মানুষের ভাষাশিক্ষা ঘটে খুব স্বাভাবিক পদ্ধতিতে – যে ভাষা-পরিবেশে সে জন্ম নেয়, বড়ো হয়, শুনতে শুনতে বুঝতে বুঝতে সেই ভাষা সে আপনি আপনি শেখে| মাতৃভাষা| এ অবধি অবশ্য মানুষের সঙ্গে যে কোনও অমানুষ বা জন্তু জানোয়ারের কোনও তফাৎ নেই| কিন্তু মানুষের ভাষায় এই ভাব প্রকাশের উপায় অসংখ্য ও অনন্ত| এবং একমাত্র মানুষই নির্দিষ্ট কয়েকটি বর্ণ বা অক্ষর নিয়ে ভাব প্রকাশের জন্য নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছে -পুরনো শব্দকে ভাঙছে – নিত্য নতুন শব্দ বাক্য প্রতিনিয়ত তৈরি করছে, করেই চলেছে – যেখানে অমানুষেরা – পিঁপড়ে মাছি থেকে হাঙর বাঁদর, গরু, ছাগল থেকে টিকটিকি, কাক – সবার ক্ষেত্রেই – মূলত জীনগত কারণে সীমিত সংখ্যক উচ্চারণের মাধ্যমেই ভাবপ্রকাশ বা পারস্পরিক যোগাযোগ নির্ধারিত| সকলেই অন্যের সঙ্গে মনের ভাব আদানপ্রদান করে গুটিকয়েক সঙ্কেতের মাধ্যমে| ছাগল ভালোবেসেও বলে ‘ব্যা’, রেগে অগ্নিশর্মা হয়েও বলে ‘ব্যা’| মানুষ প্রথমক্ষেত্রে গদগদ সুরে বলবে ‘চুমু খাবো’ আর পরের ক্ষেত্রে চীৎকার করে বলবে ‘প্যাঁদাবো’| একমাত্র মানুষই অনেক ধরণের ভাব প্রকাশের জন্য অনেক রকমের সঙ্কেত এককাট্টা করে ভাষা তৈরি করতে পেরেছে| পেরেছে তার কারণ, মানুষের উন্নততম মগজ – সেই মগজের বাইরের দিকে একটা speech centre বা বাচনকেন্দ্র আছে, যেটা নাকি শুধু মানুষেরই মাথার মধ্যে আছে – যাকে সংগঠিত শব্দনির্মাণ কেন্দ্র বললে বোধহয় ব্যাপারটা বুঝতে সুবিধে হবে| সেইখানে তৈরি হয় শব্দ, তারপর স্নায়ু বেয়ে গলা জিভ মুখগহ্বর ঠোঁট ইত্যাদিতে বিভিন্ন রকম ঠোকাঠূকি খেয়ে মুখ দিয়ে ধ্বনি হয়ে বেরোয়| এখন এই বাচনকেন্দ্রও কিন্তু হঠাৎ একদিন সক্কালসক্কাল আকাশ থেকে টুপ করে মানুষের মাথার মধ্যে এসে ঢুকে পড়েছে, তা মোটেই নয়| এটারও হাজার হাজার বছরের সুদীর্ঘ বিবর্তনের ইতিহাস আছে| মানুষের ভাষার সেই উৎস ও বিবর্তন নিয়ে ভাষাতাত্ত্বিকদের এখনও নিরন্তর গবেষণা চলছে চলবে| 

অন্যান্য প্রাণিদের গোলা মাথায় ওসব বাচনকেন্দ্র-টেন্দ্র নেই, তাই ভাষাও নেহাৎই অজটিল এবং সংক্ষিপ্ত| মানে ওইসব ছাগল-গরু-টিকটিকি-কাকেদের মতো অমানুষদের যেহেতু মানুষের মতো ধুরন্ধর মগজ নেই, তাই ব্যাটারা সহজ সরল, আর তাদের ভাষাও তাই| অবশ্য আর এক ধরণের অমানুষ আছে, যাদের মানুষের মতোই ধুরন্ধর মগজ, কেউ কেউ বলে – সাধারণ মানুষের থেকেও ধুরন্ধরতর – হিংস্র জন্তুদের থেকেও হিংস্রতর - তারাও ‘টুনটুনির বই’য়ের অমানুষদের মতো মানুষের ভাষায় কথা বলে| শুধু তাই নয়, মানুষের শরীর নিয়ে মানুষের সমাজেই তারা মিশে আছে| বোঝার যো নেই| বিজ্ঞানসম্মত ভাষায় তারাও মানুষ| মানুষের মতো তাদের ভাষাও অত্যন্ত জটিল| 

না না, আমি মানুষের অনভিধানিক গালাগালির ভাষার কথা বলছি না| সে তো শুনেই বোঝা যায় অমানুষের ভাষা| ব্যাপারটা অতো অজটিল নয়| এ ভাষা শুধু কানে শুনে বোঝার উপায় নেই| অমানুষের এই ভাষায় যা শুনি পড়ি বা বুঝি,আসল কথাটা ঠিক তা নয়| খুব গোলমেলে| এ ভাষায় লিভারপুল বললে বুঝতে হবে লক্ষ্মীকান্তপুর, রাঁচী শুনলে বুঝতে হবে রামকেষ্টপুর – অনেকটা সেই গেছোদাদার সন্ধানসূত্রের মতো – ‘তুমি যখন যাবে উলুবেড়ে, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, তখন তিনি থাকবেন মতিহারী| যদি মতিহারী যাও, তা’হলে শুনবে তিনি আছেন রামকিষ্টপুর| আবার সেখানে গেলে দেখবে, তিনি গেছেন কাশিমবাজার| ’ভগ্নাংশ বা ত্রৈরাশিকের চেয়েও অনেক জটিল শক্ত অঙ্ক| 

এ ভাষা মানুষরূপী অমানুষদের ভাষা| আপাত নিরামিষ, কিন্তু আসলে এ ধ্বংসের ভাষা, হিংস্রতার ভাষা, শয়তানের ভাষা| যে ভাষায় একজন মানুষ নিজেই নিজেকে ঈশ্বর বলে প্রচার করে অগুনতি মানুষকে অমেরুদণ্ডী নির্বোধ সরীসৃপ বানিয়ে নিজে রাজকীয় ভোগবিলাস লোভ-পাপে মত্ত থাকেন – যে ভাষায় একজন ‘অচ্ছে দিন’এর স্বপ্ন দেখিয়ে তথাকথিত ধর্মের বিকৃত তরোয়ালে মানুষকে কুচিকুচি করে কাটেন – যে ভাষায় একজন মানুষ চীৎকার করে নিজেই নিজেকে সততার প্রতীক বলেন এবং ধর্ষণকাণ্ডের মতো জঘন্য অপরাধীদের আড়াল করে ‘সাজানো ঘটনা’ বলেন, নিজেকে সর্বজ্ঞানী সর্বগুনসম্পন্ন বলে দাবী করে শেক্সপিয়র শেলী কীট্‌স্‌ রবীন্দ্রনাথদের সমসাময়িক বলে প্রকাশ্যে বক্তৃতা করেন – একজন মানুষ যে জনপ্রতিনিধির ভাষায় ধর্ষিতাদের ‘হয় চীৎকার করো, নয় উপভোগ করো’ উপদেশ দেন, আর একজন ‘ঘরে ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে রেপ করে দেবো’ বলে প্রকাশ্য জনসভায় হুঙ্কার দেন - একটা দেশ, যার নিজের বয়স পাঁচশো বছরমাত্র, যে ভাষায় সে নিজেই নিজেকে শ্রেষ্ঠ দেশ ব’লে অন্য দেশের পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতাকে বেমালুম ধ্বংস করে চলে, রক্তের বন্যা বইয়ে গোটা পৃথিবীর কুর্ণিশ আদায় করে নিজেকে শান্তির দূত হিসেবে ঘোষণা করে – সেই উন্নততম প্রাণী বা জানোয়ারের ভাষায় আমরা মানুষেরা নিজেরাই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই করি, নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে চীৎকার করে সমস্বরে কোরাসে ডেকে উঠি – ‘ব্যা’| এ রচনার শুরুতে ‘ব্যা’ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বাংলার প্রচলিত কথাটা ফের মনে পড়ে গেলো – দ্বিতীয়বার লিখতে একটু ‘অম্বিকেশিক’ ভয় কাজ করছে – হে পাঠক, মার্জনা করবেন, যদি কথাটা ভুলে গিয়ে থাকেন, কষ্ট করে শুরুটা আর একবার চুপিচুপি পড়ে নেবেন| সাবধান,কেউ যেন দেখতে না পায়! আর ভুলে না গিয়ে থাকলে, দয়া করে এক্ষুণি ভুলে যান| নইলে আপনার ক্ষেত্রেও ঐ একই বিপদ হতে পারে| 
      তুমুল জমায়েতের মলাটশিখর হয়ে দাঁড়িয়ে
      হলুদ গাঁদার কন্ঠহারশোভিত নেতা-অভিনেতা
      ভিলেন-বধ মুখে ঘোষণা করলেন –
      ‘আমার ছেলেরা সব ঘরে ঘরে ঢুকে……’
      সমবেত সকলের দু’ঠোঁটের সন্ধিমুখে তোপ হর্ষধ্বনি
      ও দু’পায়ের সন্ধিমুখে গোপন শঙ্খধ্বনির
      উন্মাদ সিম্ফনিতে চরাচর ম ম করে উঠলো

      একটু পরে সন্ধ্যে হলেই
      পাড়ার সমস্ত তুলসীমঞ্চে জ্বলে উঠবে
       পোড়ামাটির প্রদীপ নয়,
       পোড়া ঘরের নীল দীর্ঘশ্বাসশিখায়
       সারি সারি মোমবাতি

       দ্বিপদী জন্তুরাই শেষমেশ তবে জিতে যাবে?
       পৃথিবী কি ফের ফিরে যাবে
       নখ-দাঁত আদিম জঙ্গলে?
       হিংস্রতা একমাত্র ভাষা হবে সার্বজনীন?
       শিরদাঁড়া হাড়গুঁড়ো আমাদের সরীসৃপ মুখে গালে
       শুধুমাত্র রেপ-ঋদ্ধ রক্তের সুগন্ধী প্রসাধনী পাউডার? 

       যে মন্ত্রে এই গোধূলিতে শার্দুল থেকে মুষিক হলাম
       সে কি তবে অবধারিত চক্রব্যুহের চিচিংফাঁক?
       আমরা সব অভিমন্যু?
       শান্তিঘুমে উপভোগ্য ট্র্যাজিক হিরোর হাততালি?

       শেষরাত্রে কমণ্ডলু ফের
       উপচে যাক নবতর শব্দ আর অক্ষরগুঁড়োয়
       হাড়মন্ত্র নির্মাণ হোক তাম্রপাত্র হিম অন্ধকারে 

       পুবের আকাশ শিরদাঁড়া টানটান করে
       দুপায়ে দাঁড়িয়ে উঠে
       নতুন ভাষায়
       শুদ্ধ মানুষের স্বরে উচ্চারণ করুক –

       ফের শার্দুল হ

সত্যিই আমরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জানোয়ার! ভাগ্যিস ভাষা বলে একটা ব্যাপার ছিলো, মানে আছে – নইলে অমানুষ জানোয়ারদের থেকে নিজেদের তফাৎ করতে রীতিমতো হিমসিম খেতে হতো| ভাষা না থাকলে নিজেদের অমানুষিক বর্বর জানোয়ারত্বও এতো সহজে দেখা বা দেখানো যেতো কি? ভাষাই অনিবার্য সেই প্রাথমিক অস্ত্র, যাকে হাতিয়ার করে মানুষ এইসব মানুষরূপী অমানুষদের সঙ্গে লড়াই করবে, তাদের সমূলে ধ্বংস করবে – পৃথিবীকে আরো মানবিক ও সুন্দর করে তুলবে|

তুলবেই|
এ দায় মানুষেরই| 

ধন্যবাদ বার্বের সাহেব|

1 comments: