2

ধারাবাহিকঃ সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক


এক কিশোরীর রোজনামচা - ২
সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়


অ্যানির জন্য কয়েকটি কথা

অ্যানির ডাইরি প্রাথমিক ভাবে ওলন্দাজ ভাষায় লেখা হয়েছিল। অ্যানি তার পরিবারের সঙ্গে দুই বছরের অন্তর্লীন কালে এই ডাইরি লেখে। সময়টা ঐতিহাসিক ভাবেও তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৪২ সালে জার্মানি হল্যান্ড দখল করে এবং হল্যান্ডে বসবাসকারী ইহুদীরা তখন জীবনের ভয়ে গুপ্ত জায়গায় আত্মগোপন করতে বাধ্য হয়। অ্যানিও তার পরিবারের সঙ্গে গোপন আস্তানায় লুকিয়ে পড়তে বাধ্য হয়। কিন্তু ১৯৪৪ সালে তাদের পরিবার নাৎসি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যায় এবং তাদের সপরিবারে বারগেন-বেলসেন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে (Bergen-Belsen Concentration Camp) নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই অ্যানি ১৯৪৪ সালে মারা যায়। তার মৃত্যুর কারণ ছিল টাইফয়েডের আক্রমণ। তার মৃত্যুর পর মিয়েপ গিস (Miep Gies) তার ডাইরি উদ্ধার করেন। এবং তিনি তা অ্যানির বাবা ওটো ফ্রাঙ্ককে দেন। আসলে তখন অ্যানিদের পরিবারে একমাত্র ওটো ফ্রাঙ্কই বেঁচে ছিলেন। অ্যানির সঠিক মৃত্যুদিন নিয়ে মতান্তর আছে। তবে অনুমান করা হয় যে অ্যানি ১৯৪৪ সালের একেবারে শেষের দিকে মারা গিয়েছিল। 

অ্যানি তার তেরো বছরের জন্মদিনে তার বাবার কাছ থেকে একটা অটোগ্রাফ নেওয়ার ডাইরি পেয়েছিল। তখনই সে স্থির করে যে ডাইরি লিখবে। অনুমান হল, ১৯৪২ সালের মে-জুন মাসে অ্যানি বাবার সঙ্গে তাদের বাড়ীর কাছের একটা বুক-স্টোরে যায়। আর সেটা দেখেই তার কিশোরী মনে ইচ্ছা জাগে কিছু লেখার। ১৯৪২ সালের ৫ই জুলাই অ্যানির দিদি মারগটকে নাৎসি ক্যাম্প থেকে ডেকে পাঠানো হয়। ঠিক তারপর দিনই অ্যানি ও তার পরিবার আত্মগোপনের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। তাদের সঙ্গে ওটো ফ্রাঙ্কের ব্যবসার অংশীদার হ্যারম্যান ভ্যান পেলস ও যোগ দেন। তিনি ও তাঁর স্ত্রী অগস্তেঁ এবং কিশোর পুত্র পিটারও একসাথেই ছিল। দুটি পরিবার ওটো ফ্রাঙ্কের মূল অফিসের পিছনের দিকের একটি সংযুক্ত পরিত্যক্ত অংশের দোতলায় আত্মগোপন করে। পরিত্যক্ত অংশটি ছিল পিছনের দিকে এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন। তাই জায়গাটা তাদের আত্মগোপনের জন্যে কিছুটা হলেও নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য ছিল। 

কিন্তু ১৯৪৪ সালের অগস্ট মাসে তারা বিশ্বাসঘাতকতার কারণে শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে যায়। এরপর তিন-চার মাসের মধ্যে একে একে দুটি পরিবারের সকলেই মারা যায়। কেবল অ্যানির বাবা ওটো ফ্রাঙ্ক একমাত্র বেঁচে থাকেন। পরবর্তীকালে অ্যানির লাল ডাইরি ছাড়া বেশ কিছু লেখা কাগজ তারা যে সংযুক্ত পরিত্যক্ত অংশে থাকত, সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে থাকা অবস্থায় পাওয়া যায়। এগুলো কুড়িয়ে পায় মিয়েপ গিস এবং বেপ ভসকুল। পরিবার দুটি ধরা পরার পর গেস্টাপো বাহিনী তাদের গোপন আস্তানা বিধ্বস্ত ও তছনছ করার আগেই অ্যানির লেখা পাতাগুলো খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। তাই সেগুলো রক্ষা পেয়ে যায়। 

অ্যানি তার ছোট্ট ডাইরির মধ্যে দিয়ে যেমন নিজের কথা বলে গেছে, তেমনি তারই মধ্যে নির্বাক চোখে আধুনিক পৃথিবীকে জানাতে চেয়েছে স্বাধীনতা হীনতার যন্ত্রণার কথা। মানুষ যে স্বাধীনতার অভাবে জীবনের মূল স্রোতটাকেই উপভোগ করতে পারে না, এ’কথা বোধহয় অ্যানির চেয়ে বেশী কেউ বোঝে নি। মানুষের ধর্ম, বিশ্বাস, বর্ণ, সম্প্রদায়, দেশ, ইত্যাদি অনেক কিছু পৃথক হতে পারে। কিন্তু তার স্বাধীনতার বোধ, প্রয়োজনীতা, এ’গুলি কখনওই আলাদা হতে পারে না। আমরা হয়তো জ্ঞানত জানতেও পারি না, আমাদের চোখের আড়ালে কত মানুষ প্রতি দিন তার কত যন্ত্রণা, কত উদ্বেগ লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হচ্ছে। চোখের সামনে অন্যায়কে দেখেও চুপ করে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। ভোটের রাজনীতিকে সামনে এনে, প্রশাসনের ক্ষমতা হাতে পেয়ে, মানুষের মনুষ্যত্বকে নীরবে গলা টিপে ধরছে। আশা, যদি এ’ভাবেই আরও কিছুদিন শান্তিতে বেঁচে থাকা যায়। এ’কথা ঐতিহাসিকভাবে সত্য, যে, হিটলারও ছিলেন একজন নির্বাচিত “জন প্রতিনিধি”। 

ওপরের ছবিটা দেখলে মনে হয়, কিশোরী মেয়েটি কত’ই না সুখী ছিল। কিন্তু সত্যিই কি ছিল? তার লেখা পড়লে মনে হবে, সে তার বাবা মা বা পরিবারের ভয়ঙ্কর অবস্থা সম্পর্কে আদৌ ওয়াকিবহাল ছিল না। এক বাচাল স্বার্থপরের মতো সে কেবল মাত্র তার নিজের কথা, তার চারপাশের কিছু পরিবারের কথা বলে গেছে। কিন্তু আমরা কি একবারও ভাবার চেষ্টা করেছি, মানুষগুলো কিভাবে তাদের বাস্তব অবস্থাকে ভোলার জন্য অন্য অনেকের কথা ভাবার ছল করে চলেছে! তার আশা কেবল বেঁচে থাকা, আর কিছুই নয়। 

অ্যানি ও তার পরিবারের গোপন আস্তানার ভিতরের ছবি।

নীচের ছবিটা হল সেই বাড়ীর ছবি, যেখানে অ্যানি তার পরিবারের সঙ্গে লুকিয়ে ছিল। এখানেই সে তার পরিবারের সাথে দীর্ঘ প্রায় দু-বছর কাটিয়েছিল। নাৎসি বাহিনী অ্যানি ও তার পরিবারকে এই গোপন আস্তানা থেকে গ্রেপ্তার করার পর নাৎসি কম্যান্ডার অন্ধকারাচ্ছন্ন এই সংযুক্ত অংশটাকে খালি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পরবর্তী সময়ে মিত্র বাহিনী নাৎসিদের হাত থেকে হল্যান্ডকে মুক্ত করার পর, এই সংযুক্ত গোপন অংশটাকে জার্মানির তথা নাৎসিদের অত্যাচারের সাক্ষী হিসাবে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য মিউজিয়াম হিসাবে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তাছাড়াও অটো ফ্রাঙ্ক, অ্যানির বাবা, চেয়েছিলেন, এটা খালি রাখতে এবং ইতিহাসের সাক্ষী হিসাবে, এটাকে মিউজিয়াম হিসাবে সংরক্ষণ করতে। তাঁর মতে একমাত্র শূন্যতা এবং অনধিগ্রহণের মধ্যে দিয়েই, তাঁর পরিবারের সেই নির্মম একাকীত্বের যন্ত্রণাকে উপযুক্তভাবে স্মরণ করা যেতে পারে। এই অনধিগ্রহণ ও শূন্যতার মধ্যেই ইতিহাসে বেঁচে থাকবে সেই সব মানুষ, যাদের একদিন শুধুমাত্র ইহুদী হওয়ার কারণে বিতাড়িত করা হয়েছিল, আর তাদের মধ্যেই বহু মানুষ আছেন যাঁরা আর কোনওদিন ফিরে আসেন নি। 

ছবির বাঁ দিকের ঘরটিতে থাকতেন অ্যানির বাবা, মা, আর তার দিদি, মারগট। আর ডান দিকের ঘরটাতে থাকত অ্যানি আর তার বন্ধু ফ্রিটজ ফেফ্রার (Fitz Pfeffer)। 



2 comments:

  1. বেশ ভাল লাগলো। পরের লেখার অপেক্ষাতে থাকলাম।

    ReplyDelete
  2. দুটি প্রবন্ধ একসাথে ক্রমানুযায়ী পড়লাম। ইংরেজি সংস্করণটি আগে কিছুটা পড়েছি। এখন নিজের মাতৃভাষাতে পড়তে খুব ভালো লাগছে। পরবর্তী প্রবন্ধের অপেক্ষায় রইলাম। ধন্যবাদ।

    প্রথম প্রবন্ধ(অন্যান্য পাঠকদের জন্য): http://rritobak.blogspot.in/2016/01/blog-post_76.html

    ReplyDelete